কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-১১

0
449

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_১১
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

মেহবিন কথাটা শোনার সাথে সাথে একটু দাঁড়ালো। কথা বলা মানুষ টাকে একবার দেখলো। আর বলল,,

“সবাইকে দিয়ে যদি সব কাজ হতো। তাহলে আগেকার মানুষ গরু দিয়ে নয় গাধা দিয়েই হাল চাষ করতো।”

হুট করে এমন কথায় সবাই হতভম্ব হয়ে মেহবিনের দিকে তাকিয়ে রইল। যার উদ্দেশ্য কথাটা বলেছে মেহবিন সে আর কেউ নয় মিশু দাদুভাই শেখ শাহেনশাহ কে। তিনি মেহবিনের দিকে তাকালেন মেহবিন এর মুখটা কঠোর হয়ে আছে। তিনি রেগে কিছু বলতে গিয়েও আবার থেমে গেলেন। শান্ত স্বরে বললেন,,

“তাইলে তুমিই হেই ডাক্তার। যার জন্য তোমারে ডাকা হইছে হেই কাম করো।”

মেহবিন শেখ শাহনাওয়াজ এর দিকে তাকিয়ে বলল,,

“গরম পানি আনতে বলুন।”

মেহবিন মিশুর কাছে গেল সে চোখ বন্ধ করে আছে। তা দেখে মেহবিন বলল,,

“বন্ধু চোখ খোলো দেখো তোমার বন্ধু এসে পরেছে?’

“বন্ধু রক্ত দেখো তুমি।”

“তুমি চোখ খুলো রক্তের দিকে তাকাতে হবে না আমার দিকে তাকাও।”

মেহবিন মিশুর হাত ধরলো মিশু মেহবিনের দিকে তাকালো। এতোক্ষণ আরবাজ ওর পায়ের কাঁটা জায়গায় কাপড় চেপে ধরেছিল। আরবাজ মেহবিন কে জায়গা দিয়ে উঠে গেল । গরম পানি আনলে মেহবিন আস্তে আস্তে যত্ন করে কাটা জায়গা পরিস্কার করলো। ওষুধ লাগাতে যাবে তার আগে ও একবার মিশুর দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আজও কি তুমি আমায় কামড় দেবে?”

“যদি দিই তাহলে তুমি কি রাগ করবে বন্ধু?”

মেহবিন বুঝতে পারলো আজও দিতে পারে তারপরেও ও কিছু বললো না। ওষুধ লাগাতেই মিশু আরেক পা দিয়ে মেহবিন কে লাথি দিতে নিলে আরবাজ ওর পা ধরে ফেললো। মিশু একটু ব্যাথার জন্য শব্দ করলো কিন্তু মেহবিনের ঘাড় শক্ত করে ধরে রাখলো তা মেহবিন হেঁসে ওর পায়ে ঔষুধ লাগিয়ে ব্যান্ডেজ করে দিল। মেহবিন উঠতেই মিশু বলল,,

“ধন্যবাদ বাজপাখি তুমি আমার পা না ধরলে আমি বন্ধুকে ব্যাথা দিতাম।’

আরবাজ কিছু না বলে শুধু হাসলো। মেহবিন মিশুকে বলল,,,

“তুমি গাছ থেকে পরলে কিভাবে?”

“কি জানি আমি তো আমাদের গাছ থেকে পেয়ারা পারার জন্য গাছে উঠেছিলাম। কিন্তু কিভাবে যেন পরে গেলাম। নিচে একটা চারা ছিল আমি দেখতে পাইনি। তাতেই কেটে গেছে।”

“ওহ আচ্ছা তোমার সাথে কে ছিল?”

“বাজপাখি ছিল তো।”

মেহবিন একবার আরবাজ এর দিকে তাকালো সে করুন চোখে ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। মেহবিন বলল,,

“এভাবে করলে কিভাবে হবে বন্ধু। তোমাকে তো নিজের খেয়াল নিজে রাখতে হবে। কয়েকদিন আগেও তো মাথা ফেটে গেছিল আবার আজ পা কেটে গেল। এভাবে চলতে থাকলে কিভাবে হবে। তুমি না রক্ত দেখে ভয় পাও তাহলে সবসময় তো আমি আসতে পারবো না তখন তুমি ব্যাথা পাবে না। নিজের খেয়াল রাখতে হবে তো!”

“সরি বন্ধু আমি আজ থেকে নিজের খেয়াল রাখবো।”

তখন শেখ শাহেনশাহ বললেন,,

“কতো নিজের খেয়াল রাখো বোঝায় যায়। তোমার জন্য আলাদা কইরা ডাক্তার রাখতে হয়। আজ আবার তুমি বায়না করলা সেই ডাক্তার রে দিয়া চিকিৎসা করাইবা না তোমার নতুন কাউরে লাগবে।

ওনার কথা শুনে মিশু ভয়ে মেহবিনের হাত শক্ত করে ধরলো। মেহবিন বলল,,

“মিশুমনি যার কাছে কমফোর্টেবল তার কাছে থেকেই না, চিকিৎসা নেবে তাই না‌।”

“মিশু তো এর কাছেই কমফোর্টেবল ছিল তুমি আইসা ওর কমফোর্টেবল জোন বদলাই দিছো।”

মেহবিন আর কিছু বললো না একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো। মেহবিন একবার শেখ শাহেনশাহ এর পাশে মেয়েটাকে দেখলো‌। মেয়েটা কেমন করে যেন ওর দিকে তাকিয়ে আছে। মেহবিন তার কাছে গিয়ে বলল,,

“আপনিই তাহলে মিশুমনির পার্সোনাল ডক্টর?”

“জি আমিই সে!”

“আমি ডক্টর মেহবিন মুসকান।’

“আমি ডক্টর নূপুর।”

“ওহ আচ্ছা!”

“আপনার নামটা কোথায় যেন শুনেছি কিন্তু মনে করতে পারছি না।”

মেহবিন কিছু বললো না শুধু হাসলো তারপর মিশুর কাছে গিয়ে বলল,,

“বন্ধু আমায় যেতে হবে আমি আসি ঠিক আছে।”

তখন মিশু বলল,,

“বন্ধু শুক্রবার আসবে তো আমার সাথে দেখা করতে?”

“হ্যা আসবো তো। আল্লাহ হাফেজ মিশুমনি! নিজের খেয়াল রেখো। আমি যেন তোমাকে আর আহত হতে না দেখি।”

“আচ্ছা।”

তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“দুপুরের খাবারের সময় তো হয়ে গেছে কিছু খেয়ে যান!”

মেহবিন প্রতিবারের মতো মুচকি হেসে বলল,,

“দুঃখিত আপনার প্রস্তাব গ্ৰহন করতে পারছি না। আমায় যেতে হবে হাসপাতালে কাজ আছে।”

তখন শেখ শাহেনশাহ বললেন,,

“শেখ বাড়িতে এসে কেউ খালি মুখে যায় না।”

“আমি তো যাই জিজ্ঞেস করুন এ বাড়ির লোকেদের।”

“আরবাজ যাও মেয়েটারে হাসপাতালে দিয়া আইসো।”

“আমি নিজেই যেতে পারবো সাবেক চেয়ারম্যান সাহেব। আমার কাউকে দরকার নেই।”

বলেই মেহবিন বেরিয়ে গেল। সকলে অবাক হয়ে মেহবিনের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। মেহবিন কিভাবে জানলো শেখ শাহেনশাহ আগে চেয়ারম্যান ছিলেন। মেহবিন রাস্তায় যেতেই কিছুক্ষণ পর রিক্সা পেয়ে গেল একেবারে হাসপাতালে গেল। নিজের কেবিনে বসলো দুপুরের খাবার খাবে এমন সময় একজন নার্স এলো নিচে একজন গুলিবিদ্ধ অবস্থায় এসেছে। মেহবিন তাড়াতাড়ি করে নিচে যেতেই দেখলো মুখর ডান হাত দিয়ে বাম হাত চেপে রেখেছে বাম হাতে গুলি লেগেছে। মেহবিন মুখর কে বসিয়ে ওর শার্টের হাতা কাঁচি দিয়ে কাটতে লাগল তা দেখে মুখর বলল,,

‘আপনি আমার ইউনিফর্ম এভাবে কাটছেন কেন? আমার ইউনিফর্ম টা নষ্ট হয়ে যাবে তো।”

মুখরের এরকম কথা শুনে মেহবিনের রাগ হলো। তাই ও শান্ত স্বরে বলল,,

“যখন গুলি লেগেছে তখনই আপনার ইউনিফর্ম নষ্ট হয়ে গেছে। এখন নষ্ট ইউনিফর্ম কে কাঁচি দিয়ে কেটে নতুন করে আমি আর কি নষ্ট করবো।”

“তবুও আমার ইউনিফর্ম।”

“নিশ্চয়ই আপনার আরো ইউনিফর্ম আছে।”

“থাকলে কি হবে এটা তো আমার সবথেকে ফ্রেবারিট।”

“একদম বাচ্চামো করবেন না নাহলে কিন্তু পুরো শার্টটাই খুলে রেখে দেব।”

“আয় হায় মেয়ে বলে কি শার্ট খুলে নিলে আমার মান সম্মান সব এখানেই যাবে।”

“আপনি আপনার মুখটা বন্ধ করবেন নাকি,,

“করছি করছি!”

মুখর আর কোন কথা বললো না। মেহবিন ট্রিটমেন্ট শুরু করলো মেহবিন কে দেখে মনে হচ্ছে খুব রেগে আছে। তা দেখে মুখর হাসলো। মেহবিন মুখরকে হাসতে দেখে বলল,,

“বেশি দাঁত কেলালে মুখ কিন্তু সেলাই করে দেব।”

মেহবিনের কথা শুনে মুখর ফিসফিস করে বলল,,

“আপনাকে রাগতে দেখলে আমার ভিশন ভালো লাগে ডক্টর।”

“আপনার ভালো লাগা আপনার কাছেই রাখুন।”

“আমি একজন আহত ব্যক্তি। আমার সাথে একটু মিষ্টি করে হাসিমুখে কথা বলুন। যাতে আপনার হাসিতে ডুবে আমার সব কষ্ট ভুলে যাই।”

মেহবিন চোখ পাকিয়ে ওর দিকে তাকালো তা দেখে মুখর বলল,,

“আয় হায় এই দৃষ্টিতেই তো মুখর শাহরিয়ার খুন হয়ে যায়।”

এরকম পরিস্থিতিতে এ কথা শুনে মেহবিনের ইচ্ছে হচ্ছে মুখরের মাথা ফাটিয়ে দিতে। কিন্তু ও পারছে না। মেহবিন যত্ন করে মুখরের হাতে ব্যান্ডেজ করে দিল। আর সাথে সাথেই ওখান থেকে চলে গেল। কেন চলে গেল সেটা মুখর ভালো করেই বুঝতে পারলো। মুখর আস্তে আস্তে মেহবিনের কেবিনে গেল দেখলো মেহবিন মাথা নিচু করে দুই হাত দিয়ে চেপে ধরে রেখেছে। তা দেখে মুখর বলল,,

“মানলাম সে কাঁদতে জানে না তারমানে এটা নয় তার কষ্ট হয় না।”

মুখরের এমন কথায় মেহবিন মাথা উঁচু করলো। মুখর মেহবিনের চোখের দিকে তাকালো। না সব স্বাভাবিকই রয়েছে তাকে দেখে কেউ বলতে পারবে না তার ভেতরে কিছু আছে। মুখরকে দেখে মেহবিন তাড়াতাড়ি করে বলল,,

“আপনি এখানে কেন? আপনার তো রেস্টের প্রয়োজন।”

মুখর চেয়ারে বসে বলল,,

“আরে রিল্যাক্স পুলিশদের এরকম আঘাতে কিছুই হয় না। তাছাড়া তুমি ব্যান্ডেজ করে দিয়েছো তো দেখবে কিভাবে ফাইভ জি স্পিডে ক্ষত সেরে যায়।”

“আপনার হেঁয়ালিপূর্ণ কথা রাখুন এবার বলুন এরকম কিভাবে হলো।”

“আজ ডক্টর বাবুল কে কোর্টে ওঠানোর ডেট ছিল। ওকে নিয়ে যাচ্ছিলাম মাঝপথে কেউ পথ আটকে দেয়। আর আমাদের দিকে গুলি ছুড়তে থাকে শুরু হয় গুলাগুলি এক পর্যায়ে দেখি বাবুল পালাচ্ছে। ওর দিকে গুলি ছুড়তে যাবো তখন কেউ আমার বা হাতে গুলি করে দেয়।”

মেহবিন সবকিছু শুনে বলল,,

“আপনি কিন্তু আমায় বলেছিলেন আপনি নিজের খেয়াল রাখবেন।”

‘এমনিতে আমি নিজের খেয়াল রাখি কিন্তু এরকম ভুলে হয়ে যায় আর কি‌ ।”

“একদম আজাইরা কথা বলবেন না। এই জন্যই তো আপনার দাদি আপনাকে এই পেশা ছেড়ে দিতে বলে।”

“আর আমার দাদি!! হেয় তো সবসময় আমার ভালোই চায় কিন্তু ভালো চাইতে গিয়ে কখনো কখনো খারাপ হয়ে যায়।”

“সে কথা বাদ দিন দুপুরে খাবার খেয়েছেন?”

“আর খাওয়া! গুলি খেয়েই পেট ভরে গেছে আমার।”

মেহবিনের খাবারটা ওর সাইডেই ছিল মেহবিন একটা প্লেটে বেড়ে মুখরের সামনে দিল। তা দেখে মুখর বলল,,

“আমার হাত তো?”

“গুলি বাম হাতে লেগেছে ডান হাতে না।”

“জালিম কোথাকার!”

মেহবিন বলল,,

“ভালো! হয়েছে এখন খান।”

“তুমি খেয়েছো?”

“না আমি খাবো না।”

“কেন?”

“আপনার গুলি খাওয়া দেখে পেট ভরে গেছে।”

মেহবিনের কথায় মুখর হাসলো আর বলল,,

“আমি খেলে তুমি খাবে কিভাবে? এখানে তো একজনের খাবার আছে। তাই বলছো তুমি খাবে না।”

“আমি আপাতত চকলেট খেয়ে নিব আর বাড়ি গিয়ে খাবার খেয়ে নেব আপনি খান।”

“তুমি মেয়ে এতো সত্যবাদী কেন হুম। তুমি কিছুই আড়াল করো না ।”

‘আমি এরকমই তবে সবকিছু প্রকাশ কিন্তু আমি সবার কাছে করি না।”

“হুম আমি তো এখন শেখ বাড়িতে যাবো। ওখানে গিয়ে খেয়ে নেব তুমি খাও।”

“তারা তো আর জানে না আপনি গুলি খেয়ে বাড়ি ফিরবেন। তারা সকলে খেয়ে নিয়েছে আপনি খান এখন।”

“তুমি কিভাবে জানলে?”

“মিশুর পা কেটে গেছিল তাই গিয়েছিলাম। এখন একটাও কথা না খান।’

“আমি,,”

“কি বললাম আপনাকে খেতে বললাম না। এতো বেশি কথা বলেন কেন? খাওয়ার পর ওষুধ আছে তাড়াতাড়ি সুস্থ হবে তো নাহলে অপরাধীদের কিভাবে ধরবেন?

“তা ঠিক বলেছো খেয়েই নিই। তোমার হাতের রান্না অনেকদিন পর। শুকরিয়া আল্লাহ আমার রিজিক এখানে দেওয়ার জন্য।”

মেহবিন কিছু বললো না। এই সময় এখানে কেউ আসবে না। তাই মেহবিনের কোন চিন্তা নেই। মুখর খাচ্ছে আর মেহবিনের দিকে তাকাচ্ছে মেহবিন একটা চকলেট নিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে খাচ্ছে ‌। মুখর অর্ধেক খাবার সাইড করে রেখে তারপর নিজের হাত ধুয়ে নিল অন্য এক বাটিতে। মুখর হাত ধুয়ে বলল,,

“আমার খাওয়া ডান এখন খেয়ে নাও তুমি!”

মেহবিন মুখর কে ওষুধ দিয়ে বলল,,

“চকলেট বয় নিচে এসেছে আপনাকে নিতে এখন আপনি বাড়ি যান গিয়ে রেস্ট নিন। আর হ্যা ঠিক মতো ওষুধ খাবেন। কাল ছুটি নিন পুলিশ স্টেশনে যেতে হবে না।”

“এর মাঝে আরবাজ কেও বলেছো?

“আপনার কি মনে হয় এই সময় আপনাকে ড্রাইভ করতে দেব।”

“তুমি না একটা,,!

মেহবিন ভ্রু কুঁচকে বলল,,

“কি?”

“কিছু না।”

“আল্লাহ হাফেজ আমার সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে।”

“খেয়ে নিও কিন্তু আল্লাহ হাফেজ।”

বলেই মুখর চলে গেল। মেহবিন মুখরের রাখা খাবার গুলো খেয়ে নিল। এরপর আবার পেশেন্ট দেখতে লাগলো। আজ একটু তাড়াতাড়িই বাড়ি ফিরছে মেহবিন । চারটার দিকে এসেছে সে কারন পরে আর পেশেন্ট ছিল না। মেহবিন রিক্সা থেকে নামতেই দেখলো দুজন মহিলা ওর বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে মেহবিন তাদের দিকে এগিয়ে বলল,,

“কিছু দরকার আপনাদের?”

তাদের মধ্যে একজন বলল,,

“হ তোমারে আছিল।”

“জি বলুন?”

“আমার মাইয়ার আইজ অজ্ঞান হইয়া গেছিল। তুমি যদি একটু দেখতা।”

“কখন অজ্ঞান হয়েছিল?”

“এগারোটার দিকে।’

“সেই সকালে হয়েছিল প্রায় এখন বাজে সাথে চারটা আপনারা হাসপাতালে না নিয়ে আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।”

“জ্ঞান আইছিলো দেইখা নেই নাই।”

“আচ্ছা চলেন দেখি?”

মেহবিন ওনাদের সাথে চললো পাঁচ মিনিট যাওয়ার পর বাড়ি এসে গেল। ঘরে গিয়ে দেখলো একটা রোগা পাতলা মেয়ে শুয়ে আছে। চোখের নিচে দিয়ে কালি জমে আছে। মেহবিন গিয়ে মেয়েটাকে চেক আপ করলো তারপর তার মাকে জিজ্ঞেস করল,,

“আপনার মেয়ে কি বিবাহিত?”

মেহবিনের এই প্রশ্ন শুনে সবাই একে অপরের দিকে তাকালো। মেহবিন মেয়েটার দিকে তাকালো মেয়েটা মাথা দিয়ে কি যেন না না করছে মেহবিন কে হয়তো নিষেধ করছে কিছু বলতে। মেয়েটার মা বলল,,

“না আমার মেয়ে বিবাহিত না কেন কি হইছে? ওর বয়স তো সবে পনেরো।

মেয়েটার মায়ের কথা শুনে মেহবিন বুঝতে পারলো মেয়েটা কি না না করছিল। মেহবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো আর বলল,,

“না না এমনিই ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করে না। শরীরে ক্যালসিয়াম আর ভিটামিন এর অভাব তাই এরকম হয়েছে।”

“আর কইয়ো না কতোবার কই ঠিক মতো খা। এই রোগা পাতলা শরীর দেইখা তোরে বিয়া করবো কিরা? যদি আমার কথা হুনে একটু।”

মেহবিন বলল,,

“আপনারা একটু যান আমি ওর সাথে একলা একটু কথা বলতে চাই।”

“একলা ক্যান আমিও থাহি।”

“দেখি ওর আরো কোন সমস্যা আছে কি না। কারন সব তো আর বোঝা যায় না ও নিজে বললে সুবিধা হবে। আপনি থাকলে ভয়ে হয়তো কিছু বলবে না।”

“আইচ্ছা ঠিক আছে।”

বলেই সবাই ঘর থেকে চলে গেল। মেহবিন মেয়েটার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে বলল,,

“আমি কিছু বলবো নাকি তুমি বলবে?”

মেয়েটি উত্তেজিত হয়ে বলল,,

“আমার পেটে কি বাচ্চা আছে ডাক্তার আপা?”

এই পিচ্চি মেয়ের মুখে বাচ্চার কথা শুনে অবাক হওয়ার কথা থাকলেও মেহবিন অবাক হলো না। মেহবিন শান্ত স্বরে বলল,,

“না!”

“তাইলে কি সমস্যা?”

“তোমার শারীরিক সম্পর্ক যা তোমার শরীর গ্ৰহন করতে পারে নি। তাই এই অবস্থা। এখন বলো তুমি সেচ্ছায় এসব করেছো নাকি কেউ জোর করে কিছু করেছে।”

একথা শুনেই মেয়েটা কেঁদে উঠলো। আর বলল,,

“আমি তো এইসব কিছুই বুঝি না ডাক্তার আপা। চারদিন আগে শামীম ভাই কইলো আমারে নিয়া বেরাইতে যাইবো হেই ঢাকায় তার বইনের বাড়ি।”

“শামীম কে?”

“আমার কাকাতো ভাই যে মহিলা মায়ের সাথে আপনারে ডাক দিতে গেছিল তার পুলা। হের এইবার পড়াশোনা শেষ।”

“তারপর বলো?”

“মারে কইলে মায় কইলো আপাগো বাড়ি থেইকা ঘুইরা আসতে। সবে স্কুল শুরু হইছে এখন ক্লাস না করলেও হইবো। আমিও খুশি মনে গেলাম কিন্তু মাঝ রাস্তায় যাইয়া আমারে এক বোতল আর সি কিনা দিল আমিও খাইলাম কিছুক্ষণ পর আমার কেমন জানি লাগতেছিল ভালো লাগতেছিল না মাথা ঝিম মাইরা ধরলো। আমি কইলাম শামীম ভাই আমার ভালো লাগতেছে না উনি কইলো আর একটু আইসা পরছে। আমিও চুপ কইরা রইলাম বাস থামলে হেয় আমারে হাত ধইরা নামাই লো। তারপর একটা বাড়ি ঢুকলো এদিকে আমি চোহে কিছু দেহি না। আমি ভাবলাম হয়তো আপাগো বাড়ি আইসা পরছি আমিও গেলাম উনি রুমে নিয়া গিয়াই আমি কিছু বলার আগেই উনি আমারে তারপর ,,

বলতে বলতেই মেয়েটা কেঁদে উঠলো মেহবিন গিয়ে ওকে জরিয়ে ধরলো। মেহবিন বুঝতে পারলো কি হয়েছে মেয়েটার বয়সি বা কতটুকু মেয়েটা বলছেও সে কিছু বোঝেনা কিন্তু তার সাথে খারাপ কিছু ঘটেছে এটা সে বুঝতে পেরেছে আর এর থেকে সন্তান ও হওয়া সম্ভব এটাও বুঝেছে সে। মেহবিন মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিল তখন মেয়েটা বলল,,

“আমি তো শামীম ভাই রে বিশ্বাস কইরা গেছিলাম আমার মায় বাপ ও তারে বিশ্বাস কইরা আমারে এতদূর পাঠাইছে তাইলে উনি আমার সাথে এইরকম কেমনে করতে পারলো। আমি তো তারে আমার ভাই মানি আমার বাপ মাও তারে পুলা মানে তাইলে হেয় কেমনে পারলো এইরকম একটা কাজ করতে। হেয় আমারে আর আপার বাড়ি নেয় নাই বাড়ি আইসা কইছে আমি নাকি রাস্তায় অসুস্থ হইয়া পারছিলাম তাই আপার বাড়ি যায় নাই। আমার মায় বাপে এক কথায়ই বিশ্বাস কইরা নিছে। এতো বিশ্বাস করা মানুষ গুলারে উনি কেমনে পারলো ঠকাইতে। উনি কেমনে পারলো একটা মেয়ের ইজ্জত নিতে আমি তো ওনার কাকাতো বোন কিন্তু বইনের মতোই তো।

মেহবিনের হাত দুটো শক্ত হয়ে উঠলো। মনে হচ্ছে এখনি ঐ ছেলেটাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলতে কিন্তু ও পারছে না। মেহবিন মেয়েটাকে সোজা করে বসিয়ে বলল,,

“শান্ত হও! সব ঠিক হয়ে যাবে। তুমি পুলিশের কাছে চলো শামীম কে ওর কৃতকর্মের শাস্তি অবশ্যই পেতে হবে।”

“না আমি পুলিশের কাছে যামু না। ওনে গেলেই সবাই আমার কথা জাইনা যাইবো। আমার মায় বাপে এইসব হুইনা তহনি মরবো। আমগো কাছে আমাগো মান সম্মানই সব।”

“তাই বলে অপরাধী নিজের শাস্তি পাবে না।”

“আপনি না কইলে কেউ জানবো না। কারন আমি মা হমুনা কারন তহন সব শেষ হওয়ার পর আমার জ্ঞান ফিরলে উনি আমারে ওষুধ খাওয়ায়ছিল। আর কইছিল কেউ কিছু বুঝবো না উনি আমার লগে কিছু করছে কিনা। আর কইছে যদি আমি মুখ খুলি তাইলে উনি নাকি ভিডিও বানাইছে হেইডা সবার কাছে কইয়া দিব।”

এবার তো মেহবিনের পুরো মাথাটাই গরম হয়ে গেল। একটা ছেলে কতটা খারাপ হলে এরকম করতে পারে। এরকম ঘটনা শুধু শহরে না গ্ৰামেগনঞ্জে কোথায় কোথায় হচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। মেহবিন বলল,,

“এবার যদি ভিডিও নিয়ে তোমাকে ব্লাকমেইল করে আবার সেরকম কিছু করতে চায় তাহলে কি করবে তুমি?”

মেয়েটা এবার মাথা নিচু করে নিল। আর বলল,,

“পুরশুদিন স্কুল থেইকা দুই পিরিয়ড কইরা বাইর হইতে বলছে।”

মেহবিন এবার আর নিজেকে সামলাতে পারলো না উঠেই সিমেন্ট এর খুঁটিতে জোরছে একটা ঘুষি দিল। এটাই ওর রাগ নিয়ন্ত্রণের একটা পদ্ধতি। কোন কিছুর আওয়াজ পেয়ে মহিলা দু’জন বাইরে থেকে ঘরে ছুটে এলেন। এসেই বললেন,,

“কি হয়েছে?”

মেহবিন বলল,,

“কিছু না ব্যাগটা খুঁটির সাথে জোরে লেগেছিল।”

মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আমার মেয়ে কান্দে ক্যান?”

“আপনার মেয়ে ভয় পাচ্ছে যে বড় কোন রোগ হয়েছে কি না। আপনার মেয়েকে ভয় পেতে বারন করুন কারন এখনো সব হাতের বাইরে যাইনি চাইলেই কিছু করতে পারবো আমরা।”

“মানে?”

“মানে হলো এখন ঠিক মতো খাওয়া দাওয়া করলে ভিটামিন আর ক্যালসিয়াম এর অভাব পূরণ হয়ে যাবে।”

“ওহ আচ্ছা।

তিনি গিয়ে গিয়ে মেয়েকে জরিয়ে ধরে বলল,,

“আরে তুই ভয় পাইস না। সব ঠিক হইয়া যাইবো।”

মেয়েটা ওর মাকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দিল আর বলল,,

“আম্মা আমার খুব ভয় করতেছে আমি মনে হয় আর বাচুম না ‌।”

বলেই আরও জোরে জোরে কাঁদতে লাগল মেহবিন বুঝতে পারলো এই কান্না কিসের। এ যে অপরাধীকে শাস্তি না দিতে পারার কান্না। নিজের সতীত্ব হারানোর কান্না। সব মুখ বুজে সহ্য করার জন্য কান্না। মেহবিন মেয়েটাকে বোঝাতে ব্যর্থ তা ভেবে সে নিজেকেও ব্যর্থ ভাবছে। মেহবিন শূন্য চোখে বের হতে নিল। তখন সেই মেয়েটা বলল,,

“ডাক্তার আপা!”

মেহবিন বলল,,

“কেউ যদি যেচে নিজের জীবনকে নষ্টের দিকে নিয়ে যায় সেখানে অন্যকেউ কিভাবে তার জীবন কে ভালো করবে বলো। নিজের জীবন কে ভালো করতে হলে নিজেকেই শক্ত হতে হবে আর জীবনের হাল ধরতে হবে। নিজের খেয়াল রেখো আসছি ‌।”

“আপনে?”

‘প্রকৃতির সাথে সময় কাটাও ভালো লাগবে। আজ আসি নিজের খেয়াল রেখো। আর হ্যা আমি সবসময় তোমার পাশে আছি।”

বলেই মেহবিন বেরিয়ে আসলো পাঁচটা বাজতে কিছু মিনিট বাকি। রাস্তায় বেরুতেই দেখলো তাজেল দাঁড়িয়ে আছে মেহবিন বুঝলো ওর জন্যই‌। মেহবিন একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো আজকাল কারো কাছেই মেয়েরা নিরাপদ নয় দেশে কোথায় কোথায় মেয়েরা এভাবে হ্যারাসমেন্ট হচ্ছে কে জানে। কাকাতো ভাই হলে কি হবে মেয়েটা তো ছেলেটাকে নিজের ভাই মেনে আসছিল এতোদিন। ভাই হিসেবে যাকে প্রটেক্ট করার কথা সেখানে ভাই হয়েই সে জঘন্য একটা কাজ করেছে। এই জামানায় কে কাকে বিশ্বাস করবে। এরকম কতো ধর্ষণ হচ্ছে কে জানে। হয়তো এই মেয়েটার মতো নিজের সম্মানের কথা ভেবে চুপ করে সব সহ্য করছে । আবার কেউ হয়তো নিজেদের ইচ্ছায় কি আর বলবো আজকাল হারাম রিলেশনশিপ একটা ট্রাডিশন হয়ে দাড়িয়েছে। আসতাগফিরুল্লাহ, নাউযুবিল্লাহ, আল্লাহুম্মাগফিরলী! আল্লাহ তায়ালা সকল হারাম থেকে বাঁচিয়ে রাখুক। এসব ভাবতেই ভাবতেই তাজেল মেহবিনের কাছে চলে এলো। মেহবিন আজ আর কিছু বললো না ওর খুব রাগ হচ্ছে ঐ ছেলেটার প্রতি। তাজেল মেহবিনের হাতি ধরে বলল,,

“ডাক্তার আজ ইস্কুলে গেছিলাম আমার দুই জন নতুন বন্ধু হইছে জানো?”

মেহবিন শুধু বলল,,

“ভালো!”

তাজেল হেঁসে দুইটা লজেন্স হাতে নিয়ে মেহবিনের সামনে রেখে বলল

“ডাক্তার তোমার লাইগা ইস্কুল থেইকা লজেন আনছি।একটা ধরো খাও। আইজকা একসাথে লজেন খামু একটা তোমার একটা আমার।

তাজেলের লজেন্স দেখে মেহবিনের একটু ভালো লাগলো। তাজেলের মুখে হাঁসি দেখে মেহবিনের মুখেও হাসি ফুটে উঠল। কেন যেন মনে হচ্ছে তাজেল এর মুখের হাসিই ওর বুকে প্রশান্তি দিচ্ছে। মেহবিন মুচকি হেসে একটা লজেন্স নিল আর খেয়ে বলল,,

“নেত্রী বলো তো তোমার লজেন বেশি মজা নাকি আমার চকলেট।”

তাজেল হেঁসে বলল,,

“দাও তাইলে চকলেট আমি খাইয়া দেহি কোনটা বেশি স্বাদ।”

ততক্ষণে তাজেলের মুখের লজেন্স শেষ। মেহবিন নেওয়ার সাথে সাথেই সে লজেন্স এর প্যাকেট ছিড়ে গালে দিয়েছিল। মেহবিনের কথা শুনে সে চিবিয়েই খেয়ে ফেলেছে। তা দেখে মেহবিন হাসলো আর ব্যাগ থেকে একটা চকলেট দিয়ে বলল,,

“ধরো খেয়ে বলো।”

তাজেল দাঁত কেলিয়ে বলল,,

“আমি জানি তোমারে কইলে তুমি চকলেট দিবা। আসলে তোমার সব চকলেট ফুরাইয়া গেছে আমার খাইতে ইচ্ছা করছিল তাই কইলাম। আমি না খাইয়াও কইতে পারি তোমার চকলেট বেশি স্বাদ।”

বলেই তাজেল হাসলো মেহবিনের কি হলো মেহবিন হাঁটু গেড়ে বসে ওকে জরিয়ে ধরে বলল,,

‘তুমি জানো নেত্রী? তুমি আমার জীবনের এক টুকরো প্রশান্তি।”

~ চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে