#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৪১
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি
পরদিন ,,
মুখরদের পরিবারের যাওয়ার কথা থাকলেও শেখ শাহেনশাহ কাউকে যেতে দেয় নি। তার বাড়ি এখন মেহমান দিয়ে ভর্তি। আজ বাড়িতে পিঠেপুলির উৎসব রেখেছে শেখ শাহেনশাহ। তাই সবাই আজ ও রয়েছে। সন্ধ্যার ট্রেন এ সবাই চলে যাবে। সবাই সকালের খাবার খেতে বসেছে তখন আরবাজ এলো। আরবাজের চোখমুখ দেখে মিশু বলল,,
“বাজপাখি তোমার চোখমুখ এমন লাগছে কেন?”
আরবাজ মুচকি হেসে বলল,,
“নিজের জন্যই নিজের এই অবস্থা।”
তখন নাফিয়া বলল,,
‘মানে কিছু হয়েছে?”
“কাল রাতে একদম ঘুম হয় নি। একটা জানালা খোলা রেখেছিলাম সেটা দিয়ে ঝিঁঝিঁ পোকা ঢুকেছিল ঘরে বারবার একই আওয়াজ করছিল। আমি উঠে খুঁজেও পাচ্ছিলাম না। তাই না ঘুমানোর জন্য এই অবস্থা।”
আরবাজের কথা শুনে আর কেউ কিছু বললো না। সবাই খাওয়া শুরু করবে। তখন শেখ শাহনাওয়াজ এর ফোনটা বেজে উঠলো তিনি দেখলেন মেহবিন ফোন করেছে। তিনি তাড়াতাড়ি করে ধরলেন মেহবিন বলল,,
‘একটু বাইরে আসুন দরকার আছে।”
তিনি খাবার না খেয়ে সবাইকে খেতে বলে উঠে তাড়াতাড়ি করে বাইরে এলেন। বাইরে এসেই দেখলেন মেহবিন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। তিনি গিয়ে বললেন,,
“কিছু হয়েছে?”
“হুম আমার দুই লাখ টাকা ক্যাশ লাগবে বিকেলেই দিয়ে দেব। খুব জরুরী হাসপাতালে দিতে হবে নাহলে চাইতাম না এখন চেক ভাঙানোর সময় নেই। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আমার কথাও শুনছিল না তারা বলেছে না হলেও অপারেশন এর আগে আশি হাজার দিতে হবে। যার জন্য একজনের অপারেশন ও করতে সমস্যা করছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে কিছু না করতে পারলে তাকে বাঁচাতে পারবো না। যার জন্য আমি বলে এসেছি তার অপারেশন করতে আমি এক ঘন্টার মধ্যে পুরো টাকা জোগাড় করে নিয়ে যাবো। পরের ওষুধ পত্র আর বাকি টাকাও তো দিতে হবে তাই একেবারে দুই লাখ নিয়ে যাচ্ছি। আপনার কাছে তো সবসময় ক্যাশ থাকে।তাই এসেছি।”
‘হুম আমিও জানি আপনি খুব প্রয়োজন না হলে আমার কাছে আসবেন না। তারওপর সেদিন যা হলো আপনি তো আমার ত্রিসীমানায় ও আসবেন না বলেছিলেন। তবুও আল্লাহ তায়ালা চায় আমরা একসাথে থাকি তাই একটা না একটা অলৌকিক ঘটিয়েই দিলেন আলহামদুলিল্লাহ।”
‘এসব রাখুন এখন টাকাগুলো দিন।”
‘হুম আমি এখনি নিয়ে আসছি।”
শেখ শাহনাওয়াজ তাড়াতাড়ি করে নিজের ঘরে গেলেন তারপর একটা ব্যাগে ভরে দুই লাখ টাকা নিয়ে এলেন। মেহবিন টাকাটা নিয়ে বলল,,
‘শুকরিয়া আপনাকে আসছি।”
“লোকটা কে? যার অপারেশন এর জন্য টাকা লাগবে?”
‘লোকটা কুদ্দুস আপনার বাড়িতে কাজ করে। ছেলের এঙ্গেজমেন্ট এর অনুষ্ঠানে এতটাই ব্যস্ত হয়ে পরেছেন যে বাড়ির কাজের লোককে কেউ কয়েক ঘা ছুরি বসিয়ে কিছু জায়গায় জঘম করে মেরে ফেলতে চাইছিল সেটা টেরই পান নি।”
“কি কুদ্দুস এখন হাসপাতালে?”
“হুম সকাল বেলা আমার বাড়ির সামনের পাকা রাস্তায় পরেছিল। কেউ দেখে আমাকে জানায় প্রথমে ভেবেছিলাম মারা গেছে পরে দেখি হালকা হালকা পাল্স চলছে। ব্যাপারটা বেশি কেউ জানে না খুব সকালে ছিল তাই কয়েকজন ওখানে ছিল তাদের সবাইকেই বলেছি কাউকে না বলতে। প্রথমে রাজি না হলেও পরে বলেছি ওকে কেউ মারতে চাইছিল মেরে ফেলতে পারে পরে কথাটা শুনেই সবাই রাজি হয়েছে। আমি হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলাম ওখানে ডাক্তার ছিল তিনি বলেছেন খুব তাড়াতাড়ি অপারেশন করতে হবে। কিন্তু টাকা জমা না দিতে পারলে নাকি করবেন না। কারন অপারেশন এর জন্য এটা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের একটা রুলস উনি কিছু করতে পারবেন না। আমি বলেছি তার টাকা আমি আনছি এক এক ঘন্টার মধ্যে আপনারা ওনার অপারেশন শুরু করুন। আমার এক ঘন্টার মধ্যে টাকা দেওয়ার কথা বলায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রাজি হয়েছে এতো সকালে ব্যাংক খোলা থাকবে না আর ব্যাংক আশেপাশেও নেই তাই বাধ্য হয়ে এখানে আসা।”
“তারমানে এখন কুদ্দুস?”
“তার অপারেশন শুরু হয়ে গেছে। চিন্তা করবেন না তবে হ্যা এটা কিন্তু নিশাচর এর একটা কাজ। এখন কুদ্দুস এর মাধ্যমে আমরা আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো । আমি যদি ভুল না হই তাহলে কুদ্দুস নিশাচর কে দেখে ফেলেছে। এই জন্যই ওর এই অবস্থা। বাড়ির কাউকে কুদ্দুস এর ব্যাপারটা জানাবেন না আপনি। আর এমন ভাব করবেন আপনিও কিছু জানেন না।”
‘হুম! আমি হাসপাতালে আসছি।
‘ ভুলেও এখন এই বোকামী করবেন না। আমি দেখে নেব ফোনে তার আপডেট দেব। আসছি আর হ্যা বিকেলে আমি নিজেই আসবো টাকাটা ফেরত দিতে।’
“আপনার টাকা ফেরত দিতে হবে না।”
‘আপনি আমায় ভালোভাবেই চেনেন তাই কথা বলে লাভ নেই।”
বলেই মেহবিন চলে গেল। এখনো অনেকটা সময় আছে তাই পুরো ব্যাপারটা বলে গেল তাকে। শেখ শাহনাওয়াজ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তিনি বাড়ির ভেতর ঢুকতেই আরিফা জামান বললেন,,
“এতো সকালে এতোগুলো টাকা নিয়ে কোথায় গিয়েছিলেন?”
হুট করে প্রশ্নটা করায় তিনি একটু চমকালেও পরে নিজেকে ধাতস্থ করে বললেন,,
‘তুমি দেখেছো আমি টাকা নিয়েছি। আমার সবকিছু নজরে রাখো তুমি।”
‘না ব্যাপারটা তেমন নয় আপনাকে ঘরে যেতে দেখে আমিও গিয়েছিলাম তখনি দেখেছিলাম। এতোগুলো টাকা লাখ খানেক তো হবেই। ”
তখন পেছন থেকে সায়িদ বলল,,
‘আমি তো কাকাকে দেখলাম ডক্টর মেহবিন কে একটা ব্যাগ দিতে। ব্যাগের মধ্যে টাকা ছিল বুঝি।”
ব্যস হয়ে গেল। শেখ শাহনাওয়াজ সায়িদের দিকে তাকালেন। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,,
“সবার প্রশ্নের আগে আমিই জবাব দিচ্ছি। একটা ইমার্জেন্সি কাজে ডাক্তারের দুই লাখ টাকার প্রয়োজন ছিল। তাই তিনি আমার থেকে ধার নিলেন বিকেলেই ফেরত দিয়ে যাবেন।”
কথাটা শুনে সবাই অবাক হয়ে গেল। বাদ যায়নি মুখরের পরিবার তারাও অবাক হয়ে গেছে। হুট করে তখন শেখ আমজাদ বললেন,,
“ভাইয়া তুমি এক কথায়ই মেয়েটাকে দুই লাখ টাকা দিয়ে দিলে। এটা কিরকম কথা যদি,,
তখন শেখ শাহনাওয়াজ তাকে না বলতে দিয়ে বললেন,,
‘মানুষ চেনার ক্ষমতা আমার আছে। সে তো বলেছে বিকেলে দিয়ে দেবে আগে বিকেল হোক তারপর না হয় কথাগুলো বলিস। আগেই এই অহেতুক কথা বলে লাভ নেই। তাছাড়া কারো সম্পর্কে না জেনে কথাও বলতে নেই। বিকেলের আগে তার সম্পর্কে আমি কোন কথাই শুনছি না।”
তখন শেখ শাহেনশাহ বললেন,,
“দুদিন আগেও যে তোর পোলারে বিনা কারনে মারলো। তারে তুই টাহা দিয়া সাহায্য করতাছোস শাহ কিরম বাপ তুই।”
শেখ শাহনাওয়াজ মুচকি হেসে বললেন,,
“সত্যিই বাবা কিরকম বাপ আমি। আমার সন্তান আঘাত পায় কারো দ্বারা তবুও আমি কিছু করতে পারিনি।”
বলেই তিনি চলে গেলেন নিজের ঘরে এদিকে ওনার কথার মনে কেউ বুঝতেই পারলো না। আরবাজ আর মিশু ছাড়া। দুপুরে মেহবিন শেখ শাহনাওয়াজ কে ফোন করে জানালো অপারেশন সাকসেসফুল। তবে অবস্থা খুব একটা ভালো না তবুও আশা আছে সুস্থ হয়ে উঠবে। সব শুনে শেখ শাহনাওয়াজ একটু স্বস্তি পেলেন। শেখ শাহনাওয়াজ কাউকেই কিছু বললেন না সকালের দিকে আরিফা জামান খোঁজ করেছিল ওনার উনি বলেছেন ও নাকি ছুটিতে গেছে। এই নিয়ে আরিফা জামান রাগারাগী করলেও শেখ শাহনাওয়াজ একটা টু শব্দ ও করেন নি। বিকেল সাড়ে চারটা সকলে মেহবিনের বিষয় নিয়েই কথা বলছে। মুখরের পরিবার সবাই মুখরকে জিজ্ঞেস করেছিল কিসের জন্য মেহবিন টাকা নিয়েছে মুখর জানিয়েছে সে কিছু জানে না। তারা আজ সন্ধ্যায় বাড়ি চলে যাবে শেখ শাহেনশাহ তাদের কথা শুনে আজ আর না করেনি। বিকেলে সবাই ড্রয়িংরুমে কথা বলছিল হুট করে শেখ শাহেনশাহ বললেন,,
“কিরে শাহ বিকাল তো হইয়া আইলো কো তোর ডাক্তার কো?”
তখন পেছন থেকে আওয়াজ আসলো,,
“সাবেক চেয়ারম্যান সাহেব শেখ শাহেনশাহ আমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে হচ্ছিল বুঝি। হুট করে আমার খোঁজ নেওয়া হচ্ছে দেখি।”
মেহবিনের কথায় সকলেই পেছনে তাকায়। মেহবিন মুচকি হেঁসে দাঁড়িয়ে আছে। হাতের ব্যান্ডেজটা নেই খুলে রেখে এসেছে। তাই হাতের দিকে তেমন কারো নজর পরলো না। মেহবিন কে দেখে শেখ শাহেনশাহ বললেন,,
“আসলে,”
“আসলে নকলে ছাড়ুন চেয়ারম্যান সাহেব এদিকে আসুন তো!”
শেখ শাহনাওয়াজ উঠে মেহবিনের সামনে এলেন মেহবিন টাকাগুলো ব্যাগ থেকে বের করে উনার দিকে এগিয়ে দিলেন। তখন শেখ আমজাদ বলল,,
“ভাইয়া ভালো করে গুনে নাও।”
শেখ শাহনাওয়াজ মুচকি হেসে বললেন,,
“আমি যখন টাকা ওনাকে দিয়েছিলাম তখন উনি গুনে নেয় নি। তাহলে আমার ও দরকার নেই গুনার। তাছাড়া আমি ওনাকে বিশ্বাস করি।”
তখন মিশু এসে বলল,,
“ফুল তুই আমার সাথে আয়?”
মিশুর আগমনে টাকার টপিক ঢাকা পরে গেল। মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,
“কোথায় যাবো?”
“তুই জানিস আমি পিঠে বানিয়েছি। তোর জন্য নিয়ে যেতাম কিন্তু তুই আমাদের বাড়িতে এলি।”
তখন মুনিয়া বলল,,
“মেহবিন আপু মিশু আপু সত্যি পিঠা বানিয়েছে। তবে সেগুলো তুমি খেতে পারবে কিনা জানা নেই।”
“একদম আমার পিঠে নিয়ে কিছু বলবি না মুনিয়া। ফুল তুই খাবি না চল না একটু টেস্ট করে দ্যাখ কেমন হয়েছে। তুই জানিস আমার পিঠে দেখে কেউ টেস্ট ও করেনি। শুধু বাজপাখি ছাড়া কিন্তু বাজপাখি তো কিছু বললোই না।”
তখন নিসা বলল,,
“আরবাজ ভাইয়ার তোমার পিঠে খেয়ে মুখ বন্ধ হয়ে গেছে তাই কিছু বলে নি।”
মিশু একটা ইনোসেন্ট ফেস করে মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“ফুল তুই খাবি না।”
মেহবিন একবার সবার দিকে তাকালো তারপর মিশুর দিকে ও বুঝতে পারলো মিশু ইচ্ছে করে এসব করছে ওকে খাওয়ানোর জন্য। যাতে ও খায় এই জন্য নিজে বানিয়েছে। মেহবিন মনে মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। তারপর কিছু বলবে এমন সময় তখন আরিফা জামান বললেন,,
“আজ পর্যন্ত এই বাড়িতে তোমার ফুল কিছু খেয়েছে যে আজ খাবে? তুমি বানালেই কি আর না বানালেই কি?
এই কথা শুনে মিশু কোমরে হাত দিয়ে বলল,,
“এতোদিন না খেলে কি হবে। আজ তো ওর ফুল ওর জন্য পিঠে বানিয়েছে ও নিশ্চয়ই খাবে। তাই না ফুল? আর ফুল যদি না খায় তাহলে আমিও খাবো না।
বলেই মিশু দাঁত কেলালো। মেহবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,
“ঠিক আছে খাবো তবে অল্প।
মিশু ইয়াহু বলে লাফিয়ে উঠলো। মিশু ওর হাত ধরে ড্রাইনিং টেবিলে বসালো । মিশু কিচেন থেকে পাটিসাপটা আর ভাপাপিঠা নিয়ে এলো। এই দুটোই মিশু বানিয়েছে। তবে একটার চেহারাও সঠিক হয়নি। মেহবিন একবার পিঠার দিকে তাকালো আবার মিশুর দিকে। মিশু ওর চোখের ভাষা বুঝতে পেরে একটা পাটিসপটা ধরে মুখে পুরে দিল। মেহবিন কামর দিল ও বুঝতে পারলো চেহারা ভালো না হলে কি হবে স্বাদ ঠিকই আছে। অন্যদের পারেনা দেখানোর জন্য চেহারা এরকম। মেহবিন বলল,,
“ভালো হয়েছে ফুল বাকিটা আমি নিজেই খেতে পারবো। আচ্ছা ফুল রাইফা উনি কোথায় আসার পর তো দেখলাম না।”
“রাইফার শরীরটা বেশি ভালো না তাই ঘরেই আছে।”
“ওহ আচ্ছা।”
তখন মুনিয়া বলল,,
“মেহবিন আপু বলো তো কেমন খেতে? না মানে আমরাও একটু টেস্ট করতাম।”
মেহবিন মিশুর দিকে তাকিয়ে বলল,,
“তোমরা না খেলে দারুন কিছু মিস করবে মুনিয়া।”
“তাই নাকি তাহলে তো টেস্ট করতেই হয়।”
বলেই মুনিয়া এলো একটা পাটিসাপটা মুখে দিয়ে বলল,,
“মেহবিন আপু সত্যি বলেছো তুমি। এটা তো মা কাকিদের থেকেও বেশি মজার হয়েছে।”
মিশু হাসলো । তখন মেহবিন বলল,,
“এই যে মিশুর বাজপাখি মিশুকে বলেন নি কেন? তার পিঠে এতো মজা হয়েছে।”
হুট করে আরবাজকে ডাকায় আরবাজ হকচকিয়ে উঠলো। ও মেহবিনের দিকে তাকালো। ওর চোখ ছলছল করে উঠলো তবুও নিজেকে স্বাভাবিক করে হাঁসি ফুটিয়ে বলল,,
“এতো মজার হয়েছে যে আমি কোন কথাই বলতে পারলাম না। তাই তো কিছু বলিনি।”
মেহবিন কিছু বললো না শুধু হাসলো। তারপর ভাপাপিঠা একটু নিয়ে খেলা খেতেই ও বুঝতে পারলো ছোটবেলায় যেমনটা খেতে চাইতো বেশি নারকেল দিয়ে তেমনটাই বানিয়েছে মিশু।ও মিশুর দিকে তাকালো মিশু হেঁসে বলল,,
“পছন্দ হয়েছে ফুল।”
“হুম।”
বলেই মেহবিন খেতে লাগলো। শেখ শাহনাওয়াজ এর মুখে তৃপ্তির হাঁসি। তখনি মেহবিনের ফোন এলো আননোন নাম্বার থেকে। মেহবিন ফোন উঠাবে তখন মিশু বলল উঠাতে হবে না। মেহবিন বলল ইমার্জেন্সি কিছু হতে পারে। মিশু বলল ও খেতে থাক স্পিকারে দিলেই তো হয়। মেহবিন তাই করলো ফোন ধরে কিছু বলবে তার আগে ওপাশ থেকে বললো,,
“কেউ একজন বলেছিল ‘যদি একশো বছর পরেও তুই আমার কাছে আসিস আর আমি যদি বেঁচে থাকি তাহলেও সব ছেড়েছুড়ে আমি তোকে আগলে নেব।”
কথাটা শুনে মেহবিনের খাওয়া থেমে যায়। ও তাড়াতাড়ি ফোন নিয়ে বলল,,
‘রাই!”
তাড়াতাড়ি করতে গিয়ে হাতে ব্যাথা পেল তবুও একটা টু শব্দ করলো না। শেখ বাড়ির সবাই ভাবলো হয়তো ইন্ডিয়ার রাই। মেহবিন স্পিকার অফ করে দিল। তারপর বলল,,
‘রাই!”
‘কতো বছর পর এই নামটা তোর মুখ থেকে শুনতে পেলাম। জানিস আমার সবসময় মনে হতো আমি মরার আগে তোর সাথে দেখা করতে পারবো না। কিন্তু ভাবিই নি আল্লাহ তায়ালা আমাকে এতো বড় উপহার দিয়ে দেবে। তুই জানিস আমি না তোকে খুব মিস করি। শুধু মনে হয় তুই থাকলে আমার সাথে এসব হতো না। সবসময় কার মতো আমার মেহু আমার জীবনের সব সমস্যা সল্ভ করে দিতো। আমি ভালো নেই মেহু? তোর রাই কতোদিন হলো মনখুলে হাসে না। ওরা তোর রাইয়ের মুখের হাঁসি কেড়ে নিয়েছে? আর এখন তো তোর রাইকেও।
মেহবিন উত্তেজিত হয়ে দাঁড়িয়ে বলল,,
“কি হয়েছে তোর? কোথায় তুই?”
রাই কাঁশতে লাগলো আর তারপর বড় বড় শ্বাস নিয়ে বলল,,
“আমার না খুব কষ্ট হচ্ছে মেহু। মনে হচ্ছে আমি মারা যাবো মেহু। তবে শেষবার তোকে ভিশন দেখতে ইচ্ছে করছে। আমি তোকে ভিশন ভালোবাসি মেহু। তোর সাথে যা করেছি তার জন্য আমাকে মাফ করে দিস মেহু। আমি তোকে খুব ভালোবাসি।
“কিছু হবে না তোর আমি এখনি আসছি।”
বলেই মেহবিন দৌড় দিয়ে সিঁড়ি উঠতে লাগলো। সবাই প্রথমে অবাক হলেও ওকে উঠতে দেখে সবাই ওর পেছনে গেল। মেহবিন ঘরে ঢুকেই দেখতে পেল রাইফা বড় বড় করে শ্বাস নিচ্ছে আর বিছানায় ছটফট করছে । মেহবিন জোরে “রাই” বলে ওকে জরিয়ে ধরলো। ওর হাতের অবস্থা খারাপ তবুও ওর নিজের দিকে খেয়াল নেই। ওকে দেখেই রাই ওকে আঁকড়ে ধরলো। ও বড় বড় শ্বাস নিচ্ছে তা দেখে মেহবিন ওকে কোলে তুলে নিল। রোগা পাতলা শরীরকে ওঠাতে ওর কোন সমস্যা হলো না। সবাই ঘরে ঢুকবে এমন সময় সবাই দেখলো মেহবিন ও ওকে কোলে নিয়ে বের হচ্ছে আর একটা কথা বলছে,,
“তোর কিছু হবে না রাই। তোর মেহু আছে সবসময়কার মতো এইবার ও সব ঠিক করে দেবে। তোর মেহু তোকে কিছু হতে দেবে না।”
মেহবিন কারো দিকে না তাকিয়ে কষ্ট হলেও সিঁড়ি বেয়ে নেমে এলো। ওকে রাইফাকে কোলে নিতে দেখে সবাই চমকে উঠলো। মেহবিন বলল,,
” প্লিজ কেউ গাড়ি বের করুন। রাইকে এখনি হাসপাতালে নিতে হবে।”
রাইকে মেহবিনের কোলে দেখেই আরবাজ আর মুখর গাড়ি বের করেছে। মেহবিন কারো তোয়াক্কা না করে ওকে নিয়ে গাড়িতে উঠলো। ওর সাথে মিশু মুনিয়া ওরা দুজন ও উঠলো। গাড়ি গেল হাসপাতালের উদ্দেশ্যে। বাকিরা তব্দা মেরে দাঁড়িয়ে রইল সবথেকে বেশি সায়িদ। শেখ শাহনাওয়াজ সায়িদ কে রওনা দিলেন অন্য গাড়ি করে। মেহবিন শক্ত করে রাইফাকে জরিয়ে ধরলো। রাইফাও মেহবিনের কোলে গটিশুটি মেরে রইলো শ্বাসকষ্ট অনেকটাই কমেছে। তবে রাস্তাতেই রাইফা অজ্ঞান হয়ে গেল। মেহবিন হাসপাতালে গিয়েই রাইফার চিকিৎসা শুরু করলো। হাতের অবস্থা ভালো নয় তাই একটা কাপড় পেঁচিয়ে নিল। সবকিছু এখন নরমাল মেহবিন কিছু রিপোর্ট করতে দিল ওগুলো আসলেই কিছু বলতে পারবে। মেহবিন বের হলো ও বেরুতেই দেখলো পুরো শেখ পরিবার দাঁড়িয়ে আছে সেই সাথে মুখরদের পরিবার ও শুধু বাদ আছিয়া খাতুন মিসেস আছলাম আর শেখ শাহেনশাহ আর আরিফ জামানের পরিবার। মেহবিন সবাইকে সাইড করে চলে আসতে নিল তখন সায়িদ বলল,,
“কি হয়েছে রাইফার?”
