কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-১২

0
428

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_১২
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

“পুরুষ মানুষ একটাই জাতি কিন্তু পুরুষে পুরুষে কতটা পার্থক্য। যেমন একটা পুরুষের কাছেই একটা মেয়ে সবচেয়ে নিরাপদ থাকে। আবার ক্ষেত্র বিশেষে একটা পুরুষের কাছেই একটা মেয়ে সবচেয়ে অনিরাপদ সাব্যস্ত হয়।”

মুখর শুয়ে শুয়ে ফোন স্কল করছিল এমন সময় ‘কাব্যের বিহঙ্গিনী’ পেজের কিছুক্ষণ আগের করা পোস্ট টা সামনে এলো। কমেন্ট রিয়াক্ট শেয়ারের ঝড় উঠেছে আজ। মুখর বসে ভাবতে লাগলো আজ নিশ্চয়ই কিছু হয়েছে। কারন কাব্যের বিহঙ্গিনী তার পারিপার্শ্বিক বিবেচনা করেই সর্বদা পোস্ট করে। পোস্ট টা মাগরিবের নামাজের সময়ের পর করা হয়েছে‌।

মেহবিন খাবার খাচ্ছিল এমন সময় ওর ফোনে একটা নোটিফিকেশন এলো। বিহঙ্গিনীর কাব্য আইডি থেকে নতুন পোস্ট করা হয়েছে,,

‘আমি তোমার দ্বিধায় বাচি, তোমার দ্বিধায় পুরে যাই।”

মেহবিন খাওয়া শেষ করে মুচকি হেসে কমেন্ট করলো,,

“এটা কি কোন কথা না কবিতা?”

ওপাশ থেকে রিপ্লাই আসলো,,

“কোন কথাও না আর কবিতাও না এটা আমার অনুভূতি।”

‘যদিও আমি শুনি নি তবে এটা বোধহয় কোন গানের লাইন।”

‘হয়তো বা আমিও শুনিনি তবে ফেসবুকে ক্যাপশন দেখেছি পরে মনে হলো এটা আমার সাথে মিলে যায়।”

“তা আমায় নিয়ে কিসের দ্বিধা আপনার?”

‘আমার মনে হয় তোমাকে আজ পর্যন্ত আমি পুরোটা চিনতে পারি নি।”

‘অথচ আপনিই আমাকে সবথেকে ভালো চেনেন।”

‘চিনতে আর কোথায় পারলাম।”

“পারলেন না বুঝি?”

‘আমার মনে হয় তুমি কোনকিছুর অপেক্ষায় আছো। আচ্ছা তুমি কিসের অপেক্ষায় থাকো? কিসের এতো অপেক্ষা তোমার?”

প্রশ্নটা দেখে মেহবিন একটু অপ্রস্তুত হলো তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে লিখলো,,

“হুমায়ূন আহমেদ এর রজনী উপন্যাসে একটা উক্তি আছে জানেন,,
❝মানুষ হয়ে জন্মানোর সবচেয়ে বড় কষ্ট হচ্ছে মাঝেমাঝে তার সবকিছু পেছনে ফেলে চলে যেতে ইচ্ছে করে। কিন্তু সে যেতে পারেনা। তাকে অপেক্ষা করতে হয়। কিসের অপেক্ষা তাও সে ভালোমতো জানেনা।❞

এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে বরাবরের মতো ওপাশ থেকে আর কোন কমেন্ট এলো না । মেহবিন তা দেখে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে একটা উপন্যাস এর বই নিল বারান্দায় গেল। রাতের নিরব পরিবেশে নিজের মতো সময় কাটাতে লাগলো।
_________________

রাতে শেখ বাড়ির খাবার টেবিলে সবাই খাবার খেতে বসেছে। শেখ শাহনাওয়াজ মেয়েকে খাওয়াচ্ছেন আর নিজেও খাচ্ছেন। হুট করে মিশু বলল,,

“এই যে নূপুর ডাক্তার তুমি কি আমাদের বাড়ি থেকে যাবে না?”

মিশুর এমন কথায় সবাই মিশুর দিকে তাকালো। কিছুজন রেগেই তাকালো। মিশুর প্রশ্নে অপ্রস্তুত হয়ে পরল ডক্টর নূপুর। সে বলল,,

“কেন মিশু আপু আমি থাকলে কি তোমার সমস্যা হবে।”

“না কিন্তু তোমার তো কাজ শেষ। এখন তো আমার বন্ধু আছে। তাহলে তুমি এ বাড়িতে থেকে কি করবে?”

তখন শেখ শাহেনশাহ বললেন,,

“কে এ বাড়িতে থাকবো আর কে থাকবো না সেইটা না হয় আমিই ভাবমু। নূপুর তোমার ডাক্তার হইলেও সে বউমার বোনের মেয়ে মানে তোমার খালাতো বোন। তার কাজ না থাকলেও হেয় এই বাড়িতেই থাকবো যেমনটা আগে থাকতো।”

“কেন নূপুর ডাক্তারের মা বাবা নেই নাকি যে এখানে থাকবে।”

মিশুর এই কথায় শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“মিশু এভাবে বলতে হয় না। ও তোমার বোন হয় তো।”

তখন শেখ শাহেনশাহ বললেন,,

“তুমি পাগলকে কি বোঝাচ্ছো শাহনাওয়াজ।”

পাগল শব্দটা মিশু সহ্য করতে পারে না। মিশু পাগল শুনেই কাঁচের গ্লাসটা ফেলে দিল। আর চিৎকার করে বলল,,

“আমি পাগল নই!”

মিশুর এরকম চিৎকারে সবাই চমকে উঠলো। শেখ শাহনাওয়াজ মেয়ের হাত ধরে বলল,,

“মিশুমনি শান্ত হও তুমি তো পাগল নও তাহলে।”

মিশু চিৎকার করেই বলল,,

“তাহলে তোমার বাবা কেন বলল।”

“মিশু শান্ত হও আর কেউ তোমায় পাগল বলবে না।”

“তোমার বাবা আমায় পাগল বলল কেন?”

“ওটা এমনিই বেরিয়ে গেছে তুমি শান্ত হও খেয়ে নাও।”

তখন শেখ শাহেনশাহ বললেন,,

“এমনি এমনি বলি নি পাগল কে পাগল বলেছি তাতে কি হয়েছে?”

মিশু এবার শেখ শাহনাওয়াজ এর হাত ছাড়িয়ে পানির জগটা আছাড় মারল। আর চিৎকার করে বলতে লাগল,,

“আমি পাগল নই আমাকে পাগল বলবে না। নই আমি পাগল তুমি শুনতে পাচ্ছো।”

বলতে বলতেই ওখান থেকে সরে এলো আর একটা ফুলদানি ভেঙে ফেললো। তখন আরবাজ উঠে ওকে জরিয়ে ধরলো আর বলল,,,

“আমার বোনকে যে পাগল বলবে তাকে কিন্তু আমি ছেড়ে কথা বলবো না। শেখ শাহেনশাহ নিজের জবানকে কন্ট্রোলে রাখুন নাহলে কবে জানি কারো হাতে আপনার জবান বন্ধ হয়ে যায়। দুদিন আগে না ইস্তেমা থেকে ফিরলেন অথচ ভেতরটাই শুদ্ধ করে আসতে পারলেন না।”

“বাজপাখি!”

“কেউ আর তোকে পাগল বলবে না মিশু বাজপাখি আছে তো!”

আরবাজ কোন রকমে মিশুকে সামলালো। আর ওকে নিয়ে ওপরে চলে গেল । তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

‘বাবা বলে এটা ভেবো না সবসময় তোমাকে ছেড়ে দেব। একদিন কেউ গুনে গুনে তোমার কৃতকর্মের হিসাব নেবে। এটা কেন ভুলে যাও। আর হ্যা পাগল কাকে বলছো সেটাও একটু খেয়াল করো মিশু এই শেখ বাড়ির সন্তান আমার মেয়ে সে খবরদার বলে দিচ্ছি এরপর যদি পাগল ওয়ার্ড টা ইউজ করো তাহলে আমি ভুলে যাব তুমি আমার বাবা।”

“শাহনাওয়াজ তুই কিন্তু বেশি,”

“আমি আর কিছু শুনতে চাই না।”

বলেই শেখ শাহনাওয়াজ না খেয়েই চলে গেলেন। পুরো পরিবেশটাই একপ্রকার থমকে গেল। কিছু কিছু মানুষের মুখে অদ্ভুত হাসি ও দেখা গেল। তাদের মধ্যে ডাক্তার নূপুর ও একজন। মুখর মিশুর আওয়াজ পেয়ে নিচে এসেছিল সবকিছু ওপরে দাঁড়িয়েই পর্যবেক্ষন করেছে সে। তার ভালো লাগছিল না বলে সে আজ রুমেই খেয়ে নিয়েছে।

___________

“ডাক্তার আজ ঘুরতে যাবা। তুমি কিন্তু এই গ্ৰামের আসার পর থেইকা ঘুরতে যাও নাই।”

“পরার সময় ঘুরতে যাওয়ার কথা আসলো কোথা থেকে নেত্রী।”

সকাল বেলা সময়টা সাতটা থেকে আটটা পর্যন্ত মেহবিন তাজেলকে পড়ায়। আজ ও পড়াচ্ছিল হুট করেই পড়ার মাঝেই তাজেল ঘুরতে যাওয়ার কথা বলল। তাজেল মাথা চুলকিয়ে বলল,,,

“আজ পরতে ভাল লাগতেছে না ডাক্তার?”

“তাহলে তোমার বাবার কথাটা ধরে নেব নাকি নেত্রী। তোমার পরতে ভালো লাগতো না তাই পড়া বাদ দিয়েছিল।”

“ধুরু তুমি কিসের মধ্যে কি টাইনা আনতেছো।তুমি কিন্তু দুই দিন ধইরা আমারে পরাইতেছো। আমি কিন্তু এই দুই দিন ভালো মতো পরছি খালি আইজ কইলাম এই কথা।”

“আচ্ছা!”

“হ এহন কও তুমি ঘুরতে যাবানি?”

“আমি তো ঘুরতে ঘুরতেই বাড়ি আসি।”

‘হেই ঘুরা আর এই ঘুরা কি এক নাকি।”

“তাহলে কি?”

“আইজকা তুমি হাসপাতাল থেইকা আসার পর আমি তুমি, কুলসুম আর নওশি আপা ঘুরবার যামু। এই আমগো গ্ৰামডাই চক্কর মারুম। নওশি আপা সেই দিনের পর থিকা ঘরের বাইরে বাইর হয় না।”

“তারমানে নওশির জন্য বলতেছো?”

“হ এই তো বুঝছো।”

“আচ্ছা তাহলে যাবো । তবে আরেকজন কেও সাথে নেব। এই যে আমার বাড়ি থেকে পাঁচ মিনিট পর যেই বাড়িটা আছে শামীম নামের ছেলের কাকাতো বোন ওকেও নেব। তুমি বাড়ি যাওয়ার সময় ওকে একবার বলে যেও।”

“তুমি শামীম ভাইরে চিনলা কেমনে?”

‘চিনি না শুধু নাম শুনেছি। মেয়েটার বাড়ি কাল গিয়েছিলাম অসুস্থ ছিল সে কিন্তু আমি তার নাম জানি না। শামীম নামটা শুনেছিলাম।”

“মাইয়াডা রোগা পটকা আছিল তাই না ?”

“হুম!”

‘তাইলে তুমি সাইমা আপার কথা কইতেছো।”

‘মেয়েটার নাম তাহলে সাইমা।”

‘হ সমস্যা নাইকা তোমার নেত্রী খবর কইয়া দিব নে। তাইলে আইজকা আমার ছুটি আমি গেলাম তুমি না যাইতে দিলেও আমি যামু।”

বলেই তাজেল ব্যাগ নিয়ে দৌড় তা দেখে মেহবিন হাসলো। রান্নাবান্না নামাজ পরেই শুরু করে সে তাই তাড়াতাড়ি হয়ে যায়। মেহবিন গোসল করে খেয়ে নিল তারপর রেডি হয়ে বের হলো।

বিকেলে মেহবিন আজ তাড়াতাড়ি এসেছে । মেহবিন কে রিক্সা থেকে নামতে দেখেই তাজেল সবাইকে খবর দিতে গেল। মেহবিন বাড়ি এসে ফ্রেশ হয়ে নিল । একটা সাদা রঙের থ্রিপিস পরে মাথায় কাপড় দিয়ে ঘর তালা দিয়ে বের হলো। বাড়ির সামনে আসতেই দেখলো নওশি আর সাইমা কথা বলছে । কুলসুম আর তাজেল হাত দিয়ে কি যেন খেলছে। মেহবিন গিয়েই সবার সাথে কুশল বিনিময় করলো। হুট করেই মেহবিন বলল,,

“সাইমা তো কি ভাবলে?”

সাইমা মেহবিনের দিকে তাকালো কিন্তু কোন জবাব দিল না। তা দেখে মেহবিন দীর্ঘশ্বাস ফেললো। হাঁটতে হাঁটতে ওরা একটা মাঠের কাছে এসে পরেছে। ছোট বড় সবাই খেলছে কেউ ক্রিকেট তো কেউ ব্যাড মিন্টন আবার কেউ ফুটবল ও খেলছে। ওগুলোই মেহবিন দেখতে দেখতে আসছিল। তখন কতোগুলো ছেলে একসাথে এলো তাদের মধ্যে একজন এসে বলল,,

‘কিরে সাইমা নতুন ডাক্তারকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিস নাকি।”

হুট করে কারো কথায় চমকে সাইমা মেহবিনের হাত ধরলো। মেহবিন ছেলে গুলোর দিকে তাকালো আর সাইমার দিকে তাকিয়ে দেখল সাইমা ভয় পাচ্ছে তা দেখে মেহবিন বুঝতে পারলো হয়তো এই ছেলেটাই শামীম। মেহবিনের মুখটা মুহূর্তেই শক্ত হয়ে উঠলো। ও বলল,,

“তুমিই শামীম?”

শামীম কিটকিটিয়ে হেঁসে বলল,,

“আরে ডাক্তার ম্যাডাম দেহি আমারে চেনে।”

“হুম রাস্তা ছাড়ো।”

‘আরে এতদিন শুধু দূরে থেইকাই আপনারে দেখছি। আজ সামনাসামনি দেখলাম এত সহজে কি রাস্তা ছাড়া যায়।”

তখন তাজেল বলল,,

“শামীম ভাই রাস্তা ছাড়ো নাইলে কিন্তু খারাপ হইয়া যাইবো।”

“ঐ পুঁচকে কথা কম ক। দেখতেছোস না বড়রা কথা কইতেছে তুই কথা কস কেন? তোর মায় তোরে কিছু শিখাই নাই‌। আরে তোরে শিখাইবো কেমনে হেতি তো আবার অন্য নাগরের লগে ভাইগা গেছে গা।”

কথাটা শুনে তাজেল মেহবিনের জামা ধরে পেছনে গেল। মেহবিন খুব কষ্টে নিজের রাগটাকে কট্রোলে রেখেছিল কিন্তু তাজেলকে এ কথা বলতে শুনে ওর রাগটা হুট করে আরো বেড়ে গেল । ও কিছু বলবে তার আগে ওর একটা কল এলো। ও না দেখেই ফোনটা উঠিয়ে একটু সরে যাচ্ছিল তখন শামীম ওর হাত ধরলো। ও ফোনের মানুষ টাকে বলল,

“আপনাকে পরে ফোন দিচ্ছি। এখন একটু ব্যস্ত আছি।”

বলেই মেহবিন ফোনটা রেখে দিল। তখন শামীম বলল,,

“আমি তো দেখলাম আপনে ফ্রি আছেন তাহলে ব্যস্ত থাকার কথা কইলেন কেন?

মেহবিন এতোক্ষণ বোধ হয় শামীমের লিমিট ক্রস করার কথাই ভাবছিল। করে ফেললো মেহবিনের হাত ধরে। মেহবিন মুচকি হেঁসে বলল,,

“আমার মনে হয় এখন ব্যস্ত হয়ে পারবো তাই আগেই জানিয়ে রাখলাম আর কি।

বলেই মেহবিন শামীমের মুখে একটা ঘুষি মারলো। হুট করে ঘুষি খেয়ে শামীম পিছিয়ে গেল। আর সবাই অবাক চোখে মেহবিন কে দেখতে লাগলো। কেউ ভাবতেই পারে নি মেহবিন এরকম কিছু করবে। মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

“নেত্রী ওখান থেকে একটা ক্রিকেট খেলার ব্যাট নিয়ে আসো তো!”

তাজেল দৌড় দিল মেহবিন সাইমার দিকে তাকিয়ে বলল,,

“অন্যায় যে করে আর অন্যায় যে সহে দুজনেই সমান অপরাধী। জুলুমকারীর জুলুম সহ্য করাও একটা অপরাধ। যত চুপ থাকবে তত তাদের অত্যাচার বেড়ে যাবে।”

~চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে