কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-১৭+১৮

0
448

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_১৭
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

মেহবিনের কথায় মুখর হাসলো। আর বলল,,

‘Or Kitne Intezer Or Kitne Sabr Karu!”

মেহবিন হেঁসে বলল,,

‘অপেক্ষা করতে করতে কি আপনি ক্লান্ত হয়ে পরেছেন?”

“তার অপেক্ষার যদি সারাজীবন ও অপেক্ষা করতে হয় তবুও ক্লান্ত হবো না। তাছাড়া তুমি এমন একজন মানুষ যার ওপর আমার মুগ্ধতা কখনো হাড়ায় না। সবথেকে বড় কথা
“আল্লাহ মানুষের উপর তার সাধ্যাতীত কোনো দায়িত্ব চাপিয়ে দেন না!”
~সূরা বাকারা~২৮৬
এবং
ধৈর্য্য মানুষকে ঠকায় না,
বরং উত্তম সময়ে শ্রেষ্ঠ উপহার দেয়।
[সূরা যুমার – ১০]
আমিও সঠিক সময়ের অপেক্ষায় আছি। ইনশাআল্লাহ শেষটা সুন্দর হবে।

মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“বিচ্ছেদ এমনভাবে হয়েছে যে গন্তব্যটাই বদলে গেছে। তার সাথে একজন মানুষকেও নিরবে বদলে দিয়েছে। যে মানুটা অপেক্ষা করতে জানতো না ধৈর্য্য ধরতে কষ্ট হতো। তার এখন সারাজীবন অপেক্ষা করতেও দ্বিধাবোধ হচ্ছে না।”

মুখরের চোখটা ছলছল করছে । ও বলল,,

“মাওলানা তারেক জামিল একটা কথা বলেছিলেন,

এমন ভাবে বিচ্ছেদ হয়েছে যে গন্তব্য বদলে গেছে। একজন মানুষ পুরো শহরকে নিশ্চুপ করে দিয়েছে।”

এ কথা শুনে মেহবিন ঘুরে দাঁড়ালো তখন মুখর বলল,,

“আমায় একটু জড়িয়ে ধরবে বিহঙ্গিনী?”

মেহবিন আবার মুখরের দিকে ঘুরে দাঁড়ালো আর মুচকি হেসে মুখরের একদম কাছে গিয়ে দাঁড়ালো। মুখর চোখে অশ্রু আর মুখে হাসি নিয়ে মেহবিন কে জড়িয়ে ধরলো। আর বলল,,

“তোমায় খুব ভালোবাসি বিহঙ্গিনী। আমি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার আগ পর্যন্ত তোমার সাথে থাকতে চাই।”

বলতে বলতেই মেহবিনের কাঁধে মুখরের দুই ফোঁটা পানি পরলো। মেহবিন স্থির চোখে সামনের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছুক্ষণ পর মুখর ওকে ছেড়ে দিয়ে কপালে একটা চুমু দিয়ে বলল,,

‘নিজের খেয়াল রেখো আসছি! আল্লাহ হাফেজ ফি আমানিল্লাহ!”

মেহবিন মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল,,

“ইনশাআল্লাহ। আপনিও নিজের খেয়াল রাখবেন। আল্লাহ হাফেজ।”

বলেই মেহবিন ফোনের টর্চ জ্বালিয়ে হাঁটা ধরলো। পেছনে একবার ফিরে তাকালোও না মুখর সেদিকে তাকিয়ে রইল। সে কেন তাড়াতাড়ি করে একবার ও পেছনে না তাকিয়ে চলে গেল তা মুখর ভালো করেই জানে। ও গেট দিয়ে ঢোকা না পর্যন্ত তাকিয়ে রইল মুখর বাড়ির ভেতর ঢুকতেই মুখর গাড়ি নিয়ে চলে গেল। মেহবিন বাড়ি এসে ফ্রেশ হয়ে কাযা সালাত গুলো আদায় করে নিল। তারপর বিছানায় বসে ফোন স্কল করতে লাগলো।
_____________

“সে সব ছাড়ে কিন্তু ভালোবাসার মানুষের প্রতি মায়া ছাড়তে পারে না। কাউকে বলতেই পারে না শুধু এক চিলতে হাসি মুখে বিদায় নেয় সেই স্থান। কি অদ্ভুত ভালোবাসা তার। সে তার এই ছবির মতোই ঝাঁপসা তাকে দেখে মনে হয় ইশশ যদি তাকে একদম ভালোভাবে বুঝতাম।”

পোস্ট টা পাঁচ মিনিট আগে করা হয়েছে বিহঙ্গিনীর কাব্য এর আইডি থেকে। সাথে অনেক দূরের একটা ঝাঁপসা ছবি। কালো বোরকা হিজাব নিকাব মাথায় ক্যাপ পরা আর ক্যাপের ওপরে সোনালী রঙের কিছু জ্বলজ্বল করছে। পোস্ট টা চোখে পরতেই মেহবিন লিখলো,,

“তবুও তো সবসময় বুঝে ফেলেন।”

“বুঝতে পারলাম আর কই?”

“পারলেন না বুঝি?”

“বুঝতে পারলেও কিছু করতে পারি না। তাহলে সে বুঝতে পারার মূল্য রইলো কোথায়?”

“কি করতে পারলেন সেটা বড় কথা না বুঝতে পারাটাই বড় কথা।”

“বুঝতে পেরে কিছু না করতে পারার মতো ব্যর্থতা আর কিছুই হয় না।”

“বুঝতে পারেই বা ক’জন। এখনকার সময়ে ভুল বোঝাটা সহজ কিন্তু একটা মানুষের পরিস্থিতি এবং একজন মানুষ কে বুঝতে পারা সবথেকে কঠিন । সেখানে আপনি অনায়াসেই বুঝতে পারেন এটা আপনার অর্জন।”

ওপাশ থেকে কোন রিপ্লাই এলো না। তার কিছুক্ষণ পর বিহঙ্গিনীর কাব্য আইডি থেকে আরো একটা পোস্ট হলো দু’জনের একটা কাপল ছবি যেখানে কাব্য তার বিহঙ্গিনীর দিকে তাকিয়ে আছে। তার ক্যাপশনে লেখা।

“আমি আবারও চাই প্রেমে পড়তে! কিন্তু অন্যকারো নয় শুধু তোমার। আমি আবারও চাই প্রেমে পরতে উঁহু একবার নয় আমি বারবার পরতে চাই শুধু তোমার। আমার একান্তই ব্যক্তিগত শুধু তোমার।’

পোস্ট টা দেখতেই মেহবিনের মুখে হাসি ফুটে উঠল। সে মুচকি হেসে লিখলো,,

“তো পড়ুন না মানা করেছে নাকি কেউ?’

