কাব্যের বিহঙ্গিনী পর্ব-০৬

0
451

#কাব্যের_বিহঙ্গিনী
#পর্ব_৬
#লেখিকা_আজরিনা_জ্যামি

মেহবিন বুঝতে পারছে না এই পঞ্চাশ মিনিটে এমন কি হলো । যে মিশু রক্ত রক্ত করছে। তাজেল কোথায় ওকে তো দেখে রাখতে বলেছিল। রাস্তার ওপাশের বাড়ি থেকে কিছু শব্দ ও আসছে কেউ চিৎকার চেঁচামেচি করছে বোধহয়। সেসব পরে দেখা যাবে আগে মিশুকে শান্ত করতে হবে। মেহবিন শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বলল,,,

“মিশুমনি চোখ খুলো দেখো এখানে রক্ত নেই।”

“রক্ত! রক্ত! বন্ধু ঐ মেয়েটা!”

“কোন মেয়েটা কি হয়েছে চোখ খুলো দেখো রক্ত নেই।”

মিশু চোখ খুললো কিন্তু মেহবিন কে ছাড়লো না। ওর চোখ খুলতে দেখে মেহবিন বলল,,

“দেখেছো রক্ত নেই। কিন্তু তাজেল কুলসুম ওরা কোথায়?”

“ওরা তো ঐ মেয়েটার কাছে।”

ও কিছু বলবে তার আগে তাজেল কাঁদতে কাঁদতে মেহবিনের বাড়িতে এলো মেহবিন কে দেখে বলল,,

“ডাক্তার তুমি আইছো তাড়াতাড়ি চলো কাকা নওশি আপারে মাইরা ফালাই লো। নওশি আপারে খুব মারতেছে কাকা রক্ত ও বাইর হইতেছে তাড়াতাড়ি চলো নাইলে নওশি আপা বাঁচবো না।”

এ কথা শুনে মেহবিন বুঝতে পারলো মিশু কোনভাবে নওশির রক্ত দেখেছে। চিৎকার চেঁচামেচি এগুলোর মানে এখন বুঝতে পারলো মেহবিন। নওশির কথা শুনে উঠতে নিল । কিন্তু মিশু ওকে ছাড়ছে না। কি একটা মুশকিল তখনই আরবাজ আর মুখর এলো। এসেই আরবাজ বলল,,

“সরি দেরি হয়ে গেল।আর,,

ওকে বলতে না দিয়ে মেহবিন বলল,,

“সেসব বাদ দিন আগে মিশুকে ধরেন। ও বোধহয় রক্ত দেখে ভয় পেয়েছে আমার এখনি যেতে হবে। আর হ্যা আপনারা বাড়ি চলে যান।

মেহবিনের কথা শুনে আরবাজ মিশুকে ধরলো। মেহবিন ছাড়া পেয়েই কোনদিকে না তাকিয়ে দৌড় দিল। তাজেল ও সাথে গেল। মেহবিন রাস্তার ওপাশের দ্বিতীয় বাড়ি যেতেই দেখলো নওশিকে মাটিতে ফেলে লাঠি দিয়ে পেটাচ্ছে‌ একজন। সকলে তাকিয়ে দেখছে কেউ থামাচ্ছে না। তার মধ্যে একজন আঁচল চেপে কাঁদছে। তা দেখে মেহবিন এর মেজাজ চরম গরম হলো ও গিয়ে আগে লাঠি ধরলো। কারো বাঁধা পেয়ে নওশির বাবা পেছনে ঘুরলো দেখলো মেহবিন লাঠি ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তা দেখে তিনি একটা গালি দিয়ে বলল,,

“**** মাইয়া তোর সাহস কতো বড় তুই আমার লাঠি ধরোস। ওর সাথে আজ তোরেও মাইরা ফালামু।”

ওনার কথার ধরন দেখে মেহবিন বুঝতে পারলো লোকটা স্বাভাবিক নয় বোধহয় নেশাখোর ড্রাগ এডিক্টেড।তা চোখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। মেহবিন নওশির দিকে তাকালো হাত দিয়ে মাথা দিয়ে রক্ত পরছে সারা শরীরে মারের দাগ। মেহবিন লাঠিটা ফেলে নওশিকে ধরে বলল,

“আপনি কি মানুষ এভাবে কেউ মারে।”

“ঐ তোরে কইতে কইছি আমার মাইয়া আমি বুঝুম তোর তাতে কি *** মাইয়া *** ?”

“আর একটা বাজে কথা বললে এখানেই মেরে পুঁতে ফেলবো একদম।”

মেহবিনের এমন কথায় সকলে অবাক হয়ে মেহবিনের দিকে তাকিয়ে রইল। এতো কঠিন করে কোন মেয়ে হুমকি দিতে পারে সেটা বোধহয় মেহবিন কেই প্রথম দেখলো। নওশির অবস্থা দেখে মেহবিন বলল,,

“নওশি কে হাসপাতালে নিতে হবে।”

তখন নওশির বাবা বলল,

“ওরে আবার হাসপাতালে নেওয়া লাগবো কেন? ও মরুক ওর মরাই উচিত যে মাইয়া বাপের কথা হুনে না তার বাইচা থাহুনের অধিকার নাই। আমি ওর পিছে আর এক টাহাও খরচ করুম না। মইরা যাক ও।”

“লাগবে না আপনার টাকা। আমি এমনিতেই ওর চিকিৎসা করতে পারবো।

নওশির বাবা রেগে চলে গেল ওখান থেকে। মেহবিন বুঝতে পারলো এদের দ্বারা কিছুই হবে না। মেহবিন কিছু না বলে নওশিকে সোজা করে দার করালো তখন দুইজন মহিলা ধরতে এলে তখন মেহবিন বলল,,

“যদি মার খাওয়া থেকে নাই বাঁচাতে পারেন তাহলে এখন কিসের জন্য এসেছেন। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ঠিকই মার খাওয়া দেখতে পারলেন অথচ কেউ ঐ পশুর মতো মানুষ টাকে থামাতে পারলেন না।”

তখন একজন মহিলা বলল,,

“প্রথমে সবাই থামাইতে গেছিল। দুইবার মার ও খাইছে একজন। তাও থামাইতে গেছে তারপর ওর বাপের কথা হুইনা আর কেউ আগায় নাই। তার মাইয়া তার থিকা আমগো নাকি বেশি পুরে।আরো অনেক খারাপ কতা কইছে।”

“এই জন্য কেউ মেয়েটার কাছে আসলেন না। আজ শুধু আমি বাড়ি ছিলাম না। নাহলে নওশিকে এতোগুলো মার খেতে হতো না। এখন সরুন তাড়াতাড়ি হাসপাতালে নিতে হবে।

নওশির এতোক্ষণ জ্ঞান থাকলেও এখন অজ্ঞান হয়ে গেল। তা দেখে মেহবিন আর দেরি না করে ওর রোগাপাতলা শরীরটাকে কোলে তুলে তাড়াতাড়ি হাটা ধরলো। এটুকু নিতে সে পারবে তাজেল নওশির পা ধরলো। নওশির মা কাঁদতে কাঁদতে ওদের পেছনে এলেন। রাস্তায় আসতেই মেহবিন দেখলো মুখর দাঁড়িয়ে তাই মেহবিন বলল,,,

“পাঞ্জাবিওয়ালা তাড়াতাড়ি গাড়ির দরজা খুলুন নওশিকে হাসপাতালে নিতে হবে। আর নেত্রী বারান্দায় আমার ব্যাগ আছে সেটা তাড়াতাড়ি নিয়ে আসো।

মুখর আর দেরি না করে তাড়াতাড়ি গাড়ির কাছে গেল। তাজেল গেল ব্যাগ আনতে। মেহবিন নওশিকে গাড়িতে তুললো নওশির মা আর মুখর সাহায্য করলো। তাজেল আসতেই মুখর গাড়ি ছাড়লো মেহবিন ব্যাগ থেকে তুলা বের করে নওশির রক্ত মুছতে লাগলো। হাসপাতাল আসতেই তাড়াতাড়ি করে ভেতরে নিয়ে মেহবিন ওর চিকিৎসা শুরু করলো। মুখর তাজেল আর নওশির মা বাইরে রইলো। নওশির মা কাঁদছে দেখে তাজেল নওশির মায়ের হাত ধরে বলল,,,

“কাইন্দো না কাকি নওশি আপা ভালো হইয়া যাইবো। ডাক্তার দেখতেছে তো ডাক্তার খুব ভালো দেখবা নওশি আপারে একদম সুস্থ কইরা দিব। তুমি কাইন্দো না।”

“তাজেল আমার মাইয়া বাঁচবো তো। ঐ পাষাণ, বাপ হইয়া কেমনে পারলো মাইয়ারে ঐভাবে মারতে। ওনার মনে একটুও ও দয়ামায়া নাই।”

“চিন্তা কইরো না ডাক্তার আছে তো সব ঠিক কইরা দিব।”

নওশির মা আর কিছু বললো না। একটু দুর থেকে মুখর এগুলো দেখলো। মেহবিন কে সে যতো দেখে তত অবাক হয়। ও বাড়ির সবকিছুই সে দেখেছে তাইতো আরবাজ কে হেঁটে যেতে বলেছে মিশুকে নিয়ে। আর ও রয়ে গেছে গাড়ি নিয়ে যদি দরকার হয় তো। কিছুক্ষণ পর মেহবিন বের হলো ওর বোরকায় নওশির রক্ত। মেহবিন বের হয়ে ওর মাকে বলল চিন্তার কারন নেই নওশি সুস্থ হয়ে যাবে। একদিন হাসপাতালে রাখতে হবে। নওশির মা বলল সে থাকবে মেহবিন কিছু বললো না। মেহবিনের কিছুই আর ভালো লাগছে না। সে তাজেলকে বলল বাড়ি যাবে কি না সে বলল নওশিকে দেখে তার আরেকটু পর যাবে। মেহবিন বলল তাজেলকে নিয়ে ফিরবে। আজ শুক্রবার হাসপাতালে বেশি মানুষ জন নেই হয়তো ডাক্তার নেই বলে। ও বারান্দায় রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে রইল আর অস্ফুট স্বরে বলে,,,

“আজ আর আমি দেরি করি নি মা।”

তখন মুখর ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,,

রাসুল ﷺ বলেছেন,
সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষ সেই ব্যক্তি, যে মানুষের জন্য সবচেয়ে বেশি উপকারী।
~সহীহুল জামে:-৩২৮৯

মুখরের কথা শুনে মেহবিন মুচকি হেসে ওর দিকে তাকিয়ে বলল,,

“মানুষ হয়ে যদি মানুষের উপকারই না করতে পারলাম তাহলে কিসের মানুষ। সবথেকে বড় কথা আমি একজন ডক্টর। যে ব্যক্তিকে অপর ব্যক্তি সাহায্য করে তাকে আল্লাহ তায়ালা সাহায্য করেন। তাছাড়া আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ

নবী (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেনঃ যে ব্যক্তি দুনিয়াতে কোন মুমিনের দুঃখ দূর করে দেয়, আল্লাহ্ কেয়ামতের দিন তার দুঃখ দূর করে দিবেন। যে ব্যক্তি কোন বিপদগ্রস্ত ব্যক্তির বিপদ দূর করে দেয়, আল্লাহ্ দুনিয়াতে ও আখেরাতে তার বিপদ দূর করে দিবেন। যে ব্যক্তি কোন মুসলিমের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবে, আল্লাহ্ দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। যে বান্দা আপন ভাইকে সাহায্য করবে, আল্লাহ্ সে বান্দাকে সাহায্য করবেন। যে ব্যক্তি জ্ঞান লাভের জন্য কোন রাস্তা গ্রহণ করে, তার অসীলায় আল্লাহ্ তার জন্য জান্নাতের রাস্তা সহজ করে দিবেন। যেসব লোক আল্লাহর ঘরসমূহের মধ্যে কোন ঘরে (অর্থাৎ মসজিদে) সমবেত হবে, কুরআন পড়বে, সকলে মিলিত হয়ে তার শিক্ষা নেবে ও দেবে, তাদের উপর অবশ্যই প্রশান্তি অবতীর্ণ হবে, রহমত তাদের ঢেকে নেবে, ফেরেশতাগণ তাদের ঘিরে থাকবে আর আল্লাহ্ তাদের কথা এমন সকলের মধ্যে উল্লেখ করবেন যারা তাঁর কাছে উপস্থিত। যে ব্যক্তি তার আমলের কারণে পিছিয়ে পড়বে, তার বংশ পরিচয় তাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না।
[মুসলিমঃ ২৬৯৯]”

মুখর সব শুনে মুচকি হেসে বলল,,

“তা ঠিক বলেছেন তো আকাশের দিকে তাকিয়ে কি দেখছেন ডক্টর?”

“এই আকাশ টা কতো বিশাল।”

“এটা কি আমার প্রশ্নের উত্তর?”

“আপনি বলেছেন আকাশের দিকে তাকিয়ে কি দেখছেন? তার উত্তর তো এটাই হওয়া উচিত আর হয়েছেও তাই।”

“সরি মাই মিস্টেক কি ভাবছিলেন?”

“এই পৃথিবী কতো বিশাল। প্রতিদিন কতো রকমের ঘটনা ঘটে ধরনীর বুকে।

“তা তো ঘটেই।”

“মিশুমনি স্বাভাবিক হয়েছে?”

‘তুমি যাওয়ার পর একটু হায়পার হয়ে গেছিল তুমি চলে গেছো বলে। তবে আরবাজ সামলে নিয়েছে। সব ঠিক আছে সেই জন্যই তো দু’জনে হেঁটে হেঁটে বাড়ি গেল।

‘ওহ আচ্ছা ও কি অভিমান করেছে আমার ওপর।”

“কি জানি করতে পারে।”

“সবার অধিকার আছে আমার ওপর অভিমান করার। আমার নেই কেন মুখর?”

মেহবিনের মুখে মুখর শুনে আর এরকম কথা মুখর একটু থমকালো। কারন এই সম্মধোন টা ওর কাছে নতুন। আর এরকম কথাও। মুখর নিজেকে সামলে বলল,,

‘তোমারও অধিকার আছে বিহঙ্গিনী!”

“না আমার অধিকার নেই কারন এই বিহঙ্গিনী একা সে মুক্ত ভাবে নিজের মতো উড়ে বেরায়। তার নির্দিষ্ট নীড় বলতে কিছুই নেই। তার কেউ নেই?”

“বিহঙ্গিনীর সবাই আছে!”

“কেউ নেই বিহঙ্গিনীর বিহঙ্গিনী একা। আচ্ছা আপনি বললেন সবাই আছে তাই না উঁহু তার কেউ নেই। এই যে বিহঙ্গিনী কে দেখছেন এর হাত ধরে জনসমক্ষে কেউ বলতে পারবে না এই বিহঙ্গিনীর সাথে তাদের সম্পর্ক কি? না আপনি আর না আরবাজ না আমার জন্মদা থাক বাদ দিন। পরিশেষে এই বিহঙ্গিনীর আপাতত কেউ নেই মুখর। বিহঙ্গিনী এক মুসাফিরের মতো এখানে ওখানে সফর করে । এতদিন নিজের মঞ্জিল খোঁজার জন্য সে সফর করতো কিন্তু মঞ্জিল খুঁজতে খুঁজতে নিজেকে হাড়িয়ে ফেলেছে এখন সে নিজেকে খুঁজতে সফরে বেরিয়েছে। যার সঙ্গী সে আর তার সৃষ্টিকর্তা মহান রব।

এবার মুখর করুন চোখে তাকিয়ে রইল। কারন এর উত্তর তার কাছে নেই। মেহবিন মুচকি হেসে মুখরের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“কি হলো জবাব নেই?”

“মেহবিন!”

“আমায় বাড়ি যেতে হবে।”

তখনি তাজেল এলো । মুখর কিছু বলতে নিচ্ছিল তাজেল কে দেখে চুপ মেরে গেল। তাজেল মুখরকে দেখে বলল,,

“ডাক্তার ইডা কিডা? তহন নওশি আপারে গাড়িতে কইরা নিয়াইলো।”

মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

“নেত্রী উনি আমার পরিচিত!”

‘তোমার জামাই নাকি ডাক্তার! যদি অয় তাইলে আমার পছন্দ হইছে কি সুন্দর ফর্সা একদম দুধের মতো। কিন্তু তোমার মতো এতো সুন্দর না।”

তাজেলের কথায় মেহবিন একটু আওয়াজ করেই হাসলো। মেহবিন মুখরের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আপনি আমার জামাই নাকি পাঞ্জাবিওয়ালা?”

“পাঞ্জাবিওয়ালা হেয় কি পাঞ্জাবি ব্যাচে ডাক্তার?”

তাজেলের কথায় এবার মুখর হাসলো আর বলল,,

“না গো আমি পাঞ্জাবি বেচি না। এই নাম টা তোমার ডাক্তার আমারে দিয়েছিল যেভাবে তোমাকে নেত্রী নামটা দিয়েছে।”

“ও তাইলে তোমারও নাম ডাক্তার দিচে। কিন্তু তুমি ডাক্তারের কি লাগো।

মেহবিনের এবার তাজেলের পায়ের দিকে নজর গেল কালকের ব্যান্ডেজটা রক্তে ভিজে গেছে। তা দেখে মেহবিন তাড়াতাড়ি করে ওকে কোলে তুলে বলল,,

“নেত্রী পায়ের এই অবস্থা কখন হলো?”

“নওশি আপারে যহন মারছিল আমি ফিরাইবার গেছিলাম তহন কাকা আমারে ধাক্কা দিছিল। তহন আবার লাইগা রক্ত বাইর হওয়া শুরু করছে।”

মেহবিন ওকে নিয়ে নিজের কেবিনে গেল তাজেলের ব্যান্ডেজ খুলে আবার নতুন ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দিল।এর মধ্যে মুখর আর ওর সম্পর্কের কথা চাপা পড়ে গেল। মেহবিন বলল,,

“আমাকে বলো নি কেন এতোক্ষণ?”

“আমার নিজেরই তো মনে ছিল না।”

“পাগল একটা! চলো বাড়ি যাই আমরা।”

তখন মুখর বলল,,

“আমি নামিয়ে দিই!’

“লাগবে না আপনি চলে যান! আমি নেত্রীকে নিয়ে রিক্সায় আসবো।”

“প্লিজ!”

“না আপনি চলে যান।”

মুখর আর কিছু বললো না। চলে গেল ও জানে এখানে বলে লাভ নেই। মেহবিন নওশিকে আবার দেখে এলো ওর মাকে আর একটা নার্সকে সব বুঝিয়ে দিল। সবকিছুর টাকা মেহবিনই দিয়েছে। মেহবিন তাজেলকে কোলে করে বের হলো। একটা রিক্সা পেতেই সেটায় চরে বসলো। মেহবিন তাজেলের দিকে তাকিয়ে বলল,,

“আমি যাওয়ার পর কি হয়েছিল নেত্রী?”

“তুমি যাওয়ার পর তো আমরা সুন্দর কইরা চকলেট খাইতেছিলাম আর কার্টুন দেখতেছিলাম। কিছুক্ষণ দেহার পর দেহি আমগো বাড়ির এদিক থেইকা চিৎকার চেঁচামেচি করতেছে। কুলসুম তো দিল এক দৌড় তুমি আমারে তোমার বন্ধুরে দেইখা রাখতে কইছিলা আর কইছিলা কুলসুম গেলেও আমি জানি না যাই। তাই আমি যাই নাই। তহন তোমার বন্ধু কইলো যেইহানে চিৎকার চেঁচামেচি অয় ওনে যাইবো আমি মানা করলাম পরে জেদ ধরলো তহন কুলসুম আইসা কইলো নওশি আপারে মারতেছে ব্যস আমার আর কি আমিও নওশি আপার কথা হুইনা তোমার বন্ধুরে রাইখাই দৌড়। যাইয়া দেহি নওশি আপারে ইচ্ছা মতো মারতেছে নওশি আপার শরীর দিয়া রক্ত ও পরতেছে পরে আমি ফিরাইতে গেছিলাম কাকা দিল এক ধাক্কা পরে আর সাহস অয় নাই পরে দেহি তোমার বন্ধু ও গেছে ওনে। নওশি আপারে দেইহাই রক্ত রক্ত কইরা দৌড় দিল আমিও আইলাম হে তোমার বাড়ি ঢুকলো দেইখা আমি আবার মারামারির ওনে গেলাম আবার তোমার বন্ধুর কথা ভাবলাম ডরাইলো নাকি হেই ভাইবা আইয়া দেহি তুমি আইছো পরে তোমারে খবর দিলাম।”

সবকিছু মেহবিন মনোযোগ দিয়ে শুনলো। তারপর বলল,,

“বুঝলাম তবে মিশু সত্যি রক্ত দেখে ভয় পায়। রক্ত সহ্য করতে পারে না। কিন্তু নওশি কে মারলো কেন ওর বাবা?

“আজ তো নওশি আপারে দেখবার আসার কথা আছিল। সবতো ঠিকই আছিল আমি জানি না।”

“ওহ আচ্ছা!”

তখনি মেহবিনের আন নোন নাম্বার থেকে কল আসলো। মেহবিন ফোন উঠিয়ে সালাম দিতেই ওপাশ থেকে বলল,,

“ডাক্তার তাড়াতাড়ি আমার বাড়িতে আসেন মিশু দরজা আটকে বসে আছে। ডেকেও বের করা যাচ্ছে না।”

“চেয়ারম্যান সাহেব!”

“আমি জানি না আপনার বাড়িতে কি হয়েছে? তবে আপনার থেকে এটা আশা করিনি যে আপনার বাড়ি থেকে ফিরে মিশু হায়পার হয়ে যাবে। এই জন্য আমি ওকে বাইরে কোথাও নিয়ে যেতে সাহস পাইনা। কিন্তু আমি আপনার ওপর ভরসা করে ওকে আপনার বাড়ি দিয়ে এসেছিলাম।”

“আপনি যতোই বলেন আমার এতে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই। কারন এটায় আমার হাত নেই পুরোটাই একটা এক্সিডেন্ট। যাই হোক আসছি আমি।”

মেহবিনের এরকম কথা শুনে শেখ শাহনাওয়াজ থম মেরে বসে রইলেন। মেহবিন বাড়ির মোর আসতেই তাজেলকে দিয়ে চেয়ারম্যান বাড়ির দিকে রওনা দিল। কিছুক্ষণ এর মধ্যে পৌঁছে গেল বাড়িতে ঢুকতে সবাইকে নিচেই দেখলো। শুধু আরবাজ শেখ শাহনাওয়াজ আর মুখর নেই। ও কারো দিকে না তাকিয়ে সোজা মিশুর রুমে গেল। মিশুর রুম বন্ধ। রুমের সামনে তারা তিনজন দাঁড়িয়ে আছে। মেহবিন বলল,,

“কখন থেকে দরজা আটকে বসে আছে।”

তখন আরবাজ বলল,,

“আমি তো তখন ওকে শান্ত করে বাড়ি নিয়ে এলাম। সব ঠিকই ছিল কিন্তু আধঘন্টা আগে কি হলো ও রান্না ঘরে গেল তারপর দৌড়ে ওপরে চলে এলো।তারপর থেকেই দরজা আটকে বসে আছে ঘরে ভাঙচুরের আওয়াজ ও এসেছে।”

“রান্নাঘরে কিছু দেখে কিছু হয়েছে নাকি কেউ কিছু বলেছে?”

তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“তেমন কিছুই নয়।”

“আপনি সিওর কিভাবে? কারন ব্যতিত কখনো কিছু হয় না। কিছু তো হয়েছেই তাই এই অবস্থা।”

“আপনার বাড়ি থেকে কিছু হয়েছিল আরবাজ বলেছে সেটাই হয়তো মনে পরে গেছে।’

“তারমানে আপনি বলছেন এটা আমার দোষ। আপনি এখান থেকে চলে যান এদিকে আমি দেখছি। ভাঙচুরের আওয়াজ শুনেছেন তার মানে মিশু ঠিক নেই। আপনি এখানে দাঁড়িয়ে আছেন। এই ঘরের কি চাবি নেই দরজা খোলার জন্য।”

এ কথা শুনে তিনি মাথা নিচু করলেন। ওনার মেয়ের চিন্তায় মনেই ছিলনা।তিনি চলে গেলেন চাবি আনতে তখন মেহবিন দরজায় টুকা মেরে বলল,,

“বন্ধু কি হয়েছে তোমার ? দরজা খুলো!”

ওপাশ থেকে কোন আওয়াজ এলো না।তাই ও আবার ও বলল,,

“বন্ধু তুমি ঠিক আছো? দরজা খুলো প্লিজ বন্ধু তোমার সাথে খেলতে এসেছে।”

…….এবার ও চুপ

“বন্ধু কিন্তু এবার চলে যাবে।”

তখনি শেখ শাহনাওয়াজ চাবি নিয়ে এলেন মেহবিন দরজা খুলল কিন্তু ওদের আসতে বারন করলো। মেহবিন রুমে ঢূকে দেখলো ঘরের সমস্ত জিনিস পত্র এদিক ওদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে মিশু দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে চোখ বন্ধ করে কিছু বিরবির করছে। মেহবিন কাছে গিয়ে শুনলো,,

“ও অনুর মতো মরে যাবে অনুর মুখে কতো রক্ত ছিল। ঐ মেয়েটাও মরে যাবে ওর মুখেও তো রক্ত ছিল। না না ওকে কেও বাঁচাও মরতে দিও না। ও মরে যাবে কতো র’ক্ত! র’ক্ত! র’ক্ত!”

এটুকু শুনেই মেহবিন মিশুর কাঁধে হাত রাখলো ও মেহবিনকে দেখেই ওকে জড়িয়ে ধরে জোরে কেঁদে উঠলো আর বলল,,

“আমার অনুকে বাঁচাও কতো র’ক্ত! কতো র’ক্ত! ওর মুখে। ঐ মেয়েটাকে বাঁচাও ওর মুখেও তো কতো র’ক্ত।”

মেহবিন ওকে শান্ত করার চেষ্টা করলো মিশু কিছু বিরবির করে জ্ঞান হারালো। মেহবিন ওকে ধরলো। তখন মেহবিন ওদের ভেতরে ডাকলো আরবাজ এসে ওকে বিছানায় শুয়িয়ে দিল মেহবিন সব চেক করলো । তারপর বলল একটা ইনজেকশন আনতে। শেখ শাহনাওয়াজ ওষুধ আর ইনজেকশন আনতে পাঠালেন কুদ্দুস কে। মেহবিন মিশুর হাত ধরে মিশুর দিকে তাকিয়ে রইল। মাথায় ঘুরছে এই অনু কে? ইনজেকশন আনতেই মেহবিন সেটা পুশ করে দিল। তারপর নিচে আসলো সবাই নিচেই ছিল। ও সোজা গিয়ে শেখ শাহনাওয়াজ কে বলল,,

“অনু কে চেয়ারম্যান সাহেব?”

এ কথা শেখ শাহনাওয়াজ সহ সবাই চমকে উঠলেন। উনি কিছু বলবে তার আগে আরিফা জামান বললেন,,

“আমাদের পারিবারিক বিষয় এটা। তোমার না জানাই ভালো। আর আজ যা হলো এর জন্য কিন্তু তুমি দায়ী। তোমার ওপর ভরসা করেই চেয়ারম্যান সাহেব মেয়েকে তোমার বাড়ি পাঠিয়েছিল। কিন্তু তুমি ওর খেয়াল না রেখে কি করছিলে যার জন্য মিশুর এই অবস্থা। তুমি তো জানো মিশুর রক্তে ফোবিয়া আছে তারপরেও কেন ওকে একা ছাড়লে যদি কিছু একটা হয়ে যেতো তাহলে কি করতে। আরবাজ যেতেই তুমি আবার তাকে ছেড়ে দিয়ে চলে গেছো। মিশু চেয়ারম্যান সাহেব এর মেয়ে এটা ভুলে গেলে তুমি।

মেহবিন মুখ শক্ত করে বলল,,

“তো কি করতাম? আপনার মেয়ের হাত ধরে বসে থেকে আরেকটা মেয়েকে মরতে দিতাম। কারন সে চেয়ারম্যান সাহেবের মেয়ে নয়। একজন সাধারণ মেয়ে।

‘তোমারে যে মানুষ টা বাড়িতে থাকতে দিয়ে সাহায্য করলো। তার মেয়েকে তুমি ঐ অবস্থায় কিভাবে ছেড়ে দিতে পারলে এতটা অকৃতজ্ঞ তুমি।”

“চেয়ারম্যান সাহেব এর মেয়ে শুধু ভয় পেয়েছিল আর ঐ মেয়েটা মরতে বসেছিল। এই অবস্থায় সেই মেয়েটার থেকে আপনার মেয়ের দাম বেশি হয়ে গেল নাকি। আর যদি অকৃতজ্ঞ এর কথা আসে তাহলে বলবো তিনি ব্যবস্থা না করে দিলেও আমি এই গ্ৰামে কোথাও না কোথাও থাকতে পারতাম। উনি আমার একটা সাহায্য করেছে বলে একদম জান দিয়ে দিতে হবে উনার জন্য তেমনটা নয়। তাছাড়া আমি তো এমনি এমনি বাড়িটা নিই নি ভাড়ায় নিয়েছি তাহলে এই কথা আপনি বলতে পারেন না।

তখন শেখ শাহনাওয়াজ বললেন,,

“আহ আরিফা কি হচ্ছে কি? এটা কেমন ধরনের ব্যবহার।”

“আপনি তার পরেও এই কথা আমাকে বলেছেন। আজ মিশুর এই অবস্থার জন্য কিন্তু এই মেয়েটাই দায়ী।”

“মিশুর জন্য উনি দায়ী হলেও মিশুকে শান্ত আর স্বাভাবিক করার পেছনেও ওনার হাত রয়েছে।”

একথা শুনে মেহবিনের মুখ আরো শক্ত হয়ে গেল। ও চোখ মুখ শক্ত করেই বলল,,

“ভুল বললেন চেয়ারম্যান সাহেব আপনার মেয়ের এখনকার অবস্থার জন্য আমি দায়ী নই। তার অবস্থার জন্য দায়ী আপনাদের রান্নাঘর সেখানে কিছু তো ঘটেছে।”

এ কথা শুনে সবাই অবাক হয়ে মেহবিনের দিকে তাকিয়ে রইল। কিছু লোকের চেহারায় ভয় ও ফুটে উঠলো। তখন মেহবিন মুচকি হেসে বলল,,

“বুঝলেন চেয়ারম্যান সাহেব সরষের ভেতরেই ভুত আছে। আজ আমি চলি তারপর না হয় আপনাদের পারিবারিক বিষয়ে কথা বলুন।”

“সন্ধ্যা আরো আগেই নেমেছে আপনাকে কেউ দিয়ে আসুক।’

“দরকার নেই চেয়ারম্যান সাহেব আমি একাই চলে যেতে পারবো।”

বলেই মেহবিন বেরিয়ে পরলো। পেছনে আরবাজ আর মুখর ও বের হলো আস্তে আস্তে সবার অগোচরে। মেহবিন ফোনে টর্চ অন করে আগাতে লাগলো। আরবাজ আর মুখর ওর পেছন পেছন চলতে লাগল। হুট করে মেহবিন বলল,,

“অনু কে বাজপাখি?”

কথাটা শুনেই মুখর আর আরবাজ থেমে গেল। মেহবিন পেছনে ঘুরে দাঁড়ালো। আরবাজ কিছুই বললো না। তা দেখে মেহবিন বলল,,

“অধিকার নেই তাই না। আর আসতে হবে না আমি যেতে পারবো। বাড়ি এসেই গেছে।

বলেই মেহবিন ঘুরে আবার হাঁটতে লাগলো। তখন আরবাজ দৌড়ে গিয়ে বলল,,

“অনু হলো মিশুর প্রিয়জন! যার জন্য আজ চার বছর ধরে মিশুর এই অবস্থা।”

বলেই আরবাজ দ্রুতগতিতে আবার পেছনে এলো আর মুখর কে নিয়ে চলে গেলো। মেহবিন একবার ওদের দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর বাড়ির পথে রওনা দিল দুই মিনিট পর বাড়িতে ঢুকলো দেখলো বারান্দা খোলা হয়তো মিশু আর আরবাজ খোলা রেখেই গেছে কিন্তু দরজা ভালোভাবে আটকানো আবার তালা দেওয়া। তালা দিল কে আবার এসব ভাবতে ভাবতেই তাজেল এলো চাবি নিয়ে। ও নাকি ব্যাগ নিতে এসে তার পাশে তালা দেখে মনে পরেছে বাড়িতে কেউ থাকবে না তাই তালা দিয়ে গেছে। ও চাবি নিয়ে সেই সন্ধ্যা থেকে অপেক্ষা করছিল ও আসতেই ওকে দিল। মেহবিন হাসলো তাজেল এর বুদ্ধি দেখে। বাহবা ও দিল তারপর তাজেলকে বাড়িতে যেতে বলে নিজের ঘরে ঢুকলো আজ সারাটাদিন তার কি গেছে সেটা একমাত্র সেই জানে। তবুও তার মাথায় দিনশেষে একটা কথা,

“অনু মিশুর প্রিয়জন ! যার জন্য মিশুর এই অবস্থা। কি হয়েছিল চার বছর আগে?

~চলবে,,

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে