#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_২৫
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি
‘কিছু বললেন চেয়ারম্যান সাহেব?”
মেহবিনের কথায় শেখ শাহনাওয়াজ এর ধ্যান ভাঙলো। তিনি বললেন,,
“না তেমন কিছুই না। অনেক দিন ধরেই ছেলেপক্ষ চাচ্ছিল এঙ্গেজমেন্ট টা করে ফেলতে শুক্রবার একটা ভালো দিন তাই ঐ দিনটাই সিলেক্ট করলাম।”
“ওহ আচ্ছা!”
“সেদিন আপনি থাকলে ভালো হতো। মিশুকে নিয়ে সমস্যা হতো না। আসলে ও তেমন মানুষজনকে ফেস করতে পারে না ও স্বাভাবিক থাকতে পারে না। ও যদি হায়পার হয়ে সেদিন কিছু করে।”
“তো কিছু করলে কি হবে? আপনার আর আপনার বাবার মাথা নিচু হয়ে যাবে। তার জন্যে আপনার বাবা কারো সামনে ফুলকে আনতে চান না। যে কোন ভালো ওকেশন বা ভালো মানুষজন থাকলে মিশুকে আটকে রাখার নির্দেশ দেন। আপনার কোন আইডিয়া তখন ফুল কি ফিল করে ? একটা পাখিকে যখন প্রথম প্রথম খাঁচায় আটকানো হয় তখন সেই পাখি টা যেভাবে বের হওয়ার জন্য ছটফট করতে থাকে ফুল ও ঠিক তেমনটাই করে। ওর ব্রেনে কতটা চাপ পরে তার ধারনাও আপনাদের নেই। তার জন্য ফুল আরো সুস্থ হতে দেরি করছে।”
শেখ শাহনাওয়াজ অসহায় চোখে মেহবিনের দিকে তাকালেন। কিন্তু আবার অন্যদিকে ঘুরে বললেন,,
“আমি মিশুকে আটকে রাখতে চাই না। কিন্তু ও মাঝে মাঝে এমন পাগলামি করে তার জন্য বাবা ওকে শাস্তি হিসেবে ওকে আটকে রাখেন।”
“বাবার বাধ্য সন্তান হতে যেয়ে নিজের মেয়ের ক্ষতি করবেন না চেয়ারম্যান সাহেব। মেয়েটা আপনার তাই আপনাকেই প্রটেক্ট করতে হবে অন্যরা রক্ত রক্ত বলে ঠিকই চিল্লাবে কিন্তু কেউ তার দায় নেবে না। আপনার মেয়ে তাই দায়টা আপনার।”
“হুম আপনি ঠিক বলেছেন আমার মেয়ের দায় আমার সেই দায়টা অন্য কেউ নেবে না। তবে আমি আবারও বলছি আপনি থাকলে ভালো হতো।’
” সেদিন জিনিয়ার শ্বশুরবাড়ির লোকজনের সামনে ফুল ছিল তো সেদিন তো কোন সমস্যা হয় নি। এঙ্গেজমেন্ট এর দিনও হবে না ইনশাআল্লাহ।”
“সেদিন তো আপনি বলে গিয়েছিলেন যাতে মিশু গুড গার্ল হয়ে থাকে। তাই সে ভালো মেয়ের মতোই ছিল তাছাড়া সেদিন তো তেমন কেউ ছিল না আমরা আমরাই। কিন্তু এঙ্গেজমেন্ট এর দিন অনেক লোক থাকবে তাই চিন্তা হচ্ছে উঁহু আমার সম্মানের জন্য নয়। বরং মিশুর জন্য যদি ওর বাচ্চামোর জন্য ওকে কেউ কিছু বলে দেয়। আর ও নিজেকে সামলাতে না পারে।
“আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি। তবে এখানে আমার কিছু করার নেই আমাকে যেতেই হবে।”
“তাহলে আর কি করার।”
“আপনার বাবা ফুল কে থাকতে দিতে রাজি হয়েছে?”
“আমি এখনো উনার সাথে কথা বলি নি।”
“হুম তার সাথে কথা বলুন। ফুল এই বিয়ে নিয়ে অনেক এক্সাইটেড। যদি ওকে আঁটকে রাখেন তাহলে ওরই ক্ষতি হবে। আর যেটা আমি চাই না। আর হ্যা আমি তার আগে গিয়ে আপনার বাবার সাথে কথা বলবো।”
“হুম আজ আসছি।”
“কিছু খেয়ে যান। বসলেন ও তো না।
“সমস্যা নেই আর আমি খেয়েই বেরিয়েছি। আসি আল্লাহ হাফেজ।”
“হুম আল্লাহ হাফেজ।”
উনি যেতেই মেহবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেহবিন মিশুর অনুষ্ঠানে থাকা নিয়ে কিছু বলতো না। যদি না মিশু ওকে রিকুয়েস্ট করতো। মিশু জিনিয়ার বিয়ের কথা শুনেই মেহবিনের কাছে বলেছে সে সবসময়কার মতো ঘরে আটকা থাকতে চায় না তার অনেক কষ্ট হয়। সে ভালো মেয়ের মতোই চুপ করে থাকবে কিছুই করবে না তাও মেনে ওকে যেন অনুষ্ঠানে থাকতে দেয়। এক পর্যায়ে গিয়ে মিশু কান্নাই করে দেয় তার জন্য মেহবিন ওকে বলেছিল সে ব্যবস্থা করবে। কথাটা শুনে মিশু যে কতটা খুশি হয়েছিল তা বলার মতো না। খুশিতে মেহবিন কে জড়িয়েও ধরেছিল।
অনেক দিন পর আজ সকাল দশটার দিকে”কাব্যের বিহঙ্গিনী” পেজ থেকে নতুন পোস্ট করা হয়েছে।
“যেকোনো পরিস্থিতিতে খুব ভেবে চিন্তে এমনভাবে সিদ্ধান্ত গ্ৰহন করা উচিৎ। যাতে পরিস্থিতি প্রতিকূলে গেলেও জীবনে বিরুপ প্রভাব না পরে।”
পোস্ট টা করার পরেই বেশিরভাগ প্রশ্ন ছিল এটা, এতদিন সে কোথায় ছিল? আর তারপর কমেন্ট সবথেকে বেশি ছিল ঠিক বলেছেন, সহমত ইত্যাদি। হাজার খানেক লাইক শ খানেক কমেন্ট আর শেয়ার ও হয়েছে। পোস্ট টা আরবাজ আর মুখরের চোখ ও এড়ালো না।
দুপুরের দিকে মেহবিনের ফোনে কি যেন করছিল তখন একটা নোটিফিকেশন এলো। নোটিফিকেশন টা অন করতেই দেখলো বিহঙ্গিনীর কাব্য আইডি থেকে নতুন পোস্ট হয়েছে। সেখানে লেখা,,
“সে বোধহয় জানতো তার জীবন তার প্রতিকূলেই চলতে চায়। তাই তো সে এমনভাবে সব সিদ্ধান্ত গ্ৰহন যে প্রতিকূল থাকা সিদ্ধান্তগুলোও তার অনুকূলে চলে আসে। কি বলবো সবাই তো আর বিহঙ্গিনীর মতো এতো বুদ্ধিমতি নয়।”
মেহবিন বুঝতে পারলো এখন লাঞ্চ টাইম চলছে তাই এখন পোস্ট করা হয়েছে। মেহবিন মুচকি হেঁসে লিখলো,,
“জীবন তো একটাই তাইনা তাই প্রতিটা পদক্ষেপ একটু ভেবেচিন্তেই নেওয়া উচিৎ সবার।”
ওপাশ থেকে তৎক্ষণাৎ রিপ্লাই আসলো,,
“হুম তাই তো খুব ভেবেচিন্তে বিয়ে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। তাই তো দেখো আজ পরিস্থিতি প্রতিকূলে তবুও জীবনে খুব একটা বিরুপ প্রভাব পড়ছে না।”
“আমাকে বিয়ে না করে অন্য কাউকে বিয়ে করলে হয়তো আপনার জীবন আপনার প্রতিকূলে যেতো না। আচ্ছা আপনার কি আফসোস হয় কখনো?