ওপাশ থেকে রিপ্লাই আসলো,,

“না মানা করেনি আর কেউ মানা করলেই আমি শুনবো নাকি?”

“হ্যা সেটাও ঠিক।”

“আজকের দিনটা সবথেকে ভালো দিনের মধ্যে একটা ছিল।”

“ইনশাআল্লাহ আপনার রোজ রোজ এমন ভালো দিন আসুক।”

“আমিন।”

________________

“নিয়মিত তাকে ভালোবাসুন যাকে ভালোবেসে ঠকবেন না। তাকে ভালোবাসুন যে আপনার জন্য অপেক্ষা করে কখনো ক্লান্ত হয় না। তাকে ভালোবাসুন যে কখনো আপনার দিকে মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত হয় না। তাকে ভালোবাসুন যার ভালোবাসা আপনাকে মুগ্ধতায় আটকে থাকতে বাধ্য করে।”

পোস্ট টা কাব্যের বিহঙ্গিনী পেজ থেকে করা হয়েছে। এতক্ষন মুখরের এটা নিয়ে আফসোস থাকলেও এখন নেই। এখন আফসোস এর ওখানে মুখে ফুটে উঠেছে এক তৃপ্তির হাঁসি। কতোগুলো লাভ রিয়াক্ট কমেন্ট শেয়ার হয়েছে। ফেসবুকে বেশ জনপ্রিয় একটা পেজ কাব্যের বিহঙ্গিনী। কিন্তু কখনো এই নামের আড়ালের মানুষটাকে কেউ দেখেনি এমন কি তার নাম ও জানে না কেউ।

____________

রাত নয়টা এমন সময় মেহবিনের ফোনে চেয়ারম্যান সাহেব এর একটা কল এলো। মেহবিন ফোন ধরে সালাম দিল,,

“আসসালামু আলাইকুম!”

ওপাশ থেকে চেয়ারম্যান সাহেব এর কন্ঠ শোনা গেল।

“ওয়ালাইকুমুস সালাম। আপনি আজ আসেন নি কেন?

“আমার পার্সোনাল কিছু কাজ ছিল। সন্ধ্যার পর বাসায় এসেছি।”

“ওহ আচ্ছা। কিন্তু আপনার জন্য মিশু রাগ করে আছে। সারাদিন আপনার অপেক্ষায় ছিল।”

মেহবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ওর মনে ছিলনা মিশুকে বলতে।ও বলল,,

“মিশু ওখানে আছে?”

“হ্যা আমরা সবাই ড্রয়িংরুমে ও সোফায় বসে আছে। সে রাতে খায় ও নি।”

“একটু ওর কাছে যান আমি কথা বলছি।”

“আচ্ছা ঠিক আছে।”

শেখ শাহনাওয়াজ মিশুর কাছে গেলেন আর বললেন,,

“মিশু দেখো তোমার ফুলবন্ধু ফোন করেছে।”

মিশু ওর বাবার দিকে তাকিয়ে ফোনটা কানে নিয়ে বলল,,

“কেউ যেন আমার সাথে কথা বলতে না আসে। আমি সারাদিন তার অপেক্ষায় ছিলাম সে আসেনি কেন?”

মিশুর কথা শুনে মেহবিন একটু হাসলো। কথা বলবে না তবুও নিজের কাছে ফোন নিয়ে নিয়েছে। মেহবিন হেঁসে সালাম দিল,,

“আসসালামু আলাইকুম!”

মিশুর কোন আওয়াজ পাওয়া গেল না। তাই মেহবিন বলল,,

“সালামের জবাব দেওয়া ওয়াজিব। সালাম শুনে তার জবাব না দিয়ে একটা মুসলিম কখনো চুপ থাকতে পারে না।”

তখন মিশু বলল,,

“ওয়ালাইকুমুস সালাম।”

“কেমন আছো ফুল?”

“ফুল কে?”

“তুমি!”

“উঁহু আমি ফুল না, আমি মানুষ। বাবা বলেছে তুমি হলে ফুল।”

“আজ থেকে আমি তোমায় ফুল বলে ডাকবো।”

“কয়েকদিন ধরে ফুল বলে তো আমি তোমায় ডাকি।’

“তাতে কি আমিও ফুল বলেই ডাকবো।”

“আমাদের দুজনের নাম তাহলে সেইম সেইম হলো।”

“হুম আমাদের সেইম সেইম নাম। এখন বলো রাতে খাওনি কেন?

“তুমি আসো নি তাই আমি তোমার ওপর রাগ করেছি।”

‘তা কি করলে রাগ ভাঙবে?

‘কোন কিছুই করলে রাগ ভাঙবে না।”

“কাল যদি আমি অনেকক্ষন তোমার সাথে থাকি তবুও রাগ ভাঙবে না।”

মেহবিনের এ কথা শুনে মিশু খুশি হয়ে গেল আর বলল,,

‘সত্যি ফুল তুমি সত্যি কাল আমার সাথে অনেকক্ষন থাকবে।”

“হ্যা অনেকক্ষন থাকবো। এখন তুমি খেয়ে নাও।”

“আচ্ছা খেয়ে নেব। আচ্ছা কাল কখন আসবে তুমি? তুমি আসলে একজনের সাথে তোমার পরিচয় করিয়ে দেব।”

“কার সাথে ফুল?”

“সেটা সিক্রেট তুমি আগে আসো তো? আর হ্যা কাল তোমার আরেকটা ছোট বন্ধু আছে না কি যেন নাম তুমি যাকে নেত্রী বলো তাকেও নিয়ে এসো ও খুব ভালো আমার কতো যত্ন করলো।”

“ওর নাম তাজেল। শেখ তাজেল!”

‘হ্যা হ্যা তাজেল ওকেও নিয়ে এসো কাল আমরা অনেক খেলবো।”

‘আচ্ছা ঠিক আছে। রাখছি আল্লাহ হাফেজ।”

“আল্লাহ হাফেজ।”

মেহবিন ফোনটা রেখে দিল। আর ভাবতে লাগলো কার সাথে মিশু ওর পরিচয় করিয়ে দেবে। এদিকে সবাই শেখ শাহনাওয়াজ আর মিশুর দিকে তাকিয়ে আছে। নুপুর বললেন,,

‘মেয়েটাকে নিয়ে আপনাদের দুজনের বাড়াবাড়িটা একটু বেশি না খালুজান।”

এ কথা শুনে মিশু বলল,,

‘ঐ নুপুর ডাক্তার তুমি চুপ থাকো। তুমি কোন কথা বলবা না।”

তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“আমার মেয়ের যা ইচ্ছে হয় তাই করুক নুপুর তোমার কোন কথা না বলাই ভালো।”

“আসলে আমি তেমন কিছু মিন করিনি। আঙ্কেল আপনাদের কথা বাদই দিলাম মেয়েটার বা কি রাগ করেছে ওর ওপর তাতে ওর কি? মেয়েটাও মিশুকে এমনভাবে ওর সাথে কথা বলে যেন ওর পরম আত্মীয়। মিশু যাই করুক না কেন রেগে থাকুক জোরে কথা বলুক কতটা নম্র ভাবে সবসময় মিশুর সাথে কথা বলে। এটা সত্যি ভালো নাকি নিজের স্বার্থের জন্য ভালো হওয়ার নাটক করছে সেটাও তো চিন্তার বিষয় নাহলে জানা নেই শোনা নেই একটা মেয়ে এতো ভালো হবে নাকি। এখনকার সময়ে কাউকেই বিশ্বাস করা যায় না।”

শেখ শাহনাওয়াজ হেঁসে বললেন,

“তা যায় না তবে মেয়েটাকে যতদূর দেখেছি ততটুকু কে বুঝেছি মেয়েটা সবসময় আলাদা সত্যতা নিয়েই চলাচল করে। কাউকে দেখানোর জন্য সে কিছু করে না। কারন হয়তো মেয়েটা জানে ,

আয়েশা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘আল্লাহ কোমল, তিনি কোমলতাকে ভালবাসেন। আর তিনি কোমলতার প্রতি যত অনুগ্রহ করেন, কঠোরতা এবং অন্য কোন আচরণের প্রতি তত অনুগ্রহ করেন না’।
মুসলিমের অপর এক বর্ণনায় আছে, একদা রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আয়েশা (রাঃ)-কে বলেন, ‘কোমলতা নিজের জন্য বাধ্যতামূলক করে নাও এবং কঠোরতা ও নির্লজ্জতা হতে নিজেকে বাঁচাও। কারণ যাতে নম্রতা ও কোমলতা থাকে তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি হয়। আর যাতে কোমলতা থাকে না, তা দোষণীয় হয়ে পড়ে’ (মুসলিম, মিশকাত হা/৫০৬৮)।

কিন্তু আফসোস সবাই এটা মানে না। যাই হোক মিশু চলো খেয়ে নাও এখন।”

‘হ্যা বাবা চলো আমার খুব খুদা লাগছে।”

“হুম চলো তবে একটা কথা মনে রেখো এরপর থেকে খাবারের ওপর রাগ করবে কখনো খাবারের ওপর করতে হয় না মিশু।”

“আমি কোথায় খাবারের ওপর রাগ করলাম আমি তো ফুলবন্ধুর ওপর রাগ করেছিলাম।”

‘এই যে তুমি তোমার বন্ধুর ওপর রাগ করে খাবার খেলে না। এটাই খাবারের ওপর রাগ করা।”

‘আচ্ছা পরে বোলো এখন চলো বাজপাখি কোথায় সেও তো আমি খাইনি বলে খায় নি। তুমিও তো খাওনি। চলো। আচ্ছা তুমি থাকো আমি বাজপাখি কে ডেকে নিয়ে আসছি।”

সে বাজপাখি ডাকতে ডাকতে আরবাজ এর রুমে গেল। আর ওকে নিয়ে এলো তারপর তিনজনে বসে খেতে লাগলো। বাকিরা শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলো। নুপুর আরো কিছু বলতো কিন্তু শেখ শাহনাওয়াজ এর কথায় চুপ করে রইলো।

পরেরদিন তাজেল এসেছে মেহবিনের কাছে পরতে। এসে সালাম দিয়ে বলল,,

“ডাক্তার কাল কহন আইছো?”

‘রাতে!”

‘ওহ আইচ্ছা তাইলে তো অনেকক্ষন ঘুরছো। পুলিশ পাঞ্জাবিওয়ালা কিন্তু ভালো আছে তোমাগো দুই জনরে কাইল মেলা সুন্দর লাগতেছিল।

‘হুম!

তাজেল কিছু বললো না কিন্তু একটু পর পর মেহবিনের দিকে তাকাতে লাগলো। তা দেখে মেহবিন বলল,,

“কিছু বলবে নেত্রী?

‘আইজ আমরা জুলাপাতি করুম তোমার দাওয়াত রইল।”

“জুলাপাতি কি?”

‘তুমি জুলাপাতি বুঝোনা মানে হইলো আমরা সব ছোট পুলাপাইন নিজেগো বাড়ি থিকা চাইল ডাল দিয়ে একসাথে রান্না কইরা খামু।”

‘ওহ আচ্ছা চড়ুইভাতি!”

‘চড়ুইভাতি আবার কি? আমরা তো চড়ুই রে ভাত দিমুনা তাইলে চড়ুইভাতি কেমনে হইবো। তাছাড়া আমরা তো কহনো চড়ুইরে ভাত দিই না।”

তাজেলের কথায় মেহবিন হাসলো আর বলল,

“তোমার জুলাপাতির ভালো নাম চড়ুইভাতি।”

‘মানে শুদ্ধ ভাষা।”

‘হুম।”

“জুলাপাতিরে আবার চড়ুইভাতি রাখলো কোন হালায়। হেয় কি জুলাপাতি করবার যাইয়া চড়ুইরে খাইতে দিছিল।”

“হালা কোন ধরনের শব্দ নেত্রী?”

‘আরে ভুলে মুখ দিইয়া বাইর হইয়া গেছে। যাই হোক তুমি আমার প্রশ্নের উত্তর দেও।”

‘আমিও জানি না। আচ্ছা তোমাদের চড়ুইভাতি, মানে জুলাপাতি কখন?

‘এই তো বারোটার দিকে এহন যাইয়া যারা জুলাপাতি করবো তাগো সবার বাড়ি থেইকা চাল নিমু তারপর লাখড়ি খুটুম (কুড়ানো) তারপর চুলা খুদুম (মাটির ভেতর চুলা বানানো) তারপর সবাই মিলা রান্না করুম।”

“তোমরা রান্না করতে পারো?”

“আমরা ছোট না আমরা কেমনে পারুম। কিন্তু প্রতিবার নওশি আপা দেহায় দেয় হেয় তো আমাগো সাথে জুলাপাতি করে। আর আমরা রান্দি খুব ভালো না হওলেও খাওয়া যায়। কিন্তু হেইডাই আমাগো মেলা স্বাদ লাগে।”

“আচ্ছা!”

“তোমার দাওয়াত রইল কিন্তু।”

“এবার তোমাদের জুলাপাতি আমার বাড়িতেই করো না। আমিও একটু দেখতাম কিভাবে কি কর?”

“তাইলে তো ভালোই হইলো আমরা একটা জায়গা খুজতেছিলাম।”

‘আচ্ছা তাহলে এখানেই করো। আর হ্যা মিশুমনি তোমায় আজ আমার সাথে ওদের বাড়ি যেতে বলেছে।”

‘মিশুমনি কিডা ওহ চেয়ারম্যানের পাগল মাইয়া থুরি মাইয়া।”

‘হুম।”

তাজেল কে পড়ানো শেষ হলে তাজেল সবাইকে ডেকে মেহবিনের কথা বললো সবাই নিজেদের বাড়ি থেকে সব নিয়ে এলো। ওরা মোট সাতজন তাদের মধ্যে নওশিও একজন। ওরা সব করলো চুলা বানালো সব মেহবিন দেখলো রান্না করলো যা যা দরকার মেহবিন নিজের ওখান থেকে দিল। অতঃপর রান্না শেষ করে সবাই গোসল করতে গেল এসে খাবার খাবে‌। তার আগে কলাপাতা কেটে এনে রেখেছে তাজেল আর নওশি। সবার পথমে নওশি এলো মেহবিন নওশিকে জিজ্ঞেস করল,,

“তুমিও ওদের সাথে চড়ুইভাতি করো?”

‘ওরা তো আর রান্না পারে না। তাই ওদের সাহায্য করার জন্য আমি থাকি তাছাড়া আমার ভালো লাগে এটা।”

অতঃপর সবাই আসলে একসাথে কলা পাতায় এক সাথে খাবার খেলো। মেহবিন সবাইকে চকলেট ও দিল।সবাই খুশি মনে বাড়ি চলে গেল। দুপুর দুইটার পর মেহবিন তাজেলকে নিয়ে চেয়ারম্যান বাড়িতে গেল । বাড়িতে ঢুকতেই মেহবিন একটা মুখ দেখে একটু থেমে গেল। মিশু ওকে দেখেই দৌড়ে এসে ওকে নিয়ে একটা মেয়ের সামনে দার করিয়ে বলল,,

“ফুল ও হলো রাই!”

মেহবিন অস্ফুট স্বরে বলে উঠলো,,

“রাই ! রাইফা আফনূর!”

~চলবে,,

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_১৮
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

মেহবিন অস্ফুট স্বরে মেয়েটার নাম নিলেও বোধহয় নামটা কেউ শুনতে পায় নি। মেয়েটাও মেহবিনের দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। কেউ কিছু বলছে না দেখে মিশু আবার বলল,,

“ফুল তুমি কি শুনতে পাচ্ছো? ও হলো রাইফা আর রাইফা ও হলো আমার ফুল বন্ধু?”

মিশুর কথায় মেয়েটি জোরপূর্বক হেঁসে বলল,,

“ওহ আচ্ছা তাহলে এই তোমার বন্ধু আপু।”

‘হ্যা এটাই আমার বন্ধু।”

মেয়েটা মুচকি হেসে বলল,,

‘আসসালামু আলাইকুম।”

মেহবিন বলল,,

‘ওয়ালাইকুমুস সালাম।”

“আপনার নামটা যদি বলতেন? আপনি আপুর বন্ধু আমি তো আর আপনাকে সেই হিসেবে বন্ধু বলতে পারি না।”

এবার মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“আমি ডক্টর মেহবিন!”

‘ডক্টর মেহবিন?’

‘জি। আর ও হলো তাজেল আমার বন্ধু।”

তখন তাজেল সালাম দিল রাইফাকে রাইফাও এর জবাব দিল। মেহবিন মিশুকে বলল,,

“ফুল ইনি তোমার কে হয়?”

‘কাকার ছেলে সায়িদ আছে না ওর বউ।”

‘ওহ আচ্ছা।”

“তাজেল চলো আমরা আজ আমরা অনেক খেলবো। ফুল তুমিও চলো।”

তখন পাশ থেকে সায়িদ বলল,,

‘মিশুআপু আমার সাথে তোমার বন্ধুর পরিচয় করিয়ে দেবে না।”

‘তোর সাথে কেন পরিচয় করিয়ে দেব। তোরে আমার ভালো লাগে না। তুই কি রাইফার মতো ভালো নাকি।”

‘আরে আপু তুমিও না সবসময় শুধু আমায় ভুল বুঝো। বাই দা ওয়ে ডক্টর মেহবিন আমি ডক্টর সায়িদ।”

মেহবিন বলল,,

“আপনিও ডক্টর?”

“হুম আমিও ডক্টর। এই তো ছয় মাসের জন্য একটা রিচার্জ করতে গিয়েছিলাম বিদেশ। রাইফাকেও সাথে নিয়েছিলাম কালকেই ফিরেছি আমরা।

মেহবিন রাইফার দিকে একবার তাকিয়ে আবার সায়িদের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“ওহ আচ্ছা। ফুল চলো আমরা যাই।”

মেহবিন তাজেলের হাত ধরে মিশুর সাথে গেল। তাজেল মেহবিন কে ফিসফিস করে বলল,,

‘ডাক্তার তোমার সাথে আসা উচিত হয় নাই আমার?”

‘কেন কি হয়েছে?”

“এই চেয়ারম্যান বাড়ির হগলে কেমনে চাইয়া রইছে আমার পাইলে। আর আসার পর থেইকা একটা কথাও কইতে পারলাম না। আমার কেমন জানি দম বন্ধ লাগতেছে।”

‘আরে কিছুই হবে না এখন তো আমরা মিশুর ঘরেই থাকবো।”

“এরপর থেইকা আমারে আর আনবা না।”

‘আচ্ছা ঠিক আছে। এখন চলো।”

মেহবিন মিশুর ঘরে চলে গেল। তখন চেয়ারম্যান সাহেব বললেন,,

‘আরিফা ওদের রুমে হালকা নাস্তা পাঠাও।”

‘মনে তো হয়না মেয়েটা খাবে? আজ পর্যন্ত কতোবার আসা যাওয়া হয়েছে কিন্তু মেয়েটা কিছুই খায়নি।”

‘তো কি হয়েছে আজ তো একটা ছোট মেয়েও আছে। কে খেলো না খেলো তা দেখে আমাদের কোন কাজ নেই। আমাদের কাজ অতিথিদের আপ্যয়ন করা তাই করবে।”

“ঐ মেয়েটার সাথে যে মেয়েটা এসেছে সে কে?”

শেখ শাহনাওয়াজ তাজেলের বাবার নাম বলতেই আরিফা জামান বললেন,,

“ও যার বউ পালিয়ে গেছে মেয়েটাকে রেখে। আর সেও একজন কে বিয়ে করে নিয়েছে। ঐ মেয়ের সাথে এই ডাক্তারের কিভাবে পরিচয় হলো। আর এরকম মেয়েকে আমাদের বাড়িতেই কেন বা নিয়ে এসেছে।”

তখন পেছন থেকে আওয়াজ আসলো,,

“কারন আপনাদের বাড়ির মেয়ে নিয়ে আসতে বলেছে বলে তাই সে এখানে। আর তার সাথে আমার পরিচয় হয়েছে এই জন্যই যে তার পরিচয় সর্বপ্রথম সে একজন মানুষ তাই।’

সবাই তাকাতেই দেখলো বুকে হাত বেঁধে মেহবিন দাঁড়িয়ে। ওকে দেখেই আরিফা জামান একটু ভরকে গেল আর বলল,,

“আমি সেরকম কিছু বুঝাতে চাই নি?”

মেহবিন মুখ শক্ত করে বলল,,

“ওহ আচ্ছা এরকম মেয়ে বলতে কি বুঝিয়েছেন আপনি?”

“মানে ওর মা পালিয়ে গেছে।”

“তো কি হয়েছে ওর মা পালিয়ে গেছে। ও কি একবারও বলেছে ওর মাকে কারো সাথে পালিয়ে যেতে। এতকিছুর মাঝে ওর দোষ কোথায়? তবে এটা জানেন কি ওর মা চলে যাওয়ায় সবথেকে লস কিন্তু ওরই হয়েছে। ওর মা পালিয়ে তো গেছে কিন্তু ওকে একা রেখে গিয়েছে এই পৃথিবীতে । ওর বাবা দু’দিন কান্না করলেও নিজের জন্য সঙ্গী ঠিকই খুঁজে নিয়েছে কিন্তু ও পায়নি একটা মা। তাকে আপনি এরকম মেয়ে বলতে কি বুঝাতে চান। যে মেয়েটার মা পালিয়ে গেছে সেই মেয়েটা খারাপ। কিন্তু বিশ্বাস করুন আমি বলছি আমি এই কয়েকদিনে যতগুলো মানুষ কে দেখেছি তাদের মধ্যে আমার নেত্রীর মতো ভালো মানুষ আমি একটাও দেখি নি।”

সবশুনে সবাই চুপ হয়ে গেল। তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“ডাক্তার আপনি এখানে কিছু লাগবে?”

“হুম মিশু পানি খেতে চেয়েছে।”

“ওহ আচ্ছা। এখানে যা হলো তার জন্য আমি দুঃখিত।”

‘যেখানে আপনার দায় নেই সেখানে দায় দেখাতে যাবেন না চেয়ারম্যান সাহেব। নিজের পুরোনো অভ্যাস বদলান। নিজের দায়গুলো তো ঠিকমতো পালন করতে পারেন না। কিন্তু অন্যের দায় নিজের কাঁধে ঠিকই তুলতে পারেন।”

মেহবিনের কথায় শেখ শাহনাওয়াজ কিছু বললেন না। অন্যদিকে তাকিয়ে রইলেন। মেহবিন আরিফা জামান এর দিকে তাকিয়ে বলল,,

‘কাল যদি আমি ফুলকে কথা না দিতাম তাহলে আমার নেত্রীর অপমানের জন্য এখানে আর এক মুহূর্ত থাকতাম না।”

তখন আরিফা জামান বললেন,,

“আমি দুঃখিত আসলে আমি সেভাবে মিন করিনি।”

“কি মিন করেছেন সেটা না হয় থাক আপতত পানি দিন।কথা তো অনেক বলা যায়। কিন্তু কথার আসল মর্ম তো কথা বলার উপস্থাপনের ওপর নির্ভরশীল। যেমন ভাবে কথাগুলো উপস্থাপন করবেন তেমনটাই না বুঝতে পারবে মানুষ জন। যাই হোক এটা নিয়ে কথা বললে কথা বাড়বে। ”

তখন রাইফা পানি নিয়ে এলো । মেহবিন তার দিকে একবার তাকিয়ে পানি নিয়ে চলে গেল। তখন আরিফা জামান বললেন,,

“মেয়েটা আমাকে এতোগুলো কথা শুনালো আপনি কিছুই বললেন না। শুধু আমাকে নয় আপনি তো দুঃখিত প্রকাশ করলেন তাও মেয়েটা আপনাকে কথা শুনালো আপনি কিছুই বললেন না। উল্টো তার কথা শুনে উল্টো দিকে ঘুরে গেলেন যেন আপনি কোন দোষ করেছেন।”

শেখ শাহনাওয়াজ শান্ত স্বরে বললেন,,

“মেয়েটা তো ভুল কিছু বলেনি তাই কিছু বলিনি। সত্যিই তো আমরা একজনের জন্য আরেকজন কে দোষারোপ করে কিছু বলতে পারি না।”

বলেই তিনি চলে গেলেন। আরিফা জামান শুধু তাকিয়ে রইলেন তার ভিশন রাগ হলো। রাইফা একটু পর কিছু হালকা খাবার নিয়ে মিশুর রুমে গেল। মেহবিনের চোখ বাঁধা তাজেল আর মিশু কানামাছি খেলছে। তিনজনের মুখেই হাঁসি। তাজেল আর মিশু একটু পর পর মেহবিন খুচাচ্ছে। এখন ওরা একটা জায়গায় লুকিয়ে গেল। তা দেখে রাইফা খাবারটা বিছানায় রাখলো । এদিকে মেহবিন ওদের খুঁজতে খুঁজতে রাইফার কাছে এসে গেছে ওকে ধরতে গিয়েও মেহবিন থেমে গেল। মেহবিন চোখ থেকে কাপড় সরিয়ে রাইফাকে দেখে বলল,,

‘আপনি কখন এলেন?”

“একটু আগেই খাবার দিতে এসেছি।”

“ওহ আচ্ছা ফুল, নেত্রী বেরিয়ে এসো আমরা আর কানামাছি খেলবো না।”

মেহবিনের কথা শুনে দুজনেই বেরিয়ে আসলো। মিশু রাইফা কে দেখে বলল,,

“রাইফা তুমি এখানে আসো তুমিও বসো।”

“না আপু আমার কাজ আছে আমি গেলাম।”

“আরে বসোই না কোন কাজ নেই।”

মিশুর জোরাজুরিতে রাইফা বসলো। মেহবিন তাজেল কে নিয়ে একপাশে বসলো। কিছুক্ষণ গল্প করলো মেহবিন একটা কথাও বললো না। মিশু তাজেলকে নিয়ে নাস্তা খেল কিন্তু মেহবিন এক গ্লাস পানিও খেল না। কিছুক্ষণ পর মেহবিন মিশুর থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেল। এতো তাড়াতাড়ি যাওয়ার জন্য মিশু কিছুই বললো না কারন সে আজ ভিশন খুশি।
___________________

রাতে কাব্যের বিহঙ্গিনী পেজ থেকে একটা পোস্ট হলো,,

‘আমার উপস্থিতি যাদের মনে খুশি আনতে পারে না। তাদের সাথে আমার দেখা না হোক।”

তবে এবার আরবাজ আর মুখর এর সাথে মেহবিনের আরো একজন পরিচিত মানুষ পোস্ট টা দেখতে পেল। যদিও সে মেহবিনই যে এই পেজের মালিক সেটা জানে না।

____________

‘তাহার সাথে আমার বারবার দেখা হোক। আর তাহার আর আমার প্রতিটা সাক্ষাৎ তাহার মুখে এবং আমার মুখে হাসি ফোঁটার কারন হোক।”

বিহঙ্গিনীর কাব্য আইডি থেকে একটা পোস্ট হলো। পোস্ট টা চোখে পরতেই মেহবিন মুচকি হেসে লিখলো,,

‘প্রতিটা সাক্ষাতেই প্রতিবারের মতো ফুল দেওয়া হোক। হাসার কারন এমনিতেই হয়ে যাবে।”

ওপাশ থেকে রিপ্লাই আসলো,,

‘তারমানে আমার জন্য তাহার মুখে হাঁসি ফুটে না শুধু ফুলের জন্য হাঁসি ফুটে উঠে।”

‘আমি কখন বললাম শুধু ফুলের জন্য হাঁসি ফুটে ওঠে?”

‘তাহলে প্রথমে কি বললে? সেখানে কি আমাকে মেনশন করেছো একবার ও?”

“সে কি জানে সে নিজেই একটা ফুল। যাকে দেখেই আমার মুখে হাঁসি ফুটে ওঠে।”

‘এ্যা আর কিছু না আরে ফুল তো মেয়েদের কে বলে তুমি আমাকে বলছো কেন? এ কথাটা না হয় আমি বলতে পারি তুমি কেন?

‘এমনিই আমার তো ভালোই লাগছে। তাছাড়া শখের মানুষকে যেকোন নামে সম্বোধন করা যায়।”

‘তাই বলে মেয়েলি সম্মধোন?”

‘তাহলে আপনাকে ফুল না ফল বলবো। এটা বললে ভালো লাগবে।”

“ধুর ধুর এসব কি বলো আমি কাব্যই ঠিক আছি কি ফুল ফল শুরু করছো?”

‘এখন এসব বাদ দিন। আচ্ছা কাব্য আমায় একটা কথা বলুন তো আপনি একজন পুলিশ অফিসার। আপনার কতো কাজ তারমাঝেও আমার পোস্ট দেখে আপনি রোজ পোস্ট করেন। আমি কমেন্ট করলে সাথে সাথে রিপ্লাইও করেন।”

“একটা মানুষ ২৪ ঘন্টা সবসময় ব্যস্ত থাকে না। হ্যা একটা কাজ করছি সেখানে শখের মানুষের জন্য ৩০ সেকেন্ড সময় বের করে তার পোস্ট দেখা খুব বড় ব্যাপার নয় শুধু দরকার একটু মানসিকতা। তাছাড়া যে সময়টায় আমি বিহঙ্গিনীর কাব্য আইডি থেকে তোমার সাথে করা বলি সেটা আমার ছুটির পর আমি বাড়ি আসি তখন। একটা মানুষের যতোই ব্যস্ততা থাকুক সেখান থেকে সময় বের করাটা তার নিজের ওপর ডিপেন্ড করে। সে চাইলেই করতে পারবে এটা বড় কোন ব্যাপার না। শুধু একটা কথা মাথায় রাখতে হবে সেটা হলো আমাকে সময়টুকু বের করতে হবে। অধিকাংশ মানুষ বলে থাকে ব্যস্ত ছিলাম তাই তোমার সাথে যোগাযোগ করতে পারি নি। ব্যাপারটা হলো সে চেষ্টাই করেনি সময় বের করার।”

কমেন্ট টা পড়ে মেহবিন লিখলো,,

‘বুঝলাম!”

“কি বুঝলে?”

“একটা মানুষ সবসময় ব্যস্ত থাকে না‌।”

“ব্যস এইটুকুই?”

“তো আরো কিছু বোঝার কথা ছিল নাকি?”

“তেমন কিছুই না।”

“ওহ হো মনে পরেছে আরো একটা জিনিস বুঝতে পেরেছি?”

“কি?”

“এটাই যে মানুষ তার শখের মানুষের জন্য ব্যস্ততার মাঝেও সময় বের করতে পারে।”

“এই কথাটা আগে বললেই হতো?”

“আগে বললে কি হতো?”

“কিছু না।”

“আচ্ছা।”

“মেয়ে তুমি এমন কেন?”

“কেমন?”

‘অদ্ভুত রহস্যময়ী।”

“আচ্ছা।”

______________

দেখতে দেখতে এভাবেই কেটে গেল তিনটা মাস। এখন গ্ৰামের সবাই মেহবিন কে বেশ ভালোভাবেই চেনে। মেহবিন যতটুকু পারে ততটুকু সবাইকে সাহায্য করে। এমন কি তাদের কিছু বিষয়ে মেহবিনের কাছে পরামর্শ ও নিতে আসে। মেহবিনের সময়টা বেশ ভালোই কেটেছে নেত্রী গ্ৰামের মানুষজনদের নিয়ে। সে প্রতি শুক্র শনি মিশুর সাথে দেখা করতো। মাঝে মাঝে মুখরের সাথেও ঘুরতে যেতো একটু। মেহবিনকেও শেখ শাহনাওয়াজ পরিবারের একজন করে নিয়েছে এতে অবশ্য কিছু মানুষের অবজেকশন ছিল। মেহবিনের তাদের ব্যাপারে কিছু যায় আসে না। দুদিন ধরে মেহবিনের জ্বর এসেছে। তাজেল দিনের বেলা মেহবিনের কাছেই থাকে। রাত প্রায় দশটা এখন জ্বর অনেকটাই কম। কিন্তু শরীর টা বেশ দুর্বল। ও একা একাই শুয়ে আছে। এমন সময় মুখরের কল এলো। এতো রাতে কল করেছে একটু চিন্তিত হলো আর ফোন ধরলো ও ধরতেই কিছু শুনতে পেল ও বুঝতে পারল মুখরকে কেউ তাড়া করেছে । কিন্তু মুখরের আওয়াজ পেল না। ও ফোন কেটে মুখরের ফোন ট্রেস করার চেষ্টা করলো। ও দেখতে পেল এখন মুখরের লোকেশন ওর বাড়ি থেকে আধা কিলোমিটার দূরে। ও বের হবে বারান্দায় এসে তালা খুললো বের হবে নাকি ভাবতে ভাবতেই কেউ ওর বাড়ির গেট দিয়ে ঢুকে পরলো ও লোকটাকে কিছু করবে তার আগেই ও রক্তাত্ব অবস্থায় মুখরকে দেখতে পেল। ও তাড়াতাড়ি করে মুখরকে ধরে নিজের ঘরে নিয়ে গেল। ঘরে নিতেই মুখর ব্যালেন্স রাখতে না পেরে পরে গেল। হাত মাথা দিয়ে রক্ত পরছে। মেহবিন এ অবস্থা দেখে আঁতকে উঠলেও প্রথমে বারান্দার কেচিগেইট এ তালা মারলো ঘরের দরজার পর্দা টেনে দিল। মুখরকে ধরে বিছানায় শুয়িয়ে দিল। মুখর অসহায় মুখে মেহবিনের দিকে তাকিয়ে রইল। ওর শরীরে অবশিষ্ট শক্তি নেই বোধহয়। মেহবিন গরম পানি বসিয়ে মুখরের রক্ত পরিষ্কার করতে লাগলো। হাতে একটা গুলি লেগেছে তা প্রথমে খেয়াল না করলেও পরে করেছে। বাসায় সবকিছুই রাখে মেহবিন আজ ও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু সমস্যাটা হলো মুখর কে নিয়ে যদি ও ব্যাথায় চিৎকার দেয় তাহলে সবাই জেনে যাবে এই বাড়িতে মেহবিনের সাথে পুরুষ মানুষ আছে। মেহবিন বলল,,

“আপনার তো গুলি লেগেছে এটাকে এখনই বের করতে হবে।’

মুখর অসহায় স্বরে ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,,

“সমস্যা নেই তুমি বের কর?”

“আপনি ব্যাথাটা সহ্য করতে পারবেন তো?”

“পারবো।”

বিছানায় মেহবিনের একটা ওরনা ছিল ওটা নিয়ে মুখর নিজের মুখে যতটা ঢোকানো সম্ভব ঢুকিয়ে নিল। আর কামড় দিয়ে ধরে রাখলো। মেহবিনের আজকে নিজেকে অনেক অসহায় লাগছে এর আগে বোধহয় ও এতটা অসহায় বোধ করে নি। মেহবিন আস্তে আস্তে ধীরে বুলেটটা বের করতে লাগলো যাতে মুখরের কম ব্যাথা লাগে । বুলেটটা বের করার সময় যেন মেহবিনের নিজেরই জান বের হচ্ছিল। মুখর ছটফট করছিল তবুও একটা শব্দ বাইরে যেতে দেয় নি কাপরটা শক্ত করে কামড়ে ধরে রেখেছিল। মেহবিন হাতের ব্যান্ডেজ শেষ করে মাথায় ব্যান্ডেজ করে দিল। তারপর রান্নাঘরে গিয়ে স্যুপ বানিয়ে নিয়ে আসলো। মেহবিন যত্ন সহকারে মুখরকে খায়িয়ে দিল। ওষুধ ও খায়িয়ে দিল। এখন মুখরের বেশ ভালো লাগছে ওর একটু ফ্রেশ হওয়া প্রয়োজন এখন তো উঠতে পারবে না। তাছাড়া বাইরে বের হওয়াও টাফ বারান্দায় বাথরুম মেহবিন এতো ঝামেলা না নিয়ে বালটি করে পানি নিয়ে এলো। তারপর শার্টে হাত দিতেই মুখর বলল,

“কি করছো?”

“দেখতেই তো পাচ্ছেন শার্ট খুলছি ?”

“আস্তাগফিরুল্লাহ নাউযুবিল্লাহ কি বলো শার্ট খুলছো কেন?

“আপনার কি মনে হয় এই অবস্থায় আপনার শার্ট খুলে আমি কি করবো?”

“কি করবে মানে আমার ইজ্জত ও তো হরন করতে পারো?’

“সিরিয়াসলি কাব্য। আপনার এই বাচ্চামো দেখে আমার ভিশন রাগ লাগছে এখন। আপনি কি সারারাত এই রক্ত মাখা ময়লা শার্ট পরেই থাকবেন?”

“তো কি করবো তোমার সামনে খালি গায়ে থাকবো নাকি? আমার লজ্জা করবে না।”

“আপনার লজ্জা লাগবে না। নিচে তো স্যান্ডু গেঞ্জি আছে তাই না। খুলুন তো খুলুন।”

“ওহ হ্যা আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।”

মেহবিন মুখরের শার্ট খুলে দিল আর গামছা দিয়ে শরীর মুছিয়ে দিল। আর পেছনের বারান্দায় গিয়ে ভালো করে পা ধুয়িয়ে দিল। তারপর বিছানায় শুয়িয়ে দিল আবার ওপরে কম্বলটাও টেনে দিল। ও চেয়ারে বসে বলল,,

“এসব কি করে হলো?’

মুখর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,,

“পুলিশ স্টেশন থেকে বাড়ি ফিরছিলাম। এমন সময় দেখি কেউ রাস্তায় পরে আছে। সেটা দেখতে বাইরে বেরিয়ে তার কাছে যেতেই কেউ আমার মাথায় কিছু একটা দিয়ে আঘাত করলো। পেছনে ঘুরে দেখি বেশ কয়েকজন ততক্ষণে রাস্তার মানুষটাও দাঁড়িয়েছে। পরে ওদের থেকে জানতে পারলাম নিশাচর পাঠিয়েছে আমাকে শেষ করতে। এতদিন নাকি আমাকে সময় দিয়েছিল কিন্তু আমি তার বিরুদ্ধে গিয়ে বাবুল কে বের করে আবার জেলে ঢুকিয়েছি তাই নাকি আমার সময় ঘনিয়ে এসেছে। আমি ওদের কথা শুনে রিভলবার বের করি আর দৌড়ে অন্য একটা জায়গায় গিয়ে লুকিয়ে ওদের দিকে গুলি ছুড়ি। ওদের সাথে গুলাগুলি শুরু হয়। কিন্তু আমি একা কিছুতেই ওদের সাথে পারছিলাম না। গাছের মাধ্যমে নিজেকে আড়াল করি তবুও একটা লেগেই যায় হাতে এদিকে আমার গুলিও শেষ হয়ে যায় কি করবো বুঝতে পারছিলাম না। তারপরেই দৌড় লাগাই তারপর জানিনা দৌড়াতে দৌড়াতে কখন এই এলাকায় ঢুকে পরেছি। এদিকে শরীরের শক্তি ও ফুরিয়ে এসেছিল তাই তোমাকে ফোন দিই তখনই ওরা আমায় দেখে ফেলে আবার তাড়া করে। তারপরেই কোন কিছু না ভেবে ওদের থেকে লুকিয়ে এখানে চলে আসি।”

“ওহ আচ্ছা বাকি কথা পরে দেখা যাবে এখন আপনি ঘুমান।”

“তুমি কি করবে? এসো শুয়ে পড়।”

“আপনি ঘুমান আগে তারপর শুবো। আমি আপনার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি।”

মেহবিন মুখরের মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। কিছুক্ষণের মাঝেই মুখর ঘুমিয়ে পড়লো। মেহবিনের শরীরটাও খুব একটা ভালো না তাই ও নিজেও মুখরের মাথার কাছে বসে বসেই ঘুমিয়ে পরলো। এদিকে রাতে মেহবিনের জ্বর বেরে গেল। ও ঠান্ডায় কাঁপছিল হুট করেই মুখরের ঘুম ভেঙে গেলে ও দেখলো মেহবিনের এই শীতের মাঝেও কিছু নেই ও ঠান্ডায় কাঁপছে। মুখর উঠতেই ওর মাথা আর হাত পচন্ড ব্যাথা ও মেহবিন কে ডাকতে লাগলো আর বলল ওর পাশে শুয়ে পরতে। মেহবিন ঘুমের ঘোরেই মুখরের পাশে শুয়ে পড়লো। মুখর কম্বল টা ভালো করে দিয়ে দিল আর মেহবিনের কপালে একটা চুমু দিয়ে ওকে এক হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে ধরলো। এই মুহূর্তে ও উঠতে পারছে না তাই ওষুধ বা মেহবিনের জন্য কিছুই করতে পারছে না এই জন্য ওর আফসোসের শেষ নেই। কিন্তু একটু উষ্ণতা ঠিকই দিতে পারবে তাই হাতে ব্যাথা থাকা সত্ত্বেও ও মেহবিনকে জড়িয়ে ধরে রাখলো। কখন যে নিজেও ঘুমিয়ে গেল ও বুঝতে পারল না। সকাল বেলা বাইরে থেকে কারো ডাকে মেহবিনের ঘুম ভেঙে গেল। ঘুম ভাঙতেই নিজেকে মুখরের বাহডোরে পেল দেখে এক প্রকার চমকেই গেল সে। এদিকে বাইরের আওয়াজ ও তীব্র হচ্ছে। ও তাড়াতাড়ি করে মুখরকে কম্বল দিয়ে ঢেকে উঠে এলো। বারান্দায় এসেই একপ্রকার থমকে গেল। আর মুখ দিয়ে অস্ফুট স্বরে বেরিয়ে এলো,,

“চেয়ারম্যান সাহেব!”

~চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে