#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_২৭
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি
মেহরব চৌধুরীর পার্টিটে অনেক রাজনীতিবিদ ও বড় বড় বিজনেসম্যানদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। সেই সাথে রয়েছে তার নিকট আত্মীয় স্বজন। সন্ধ্যার দিকে মাহফুজ শাহরিয়ার তার পুরো পরিবার নিয়ে এসেছেন। মুখর এসে থেকেই মেহবিন কে খুঁজছে কিন্তু পাচ্ছে না। কারন ও নিজের রুম থেকে এখনো বের হয় নি আর ও কোন রুমে আছে সেটাও কারো কাছে জিজ্ঞেস করতে পারছে না। সে আজ সাদা শার্টের ওপর ক্রীম কালারের ব্লেজার আর প্যান্ট পরেছে ফর্সা গায়ে রঙটা বেশ মানিয়েছে।ও এদিক ওদিক তাকাচ্ছে দেখে নাফিয়া বলল,,
“কি ব্যাপার ভাইয়া কি খুঁজছো?
মুখর বলল,,
“বিহঙ্গিনীর কাব্য আর কাকে খুঁজবে এই অচেনা পরিবেশে এসে? তার বিহঙ্গিনীকেই খুঁজছে।”
মুখরের কথা শুনে নাফিয়া হাসলো। ভাইয়ের ভালোবাসা সবসময়ই তাকে মুগ্ধ করে। এখন এই মানুষটা যাকে খুঁজছে সে যদিও এখানে আসে সে তার সাথে কথা বলবে কিনা সন্দেহ। তবুও অপেক্ষা করতে ক্ষতি কি! দেখতে তো পারবে। অতঃপর আগমন ঘটলো কাব্যের বিহঙ্গিনীর সেও আজ ক্রীম কালারের লেহেঙ্গা পরেছে সাথে শুভ্র রঙের হিজাব নিকাব। আদরের হাত ধরে সিড়ি দিয়ে নামছে মেয়েটার নিকাব থাকলে কি হবে মুখরের চিনতে ভুল হয় নি। দুজন যে কাপল তা ওদের ড্রেস দেখে যে কেউ বলে দেবে। মেহবিন আদরের হাত ধরে নামছে দেখে সবার দৃষ্টি সেদিকেই গেল। মন্ত্রীর নাতি বলে কথা। মন্ত্রী সাহেবের কাছে থাকা সবাই জিজ্ঞেস করল সে কে? তিনি হাঁসি মুখে জানালেন তার ভাগ্নি। সিঁড়ি থেকে নামতেই মেহবিনের নজর গেল মুখরের দিকে। মেহবিনের নজর সেদিকে পরতেই মুখর বুকের বাঁ পাশে হাত দিয়ে হেঁসে উঠলো। তা দেখে মেহবিন মাথা নাড়িয়ে হাসলো। ওর সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মুখর বলে উঠলো,,
“আসসালামু আলাইকুম বিয়াইনসাহেবা।”
মেহবিন মুচকি হেসে মুখরের দিকে তাকালো। তার মুখটা না দেখা গেলেও মুখর মেহবিনের চোখের হাসি দেখতে পেল। মেহবিন বলল,,
‘ওয়ালাইকুমুস সালাম।”
জবাব দিয়েই সে তার মামার কাছে চলে গেল। ওখানে গিয়ে কথা বলতে লাগলো। এখানে পার্টি শুরু হবে সাড়ে সাতটায়। তাই এখনো কেউ আসেনি। তাই এখনো শুরু হয় নি। মেহবিনের ফোন আসতেই দেখলো আরবাজ ভিডিও কল দিচ্ছে ও একটু অবাক হলেও কি মনে করে একটু দূরে গিয়ে ফোনটা উঠালো। ফোন উঠাতেই দেখলো মিশুকে। একটা পিংক কালারের গাউন পরেছে সে সেই সাথে সাদা হিজাব ও করেছে। হয়তো কেউ করে দিয়েছে। মিশু ফোনের দিকে তাকাতেই দেখল একটা হিজাব নিকাব পড়া মেয়েকে।তা দেখে বলল,,
‘এই তুমি কে? আমার ফুলের ফোন ধরেছো কেন?”
মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,
“ফুল, আমিই তোমার ফুল।”
“তুমি কোথায় ফুল? তোমার আওয়াজ তো শুনতে পাচ্ছি কিন্তু তোমাকে তো দেখতে পাচ্ছি না। এই তোমার ফোন কে ধরে রেখেছে?”
মেহবিন বুঝতে পারলো নিকাব দেখে হয়তো বুঝতে পারছে না। তাই ও বলল,,
“ফোনের মানুষটার চোখের দিকে তাকাও ফুল। তাহলেই বুঝতে পারবে তোমার ফুল কোথায়?”
মিশু সত্যি সত্যি মেহবিনের চোখের দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ পর হেঁসে বলল,,
‘ও তারমানে তুমিই ফুল মুখটা ঢাকা দেখে চিনতে পারি নি।”
‘হুম! কখনো যদি তোমার পরিচিত মানুষকে না চিনতে পারো। তাহলে তার চোখের দিকে তাকাবে। তাহলেই তার চোখ দেখে চিনতে পারবে। মনে থাকবে?
“হুম মনে থাকবে। এখন বলো না আমাকে কেমন লাগছে ফুল?’
‘মাশাআল্লাহ আমার ফুলকে ফুলের মতোই সুন্দর লাগছে।”
মিশু এক হাত দিয়ে চোখে হাত দিয়ে হেঁসে উঠলো। মানে ও লজ্জা পেয়েছে। মিশু হেঁসে বলল,,
“তুমি জানো আজকে ঐ বাজপাখি আমাকে হিজাব করে দিয়েছে। সুন্দর হয়েছে তাই না।”
‘হুম অনেক সুন্দর হয়েছে।”
‘আমাকে কেমন দেখাচ্ছে সেটা জানতেই তো বাজপাখি কে বললাম তোমাকে ভিডিও কল দিতে। আর তো কেউ বলবে না তাই।”
মেহবিন কিছু বললো না শুধু হাসলো। হুট করেই মিশু বলল,,
‘ফুল তোমাকেও অনেক সুন্দর লাগছে। কিন্তু তোমার মুখটা কোথায় একটু দেখি।”
‘আমি তো নিকাব বেঁধেছি তাই দেখতে পারছো না।”
‘আমি তোমায় দেখবো ফুল।”
‘এখন তো আমি একটা অনুষ্ঠানে আছি ফুল।”
‘তুমি কি নিকাব টা খুলতে পারবে না? একটু খুলো না আমি দেখবো তোমায় কতটা সুন্দর লাগছে।”
মেহবিন মিশুর জোরাজুরিতে আর না করতে পারলো না। ও বলল,,
‘আমি রুমে গিয়ে দেখাচ্ছি।”
‘ফোন কাটবে না কিন্তু।”
‘আচ্ছা!”
মেহবিন ফোনটা ধরে যেতে লাগল সবাই ওকে ওপরে যেতে দেখে। তখন মেহরব চৌধুরী মেহবিনকে বললেন,,
“এই মেহু কোথায় যাস?”
‘মামা আসছি একটু রুম থেকে।”
‘এখনি তো পার্টি শুরু হবে।”
“এখনো তো তেমন কেউ আসে নি আমি আসছি।”
বলেই মেহবিন উপরে চলে গেল। মেহবিন রুমে গিয়ে ফোনটা উঁচু করতেই মিশু বলল,,
“তুমি তোমার মামাবাড়ি গিয়েছো ফুল?”
‘হুম!”
মেহবিন ফোনটা ড্রেসিং টেবিলে রেখে নিকাব খুলল। তা দেখে মিশু বলল,,
‘হুম এখন ভালো লাগছে আমি আমার ফুলকে দেখতে পাচ্ছি।”
মেহবিন ফোন ধরে বলল,,
“তোমাদের অনুষ্ঠান শুরু হয়ে গেছে?”
‘হুম হবে আর বাজপাখি ফোন দিয়ে চলে গেছে। আর আমাকে তোমার সাথে কথা বলে নিচে যেতে বলেছে। চলো তোমাকে দেখাই জিনিয়ার জামাইকে আর আমাদের বাড়ি কতো সুন্দর করে সাজানো হয়েছে।”
মেহবিনের পার্টি তেমন ভালো লাগে না তাছাড়া এখনো তেমনভাবে মামার পার্টি শুরু হয়নি তাই ও আর না করলো না। মিশু নিচে চলে এলো সিড়ি দিয়ে নামার সময় সবার নজর ওর দিকেই ছিল কারন ওকে ভিশন সুন্দর লাগছে তারওপর ওর হাসিটা। মেহবিনের সাথে হেঁসে হেঁসে কথা বলছে আবার নিচের দিকেও তাকিয়ে দেখে দেখে আসছে। মিশু শানকে দেখানোর আগে বাড়িটাকে দেখাচ্ছে। মেহবিন ও দেখছে আরবাজ আর শেখ শাহনাওয়াজ মিশুর দিকে এগিয়ে এসেছিল কিন্তু মেহবিন কে কলে দেখে আবার চলে গেছে। সাতটা বেজে গেছে শান আর জিনিয়ার এঙ্গেজমেন্ট হবে এখন। জিনিয়ার বাবা মাইক নিয়ে বলতে লাগলেন নিজের মেয়ে ও হবু জামাইয়ের ব্যাপারে মিশু একদম কর্নারে চলে এসে মেহবিন এখনো কলে আছে । কথা বলতে বলতে একটা মেয়ের সাথে ধাক্কা খেল আর মেয়েটার হাতের জুসটা মেয়েটার ড্রেসেই পরে গেল। মিশু কিছু বলবে তার আগেই মেয়েটা বলল,,
‘পাগল নাকি অনুষ্ঠানের মধ্য বাদরের মতো লাফালাফি করছো কেন? তোমার জন্য আমার কতো দামি ড্রেসে জুস পরে গেল।”
মিশুর জন্য ঐ একটা কথাই যথেষ্ট পাগল। বাকিটা ও শুনেও নি। তবুও আজ যেহেতু সে কিছু বলবে না বলে মেহবিনের কাছে ওয়াদা করেছে তাই ও নিজেকে শান্ত করলো। ও হাত দিয়ে নিচু হয়ে মেয়েটার ড্রেস থেকে হাত দিয়ে ঝাড়তে লাগলো ঝাড়তে গিয়ে একটা পাথর পরে গেল তা দেখে মেয়েটা বলল,,
‘এই পাগল নাকি তুমি? কি করছো হাত দিয়ে কেউ জুস পরিস্কার করে। আমার পাথরটাও ফেলে দিলে।”
মিশু এবার মেয়েটার কথা শুনে কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠলো ও বলল,,
‘আমি পাগল নই আমাকে পাগল বলবে না।”
তখন পাশ থেকে আরেকজন মেয়ে বলল,,
‘পাগলকে পাগল বলবে না তো কি বলবে শুনি।”
“আমি পাগল নই!”
“তুমি পাগল না হলে কেউ অনুষ্ঠানে এসে এতো লাফালাফি করে তোমার থেকে আমাদের বাচ্চাগুলোও শান্ত হয়ে আছে। তুমি এক জায়গায় স্থির হয়ে থাকতে পারছো না। তোমার মতো পাগলকে এই বাড়িতে কে রেখেছে বলো তো। পাগলকে পাগলা গারদে রাখতে হয় বাড়িতে নয়। পাগল একটা!
“আমি পাগল নই একদম আমি পাগল নই”
বলতে বলতেই মিশু মেয়েটাকে ধাক্কা মারলো। মেয়েটা একটা বড় ফুলদানির ওপর পরে গেল সঙ্গে সঙ্গে ফুলদানিটা পরে একটা বিকট আওয়াজ হলো। মিশু হায়পার হয়ে গেছে ও হাতের ফোনটা ফেলে দিয়ে ওখানে থাকা একটা একটা করে সব ভাঙতে লাগলো আর বলতে লাগল,,
‘আমি পাগল নই আমাকে পাগল বলবে না।”
আরবাজ আর শেখ শাহনাওয়াজ দৌড়ে মিশুকে ধরার চেষ্টা করলেন কিন্তু মিশু বেশি হায়পার হয়ে উঠেছে বলে ওকে সামলানো যাচ্ছে না। সবার দৃষ্টি মিশুর দিকে। তখন শেখ শাহেনশাহ বললেন,,
“এহন হইলো তো শাহ তোর মাইয়া সব শেষ দিলো তো! কো হেই ডাক্তার কো ওরে ফোন লাগা বড় বড় কথা কইতেছিল না এহন কি হইলো।”
এমনিতেই শেখ শাহনাওয়াজ মেয়েকে সামলাতে পারছেন না তারওপর বাবার কথাগুলো একদম গায়ে লাগলো তবুও সে নিজেকে সামলিয়ে বলল,,
‘ডাক্তার তার একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানে আছে এখন তাকে বিরক্ত করা ঠিক হবে না। তাছাড়া মিশু আমাদের বাড়ির মেয়ে তাই ওকে সামলানো আমাদের দায়িত্ব।”
‘না আজ আমাগো কোন দায় নাই। আজ সব দায় ঐ মাইয়ার। কল লাগাও ওরে।”
শেখ শাহেনশাহর জোরাজুরিতে শেখ শাহনাওয়াজ কল করলো মেহবিন ফোন ধরে শেখ শাহনাওয়াজ কে বললেন,,
“কিছুই বলতে হবে না। আমি বেরিয়ে পরেছি আসছি আমি।”
বলেই মেহবিন ফোন কেটে দিল। মেহবিন ফোনে সবকিছুই সে দেখছিল সে এমনিতেও মিশুকে অস্বাভাবিক দেখেছে তাই ভাঙচুর শুরু করার সময়ই দৌড়ে নিচে এসেছে আর ওকে দৌড়াতে দেখে সবাই অবাক হয়েছে মেহবিন সোজা মেহরব চৌধুরীর কাছে গিয়ে বলেছে গাড়ির চাবি দিতে এখনি ওকে যেতে হবে। কারন জানতে চাইলে ও মিশুর কথা জানিয়েছে তারা আর কিছু বলেনি বরং মিহিরকে সাথে পাঠিয়েছে। মেহবিন না করেছিল কিন্তু তারা শুনেনি। মেহবিন ও গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পরেছে। মিহির গাড়ি চালাতে চাইলে ও বলেছে নিজেই ড্রাইভ করবে।সে খুব জোরে গাড়ি চালাতে পারে তাই গাড়ির যতো স্পিড ছিল ফুল স্পিডে গাড়ি চালানো শুরু করে দিয়েছে দেড় ঘন্টার ভেতরে চলে আসবে মিশুর বাড়ি।
এদিকে সব কিছু দেখে শানের পরিবার অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। জিনিয়ার বাবা তাদের কাছে গিয়ে মিশুর ব্যাপারে বললেন আর সবকিছুর জন্য মাফ চাইলেন। হাতের কাছে যা ছিল মিশু তা ভেঙে মেঝেতে বসলো আরবাজ গিয়ে বোনকে ধরলো এখন এতোক্ষণ ধরতে পারছিল না এখন তার বোনটা শান্ত হয়ে গেছে। শেখ শাহনাওয়াজ মিশুকে ওপরে নিয়ে যেতে বলল আরবাজ ওকে ওপরে নিতে চাইলে মিশু গেলো না। আর জোর করতে গেলেই ও চিৎকার করে উঠলো। আরবাজ আর চেষ্টা করেনি বোনের হাত ধরে বোনের সাথেই বসে রইল। মিশুর অবস্থা দেখে আরবাজ আর শেখ শাহনাওয়াজ বেশ অবাক হলেন আজ মিশুকে ওনাদের অস্বাভাবিক লাগছে। এরকম অবাধ্য মিশু কখনো হয় না। তবে আজ কেন? মিশুকে সরানো গেল না। শেখ শাহনাওয়াজ শানের পরিবারের কাছে মাফ চাইলো তারা বলল সমস্যা নেই। আজ তো তারা যাচ্ছে না মিশু একেবারে শান্ত হয়ে গেলে তখন না হয় আংটিবদল করা যাবে।
দেড় ঘন্টা পর শেখ বাড়ির দরজা দিয়ে একটা লেহেঙ্গা হিজাব পরিহিতা মেয়েকে ঢুকতে দেখ গেল। সবার দৃষ্টি দরজার দিকেই মেয়েটার চেহারা দেখে কিছু মানুষ অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে রইল । কারন মেয়েটা আর কেউ নয় আমাদের ডক্টর মেহবিন মুসকান। তখন নিকাব খুলেছিল তার পরে তাড়াহুড়োয় আর পড়া হয় নি তাই সবাই মেহবিনের মুখটা দেখতে পাচ্ছে। সে লেহেঙ্গা দুই হাত দিয়ে উঁচু করে এগিয়ে যাচ্ছে মিশুর দিকে। মেহবিনের গায়ে এতো দামি লেহেঙ্গা দেখে আহমেদ পরিবার আরো অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। মিশু এখনো মেঝেতেই বসে আছে চোখ বন্ধ করে। আরবাজ পাশে। মিসেস সাবিনার মেহবিনকে দেখে চোখ ছলছল করে উঠলো। তিনি আগাবে তার আগে মেহবিন গিয়ে মিশুর সামনে বসলো। তা দেখে আরবাজ উঠে গেল। মেহবিন বলল,,
‘ফুল!”
মিশু আস্তে আস্তে চোখ খুললো। মেহবিন ওর চোখটা অস্বাভাবিক লাল দেখতে পেল। মিশু বলল,,
“ফুল তুমি এসেছো?”
মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,
‘একটু পাগল বলাতে তুমি এতো হায়পার হয়ে গেলে। তুমি কি পাগল ফুল?”
মিশু মাথা নাড়িয়ে না বুঝালো তা দেখে মেহবিন বলল,,
“তাহলে পাগলরা পাগল বলাতে হায়পার হয়ে যায় তুমি তো পাগল নও তাহলে হায়পার হয়ে গেলে কেন? আমি তো তোমায় বলেছিলাম তুমি পাগল নও তাই কেউ পাগল বললে তাকে কিছুই বলবে না।”
‘আমি তো শুধু পাগল বলাতেই প্রথমে কিছু করি নি ফুল। ঐ মেয়েটাই তো আমাকে কতোকিছু বলছিল।”
তখন মেহবিন শান্ত স্বরে বলল,,
“তুমি আমাকে সবার সামনে হাড়িয়ে দিলে ফুল। তুমি তো বলছিলে আজ কিছু করবে না তাহলে আজ কি করলে তুমি? সবার সামনে আমাকে ছোট করে দিলে আমাকে সবার কাছে হাড়িয়ে দিলে।”
বলেই মেহবিন দাঁড়ালো আর হাত ভাঁজ করে দাঁড়িয়ে রইলো। মিশু মেহবিনের কথা শুনে কেঁদে উঠলো ও পুরো কথাটা না বুঝলেও এইটুকু বুঝতে পেরেছে মেহবিন কষ্ট পেয়েছে আর ও মেহবিনকে ছোট করেছে। মিশুকে এভাবে কাঁদতে দেখে সবাই অবাক হলো। তার থেকে অবাক হয়েছে মেহবিনের মুখে মুচকি হাঁসি দেখে। মিশু কাঁদতে কাঁদতে মেহবিনের দিকে তাকালো তখন মেহবিন আরেকটু জোরে হেঁসে দিল । তা দেখে মিশু আরো জোরে কেঁদে উঠলো। সব দেখে শুধু শেখ শাহনাওয়াজ নয় সবাই হতভম্ব হয়ে গেল। মেহবিন হেঁসে মিশুকে জড়িয়ে ধরলো আর বলল,,
‘আমার ফুল এতো কিউট কেন বলোতো মিশুমনি? তুমি জানো তুমি কাঁদলে কতোটা কিউট লাগে।”
মেহবিনের কথা শুনে মিশুর কান্না আপনা আপনি থেমে গেল। মেহবিন মিশুর কান্না থামানোর জন্যই বলেছে এরকম কথা। মিশু অবাক হয়ে মেহবিনকে ছাড়িয়ে বলল,,
‘তুমি সত্যি বলছো আমাকে কাঁদলে কিউট লাগে।”
মেহবিন মাথা উপরনিচ করে বুঝালো হ্যা। তারপর বলল,,
‘কাদলে তো কিউট লাগেই কিন্তু হাসলে আরো বেশি কিউট লাগে।”
মিশু হেঁসে বলল,,
‘সত্যি!”
মেহবিন ও হেঁসে বলল,,
‘হ্যা তিন সত্যি!”
মিশু এবার খিলখিল করে হেসে উঠলো। সবাই আরো অবাক হয়ে গেল এই মেয়েটাই একটু আগে মিশুকে কাঁদিয়েছিল আর এখন এই মেয়েটার কারনেই মিশু হাসছে। মেহবিন উঠে দাঁড়ালো ওর দেখা দেখি মিশুও উঠে দাঁড়ালো। মিশুর জুতোর ফিতে খুলে গেছে মেহবিন মিশুকে বলল বসতেই মিশু বসলো তখন মেহবিন ও বসে পা উঠিয়ে জুতোর ফিতে বেঁধে দিল। মিশু খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। এই মুহূর্তটা আরবাজ হেঁসে ক্যাপচার করলো ফোনে। মেহবিন মিশুর হাত ধরে দাঁড়ালো আর সবার উদ্দেশ্যে বলল,,
‘আজ মিশু যা করেছে তার জন্য আমি দুঃখিত। তবে সে যদি সুস্থ মানুষ হতো তাহলে হয়তো কোন কথা থাকতো না আসলে মিশু একটু অসুস্থ। তাই বলে আমরা তাকে পাগল উপাধি দিতে পারি না। কারন সে পাগল নয় সে একটু অবুঝ লাইক পাঁচ বছরের বাচ্চা। এখানে যা হয়েছে সেটার দোষ আমি একা মিশুর ওপর দেব না।”
তখন ঐ মেয়েটা যাকে মিশু ধাক্কা মেরেছিল সেই মেয়েটা বলল,,
“তুমি তো এখানে ছিলে না তুমি কি করে বুঝলে এখানে এই পাগলের দোষ নয়।”
মেহবিন হেঁসে মেয়েটার দিকে এগিয়ে গেল আর ঠাঁটিয়ে একটা চড় মেরে বলল,,
“বললাম না মিশু পাগল নয় তাই ওকে পাগল বলবেন না। এই জন্য এই থাপ্পড় টা দিলাম আর কি। যাই হোক থাপ্পড় মারার জন্য দুঃখিত।
মেয়েটাকে থাপ্পড় মারতে দেখে সকলেই অবাক হয়ে গেল। তারওপর মেহবিনের দুঃখিত বলার জন্য। মেয়েটি গালে হাত দিয়ে ডলতে লাগলো। তখন মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,
“আর যখন ওখানে আপনি ওকে বারবার পাগল বলছিলেন। ওকে প্রলোভিত করছিলেন রাগতে তখন মিশুর ফোনের ভিডিও কলে আমিই ছিলাম তাই ওখানে কি হয়েছে তা নিশ্চয়ই আপনার থেকে জানতে হবে না। আর মিস শিলা আহমেদ?”
হুট করে মেহবিনের মুখে শিলার নাম শুনে শিলা অবাক হয়ে গেল। ও বলল,,
“হ্যা?”
‘মিশুর ধাক্কা লেগে আপনার গায়ে জুস পরে গিয়েছিল তাই না?”
শিলা অবাক হয়েই মাথা নাড়ালো। তখন মেহবিন বলল,,
‘সে কিন্তু তার ভুল বুঝতে পেরে আপনার ড্রেস ঠিকই পরিস্কার করতে গিয়েছিল হ্যা হয়তো টিসু বা কাপড় নেয় নি। কিন্তু কি বলুন তো এটা ওর মাথায়ই আসে নি। যাই হোক সে কিন্তু তার ভুল শুধরানোর চেষ্টা করেছিল কিন্তু ভুলে আপনার পাথর পরে যায়। যাই হোক মিশু ওনাকে সরি বলো।”
মিশু সরি বলল। মেহবিন এবার বলল,,
‘এখন আপনি ওকে পাগল বলার জন্য সরি বলুন।”
শিলা মেহবিনের দিকে তাকালো কিছু বলতে চাইলো কিন্তু মেহবিনের চোখে কি ছিল ওর জানা নেই ও ভয় পেল। ও সরি বলল। এবার ঐ মেয়েটার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে বলল,,
‘মিশু ওনাকে ধাক্কা মেরেছিলে তাই না এখন তুমি তাকে সরি বলো।”
মিশু বাঁধ্য মেয়ের মতো সরি বলল। ওর সরি বলা হলে মেহবিন মেয়েদিকে সবকিছুর জন্য সরি বলতে বলে। মেয়েটা ওর থাপ্পড় খাওয়ার এমনিতেই ভয়ে আছে ও বলল দেখে মেয়েটা তাড়াতাড়ি করে সরি বলে দিল। সবাই সবকিছু দেখে অবাক হলো। মেহবিন শেখ শাহেনশাহ এর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,,
“অন্যের কথা শুনে নিজেদের লোকদের বিচার করা নির্বোধদের কাজ।”
ও আরো কিছু বলবে তার আগেই মেহবিনের ফোনে ফোন এলো। ও ফোন ধরে বলল,,
“আর একটু পর বের হচ্ছি তোমরা তোমাদের কাজ শুরু করে দাও আমাদের আরো ঘন্টাদুয়েক সময় লাগবে পৌঁছাতে। আর হ্যা আমার সাথে আরেকজন স্পেশাল গেস্ট আসছে তুমি তার জন্য চকলেট কেকের ব্যাবস্থা করো আর আনলিমিটেড হাওয়ার মিঠাই সাথে আইসক্রিম।
এইটুকু বলে মেহবিন মিশুর দিকে তাকিয়ে বলল,,
‘ফুল আর কিছু খাবে?”
মিশু হেঁসে বলল,,
“সবকিছু আমার জন্য?”
