কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-১০

0
470

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_১০
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

(অনুমতি ব্যতিত কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ)

“আপনি নাকি টাকার সমস্যার জন্য নেত্রী কে পরতে দেবেন না?’

মেহবিনের কথায় তাজেলের সৎ মা মুখ বাঁকিয়ে বলল,,

“বাবাহ এ কথাও তোমারে বইলা দিছে। হ আমি টাহার জন্য ওরে পড়ামু না। আমাগো ভাতই চলে না ঠিক মতো ওরে আবার স্কুলে পড়ামু কেমনে?”

“আমার জানামতে গ্ৰামের সরকারি স্কুলে পড়তে তেমন টাকা লাগে না। শুধু ভর্তি হওয়ার সময় পঞ্চাশ একশো টাকা লাগে। তারওপর সরকারি ফান্ড থেকে উপবৃত্তি দেওয়া হয় প্রত্যেক স্টুডেন্ট কে। তারপরেও ওকে কেন পড়াবেন না আপনি?”

“দেহো আমগো পরিবারে তুমি কথা কইবা না। ইস্কুলে নাহয় টাহা লাগলো না বুঝলাম। ওরে ইস্কুলে যাওয়ার জন্যে ইস্কুল ড্রেস বানাইতে টাহা লাগবো। আবার ইস্কুল ব্যাগ কিনা দিতে হইবো সেই টাহা আমি পামু কোনে? তাছাড়া এহনকার পুলাপাইন গো আবার প্রাইভেট পড়ানো লাগে হেয় ছোট থেইকায় সেই টাহা পামু কোনে তাই তো ওর পড়া বন্ধ করছি।”

“তারমানে শুধু স্কুল ড্রেস একটা স্কুল ব্যাগ আর প্রাইভেট পড়ানোর জন্য ওকে স্কুলে পাঠান নি তাই তো?”

“হ তাই!”

মেহবিন মনে মনে হাসলো এরকম লেইম এক্সকিউজ শুনে। মূলত উনি চান না তাজেল পড়াশোনা করুক। এমনিতে তাজেলদের পরিবার খুব ভালো না চললেও একেবারে খারাপ ও চলে না। সপ্তাহে বা পনেরো দিনে তাজেলের বাবা মুরগি কেনে খাওয়ার জন্য।যদিও তাজেলের ভাগ্যে সেগুলো তেমন ভাবে জুটেনা। এগুলো তাজেলই বলেছে মেহবিন কে। তাই মেহবিন বলল,,

“যদি স্কুল ড্রেস, স্কুল ব্যাগ আর প্রাইভেট পড়ানোর টাকা হয়ে যেত তাহলে ওকে পড়াতেন ?”

“অবশ্যই পড়াতাম সতিনের মাইয়া বইলা কি ওরে অশিক্ষিত কইরা রাখতাম নাকি।”

“ওকে সমস্যা নেই আমি নেত্রীর স্কুল ড্রেস বানিয়ে দেব। স্কুল ব্যাগ ও কিনে দেব। আর হ্যা নেত্রী আমার কাছে প্রাইভেট পরবে। এখন কোন সমস্যা নেই তো।”

তাজেলের সৎ মা একবার মেহবিনের দিকে তাকিয়ে মুখ ভেংচি দিয়ে বলল,,

“আপনে যদি সব দেন তাইলে আমার আপত্তি থাকবো কোন থেইকা। এমনিতেও সারাদিন আকাম কুকাম করে আর ঘুইরা বেড়ায় স্কুলে গেলে ভালোই হইবো। দ্যাখ তাজেল দ্যাখ আমি দেইহা তোরে পড়ানোর সুযোগ কইরা দিলাম। অন্য কোন সৎমায় হইলে সব পাইয়াও কইতো সতিনের মেয়েরে শিক্ষিত করা লাগবো না।”

এ কথা শুনে তাজেল হেঁসে বলল,,

“তুমি কোনে সুযোগ দিলা? সুযোগ তো ডাক্তার কইরা দিল আর আমি নিলাম।”

তাজেলের কথায় মেহবিন হাসলো। তাজেলের মা মুখ বাঁকিয়ে চলে গেল। মেহবিন সকাল হতেই রান্না শেষ করে তাজেলের বাড়ি এসেছে ওর পড়াশোনার জন্য কথা বলতে। তাজেলের বাবার সাথে কথা বললে তিনি বলেন তাজেলের মায়ের সাথে কথা বলতে তিনি এখন কাজে বেরুবেন। তবে তিনি বলেছিলেন তাজেলের নাকি পড়ায় মন বসেনা তাই তাজেলই স্কুলে যায় না । একথা শুনে মেহবিন অবাক হলেও পরে বুঝেছে হয়তো তাজেলের মা বলেছে এই কথা। তাই সে পড়ার ব্যাপারে বলল তাজেলের বাবা মেহবিন এর কথা শুনে বলল তাজেল যদি যেতে চায় তাহলে তার আপত্তি নেই। এই সব কথা তাজেলের মা শুনেছিল তাই স্বামীর কাছে ভালো হওয়ার জন্য তাজেলকে পড়ানোর কথা বলল। যদিও নিজের লাভটাও দেখে নিয়েছে সে। তাজেলের পেছনে তার কোন খরচ হচ্ছে না। বরং লাভ হয়েছে এখন তাজেলের কথা বলে তিনি টাকা নিতে পারবেন। মেহবিন তাজেলকে বলল,,

“আমার নেত্রী ও তাহলে স্কুলে যাবে। বিকেলে তৈরি থেকো তোমায় নিয়ে দোকানে যাবো স্কুল ড্রেসের কাপড় আর ব্যাগ কিনতে তারপর দর্জির দোকানে যাবো। কাল সকাল থেকে তুমি আমার কাছে পরবে ঠিক আছে। কিন্তু তোমাকে স্কুলে ভর্তি করাতে নিয়ে যাবে কে? আমি তো এখন হাসপাতালে যাবো।”

“তুমি চিন্তা কইরো না দুপুরে আমার বাপ কাম থিকা বাড়ি আসবো তহন বাপরে কইলে নিয়া যাইবোনে স্কুল তো দূরে না পাঁচ মিনিট এর পথ। এই বিষয়ে আমার বাপে ভালো আছে এহনো। তুমি বাড়ি যাও আমি কুলসুম রে কইয়া আসি আমিও স্কুলে যাইতে পারুম এহন থিকা।”

বলেই তাজেল একটা দৌড় দিল। মেহবিন ও হেঁসে বাড়ির দিকে গেল। গিয়েই দেখলো সেদিনের মহিলাটা যে মেহবিনের ফ্রিজে দুধ রেখে গিয়েছিল এখন নিতে এসেছে। মেহবিন তাকে দুধ দিয়ে রেডি হয়ে নিল। তারপর খাওয়া শেষ করে ঘর তালা দিয়ে রাস্তায় এলো। পাকা রাস্তায় উঠতেই দেখলো মুখর পুলিশের জিপ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মেহবিন কে দেখেই সে মুচকি হাসলো।আর বলল,,

“আসসালামু আলাইকুম। অবশেষে আপনি এলেন?”

“ওয়ালাইকুমুস সালাম। কেন আমার জন্য অপেক্ষা করছিলেন বুঝি?

“তা তো একটু করছিলাম। আজকে একটা বড় দায়িত্ব নিয়ে বিশেষ পদে বসতে যাচ্ছি। কিন্তু আপনার সাথে দেখা না করেই চলে যাবো ব্যাপারটা কেমন দেখায় না।”

মেহবিন হেঁসে ব্যাগ থেকে দু’টো জবা ফুল বের করলো। এগুলো ওর ঘরের পেছনের গাছ থেকে এনেছে। মেহবিন হেঁসে জবা ফুল গুলো মুখরের সামনে ধরে বলল,,

“আপনাকে অনেক প্রীতি ও শুভেচ্ছা। এবং নতুন দায়িত্ব পালনের জন্য শুভকামনা রইল।”

“ইনশাআল্লাহ আমি আমার দায়িত্ব অবশ্যই পালন করার সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো।”

“হুম তাহলে আপনি যান আপনার কাজে।আর আমি যাই আমার কাজে।”

মুখর হেঁসে বলল,,

“বিহঙ্গিনী কি কিছু ভুলে যাচ্ছে?”

মেহবিন আশেপাশে তাকালো এই সময় কেউ নেই। আজ সে আগেই বের হয়েছে। মেহবিন জিপের দিকে এগিয়ে গিয়ে ফ্রন্ট সিট থেকে মুখরের পুলিশি ক্যাপ নিয়ে এলো । মুখর হেঁসে মাথা নিচু করলো মেহবিন মুখরের মাথায় ক্যাপটা পড়িয়ে দিল। আর বলল,,

“আল্লাহ তায়ালা আপনাকে এই হ্যাটের মর্যাদা রক্ষা করার তওফিক দান করুক।”

মুখর মুচকি হেসে বলল,,

“আমিন। তো আপনাকে হাসপাতালে ড্রপ করে দিই।”

“আমার হাসপাতাল উল্টো পথে। আপনি আপনার গন্তব্যের দিকে যান মিস্টার মুখর শাহরিয়ার। আমি আমার গন্তব্যের দিকে যাচ্ছি। আল্লাহ হাফেজ।

“আল্লাহ হাফেজ ফি আমানিল্লাহ।”

“ইনশাআল্লাহ।”

বলেই মেহবিন হাঁটা ধরলো। তা দেখে মুখর হেঁসে গাড়ি থেকে নরমাল একটা কালো ক্যাপ আর ফুল নিয়ে দৌড়ে মেহবিনের সামনে গিয়ে দাঁড়ালো। মেহবিন বলল,,

“কি?”

মেহবিনের হিজাবের ওপর দিয়ে মুখর ওকে ক্যাপ পরিয়ে দিল।আর হাতে ফুল দিয়ে বলল,,

“ফুল না নিয়েই কোথায় যাচ্ছো আমার কথা আমি সবসময় রাখি। যাই হোক আর এটা আমার তরফ থেকে একটা উপহার। পারলে এটা নিয়েই সবসময় চলাফেরা করবে আমার ভালো লাগে তোমায় এভাবে দেখতে। ফাইনাল আল্লাহ হাফেজ ফি আমানিল্লাহ।”

বলেই মুখর আবার দৌড়ে চলে গেল আর গাড়ি স্টার্ট করে ওখান থেকে চলে গেল। তা দেখে মেহবিন হেঁসে ফেললো। তারপর ক্যাপটা খুলে নিজের হাতে নিল ক্যাপের ওপরে সোনালী রঙের ছোট ছোট করে ইংরেজি তে লেখা KABBER BIHONGGINI। মেহবিন বুঝতে পারলো মুখর এটা অর্ডার দিয়ে বানিয়েছে।আর কেউ যাতে সরাসরিই বুঝতে না পারে কাব্যের বিহঙ্গিনী তাই ইংরেজি তে লিখেছে। মেহবিন হেঁসে মাথায় ক্যাপ টা পরে নিল। তারপর হাঁটা ধরলো আজ সে আগেই বেরিয়েছে তার মুডটাও ভালো তাই আজ হেঁটেই যাবে। হাসপাতালে যেতে একটা মাঠ পরে সেখানে তিনটি আট নয় বছরের বাচ্চা দাঁড়িয়ে ছিল। মেহবিন ওখান দিয়ে যাওয়ার সময় একজন গেয়ে উঠলো,,

” বোরখা পড়া এক মাইয়া
আমার মনটা নিল যে কাইরা।

তার সাথে বাকি দুজন ও গেয়ে উঠলো একই গান। মেহবিন একবার ওদের দিকে তাকালো ও বুঝতে পারল না ওকে টিজ করছে না এমনিই মজা নিচ্ছে। বাচ্চা দেখে কিছুই বললো না চলে গেল।

হাসপাতালে গিয়ে দেখলো আজ বেশ বড় একটা লাইন। ও সব রেখে পেশেন্ট দেখতে শুরু করলো। দুপুরের দিকে নওশিকে দেখতে গেল ওকে আজ রিলিজ দেওয়া হবে। মেহবিন ওকে বিদায় দিয়ে নিজের কাজে ব্যাস্ত হয়ে পড়ল।

_____________

“তা ডক্টর বাবুল আপনি একটা কথা বলুন তো! ডক্টর মেহবিনের সাথে আপনার শত্রুতা ছিল নাকি যে আপনার কৃতকর্মের জন্য ওনাকে ফাঁসিয়ে দিতে চাইলেন। আর সুস্থ মানুষদের অসুস্থ করে কি লাভ পান সেটাও বলুন। কে আছে আপনার মাথার ওপর।

ডক্টর বাবুল কোন কথা বললো না। মুখর এসেই ওনার চেহারার বারোটা বাজিয়ে দিয়েছে। নতুন এসেছে একটু রয়ে সয়ে কর কিন্তু না আজকেই সব করতে হবে। পুলিশ স্টেশনের সবাই এটা দেখে অবাক হয়েছে মুখর সবার সাথে হাঁসি মুখে কথা বলেছে তারা ভেবেছে মুখর হয়তো অপরাধীদের সাথেও একইরকম হবে। কিন্তু কে জানতো অপরাধীদের সাথে তার এতো কঠোরতা। এস আই ও কনস্টেবলরা ভয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কারন যেভাবে মুখর বাবুল কে মেরেছে সেভাবে কোনদিন কোন পুলিশকে তারা মারতে দেখেনি। ডক্টর বাবুল বলল,,

“আমি একাই এই কাজ করি আমার মাথার ওপরে কেউ নেই।”

“ওহ আচ্ছা তাহলে এস এস হাসপাতাল কি তোর নাকি। যে তুই পেশেন্ট দের ওখানে যেতে বলিশ।

একথা শুনে ডক্টর বাবুল চমকে উঠলো। আর বলল,,

“হ্যা ওটা আমারই।”

মুখর হেঁসে উঠল আর বলল,,

“তোকে দেখে মনে হয় আমি গাধা। ওটা যে শেখ শাহেনশাহ ওনার নামকরণে এস এস হাসপাতাল দেওয়া হয়েছে সেটা আমি জানি না। আর ওটা সম্পূর্ণ শেখ পরিবারের হাসপাতাল এটা আমি জানি না। এখন বল ঐ হাসপাতালের কার সাথে তোর আঁতাত।”

বাবুল ঢোক গিলতে লাগলো। তা দেখে মুখর শান্ত স্বরে বলল,,

“ভালোই ভালোই বলে দিন নাহলে আপনার সাথে কি করবো আমি নিজেও জানি না।”

তখন ডক্টর বাবুল অসহায় স্বরে ভাঙা ভাঙা গলায় বলল,,

‘ না বললে হয়তো শুধু আমি মরবো। কিন্তু বলে দিলে আমার পরিবার শেষ হয়ে যাবে। নিজের পরিবারকে শেষ হতে দেখার চেয়ে নিজে মরাই উত্তম। আপনি আমায় মেরে ফেলুন তবুও আপনি আমার মুখ থেকে তার কথা জানতে পারবেন না।”

মুখর রেগে তার দিকে এগুবে এমন সময় বাবুল অজ্ঞান হয়ে গেল। মুখর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে সেল থেকে বের হলো। নিজের কেবিনে গিয়ে এক গ্লাস পানি খেল। তখনি ওর টেবিলের ল্যান্ড ফোনটা বেজে উঠলো ও ধরে কিছু বলবে তার আগেই ওপাশ থেকে আওয়াজ আসলো,,

“এই জুমাত তোর কি মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছে তুই কোন সাহসে বাবুলকে গ্রেপ্তার করেছিস। ওকে তাড়াতাড়ি বের কর।”

মুখর হেঁসে বলল,,

‘দুঃখিত আপনার কথায় ডক্টর বাবুল কে ছাড়তে পারলাম না।

ওপাশের লোকটা বোধহয় হকচকিয়ে গেল। তবুও নিজেকে ধাতস্থ করে বলল,,

‘কে?”

“এই থানার ইনচার্জ ইন্সপেক্টর মুখর শাহরিয়ার।”

‘জুমাতের ট্রান্সফার হয়েছে আর আমি জানলাম না।”

“হয়তো আপনাকে জানানোর সুযোগ হয় নি।”

“হয়তো বা যাই হোক বাবুলকে ছেড়ে দিন।”

“কোনভাবেই না।”

“আপনার কতো লাগবে শুধু বলুন আপনার টেবিলে পৌঁছে যাবে।”

এবার মুখর রেগে গেল আর চিবিয়ে চিবিয়ে বলতে লাগলো,,

‘আমাকে কি আপনার ঘুষখোর মনে হয়। যে ঘুষ নিয়ে একজন অপরাধী কে আপনার কথায় ছেড়ে দেব।

ইবনু মাস‘ঊদ (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই সুদ এমন বস্তু যার পরিণাম হচ্ছে সংকুচিত হওয়া যদিও তা বৃদ্ধি মনে হয়’ (ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/২৮২৭)।
আরেকটা হাদিস এ রয়েছে ‎আবু হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

রাসূল (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেছেন, ‘সুদের পাপের ৭০টি স্তর রয়েছে। তার মধ্যে সবচেয়ে সাধারণ হচ্ছে মাতাকে বিবাহ করা’ (ইবনু মাজাহ, মিশকাত হা/২৮২৬, হাদীছ ছহীহ)।

যদিও আপনাকে বলে কোন লাভ নেই। তবুও আমার বলার দরকার ছিল তাই বললাম। আমাকে যদি আর পাঁচটা পুলিশ অফিসারের মতো মনে করেন তাহলে আপনি ভুল। বাই দা ওয়ে আপনার নামটা বলেন একটু শুনি তো আপনার নামে তেমন কিছু আছে কি না যাতে ভয় পেয়ে আমি বাবুলকে ছেড়ে দিই।”

বলেই মুখর একটু শব্দ করে হাসলো। তা দেখে ওপাশের লোকটা রেগে বলল,,

‘এই তুই কে? তুই কার সাথে কথা বলছিস তুই জানিস ?”

“আরে আরে আপনি রেগে যাচ্ছেন কেন? আমিও তো জানতে চাইছি আপনি কে?”

‘আমি তো সেই যার নাম তো সবাই শুনেছে কিন্তু কেউ দেখে নি। আমি হলাম ‘নিশাচর’ যার অস্তিত্ব শুধু অন্ধকারে।”

মুখর একটু থমকালো কারন এই নামটা ও পুলিশে ঢোকার পর থেকেই শুনে আসছে। অন্ধকার জগতের মাস্টার বলা যায় তাকে। একেই ধরার জন্য কতো পুলিশ অফিসার নিজেদের জীবন আর পরিবার হাড়িয়েছে তার ইয়ত্তা নেই। মুখর সব কিছু কে সাইডে রেখে বলল,,

“বাহ বাহ এতো সুন্দর পারফেক্ট নাম কোথা থেকে রাখলেন বলুন তো। আপনার সাথে কতো কথা বলার ইচ্ছে ছিল আমার। এখানে আসতে না আসতেই পুরন হয়ে যাবে বুঝতে পারি নি।”

“আমার সাথে যেহেতু কথা বলার ইচ্ছে ছিল তারমানে আমাকে নিশ্চয়ই জানিস।”

“আরে জানবো না কেন? পুলিশে ঢোকার পর থেকে প্রত্যেকটা পুলিশ অফিসারের মুখে আপনার মতো বড় অপরাধীর কথা শুনেই তো এতদূর এসেছি ।”

“এই তুই অপরাধী কাকে বলছিস?

“কেন আপনাকে মানে নিশাচর কে।”

“তোকে তো আমি!! যাই হোক তুই বাবুলকে ছাড়বি কিনা?”

“কদাচিৎ নহে!”

‘তাহলে জীবনের কথা ভুলে যা। তোর ধারনা নেই আমি কি কি করতে পারি আমার কথা না শুনলে।”

“আরে ভাই দুনিয়ায় জীবনই তো মেন। যদি এটার কথা ভুলে যাই তাহলে কি করে হবে।”

মুখরের এরকম হেঁয়ালি পনা কথা শুনে ওপাশের লোকটা রেগে গেল আর বলল,,

“অতি বার বেরো না ঝড়ে পড়ে যাবে। এই বাক্যটা নিশ্চয়ই জানিস।”

“কথাটা আপনার জন্যেও প্রযোজ্য মিস্টার নিশাচর।”

“জীবনের মায়া আর এখানে থাকার ইচ্ছে থাকলে আমার কথা মতো চলতে হবে নাহলে এগুলোর কথা ভুলে যা।”

‘দেখা যাক না কি হয় তবে আমি যে আপনাকে ভুলে যাবো এটা সিওর।”

‘প্রথমদিনই আমার সাথে টেক্কা নিতে এসেছিস। কতোদিন টিকতে পারবি আমিও দেখে নিব।”

‘আইচ্ছা দেইখেন। যেদিন আমাদের দেখা হবে সেদিন কিন্তু আমার থেকে চোখ সরাবেন না বলে দিলাম।”

‘তোকে আমি কি করবো আমি নিজেও জানিনা।”

‘আমিও তোর সাথে কি করবো আমি নিজেও জানি না।”

শেষের কথাটা মুখর রেগেই বলল আর ফোন রেখে দিল। এতক্ষন দরজার আড়াল থেকে দুজন মানুষ মুখর কে পর্যবেক্ষন করেছিল। মুখর তা টের পেয়ে বলল,,

“আপনারা দুজন ভেতরে আসুন।”

তখন এস আই আর এক কনস্টেবল এলো ভেতরে তারা এসেই সরি বলল। মুখর তাদের কতোগুলো কথা বলল তারপর চলে যেতে বলল তারাও মাথা নিচু করে চলে গেল। এদিকে মুখর অন্য কিছু ভাবতে লাগলো।

_______________

মেহবিন ওর ডিউটি শেষে বের হয়ে দেখলো আরবাজ দাঁড়িয়ে তা দেখে মেহবিন বলল,,

“এখন এখানে কেন আপনি?”

“কালকের কাজটার জন্য শুভেচ্ছা জানাতে এলাম।”

“ওহ আচ্ছা।”

“এখন এই চকলেট গুলো নিন।”

মেহবিন আরবাজের হাত থেকে চকলেট নিল তার থেকে একটা ছিঁড়ে খেতে লাগলো। এক বাইট দিয়ে বলল,,

‘কালকে সরষের মধ্যে ভুতটাকে খুঁজে পেয়েছেন চকলেট বয়?”

“কাকে কি বলবো বলেন তো? তখন রান্না ঘরে মিসেস চেয়ারম্যান, তার ভাইয়ের বউ এবং আমার কাকার বউ ছিল তিনজন মানুষের মধ্যে কাকে সন্দেহ করবো। আর বুঝবোই বা কিভাবে কে কি করেছে বাড়িতে তো আর সিসি টিভি ক্যামেরা নেই। তাছাড়া মিশুকে বলে ওর থেকেও কোন কথা বের করতে পারলাম না কারন ঐ কথা শুনেই ও হায়পার হয়ে যায়।”

“ওহ আচ্ছা। তা তাদের এর বউ ওর বউ না বলে নিজের সম্বোধনেই ডাকতে পারতেন।

‘আপনি যদি না চেনেন তাই!”

“ওহ আচ্ছা। কালকে প্রথমে মিশু আমাকে ফোন করেছিল তখন কে ছিল সাথে?”

‘মিশুকে কয়েকবার জিজ্ঞেস করা হয়েছে সে বলতে নারাজ।”

“ওহ আচ্ছা শুনলাম আপনার দাদুভাই বাড়ি ফিরেছেন?”

‘হ্যা কালকেই ফিরেছেন ইস্তেমায় গিয়েছিলেন।”

“তা আপনার দাদুভাই নিজেকে শুদ্ধ করে ফিরেছেন তো। নাকি থাক আর বললাম না।”

মেহবিনের কথায় আরবাজ ভ্রু কুঁচকে ওর দিকে তাকিয়ে রইল। আর বলল,,

“মানে? ”

“কিছু না আপনি বাড়ি যান আমার কাজ আছে।”

“আপনি সবসময়,,

“শেখ আরবাজ শাহনাওয়াজ আপনি এখন আসতে পারেন আমার তাড়া আছে।”

“আজ ও কি আমার গাড়িতে যাবেন না।”

তখন মেহবিন হেঁসে বলল,,

‘আপনার তো আর সরকারি গাড়ি না যে, আপনার গাড়িতে চড়ে আমি ট্যাক্সের টাকা উসুল করবো।”

বলেই মেহবিন হাঁটা ধরলো একটু এগিয়ে রিক্সা পেতেই সে রিক্সায় উঠে বসলো। আরবাজ ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল আর নিজেও হেঁসে গাড়িতে করে চলে গেল। সকালে মুখর ওকে স্টেশনে নামিয়ে দিয়ে মেহবিনের কাছে এসেছিলো। পরে আরবাজের বাবা আরবাজের জন্য গাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছেন। বাড়ির রাস্তার সামনে মেহবিন রিক্সা দিয়ে আসতেই দেখলো তাজেল দাঁড়িয়ে আছে। মেহবিন দেখলো তাজেল রেডি হয়েই দাঁড়িয়ে আছে তাই ওকে রিক্সায় তুলে নিয়ে বাজারের দিকে গেল। মেহবিন জিজ্ঞেস করল,,

“নেত্রী স্কুলে ভর্তি হয়েছো?”

“হ দুপুরে কওয়ার পর বাপে নিয়া গেছিল। এই ক্যাপে তোমারে অনেক সুন্দর লাগতেছে ডাক্তার।”

“তাই বুঝি।”

“হ তোমার পাঞ্জাবিওয়ালা দেহি পাঞ্জাবি ব্যাচে না হেয় দেহি পুলিশ।”

“তুমি তাকে কোথায় দেখলে?”

“যহন তুমি ওনারে ফুল দিতাছিলা তহন থেইকা তোমার যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমি সব দেখছি।”

তাজেলের কথা শুনে মেহবিন মাথা চুলকিয়ে হাসলো। সে তো সবদিক দেখেই নিয়েছিল তাও তাজেল দেখলো কিভাবে? মেহবিন বলল,,

“তুমি লুকিয়ে লুকিয়ে আমাদের দেখছিলে?”

“লুকায় দেখুম ক্যান আমার চোখ তো সামনাসামনি দেখছে। খালি আমার শরীর লুকাইয়া আছিল। তোমারে আশেপাশে তাকাইতে দেইখা আমি আমার শরীর লুকাইছিল কিন্তু আমার চোখ ঠিকই দেখছে।’

তাজেলের এরকম কথায় মেহবিন এর কিরকম রিয়াক্ট করা উচিৎ ওর জানা নেই। কিন্তু ও হেঁসেই ফেলল। তা দেখে তাজেল বলল,,

“কাল কেউ আইলেও দেখতে পারুম না কাল থেইকা আমি ইস্কুলে যামু। এমনিতে তো আমি প্রতিদিন আইয়া দেখতাম তুমি কেমনে যাও একদিন রিক্সায় যাও হাইটা যাও। ”

“তারমানে তুমি আমাকে চোখে চোখে রাখো নাকি নেত্রী।”

“তুমি যে সুন্দর যদি কেউ উঠায় নিয়া যায় হের লাইগাই তো চোহে চোহে রাহি। তুমি আসার সময় হইলে আমি তোমার বাড়ির সামনে দাড়াই থাহি। তোমারে দেখলেই বাড়ি যাইগা। যেইদিন তুমি চেয়ারম্যান গেছিলা হেইদিন খালি দাড়াই নাই।রাত হইয়া গেছিল দেইখা।”

মেহবিন তাজেলের কথায় হাসলো ওর জন্য তার নেত্রীর কতো চিন্তা। যেন তাজেল ওর অভিভাবক । বাজার এসে গেল তাই মেহবিন তাজেলকে নিয়ে ওর প্রয়োজনীয় সব কিনে নিল। দু’টো ভালো জামাও কিনে দিল একজোড়া জুতো ও কিনেদিল। তাজেল তো নেবেই না যদি ওর সৎমায় কিছু বলে এই জন্য। কিন্তু মেহবিন তো মেহবিন ও কিনে দিল। আবার সেগুলো সমেত ওকে বাড়ি দিয়ে এলো। তাজেলের সৎমা আড় চোখে কয়েকবার দেখে কিছু বলতে নিয়েছিল কিন্তু সেদিনকার কথা মনে পড়লো নওশির বাবাকে কি বলেছিল। এমনিতেও কেন যেন তিনি মেহবিন কে ভয় পায়।

পরেরদিন মেহবিনের সকালে হাঁটতে ভালোই লাগে তাই মনস্থির করলো। আজকেও হেঁটে যাবে আজকে তার সঙ্গী হলো তার নেত্রী মানে তাজেল তার সাথেই বেরিয়েছে। স্কুলে যাবে সে। আজকেও বাচ্চা তিনটাকে দেখলো মেহবিন আজ তো সরাসরিই একজন বলে দিল ,,

“আই লেবু!”

কাল না দাড়ালেও আজকে মেহবিন দাঁড়ালো এদিকে ওকে দাঁড়াতে দেখে তাজেল ও দাঁড়ালো। মেহবিন ওদের দিকে আগাতে দেখে ওখানের একজন বলল,,

” আজকে তোরে মারবো দেখিস। কাল গান গাইছিলি আজ আইলেবু কইছোস তুই আইজকা শেষ।”

কথাটা শুনে ছেলেটা বোধহয় ভয় পেল। মেহবিন ঐ ছেলেটার কাছে গিয়ে হেঁসে বলল,,

“আই লেবু মানে কি?”

ছেলেটা অবাক চোখে তাকিয়ে বলল,,

“আপনে আইলেবু মানে জানেন না?”

তখন তাজেল বলল,,,

“আই তো গ্ৰামের মানুষ নিজেরে কয় আর লেবু মানে তো লেবু তাই ডাক্তার ওইডার মানে হইলো আমি লেবু।”

বলেই তাজেল হাসলো তা দেখে মেহবিন ও হাসলো তখন ঐ ছেলেটা বলল,,

“ঐ তাজেল চাপা কম নাড়। আই লেবু হইলো আই লাভ ইউ এর শর্টকাট। মানে আমি তোমারে ভালোবাসি।”

তখন মেহবিন বলল,,

“তারমানে আমারে তোমার পছন্দ হইছে? কাল ও গান গাইছিলা আমি নাকি তোমার মন কাইরা নিছি।

‘আপনেরে আমার বালা হাতুনের মতো লাগে খুব ভাললাগে আপনেরে।”

“বালা হাতুন কে?”

“কি জানি বড় ভাইয়ের ফোনে একদিন এক মাইয়ারে দেখছিলাম আপনার মতো বোরকাটাইপ কিছু পরে আবার মাথায় ও কি যেন পরে। পরে বড় ভাইরে জিগাইছিলাম সে কিডা হেয় কইলো বালা হাতুন কোন ওসমানের বউ। আমি তো মাঝে মাঝেই তাগো ভিডিও তে দেহি।

মেহবিন বুঝতে পারলো কুরুলুস ওসমানের কথা বলছে। মেহবিন হেঁসে বলল,,

“আমায় বিয়ে করবে?”

“এহ আপনে কতো বড় আপানারে বিয়ে করুম ক্যান।”

“তাহলে এভাবে গান গাইছিলে কেন কাল? আবার আজ তো আইলেবু বলেই দিলা।”

‘আরে এইডা তো আমি বড় ভাইয়ের থিকা শিখছি ওনারা তো কতো মাইয়ারে দেইখা কতো গান গায় আইলেবু কয় তারা কতো মজা করে।”

মেহবিন বুঝতে পারলো বড়দের দেখে টিজ করা শিখছে। তাই বলল,,

“তা মেয়েরা কি করে?”

“মাইয়ারা তো তাড়াতাড়ি ভাইগা যায়।”

“ওহ আচ্ছা তবে শুনো এরকম করতে হয় না। এগুলো খারাপ অভ্যাস। তোমার বড় ভাইরা ভুল করছে। এগুলো করলে মেয়েদের খারাপ লাগে।”

“কই বড় ভাইগো তো কেউ কিছু কয় না।”

মেহবিন বুঝতে পারলো এদের বলে লাভ নেই। এদের বড় ভাইদের কিছু করতে পারলে তাহলে ওরা বুঝবে। মেহবিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে তাজেল কে নিয়ে চলে গেল ।মেহবিন দুপুরের দিকে চেয়ারম্যান বাড়ি থেকে একটা কল পেল মিশুর নাকি গাছ থেকে পরে পা কেটে গেছে। তাকে ছাড়া অন্য কাউকে দিয়ে সে হাত চিকিৎসা করাবে না। তাই তাকেই যেতে হবে মেহবিন তড়িঘড়ি করে চেয়ারম্যান বাড়ির দিকে ঢুকলো তখন কারো আওয়াজে সে থেমে গেল,,,

“বাড়ির ব্যক্তিগত মাইয়া ডাক্তার থাকতে আবার মিশুর জন্য অন্য ডাক্তার লাগবো কেন? ঐ ডাক্তার কি ওরে মাইরা ফেলবো যতসব পাগল।”

~চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে