#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৩১
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি
দেখতে দেখতে কেটে গেল আরো তিন চারদিন। আজ শুক্রবার নাস্তা করেই সকাল সকাল তাজেল হাজির তার সাঙ্গোপাঙ্গদের নিয়ে মেহবিনদের বাড়িতে। সবাই একই বয়েসের সাত অথবা আট বছর হবে। তাজেল এসেই মেহবিন কে ডাকতে লাগল,,
“ডাক্তার ও ডাক্তার।”
তাজেলের ডাক শুনে মেহবিন বেরিয়ে দেখলো পাঁচ ছয়জন বাচ্চা কুলসুম আর তাজেল দাঁড়িয়ে। ওদের দেখে মেহবিন বলল,,
“কি ব্যাপার নেত্রী? বন্ধের দিন সকাল সকাল সবাই আমার বাড়িতে?”
“কালক্যা না তুমি কইছিলা জুতা চোর খেলবা। তাই সকাল সকাল সবাইরে লইয়া আইছি।”
তাজেলের কথায় মেহবিন হাসলো। কাল বিকেলে ওরা জুতা চোর খেলছিল রাস্তায় মেহবিন বলে সে কোনদিন এগুলো খেলে নি তাই খেলতে চায় কিন্তু আজকেই যে তাজেল সবাইকে নিয়ে হাজির হবে তা বুঝতে পারে নি ও। মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,
‘ঠিক আছে খেলবো। ”
তখন তাজেল সবাইকে বলল,,
‘আমি আর কুলসুম রাজা রানী তোরা বাইটা আয়। আমরা দুইজনে তোগোরে নিমু তয় ডাক্তার আমার দলে হেতির বাটা লাগবো না।”
তখন কুলসুম বলল,,
“এ ডাক্তার কতো বড় দেখছোস তুই। উনি তো একাই সব জুতা নিয়া আইবো আমরা ধরবার পারুম নাকি তারে।”
‘ডাক্তার জীবনে নাকি জুতা চোর খেলে নাই। হে বড় হইলে কি হইবো হেতি তো আর পারে না।”
‘তাও তোমার ডাক্তাররে বাইটা আইতে ক। উনি একা আর দুইজন থাকবো উনার বদলে দলে।”
“উঁহু ডাক্তার বাটবো না ডাক্তার আমার দলে তুই বাকি দুইজন রে নিয়া যা।”
মেহবিন তাজেলের কর্মকাণ্ড দেখে হাসে এই মেয়েটাও না। সবসময় ওকেই লাগবে। কুলসুম সব থেকে ভালো দুইটা বাচ্চা কে নিজের দলে নিল। বাকি চারজন দুই জন দুই জন করে নিজেদের নাম নিয়ে এলো। তাজেল আর কুলসুম এর কাছে এসে বলল,,
‘আম না জাম?
তাজেল আম নিল । তখন একজন হেঁসে তাজেলের দলে চলে এলো। আরেকজন কুলসুম এর কাছে মেহবিন বুঝতে পারলো ওদের আম জাম নাম রেখেছিলে রাজা রানী যাকে চাইবে সেই জন ঐ দলে। পরের দুইজন এলো আকাশ না বাতাস বলে এইবার কুলসুম চাইলো আকাশ একজন ওর দলে চলে গেল। তাজেলের দলে চারজন আর কুলসুমের দলে পাঁচ জন। এবার টস করা হবে। তাজেল একটা পাতা নিয়ে এলো কুলসুম কে বলল কোন পাশে সে নেবে শিরওয়ালা নাকি শির ছাড়াওয়ালা কুলসুম শিরওয়ালা পাশ চাইলো তাজেল ছেড়ে দিল। টসে জিতলো তাজেল। তাজেলের খুশি আর দেখে কে। তাজেল রা জুতো নেবে। তাজেল মেহবিনকে শিখিয়ে দিল কিভাবে খেলে। মেহবিন ও হেঁসে সব শিখে নিল। অতঃপর শুরু হলো খেলা মেহবিন অনেকে ভালো খেলছে বাচ্চারা ওকে ধরতে পারছে না। মেহবিন সব জুতো নিয়ে এলো ওরা জিতেছে তখন কুলসুম বলল,,
“কইছিলাম আমি উনার হাতে কেউ পারবো না এহন?”
তখন তাজেল বলল,,
‘যা সবাইরে তোরে দিয়া দিলাম । আমাগো দলে আমি আর ডাক্তার খালি এহন দেহুম।”
তাজেলের এতো আত্মবিশ্বাস দেখে মেহবিন হা করে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। তখন তাজেল বলল,,
‘এহন হারলে কিন্তু মান সম্মান থাকবো না ডাক্তার ভালো কইরা খেলবা।”
মেহবিন মাথা নাড়ালো মানে সে ভালো করে খেলবে। মেহবিন আর তাজেল অর্ধেক এর বেশি জুতো নিয়ে এলো তখন মেহবিন আউট হয়ে গেল। যদিও কুলসুমের দলের তিনজনকে মেহবিন আর তাজেল আউট করে দিয়েছে। তাজেল এখন একা ও মেহবিনের দিকে রেগে তাকালো তা দেখে মেহবিন বলল,,
“আমার দোষ নেই নেত্রী। আমি দেখিনি কুলসুম আমার পেছনে ছিল। তাছাড়া তুমি আছো তো তুমি সব জুতা নিতে পারবে।”
‘তুমি দেখছো ওরা চারজন আর আমি একা।”
“তো কি হয়েছে শক্তির থেকেও বুদ্ধি দিয়ে খেলাটা সহজ। তোমার বুদ্ধি দিয়ে তুমি খেলবে তাহলেই জিততে পারবে।”
মেহবিনের কথায় তাজেল বুদ্ধি দিয়ে খেললো। আর জিতলোও তাজেল এর খুশি দেখে কে। ও সোজা গিয়ে মেহবিনের কোলে উঠে পরলো আর চিৎকার করে বলল,,
‘আমরা এই দাইন ও জিতা গেছি ডাক্তার।”
তখন কুলসুম আর বাকি সবাই বলল,,
‘আমরা তোমাগো হাতে আর খেলুম না। তোমরা দুইজনেই ভালো খেলো।’
তাজেল মেহবিনের কোলে থেকে নেমে বলল,,
‘হাইরা গেছোস দেইহা খেলবি না।”
তখন কুলসুম বলল,,
‘এমবাই খেলুম না। আমি গেলাম।
তখন তাজেল বলল,,
“কাউ খাইটা বাড়ি গেল
ব্যাঙবাজা দিয়া ভাত খাইলো
ব্যাঙ গেল ঝোরে
কুলসুম চিল্লায়া মরে।
তাজেলের মুখে এরকম ছন্দ শুনে মেহবিন বলল,,
“এটা কি ছিল?”