“এখনো অব্দি কখনো হয়নি। তবে এখানে সবথেকে বড় কথা এটা নিয়ে আফসোস এর কিছু নেই। এটা আমাদের তকদিরে ছিল তাই হয়েছে।
আমার তকদিরে তুমি আর তোমার তকদিরে আমি ছিলাম বলেই আজ আমরা হতে পেরেছি।”
“হুম সেই জন্যই আমারও কখনো রিরুপ কিছু মাথায় আসে নি। কারন আমি আমার রবকে বিশ্বাস এবং ভরসা করি। জীবনে কি হলো না হলো সেটা নিয়ে আফসোস বহুদিন আগেই ছেড়ে দিয়েছি। জীবন সবসময় প্রতিকূল পরিস্থিতিতেই থাকে আমার জীবন অনুকূলে আনা আমাদের সিদ্ধান্তের ওপর ডিপেন্ড করে।”
ওপাশ থেকে কিছুক্ষণ রিপ্লাই আসলো না। মেহবিন ভাবলো হয়তো আর আসবে না। তাই সে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। কিন্তু তার কিছুক্ষণ পরেই আবার কমেন্ট এর রিপ্লাই হলো,,
“তাহার রবের প্রতি এতো ভরসা, বিশ্বাস আর ভালোবাসাই আমাকে তাহার প্রতি বারংবার মুগ্ধ করে।”
মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,
“পৃথিবীর সকল দরজা বন্ধ হলেও ঐ একজনের দরজা কখনো বন্ধ হবে না। তার বান্দার প্রতি তার অসীম দয়া। তিনি তার বান্দার সবকিছুই লক্ষ্য করেন এবং দেখেন। যদি কখনো কোন বান্দা আকাশের দিকেও তাকায় তখন আল্লাহ তায়ালা বলেন,,
“আকাশের দিকে তোমার বার বার তাকানোকে আমি অবশ্যই লক্ষ করি!”
(সূরা বাকারা – ১৪৪)
তাহলে বলুন আমরা আল্লাহর তায়ালার ওপর ভরসা করবো না তো কাকে ভরসা করবো। মানুষ মানুষকে কখনো কখনো ভালোবেসে ধোঁকা খায় কিন্তু আল্লাহ কে ভালোবাসলে কখনো ধোঁকা খাবে না। আল্লাহ তায়ালা বলেন ‘তার কোন বান্দা যদি তার দিকে এক পা আগায় তিনি(আল্লাহ) তার বান্দার দিকে দশ পা আগান।
“নিশ্চয়ই আল্লাহ তায়া’লা ধৈর্যশীল দের সাথে আছেন’
যে ব্যক্তি আল্লাহর উপর তাওয়াক্কুল করে, তার জন্য আল্লাহ-ই যথেষ্ট”
~সূরা তালাক-২-৩
ওপাশ থেকে হাসির ইমুজি ওয়ালা একটা রিপ্লাই আসলো। তার সাথে লেখা “আল্লাহ তায়ালা সবাইকে হেদায়েত দান করুক আর তার ওপর তাওয়াক্কাল করে জীবন যাপন করার তওফিক দান করুক।”
মেহবিন মুচকি হেসে লিখলো,,
‘আমিন।”
_____________
বিকেলে মুখর আসলো তবে আজ সিভিল ড্রেসে নয় আর মুখে মাস্ক ও নেই। আজ পুলিশের ইউনিফর্ম পরা। মেহবিনের বাড়ির দিকে পুলিশ আসতে দেখে সবাই এগিয়ে এলো। মুখর তা দেখে একটু অবাক হলো। ও গেটের কাছে এসে দাড়াতেই একজন জিজ্ঞেস করল,,
‘ছার আপনে এনে কিসের জন্য আইছেন? কেউ কি কিছু করছে ছার?
মুখর বুঝতে পারলো পুলিশ দেখে সবাই একটু ভয় পেয়েছে আর একটু কৌতূহলও আছে সবার মনে। তবে ওনার মুখে ছার শুনে মুখর বুঝতে পারলো স্যার হিসেবেই ডেকেছে। মুখর হেঁসে বলল,,
‘না কেউ কিছু করে নি। আসলে সেদিন মারামারি হলো না ডাক্তারের সাথে সেই লোকগুলো কে তো ধরা হয়েছে। তাই কিছু জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ডক্টর মেহবিন এর কাছে এসেছি।”
আর কেউ কিছু বললো না। মুখর ভেতরে ঢুকলো বাকিরা সবাই চলে গেল একজন বাদে পুলিশ মানেই গ্ৰামের মানুষদের কাছে ভয়ের। সবাই চলে গেল তবে একেবারে গেল না বাড়ির ভেতরে ঢুকে লুকিয়ে দেখতে লাগলো। মুখরের সাথের একজন মেহবিনকে ডাকলো মেহবিন আর তাজেল বের হলো রুম থেকে। স্কুল থেকে ফিরেই সে মেহবিনের কাছে চলে এসেছে। মেহবিন মুখর কে দেখে বুঝতে পারলো ওর সাথে দেখা করার জন্যই এসেছে এমনিতেও সকালে বলেছিল। লোকটা মুখরের কথা জানিয়ে চলে গেল। মেহবিন মুখর কে নিয়ে ঘরে ঢুকালো না ও দেখতে পেয়েছে রাস্তার ওপাশ থেকে ওদের দেখছে তাই ও বারান্দায় দুইটা চেয়ার আনলো। মুখর কে বসতে বলল। মুখর বসতেই তখন তাজেল বলল,,
‘পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা তুমি এইহানে কি করতে আইছো?”
তাজেলের কথায় মুখর হেঁসে বলল,,
“তোমার ডাক্তাররে দেখতে এসেছি।”
“কিছু আনো নাই ডাক্তারের লাইগা? তোমার হাতে তো ফলটল কিছু দেহি না। তুমি জানো না অসুস্থ মানুষ রে দেখতে আইলে ফল আনা লাগে।”
তাজেলের কথায় মুখর ওর দিকে হা করে তাকিয়ে রইল। আর মেহবিন মুচকি হাসলো। কিছুক্ষণ ভেবে মুখর বলল,,
“আগে তুমি বলো এখানে কেন এসেছো?”
তাজেল হেঁসে বলল,,
‘ডাক্তাররে দেখতে।”
‘তুমি কি এনেছো তোমার ডাক্তারের জন্য।”
তাজেল আর মেহবিন বুঝতে পারলো মুখর তাজেলকে পিন্স মারছে। তাজেল ও কম যায়না সে দাঁত কেলিয়ে বলল,,
“আমি ছোট মানুষ কি আর আনুম তাও আমি বরই আনছিলাম। জিগাও ডাক্তার রে।”
তখন মেহবিন বলল,,
‘হুম হুম নেত্রী কিন্তু আমার জন্য আজ বরই এনেছিল। কিন্তু আপনি কিছুই আনেন নি। আবার আমাকে দেখতে এসেছেন।”
তখন মুখর বলল,,
“ওহ আচ্ছা। তাহলে কি আমাকেও কিছু আনতে হবে?”
তখন তাজেল বলল,,
‘হ হ আনতে হইবো। অসুস্থ মানুষরে দেখতে আইছো কিছু আনো নাই এইডা ভালো কথা না।”
“তাহলে তো আনতেই হয়। ঐ দেখো গেট এ কেউ একজন আসছে।”
তাজেল আর মেহবিন দু’জনেই সেদিকে তাকালো। সত্যিই একজন আসছে হাতে বড় একটা বক্স। মুখর মেহবিন কে এগিয়ে যেতে বলল মেহবিন লোকটার থেকে বক্সটা নিয়ে এলো। লোকটা মুখরের দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে চলে গেল। মেহবিন ওটা এনে বারান্দায় রাখলো। তখন মুখর বলল,,
“এই যে সব এসে গেছে নেত্রী। আমি জানি আমি এ বাড়িতে আসলে সবাই যেভাবেই হোক দেখবে আমি যদি নিজের হাতে কিছু নিয়ে আসি তাহলে অনেকেই অনেক কিছু মনে করবে। তাই অন্য একজনের হাত দিয়ে নিয়ে আসলাম। আর হ্যা এখানে শুধু ফল না আরো অনেক কিছু আছে তোমার জন্য এক বক্স চকলেট ও আছে। আমি যাওয়ার পর তোমার ডাক্তারের থেকে নিয়ে নিও।”
তাজেল হেঁসে বলল,,
“আইচ্ছা তুমি তো দেহি খুব চালাক পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা।”
“একটু চালাক না হইলে কি তোমার ডাক্তাররে বিয়া করতে পারতাম নেত্রী।”
” তুমি তো দেহি আমার মতো কথা কওয়া শুরু করছো পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা।”
“হ তোমার কথা আমার ভাললাগছে তাই। তা কেমন আছো দুজন?
মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো!”
‘আমায় জিজ্ঞেস করবে না কেমন আছি?”
তখন তাজেল বলল,,
“তুমি ভালো আছো দেইহাই এনে আইছো তাই ডাক্তার জিগাস করে নাই।”
“এই তোমরা দুজন কি আমার সাথে মজা করছো?”
মেহবিন আর তাজেল দুজন দুজনের দিকে তাকালো আর একসাথে হেঁসে মাথা নাড়িয়ে বলল না আবার একে অপরের দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়িয়ে বলল হ্যা।এর মানে মুখর বুঝলো দু’জনে মিলে ওকে বোকা বানাচ্ছিল। মুখর হেঁসে বলল,,,
“তা আপনারা দুজন কি অতিথি আপ্যায়ন করেন না নাকি? কেউ বাড়িতে আসলে নাস্তা দিতে হয় এইটুকু ভদ্রতা নেই নাকি?
মুখরের কথা শুনে মেহবিন ভেতরে গেল আর একটা প্লেটে খাবার সাজিয়ে নিয়ে এলো। মুখর হেঁসে ফেললো তারপর তিনজনে আরো কিছুক্ষণ কথা বলল। ওদের কে কেউ কেউ দেখছে বলে মুখর তাড়াতাড়ি চলে গেল। তবে কেউ ওরা কি কথা বলেছে সেটা শুনতে পায়নি। এরপর মেহবিন মুখরের দেওয়া বক্সটা নিয়ে নিজের ঘরে ঢুকলো। বক্সটা খুলতেই সবার প্রথমেই একটা গোলাপ ফুলের তোড়া দেখতে পেল। সেটার ওপরে লেখা বিহঙ্গিনীর সাথে সাক্ষাতের জন্য। তার নিচে দুটো চকলেট বক্স একটা তাজেলের আরেকটা মেহবিনের। তার নিচে কয়েক রকমের ফল। তার নিচে মেহবিনের ফ্রেবারিট চিপস বিস্কুট। এগুলো দেখে তাজেল বলল,,
‘ পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা দেহি তোমারে মেলা ভালোবাসে ডাক্তার।”
মেহবিন কিছু বললো না শুধু মুচকি হাসলো। তারপর তাজেলের জন্য আনা চকলেট বক্স ওর হাতে দিল সাথে চিপসের প্যাকেট আর বিস্কুট ও দিল।
________________
“‘আপনি নাকি ফুল মানে মিশুমনিকে অনুষ্ঠানে থাকতে বারন করেছেন?”
মেহবিনের কথায় শেখ শাহেনশাহ মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“তো কি করমু পাগল কে অনুষ্ঠানে নিজেদের মান সম্মান ডুবামু নাকি।”
“মিশু পাগল নয় ও একটু অবুঝ আর কিছু না। ”
‘এতো বড় দামরা মাইয়ার কাজ যদি পাঁচ বছরের পুলাপাইন এর মতো হয় তাইলে কি চলবো। তারে তো সবাই পাগলই বলবো তাই না। তাই মান সম্মান খুয়ানোর জন্য ওরে অনুষ্ঠানে রাখুম না।
“কোনদিন রেখেছেন কোন অনুষ্ঠানে যে বুঝবেন ও আপনার মান সম্মান ডুবাবে নাকি।”
‘আমাদের পারিবারিক বিষয়ে তোমার না কথা কওয়াই ভালো।”
‘আমি তো আপনাদের পারিবারিক বিষয় নিয়ে কিছু বলছি না শুধু মিশুকে নিয়ে বলছি। মিশু জিনিয়ার বিয়ে নিয়ে অনেক এক্সাইটেড তাই ওকে আটকে রাখবেন না।”
‘অনুষ্ঠানে কিছু হইলে তুমি তার দায় নিবা। তাছাড়া তুমি তো শুনলাম ঢাকায় যাইবা ওরে সামলাইবো কি রা?”
এ কথা শুনে মেহবিন একবার শেখ পরিবারের সদস্যদের তাকালো। মিশু ওর হাতটা শক্ত করে ধরলো। পাগল বলার পরও ও কিছু বললো না কারন মেহবিন বলেছে একটা কথাও না বলতে তাই সে চুপ করে আছে। পুরশুদিন শুক্রবার আর জিনিয়ার এঙ্গেজমেন্ট। তাই আজ এসেছে শেখ শাহেনশাহ এর সাথে কথা বলতে। কাল রাতেই শেখ শাহনাওয়াজ জানিয়েছেন তার বাবা রাজি নয় মিশুকে অনুষ্ঠানে রাখতে তাই আজ এসেছে হাসপাতাল থেকে সোজা এখানে। বাড়িতে এসে সবাইকেই পায় শুধু আরবাজ আর ওর কাকা মামা ছাড়া। মেহবিন সবার শেষে মিশুর দিকে তাকালো।তখন মিশু ফিসফিস করে মেহবিনের কানে কানে বলল,,,
“আমি গুড গার্ল হয়ে থাকবো কিছু করবো না প্রমিস।”
তা শুনে মেহবিন শেখ শাহেনশাহ এর দিকে তাকিয়ে বলল,,,
“আমি না থাকলাম তবুও ওকে থাকতে দিন। কিছু হলে আমায় ফোন করবেন আমি চলে আসবো মিশুকে সামলাতে।”
“তোমার কথা শুইনা ওরে রাখতেছি কিছু হইলে তোমার দায় কিন্তু। আর মিশু যদি পাগলামি করে তাইলে এরপর থেইকা আর কোন অনুষ্ঠানেই ওরে রাখা হইবো না।”
শেখ শাহেনশাহ এর কথা শুনে মেহবিন হাসলো সাথে দুজনের মুখেও হাঁসি ফুটে উঠলো তারা হলো শেখ শাহনাওয়াজ আর মিশু। মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,,
“আচ্ছা।”
এরপর মেহবিন সবার থেকে বিদায় নিয়ে বাড়ির পথে রওনা দিল। বাড়ির সামনে আসতেই দেখলো নওশি দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে মেহবিন বলল,,
“নওশি তুমি এখানে?”
‘আপনার জন্যই অপেক্ষা করছিলাম।”
‘কেন?”
‘তাজেল,,”
তাজেলের কথা শুনে মেহবিন তাড়াতাড়ি করে বলল,,
“কি হয়েছে নেত্রীর?”
‘জানিনা কলেজ থেকে আসার পর দেখলাম চুপচাপ শুয়ে আছে। পরে শুনলাম স্কুলেও যায়নি। আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম ও কিছুই বলেনি। ওভাবেই নাকি সকাল থেকে সারাদিন না খেয়ে শুয়েছিল। জোর করেও কেউ ওঠাতে পারে নি। পরে শুনলাম ওর,,
তাজেলের অবস্থা শুনেই মেহবিন তাজেলের বাড়ির দিকে হাঁটা ধরল। নওশি আর কিছু বলার সুযোগ পেল না তাই মেহবিনের পেছন পেছন চললো। মেহবিন যখন যাচ্ছে তার নেত্রীকে ঠিক সামলে নিতে পারবে তাই ভেবেই নওশি একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো।
~চলবে,,
#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_২৬
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি
মেহবিন তাজেলের বাড়িতে পৌঁছে দেখলো তাজেলের মা আর ভাইবোন তাদের বারান্দায় বসে কি যেন করছে। ও এক পলক সেদিকে তাকিয়ে তাজেলের ঘরে গেল। নওশি যা বলেছিলো তাই ও শুয়ে আছে চোখ বন্ধ করে। মেহবিন তাজেলের পেটের সামনে ওখানে চকিতে বসলো আর তাজেলকে আলতো ডাক দিল,,
“নেত্রী!”
তাজেল আস্তে করে চোখ খুললো। মেহবিন তাজেলের কপালে হাত দিয়ে চেক করলো জ্বর হয়েছে কি না। না জ্বর নেই। তাই ও বললো,,
“কি হয়েছে আমার নেত্রীর ? সে নাকি সারাদিন না খেয়ে শুয়ে আছে।”
তাজেল মেহবিন কে দেখে উঠে বসলো। ততক্ষণে নওশিসহ তাজেলের সৎমাও ঘরে ঢুকেছে। তাজেল কিছু বলছে না দেখে মেহবিন ওর গালে হাত রেখে বলল,,
“নেত্রী কি হয়েছে? তোমার ডাক্তারকে বলবে না?”
তাজেলের চোখটা মুহূর্তেই ছলছল করে উঠলো। তা দেখে মেহবিন একপ্রকার থমকে গেল। এরকম টা ও তাজেলকে কখনো দেখেনি। মেহবিন ওর গালে হাত রেখে হাতের বুড়ো আঙুল দিয়ে দিয়ে চোখের নিচে ডলে দিতে লাগলো। তাজেলের কান্না আর বাঁধ মানলো না ও কেঁদে উঠলো। আর মেহবিনকে জরিয়ে ধরলো। তাজেল মেহবিন কে জরিয়ে ধরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগলো। হুট করে এমন কান্না দেখে মেহবিন ভরকে গেল সেই সাথে নওশিও । তাজেলের সৎমাও যে অবাক হয়েছে সেটা তার মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। এদিকে তাজেলের কান্না শুনে আশেপাশের সকল মহিলারা চলে এলো। ঘরে ঢুকেই সবাই দেখলো তাজেল মেহবিন কে জরিয়ে ধরে কাঁদছে। মেহবিন তাজেলের মাথায় হাত বুলিয়ে শান্ত করার চেষ্টা করছে। কিছুক্ষণ পর তাজেল কান্না শেষ করে শান্ত হলো। মেহবিন কিছু বললো না ওকে। ওকে কোলে তুলে তাজেলের সৎমায়ের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“তাজেলকে আমি আমার সাথে নিয়ে যাচ্ছি। ও আজ আমার সাথেই থাকবে।”
তখন তাজেলের মা মুখ বাঁকিয়ে বলল,,
“তোমাগো এত রঙঢঙ কিসের বুঝি না বাপু। যেনে ইচ্ছা হেনে যাক। দরকার পরে আমার জীবন থেইকা একেবারে চইলা যাক। আমি একটু বাঁচি!
তাজেলের সৎমায়ের কথা শুনে তাজেল মেহবিনকে আরো শক্ত করে জরিয়ে ধরলো। মেহবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো মানুষ এরকম হয় কিভাবে এমনিতেই দেখছে মেয়েটা কাঁদছে তারওপর এরকম কথা। মেহবিন নওশিকে বলল,,
“নওশি আমার ব্যাগটা একটু আমার বাড়িতে দিয়ে আসতে পারবে?”
মেহবিনের কথা শুনে নওশি বলল,,
“পারমু না কেন ডাক্তার আপা।আমি এখনি যাইতেছি।”
মেহবিন আর কোন কথা না বলে তাজেলকে কোলে নিয়ে বের হলো। সবাই ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে ও কারো তোয়াক্কা না করে বাড়ি চলে এলো। নওশি ব্যাগ দিয়ে চলে গেল। মেহবিন তাজেলকে বিছানায় বসিয়ে দিল । তাজেল ও বাধ্য মেয়ের মতো বসলো। ও ফ্রেশ হয়ে বের হলো। তখনি মাগরিবের আজান শোনা গেল মেহবিন আজানের জবাব দিয়ে তারপর তাজেলকে বলল,,
“নেত্রী যাও ওযু করে এসো। আমরা একসাথে মাগরিবের নামাজ আদায় করবো। ”
মেহবিনের কথা শুনে তাজেল বিছানা থেকে নেমে ওয়াশরুমে চলে গেল। ওযু করে আসলে মেহবিন বড় একটা ওরনা দিয়ে ওর হিজাব বানিয়ে দিল। মেহবিনের কাছে এক্সট্রা জায়নামাজ ছিল সেটাই ওর পাশে বিছিয়ে দিল। তারপর তাজেলের হাত ধরে জায়নামাজে দাড় করিয়ে দিল। দুজনে একসাথে নামাজ আদায় করলো। নামাজ শেষে তাজেল লম্বা একটা মুনাজাত করলো। মেহবিন ওর জন্য অপেক্ষা করতে করতে তসবিহ শেষ করে নিল। দু’জনের হয়ে গেলে মেহবিন জায়নামাজ দুটো গুছিয়ে রাখলো। এই মুহূর্তে তাজেলকে অনেক স্নিগ্ধ লাগছে। ও ওরনা খুলে মেহবিন কে দিতে চাইলে মেহবিন বলল থাক খুলতে হবে না। তাজেল আর কিছু বললো না চুপ করে বিছানায় বসে রইল। মেহবিন তাজেলের সামনে বসে বলল,,
“আমার নেত্রীকে নীরবতা মানায় না। তাকে সর্বদা চঞ্চলতায় মানায়।”
তাজেল মেহবিনের কথায় ওর দিকে তাকালো। মেহবিন ওর হাত ধরে বলল,,
“কি হয়েছে নেত্রী?”
“আজ সকালে মা আইছিল ডাক্তার!”
তাজেলের কথায় মেহবিন একটু অবাক হয়। তবুও বলে,,
“কি করতে এসেছিল তোমায় দেখতে নাকি তোমায় নিতে?”
“আমি জানি না।”
“মানে? এতো বছর পর সে কেন এখানে এলো?”
“আবার সংসার করার লাইগা।”
“আমাকে ক্লিয়ার করে বলো তো?”
“আমার মায় আমার বাপের কাছে ফিরা আইছে। হেয় নাকি তার ভুল বুঝবার পারছে যে আমার বাপ তারে কতো ভালোবাসতো। আমারে নাকি হেয় অনেক ভালোবাসে তাই নাকি আমাগো ছাড়া এহন হে থাকবার পারবো না। তাই সব ছাইড়া চইলা আইছে আমাগো কাছে।”
“তারপর?”
“আমার বাপ তো আর তারে কোনমতেই উডাইবো না বাড়ি। আমার সৎমায়েও যাচ্ছে তাই কইয়া মুখ করছে। তারা সবাই মিলা কাইজা(ঝগড়া) করে। এক পর্যায়ে মা কয় আমারে আমার সৎমায় আদর করেনা বকা বাজি করে আমার জন্য হইলেও জানি মায়রে থাকতে দেয়। তহন আমার বাপ কয়টা কথা কইছিল আমারে নাকি দরকার পরলে বেইচা দিব নাইলে কাইটা নদীতে ফালাই দিবো। আমারে তার দরকার নাই। আমি কেন মরি না তাইলে তার সংসারে অশান্তি হয় না। আমি নাকি আমার সৎমায়রে জালাই আমি মরলে ভালো হইবো। আমার জন্য নাকি আবার মায়রে রাখবো। এই কথা হইনা আমার মায় চইলা গেছিল আর আসে নাই পুরা দিনে।সবাই ভাবছে আমি কিছু হুনি নাই কিছু দেহি নাই তোমার কাছে প্রাইভেট পরতে আইছি। কিন্তু আমি সব দেখছি সব শুনছি তাই তো তহন কানবার পারি নাই তহন আর বাড়িও যাই নাই পরে গেছিলাম।
তুমি বিশ্বাস করো ডাক্তার। আমার বাপের ঐ কথাগুলা শুইনা আমার মনে হইছিল আমি চোহে আন্দার দেখতেছি। তহন আমি কানবার পারি নাই ডাক্তার। খালি মনে হইতেছিল আমার বাপ আমারে মরার কথা কইছে এতোদিন কেউ না থাকলেও হেই মানুষ টা দিনশেষে খবর নিতো হেই মানুষটাও আমি থাহায় ভালো নাই। কিন্তু আমার বাপ কতো ভালো এর আগে এতকিছু কইছে আমারে নিয়া কিন্তু আমি বাড়ি যাওয়ার পর আমারে জিগাইছিলো আমি স্কুলে যামু নাকি আমার টাকা লাগবো নাকি। কিন্তু হেই ভালোকথা গুলাও আমার মন খারাপ দূর করতে পারে নাই আমার কানে তো একটু আগের কওয়া কথা গুলা বাজতেছিল।
বলতে বলতেই তাজেল আবার কেঁদে উঠলো। মেহবিন এক হাত দিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরলো কিন্তু কিছু বললো না। কাদুক একটু হালকা হোক। পুরোটা দিন এই কান্নাগুলো আঁটকে রেখেছিল। মেহবিন বুঝতে পারলো না ওর মাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই এসব বলেছে নাকি মন দিয়ে থেকে। তবে পরে যেহেতু ভালোভাবেই কথা বলেছে সেহেতু ওর মনে হচ্ছে ওর মাকে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্যই বলেছে। কিন্তু এটা তো তাজেলের মাথায় ঢুকবে না এখন তবে ঢুকাতে হবে এখন না হয় পরে। তবে এইটুকু বয়সে এতটা ম্যাচুরিটি এসেছে এটা বোধহয় বাস্তবতা থেকেই হয়েছে এগুলোই ভাবলো কিছুক্ষণ। একটু শান্ত হতেই মেহবিন বলল,,
“তোমার বাবা তোমার মায়ের ওপর রাগ করেই ওগুলো বলেছিল যাতে সে চলে যায়। মন থেকে সেসব বলেনি যদি বলতো তাহলে পরে আর তোমার স্কুলে যাওয়ার কথা টাকা নেওয়ার কথা বলতো না।”
“আমি কিছু শুনবার চাই না ডাক্তার। তুমি আমারে কিছু কইয়ো না এহন।”
“আইচ্ছা কিছু না কইলাম এহন তুমি বসো তো একটু কিছু খাইয়া নও।আমি খাবার গরম কইরা নিয়ে আসি। দেহো তো তোমার ভাষা ঠিক আছে নাকি নেত্রী।
মেহবিনের গ্ৰাম্য ভাষা শুনে তাজেল একটু হাসলো আর বলল,,
“তোমার ভুল হইছে ডাক্তার তুমি বসো তো একটু হইবো না। হইবো, বইসা থাহো ইটু, আর নিয়ে আসি হইবো না নিয়া আসি। ”
“যাক অবশেষে নেত্রীর মুখে হাসি ফুটে উঠল।”
তাজেল হেঁসে বলল,,
“নও এহন রান্দুন ঘরে আমার মেলা খিদা লাগছে সারাদিন কিছু খাই নাই।”
মেহবিন হেঁসে ওকে একটা চকলেট দিল। আর বলল,,
“আপাতত এটা খাও। আমি পাঁচ মিনিটে আসছি।”
মেহবিন রান্না ঘরে চলে গেল। তাজেল ও চকলেট খেতে খেতে পেছন পেছন গেল। মেহবিন খাবার গরম করলো। তারপর একটা প্লেটে বেরে রুমে নিয়ে এলো। তাজেলের হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলল,,
“নাও এখন খাওয়া শুরু কর?”
“তুমি খাইবা না?”
“না আমি পরে খাবো এখন খিদে নেই।”
“ওহ আচ্ছা।
তাজেল একবার খাবারের দিকে তাকালো আবার মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“আমার মায় আবারো আমারে ধোঁকা দিছে ডাক্তার। আর সাতে এইবার মনে অয় আমার বাপ ও আমারে তাড়াতাড়ি ধোঁকা দিব।
এই ধোকার মানে মেহবিন বুঝলো ছেড়ে গেছে বোঝাতে চেয়েছে তাজেলের কাছে এটাই ধোঁকা। মেহবিন কিছু বললো না তখন তাজেল আবার বলল,,
“তুমি কহনো আমারে ধোঁকা দিও না ডাক্তার। তুমি জানো আল্লাহর কাছে এতোবড় মুনাজাতে কি চাইছি? চাইছি তুমি জানি আমারে কোনদিনও ধোঁকা না দাও।”
তাজেলের এমন কথা শুনে মেহবিন থমকে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। এ কয়েকদিনেই মেহবিন ওর কতোটা কাছের হয়ে গেছে এটা ও উপলব্ধি করতে পারছে। নরমালি একটা মানুষের এরকম কথা শুনে ইমোশনাল হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু মেহবিনের চেহারার তার রেশ মাত্র নেই কারন সে কঠোর ব্যক্তিত্বসম্পূর্ন একজন মানুষ। যাকে কেউ কাঁদতে দেখেনি। তাজেল না খেয়ে ভাত নাড়াচাড়া করছে দেখে মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,
“নেত্রী আমি তোমায় খায়িয়ে দিই?”
তাজেল মেহবিনের দিকে তাকিয়ে বলল,,
“তুমি আমার জবাব দিলা না। আমারে কোনদিন ধোঁকা দিবা না তো?”
মেহবিন জবাব দিতে পারলো না ও নিজেও জানে না এই প্রশ্নের উত্তর কি হতে পারে। ও প্লেট টা নিয়ে খাবার মেখে তাজেলের সামনে ধরে বলল,
“খেয়ে নাও এখন আর কোন কথা না।”
“ডাক্তার তুমি!”
“নেত্রী আমি কি বললাম তোমায়। এখন খেয়ে নাও।”
তাজেল আর কিছুই বললো না। চুপচাপ খেয়ে নিল। তারপর তাজেলকে জিজ্ঞেস করল কার্টুন দেখবে কি না। ও বলল দেখবে মেহবিন কার্টুন ছেড়ে দিল। আর ওর সাথে বসে কার্টুন দেখতে লাগলো। তখন ও শুনতে পেল বাইরে থেকে কেউ মেহবিন কে ডাকছে। ও তাজেলকে ঘরে রেখে বারান্দায় এলো। তখন দেখলো তাজেল এর দাদি আর বাবা এসেছে। ও নিচে আসলো। তখন তাজেলের বাবা বলল,,
“তাজেল কি ঘুমাই গেছে?”
মেহবিন মুচকি হাসলো ও বুঝতে পারলো মেয়ের খোঁজেই এসেছে। ও বলল,,
“না কার্টুন দেখছে।”
“ও নাকি সারাদিন খায় নাই ও কি কিছু খাইছে?”
“যে বাচ্চাটাকে বেঁচে দিতে চেয়েছেন নাহলে কেটে নদীতে ফেলে দেবেন বলেছেন। তার জন্য হঠাৎ এতো দরদ।”
মেহবিনের কথায় তাজেলের বাবা আর দাদি দুজনেই চমকায়। তাজেলের বাবার চোখ ছলছল করে ওঠে লাইটের আলোয় মেহবিন তা স্পষ্ট দেখতে পায়। ও বলল,,
“চিন্তা করবেন না তাজেল খেয়েছে?”
“ও কি সব শুইনা ফালাইছে?”
মেহবিন শান্ত স্বরে বলল,,
“হুম যার জন্য ও সারাটাদিন চুপ চাপ শুয়ে ছিল। আর আমাকে দেখেই কেঁদে দেয়। তবে ওর মায়ের এখানে আসায় ওর মধ্যে কোন প্রভাব পরেনি প্রভাব পরেছে আপনার কথায়।”
কথাটা শুনেই লোকটা কেঁদে উঠলো আর বলল,,
“আমি মন থেইকা ওরে কিছু কই নাই। যাতে ওর মায়রে না উঠান লাগে এই জন্য আমি কইছি। আমি ওর মায়রে মেলা ভালোবাসতাম সে আমার ভালোবাসার মুল্য দেয় নাই। এহন ফেরত আইছে যহন আমি আরেকজনরে লইয়া সংসার করতেছি তাজেলের সৎমায় সতিনের মেয়েরেই সহ্য করতে পারে না হেনে সতিনরে করবো কেমনে। আমি তাজেলরে মেলা ভালোবাসি তাই তো ওর সৎমায়ের এতো কথা হুইনাও আমি ওরে আমার সামনে রাহি । দিনশেষে যহন কাম কইরা আমি বাড়ি আসি তখন ওর চেহারা দেখলেই আমি মনে শান্তি পাই। হেই জন্যই বাড়ি আইসা আমি রাইতে ওর খবর নেই। আমি জানি আমি মাইয়ার জন্য ভালো কিছু করবার পারি না। তবে আমি চাই করবার কিন্তু ওর সৎমায়ের জন্য পারি না। তাজেলের ভালো করার নিগা আমি বিয়া করছিলাম কিন্তু বুঝিনাই বিয়া কইরা ওর ভালো না খারাপ কইরা ফালাইছি। ও আমারে কতোদিন ধইরা আব্বা ডাকে না খালি কয় আমার বাপ। আমি তাজেলরে মেলা ভালোবাসি কিন্তু ভালোবাসা দেখাইতে পারি না।”
তখন মেহবিনের পেছন থেকে শোনা গেল ,,
“আব্বা!”
বলেই তাজেল দৌড় দিল আর সোজা ওর বাবার কোলে উঠে পরলো। তাজেলের বাবা ওকে ধরে কেঁদে উঠলো। আর বলল,,
“আমারে মাফ কইরা দিস তাজেল।”
তাজেল কিছু বললো না শক্ত করে ওর বাবাকে ধরে রইলো। এখানের সবকিছুই শুনেছে সে মেহবিনের পেছনেই বেরিয়েছিল সে ওর বাবাকে দেখে আগায় নি। কিন্তু যখন দেখলো ওর বাবা কাঁদছে তখন আর থাকতে পারলো না। তাজেলের বাবা কান্না থামিয়ে ওকে জরিয়ে ধরলো। তখন তাজেল বলল,
“আমি আব্বার সাতে বাড়ি গেলাম ডাক্তার আবার কাইল সকালে আসমুনি।”
মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,
‘আচ্ছা!”
তাজেল ওর বাবার সাথে চলে গেল। মেহবিন হাসলো তাজেলদের দেখে কিন্তু ঘরে ঢুকতেই মেহবিনের হাঁসি গায়েব হয়ে গেল। ওর হুট করেই অস্থির লাগছে ভিশন। ও মেঝেতেই শুয়ে পরলো হাত পা ছড়িয়ে। দৃষ্টি ওপরের দিকে। কিছুক্ষণ পর মেহবিন অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,,
‘আপনি কি তাজেলের বাবার মতো নিজের কাছে রেখে আগলে রাখতে পারতেন না আমায় বাবা?”
প্রশ্নটা আজকে তার বাবার কাছে করতে ইচ্ছে করছে ভিশন। কিন্তু চাইলেও কি সবসময় সব হয়। মেহবিন একটু কান্না করতে চাইছে কিন্তু পারছে না কারন ও কাঁদতে জানেনা মায়ের কাছে যে কথা দিয়েছিল সে কখনো কাঁদবে না। বারবার কষ্ট পেয়েও না কাঁদতে কাঁদতে এখন কাঁদতে ভুলে গেছে সে। এক শক্ত খোলস দ্বারা নিজেকে আবৃত করেছে। কিছুক্ষণ পর আবার ও বলে উঠলো,,
“আমি ভিশন একলা মানুষ
নিজের ভেতরেই আমার আটকে থাকা।
কেউ কি কখনো বুঝতে পারে
আমার ভেতরে কতোটা কষ্ট ঢাকা।”
‘আমার একাকিত্বের শহরে কখনো অশ্রুর বৃষ্টি আসুক। সাথে খুব বেগে ঝড় উঠুক যাতে সব কষ্টগুলো ধুয়ে মুছে সাফ হয়ে যায় আমার একাকিত্বের শহর।”
_________________
আজ বৃহস্পতিবার আজকেই হাসপাতাল থেকে ফিরে মেহবিন তার মামার বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হবে। আদর বলেছে একদিন আগেই যেতে হবে নাহলে নাকি সে তার সাথে কথা বলবে না আরো কতোগুলো ইমোশনাল ব্ল্যাকমেল করেছে সাথে ওর মামামামি মামাতো ভাইবোনেরাও যুক্ত হয়েছে। শেষমেষ ওর আর কি করার ও রাজি হয়েছে। মেহবিন বাড়ি এসে ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নিল। তাজেলকে বলেছে সে আজ যাবে তাই তাজেল অপেক্ষা করছে। সেদিনের পর থেকে তার বাবার সাথে তার সম্পর্ক অনেকটাই ভালো হয়েছে। এখন ওর সৎমা কিছু বলতে পারে না তাজেলকে ওর বাবা কড়া করে কতোগুলো কথা বলেছে আর এটাও বলেছে তাজেলকে যেন খারাপ কথা না বলে। তাজেলের থেকে বিদায় নিয়ে ও রিক্সায় উঠলো ট্রেনে করেই যাবে সে। অতঃপর স্টেশন গিয়ে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করতে লাগলো। ট্রেন আসলে ট্রেনে উঠে পরলো। গন্তব্য তার ঢাকা অতঃপর তার মামার বাড়ি।
_________________
“এ কি মিস নাফিয়া আপনি এখানে? একাই এসেছেন নাকি?”
কারো কথায় নাফিয়া পেছনে তাকায়। পেছনে তাকিয়ে আরবাজ কে দেখতে পায়। আরবাজ কে দেখে ও বলল,,
“আরে মিস্টার শেখ! আপনি শপিং মলে তাও আবার গার্লস সেকশনে?”
“আমি আগে প্রশ্ন করেছি মিস?”
“হুম আর আমি একা নই নিসা আর আলভি ভাইয়াও আছে। ওরা ওদের মতো শপিং করছে আর আমি আমার মতো। এখন আমার প্রশ্নের উত্তর দিন?”
“মিশুর জন্য ড্রেস আর জুতো কিনতে এসেছি। কিন্তু কোনটা নেব বুঝতে পারছি না। ও বলেছে সুন্দর দেখে একটা ড্রেস নিতে।”
মিশুর কথা নাফিয়া বলল,,
“মিশু আপু এখন কেমন আছে?”
“আছে আগের থেকে একটু বেটার। আমায় একটু হেল্প করবে?”
নাফিয়া আরবাজের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে বলল,,
“আপনার মতিগতি আমি বুঝি না কখনো আপনি বলেন কখনো তুমি ?
“আসলে কি বলো তো তোমায় প্রথমে ভাবি তুমি একজন সফল উদ্যোক্তা তাই আপনি বলি। পরে মনে পরে আরে তুমি তো আমার বন্ধুর ছোট বোন তাই । এখন বলো তো আমায় হেল্প করবে কি না?
“মিশু আপুর জন্য যেহেতু সেহেতু হেল্প করাই যায়।”
‘কেন অন্যকারো জন্য হলে কি করতে না?”
‘আপনার গার্লফ্রেন্ড এর জন্য হলে করতাম না।”
“আস্তাগফিরুল্লাহ নাউযুবিল্লাহ মেয়ে বলে কি? আমি কেন হারাম রিলেশনশিপ এ জড়াতে যাবো । যেখানে কিনা আমার আল্লাহ আমার জন্য একজন জীবনসঙ্গী কে নির্বাচিত করে রেখেছেন সেখানে আমি কেন অন্যজনের প্রতি আবেগ দেখিয়ে আমার জীবনসঙ্গীর হক নষ্ট করবো।আমি তো আমার সব আবেগ ভালোবাসা সব আমার হালাল নারীর জন্য রেখেছি। বুঝেছেন ম্যাডাম?”
আরবাজের কথা শুনে নাফিয়া হা করে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে তারপর বলে,,
“হুম বুঝলাম আর আপনাকে কখনো কিছু বলবো না আমি।”
‘কেন? কেন?”
“আমি এক লাইন বললে আপনি দশ লাইন শুনিয়ে দেবেন। তাছাড়া এখানে আমি একটা এক্সামপেল দিয়েছি আর আপনি তো পুরো… যাই হোক চলুন মিশু আপুর জন্য শপিং করে দিই।”
আরবাজ আর কিছু বললো না। নাফিয়ার সাথে যেতে লাগলো। কিছুক্ষণ পর আলভি আর নিসার সাথেও দেখা হলো। আরবাজ আলভি কে বলল,,
“কাল অনুষ্ঠান আর আজ এসেছো শপিং করতে। কি কাজে ব্যস্ত ছিলে শুনি দুলহারাজা?”
তখন আরভি হেসে বলল,,
‘কি আর বলবো বলো! কাল কাল করতে করতে সেই অনুষ্ঠানের আগের দিনই আসতে হলো। আমাদের শপিং তো শেষ শুধু নাফিয়ার টা হচ্ছে না। একটা গাউন পছন্দ করেছে কিন্তু কি রঙের নেবে বুঝতে পারছে না।”
তখন আরবাজ নাফিয়ার দিকে তাকিয়ে বলল,,
“যাদের মন এতো পবিত্র তাদের শুভ্র রঙেই মানাবে ভালো।”
তখন নিসা বলল,,
‘একদম পারফেক্ট রঙ বলেছো আরবাজ ভাইয়া। আর নাফি আপুকে তো সবথেকে সুন্দর শুভ্র রঙেই লাগে।”
আরবাজ কিছু বললো না শুধু হাসলো সবাই মিলে শপিং করলো। আরবাজকে সাহায্য করার জন্য আরবাজ নাফিয়া কে একটা শুভ্র রঙের হিজাব গিফট করলো। প্রথমে না করলেও পরে নিতেই হলো নাফিয়া কে। ওরা চারজন মিলে কফিও খেল। কথায় কথায় জানতে পারলো আরবাজ এখনি বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেবে। আরবাজ মুখরের পরিবারকেও দাওয়াত করেছিল কিন্তু মন্ত্রীসাহেবের বাড়ি যেতে হবে বলে মানা করেছে মুখররা। আরবাজ ওদের কে একদিন যেতে বলে চলে গেল। ওরাও নিজেদের মতো বাড়ি চলে গেল।
________________
আজ শুক্রবার আজ সন্ধ্যা সাতটায় জিনিয়ার এঙ্গেজমেন্ট হবে। জিনিয়ার হবু জামাইয়ের নাম শান আহমেদ। সন্ধ্যায় সবাই চলে এলো। শেখ শাহনাওয়াজ শেখ শাহেনশাহ সবাই মিলে ওদের ওয়েলকাম করলো। নতুন কিছু মুখ দেখে জিনিয়ার বাবা বললেন,,
“এই নতুন মানুষদের তো চিনলাম না মিস্টার আহমেদ!
শানের বাবা হেঁসে বললেন,,
“উনি হচ্ছে আমার ভাই আলম আহমেদ আর উনি তার স্ত্রী সাবিনা আর ও হলো তাদের একমাত্র মেয়ে শিলা আহমেদ।”
~চলবে,,