মেহবিন শান্ত স্বরে বলল,,
‘আপতত অজ্ঞান হয়েছে আর কিছু না।”
‘আমরা রাইফাকে এই সরকারি হাসপাতালে রাখবো না। আমাদের হাসপাতালে নিয়ে যাবো।”
‘রাইকে এখানে আমি এনেছি। আমি বুঝবো আমার রাইকে কোথায় কিভাবে ট্রিটমেন্ট করতে হবে।”
“তোমার রাই?”
“হ্যা আমার রাই। আমার বেস্ট ফ্রেন্ড আমার রাই। এখানে কি করতে এসেছেন আপনারা এতোদিন তো আপনাদের বাড়ি ছিল দুদিন অজ্ঞান ও হয়ে গিয়েছিল। একটা ডক্টর দেখাতে পারলেন না আপনারা কেউ। আর এখন এসেছেন আদিখ্যেতা দেখাতে। কি দেখতে এসেছেন ও মারা গেছে কি না।”
‘আপনি এভাবে আমার সাথে কথা বলছেন কেন? আমি তো বলেছিলাম ওকে যেতে ও যায় নি।”
‘শুধু বললেই সব দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না করে দেখাতে হয়। আপনারা এখান থেকে চলে যান রাইয়ের জন্য যা ভালো হয় সেটা আমি দেখে নেব। ওর জন্য এখানে কারো থাকার দরকার নেই।”
তখন শেখ আমজাদ বললেন,,
“তুমি বোধহয় ভুলে যাচ্ছো আমরাও ডাক্তার?”
“এরকম ডাক্তার হয়ে কি লাভ যদি নিজেদের লোকের কাজেই না আসে। আমি আপনাদের এতো কথা বলছি কেন? আমার তো আপনাদের ওপর কোন দায় নেই।”
বলেই মেহবিন ওখান থেকে আসতে নিল তখন মুখর বলল,,
“আপনার হাত থেকে রক্ত পরছে ?”
মেহবিন মুখরের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“এসব তো কিছুই নয় তবে,,
এইটুকু বলে ও নিজের কেবিনে চলে গেল। মেহবিন কেবিনে গিয়ে ওর টেবিলে রাখা সবকিছু ফেলে দিল। ওর ভিশন রাগ হচ্ছে কিন্তু কার ওপর শেখ পরিবারের ওপর নাকি রাইফার ওপর নাকি নিজের ওপর। ও চেয়ারে বসে মাথা ধরে পুরোনো কিছু স্মৃতি মনে করতে লাগলো।
অতীত,,
আলম আহমেদ মেহবিন কে নতুন স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছে। মেহবিন কোন বাচ্চার মিশতো না। একা একা থাকতো কারো সাথে কথা বলতো না। এভাবেই ক্লাস টু থেকে ক্লাস থ্রি তে উঠলো। হুট করে একদিন একটা মেয়ে বলল,,
“এই তুমি কথা বলতে পারো না?”
মেহবিন কিছু লিখছিলো কারো কথায় ও মাথা তুলে তার দিকে তাকালো। মেহবিন কিছু বলছে না দেখে মেয়েটা আবার বলল,,
“সত্যি তুমি কথা বলতে পারো না।”
মেহবিন এবার বলল,,
“পারি!”
“তাহলে কথা বলো না কেন?”
‘এমনি।”
“আমার নাম রাইফা আফনূর। তুমি আমার বন্ধু হবে। আমি না চকলেট খেতে খুব ভালোবাসি তোমায় চকলেট দেব।”
“লাগবে না।”
“হবে না আমার বন্ধু?”
“না।”
“কেন হবে না?”
“এমনিই!”
রাইফা উদাস হয়ে চলে গেল। নিজের বেঞ্চ এ বসলো তখন দুজন বাচ্চা রাইফাকে মারতে লাগলো কারন ওরা রাইফার কালারিং কলম চেয়েছিল কিন্তু ও দেয় নি। মেহবিন তা দেখে ওখানে গিয়ে ঐ দুটো বাচ্চাকে সরিয়ে দিল। আবার এগুতে এলে ও বলল ওকে যদি মারে নাহলে ম্যাডামের কাছে বিচার দেবে। বাচ্চা দুটো ভয় পেয়ে ওখান থেকে চলে গেল। তারপর মেহবিন বলল,,
“তুমি এতো বোকা কেন? তোমাকে মারছিল আর তুমি কিছু না করে মার খাচ্ছিলে?”
রাইফা বলল,,
‘আমি তো মারতে পারি না। এই তুমি আমার বন্ধু হয়ে যাও না। তাহলে ওরা আমাকে আর মারবে না শুধু ওরা না তুমি থাকলে কেউ কিছু বলতে পারবে না। তোমার অনেক বুদ্ধি তাই তো ম্যাডামের কাছে বিচার দেওয়ার কথা বলে ওদের ভাগিয়ে দিলে।”
মেহবিন কিছু না বলে ওখান থেকে চলে গেল। সেদিনের পর রাইফা মেহবিনের পেছনে পরলো প্রতিদিন এসে ওর সাথে বসতো অনেক কথা বলতো । প্রায় দুই মাস পর রাইফা মেহবিনের বন্ধু হতে পারলো। এরপর থেকেই শুরু হয় রাইফা আর মেহবিনের বন্ধুত্ব। সময়ের সাথে ওরা হয়ে ওঠে একে অপরের বেস্ট ফ্রেন্ড। তাদের জোরা কবুতর বলে সব স্যার ম্যাডামরা ডাকতেন। ওদের দুজনকে সবাই ওদের বন্ধুত্বের জন্য চিনতো। ক্লাস টেন এ উঠার পর এই জোরা কবুতরের মধ্যে এক কাউয়া আসে নাম তার সাগরিকা।
~চলবে,,
#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৪২
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি
“এই তোমরা দুজন তো অনেক ব্রিলিয়ান্ট আমাকে একটু নেবে তোমাদের দলে।”
হুট করে সাগরিকার কথায় দুজনেই ওর দিকে তাকায়। মেহবিন আর রাইফা দু’জনেই ক্লাসের ফাস্ট আর সেকেন্ড গার্ল। রাইফা ফাস্ট আর মেহবিন সেকেন্ড। আর সাগরিকা নিম্নস্তরের প্রথম সারির ছাত্রী মানে টেনেটুনে পাশ এমন টাইপ। ওর কথায় রাইফা বলল,,
“আমাদের দলে নিলেই কি? তোমার গোবর মাথায় পদ্ম ফুটবে সাগরিকা?”
তখন মেহবিন বলল,,
“এসব কি ধরনের কথা রাই। আর শুনো সাগরিকা আমরা কোন দল করি না যে তুমি আমাদের দলে আসবে।”
তখন সাগরিকা বলল,,
“আসলে আমি তো খুব একটা ভালো স্টুডেন্ট না। তোমরা দুজন যদি আমাকে একটু সাহায্য করতে তাহলে আমি পড়াশোনায় একটু আগাতে পারতাম।”
তখন রাইফা বলল,,
“পড়াশোনা নিয়ে সাহায্য করাই যায়। তবে হ্যা আমাদের মধ্যে একদম ঢোকার চেষ্টা করবে না।”
“তোমরা যে আমায় সাহায্য করবে এতেই খুশি। আমি তাহলে তোমাদের সিটে বসি?
মেহবিন বলল,,
“ঠিক আছে।”
এরপর থেকে সাগরিকা ওদের সাথে বসতো। কয়েকদিন পর সাগরিকা রাইফাদের বিল্ডিং এ রাইফাদের সামনের ফ্ল্যাটে ভাড়া উঠে। ওদের ফ্ল্যাটে আসা যাওয়া হতো রাইফা আর সাগরিকার। দু’জনের বেশ ভাব ও হয়ে যায়। এভাবে প্রথম প্রাক নির্বাচনী পরীক্ষা এসে পরে সাগরিকা তো পারলে ওদের বাড়িই থাকে। পড়াশোনা দেখে রাইফাও কিছু বলে না সেই সাথে ওদের মায়েরাও না। ভালোই ভালোই পরীক্ষা টা হয়ে যায়। পরীক্ষায় মেহবিন ফাস্ট হয় রাইফা সেকেন্ড। সাগরিকাও অনেক ভালো নাম্বার পেয়ে খুশি। রাইফা ফাস্ট হতে পারে নি দেখে রাইফার একটু মন খারাপ হয় কারন ও ফাস্ট হলে ওর বাবা ওর পছন্দের একটা ঘড়ি দেবে।তবুও নিজের প্রানপ্রিয় বান্ধবী ফাস্ট হয়েছে এই খুশিতে মন খারাপ চলে যায়। রাইফা বলল,,
“এই মেহু তুই তো ফাস্ট হয়েছিস ট্রিট দে!”
মেহবিন হেঁসে বলল,,
“চল কি খাবি বল? তিনশো টাকার ভেতরে যা খাবি তাই খাওয়াবো বাজেট এতটুকুই।”
“ধুরু কি বলিশ তিনশো টাকায় কি আর দুজনের পার্টি হবে তাই মন চায় সব খাবো আজ।”
“আরে বললাম তো বাজেট এতটুকুই আমি তো আর রোজগার করি না। পাপা যা দেয় তাই।”
“হুম হইছে চল তাহলে।”
তখন সাগরিকা এসে বলল,,
“এই যে জোরা কবুতর তোমাদের জন্য আমি এতো ভালো নাম্বার পেয়েছি বলে। আজ তোমাদের মন খুলে ট্রিট দেব।”
রাইফা খুশি হয়ে বলল,,
“তাই!”
মেহবিন কিছু বললো না। ওর আজকাল সাগরিকা কে ভিশন অদ্ভুত লাগে। ওর মনে হয় ও সব স্বার্থের জন্য করছে। মেহবিন বলল,,
“আজ আমাদের সময় হবে না তুমি বরং অন্য দিন দিও।”
তখন রাইফা গুঁতা মেরে ফিসফিস করে বলল,,
“আরে অফ যা এতোবড় ট্রিট মিছ দেওয়া যায় নাকি। আজ জমিয়ে খাওয়া দাওয়া হবে আমার বান্ধবী ফাস্ট হয়েছে। যদিও অন্যের টাকায় তোরটা কাল খাবো এখন চল।”
রাইফার জোরাজুরিতে ও আর কিছু করতে পারলো না। ওদের সাথে গেল আর বেশ ভালো একটা রেস্টুরেন্টে ট্রিট দিল। সবশেষে রাইফার জন্য সাগরিকা একটা ঘড়ি দিল যেটা রাইফা কিনবে বলে ওর বাবার কাছে আবদার করেছিল তবে ঘড়িটা বেশ দামী তাই তার বাবা বলেছে পরীক্ষায় ফাস্ট হলে কিনে দেবে । কিন্তু ওতো ফাস্ট হয় নি।ঘড়িটা পেয়ে রাইফা খূ্শিতে লাফিয়ে উঠে। কিন্তু তা দেখে মেহবিনের মুখে হাঁসি ফুটে উঠে না। রাইফা খুশি হয়ে মেহবিনকে দেখাতে থাকে। সাগরিকা মেহবিন কে একটা কলম দেয় যদিও সেটা খুব দামী নয় তবে একটু ভালো ওটা দিয়ে বলল,,
“আসলে রাইফার ওটা পছন্দের এটা জানতাম তাই ওর জন্য ঘড়িটা এনেছি। তোমার পছন্দ জানি না তো তাই এই ছোট্ট উপহার।”
মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,
“ধন্যবাদ।”
কিছুক্ষণ পর সাগরিকা ওদের রেখে চলে গেল। মেহবিন আর রাইফা একটা রিক্সায় উঠলো। রাইফার মুখে হাঁসি তা দেখে মেহবিন বলল,,
“আজ খুব খুশি তুই তাই না?”
“হুম খুব খুশি । তুই জানিস আমি ফাস্ট হইনি বলে খুব খারাপ লাগছিল কারন বাবা বলেছিল আমি ফাস্ট হলে এই ঘড়িটা কিনে দেবে। কিন্তু এখন ফাস্ট না হয়েও পেয়ে গেলাম খুশি হবো না বল তুই।”
“ওহ আচ্ছা।”
মেহবিন একটা ছোট চকলেট বক্স দিয়ে বলল,,
“নে এটা তোর জন্য কিনেছিলাম।”
“ও মাই আল্লাহ চকলেট। আজ তো আমার ঈদ লাগছে দোস্ত।”
বলেই মেহবিনের গালে একটা চুমু দিল। তা দেখে মেহবিন হাসলো। এই মেয়েটার পাগলামি ওর মুখে হাঁসি ফুটায়। এভাবেই চলতে লাগলো কিছুদিন হুট করেই মেহবিন বুঝতে পারলো রাইফা ওর সাথে আগের মতো থাকছে না। ওর সাথে থাকলেও সাগরিকার সাথে বেশি কথা বলছে । আসলে রাইফা আর সাগরিকা একই বিল্ডিং এ হওয়ায় নানা গল্প তারা স্কুলে এসে করে। এই জন্য মেহবিন একদিন ছুটির সময় বলল,,
“এই রাই আজ তুই আমার রিক্সায় বাড়ি যাবি।”
তখন সাগরিকা বলল,,
“এই রাইফা তোমাকে আজ আন্টি তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে না। আমাদের সাথে মোটর সাইকেল এ চলো।”
তখন রাইফা বলল,,
“সরি মেহু আজ ওদের সাথেই যাই। মা তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে।”
মেহবিন কিছু বললো না। ও নিজের মতো চলে গেল। দেখতে দেখতে দ্বিতীয় প্রাক নির্বাচনী পরীক্ষা এলো। রাইফা আর মেহবিন বেশ ভালোই পরীক্ষা দিল। এবার রাইফা ফাস্ট আর মেহু সেকেন্ড। এ নিয়ে মেহবিন একটুও মন খারাপ করলো না। ও রাইফা কে জড়িয়ে ধরে শুভেচ্ছা জানালো। রাই ও ভিশন খুশি। এই জন্য সে বলল কেক ট্রিট দেবে। রাই মেহবিনের সাথে সাগরিকাকেও নিল সেই সাথে আরো দুই তিনজন ক্লাসমেট। চকলেট কেক কাটতে দেখে সাগরিকা বলল তার ভিশন পছন্দের বলেই প্রথম পিচ টা রাইয়ের হাত থেকে সে খেয়ে নিল। ব্যাপারটাতে মেহবিন আর রাইফা দু’জনেই হতভম্ব গেল। রাইফা বলল,,
“এই তুমি আগে কেকটা খেলে কেন ওটা তো সবসময় মেহুর জন্য ।”
“আরে রাই চিল এটা আর কি বড় ব্যাপার। তোকে বললাম না আমার চকলেট কেক ভিশন পছন্দের।তাই লোভ সামলাতে পারি নি। নে এখন তুই মেহবিন কে খাওয়া।”
মেহবিন সাগরিকার মুখে রাই শুনে থমকে গেল কারন রাই শুধু ঐ বলতো আর ওর বাবা মা। রাইকে অন্য কেউ রাই বললে রাই রেগে যেত। কিন্তু আজ কিছুই বলছে না। রাইফা মেহবিনের সামনে গিয়ে বলল,,
“সরি দোস্ত ঐ সাগরিকার জন্য তোকে প্রথমে খাওয়াতে পারলাম না।”
মেহবিন মুচকি হাসি ফুটিয়ে খেয়ে বলল,,
“ইটস ওকে।”
বলে রাইফাকেও খায়িয়ে দিল। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এক অন্যরকম যন্ত্রনা তৈরি হলো। কিন্তু ও বুঝতে দিল না কাউকে ভেতরে ভেতরে ও বুঝতে পারছে ওর রাই ওর থেকে আলাদা হয়ে যাচ্ছে। সবাই চলে গেল খেয়ে দেয়ে রাইফাও চলে গেল তাড়াতাড়ি বাড়ি যেতে হবে বলে ।শুধু রয়ে গেল মেহবিন একা। ও অস্ফুট স্বরে বলল,,
“মানুষের জীবন কি অদ্ভুত তাইনা? কিছু জিনিস খুব অপছন্দের থাকা সত্বেও সৌজন্যতার খাতিরে হাঁসি মুখে সহ্য করতে হয়!”
কিছুদিন এভাবেই কেটে গেল টেস্ট পরীক্ষার পাঁচ দিন বাকি। এই কয়েকদিনে মেহবিন ঠিক বুঝে গেছে ও ওর বেস্ট ফ্রেন্ড কে হারাতে চলেছে। রাইফা আগের মতো আর মেহবিনের সাথে থাকে না কথাও বলে না। তবে সাগরিকার সাথে তার বেশ ভাব । আজকাল মাঝে মাঝে মেহবিন মনে করে রাইফা ওর জন্য বিরক্তবোধ হচ্ছে। এসবই আনমনে ভাবছিল মেহবিন হুট করে রাইফা ওর সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল,,
“তুই যদি আমার বান্ধবী না হতিস? তাহলে তোর গালে আমি কষিয়ে দুটো থাপ্পড় মারতাম।”
হঠাৎ এ কথায় মেহবিন ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। পাশে সাগরিকা কে দেখতে পেল। তা দেখে মেহবিন শান্ত স্বরে বলল,,
“আমি কি করেছি?”
রাইফা মেহবিনের সামনে একটা চিঠি রাখলো। মেহবিন পরে দেখলো তাতে ওদের ফিজিক্স এর স্যারের নামে প্রেমপত্র লেখা হয়েছে। তা দেখে মেহবিন বলল,,
“এটা এটার জন্য কি হয়েছে?”
“এটা আমার ফিজিক্স এর অ্যাসাইনমেন্টের খাতার ভেতর এলো কি করে?”
“মানে কি?”
“মানে এটা আমার হাতের লেখা আর তুই ছাড়া আমার হাতের লেখা কেউ কপি করতে পারে না।”
“তো কি হয়েছে?”
“আমি তো লিখিনি তাহলে তুই তুই লিখেছিস এটা। আর আমার অ্যাসাইন্টমেন্টের ভেতরে রেখেছিস।”
এটা শুনে মেহবিন রেগে গেল আর বলল,,
“তুই এসব কি বলছিস? তুই কি পাগল হয়েছিস।”
তখন সাগরিকা বলল,,
“এখন কিছু না জানার ভান ধরা হচ্ছে। তুমিই এটা রেখেছো যাতে স্যারের মনে রাইকে নিয়ে বিরুপ ধারনা হয় আর স্যার যাতে ওকে কম নাম্বার দেয়। প্রথম পরীক্ষায় তুমি ফাস্ট হয়েছিলে আর দ্বিতীয় পরীক্ষায় রাই হয়েছে যাতে টেস্ট পরীক্ষায় ও তুমি ফাস্ট হতে পারো তাই এসব করেছো তাই না। তুমি জানো এই নোংরা খেলার জন্য স্যার ওকে যাচ্ছে তাই বলে অপমান করেছে । সেই সাথে তো প্রিন্সিপাল স্যারের কাছেও নালিশ দিতে গিয়েছিল। আমরাই কতো অনুরোধ করে বলেছি এসব ভুল আরো কতোকিছু করে মাফ চেয়েছি। রাই তো দেখেই বুঝেছিল এটা তোমার হাতের লেখা তারপরও তোমার নাম বলেনি আর তুমি তার বন্ধুত্বের এই দাম দিলে ছিঃ!”
সব শুনে মেহবিন স্তব্ধ হয়ে যায়। ওর নিজের ভেতরে খুব অনুশোচনা হচ্ছিল এই কারনে যে ওর খারাপ সময়ে ওর পাশে থাকতে পারে নি। তবে ওর অভিযোগ আনা শুনে ও ঠান্ডা মাথায় বলল,,
“তুই আমাকে ক’বছর ধরে চিনিস রাই?”
হুট করে এমন প্রশ্নে রাই চমকে উঠলো। তখন সাগরিকা বলল,,
“তুমি এসব কি বলছো নিশ্চয়ই কথা ঘুরাতে চাইছো।”
মেহবিন এবার রেগে বলল,,
“ইডিয়ট আমি তোমায় নয় রাইকে জিজ্ঞেস করেছি।”
একথা শুনে রাই বলল,
“তুই ওকে ইডিয়ট বলছিস কেন?’
“আমার উত্তর আগে দে তুই?”
“তার আগে তুই বল তুই ওকে ইডিয়ট বললি কেন? ও কি বলেছে তোকে ওতো যা দেখেছে তাই বলেছে।”
মেহবিন রাইয়ের খুব কাছাকাছি চলে গেল ওর চোখে চোখ রেখে বলল,,
“আমায় বিশ্বাস করিস রাই?”
রাই বেশিক্ষণ চোখ রাখতে পারলো না। অন্যদিকে ঘুরিয়ে বলল,,
“আগে নিজের থেকেও বেশি করতাম। কিন্তু এগুলো দেখে করতে পারছি না।”
মেহবিন চিঠির দিকে তাকিয়ে ওর মুখে মুচকি হাসি ফুটলো তা দেখে সবাই অবাক হলো। রাই নিজেও ওর দিকে তাকিয়ে অবাক হলো। মেহবিন কোনদিকে না তাকিয়ে চিঠিটা নিয়ে ফিজিক্স স্যারের রুমে গেল। কি যেন বলল তাকে তারপর বেরিয়ে এলো কিছুক্ষণ পর স্যার ক্লাসে এসে রাইকে সবার সামনে সরি বলল আর যাওয়ার আগে মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“তোমার ভাগ্য খুব ভালো যে তুমি মেহবিনের মতো বান্ধবী পেয়েছো।”
কথাটা শুনেই রাইফার চোখ ছলছল করে উঠলো। স্যার যেতেই মেহবিন বলল,,
“আমার জন্য সব হয়েছিল না। নে আমিই সল্ভ করে দিলাম। এবার হ্যাপি।”
বলেই মেহবিন বেরিয়ে গেল। পরে রাইফা গেল স্যারের কাছে জানতে চাইলো মেহবিন কি বলেছে। বলে সে বলল সে এসে জানালো তুমি এই কাজ করোনি কেউ তোমাকে খারাপ বানানোর জন্য এসব করেছে । আমরা বিশ্বাস করিনি পরে ও বলল ও নিজেও তোমার হাতের লেখা নকল করতে পারে। এই বলে কিছুটা লিখলো তবে চিঠিতে এমন কিছু জিনিস ছিল তা তোমাদের দুজনের কারোটাই মিল ছিল না। এটা ও প্রুভ করে দিয়ে গেল আর বুঝিয়েও দিল তাই বুঝতে পারলাম ওটা কেউ ইচ্ছে করে তোমার নামে করেছে। সব শুনে রাইফা কেঁদে উঠলো ও মেহবিনকে খুঁজতে লাগলো একটা সময় পেয়েও গেল ও ওকে জড়িয়ে কাঁদতে লাগলো। আর বলল,,
“সরি রে আমি আজ বড় একটা ভুল করে ফেলেছি।আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম আমার সব সমস্যার সমাধান তুই। প্রথমে সাগরিকার কথা কানে না নিয়ে যদি তোর সাথে কথা বলতাম তাহলে কোন সমস্যাই হতো না। আই এম রেইলি সরি।”
মেহবিন তো আর এক কথায়ই কাউকে ক্ষমা করে দেওয়ার পাত্রী নয়। ও কিছু না বলে বাড়ি চলে গেল। এদিকে সাগরিকা এসে ন্যাকা কান্না করতে লাগলো। রাইফা গলে গেল। দুদিন ধরে রাইফা মেহবিনের সাথে কথা বলতে চাচ্ছে কিন্তু মেহবিন বলছে না। আজ ক্লাসের শেষদিন তাই আজ সে মেহবিনের জন্য চকলেট আর ফুল নিয়ে এলো আজ রাগ ভাঙিয়েই ছাড়বে। কিন্তু স্কুলে এসেই দেখলো মেহবিন সাগরিকাকে পরপর দু’টো থাপ্পড় মারলো। তা দেখে রাই দৌড়ে ওখানে চলে গেল মেহবিন আরেকটা থাপ্পড় মারবে এমন সময় রাই হাত ধরে ফেলল আর বলল,,
“কি করছিস তুই পাগল হয়ে গেছিস? ওকে মারছিস কেন?
মেহবিন রেগে বলল,,
“সেটা ওকেই জিজ্ঞেস কর?”
“কি হয়েছে সাগরিকা?”
তখন সাগরিকা বলল,,
“মেহবিন স্কুলের সবাইকে বলছিল তুই নাকি মেহবিনের টা দেখে দেখে পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করিস। তোর নাকি কোন যোগ্যতা নেই ওর রেজাল্ট এর সমান করার। আবার ও সবাইকে বলে বেড়াচ্ছে তোর নাকি কোন বড় ভাইয়ের সাথে সম্পর্ক আছে সে তোকে প্রশ্নপত্রের ব্যাপারে হেল্প করে । এটা শুনে আমি প্রতিবাদ করতেই ও আমায় থাপ্পড় মারলো।”
সব শুনে রাই মেহবিনের দিকে তাকালো মেহবিন শান্ত চোখে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে। রাই বলল,,
“এসব সত্যি মেহবিন?”
তখন সাগরিকা বলল,,
“তোর বিশ্বাস না হয় ওদের জিজ্ঞেস কর?”
সাগরিকার সাথে থাকা সবাই বলল সাগরিকা সত্যি কথা বলছে। রাইয়ের চোখ ছলছল করে উঠলো ও মেহবিনের কাছে গিয়ে বলল,,
“মেহু এসব কি?”
“সেদিন তোকে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করেছিলাম তুই আমায় বিশ্বাস করিস কি না তোর মনে হয় আমি এসব করবো। আমি ওকে এই কারনেই থাপ্পড় মেরেছিলাম কারন চিঠিটা ও রেখেছিল।”
তখন সাগরিকা বলল,,
“এখন আমার ওপর দোষ চাপানো হচ্ছে। তাছাড়া আমি ওর মতো কোনদিন লিখতেই পারবো না। আমার হাতের লেখা ওতো সুন্দর নাকি। সবথেকে বড় কথা আমি তোমার মতো বন্ধুরূপী শত্রু নই আমি সত্যি সত্যি রাইয়ের শুভাকাঙ্ক্ষী। আচ্ছা তোর বিশ্বাস হচ্ছে না তাই না রাই আমি তোকে প্রমান দিচ্ছি।
সাগরিকা খাতা বের করে রাইয়ের মতো লেখার চেষ্টা করলো হলো না। তখন সাগরিকা মেহবিন কে নিয়ে বলতে লাগলো তখন কিছুজন সাগরিকার সাথে তাল মেলালো। সব শুনে রাইফা বলল,,
“আমি ভাবতেও পারিনি মেহু তুই আমার নামে এসব বলে বেড়াবী। তোকে বন্ধু ভাবতেই আমার কেমন যেন লাগছে।
মেহবিন কিছুই বললো যে ওকে বিশ্বাস করেনা তার কাছে নিজের সম্পর্কে সে কিছু সাফাই দেবে না। তখন সাগরিকা বলল,,
“মেহবিন আমার নামে ওসব বলল আমাদের দুজনের মাঝে সম্পর্ক নষ্ট করতে। এই মেহবিন একদম আমাদের দুজনের মাঝে আসবে না।
তখন মেহবিন উচ্চ স্বরে হেঁসে উঠলো আর বলল,,
“তোমাদের মাঝে বাহ বেশ ফানি তো । আমি তোমাদের মাঝে আসছি না তুমি আমাদের মাঝে এসে পরেছো। এতো সুন্দর একটা বন্ধুত্ব কতো সহজেই না ভেঙে দিলে তুমি। এই জন্য তোমাকে স্যালুট দেওয়া উচিত। কি সুন্দর জোরা কবুতর কে ভেঙে দিল এক কাক অরফে কাউয়া।”
এ কথা শুনে সাগরিকা রেগে বলল,,
“এই মেহবিন মুখ সামলে কথা বল। নাহলে তোর মুখ আমি ভেঙে দেব।”
মেহবিন হেঁসে বলল,,
“এই মেহবিন কে আঘাত করা এতো সহজ নয়। যেখানে এতোকিছুর পরেও রাই নিজেই আমার কিছু করতে পারলো না সেখানে তুই কি করবি।”
মেহবিনের কথার মানে রাই বুঝলো আর বলল,,
“আমি তোকে এই কারনেই আঘাত করি নি কারন আমি তোকে নিজের বান্ধবী মনে করি। আমার এখন তোকে দেখে ভাবতেও ঘৃনা হচ্ছে তুই আমার বান্ধবী।”
মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,
“তাহলে ভেঙে দে না বন্ধুত্ব। ট্রাস্ট মি আমি কিছুই বলবো না।”
মেহবিনের মুচকি হাসির বলা কথাটা রাইয়ের মনে ঝড় তুলল। ও ব্যাগ থেকে ফুল আর চকলেট বের করলো আর বলল,,
“এসব এনেছিলাম তোর রাগ ভাঙাবো বলে কিন্তু এখানে এসে বুঝলাম এসব তুই ডিজার্ভ করিস না।”
“ওহ আচ্ছা আমি করি না। তো কে করে ঐ সাগরিকা?”
রাই ওর দিকে অশ্রুশিক্ত চোখে তাকিয়ে বলল,,
“হ্যা ঐ ডিজার্ভ করে । তোর মতো ধোঁকাবাজ নয়।
বলেই রাই সবকিছু সাগরিকাকে দিয়ে দিল। মেহবিন দেখলো সাগরিকার মুখে অদ্ভুত ক্রুর হাঁসি। সবাই চলে গেল শুধু রইলো মেহবিন। মেহবিনের মুখে অদ্ভুত হাসি। ও ব্যাগ থেকে দু’টো দামি কলম আর ডায়রি বের করলো যা ও আজ রাইফাকে দেবে বলে এনেছিল। ও ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আপন মনে বলল,,
“যখন সাগরিকা নামক মেয়েটা আমাদের কাছে আসে তখনই বুঝেছিলাম যে কিছু একটা হবে। কিন্তু বুঝতে পারি নি আমাদের সম্পর্কই শেষ করে ফেলবে। যবে থেকে তুই আমাকে বাদ দিয়ে ওর সাথে বেশি কথা বলতে লাগলি তবে থেকেই বুঝতে পারছিলাম তুই আমার থেকে দূরে সরে যাচ্ছিস যেদিন রেস্টুরেন্টে তোকে ও রাই বলে সম্বোধন করলো কিন্তু তুই কিছু বললি না সেদিন বুঝতে পেরেছিলাম তুই নিজেও ওকে প্রশ্রয় দিচ্ছিস। সম্পর্ক কখনো তৃতীয় ব্যক্তির কারনে নষ্ট হয় না, সম্পর্ক তো নষ্ট হয় তৃতীয় ব্যক্তিকে প্রশ্রয় দেওয়ার জন্য। আর তুই সেটা দিচ্ছিলিস। দিন যাচ্ছে তুই কেন আমাকে ভুলেই যাচ্ছিস মানে সম্পর্ক অসুস্থ হয়ে পরছে তৃতীয় কারো আগমনে অথচ তুই বুঝতেই পারছিস না। কি অদ্ভুত তাইনা তৃতীয় একজন তোর গালে এতো জোরে থাপ্পর মেরে গেল তুই বুঝতেই পারলি না। আমি তো খুব করে বুঝতে পারছিলাম তোর আর আমার বিচ্ছেদ খুব নিকটে অথচ তুই কিছু আচই করতে পারছিস না। মানে তোর এই আমি কাউকে পেছনে ফেলে আসা তোর জীবনে কোন ইফেক্টই পরছে না। তুই এই কয়েকমাস ভেবে দেখতো একটু আমাকে কতটুকু সময় দিয়েছিস যে মেয়েটা আমাকে বন্ধের দিন তিনবার করে ফোন দিতো সেই মেয়েটা সেই ঘটনার আগের তিন মাস যাবৎ আমাকে ফোনই দেয় না কি অদ্ভুত তাইনা।
সাত বছরের সম্পর্ক আমাদের। দুজন দুজনকে খুব ভালোমতো চিনি তবুও মনে হচ্ছে কোথাও কমতি ছিল। তাই তো আজ তুই আমায় অবিশ্বাস করলি। তুই তো বলতি আমাদের কেউ ভাঙতে পারবে না। অথচ কত ছোট্ট কারনেই না তুই সম্পর্ক ভেঙে দিলি। হয়তো অন্য কেউ হলে সে সাফাই দিতো কিন্তু আমি তো অন্যদের মতো নই। যেখানে বিশ্বাস নেই সেখানে সম্পর্ক রাখা বোকাদের কাজ। পৃথিবীতে সবচেয়ে ভয়ংকর জিনিস হলো চেনা মানুষের অচেনা রুপ যা তৃতীয় ব্যক্তির কারনে হয়ে থাকে। আর আজ তা আমার চোখের সামনে।
এইটুকু বলেই মেহবিন ক্লাসে গেল। ওখানে গিয়ে দেখলো রাইফা কাঁদছে আর সাগরিকা ওকে আগলে রেখেছে কিন্তু মুখে অদ্ভুত হাঁসি। মেহবিন কিছু বললো না অন্য বেঞ্চে গিয়ে বসে পরলো। সেদিনের মতো সবাই ক্লাস করে চলে গেল।অথচ এই শেষ দিন নিয়ে দুই বান্ধবীর কতো প্ল্যান ছিল। অতঃপর পরীক্ষা শুরু হলো দু’জনের চোখাচোখি হলো কিন্তু কেউ কারো সাথে কথা বললো না। মেহবিন শান্ত চোখে ওর দিকে তাকিয়ে থাকতো আর রাইফা সাগরিকার সাথে গল্প করতো চলাফেরা করতো ওকে ইগনোর করে। এমন একটা ভাব ওর জীবনে মেহবিন নামের কেউ নেই। সবগুলো পরীক্ষা এভাবেই দিল। রেজাল্ট ও প্রায় সেম সেমই করলো। রাইফাই বেশি পেল বরং একটু। এটা নিয়ে সাগরিকা মেহবিন কে নিয়ে অনেক কথা বলল রাইফাও সেদিন তাল দিল। মেহবিন একটা টু শব্দ করে নি সেদিন। ও তো শুধু দেখছিল চোখের সামনে ওর বেস্ট ফ্রেন্ড এর ও কেউ বেস্ট ফ্রেন্ড হয়ে যাচ্ছে। দুজনে একজনের কাছেই কোচিং করতো কিন্তু ওদের দেখে মনে হতো কোন নিরব যুদ্ধ চলছে। এভাবেই চলে এলো এস এস সি পরীক্ষা। দুজনেই সিট আগে পিছে কিন্তু ওদের মাঝে মনে হয় কতো মাইলের দূরত্ব। ওদের দুজনকে এভাবে পরীক্ষা দিতে দেখে স্যার ম্যাডামের কতো প্রশংসা পেয়েছে। দেখতে দেখতে সবগুলো পরীক্ষা শেষ হলো আজ লাস্ট পরীক্ষা। পরীক্ষা দিয়ে বের হওয়ার পর মেহবিন রাইফাকে ডাকলো।
“মিস রাইফা আফনূর একটু শুনবেন? আজকের পর থেকে এই মেয়েটা আপনাকে আর ডিস্টার্ভ করবে না। কারন আপনার সঙ্গ সে ডিজার্ভ করে না।”
এতোদিন পর প্রানপ্রিয় বান্ধবীর ডাকে রাইফা না চাইতেও দাঁড়িয়ে পরলো মেহবিন রাইফার সামনে দাঁড়ালো তার মুচকি হাঁসি ফুটিয়ে তুলল আর বলল,,
“পরীক্ষা কেমন হলো আপনার?”
রাইফা মুচকি হেঁসে বলল,,
“আপনারটা না দেখে দিলে তো আমি ভালো রেজাল্ট করতেই পারতাম না তাই না। সেই হিসেবে বলতে পারি বেশ ভালো হয়েছে ইনশাআল্লাহ রেজাল্ট আপনার থেকে ভালোই আসবে।”
“ইনশাআল্লাহ আল্লাহ তায়ালা আপনার মনের সকল আশা পুরন করুক।”
কথাটা শুনে রাইফা থমকে গেল ও ভাবেও নি মেহবিন ওর সাথে এভাবে কথা বলবে। ও কিছু বলবে তার আগে। মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,
‘আমরাও একটা সময় অনেক কথা বলতাম, একসাথে কতো সময় কাটাতাম। তাহলে আমাদের সাথে তেমন কি হয়েছে যে আজ হাজার মাইলের দূরত্ব তৈরি হয়েছে।”
মেহবিনের কথা শুনে রাইফাও বলল,,
“তখন তো আর জানতাম না নিজের সবথেকে প্রিয় বান্ধবী ধোঁকা দিয়ে দেবে।”
মেহবিন আবারও মুচকি হাসলো আর বলল,,
“আমাকে সবথেকে ভালো তুই চিনতিস যদি তোর মনে হয় আমি তোকে ধোঁকা দিয়েছি। তাহলে হয়তো সত্যিই দিয়েছি।”
মেহবিনের এইটুকু শুনে রাইফা ফ্যালফ্যাল করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। মেহবিনের মুচকি হাসি বরাবরই রাইফাকে মুগ্ধ করে কিন্তু আজ অদ্ভূত যন্ত্রনা দিচ্ছে। ওর চোখ ছলছল করে উঠলো ও বলল,,
‘হয়তো আমি তোকে সবথেকে ভালো চিনতাম কিন্তু আমি ধোঁকাবাজ মেহবিন কে চিনি না। আমি চিনি না তাকে। আর এই ধোঁকাবাজের সাথে আমি সম্পর্ক রাখতে চাই না।
‘সেদিনের পর কোন সম্পর্ক ছিল বুঝি। উঁহু ছিল না কোন সম্পর্ক। তাই তো আজ আপনি সম্মধোন করতে হচ্ছে।
“এই সবকিছুর জন্য তুই দায়ী।”
“মানুষ বরাবরই স্বার্থপর এটা আমার মা বলেছিল একদিন। তবে আমার মা এটাও বলেছিল নিজেকে এমনভাবে তৈরি করবে যাতে কেউ তোমাকে স্বার্থপরতার কাজে না লাগাতে পারে। ”
রাইফা অবাক হয়ে বলল ,,,
“মানে কি?”
মেহবিন মুচকি হেঁসে আবার বলল,,
“আমি একটা রিয়ালাইজ করেছি জানিস সেটা হলো ‘বন্ধুত্বের সম্পর্ক যতো গভীরই হোক না কেন? যখন সেই বন্ধুত্বে তৃতীয় ব্যক্তি ঢুকে পরে তখন তার বন্ধুত্বের বিশ্বাস আর তৃতীয় ব্যক্তির মাঝে সবসময় তৃতীয় ব্যক্তিরই জিত হয়।”
এটা শুধু বন্ধু্ত্ব নয় যে কোন সম্পর্কের ক্ষেত্রে হয়।সেদিন কি যেন বলছিলি আমাকে তোর বন্ধু ভাবতে ঘৃনা হচ্ছে তাই না। তবে আমার কিন্তু এতো সুন্দর বন্ধুত্ব সম্পর্কটার ওপর ঘৃনা আসছে না কিন্তু সহ্য ও হচ্ছে না। আমি চাইতাম যুগের পর যুগ চলে যাক তবুও আমাদের বন্ধুত্ব যাতে নষ্ট না হোক। তোকে আমি আমার হয়ে কোন সাফাই দেব না। তবে একটা কথা মনে রাখিস একটা সম্পর্ক নষ্ট করতে অনেকের দরকার হয় না একজনই যথেষ্ট। তবে হ্যা আরেকটা কথা ‘একশো বছর পরেও যদি তুই আমার কাছে আসিস আর আমি যদি বেঁচে থাকি তাহলেও সব ছেড়েছুড়ে আমি তোকে আগলে নেব।’ যাই হোক অনেক কথা বললাম নিজের খেয়াল রাখিস আসছি হয়তো আর কোনদিন দেখা হবে না আমাদের।
মেহবিন হেঁটে চলল সামনের দিকে। রাইফা মেহবিনের কথার কিছুই বুঝতে পারলো না। কারন ওর সবকিছু গোলমেলে লাগছে। তবুও বলল,
“মেহু আমার কথাটা শোন?”
মেহবিন পেছনে ফিরে মুচকি হেঁসে বলল,,
“বিচ্ছেদ মানেই সবসময় অসমাপ্ত নয়, কখনো কখনো বিচ্ছেদ মানে এক সুন্দর সমাপ্তি!”
~আজরিনা জ্যামি
~চলবে,,