তখন কুলসুম রেগে তাজেলের হাতে চিমটি দিল তখন তাজেল হেঁসে বলল,,
“চিমটি দিলি ক্যা
দুক্কু পাইলাম ক্যা
মাচার তলে বায়া ব্যাঙ
তোর নানির চার ঠ্যাং
কিছু করতে না পেরে কুলসুম রাগে দুঃখে কেঁদে উঠলো। মেহবিন কি বলবে ও তো তাজেলের ছন্দ শুনেই থমকে গেছে। মেহবিন নিজেকে সামলে কুলসুম কে গিয়ে ধরে বলল,,
‘নেত্রী এসব কি বলতো কুলসুমকে কাদাচ্ছো কেন?”
‘কুলসুম খেলা থুইয়া যাইবো কেন?”
তখন কুলসুম নাক টেনে বলল,,
‘না পারলে খেইলা কি হইবো। তোগো দুইজনের জন্য তো আমরা দাইনই পামু না তোগোডি শুধাম কহন আর দিমুই কহন।”
‘ওহ আচ্ছা এই ব্যাপার নেত্রী চলো এবার ওদের জুতো নিতে দাও। ওরা এবার জুতো নেবে।”
মেহবিনের কথায় তাজেল বাঁধা দিয়ে বলল,,
‘ওগো এতো যুক্তা ওরা খেইলা নিক। আমরা দাইন দিমু ক্যা।”
“নেত্রী!”
‘তুমি খালি কইলা দেইখা নাইলে জীবনেও দাইন দিতাম না। এই যে কুলসুম এহন খুশি হইছোস যা খেল। দেখবি তোরা জুতাও নিতে পারবি না। আর জিততেও পারবি না।”
‘দেহা যাইবো তোরেই আগে মারুম তাজেল দেহিস তুই।”
‘এই তাজেল রে মারা সহজ না কুলসুম। ভুইলা যাইস না আমাগো দলের লিডার কিন্তু আমিই। যা কথা বাদ দিয়া খেলা শুরু কর।”
খেলা শুরু হলো অর্ধেক জুতো নিতেই পাঁচজন আউট। চারটা তাজেল করছে আর একটা মেহবিন। সবার আগে আউট কুলসুম সেই জন্য তাজেল খুব খুশি। ওরা খেলছিল তখন গেটের সামনে থেকে বলল,,
‘আমিও খেলবো জুতা চোর।”
সবাই খেলা বন্ধ করে সেদিকে তাকালো । মেহবিন দেখলো রাইফা আর মিশু পেছনে অবশ্য জিনিয়া মুনিয়া,আর মিশুর মামাতো বোন শান্তা ও আছে। মেহবিন ওদের দেখে এগিয়ে গেল আর বলল,,
“ফুল তোমরা এই সময় এখানে ?”
‘সববার তো তুমি আমাদের বাড়িতে যাও তাই এইবার আমি এলাম। সারাদিন ইজ তোমার বাড়ি থাকবো।বাবা কে বললে বাবা বলল একা যাওয়া যাবে না তাই সবাইকে নিয়ে এলাম।”
‘ভালো করেছো এসো ভেতরে এসো।”
‘তুমি জুতা চোর খেলছিলে?”
‘হ্যা!”
“আমিও খেলবো।”
তখন সবার ছোট শান্তা বলল,,
“আমিও খেলবো।”
তখন জিনিয়া বলল,,
‘এগুলো ছোটবেলায় খেলতাম আজ সবাইকে দেখে ভালো লাগছে। কয়েকদিন পর আমার বিয়ে হয়ে যাবে আজ একবার স্মৃতিচারন করবো আমিও খেলবো।’
মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,
‘খেলো না এমনিতে সমস্যা নেই চারদিকে তো দেয়াল আছে।”
তখন মুনিয়া বলল,,
“তাহলে আমিও খেলবো।”
তখন মেহবিন রাইফার দিকে তাকিয়ে বলল,,
‘সবাই যখন খেলবে আপনি বাদ যাবেন কেন? খেলাধুলা করলে মন ভালো থাকে আপনিও আসেন রাইফা।”
তখন কুলসুম বলল,,
“হেতিগো বাইটা আসতে কন ডাক্তার আর একজন বেশি আছে হইবো না। আরেকজন লাগবো তাও বড়।
তখন মেহবিন বলল,,
“নেত্রী যাও গিয়ে নওশি কে ডেকে নিয়া এসো।”
তাজেল গেল নওশি কে আনতে। মেহবিন কি মনে করে ঘরে গেল আর ফ্রিজ থেকে মাংস বের করে ভিজিয়ে রাখলো। ঘড়ির কাঁটা এখন সারে দশটা দুপুরের রান্নাটা আজ ভালোভাবেই করতে হবে। সবাইকে খাওয়াতে হবে তো। ততক্ষণে নওশি ও এসে গেছে অতঃপর সবাই নিজেদের মতো করে আসলো মিশু মুনিয়া আর রাইফা তাজেলের দলে। নওশি জিনিয়া আর শান্তা কুলসুমের দলে। তারপরেই শুরু হলো খেলা বেশ ঘন্টা খানেক খেলা চললো সবার মুখেই তৃপ্তির হাঁসি। মেহবিন রাইফার দিকে তাকালো ওকে দেখার পর আজকেই প্রথম মেয়েটাকে মন খুলে হাসতে দেখলো সে। যা দেখে ওর মুখেও হাসি ফুটে উঠলো। সবাই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। মেহবিন সবাইকে বলল সে ভুনা মাংস আর খিচুড়ি রান্না করবে দুপুরে সবার দাওয়াত। সবাই যেন দুপুরে গোসল করে নামাজ শেষ করে চলে আসে। বাচ্চারা সবাই খুশি মনে চলে গেল বাড়িতে। মেহবিন সবাইকে হাত মুখ ধুয়ে আসতে বলল সবাই এলে মেহবিন কফি আর স্ন্যাক্স রাখলো ওদের সামনে। তখন জিনিয়া বলল,,
‘ভাগ্যিস তোমার বাড়িতে এসেছিলাম। অনেক দিন পর আবার ছোটবেলার মতো এতো আনন্দ করলাম।”
মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,
‘তোমরা নিজেদের মধ্যে আড্ডা দাও। আমি রান্না শেষ করি দুপুর বেলা কিন্তু এখানেই খেতে হবে।”
তখন মিশু বলল,,
“আমি তো সন্ধ্যার আগে যাবোই না।”
মেহবিন মুচকি হেঁসে রান্না ঘরে চলে গেল। আর নিজের মতো করে রান্নার জোগাড়ে ব্যস্ত হয়ে পরলো। তখন রাইফা এলো রান্না ঘরে ও বলল,,
‘হেল্প করবো কিছু?”
‘লাগবে না সব জোগাড় শেষ এখন শুধু রান্নাটা বাসাবো।”
‘আহমেদ পরিবার তাহলে আপনার পরিবার নয়।”
“সব তো সেদিন জেনেছেনই তাহলে আবার প্রশ্ন কেন?”
রাইফা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো হুট করে মেহবিন বলল,,
‘আপনি আপনার দাম্পত্য জীবনে সুখী তো মিসেস রাইফা আফনূর?”
মেহবিনের কথায় রাইফা ওর দিকে চমকে তাকালো। বলল,,
“হয়তো আমি একজন সুখী মানুষ।”
মেহবিন স্থির চোখে রাইফার দিকে তাকিয়ে বলল,,
“কিন্তু লোক চক্ষুর অন্তরালে হয়তো বা বিপরীত কিছুও থাকতে পারে।”
রাইফা কিছু বললো না ওখান থেকে চলে এলো। ও যেতেই জিনিয়া গেল মেহবিনের কাছে ওর পাশে দাঁড়াতেই মেহবিন ওর দিকে তাকালো। তা দেখে জিনিয়া হাসলো মেহবিন কিছু একটা বুঝতে পেরে বলল,,
‘শান ভাইয়া খুব ভালো মানুষ জিনিয়া। যাকে আপন করে নেয় তাকে নিজের পুরোটা দিয়েই সুখী করতে চায় সে। চিন্তা করো না তুমি।”
মেহবিনের কথা শুনে জিনিয়া অবাক হয়ে বলল,,
‘তুমি জানলে কিভাবে আমি শানের কথাই জিজ্ঞেস করবো?”
‘কিছু না এমনিই মনে হলো। যাই হোক এখন যাও আমি রান্নাটা মনোযোগ দিয়ে শেষ করি।”
জিনিয়া আর কিছু বলতে পারলো না । ও চলে গেল এরপর মিশু এলো একটা চেয়ার নিয়ে সে মেহবিনের রান্না দেখবে। মাংস হওয়ার আগে মিশু জানালো সে চেক করবে তার এটা ভালো লাগে। অতঃপর মেহবিনের রান্না শেষ হলো। আজ যেহেতু শুক্রবার তাই আধা ঘন্টা আগে আজান দিয়েছে এখন একটা বাজে মেহবিন ওদের কে নামাজ পরতে বলে গোসলে গেল পরে সে পরে নেবে। সবার সাথে আজ মিশুও নামাজ পরলো। মেহবিন শেষ করে বের হলো। খাবার গুলো বেড়ে রাখলো কিন্তু ওর কাছে প্লেট আছে বারোটা মানুষ হবে ষোলো সতেরজন বাকি প্লেট কোথায় পাবে এখন। ভাবতে ভাবতেই সবার নামাজ শেষ হলো। মেহবিন ভাবলো আগের ওদের খায়িয়ে দেওয়া যাক। মেহবিন সবাইকে খেতে ডাকলো সবাই বসলো মেহবিন সবাইকে দিয়ে মিশুকে খায়িয়ে দিল। সবার খাওয়া শেষ হলে তাজেল আর নওশি এলো সবাইকে নিয়ে। কাজটায় মেহবিন নিজে নিজেই হাসলো। ও প্লেট গুলো ধুয়ে সবাইকে খেতে দিল তাজেল মেহবিনকে জিজ্ঞেস করল ও খেয়েছে কি না মেহবিন বলল ওদের সাথেই বসবে। মেহবিন ওদের সাথে খেয়ে নিল সবাই কষা মাংস আর খিচুড়ি আয়েশ করে খেল যা দেখে মেহবিনের ভালো লাগলো। ওদের খায়িয়ে মেহবিন নামাজ পরে নিল। তারপর রাইফাদের সাথে কিছুক্ষণ কথা বললো। বিকেল হতেই ওরা এখন বাড়ি যাবে ওরা পাকা রাস্তায় উঠলো। ওরা মেহবিনের থেকে বিদায় নিয়ে হাঁটা ধরলো। তখনি পেছন থেকে তাজেল ডাক দিল। মেহবিন পাশ ফিরে বলল,,
‘নেত্রী!”
তখনি মেহবিনের একটা ফোন এলো ও ফোন রিসিভ করে কিছু বলবে তার আগে ওপাশ থেকে আওয়াজ এলো,,
‘ফাইভ…. ফোর…থ্রি…. টু…. ওয়ান!!”
মেহবিন তাকাতেই দেখলো একটা গাড়ি আসছে আর তার মধ্যে থেকে একজন রিভলবার তাক করে রেখেছে। তা দেখে ও তাড়াতাড়ি করে সরে গেল সরে যাওয়ায় গুলিটা বুকে না লেগে হাতে লাগলো। তখনি পেছন থেকে একটা গাড়ি এসে মেহবিন কে ধাক্কা মারলো। মেহবিন রাস্তায় পরে গেল মুহুর্তেই ওর রক্ত দিয়ে রাস্তাটা ভিজে উঠলো। সব কিছু এতো তাড়াতাড়ি হলো যে কেউ গাড়ির কুল কিনারা পেল না। তখন মেহবিনের কানে আওয়াজ এলো কেউ ডাক্তার ডাক্তার বলে চিৎকার করছে। মেহবিন চোখ মেলে তাকাতেই দেখলো মিশুরা সবাই ওর দিকে দৌড়ে আসছে।
গুলির আওয়াজে সবাই পেছনে তাকাতেই রাইফারা দেখলো মেহবিনের পেছনে একটা গাড়ি খুব জোরে আসছে আর মুহুর্তেই মেহবিনকে ধাক্কা মারলো। মেহবিনের পেছনে কাঁচা রাস্তায় তাজেল ছিল ঐ ডাক্তার ডাক্তার বলে চিৎকার করে উঠেছিল। তাজেল দৌড়ে গিয়ে মেহবিনের সামনে বসলো। রাইফা দৌড়ে এসে মেহবিনের মাথাটা কোলে তুলে নেয় আর কাঁদতে থাকে আর ডাকতে থাকে ,,,
‘মেহু মেহু একদম চোখ বন্ধ করবি না। কিছু হবে না তোর।কেউ আছেন একটা গাড়ির ব্যবস্থা করুন প্লিজ মেহুকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে হবে।”
রাইফার হুট করে মেহু আর তুই শুনে ওরা অবাক হলো। কিন্তু এই মুহূর্তে এটা ভাবার সময় নেই। এদিকে মিশুর মেহবিনের রক্ত দেখে হাত পা কাঁপছে পুরোনো কিছু তিক্ত স্মৃতি মনে পরছে ও অনু অনু রক্ত রক্ত করতে বসে পরলো। এই মুহূর্তে কে কি করবে বুঝতে পারছে না কাকে রেখে কাকে সামলাবে। মুহুর্তেই এলাকার সব মানুষ জরো হয়ে গেছে। সবাই মিলে একটা গাড়িতে উঠিয়ে দিল রাইফা মেহবিনের মাথাটা নিজের কোলে নিল। জিনিয়াও উঠে বসলো তাজেল ও উঠে বসে ওকে রেখে যেতে চাইলেও তাজেল বলে সে যাবেই তাজেল মেহবিনের হাতটা শক্ত করে ধরে রাখে আর বলে,,
‘ডাক্তার চিন্তা কইরো না । তোমার কিছুই হইবো না আমরা তোমারে হাসপাতালে নিয়া যামু।”
মেহবিনের নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছে। তাজেল আর রাইফা কতোকিছু বলছে কিন্তু ও শুনতে পারছে কি না বোধগম্য হচ্ছে না। অতঃপর হাসপাতাল আসতেই মেহবিন কে রক্তাক্ত অবস্থায় দেখে নার্সরা ডাক্তার কে ডাকে। মেহবিনকে দ্রুত অপারেশন থিয়েটারে নেওয়া হয়। শুক্রবার মেহবিনের বন্ধ থাকলেও দুজন ডাক্তার থাকে হাসপাতালে ইমার্জেন্সির জন্য। আর সবথেকে বড় মহিলা ডাক্তার আজ কোথাও যায় নি তার পরিচিত একজন হাসপাতালে ভর্তি ছিল বলে তিনি হাসপাতালেই ছিলেন। তাই মেহবিন কে দেখে বলে তিনিই অপারেশন টা করবেন যা মেহবিনের গুড লাক বলা যায়। কাঁদতে কাঁদতে তাজেলের মাথায় এলো মুখরের কথা। কিন্তু কিভাবে জানাবে ওকে। তখনি একজন মাস্ক ক্যাপ পরিহিত একজন দৌড়ে এলো। তাজেল কে দেখেই সে তাজেলের সামনে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসে বলল,,
“নেত্রী!”
মুহুর্তেই তাজেল বুঝে ফেললো এটা মুখর। ও মুখরকে দেখে কেঁদে উঠলো আর জড়িয়ে ধরে বলল,,
‘পাঞ্জাবিওয়ালা আমার ডাক্তার!”
মুখরের চোখ থেকেও দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। ও তাজেলকে শক্ত করে দুই হাত দিয়ে জরিয়ে ধরলো। এতটা অসহায় ও বোধহয় কখনো হয় নি। রাইফা আর জিনিয়া একবার ওদের দিকে তাকালো ওরা বুজতে পারলো না তাজেল কাকে জরিয়ে ধরে কাঁদছে। তখনি আরবাজ আর শেখ শাহনাওয়াজ কে দেখা গেল হাসপাতালে। রাইফা সেই তখন থেকে একটা বেঞ্চে বসে অপারেশন থিয়েটারের দিকে তাকিয়ে আছে। জিনিয়া ওর পাশে বসে আছে। ওনারা আসতেই একজন নার্স বলল রক্ত লাগবে ও নেগেটিভ। কথাটা শুনে শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,
‘আমি দেব রক্ত আমার ব্লাডগ্ৰুপ ও নেগেটিভ।”
তখন নার্সটি বলল,,
‘স্যার আপনার অনেক বয়স হয়েছে। এই সময় রক্ত দেওয়াটা একটু রিস্ক। তাই আমরা আপনার রক্ত নিতে পারবো না।”
‘দেখুন আমি একদম সুস্থ আমার তেমন কোন রোগ ও নেই ।”
“তবুও স্যার আমরা পারবো না।”
তখন আরবাজ বলল,,
“বাবা শান্ত হও তোমার এখন রক্ত দেওয়াটা ঠিক হবে না। আমি দেখছি রক্ত কোথায় পাওয়া যায়।”
“তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করো আরবাজ।যেভাবেই হোক ডাক্তারের কিছু হতে দেওয়া যাবে না।
রক্তের কথা শুনে মুখর বেরিয়ে গেছিল আরবাজ যাবে এমন সময় মুখর এলো একজন কে নিয়ে। ও এসেই বলল,,
‘কাউকে কোথাও যেতে হবে না। রক্তের ব্যবস্থা হয়ে গেছে উনি দেবেন।”
মুখরের কথা শুনে নার্সটা তাড়াতাড়ি লোকটাকে নিয়ে চলে গেল। মুখর মেহবিনের খবর শুনেই বুঝেছিল রক্ত লাগতে পারে তাই ওর এখানের পরিচিত একজন কে নিয়ে এসেছিল সাথে করে। তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,
“আপনি কে?”
তখন মুখর বলল,,
‘আমি ডক্টর মেহবিন মুসকান এর হাজবেন্ড।”
তখন জিনিয়া বলল,,
‘মেহবিন আপু ম্যারিড।”
মুখর বলল,,
“জি তবে এগুলো ভাবার সময় এখন নয়।”
কেউ আর কিছু বললো না। শেখ শাহনাওয়াজকে আরবাজ নিয়ে বেঞ্চে বসিয়ে দিল। তার চোখ দুটো অপারেশন থিয়েটারের দিকে। কিছুক্ষণ পর গ্ৰামের বেশ কয়েকজন ও এলো। তাজেল নওশিকে দেখে ওকে জরিয়ে কাঁদতে লাগলো। ঘন্টাখানেক পর ডাক্তার বের হলে মুখর গিয়ে জিজ্ঞেস করল,,
‘ডক্টর মেহবিনের কি অবস্থা?”
“অপারেশন সাকসেসফুল তবু ওনার অবস্থা খুব একটা ভালো নয়। প্রথমত উনার হাতে গুলি লেগেছিল যা প্রথমে বুঝতে পারিনি পরে বুঝেছি তারওপর ঐ এক্সিডেন্ট মাথায় হাতে পায়ে প্রচন্ড আঘাত পেয়েছে। উনার জ্ঞান না ফেরা কিছুই বলতে পারছি না আমরা। তবে আশা আছে ইনশাআল্লাহ খুব তাড়াতাড়ি উনার জ্ঞান ফিরবে কারন উনি খুব স্ট্রং।”
‘ইনশাআল্লাহ তাড়াতাড়িই যেন জ্ঞান ফিরে আসে। সবকিছুর জন্য ধন্যবাদ ডক্টর।”
‘সবকিছুর মালিক আল্লাহ তাই আগে উনার শুকরিয়া আদায় করুন। এক্সকিউজ মি।”
বলেই ডক্টর চলে গেল। মুখর ধাপ করে বসলো। একটা দীর্ঘশ্বাস নিল। ভেতরে ভেতরে কি চলছে এটা শুধু ঐ জানে ও কাউকেই ওর অবস্থা বোঝাতে পারছে না। মাস্ক ক্যাপ পরে আছে ও উঠে চলে গেল মনকে শান্ত করার জন্য আর ওর বিহঙ্গিনীর জন্য সুস্থ হয়ে উঠার জন্য নামাজ পরতে হবে। সবার অগোচরে নিজের মাস্ক ক্যাপ রেখে উযু করে করে আবার সব পরে মসজিদে ঢুকলো। এই সময়টা কোন নামাজের সময় নয় তাই মুয়াজ্জিন ছাড়া আর কেউ নেই । ও নামাজে দাঁড়িয়ে পরলো।
রাত নয়টা সবাই বাড়ি চলে গেছে শুধু রয়ে গেছে মুখর আর আরবাজ। তাজেল থাকতে চেয়েছিল মুখর ওকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছে। ঐ একজন মানুষ যে মন মতো তার দুঃখ আর মেহবিনের প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ করেছে। বাকিরা তো কেউ কিছু প্রকাশ করেনি তাই বলতেও পারছি না। শেখ শাহনাওয়াজ আরবাজ কে মুখরের সাথে থাকতে বলেছিল। ও বলেছে ওর কারো দরকার নেই একাই থাকতে পারবে। আর কেউ না জানলেও আরবাজ জানে মেহবিনের হাজবেন্ড কে তাই ও মুখরের না সত্বেও থেকে গেছে। শেখ শাহনাওয়াজ সবাইকে নিয়ে বাড়ি ফিরে গেল। মুখর মেহবিনের কেবিনের সামনের বেঞ্চে বসে আছে সবাই আরবাজ এতোক্ষণ মুখরের কাছে আসার সাহস পায় নি। এবার সাহস করে মুখরের কাঁধে হাত রাখতেই মুখর আরবাজ কে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠলো। এটারই বোধহয় অপেক্ষা করছিল মুখর। একটা কাঁধ পেতেই নিজের এতোক্ষণ জমানো অশ্রুগুলো ঢেলে দিল।
~ চলবে,,
#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৩২
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি
আরবাজের চোখ দিয়েও দুই ফোঁটা পানি গড়িয়ে পরলো। মুখরের কান্নার জন্য আরবাজের আরো বেশি খারাপ লাগছে। আরবাজ মুখরের পিঠে হাত রেখে বলল,,
“শান্ত হ মুখর এতোটা ভেঙে পরলে চলবে?”
মুখর কাঁদতে কাঁদতেই বলল,,
“কি করে শান্ত হবো আরবাজ? যে মানুষটাকে আমি সবসময় আগলে রাখতে চাই। একটা কাঁটাও ফুটতে দিতে রাজি নই। সেই মানুষটা এখন নির্জীব হয়ে শুয়ে আছে। এটা কি করে আমি সহ্য করবো আরবাজ?”
“প্লিজ মুখর এভাবে ভেঙ্গে পরিস না। ডাক্তার তো বলেছে আশা আছে ইনশাআল্লাহ মেহবিন খুব তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠবে।
মুখর আর কিছু বললো না। কিছুক্ষণ পর ও নিজেকে সামলিয়ে উঠলো। ও সোজা হয়ে বসলো। তখন আরবাজ বলল,,
“এখন কেবিনে চল মাস্ক আর ক্যাপ খুলে রাখ। আমি খাবার নিয়ে আসি নাহলে তুই নিজেই অসুস্থ হয়ে পরবি।”
“না আমি ঠিক আছি আমি ভেতরে যাবো না। বিহঙ্গিনীকে ঐ অবস্থায় দেখতে পারবোনা। আর আমার খিদে পায় নি খাবো না আমি।”
‘একদম পাগলামি করবি না সেই কখন থেকে মাস্ক ক্যাপ জড়িয়ে আছিস। বেশিক্ষণ মাস্ক পরে থাকলে তোর সাফোকেশন হয়। বিহঙ্গিনী কে সুস্থ করতে হলে আগে নিজেকে সুস্থ থাকতে হবে তো। তাছাড়া আমি তোকে মেহবিনের কেবিনে যেতে বলছি না আমি সব ভেবে আলাদা করে কেবিন নিয়েছি তোর থাকার জন্য।এখন সেখানে চল।”
“আমার কিছু ভালো লাগছে না।”
আরবাজ জোর করে মুখরকে কেবিনে নিয়ে গেল। তারপর ওখানে গিয়ে মাস্ক ক্যাপ খুলে ফেললো। সেগুলো খুলতেই আরবাজ দেখলো মুখরের মুখটা লাল হয়ে গেছে। ও ওকে হাত মুখ ধুয়ে আসতে বলল। শেখ শাহনাওয়াজ মেহবিনের খবর শুনে কুদ্দুস কে দিয়ে খাবার আনিয়ে ছিলেন বাড়ি থেকে। মুখর হাত মুখ ধুয়ে এসে দেখল আরবাজ খাবার বেড়ে বসে আছে। আরবাজ গিয়ে মুখরের হাত ধরে বসালো নিজের হাতে ভাত মেখে তুলে বলল,,
“আল্লাহই আমাদের জন্য যথেষ্ট এবং তিনি কতই না উত্তম কর্মবিধায়ক।
[সূরা আলি-ইমরান, আয়াত ১৭৩]
“নিশ্চয়ই আল্লাহ ভালোবাসেন তাঁর উপর ভরসাকারীদেরকে।”
[সূরা আল-ইমরান ১৫৯]”
এই আয়াত দ্বারা কি বুঝলি যারা আল্লাহর ওপর ভরসা করে তাদের আল্লাহ তায়ালা ভালোবাসেন এবং তিনি তার বান্দাদের নিরাশ করেন না। আল্লাহর ওপর ভরসা রাখ নিশ্চয়ই ভালো কিছু হবে। আল্লাহ তায়ালা মাঝে মাঝে আমাদের পরীক্ষা করেন আমাদের খারাপ অবস্থায় ফেলে। এটাও তেমন একটা পরীক্ষা মনে কর ধৈর্য্য ধরে এই সময়টা পার করতে পারলেই তুই সফল।”
সব শুনে মুখর বলল,,
“এই সবকিছু তুই বলছিস ?”
আরবাজ মুখরের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“বছর খানেক আগে কাব্যের বিহঙ্গিনী পেজ থেকে একটা পোস্ট করা হয়েছিল,,
“আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করা শিখুন তার ওপর ভরসা রাখুন। ইনশাআল্লাহ জীবন সহজ হয়ে যাবে।”
মুখর আর কিছু বললো না। মুখর হা করছে না দেখে আরবাজ বলল,,
“নে এবার হা কর!”
মুখর হা করলো । আরবাজ খুব একটা ওকে খাওয়াতে পারলো না। হালকা খেয়ে মুখর পানি খেয়ে বলল,
‘আমাকে জ্ঞান ঝাড়লি নিজে খাচ্ছিস না কেন । তাড়াতাড়ি খেয়ে নে আমি কিন্তু তোকে খাওয়ার জন্য তোয়াতে পারবো না।”
মুখরের কথায় আরবাজের একটু ভালো লাগলো ও যে টেনশন কম করতে চাইছে সেটা বুঝতে পারলো। আরবাজ বলল,,
‘আমি তোর মতো নাদান বাচ্চা নই যে এইটুকুতেই কান্নাকাটি করবো।”
‘এতো কিছুকেও তুই এইটুকু বলছিস। তুই কেমন রে তোর একটুও মায়া মোহাব্বত নাই।”
মুখরের কথা শুনে আরবাজ কিছু বললো না ও অন্যদিকে ঘুরে গেল। মুখর সামনে আসলো তখন আরবাজ খেতে শুরু করলো। তা দেখে মুখর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাস্ক পরে কেবিন ছেড়ে বেরিয়ে গেল। ডাক্তারের সাথে কথা বলে মেহবিনের কেবিনে গেল । ওখানে গিয়েই ওর চোখটা ছলছল করে উঠলো। মেহবিনের মুখে অক্সিজেন মাস্ক হাতে ক্যানুলা স্যালাইন চলছে। ও আস্তে করে টুলে বসলো আর মেহবিনের হাতটা নিজের হাতের মুঠোয় নিল। আর একটা চুমু দিয়ে বলল,,
“তুমি তো খুব স্ট্রং তাই না বিহঙ্গিনী। তুমি নিশ্চয়ই ফিরবে তোমার কাব্যের কাছে। তুমি জানো এই কম সময়েই তুমি আরো একজনের খুব কাছের হয়ে গেছো। জানো তোমার নেত্রী আজ তোমার জন্য কতো কেঁদেছে। তোমার জন্য বাড়িই যেতে চাইছিল না। ও কি বলছিল তুমি জানো ও বলছিল আমি যেন তোমায় আটকে রাখি যাতে তুমি ধোঁকা দিতে না পারো। ও বারবার একটাই কথা বলছিল ডাক্তার যেন আমারে ধোঁকা না দেয় পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা। আমি ওর ধোঁকা কথাটার মানে বুঝিনি বিহঙ্গিনী। তবে ওর কথাটার মাঝে কতটা যন্ত্রনা ছিল তা ঠিকই বুঝেছি। তুমি প্লিজ আমাকে আর তোমার নেত্রী কে ধোঁকা দিও না বিহঙ্গিনী।
বলতে বলতেই মুখরের চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরলো। ও আবার বলতে লাগলো,,
“আমাদের এখনো সংসার করা বাকি বিহঙ্গিনী। আমাদের দুজনের সাজানো স্বপ্নগুলো তো একসাথে পূরন করতে হবে তাই না। এই জন্য তো তোমায় তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে উঠতে হবে। প্লিজ বিহঙ্গিনী খুব তাড়াতাড়ি ফিরে এসো।
মুখর আর কিছু বললো না হাতটা ধরে মেহবিনের দিকে তাকিয়ে রইল। পেছনে দাঁড়িয়ে আরবাজ সেটা দেখলো ওর চোখ থেকেও পানি গড়িয়ে পরলো ও ওখান থেকে চলে গেল।
_________________
“বাড়িতে কোন শোক লাগছে নাকি যে সবাই না খাইয়া নিজের ঘরে ঘাপটি মাইরা রইছে।”
শেখ শাহেনশাহ এর কথায় আরিফা জামানসহ সবাই তার দিকে তাকালেন। মিসেস আমজাদ বললেন,,
“ভাইজানের শরীরটা বেশি ভালো না তাই উনি খাবে না। আর মিশু তো বাড়ি এসেই থম মেরে আছে। যতো যাই বলি মেয়েটাকে তো মিশু অনেকটাই আপন করে নিয়েছে। আমাদের থেকেও ঐ মেয়েটার কথা বেশি শুনে। আর রাইফা জিনিয়া ওরা তো সবটাই নিজের চোখের সামনে দেখেছে তাই ওদের গলা দিয়ে খাবার নামবে না বলেছে তাই আসেনি।”
“সবটাই সামনে দেখছে তাই গলা দিয়া ভাত নামবো না কেন? ঐ মাইয়া আমাগো কিরা তার জন্য বাড়িতে শোক সভা লাগাই লইছে। শাহের ও বলিহারি তার জন্য নাকি আবার আরবাজ রে রাইখা আইছে।”
তখন আরিফা জামান বললেন,,
“আমারও মনে হয় আরবাজকে রেখে আসা উচিৎ হয় নি।
তখন কেউ সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে বলল,,
‘সত্যিই ঠিকই বলেছে ওখানে আরবাজ রেখে আসা উচিত হয় নি। বরং আমারই থেকে আসা উচিত ছিল। কারন যে মেয়েটা আমার মেয়ের জন্য এতো কিছু করে তারজন্য আমার নিজেরই উচিত ছিল ওখানে থাকা।”
শেখ শাহনাওয়াজ কে দেখে আরিফা জামান বললেন,,
“ব্যাপারটা আসলে তেমন নয় আমি এই জন্যই বলছিলাম, মেয়েটারও মনে হয় শত্রুর অভাব নেই সেদিন তুলে নিয়ে যেতে চাইছিল আজ আবার এরকম ঘটনা ঘটলো। মেয়েটার মধ্যেই কোন ঘাপলা আছে যদি তারা কিছু করে এতো ঝামেলার মধ্যে আরবাজ কে ওখানে রেখে আসা উচিত হয় নি তাই বলছিলাম আর কি।”
“মেয়েটার মধ্যে ঘাপলা নয় বরং সততা আছে। মানুষের ভালো করতে গিয়েই তার শত্রু হয়েছে তাই আজ এই অবস্থা ডাক্তারের।
“আপনি কি করে জানলেন। আমার তো মেয়েটাকে দেখেই কেমন লাগে সুবিধার মনে হয় না । তাছাড়া সে কোন কথা ফেলতে দেয় না সবার মুখের ওপর জবাব দেয়।”
“তার স্পষ্টবাদীতায় কি তোমার সমস্যা হয় । সে স্পষ্টভাষী তাই সবকিছু স্পষ্টভাবেই বলে এবং করে। আর কি বললে তাকে সুবিধার মনে হয় না আমি তো তার মধ্যে তেমন কোন গুনই দেখতে পেলাম না যার জন্য মনে হতে পারে তার মধ্যে অন্যকিছু থাকতে পারে। সবথেকে বড় কথা হলো,,
‘না জেনে তোমরা কারো ওপর খারাপ ধারণা রেখো না। এটা সবচেয়ে বড় গুনাহ ।
– সহীহ বুখারী –৫১৪৩
আরেকটা হাদিসে ‘রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, তোমরা (মন্দ) ধারণা করা থেকে বিরত থাকো। কারণ, (মন্দ) ধারণাই হচ্ছে সব থেকে বড় মিথ্যা।” (বুখারী ৬০৬৬, মুসলিম ০২৬৩)
সে আসার পর থেকেই দেখছি তুমি তার ব্যাপারে অনেক সমালোচনা করছো কথা বলছো কখনো তোমার জায়ের কাছে কখনো তোমার ভাবির কাছে। শুনে রাখো আরিফা হযরত আলী (রা) বলেছেন,,
“অতিরিক্ত সমালোচনা করবেন না। অতিরিক্ত সমালোচনা ঘৃ*ণা এবং খারাপ চরিত্রের দিকে এগিয়ে নিয়ে যায়।”
যাইহোক আর কিছু ভালো লাগছে না। তাছাড়া ওখানে আরবাজ একা নেই ডাক্তারের হাজবেন্ড ও আছে।”
সবশুনে আরিফা জামান মাথা নিচু করলেন আর বললেন,,
‘আমি সেভাবে বলি নি যে আপনি আমায় এতোকিছু বলবেন।”
“এটা শুধু ডাক্তারের জন্য বলি নি। তোমায় স্ত্রী হিসেবে কিছু নসিহত করলাম এখন। যাই হোক মনে কষ্ট পেলে মাফ করে দিও।”
বলেই শেখ শাহনাওয়াজ এক গ্লাস পানি খেয়ে ওপরে চলে গেলেন। নিজের রুমে যাওয়ার আগে মিশুর রুম চেক করলেন মিশু নামাজ পরছে দেখে উনি একটু অবাক হলেন। তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে নিজের রুমে চলে গেলেন।
___________________
“তোমার কেউ মারা গেছে নাকি রাইফা?”
হুট করে সায়িদের কথায় রাইফা চমকে উঠলো। সবেই নফল নামায শেষ করে ঘুরলো। আর এখনি এরকম কথাটা শুনে যে কেউ চমকে উঠবে। রাইফা নিজেকে সামলে বলল,,
“আপনি কখন এলেন?’
‘যখন তুমি মুনাজাতে বসে কাঁদছিলে। বোধহয় কারো ভালোর জন্য কিছু চাইছিলে আল্লাহর কাছে আমি ঠিক শুনতে পাইনি।”
রাইফা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,,
‘তেমন কিছু না।”
তখন সায়িদ হুট করেই এসে রাইফার গাল চেপে ধরে বলল,,
‘আমি কখনো অসুস্থ হলে তো এভাবে জায়নামাজ এ পরে কাঁদতে দেখি না। আজ ঐ দুই টাকার ডাক্তারের জন্য মুনাজাতে নদী বানাচ্ছিস। ও কে হয় তোর শুনি?”
রাইফা নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে কোন রকমে বলল,,
‘সায়িদ আমাকে ছাড়ুন আমার লাগছে।”
‘লাগুক লাগার জন্যই তো ধরেছি। খুব দরদ তোর ডাক্তারের প্রতি।”
রাইফা এ ঝটকায় সায়িদকে সরিয়ে দিল। আর বলল,,
“একজন মানুষ হাসপাতালে ভর্তি তার জ্ঞান নেই আর আপনি তাকে নিয়ে কি সব বলছেন। আমি তো আপনার মতো নই। আর কি বললেন আপনার জন্য কিছু করেছি কিনা তাহলে তো আমিও বলছি আপনি কখনো আপনাকে একটু আপনার ওপর সম্মান ভালোবাসা জাগানোর কারন দিয়েছেন কি না। যে কিনা বিয়ে করেও অন্য নারীতে আসক্ত থাকে তার জন্য জায়নামাজ এ পরে কাঁদবো আমি। যে কিনা আমার ওপর দিনের পর দিন মানসিক শারীরিক টর্চার করে তার জন্য কাঁদবো আমি। বাড়িতে একটা কুকুর থাকলেও নাকি তার ওপর মায়া তৈরি হয়ে যায় আর আমি তো মানুষ একই ছাদের নিচে থাকি। তবুও তো কোনদিন আমার ওপর একটু দয়া মায়া দেখান নি। তাহলে আমার ওপর এইটুকু আশা করাও বোকামি ছাড়া কিছু নয়।”
সব শুনে সায়িদ রেগে বলল,,
‘তোর খুব চাপা হয়েছে তাই না? এই চাপা কি করে ভাঙতে হয় সেটাও আমি জানি। শুধু কাকার জন্য তোকে কিছু করতে পারি না। নাহলে এতোদিনে তোকে জ্যন্ত পুতে দিতাম আমি।”
বলেই সায়িদ ফোন নিয়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল। আজ কেন যেন এরকম করায় রাইফার চোখ দিয়ে পানি পরলো না।
____________________
মুখর কেবিন থেকে বেরিয়েই দেখলো দুই জন ক্যাপ মাস্ক পরিহিত পুরুষ আর একজন বোরকা হিজাব নিকাব পরিহিতা মহিলা এদিকেই আসছে। মুখরকে দেখেই একজন বলল,,
‘মেহু কেমন আছে এখন?”
মুখর বুঝতে পারলো এটা মেহরব চৌধুরী। বাকি দুজনের দিকে তাকিয়ে দেখলো মিহির আর মাইশা। তখন আরবাজ এলো তাদের দেখে একটু অবাক হলো তবুও এগিয়ে গেল। মুখর ওনাদের সবকিছু জানালো
আর এটাও বলল,,
“আপনাদের খবর কে দিল?”
তখন মেহরব চৌধুরী বললেন,,
‘দিয়েছে কেউ সেটা নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না।তুমি তো আর দাওনি।”
‘আসলে স্যার মেহু আমাকে দিয়ে একটা ওয়াদা করিয়ে নিয়েছে। ওর মৃত্যু ছাড়া আর যাই হোক না কেন আমি যেন ওর অনুমতি ছাড়া আমার পরিবার আর আপনাদের কে না জানাই। এখানে আমি ওয়াদা বদ্ধ তাই আপনাদের জানাই নি। এমনকি আমার পরিবারও ওর বিষয়ে কিছু জানে না।”
তখন মাইশা বলল,,
‘এই মেয়েটা কি দিয়ে তৈরি আল্লাহ ভালো জানেন। এটা কোন কথা ওর মৃত্যুর খবর ছাড়া আর কোন খবর!”
মাইশা কে না বলতে দিয়ে তখন মিহির বলল,,
‘এসব কথা ছাড় মাইশা আমরা এমনিতেও জানি ও কিরকম। এখন কথা হলো মেহুকে এখানে রাখাটা সেফ নয়। এমনিতেই এটা সরকারি হাসপাতাল সিকিউরিটি তেমন জোরালো নয়। যদি মেহুর ওপর অ্যাটাক হয় তাহলে কিছুই করার থাকবে না। এমনিতেও এই অবস্থায় এখানে রাখা রিস্ক।”
‘আমিও তাই ভাবছি মিহির ভাইয়া। কাল সকালেই শিফট করবো।”
‘না যা করার রাতের অন্ধকারেই করতে হবে সবার আড়ালে।”
তখন মেহরব চৌধুরী বললেন,,
‘মিহির ঠিক বলেছে। যা করার রাতেই অন্ধকারেই করতে হবে। আমি যদি ভুল না হই তাহলে মেহবিনের ওপর আবার অ্যাটাক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। দিনের বেলায় কেউ মেহবিনের ওপর নজর রাখতে পারে। তাছাড়া সে তো জানে মেহবিন অনাথ ওর কেউ তাই সে আমাদের বিষয়ে ভাববে না। কেউ যে মেহবিন কে এখান থেকে রাতে সরাতে পারে সেটা তার মাথাতেও আসবে না। মুখর তুমি ডাক্তারের সাথে কথা বলো আমরা সব ব্যাবস্থা করে ওকে নিয়ে যাবো জানি এটা রিস্ক তবুও এই রিস্কটা নিতেই হবে।”
‘ঠিক আছে স্যার আমি কথা বলে দেখছি।”
‘আমরাও যাচ্ছি সাথে চলো।”
সবাই ডাক্তারের কাছে গেল। কিন্তু তিনি জানালেন মেহবিনের জন্য এখন রিস্ক কোথাও শিফট করা। সবাই মিলে তাকে অনেক রিকুয়েস্ট করলো আর এটাও বলল ওর লাইফ রিস্ক আছে এখানে। তাছাড়া তারা সবথেকে ভালো হাসপাতালে ওকে শিফট করবে। সব শুনে তিনি রাজি হলেন। তাকে সবাই বলল তিনি যেন কাউকে কিছু না বলেন। তিনি এতেও রাজি হলেন।তিনি মেহবিন কে অনেক স্নেহ করে তার খারাপ হোক এটা তিনি চান না। মিহির বেরিয়ে অ্যাম্বুলেন্স কল করলো এখানের অ্যাম্বুলেন্স ওরা নেবে না। ওরা কোন কিছুতেই কিছু বিশ্বাস করবে না। অ্যাম্বুলেন্স আসতে আরও ঘণ্টা তিনেক সময় লাগবে। মেহরব চৌধুরী মিহির আর মাইশা মেহবিন কে একবার দেখে এলো। মেহরব চৌধুরীর চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পরলো আজ ভিশন অসহায় লাগছে নিজেকে তার। ওরা বেরিয়ে এলো কেবিন থেকে। ওরা সবাই অন্য কেবিনে গিয়ে বসলো আর অ্যাম্বুলেন্সের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। তখন সবার অগোচরে একজন মেহবিনের রুমে ঢুকলো। মেহবিন কে দেখেই কে দেখেই তার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো। সে আস্তে করে মেহবিনের হাত দু’টো নিজের মুঠোয় নিয়ে চোখের পানি ছেড়ে বললেন,,
“আমার আম্মা! আমার আম্মা! আপনি আমায় ক্ষমা করবেন আমি আপনাকে রক্ষা করতে পারি নি। আপনাকে সুরক্ষিত রাখার জন্য আপনাকে নিজের থেকে দূরে রেখেছি। তবুও আজ নিজেকে ভিশন ব্যর্থ মনে হচ্ছে আম্মা। আমি জানি আমার ওপর আপনার অনেক অভিযোগ আর এটা জায়েজ ও। কিন্তু সবটাই আপনার সুরক্ষার জন্য। ওরা যে মেহেরের মতো আপনাকেও বাঁচতে দিতো না আম্মা। আমি যে আপনাকে অনেক ভালোবাসি আম্মা তাই তো আপনাকে একেবারের জন্য হারাতে চাইনি। আমি জানি আপনি কোন একদিন ঠিক ফিরবেন আমার কাছে আমি সেদিনটারই অপেক্ষায় আছি।
লোকটার চোখের পানি মেহবিনের হাতে পরলো। তিনি মেহবিনের হাত ধরে চুমু খেলেন মাথাটা উচু করতেই তখন তিনি শুনতে পেলেন,,
“বাবা!”
~চলবে,,