#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_৪৪ (অন্তিম পর্ব)
#ইসরাত_তন্বী
❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌
গ্রামে জাঁকিয়ে শীত পড়তে শুরু করেছে। হাড়কাঁপানো শীতে অসাড় প্রকৃতি।হিম হিম ঠান্ডা ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে। কুয়াশার আবরনে ঢাকা প্রকৃতি। নিস্তব্ধ পরিবেশ।রাতের নিস্তব্ধতা গলিয়ে ভেসে আসছে ক্ষুধার্ত কুকুরের হুংকার। চন্দ্রিমা বাঁশ বাগানের মাথার উপরে বসে নিজের রুপ প্রদর্শনে ব্যস্ত।জোৎস্নায় রাঙা গ্রামের মেঠোপথ।কবরস্থানের ল্যাম্পপোস্ট গুলো টিমটিম করে জ্বলছে।সদ্য হওয়া নতুন কবরটার উপর মাথা রেখে বসে আছে তাইফ।গুনগুনিয়ে কাঁদছে।দুহাতে শক্ত করে মাটি খামচে ধরে রেখেছে।
“মাধবীলতা তুমি আমারে কেন বললে না ?এই জীবনে ভালোবাসা যায় কিন্তু তাকে পাওয়ার স্বপ্নটা দেখা যায় না।তাহলে আমি কেবল ভালোই বাসতাম।তোমারে পাওয়ার স্বপ্নটা আমি দেখতাম না।যে চোখ দিয়ে তোমারে দেখেছি সেই চোখজোড়া যে চিরস্থায়ী ভাবে বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত তোমার মায়া কাটবে না।তুমি আমারে রেখে কেন চলে গেলে?এ কেমন ভালোবাসা তোমার? এই অভাগার জন্য একটুও কষ্ট হচ্ছে না তোমার?আমি যে এই ম র ণ য ন্ত্র ণা সহ্য করতে পারছি না।তুমি কি শুনতে পারছো আমার কথা?মাধবীলতা?”
কোনো উত্তর আসে না।অদূর থেকেই ভেসে আসে পাখিদের করুণ ডাক।তাইফ ডুকরে কেঁদে ওঠে।অস্ফুট স্বরে বলে,
“আমার আল্লাহর কসম।যারা আমার থেকে তোমাকে দূরে সরিয়েছে তাদের প্রত্যেকের গ র্দা ন কে টে তোমার পদতলে রাখবো আমি।আমার পবিত্র ভালোবাসার কসম মাধবীলতা।তোমার চেয়েও দ্বিগুণ কষ্ট দিয়ে তাদের মা র বো আমি।”
তাইফের কর্ণে ভেসে এক কিশোরীর খিলখিলিয়ে হাসির শব্দ।তাইফ সেই হাসির শব্দ লক্ষ্য করে সেদিকে তাকায়। কবরস্থানের ফুলের সমাহারের মাঝে শুভ্রারঙা কাপড় পড়ে দাঁড়িয়ে আছে তাইফের মাধবীলতা।মাধবীকে দেখতেই তাইফের হৃদয়ে সদ্য জন্ম নেওয়া ফুলের কুঁড়ি গুলো ফুটে ওঠে।হৃদয়জুড়ে সুবাস ছড়িয়ে পড়ে।মুচকি হাসে তাইফ।
“তুমি এসেছো মাধবীলতা?আমি জানতাম তুমি আসবে। আমাকে ছেড়ে আমার মাধবীলতা কখনও যেতে পারে না।”
মাধবী কিছু বলেনা। আবারও খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে।তাইফ মুগ্ধ চোখে সেই হাসি দেখে।হঠাৎ তাইফের সামনে থেকে মাধবীর অবয়ব টা অদৃশ্য হয়ে যায়।তাইফ চিৎকার করে ডাকতে থাকে,
“মাধবীলতা?কোথায় চলে গেলে তুমি?আমার সাথে লুকোচুরি খেলছো?”
তাইফের মনে হয় ওর মাধবীলতা কবরের মধ্যে থেকে মৃদু স্ব রে ওকে ডাকছে।
“তাইফ আমাকে তোমার সাথে নিয়ে চল।এখানে এই অন্ধকারে একা থাকতে আমার খুব ভয় লাগছে।”
“তোমার কোনো ভয় নেই মাধবীলতা।আমি আছি তো।তোমাকে আমার সাথে নিয়ে যাবো।এখানে একা রাখবো না তো তোমাকে।বোকা মেয়ে ভয় পায় না।”
তাইফ পাগলের মতো হাত দিয়ে কবরের মাটি সরাতে থাকে।মুখ দিয়ে বিড়বিড় করে বলে,
“আমার মাধবীলতা।এইতো আর একটু।ভয় পেও না তুমি।”
হৃদিত, আয়াশ কবরস্থানে এসে তাইফ কে এই অবস্থায় দেখতেই দ্রুত এগিয়ে আসে।তাইফকে জোর করে ওখান থেকে নিয়ে চলে আসে।তাইফ রাগে গজগজ করতে করতে বলে,
“আমার মাধবীলতা কষ্ট পাচ্ছে।আমাকে ছাড়ো তোমরা।আমার মাধবীলতা আমার সঙ্গে যাবে। ছেড়ে দেও বলছি।”
হৃদিত আর আয়াশ তাইফকে গাড়িতে তুলে নেয়।হৃদিত ড্রাইভ করতে শুরু করে।আয়াশ তাইফকে নিজের সাথে জড়িয়ে রাখে।ভাইয়ের ঘাড়ে মাথা দিয়ে ঘাপটি মেরে বসে থাকে তাইফ।চোখজোড়া দিয়ে বর্ষণ নামে।
___
চৌধুরী বাড়িতে পৌঁছেই তাইফ কে নিয়ে দোতলায় চলে যায় হৃদিত,আয়াশ।ওদের পিছু পিছু সবাই উপরে উঠে আসে।আরিফ চৌধুরী ডক্টরকে ইনফরম করে।তাইফের পাগলামি যেন কমবার নয়। মুখে শুধু একটাই শব্দ উচ্চারণ করে চলেছে
‘আমার মাধবীলতা।’ ছেলের কষ্ট দেখে হাউমাউ করে কান্না করে দেন আতিয়া চৌধুরী।সবাই আতিয়া চৌধুরীকে নিয়ে নিচে চলে যায়।থেকে যায় হৃদিত,আয়াশ আর আরিফ চৌধুরী।তাইফকে ফ্রেশ হতে সাহায্য করে হৃদিত।দশ মিনিটের ব্যবধানে ডক্টর এসে তাইফ কে চেক আপ করে ঘুমের ইনজেকশন দেয়। কিছু সময়ের ব্যবধানে ঘুমিয়ে পড়ে তাইফ। ডক্টর চিন্তিত মুখে বলে,
“তাইফের মেন্টাল কন্ডিশন ভালো না।আপনারা যত দ্রুত সম্ভব সাইকোলজিস্টের পরামর্শ নিন।এই অবস্থায় ম্যাক্সিমাম পেসেন্টের হ্যালুসিনেশন হয়ে থাকে। এরকম হতে থাকলে তাইফ মাধবীকে দেখতে পাবে।আর ওর টানে ওই কবরস্থানেই চলে যাবে।এটা তাইফের জন্য রিস্কি একটা ম্যাটার।”
ডক্টরের কথায় সায় জানায় আরিফ চৌধুরী। আগামীকাল’ই তাইফকে নিয়ে ঢাকাতে যাওয়ার প্ল্যান করে রাখে।ডক্টর চলে যেতেই তাইফকে ঠিকভাবে শুইয়ে দিয়ে ঘরের লাইট অন করে রেখে নিচে নেমে আসে সবাই।আজ রাতে আর তাইফের ঘুম ভাঙবে বলে মনে হয় না।চৌধুরী বাড়ির প্রতিটা সদস্য ড্রয়িং রুমে উপস্থিত।আরিফ চৌধুরী এতক্ষণ ধরে নিজের চেপে রাখা রাগটা আর কন্ট্রোল করতে পারেন না।হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সবার সম্মুখে শ্রেয়া চৌধুরীর গালে ঠাস করে থাপ্পড় মেরে বসেন।থাপ্পড়ের শব্দে সবাই চমকে শ্রেয়া চৌধুরী আর আরিফ চৌধুরীর দিকে তাকায়। শ্রেয়া চৌধুরী গালে হাত দিয়ে হতভম্ব হয়ে ছলছল চোখে আরিফ চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে আছেন। আকস্মিক এটার জন্য উনি মোটেও প্রস্তুত ছিলেন না। বাড়ির সবাই হতবাক হয়ে যায়!সিঁড়ির উপরেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে হৃদিত।আরিফ চৌধুরী রাগে গর্জে উঠে বলেন,
“এই কাজ তোর তাই না?ছোট্ট নিষ্পাপ বাচ্চাটাকে তুই মেরেছিস?জবাব দে।মানুষ হয়ে মানুষ মা র তে একটুও হাত কাঁপে না?ওহ হো আমি তো ভুলেই গেছি তুই তো মানুষের কাতারেই পড়িস না।তাইফের কিছু হয়ে গেলে তোকে মাটিতে জ্যা ন্ত পু তে রেখে দেবো আমি।থা র্ড ক্লাস মহিলা। আমার জীবনের সবচেয়ে বড় অ ভি শা প তুই।”
শ্রেয়া চৌধুরী কোনো প্রত্যুত্তর করেন না।কেবল হতভম্ব হয়েই তাকিয়ে থাকেন।ওনার বুকে কেউ যেন ছুরি চালিয়ে হৃদয়টা খ ন্ড বি খ ন্ড করে দিচ্ছে।যেই মানুষটার জন্য এতো গুলো পাপের বোঝা মাথায় নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন,নিজের গর্ভে জন্ম নেওয়া ছেলে দু’টোর জীবনটা পর্যন্ত ন ষ্ট করতে পিছপা হননি।আজ সেই মানুষটাই শেষ পর্যায়ে এসে হাত ছেড়ে দিল!তবে কি কারোর ক্ষতি করে কখনও ভালো থাকা যায় না?পঁয়ত্রিশ বছর আগে করা পাপের শা স্তি কি এখন পাচ্ছে?এটাই কি তবে প্রকৃতির বিচার?আরিফ চৌধুরী ওখান থেকে চলে যেতেই নিলে শ্রেয়া চৌধুরী হুশে ফেরেন।ধীর কন্ঠে বলেন,
“আমি খু ন করিনি।ওই নিষ্পাপ বাচ্চা মেয়েটার সাথে তো আমার কোনো শ ত্রু তা নেই। তাহলে আমি কেন ওর জীবনটা শেষ করে দেবো?এতোটা নি ষ্ঠু র আমি না।”
আরিফ চৌধুরী কথাগুলো শুনেও যেন শুনলেন না।বাড়ি থেকে বেরিয়ে যান।হৃদিত নিচে নেমে আসে।ঠিক আয়রা চৌধুরীর সামনে দাঁড়ায়।হিসহিসিয়ে বলে,
“আমি যদি জানতে পারি এর পিছনে আপনার হাত আছে।আই সোয়্যার এই পৃথিবীতে জা হা ন্না ম দেখিয়ে দেবো।”
কথাটা বলেই হৃদিত বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে। গন্তব্যস্থল শেখ বাড়ি।দীর্ঘক্ষণ অ্যানাবেলাকে দু’চোখ ভরে দেখতে পায়নি।বুকের মাঝে অশান্তির ঝড় বয়ে চলেছে।হৃদিতের বলা কথাটা শুনতেই আয়রা চৌধুরী দরদরিয়ে ঘামতে শুরু করে। শাড়ির আঁচল দিয়ে কপাল মুছে চটজলদি ওখান থেকে কেটে পড়তে নিলেই আয়াশ বলে ওঠে,
“ওটা কথার কথা ছিল ফুপি মণি।এতো ঘামবেন না।আর চোরের মতো পালিয়ে বেড়াবেন না।তাহলে কিন্তু সত্যিই আপনাকে সন্দেহের তালিকায় রাখা হবে।”
আয়াশের ঠোঁটে বাঁকা হাসি।অলিভিয়ার দিকে এক চোখ মেরেই হৃদিতের পিছু পিছুই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে।
___
রাত নয়টা বেজে পনেরো মিনিট।চৌধুরী বাড়ির সকলে শেখ বাড়িতে রাতের খাবার নিয়ে উপস্থিত হয়েছে।শুধু ছেলের জন্য আসতে পারেননি আতিয়া চৌধুরী।একমাত্র ছেলের এই অবস্থায় উনি দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।স্বামী ছাড়া এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে যেয়ে মানুষটা যেন আরও বেশি ভে ঙে পড়েছে।সবাই ড্রয়িং রুমে বসে আছে। অবনী শেখের সাথে টুকিটাকি কথা বলে ওনাকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে সকলে মিলে।অবনী শেখ এখন বাইরে থেকে অনেকটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভেতরের খবর কে জানে?মেহরিমার ঘরের দরজাটা বন্ধ।সেই সন্ধ্যায় বন্ধ করেছে এখনও খোলেনি।হৃদিত স্লথ পায়ে হেঁটে দরজার দিকে এগিয়ে যায়। কয়েকবার নক করে। দরজার ওপাশ থেকে কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যায় না।হৃদিত ঘুরে চলে আসতে নিলেই দরজার লকটা শব্দ করে খুলে যায়।হৃদিত কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থাকে।এক অজানা ভয় চারিদিক থেকে জেঁকে ধরে।ধীর পায়ে ঘরের ভেতরে প্রবেশ করে।ঘুটঘুটে অন্ধকারে আচ্ছন্ন রুমটা।একটা লাইটও জ্বালানো নেই।জানালা দিয়ে চাঁদের মৃদু আলো এসে ঘরে প্রবেশ করেছে।সেই মৃদু আলোয় যেন অন্ধকার আরও দ্বিগুন বেড়ে গেছে।হৃদিত আর রুমের লাইট অন করে না।শব্দহীন পায়ে হেঁটে মেহরিমার পাশে যেয়ে বসে।চাঁদের আবছা আলোয় মেহরিমাকে দেখতেই বুকের মাঝে মোচড় দিয়ে ওঠে।খাটের সাথে হেলান দিয়ে অগোছালো অবস্থায় নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে মেহরিমা।দেহে যেন প্রাণ নেই!দৃষ্টি ফ্লোরে নিবদ্ধ।এক দিনেই মেয়েটার শরীর ভেঙে গেছে।কেমন অসহায়ের মতো দেখাচ্ছে!মেহরিমার চোখদুটো রক্তের ন্যা য় লাল হয়ে ফুলে আছে। ঠোঁটের কাটা স্থান চিঁড়ে র ক্ত বেরিয়ে জমে গেছে। চুলগুলো এলোমেলো ভাবে জট বেঁধে ফ্লোরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।পায়ে বাঁধা নতুন ব্যান্ডেজ টাও র ক্তা ক্ত হয়ে আছে। চাঁদের আলোয় হৃদিত স্পষ্ট দেখতে পায় ঘরের ফ্লোর জুড়ে পায়ের ছোপ ছোপ র ক্তে র দাগ লেগে আছে।হৃদিতের চোখ বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে।ফ্লোরে দৃষ্টি রেখেই মেহরিমা বলে,
“কাঁদছেন কেন?কান্না করার কথা তো আমার।সব হারিয়েছি আমি।”
মেহরিমার কথায় হৃদিত নড়েচড়ে বসে।শক্ত খসখসে হাত দুটো দিয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়া পানি গুলো দ্রুত মুছে ফেলে।ভাঙা গলায় বলে,
“জান তুই এভাবে নিজেকে কষ্ট দিচ্ছিস কেনো?আমি তো আছি তোর পাশে।সবাই তোকে ছেড়ে গেলেও আমি কখনও ছেড়ে যাবো না।তোর থেকে সহস্র মাইল দূরে থাকলেও আমার ছায়া,বিশ্বস্ত দুটো হাত সবসময় তোর মাথার উপরে থাকবে অ্যানাবেলা।”
“আপনি আর আপনার পরিবার প্রতিনিয়ত যে মৃ ত্যু য ন্ত্র ণা দিয়ে চলেছেন সেগুলোর কাছে এই য ন্ত্র না খুবই তুচ্ছ হৃদিত চৌধুরী।এটাতো বাহ্যিক য ন্ত্র ণা তাই দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু আমার মনের গহীনে যে কষ্ট,ক্ষ ত লুকায়িত আছে সেগুলো তো কেউ দেখতে পায় না।আপনিও দেখতে পাচ্ছেন না।”
“আমি এই বিষয়ে কিছুই জানতাম না বিশ্বাস কর।আগে থেকে যদি ওদের প্লানিং এর একাংশও জানতে পারতাম তাহলে এমনটা কখনোই হতে দিতাম না।তুই তো আমায় বিশ্বাস করিস জান?আমি কথা দিচ্ছি মাধবীর শরীর থেকে ঝরা প্রতিটা র ক্তে র ফোঁটার হিসাব ওদেরকে দিতে হবে।”
“আপনার হিং স্র তা আমার থেকে সব কেড়ে নিল হৃদিত চৌধুরী।আমার বাবা, আমার নিষ্পাপ বোনটাকে কেড়ে নিলো।আপনি তো এটাই চেয়েছিলেন তাই না?আমাকে মুখ দেখাতে আপনার লজ্জা লাগছে না?বিশ্বাস করুন আপনার দিকে তাকাতেও আমার ঘৃ ণা লাগছে।”
কথাগুলো বলেই হুঁ হুঁ করে কেঁদে ওঠে মেহরিমা। ও যেন হুশে নেই। মুখে যা আসছে তাই বলে চলেছে।মেহরিমার বলা একেকটা ধারালো কথা যে সামনে বসা মানুষটাকে ভেতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে শেষ করে দিচ্ছে সেই দিকে ওর কোনো খেয়াল’ই নেই।মেহরিমার মানসিক অবস্থা বুঝতে পারে হৃদিত। কিন্তু মুখনিঃসৃত কথাগুলো!মানুষ বলে শব্দতেই যত্ন,শব্দতেই বিচ্ছেদ।ভগ্নহৃদয়, ব্যথিত মন নিয়েই হৃদিত বলে,
“শা স্তি দিতে চাস?”
“আমার দু’চোখের সামনে আর কখনও আসবেন না।”
“আমার সীমানা পেরিয়ে কতদূর যেতে চাস?”
“যতদূর গেলে হৃদিত চৌধুরী আর তার সাথে কাটানো বি ষা ক্ত স্মৃতিগুলো আমাকে তাড়া করে বেড়াবে না।ঠিক ততটা দূর’ই যেতে চাই।”
“আমাকে ছাড়া ভালো থাকতে পারবি?”
“আপনার সাথে থেকেও তো আমি ভালো নেই।”
“তোকে ভালো রাখার আরেকটা সুযোগ কি আমি পেতে পারি না অ্যানাবেলা?”
“কেনো নয়? অবশ্যই পেতে পারেন।আমার হারানোর মতো আর কীই বা আছে?মা আর আমার কুট্টুস পাখিটা।ওদের দু’জনকে হারিয়ে স্বর্বহারা হওয়ার জন্য আপনাকে আমি আরেকটা সুযোগ দিতে চাই।”
মেহরিমার কথায় হৃদিতের বুকে র ক্ত ক্ষ র ণ হয়। নিজের অ্যানাবেলার চোখে এতোটা খারাপ কবে হয়ে গেল?ব্যথিত,অবিশ্বাস্য চাহনি দিয়ে মেহরিমার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।যেই দৃষ্টি ফ্যাকাশে।নেই কোনো অর্থ।দৃষ্টিতে কেবল অসহায়ত্ব ফুটে উঠেছে।নিরবতায় কেটে যায় কিয়ৎকাল।নিরবতা ভে ঙ্গে হৃদিত বলে,
“আমার হিং স্র তা দেখলি অথচ ভালোবাসাটা দেখলি না?”
“ভালোবাসা পবিত্র।এখানে হিং স্র তা র কোনো স্থান নেই হৃদিত চৌধুরী।”
“তবে কি তোকে আমি পেয়েও হারিয়ে ফেললাম অ্যানাবেলা?”
মেহরিমা কোনো প্রত্যুত্তর করে না। কাঁদতেই থাকে।ওদের দু’জনের কথার মাঝেই আয়েশা চৌধুরী এসে হৃদিতের কাছে মেহরিমার খাবার দিয়ে যায়।হৃদিত হাত ধুয়ে আসে।মেহরিমা ততক্ষণে টলমল পায়ে উঠে দাড়িয়েছে।হৃদিত খাবারের প্লেট হাতে নিয়ে মেহরিমাকে বিছানায় বসতে বলে।মেহরিমা বসে না।ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়। মুখে বলে,
“ক্ষুধা নেই।খাবো না।”
“প্লিজ অ্যানাবেলা।জেদ করিস না। আজকের পর আর কখনও আমাকে তোর দু’চোখের সামনে দেখতে পাবি না।কিন্তু এখন আমাদের কুট্টুস পাখির জন্য হলেও খাবারটা খেয়ে নে।সারাদিন না খেয়ে আছিস।শরীর আরও অসুস্থ হয়ে পড়বে জান।”
“ওই নামে আমাকে আর কখনও ডাকবেন না।আর আমাদের না ও শুধুমাত্র মেহরিমা শেখের সন্তান।ওর রক্ত পবিত্র।ওর রক্তে ওই বিশ্বাস ঘা ত ক চৌধুরীদের বি ষা ক্ত র ক্ত নেই। ”
“আচ্ছা ঠিক আছে।এবার তো খেয়ে নে।”
মেহরিমা এবার রাগে জেদে হৃদিতের হাত থেকে খাবারের প্লেটটা ছুঁড়ে ফেলে দেয়।বিকট শব্দে প্লেট টা ভেঙ্গে ফ্লোরে ছড়িয়ে পড়ে। বাড়ির সকলে সেই শব্দে মেহরিমার রুমের দিকে ছুটে আসে।মেহরিমা মুখে হাত দিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে।চিৎকার করে কাঁদতে কাঁদতেই বলে,
“আপনাকে বললাম না আমার সামনে থেকে চলে যান। আপনি এতো নি র্ল জ্জ কেনো?আপনাকে দেখলে আমার খুব কষ্ট হচ্ছে,রাগ হচ্ছে, ঘৃ ণা লাগছে।আপনার জন্য মাধুপুকে হারিয়েছি আমি। আমার বোন।আমার মাধুপু।আপনার ওই মুখ আর কখনও দেখতে চাই না আমি।চলে যান আপনি।দয়া করুন আমাকে।একটু বাঁচতে দেন আমাকে।”
মেহরিমার বলা কথাগুলো শুনে সবাই হকচকিয়ে যায়!মেহরিমা ঠিক আছে তো?হৃদিতের মতো করে আদৌও কি কেউ ভালোবাসতে পারে?বোনের শোকে মেয়েটা পাগল হয়ে গেল নাকি?হৃদিত কিছুক্ষণ নীরব থেকে মেহরিমার দিকে এগিয়ে যায়।ওর হাত দুটো আলতো করে নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে বলে,
“তোকে অনেক কিছু বলার আছে অ্যানাবেলা।প্লিজ আমার সম্পূর্ণ কথাটা শোন।”
“হাত ছাড়ুন আমার। ছুঁবেন না আমাকে।”
হৃদিত আরও কিছু বলতে নিলেই মেহরিমা রাগের বশে থাপ্পড় মেরে দেয় হৃদিত কে। মূহুর্তেই ছোট খাটো একটা বজ্রপাত পড়ে শেখ বাড়িতে।অদূরেই যেন কোনো পাহাড় ধ্বসে পড়ে।সেই শব্দে কেঁপে ওঠে সকলের অন্তরাত্মা।উপস্থিত সবার চোখজোড়া অক্ষিকোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম। অবনী শেখ যেন নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছেন না।মেহরিমা নিজের হাতের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।এটা কী করে ফেললো!ও তো এমনটা করতে চায়নি।নিজের হাতটা এক্ষুনি ক্ষতবিক্ষত করে ফেলতে মন চায় মেহরিমার।অবনী শেখ হুং কা র দিয়ে ওঠেন,
“নীলাক্ষী তোর কী বোধশক্তি লোপ পেয়েছে?এটা কী করলি তুই? এক্ষুনি ক্ষমা চা হৃদিত বাবার থেকে।”
হৃদিত কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে যায়। পরক্ষণেই মেহরিমার দিকে তাকিয়ে মলিন মুখেই মৃদু হেসে বলে,
“বিচ্ছেদ চাস নাকি মুক্তি?”
মেহরিমা নিশ্চুপ।কোনো কথা বলে না। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়তে থাকে।হৃদিতের বুক থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।মুখে বলে,
“ইয়্যু নো অ্যানাবেলা অপেক্ষা একটা মানসিক য ন্ত্র ণা। তবুও আমাদের অপেক্ষা করতে হয়।ওই যে নির্দিষ্ট একটা মানুষের কাছে আমরা সকলে অসহায় থাকি।আমাদের সবটুকু অপেক্ষা ওই জীবিত মানুষগুলোর জন্য।আমি আমার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস অব্দি তোর জন্য অপেক্ষা করবো।হোক না সেটা দীর্ঘ অপেক্ষা।যদি কখনও আমাকে মনে পড়ে চলে আসিস।আমার মনের,ঘরের দুটো দরজা’ই সবসময় তোর জন্য খোলা।তোকে নিজের করে পেয়েও পেলাম না আমি।তোকে জড়িয়ে ধরে আমি আমার অসহায়ত্বের কথাগুলো বলতে পারলাম না। তুই আমার সব বুঝলি কিন্তু এই আমিটাকেই বুঝলি না অ্যানাবেলা।এই একটাই আফসোস আমার আজীবন থেকে যাবে।এ য ন্ত্র ণা বয়ে বেড়াতে পারলে হয়তো বেঁচে থাকবো আর যদি না পারি এই পৃথিবী থেকে নিখোঁজ হয়ে চিরতরে হারিয়ে যাবো।তখন একটুও আফসোস করিস না আমার সানসাইন।ভুলে যাস তোর জীবনে হৃদিত নামের কেউ ছিল।কুট্টুস পাখিকে বলিস ওর পাপা মানুষ হিসেবে খা রা প হলেও একজন বাবা হিসেবে খা রা প নয়।ওর পাপা ওকে খুব ভালোবাসে।”
কম্পনরত কন্ঠস্বর হৃদিতের।হৃদিতের চোখের জলেরা বাঁধ মানে না।সাতাশ বছরের গড়া কঠিন সত্তাটা এক নিমিষেই ধ্বসে পড়ে।বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।কাঁদতে কাঁদতেই টলমলে পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।আয়াশ হৃদিতের পিছু ছোটে।হৃদিত চলে যেতেই মেহরিমার ঘোর কাটে।হুশে ফেরে।এতক্ষণ ধরে কী করেছে সেটা ভাবতেই গলায় কান্নারা দলা পাকিয়ে আসে!এতো বড় শা স্তি ওই নিঃশেষ হয়ে যাওয়া মানুষটাকে কীভাবে দিল?দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যায় মেহরিমা।ততক্ষণে হৃদিতের গাড়িটা ধুলো উড়িয়ে শেখ বাড়ির আঙ্গিনা ত্যাগ করেছে।মেহরিমা দৌড়ে গাড়িটার পিছু পিছু যায়। চিৎকার করে বলতে থাকে,
“যাবেন না।আমাকে ছেড়ে যাবেন না দয়া করে।আমি ভুল করেছি।”
মেহরিমা দৌড়াতে দৌড়াতে রাস্তায় হোঁচট খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে।এবার নাক মুখ দিয়ে গলগলিয়ে র ক্ত উঠে আসে। তবুও সেই র ক্তা ক্ত অবস্থায়’ই উঠে দাঁড়িয়ে আবারও দৌড় দেয়।কিন্তু ততক্ষণে চোখের সামনে থেকে হৃদিতের গাড়িটা অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে গেছে।তীব্র অন্ধকার যেন গাড়িটাকে গ্রাস করে নেয়।মেহরিমা রাস্তায় উপরেই বসে পড়ে। হাত পা ছড়ায়ে ছিটায়ে চিৎকার করে কাঁদতে থাকে।ডান হাতটা দিয়ে ক্রমশ আঘাত করতে থাকে রাস্তায়।কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই হাতটা ক্ষ ত বি ক্ষ ত হয়ে যায়।কিন্তু সেই আর্তনাদ কি আদৌও হৃদিত পর্যন্ত পৌঁছায়?হয়তো না!আমরা মানুষেরা বড়ই অভিনব প্রাণী!কেউ থাকতে মূল্য দেই না।অথচ ছেড়ে গেলে দেওয়ালে কপাল ঠুকে মরি।মেহরিমার বুকের মাঝে কেউ যেন হাতুড়ি দিয়ে পিটাচ্ছে।বুকটা য ন্ত্র ণা য় ফেটে যাওয়ার উপক্রম।চারিদিক থেকে পৃথিবী ক্রমশ শূন্য হয়ে আসছে!কীসের এতো যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে? বিচ্ছেদের?হৃদিতের বলা শেষ কথাগুলো মেহরিমার মস্তিষ্কে কিলবিল করে দৌড়ে বেড়াচ্ছে।এতো বড় ভুল মেহরিমা কীভাবে করতে পারল?শরীর নিস্তেজ হয়ে আসে।ততক্ষণে সবাই দৌড়ে মেহরিমার নিকট এসেছে।অবনী শেখ মেয়েকে নিজের বুকে আগলিয়ে নেন।মেহরিমা মায়ের বুকে ঢলে পড়ে।অস্ফুট স্বরে বলে,
“আমি ওনাকে ভালোবাসি মা।ওনাকে ফিরে আসতে বলো না মা।আমি ওনাকে ছাড়া বাঁচতে পারবো না মা।”
#সমাপ্ত
(নোট: #কাঠগোলাপের_আসক্তি প্রথম পরিচ্ছেদের সমাপ্তি টানলাম আজ।আমি যেভাবে প্লট সাজিয়েছি ঠিক সেভাবেই লিখেছি অ্যান্ড এন্ডিং টেনেছি।মাঝে এক দুটো দিন রেস্ট নিয়ে দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ দেওয়া শুরু করবো ইন শা আল্লাহ।প্রিয় পাঠক আজ সবাই রেসপন্স করবেন কেমন?প্রথম পরিচ্ছেদটা কেমন লেগেছে অবশ্যই মন্তব্য করে জানাবেন। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।আজ সব ধরনের পাঠকদের রেসপন্স আশা করছি।)