“হ্যা তোমার জন্য।”
“তাহলে ফুচকাও রাখতে বলো অনেকদিন হলো খাইনা।”
মেহবিন হেঁসে বলল আচ্ছা তারপর ফোনে ওর ফুচকার কথা জানিয়ে রেখে দিল।সকলে এখনো অবাক হয়েই মেহবিনের দিকে তাকিয়ে আছে। এই মেয়েটা ঠিক কি চাইছে কারো মাথাতেই আসছে না। মেহবিন শেখ শাহনাওয়াজ এর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল,,
‘আমায় যেতে হবে এখন আর হ্যা আমি ফুলকেও নিয়ে যাচ্ছি। ও এখানে থাকবেও না আর আপনাদের কাজে ব্যাঘাত ঘটবে না। এইটুকু কথা দিতে পারছি যে মিশু আমার সাথে ঠিকই থাকবে আর হাসিখুশি ও। আপনারা আপনাদের কাজ শুরু করুন।
তখন শেখ শাহেনশাহ বললেন,,
“না আমাদের বাড়ির মেয়ে তোমার সাথে কোথাও যাবে না।”
“আজকে মিশু আমায় দায় তাই আমি যা ইচ্ছা তাই করবো। তাছাড়া মিশু যখন হায়পার হয়ে গেছিল তখন তো আপনি দায় নেন নি সেই আমাকেই আসতে হলো। সেখানে এখন আপনাদের বাড়ির মেয়ে কোথা থেকে আসছে।”
কথাটা শুনে তিনি আর কিছু বললেন না। শেখ শাহনাওয়াজ মেহবিনকে পারমিশন দিয়ে দিল। মেহবিন আগাতেই সাবিনা আহমেদ মেহেবিনের সামনে এসে দাঁড়ালো। মেহবিন মুচকি হেসে মিসেস আহমেদ কে জড়িয়ে ধরে বলল,,
“কেমন আছো মামনি? অনেকদিন পর তোমায় দেখলাম। আসলে তোমাকে প্রথমেই দেখেছি মিশুকে স্বাভাবিক করতে হতো তাই তখন তোমার সাথে কথা বলতে পারি নি।”
সাবিনা আহমেদ কে জড়িয়ে ধরতে দেখে শেখ বাড়ির সকলেই অবাক হলো। মিসেস আহমেদ ও জড়িয়ে ধরে বলল,,
“ভালো তোর খবর বল? এতোদিন কোথায় ছিলি সেই কতবছর পর দেখা।”
“হুম শান ভাইয়ার সাথে জিনিয়ার বিয়ের কথা নাকি?”
‘হুম!”
“আচ্ছা পরে কথা হবে এখন আমায় যেতে হবে।”
মেহবিন ওনাকে কথা না বলতে দিয়ে মিশুর হাত ধরে বাইরে বের হলো। আর একেবারে গাড়ির সামনে নিয়ে দাড় করালো। মিশু গাড়ির সামনে গিয়ে দেখতে পেল একটা ছেলেকে কোর্ট প্যান্ট পরে উল্টো দিকে দাঁড়িয়ে আছে। ওদের অস্তিত্ব টের পেয়েই ছেলেটা পেছনে ঘুরলো ছেলেটার চোখ দেখে মিশু বলল,,
‘এই তুমি কে ? তোমাকে তো আমি চিনি! চিনি আমি তোমায়!”
মিশুর কথায় ছেলেটা হাসলো। তা দেখে মিশু মেহবিনের কথামতো পরিচিত মানুষদের চেনার জন্য ছেলেটার চোখের দিকে তাকালো আর চোখের দিকে গভীর ভাবে তাকাতেই থমকে গেল। আর অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,,
‘অনু!”
~চলবে,,
#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_২৮
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি
মিশুর মুখে অনু শুনে মেহবিন মিহিরের দিকে তাকায়। ও কিছু বলবে তার আগেই মিহির মিশু কে বলল,,
“আমি অনু নই মিস ওর মিসেস? আমি হচ্ছি মিহির, মিহির চৌধুরী আপনার ফুলের মামাতো ভাই।”
এ কথা শুনে মিশু তাড়াতাড়ি করে বলল,,
“না তুমি অনুই?”
‘আমাকে কি আপনার অনুর মতো দেখতে?”
মিশু ভালো করে কিছুক্ষণ মিহিরের দিকে তাকিয়ে বলল,,
‘না কিন্তু তোমার চোখ দু’টো তো অনুর মতো।”
‘একইরকম চোখ তো অনেকের হয়।”
কথাটা শুনে মিশুর হাসিমুখটা মিইয়ে গেল। ও অন্যদিকে তাকালো মেহবিন এসে মিশুর হাত ধরলো। তখন মিহির একটা চকলেট মিশুর দিকে এগিয়ে দিল আর বলল,,
‘আপনার নাকি চকলেট অনেক পছন্দ। নিন আপনি চকলেট খান।”
চকলেট পেয়ে মিশুর মুখে হাসি ফুটে উঠল। চকলেটেই মেয়েটা গলে যায়। ও চকলেট নিয়ে বলল,,,
‘ধন্যবাদ।”
তখন মেহবিন বলল,,
“ফুল এবার যাওয়া যাক। গাড়িতে উঠে বসো এখন। আমাদের জন্য সবাই অপেক্ষা করছে।”
মিশু গাড়ির দিকে তাকিয়ে বলল,,
“আমি কিন্তু সামনে বসবো।”
মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,
‘ঠিক আছে।”
তখন মিহির বলল,,
‘এবার কিন্তু আমি গাড়ি চালাবো মেহু । এইবার আর কোন বারন শুনবো না।”
“আচ্ছা ঠিক আছে ভাইয়া।”
মিহির উঠে বসলো সাথে মিশুও আর পেছনে মেহবিন উঠে বসলো। দরজার সামনে থেকে কয়েকজোরা চোখ ওদের দেখলো। যদিও দূরে হওয়ার জন্য ছেলেটার চেহারা কেউ দেখতে পারে নি। এটা দেখার জন্য শিলাও বাদ যায় নি।
_________________
ঘন্টা দুয়েক পর মেহবিন রা মেহরব চৌধুরীর বাড়িতে পৌঁছে গেল। গাড়ি থেকে নেমে মিশু মিহিরকে বলল,,
“তোমার বাড়ি তো দেখি আমাদের বাড়ির থেকেও বড় আর সুন্দর করে সাজানোও হয়েছে।”
মিহির হেঁসে বলল,,
“আপনার পছন্দ হয়েছে?”
‘হুম খুব খুব।”
মেহবিন মুচকি হেঁসে মিশুর হাত ধরলো আর বলল,,
“ওয়েলকাম টু মামার বাড়ি মিশুমনি।”
মেহবিনের কথা বলার ধরন দেখে মিশু হাসলো। মেহবিন হেঁসে ওকে নিয়ে ভেতরে ঢুকলো। অনুষ্ঠান শেষ শুধু শাহরিয়ার পরিবার রয়েছে আর বাকি সবাই চলে গেছে। মেহবিন বুঝতে পারলো কিসের জন্য শেষ হয়ে গেছে অবশ্য অনেকটা দেরিও হয়ে গেছে। মিশু মুখরকে দেখে ওর দিকে দৌড়ে গেল আর বলল,,
‘পুরোনো বন্ধু নতুন অথিতি তুমিও এখানে আছো?”
মিশুকে দেখে মুখর হাসলো বাকি সবাই অবাক হয়ে মিশুকে দেখতে লাগলো। মুখরের পরিবারের সবাই ওকে চেনে তাই অবাক হয়েছে আর মেহবিনের সাথে দেখে আরো বেশি। মুখর হেঁসে বলল,,
“হুম আমিও আছি দাওয়াত ছিল যে এখানে।”
‘তুমি তো আমাকে ভুলেই গেছো পুরোনো বন্ধু নতুন অথিতি। আমাদের বাড়িতে তো যাওই না এখন।”
“কি বলো তো মিশুমনি তোমার পুরোনো বন্ধু নতুন অথিতি এখন অনেক ব্যস্ত হয়ে পরেছে। তাই যেতে পারি না। কেমন আছো তুমি?
“অনেক ভালো আছি তুমি কেমন আছো?’
“আমিও ভালো আছি।”
তখন মেহবিন বলল,,
“ফুল এদিকে এসো ?”
মিশু মেহবিনের দিকে এগিয়ে গেল। মেহবিন ওর মামার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল। মিশু কেমন করে যেন মেহরব চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে রইল। মেহরব চৌধুরী মিশুর মাথায় হাত দিয়ে বলল,,
“কেমন আছো মিশু?”
মিশু হেঁসে বলল,,
“ভালো আছি আর তুমি আমায় চেনো? আচ্ছা তুমি কে বলো তো? আর আমাকে চেনো কিভাবে?”
“তোমার কথা তোমার ফুল আমাকে বলেছে । আর আমি তোমার ফুলের মামা সেই হিসেবে তুমি আমায় মামা ডাকতে পারো।”
” মামা !”
“হ্যা মামা।”
“তুমি কতো সুন্দর মামা একদম আমার ফুলের মতো।”
মেহরব চৌধুরী হাসলেন আর বললেন,,
“তুমিও অনেক সুন্দর একদম ফুলের মতো।”
মিশুও এবার হাসলো। তখন মেহবিন বলল,,
“তোমরা সবাই খেয়েছো মামা?”
“না সবাই তোদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আমি তো আলভির দাদিকে বললাম ওনারা যাতে খেয়ে নেয় কিন্তু ওনারা বলল তুই আসলে তারপর খাবে।”
মেহবিন একবার আছিয়া খাতুনের দিকে তাকালো উনি এতোক্ষণ ওর দিকেই তাকিয়ে ছিল। ও তাকাতেই তিনি অন্য দিকে ঘুরে গেলেন। তা দেখে মেহবিন হাসলো আর বলল,,
“ওনারা আজ থাকবেন মামা?”
“না চলে যাবেন তোর জন্যই অপেক্ষা করছিল।”
মেহবিন মাহফুজ শাহরিয়ার এর দিকে এগিয়ে গেল আর বলল,,
“সরি বাবা আজ আপনাদের সাথে তেমন কথা হলো না। আসলে ওদিকে বেশ একটা ঝামেলা হয়েছিল তাই যেতে হলো।”
তখন নাফিয়া বলল,,
“তুমি থাকলেও যে আমাদের সাথে অনেক সময় কাটাতে তেমনটাও কিন্তু হতো না মেহু। কারন বাধ্যবাধকতা রয়েছে একজনের। যাই হোক গিল্ট ফিল করার তেমন কারন নেই।সবাই চলে গেল তাই আমরা ভাবলাম তোমার সাথে আবার একটু দেখা করেই যাই। আবার কবে না কবে দেখা হবে। তবে তুমি মিশু আপুকে কোথায় পেলে তাকে আনার জন্যই কি গিয়েছিলে আচ্ছা তোমাদের পরিচয় হলো কিভাবে?
“সে অনেক কথা আপু। এখন বলার সময় নেই। তোমরা খেতে বসো আমি একটু ওপর থেকে আসছি।’
মিশুর কাছে গিয়ে বলল,,
“তুমি কি ফ্রেশ হবে এখন ফুল?”
“না এখন হবো না একদম শোয়ার আগে হবো। এখন হলে আমার সাজ নষ্ট হয়ে যাবে।”
মিশুর কথায় মেহবিন হাসলো আর বলল,,
“ঠিক আছে। তুমি তাহলে সবার সাথে পরিচয় হয়ে নাও ঠিক আছে।”
“হুম হুম!”
মেহবিন ওপরে চলে গেল। তখন আদর মিশুর সামনে হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল,,
“আমি আদর। তুমি যার সাথে এসেছো তার ছেলে আমি।”
মিশু অবাক চোখে আদরের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“তুমি ফুলের ছেলে তাও আবার এতো বড়?
তখন মিহির বলল,,
“না ও মেহবিনের ছেলে নয় আদর আমার ছেলে।”
মিশু মিহিরের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“তোমার ছেলেও আছে। তোমাকে তো দেখে বুড়ো মনে হয় না। তোমার এতো বড় ছেলে কোথা থেকে এলো?”
মিশুর কথায় সকলেই হেঁসে ফেললো শুধু আদর আর মিহির ড্যাব ড্যাব করে মিশুর দিকে তাকিয়ে রইল।
তখন মেহরব চৌধুরী হেঁসে বলল,,
“মিশুমনি এসব বাদ দাও। এখন চলো তোমার মামীর সাথে আর বোনের সাথে পরিচিত হও।”
তখন মিশু বলল,,
‘আরে দাঁড়াও আদরের সাথে তো আগে হাত মিলাই।”
মিশু আদরের সাথে হাত মিলিয়ে জোরে জোরে নাড়াতে লাগলো। আর বলল,,
‘এটা হচ্ছে মিশুর স্পেশাল হাত মেলানো।”
তখন আদর হেসে বলল,,
‘আমার তোমার হাত মেলানো পছন্দ হয়েছে। এবার আমার পালা।
বলে এবার আদর জোরে জোরে হাত নাড়াতে লাগলো। তা দেখে মিশু আর আদর দু’জনেই খিলখিল করে হেঁসে উঠলো। দুজনে হাত ছেড়ে দিতেই মেহরব চৌধুরী মাইশা আর উনার মিসেস এর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। আর মুখর ও সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল নতুন ভাবে। ততক্ষণে মেহবিন নিচে আসলো সকলে ড্রাইনিং টেবিলে বসলো। মেহবিন মিশুকে ওর বাম পাশের চেয়ারে বসিয়ে দিল। আর আদর ওর ডানদিকে বসলো। মেহবিন মিশুর জন্য খাবার বাড়তেই মিশু বলল,,
“তুমি না আমার জন্য চকলেট কেক , হাওয়ার মিঠাই, আইসক্রিম আর ফুচকা রাখতে বলেছো আমি সেগুলো খাবো এগুলো খাবো না।”
“হ্যা খাবে তো। আগে এখন খাবার খাও তারপর রাতে শোয়ার আগে আমরা সব খাবো।”
“সত্যি তো?”
“হুম একদম সত্যি।”
মেহবিন মুচকি হেসে মিশুকে খায়িয়ে দিতে লাগল। কারন ও নিজের হাতে খাবার খেতে পারে না। আদর কে মিহির খায়িয়ে দিচ্ছে তা দেখে মিশু মিহিরের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“তুমিও আমার বাবার মতো তোমার ছেলেকে খায়িয়ে দিচ্ছো। তুমি জানো আমার বাবাও আমাকে সবসময় খায়িয়ে দেয়।”
মিশুর কথা শুনে মিহির হাসলো কিছু বললো না। অতঃপর সবার খাওয়া শেষ হলে। মেহবিন আদরকে বলল মিশুকে পুরো বাড়ি ঘুরিয়ে দেখাতে সাথে মিহিরকে ও পাঠালো। ওরা চলে গেলে মেহবিন আছিয়া খাতুনের কাছে গেল আর বলল,,
“যে মানুষটাকে নিজের নাতবউ হিসেবে মেনে নিতে পারেন নি। তার জন্য এতোক্ষণ অপেক্ষা করলেন?”
আছিয়া খাতুন বললেন,,
“খোঁচা দিতাছো?”
“না তো সত্যি কথা বলছি।”
“বেয়াদব একটা।”
“শুধু আপনার কাছে।”
মেহবিনের কথায় আছিয়া খাতুন মেহবিনের দিকে তাকালেন। মেহবিন মুচকি হেসে তাকিয়ে আছে। আছিয়া খাতুন চোখ নামিয়ে বললেন,,
“তা আজকাল থাকো কোথায়? এ বাড়িতে এসে জানলাম তুমি নাকি কোন সরকারি হাসপাতালে ডাক্তারি করো?
“এতদিন খোঁজ না দিয়ে হঠাৎ আমার খোঁজ করছেন কেন?”
“তুমি বাড়ির বউ খোঁজ নেওয়া লাগবো না।”
“বাড়ির বউ তো তখন হবো। যখন আমি আপনার নাতির বউ হয়ে ঐ বাড়িতে যেতে পারবো।”
আছিয়া খাতুন আর কিছু বললেন না একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। তা দেখে মেহবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,
“তা কেমন আছেন আপনি?”
“ভালো!”
“শুধু ভালো নাকি অনেক ভালো?”
“এই তুমি কি আমার সাথে মশকরা করতেছো?”
“দাদি শাশুড়ি আপনি আমার করতেই পারি।”
“তোমারে আমি ভালো মনে করছিলাম কিন্তু দিনকে দিন তুমি বেয়াদব হয়তেছো।”
“হ খালি আপনার জন্য।”
“তুমি আমারে ভেঙাইতেছো?”
“হ !”
তখন আছিয়া খাতুন জোরে বললেন,,
“ঐ মুখর তোর বউরে সামলা। নাইলে কিন্তু তোর বউয়ের খবর আছে কইয়া দিলাম আমারে তোর বউ ভেঙায়।”
হুট করে আছিয়া খাতুনের এমন কথায় সবাই অবাক হয়ে তার দিকে তাকায়। এতোক্ষণ মেহবিন আর আছিয়া খাতুন সবার দূরে সোফায় বসে কথা বলছিল। ওদের কে কেউ ডিস্টার্ব করে নি। মেহবিন আছিয়া খাতুনের কথায় জোরে হেঁসে উঠলো তা দেখে সবাই আরেকদফা অবাক। মেহবিনের হাঁসি দেখে আছিয়া খাতুন রেগে বলল,,
“ঐ মেহু হাসতেছিস কেন? তুই খালি একবার বাড়ি আয় তোর হাঁসি কেমনে বাইর হয় আমিও দেখুম।”
তখন মেহবিন হেঁসে বলল,,
“হ আমিও দেখুম।”
আছিয়া খাতুন মিছে রাগ দেখিয়ে ওখান থেকে চলে গেলেন। আর ছেলের কাছে গিয়ে বললেন এখনই সে চলে যেতে চাচ্ছে। তা দেখে সবাই মুখ টিপে হাসলো। তখন মুখর আর নাফিয়া মেহবিনের কাছে এলো। নাফিয়া বলল,,
“এখানে কি হয়েছিল?”
মেহবিন হেঁসে বলল,,
“তেমন কিছু না তোমার দাদিজানকে একটু জ্বালাচ্ছিলাম।”
মুখর বলল,,
“বেশ হয়েছে বুড়ি খালি আমাদের জ্বালাবে নাকি আমরাও একটু জ্বালাই।”
“এটা কি রকম কথা পাঞ্জাবিওয়ালা।”
নাফিয়া ওদের রেখে চলে গেল। এখন বাড়ি যাবে সবাই তাই ওদেরকে একটুর জন্য হলেও একা ছেড়ে দিল। নাফিয়া যেতেই মুখর বলল,,
‘তা দাদি শাশুড়ি কে কি বলে জ্বালানো হচ্ছিল শুনি।”
মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,
‘সেটা আমার আর তার ব্যাপার আপনাকে কেন বলবো?”
‘বলবে না কেন?”
“আমার ইচ্ছে তাই ।”
‘তুমি এমন কেন?”
‘কেমন?”
‘একটা জালিম!”
‘ভালো!”
মুখর বুঝতে পারলো এখানে বলে লাভ নেই তাই ও প্রসঙ্গ বদলে বলল,,
“বিহঙ্গিনী তোমায় আজকে অনেক সুন্দর লাগছে মাশাআল্লাহ।”
“আপনাকেও অনেক সুন্দর লাগছে মাশাআল্লাহ।”
“আজ আমি মামাশ্বশুর বাবা থেকে যাই আমার বউয়ের কাছে।”
“আপনার দাদিজান যদি পারমিশন দেয় তাহলে আমার কোন আপত্তি নেই।”
“তার মানে তুমি গ্ৰীন কার্ড দিচ্ছো?”
“আজ আমি ফুলের সাথে থাকবো।”
“এটা কেমন কথা আপত্তি ও করছো না আবার বুঝিয়েও দিচ্ছো থাকা যাবে না।”
মেহবিন মুচকি হাসলো আর বলল,,
“বুদ্ধিমানদের ইশারাই যথেষ্ট।”
মুখর বেচারা একটু ইনোসেন্ট ফেস করে বলল,,
“আমি বুদ্ধিমান না আমি ওতশত বুঝি না আমার বউ থাকতে বলেছে মানে সেটাই অন্য কথা দ্বারা কি বুঝিয়েছে আমি বুঝি নি।”
“তারমানে আপনি বোকা।”
মেহবিনের কথা শুনে মুখর ওর দিকে হা করে তাকিয়ে রইল। তারপর হেঁসে বলল,,
“আমি যদি বোকা হই তাহলে তুমি আমার বউ বোকী।”
বোকী শুনে মেহবিন হাঁসি থামিয়ে তা দিল তা দেখে মুখর আরো জোরে হেঁসে উঠলো। মেহবিন বলল,,
“বোকী এলো কোথা থেকে?আজ আপনার থেকেই প্রথম শুনলাম আর এটার মানেই বা কি?
“বোকার ফিমেল বোকী রাখলাম আমি। এবার কোথায় যাবে শুনি? সবসময় আমাকে কথার জালে ফাসাও আজ আমি ফাসালাম।”
“ফাসালেন কোথায় শুনি উল্টো নিজে নিজের বোকামি প্রকাশ করলেন। অন্যকে ফাঁসাতে হলেও বুদ্ধি দিয়ে ফাঁসাতে হয়। নিজের মন মতো অযৌক্তিক কিছু বললেই হলো নাকি।”
“এবার কিন্তু আমি দাদির কাছে বিচার দেব বলে দিলাম।”
“দেন না তাতে আমার কি? আপনার দাদিকে দেখে আমি ভয় পাই নাকি।”
মুখর কিছু বললো না। হুট করেই মুখর মেহবিনের দিকে তাকিয়ে হেঁসে উঠলো তা দেখে মেহবিন ও হাসলো। মুখর বলল,,
“তোমার সাথে ঝগড়া করেও আলাদা শান্তি আছে। সময়ের ব্যবধানে সবসময় একজন ব্যক্তিত্বসম্পূর্ন মানুষ হতে গিয়ে নিজের বাচ্চামো কে হাড়িয়ে ফেলেছিলাম। তোমার আগমনের মাধ্যমে আবার পূর্নজ্জিবীত করেছি।আর সেটা শুধুমাত্র তোমার কাছেই প্রকাশ পায়। আর তুমিও সেই মানুষ টাকে খুব যত্ন করে সামলে নাও। সবকিছুর জন্য শুকরিয়া তোমাকে আমার বাচ্চামোর সঙ্গী সবথেকে আমার উত্তম জীবনসঙ্গী আমার বিহঙ্গিনী।”
মেহবিন কিছু বললো না মুচকি হাসলো। সবাই তৈরি বাড়ি যাওয়ার জন্য মুখরের পরিবার সবার থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। তখন মিহির ও নিচে এসেছিল আদরের রুমে মিশু আর আদরকে রেখে এসেছে। সবাইকে ফ্রেশ হতে বলে আদরের রুমে যায় ওখানে গিয়ে দেখতে পায় দুজন বালিশ নিয়ে মারামারি করছে। মেহবিন হেঁসে বলল,,
“এখানে কিসের যুদ্ধ চলছে শুনি ?”
মেহবিনের আওয়াজ পেয়ে দু’জনেই থেমে যায়। আদর বলল,,
“আমরা তো যুদ্ধ করছি না। আমরা এমনিই মজা করছি।”
“ওহ আচ্ছা ফুল চলো ফ্রেশ হয়ে নাও।”
মেহবিনের কথা শুনে মিশু মাথায় হাত দিয়ে বলল,,
“আমার তো কোন ড্রেসই আনিনি ফুল। এখন কি পরবো আমি।”
তখন মাইশা একটা জামার সেট এনে বলল,,
“টেনশন করো না মিশু আমার একটা পরে নাও।”
মিশু আর মাইশা সমবয়সী বডিও সেম। তাই সমস্যা হবে না। মেহবিন বলল,,
“প্রবলেম সল্ভ এখন চলো। আর আদর তুমিও ফ্রেশ হয়ে নাও।”
মেহবিন মিশুকে নিয়ে চলে গেল। ফ্রেশ হতে সাহায্য করলো। ও বেরিয়ে দেখল আদর চকলেট কেক নিয়ে বসে আছে। মিশু যেতেই মেহবিন ওটা কেটে সার্ভ মিশুকে আর আদরকে দিল নিজেও নিল। এরপর হাওয়ার মিঠাই আর আইসক্রিম নিয়ে এলো । আর ফুচকা বলল কাল বাড়ি যাওয়ার সময় খাওয়াবে মিশু কিছুই বললো না সব খেয়ে দেয়ে মেহবিনের কোলে শুয়ে পড়লো। মেহবিন মিশুর মাথায় হাত বুলিয়ে দিল ও কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লো। মেহবিন ওকে ভালো করে শুয়িয়ে দিল। ওর ঘুম আসছে না তাই ও ছাদে গেল। ওখানে গিয়ে ওর মামাকে দেখতে পেল দোলনায় বসে আছে। হয়তো তার ও ঘুম আসছে না। ও হেঁটে এগিয়ে গেল আর পাশে দাঁড়িয়ে বলল,,
“এখনো ঘুমাওনি কেন মামা?”
পাশে তাকাতেই মেহবিন কে দেখে বলল,,
“তুই ও তো ঘুমাস নি। আয় বোস।
মেহবিন মেহরব চৌধুরীর পাশে বসলো। মেহবিন বলল,,
“কি এতো ভাবছো? যা তোমায় ঘুমাতে দিচ্ছে না।”
মেহরব চৌধুরী বললেন,,
“আজ মেহের থাকলে তোর জীবনটা এমন হতো না।”
মেহবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,
“হয়তো বা!”
‘মিস করিস?”
“কাকে? মাকে না বাবাকে নাকি ভাইবোন কে নাকি এতো সুন্দর পরিবার কে?”
এটুকু বলে মেহবিন থামলো মেহরব চৌধুরী মেহবিনের দিকে তাকালেন। তখন মেহবিন আবার বলল,,
“মা তো নেই দুনিয়াতে তাই তাকে মিস করাই যেতে পারে। কিন্তু আর বাকি মানুষজন তাদের কি আমার মিস করা উচিৎ মামা?
মেহরব চৌধুরী এবার অসহায় চোখে মেহবিনের তাকালেন আর বললেন,,
‘মেহু!”
‘মাঝে মাঝে মায়ের প্রতি ভিশন অভিমান হয় আমার। সে নিজে তো আমায় ছেড়ে গেলোই সেই সাথে সবাইকেই আমার আড়াল করে দিয়ে গেল।”
‘আর তোর বাবা! তার প্রতি কখনো কি অভিমান হয় না।”
মেহবিন মুচকি হেঁসে আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল,,
‘না তার ওপর অভিমান নেই আমার। আছে এক আকাশ অভিযোগ। সদ্য মা হারা মেয়েটাকে কি সে নিজের কাছে আগলে রাখতে পারতো না।”
~চলবে,,