সম্প্রতি ব্রেক আপ হয়েছে আমার। সারাদিন কম্বল মুরি দিয়ে কান্নাকাটি করে বালিশ ভেজানো ছাড়া আর কিছুই করতে পারছিনা। না হচ্ছে খাওয়া-নাওয়া, না হচ্ছে পড়াশুনা, ঘুমও হচ্ছে না। সারাদিনের রুটিন হলো ফোনে চার্জ থাকলে ইয়ারফোন কানে লাগিয়ে ভলিউম বাড়িয়ে স্যাড সং শোনা, চার্জ না থাকলে চার্জে বসিয়ে ইয়ারফোন খুলে ফুল ভলিউমে স্যাড সং শোনা, মাঝে মধ্যে ছোট ভাইয়ের সাথে মারামারি করে তার সাউন্ড বক্সটা এনে ফুল ভলিউমে স্যাড সং বাজানো, ফেসবুকে স্যাড পোষ্ট করা, যত প্রকার স্যাড ভিডিও আছে তা শেয়ার করা, মেসেঞ্জারে স্যাড পিকচার মাইডে দেওয়া।
বাসার সবাই অলরেডি জেনে গিয়েছে আমার বয়ফ্রেন্ড তপু আমাকে রেখে ক্লাস সিক্সে পড়া তার খালাতো বোনের বান্ধবীর সাথে চুটিয়ে প্রেম করছে। তারপরেও দাদি মাঝে মাঝে এসে আমাকে খোঁচা দিয়ে জিজ্ঞেস করেন ‘কি রে তোর তপু কি বেঁচে আছে নাকি মরে গেছে?’
আমি তখন কম্বলের নিচ থেকে বের হয়ে কটমট দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলি ‘দাদি ও আমার তপু না। আর কখনও তুমি ওকে আমার তপু বলবা না।’
দাদি তখন বান্দর খেলা দেখে মজা পাওয়ার মত মজা পেয়ে বলে ‘আচ্ছা তোর তপুকে আর কখনও তোর তপু বলবো না। মনে থাকবে।’
চোখের জল মুছতে মুছতে দাদির মজা পাওয়া দেখে বললাম ‘ও হলো সিক্সে পড়ুয়া মেয়ের তপু। তুমি এখন যাও তো আমাকে একটু একলা থাকতে দাও।’
তপুর সাথে যেদিন ব্রেকাপ হয় তাকে অপমান করার জন্য বললাম ‘শেষ মেষ তুমি ক্লাস সিক্সে পড়া মেয়ের প্রপোজাল এক্সেপ্ট করলা! যার নাক চাপলে বের হয় দুধ সে প্রেমের কি বোঝে!’
তপু তখন রাগত্ব স্বরে উত্তর দিলো ‘তোমার থেকে খুব ভালো বোঝে! তোমার মত সবাই ইম্ম্যাচিউর না যে নাক চাপলে দুধ বের হবে।’
-দুধ না বের হলে কি বের হয় সর্দি?’
-সর্দি বের হোক, আমি দরকার হলে বসুন্ধরা টিস্যু নিয়ে যাব দেখা করতে।
আমি ভেবে পাইনা আমি কি এমন ইম্ম্যাচিউরিটি দেখালাম যে আমাকে ছেড়ে সিক্সের মেয়ের সাথে প্রেম করতে হলো। একদিন তপু ওর বন্ধুবান্ধবীদের সাথে ওর বাবা সম্পর্কে গল্প করতে করতে বললো ওর জন্মের সাত মাস আগে নাকি ওর বাবা বিদেশ চলে যায় আর আসে তখন ওর বয়স পাঁচ। তারপর দেশে এসে যখন ওকে দেখে আর বিদেশ যায় নি। এতটাই ভালোবেসে ফেলে তপুকে।
আমি তখন শুধু জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘তোমার জন্মের সাত মাস আগে তোমার বাবা বিদেশ গেলে তোমার জন্ম হলো কিভাবে? তোমার মা কি তখন তোমার বাবার কাছে গিয়েছিলো?’
আমার এমন প্রশ্নে তপুসহ ওর সাথের সকলে সাড়ে সায়ত্রিশ মিনিট হা হয়ে ছিলো। আমি কিছু না বুঝে আমিও হা হয়ে ছিলাম। আর এই সিলি একটা কারনে ও আমার সাথে ব্রেক করলো। যতবার’ই ব্রেকাপের কারন নিয়ে চিন্তা করি ততবার’ই মাথায় প্রশ্ন আসে ‘আসলেই তো ওর জন্ম হলো কিভাবে?’
যেভাবেই ওর জন্ম হোক সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো তপু এখন সিক্সের মেয়ের। আর এই কথাটা মাথায় এলেই আমার আর বাঁচতে মন চায় না, মরে যেতে ইচ্ছে করে। আয়নার দিকে এখন তাকালে নিজেকে দেখে নিজের ভয় লাগে। চোখের নিচে কালো দাগ, মুখ ভর্তি বড় বড় ব্রণ। কি অবস্থা করে ফেলেছি আমি আমার।
আমার এমন দশায় বাড়ির সবাই বকাবকি করতে করতে ক্লান্ত। এক বান্ধবী এলো বাসায় আমাকে দেখতে।
এসেই কেমন আছি এসব জিজ্ঞেস না করে জিজ্ঞেস করলো ‘ব্রেকাপ হার্টস্?’
আমি কিছু না বলে চুপচাপ করে রইলাম। আসলে ওর কাছে আমার বলার মত কিছু নেই। ও হলো এমন একটা মেয়ে যে এখনও বিয়ে করে নি, প্রেম করেনি, ব্রেকাপ হয় নি, প্রেমে পড়েও নি কিন্তু দুনিয়ার প্রেম ভালোবাসা বিয়ে সহ সব বিষয়ে তার বিস্তার জ্ঞান। এই মেয়ে এখানে এসেছে তারমানে এ আমার মস্তিষ্কটাকে ওয়াশ করে ছাড়বে, আমি ঢের বুঝতে পারছি। পালাবার রাস্তা নেই!
এসেই আমাকে জোড় করে বিছানা থেকে তুলে ওয়াশরুমে পাঠালো গোসলের জন্য।
আমি শাওয়ার অন করতেই ঠান্ডা পানি যখন গায়ে লাগলো চিৎকার করে উঠলাম।
বাথরুমের বাহিরে থাকা বান্ধবী তখন বললো ‘কি রে ব্রেকাপ হার্টস্?’
আমি তখন আসলেই অনুভব করলাম ব্রেকাপের থেকে এই ঠান্ডায় ঠান্ডা পানি দিয়ে গোসল করা অনেক বেশি কষ্টের।
চুলের শ্যাম্পু যখম এসে চোখে লেগে চোখ জ্বালাপোড়া শুরু করলো। ট্যাপ অন করে চোখ পরিষ্কার করতে যাবো ঠিক সেই সময় পানি শেষ। গোসলের এই মাঝ বরাবর পানি শেষ হওয়াটা এতটা বিরক্তিকর। দাঁতে দাঁত খিঁচিয়ে দাঁড়িয়ে চোখ মুছতে লাগলাম। হঠাৎ লোডশেডিং।
বান্ধবীর আওয়াজ ‘এখনও বল যে ব্রেকাপ হার্টস্’
গোসল শেষ করে রুমে আসতেই ব্রণ স্টিকটা হাতে ধরিয়ে দিলো।
এক একটা ব্রন ফাটাচ্ছিলাম আর চিৎকার করে উঠতে দেখে বান্ধবী প্রশ্ন করলো ‘ব্রেকাপ হার্টস্?’
আমি চোখের জল মুছতে মুছতে মাথা নেড়ে উত্তর দিলাম “একদমই না।”
খেতে বসলাম দুজন একসঙ্গে। হঠাৎ একটা কাঁচা মরিচ ঠোঁটে লাগলো। ঝালে নাকের পানি চোখের পানি এককার করে শুধু পানি গিলতে লাগলাম। বান্ধবী কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিস করে বললো ‘আর জীবনেও বলবি ব্রেকাপ হার্টস্?’
আমি অসহায়ের মত পানি খেতে লাগলাম।
খাওয়া শেষ করে রেষ্ট নিয়ে ওয়াশরুমে হাই কমোডে বসতেই মনে হলো আমি ভুল করে বরফের ভিতরে বসে পড়ছি। চিৎকার করতে যাবো ঠিক তখন মনে পড়লো বান্ধবীর প্রশ্ন ‘কি রে ব্রেকাপ হার্টস্?’
নিজে নিজেই তখন চুপ হয়ে গেলাম।
বাহিরে বের হবো, হিজাব পড়ার সময় হিজাব পিনগুলো যখন ভুল করে চামড়ায় ফুটে গিয়ে ব্যথায় চোখ বন্ধ হয় তখন আর বান্ধবীর বলতে হয়না নিজেই নিজেকে প্রশ্ন করি “ব্রেকাপ হার্টস্?”
পানি খাওয়ার সময় যখন শরীরের শিরা উপশিরা দিয়ে ঠান্ডা পানি চলাচল অনুভুত হয় তখন সত্যিই মনে ব্রেকাপ কোনো কষ্ট’ই না।
রাতে ঘুমানোর সময় পা গরম হয় না আর সেই ঠান্ডা পা যখন গরম কোনো স্থানে স্পর্শ লাগে তখন চিৎকার মেরে বলতে ইচ্ছা করে “ব্রেকাপ ডন্ট হার্টস্, ব্রেকাপ ডন্ট হার্টস্”
গল্পঃ ব্রেকাপ ডন্ট হার্টস্।
লেখাঃ তৃষ্ণা জান্নাত।