#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_৩৯
#ইসরাত_তন্বী
❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌
রাস্তা দিয়ে একা হেঁটে চলেছে মাধবী।সূর্যের তাপদাহে পুড়ছে প্রকৃতি।গ্রামের রাস্তায় আজ মানুষের আনাগোনাও কম।এই অতিরিক্ত তাপমাত্রায় মাধবীর অবস্থা শোচনীয়।গন্তব্যস্থল ‘উচ্ছ্বাস কোচিং সেন্টার’।আর পাঁচ মিনিট হেঁটে গ্রামের মোড় পর্যন্ত যেতে পারলেই ভ্যান অথবা অটোরিকশা পেয়ে যাবে।কিন্তু সেই পাঁচ মিনিট হেঁটে যাওয়া মাধবীর জন্য কষ্টকর হয়ে দাঁড়িয়েছে।বাসায় একা থাকতে বড্ড বোরিং লাগছিল।পড়াশোনাটাও ঠিকমতো হচ্ছিল না।তাই অবনী শেখের কথায় আজ কোচিংয়ের উদ্দেশ্যে বেরিয়েছে মাধবী।এখন কিছুদিন ওখানে ক্লাস গুলো করলেও কিছুটা উপকৃত হবে।
সময় এগারোটা বেজে দশ মিনিট।ক্লাস সাড়ে এগারোটায়।আজ ছাতাটাও আনতে ভুলে গেছে।বেজায় বিরক্ত হয় মাধবী।মাধবীর ভাবনার মাঝেই কোথা থেকে উড়ে এসে ওর সামনে দাঁড়ায় তাইফ। হঠাৎ কেউ এভাবে সামনে এসে দাড়ানোতে মাধবী ভড়কে যায়।পরক্ষণেই তাইফকে দেখতে গলায় আটকে রাখা শ্বাস টুকু ফেলে।
“কোথায় যাচ্ছো মাধবীলতা?”
মাধবীলতা নামটা শুনতেই মাধবী কিছুক্ষণের জন্য থমকায়।বুকের মাঝে একটা অদ্ভুত শিহরণ খেলে যায়।নতুন এক অনুভূতি জন্ম নেয়।কী এই অনুভূতির নাম?মাধবীর জানা নেই।তবে ‘মাধবীলতা’ নামটা শুনতেই মনের বিরক্ত ভাব কেটে মনটা ভালো লাগায় ছেয়ে যায়। মাধবী সময় নিয়ে আস্তে করে জবাব দেয়,
“কোচিংয়ে।”
“হঠাৎ?মাঝে তো যেতে না।”
“বাসায় ভালো লাগছিল না।তাই আজ যাচ্ছি।”
“এখন প্রতিদিন’ই যাবে নাকি?”
“ঢাবির এক্সামের আগ পর্যন্ত রেগুলার যাবো।কিন্তু আপনি কীভাবে জানলেন আমি কোচিংয়ে যাই না?”
মাধবীর পাল্টা প্রশ্নে তাইফ থতমত খেয়ে যায়। পরক্ষণেই মুচকি হেসে বলে,
“ভাবী বলেছিল।”
“ওও আচ্ছা।পথ ছাড়ুন ভাইয়া। আমার লেইট হচ্ছে।”
“কী! তুমি আমায় ভাইয়া ডাকলে?”
“জি,তো?”
“প্রেজেন্ট ভাইয়া,
ফিউচার ছাইয়া।”
কথাটা বলেই লাজুক হাসে তাইফ। মাধবী হতবাক হয়ে যায়!এই ছেলেকে যতটা ইনোসেন্ট ভেবেছিল ততোটাও ইনোসেন্ট এই ছেলে না। মাধবী আর কিছু না বলে পাশ কাটি সামনের দিকে হাঁটা ধরে।তাইফ ও প্যান্টের পকেটে হাত গুজে পিছু পিছু হাঁটতে থাকে।মাধবী পিছনে না তাকালেও সেটা অনুভব করতে পারে।আর তাতেই অধরে মুচকি হাসি ফুটে ওঠে।
“চুমকি চলেছে একা পথে
সঙ্গী হলে দোষ কি তাতে?
রাগ করোনা সুন্দরী গো
রাগলে তোমায় লাগে আরও ভালো।”
হঠাৎ এমন আজগুবি গান শুনতেই মাধবীর পা জোড়া আপনাআপনিই থেমে যায়।পিছনে ঘুরে তাকায়।তাইফ নিজের আটাশ পাটি দাঁত বের করে হাসছে।মাধবী কিয়ৎকাল মুগ্ধ চোখে সেই হাসির দিকে তাকিয়ে থাকে।হৃদয় থমকে যায়!এভাবে কয়েক মিনিট পেরোতেই মাধবী নিজের মনের মুগ্ধতা কাটিয়ে মিছে মিছে বিরক্তির ভাব ধরে বলে,
“আপনি কি আমায় টিজ করছেন?”
“উহু,আমি তো নিজের পছন্দের একটা গান গাচ্ছিলাম।”
মাধবী হতাশ হয়।কথা বললে আরও কথা বাড়বে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে এভাবে কথা বলা ঠিক না।গ্রামের মানুষ নিশ্চয় সেগুলো ভালো চোখে দেখবে না।দিন শেষে তখন সব দোষ মাধবীর হবে। চৌধুরীরা ধোঁয়া তুলসী পাতা কি না! মাধবী আর কথা বাড়িয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়।তাইফও বিষয়টা বুঝতে পারে।আর পিছু নেয় না।মোড়ে পৌঁছাতেই অটোরিকশার দেখা মেলে।মাধবী অটোরিকশায় উঠে বসে।আবারও আগের ন্যায় কোথায় থেকে উড়ে এসে ড্রাইভারের পাশের সিটে বসে পড়ে তাইফ।ড্রাইভার চাচা তাইফকে দেখতেই খুশি হয়ে যান।গাড়ি স্টার্ট দিয়ে নিজের চৌদ্দ গোষ্ঠীর গল্প শোনাতে শুরু করেন।তাইফও মনোযোগী শ্রোতার ন্যায় সবটা শুনতে থাকে।মাঝে মাঝে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকিয়ে দুষ্টু হাসি দেয়।মাধবী না পারছে কিছু বলতে আর না পারছে সহ্য করতে।মনে মনে বলে,”ভারী দুষ্টু ছেলে!”কোচিংয়ের নিকট আসতেই মাধবী নেমে পড়ে। ড্রাইভার চাচা ভাড়া নিতে না চাইলেও জোর করে ভাড়াটা হাতে ধরিয়ে দেয় মাধবী। অতঃপর নিজের ক্লাসের দিকে হাঁটা ধরে।তাইফ ততক্ষণে নেমে দাঁড়িয়েছে। অটোরিকশাওয়ালা চাচা চলে যেতেই তাইফ ও কিছুটা সামনে এগিয়ে যায়।রোদের তাপমাত্রা থেকে বাঁচতে একটা জাম গাছের নিচে আশ্রয় নেয়। ঘেমে গায়ে থাকা শার্টটা শরীরের সাথে লেপ্টে গেছে।মাধবী কিছু দূর যেয়েই থেমে যায়।পিছনে ফিরে তাকায়।তাইফের গভীর দৃষ্টির সাথে দৃষ্টি মিলে যায়। মাধবী কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলে,
“চুমকির সঙ্গী হলে দোষ নেই।চুমকিও রাগ করবে না।”
কথাটা বলেই এক ছুটে নিজের কোচিং রুমে ঢুকে পড়ে মাধবী।তাইফ যেন নিজের কান দুটোকে বিশ্বাস করতে পারছে না!দুই মিনিট সময় নিয়ে নিজেকে ধাতস্থ করে।পরক্ষণেই জিতে যাওয়ার ভঙ্গিতে শব্দ করে বলে ওঠে,
“ইয়েস!”
তাইফ খুশি মনে আরও কিছুক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়ে থাকে।তারপর মুচকি একটা হাসি দিয়ে অবাধ্য চুলের ভাঁজে আঙ্গুল গলিয়ে দিয়ে গুনগুন করে গান গাইতে গাইতে উল্টো পথে হাঁটা ধরে।মাধবী জানালার পাশে লুকিয়ে সবটাই দেখে। বিড়বিড় করে বলে,
“পাগল একটা!”
পরক্ষণেই ওর মনে পড়ে যায় বাবা তো সবসময় বলতো মাধবী ওর খালামনির হতো হয়েছে।ভাগ্যটা আবার খালামনির মতো হবে না তো!মাধবীর মুখে তমসা নেমে আসে।
____
সময় বিকালবেলা।গাছের নিচে একটা বড় পাথরের উপর বসে আছে মেহরিমা।আজ একটা পার্পল কালারের জর্জেট শাড়ি জড়িয়েছে শরীরে। হাঁটু সমান দীঘল কালো চুলগুলো ছেড়ে দেওয়া।চোখে হালকা করে কাজল টেনেছে।ঠোঁটে নুড কালারের লিপস্টিক দিয়েছে।গলায়,কানে,হাতে শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে হৃদিতের কিনে দেওয়া অর্নামেন্টসগুলো পরেছে।মেহরিমার সামনে বড় একটা নদী বয়ে চলেছে।মেহরিমা একদৃষ্টিতে নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে আছে।কী ভাবছে কে জানে!পাশেই হৃদিত বসে আছে।হৃদিতও আজ একটা পার্পল কালারের পাতলা শার্ট আর হোয়াইট কালারের গ্যাবার্ডিন প্যান্ট পরেছে।চোখে সবসময়ের ন্যায় সানগ্লাসও আছে।এর জন্য বিশেষ কোনো কারণ নেই।হয়তোবা নিজের অদ্ভুত চোখদুটো লোকচক্ষুর আড়ালে লুকিয়ে রাখতে পছন্দ করে।নদীর ঠান্ডা ঝিরিঝিরি বাতাসে দু’জনের মন প্রাণ জুড়িয়ে যাচ্ছে।পরম আবেশে পরিবেশটা উপভোগ করছে একজোড়া লাভ বার্ডস।দু’জনের মাঝে নিরবতা বিরাজমান।মেহরিমা নিরবতা ভেঙ্গে বলে,
“এই নদীর নাম কী?”
“আমি অ্যাকিউরেট নামটা জানি না।তবে এই এলাকাটা হচ্ছে খ্রিস্টানদের।ওরা এই নদীকে ‘ইচ্ছাপূরণ’ নদী নামেই ডাকে।এই নদীর কাছে কিছু চাইলে নাকি সেটা পাওয়া যায়।”
“ওও আচ্ছা। উদ্ভট চিন্তাভাবনা!”
“হুম।”
“আচ্ছা আপনি না থাকলে আপনার বাগান বাড়িতে আর কেউ থাকে না?”
“থাকে তো।কেয়ারটেকার চাচা।তুই আসবি বলে ওনাকে ছুটি দিয়েছি।আমাদের প্রাইভেট মোমেন্টস এ যেন একটুও ডিস্টার্ব না হয় সেজন্য।”
হৃদিতের বলা কথাটা শুনে মেহরিমা অবাক হয়ে যায়!পরক্ষণেই ভাবে ওর জামাইকে দিয়ে সব সম্ভব।মেহরিমা বেশ ব্যঙ্গ করেই বলে,
“খুউউব ভালো কাজ করেছেন আপনি।ডক্টর ইউনুস আপনাকে নোবেল দেওয়ার জন্য হ্যারিকেন জ্বালিয়ে খুঁজছে।”
“আই নো আমি সবসময় ভালো কাজ’ই করি।”
বুক ফুলিয়ে গর্বের সাথে বলে হৃদিত।কিছু একটা ভেবে ভ্রু জোড়া কুঁচকে তৎক্ষণাৎ আবারও বলে,
“বাট নোবেল কী ডক্টর ইউনুসের নিজের সম্পত্তি? উনি আমায় কিভাবে দিবেন?”
“আমি কী জানি?মুখে ওনার নাম আসলো বলে দিলাম।ব্যস হয়ে গেলো।আপনাকে কেনো ওতো গভীরে যেয়ে ভাবতে হবে?আজব তো!সে যার সম্পত্তি হয় হবে।”
মেহরিমার কথায় হৃদিত ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।বউয়ের অনেক রুপ’ই তো দেখেছে এটা আবার কোন রুপ কে জানে!প্রতিদিন’ই তো নতুন নতুন রুপ দেখেই চলেছে।আর কতো রুপ যে দেখতে হবে আল্লাহ ভালো জানেন!
“আমাদের শেষ টা সুন্দর হবে তো?আমার সব অপ্রাপ্তির মাঝে একমাত্র প্রাপ্তি আপনি।আপনাকে আমি হারাতে চাই না।”
মেহরিমার প্রশ্নে হৃদিত চুপ হয়ে যায়।এর উত্তর হৃদিতের কাছে নেই।বুকের মাঝে যন্ত্রণা গুলো কিলবিল করে ওঠে।একদিকে নিজের ভালোবাসা অন্যদিকে নিজের জন্মদাত্রী মা।দু’জনকেই তো ভালোবাসে হৃদিত।মাকে কী কোনোদিন পরিবর্তন করতে পারবেনা হৃদিত!ছেলের শূন্যতা কী কখনও মা নামক মানুষটা অনুভব করতে পারবে না?মেহরিমা হৃদিতের মনের অবস্থা বুঝতে পারে।নিজের মনের কষ্ট,ক্ষত সবটা নিজের কাছেই রেখে কথা ঘুরিয়ে নেয়।দিন শেষে নিজের ক্ষত নিজেকেই সারতে হয়।মানুষ ওই মলম লাগিয়ে দেওয়া পর্যন্ত’ই ঠিক আছে।
“ওই পাহাড়ে যাবো।”
মেহরিমার কথায় হৃদিতের ধ্যান ভাঙে। মুখে মুচকি হাঁসি ফুটিয়ে বলে,
“কাল সকালে যাবো পাহাড়ে।তোর জন্য একটা সারপ্রাইজ আছে।”
“সত্যিই!”
উৎফুল্ল কন্ঠস্বর মেহরিমার।হৃদিত মৃদু হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।মেহরিমার অভিনয় টা খুব সহজেই বুঝে যায়।বুক থেকে চাপা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে।মুখে বলে,
“যে হাসি নীরবে নিজের সবটুকু ব্যথা লুকাতে জানে সেই হাসি বোঝার ক্ষমতা সবার থাকে না তাই না অ্যানাবেলা?কিন্তু বিশ্বাস কর তোর প্রতিটা শ্বাস প্রশ্বাস আমি বুঝি। আমার জীবনে সবকিছুর ঊর্ধ্বে তুই।তুই যতক্ষণ আছিস ততক্ষণ এই আমি আছি।তোর থেকেও আমি অনেক বেশি ভালোবাসি তোকে।এই সম্পূর্ণ আমি টার থেকেও অনেক বেশি।”
মেহরিমার মুখে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে।বুকে প্রশান্তির হাওয়া ছড়িয়ে পড়ে।ওরা দু’জন পুরো বিকাল জুড়ে আরও অনেক যায়গায় ঘোরাঘুরি করে।মেহরিমার মন খারাপ সবটুকু ভালো হয়ে যায়।সন্ধ্যায় শহরের মধ্যে একটা রেস্টুরেন্টে খেতে যায় ওরা।রেস্টুরেন্ট টা বাইরে থেকে দেখতে অনেক বিলাসবহুল লাগে।মেহরিমা রেস্টুরেন্টের ভিতরে ঢুকেই অবাক চোখে সবটা দেখতে থাকে।রেস্টুরেন্টটা চোখ ধাঁধানো সুন্দর।হৃদিত মেহরিমার পছন্দ মতো কিছু খাবার অর্ডার করে।আধা ঘন্টার ব্যবধানে ওয়েটার এসে ওদের টেবিলে খাবার দিয়ে যায়।মেহরিমা হালকা পাতলা খায়।বেশি খেতে পারেনা।ওয়াশ রুমে যাওয়ার কথা বলতেই হৃদিত মেহরিমাকে ওয়াশ রুমে নিয়ে যায়।নিজেও একটু দূরে থাকা বেসিংয়ের নিকট যেয়ে হাত টা ধুয়ে নেয়। হঠাৎ একটা ফোনকল আসায় হৃদিত ফোনে কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। হাঁটতে হাঁটতে বেশ অনেকটা সামনেই এগিয়ে যায়।
পাঁচ মিনিট পরে মেহরিমা ওয়াশ রুমের দরজা খুলতেই একটা মধ্যবয়স্ক অপরিচিত লোককে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।ও ভয় পেয়ে যায়।লোকটা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে লা ল সা র চোখ দিয়ে মেহরিমাকে গিলে খাচ্ছে।মেহরিমা অত্যন্ত ঘাবড়ে যায়।চোখের সামনে সেই ভ য়ং ক র রাতের দৃশ্য ভেসে ওঠে।আশেপাশে তাকিয়ে হৃদিতকে খুঁজতে থাকে কিন্তু কোথাও হৃদিতের দেখা মেলে না।ওয়াশ রুমটা অফসাইডে হওয়ায় এদিকে মানুষের আনাগোনাও কম।এবার ভয়ে অন্তরাত্মা শুকিয়ে যায় মেহরিমার।শুকনো ঢোক গিলে।শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত পরিবেশে থেকেও দরদরিয়ে ঘামতে শুরু করে।পরক্ষণেই নিজেকে শান্ত করে এখান থেকে বাঁচার উপায় ভাবতে থাকে।লোকটা কুৎসিত হেসে বলে ওঠে,
“সুন্দরী রমনী ভয় পাচ্ছো নাকি?”
“আমার সামনে বাঘ,ভাল্লুক কিছুই তো দাঁড়িয়ে নেই।তাহলে ভয় কেনো পাবো আংকেল?সামনে থেকে সরে দাঁড়ান।আমি বাইরে যাবো।”
কথাটা বলে লোকটাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে নিলেই লোকটা মেহরিমার ডান হাত চেপে ধরে।মেহরিমা কয়েক সেকেন্ড নিজের হাতটার দিকে তাকিয়ে থাকে।তারপর হঠাৎ করে লোকটার মেইন পয়েন্টে জোরে লাথি মেরে বসে।লোকটা এমনটা একদম আশা করেনি।মেহরিমার হাত ছেড়ে দিয়ে ওখানেই বসে পড়ে।মেহরিমা এক দৌড়ে ওখান থেকে পালিয়ে যেতে নিলেই হৃদিতের সাথে ধাক্কা খায়।হৃদিত দুহাতে মেহরিমাকে আগলে নেয়।মেহরিমার র ক্ত শূ ন্য ফ্যাকাশে মুখের দিকে তাকাতেই হৃদিতের ভ্রু জোড়া কুঁচকে যায়। কপালে সুক্ষ্ম ভাঁজের সৃষ্টি হয়।একটু দূরে মধ্যবয়স্ক একটা লোককে বসে কাতরাতে দেখে ঘটনা যা বোঝার বুঝে যায় হৃদিত।এতেই যেন মাথায় আগুন উঠে যায়।হৃদিত বাইরে যেয়ে কয়েক মিনিট কথা বলার পরেই মেহরিমার কথা মনে পড়ে যায়।দ্রুত কল কেটে ওয়াশরুমের দিকে হাঁটা ধরে।ওর অ্যানাবেলা একা ভয় পাবে এই ভেবে।কিন্তু এখানে এসে এমন একটা দৃশ্য দেখবে কখনও কল্পনাও করেনি।হৃদিত হুংকার দিয়ে ওঠে,
“বা স্টা র্ড!”
লোকটা সেই হুংকারে কেঁপে ওঠে।ভয়ে আরও কুঁকড়ে যায়।হৃদিত রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে পাশের বেসিনে থাকা আয়নাটা খুলে লোকটার মাথায় মারে।সাথে সাথে লোকটা গগনবিদারী চিৎকার দিয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়ে। শুভ্র রঙা টাইলসের ফ্লোর তা জা লাল র ক্তে ভেসে যায়।ততক্ষণে রেস্টুরেন্টের সকল স্টাফ, ম্যানেজার উপস্থিত হয়েছে।মেহরিমা দৌড়ে এসে হৃদিতকে জড়িয়ে ধরে।হৃদিত মেহরিমাকে এক হাতে নিজের সাথে আগলিয়ে নেয়।উপস্থিত সবাই ঘটনা অনেকটাই আঁচ করতে পারে।কারণ লোকটার স্বভাব,চরিত্র সম্পর্কে কমবেশি সবাই জানে। রেস্টুরেন্ট ওনারের নিজের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হওয়ার দরুন কেউ কিছু বলতে পারে না।মুখবুজে সবটা সহ্য করে নেয়।ম্যানেজার এগিয়ে এসে বলে,
“অ্যানি প্রবলেম স্যার?”
হৃদিত বড় বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে শান্ত করে।মেহরিমার চোখে আর খা রা প হতে চায় না।
“চেক দ্য সিসিটিভি ফুটেজ।হোপ ইয়্যু আন্ডারস্ট্যান্ড এভরিথিং।আর পুলিশকে ইনফরম করার প্রয়োজন নেই।ওনার শা স্তি উনি পেয়ে গেছেন।বয়স্ক একটা মানুষ ওনার ট্রিটমেন্টের ব্যবস্থা করুন।ওনাকে দ্রুত সুস্থ হতে হবে।”
হৃদিতের কথামতো সিসিটিভি ফুটেজ চেক করা হয়।রেস্টুরেন্টের ওনার ততক্ষণে রেস্টুরেন্টে উপস্থিত হয়েছে।সিসিটিভি ফুটেজে সবটা দেখে সবাই খুব লজ্জিত বোধ করে।রেস্টুরেন্টের ওনার হৃদিতের কাছে বার বার ক্ষমা চেয়ে নেন। মন্ত্রীর ভাই আবার এমপির ছেলে বলে কথা!উনি সবদিকে নজর রাখবেন এরকম টা আর কখনও হবে না কথা দেন।হৃদিত গম্ভীর মুখেই কিছু কথা বলে লোকটার ট্রিটমেন্টের জন্য নিজের কার্ড থেকে রেস্টুরেন্টের ওনারের কার্ডে টাকা ট্রান্সফার করে দেয়।স্তব্ধ হয়ে যাওয়া মেহরিমাকে এক হাতে আগলিয়ে নিয়েই গাড়ির দিকে হাঁটা ধরে।লোকটাকে ততক্ষণে বাইরে আনা হয়েছে।চেয়ারে বসে তখনও ব্যথায় কাতরাচ্ছে।হৃদিত যাওয়ার আগে লোকটার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকায়।যেই দৃষ্টির ভাষা বোঝা দুঃসাধ্য।
____
মেহরিমা কম্ফোর্টার মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে।গায়ে জ্বর জ্বর ভাব।সন্ধ্যার ব্যপারটা নিয়ে কেমন একটা ট্রমার মধ্যে চলে গেছিল।হৃদিতের সাহায্যে কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে সেটা এখন অনেকটাই কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।তবুও কেন যেন ভালো লাগছেনা।অস্থির অনুভব হচ্ছে!
রেস্টুরেন্টে মেহরিমা ঠিকমতো খেতে না পারায় ওর জন্য খাবার নিয়ে রুমে আসে হৃদিত।মেহরিমাকে শুয়ে থাকতে দেখে খাবারের প্লেটটা ডিভানের উপর রেখে ধীর পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যায়।মেহরিমার মাথা থেকে কম্ফোর্টার টা সরাতেই মেহরিমা নিজের রক্তাভ চক্ষু জোড়া মেলে তাকায়।হৃদিতের সাহায্য নিয়ে আস্তে করে উঠে বসে।মেহরিমার করুণ দৃষ্টি সেকেন্ডের ব্যবধানে হৃদিতকে ভেতর থেকে নাড়িয়ে তোলে।হৃদিত নিজের চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়।দ্বিতীয়বারের মতো নিজেকে খুব অসহায় অনুভব করে।পরক্ষণেই নিজেকে স্বাভাবিক করে আদুরে কন্ঠে বলে,
“সরি অ্যানাবেলা।আমি কল অ্যাটেন্ড না করলে আজ তোর সাথে..।”
হৃদিতকে আর কোনো কথা বলতে না দিয়ে মেহরিমা নিজেই বলে,
“আপনি আছেন বলেই আমি নিরাপদ আছি।আর একটাও কথা না।যা হওয়ার হয়ে গেছে।আজ আপনার পরিবর্তন দেখে আমি খুব খুশি হয়েছি। আমার ভালোবাসার কত্তো পাওয়ার দেখেছেন? আপনাকে পরিবর্তন করেই ছেড়েছে। আপনার হিংস্রতা কমিয়ে এনেছে।”
“হুম জান।”
“আমার ক্ষুধা পেয়েছে।আজও খাইয়ে দিতে হবে কিন্তু!”
“যো হুকুম রানী সাহেবা।সামান্য প্রজা হয়ে রানীর আদেশ অমান্য করার সাধ্য আছে নাকি আমার?”
“উহু একদম নেই। তাহলে গ র্দা ন নিয়ে নেবো।”
কথাটা বলেই হেসে ওঠে মেহরিমা।এই মানুষটার সান্নিধ্যে আসলেই মনটা নিজের অজান্তেই ভালো হয়ে যায় মেহরিমার।মানুষটা কোনো যাদু টোনা জানে নাকি কে জানে!মেহরিমার হাসির দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে হৃদিত।সন্ধ্যা থেকে এই হাসিটা দেখার জন্যই ছটফট করছিল।ওই ব্লা ডি বি চ কে একদম ছাড়বে না।কলিজায় হাত দিয়েছে ওই জা নো য়া র।সবচেয়ে কঠিন মৃ ত্যু দিবে ওকে।আজ যদি অ্যানাবেলার কিছু হয়ে যেত!হৃদিত আর ভাবতে পারে না।হাতজোড়া মুঠো করে ফেলে।
#চলবে___
#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_৪০
#ইসরাত_তন্বী
❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌
সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে রেডি হয়ে বসে আছে মেহরিমা।হৃদিতকে বারবার খোঁচাচ্ছে তবুও উঠছে না।মেহরিমা দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখে সকাল পাঁচটা বেজে পঞ্চাশ মিনিট।সাড়ে ছয়টার আগে পাহাড়ে পৌঁছাতে হবে। কথাটা গতকাল রাতে হৃদিত নিজেই বলেছিল।অথচ ব্যাটা এখন কেমন কুম্ভকর্ণের মতো ঘুমাচ্ছে।মেহরিমা এবার অধৈর্য হয়ে হৃদিতের গায়ের উপর থেকে কম্ফোর্টার সরিয়ে নেয়।হৃদিত গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। হঠাৎ গায়ে ঠান্ডা অনুভব হতেই আশেপাশে হাতড়াতে থাকে।কোথাও কম্ফোর্টার না পেয়ে চোখ জোড়া মেলে তাকায়।মেহরিমার দিকে নজর পড়তেই শুকনো ঢোক গিলে।মেহরিমার রণচণ্ডী রুপ দেখতেই বুজতে পারে এখন ওর আর নিস্তার নেই।
“ওহ শিট!বেইবি আ’ম সরি।জাস্ট গিভ মি ফাইভ মিনিটস।”
কথাটা বলেই মেহরিমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ক্যাবিনেট থেকে শার্ট,প্যান্ট নিয়ে ওয়াশ রুমে দৌড় লাগায় হৃদিত।মেহরিমা না চাইতেও হেসে ওঠে।ঠিক দশ মিনিটের ব্যবধানে ফ্রেশ হয়ে বের হয় হৃদিত।এই প্রথম এতো কম সময়ে ফ্রেশ হয়েছে।লেদার জ্যাকেট,টুপি,মোজা পরিধান করেই মেহরিমাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।মেহরিমাকে গিফটের মতো করে মোড়িয়ে এনেছে একদম।শুধু চোখ দুটো দেখা যাচ্ছে।
হৃদিতের বাগানবাড়ির সবচেয়ে আকর্ষণীয় গাছ হচ্ছে কাঠ গোলাপ গাছগুলো।মেইন গেইট থেকে ঘরের সদর দরজা পর্যন্ত রাস্তার দুই পাশে লাইন দিয়ে কাঠগোলাপ গাছ গুলো বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মেহরিমা দিনের বেশিরভাগ সময় এই গাছগুলোর নিচেই কাটায়।বাড়িটার আশেপাশে গভীর জঙ্গল।জ ন্তু জা নো য়া রে র বসবাস সেথায়।তাই সেফটির জন্য উঁচু করে প্রাচীর নির্মাণ করা বাড়ির চারিপাশ ঘিরে।মেইন গেইটটাও স্ট্রং করে বানানো। বাড়ির সামনের জঙ্গল পেরিয়ে মেইন রোডে আসতে একঘন্টা বিশ মিনিট মতো সময় লাগে।ঠিক ছয়টা বেজে ত্রিশ মিনিটে পাহাড়ের পাদদেশে পৌঁছায় ওরা।উঁচু নিচু রাস্তা হওয়ার দরুন গাড়ি আস্তে চালাতে হয়েছে।নাহলে বিশ মিনিটের রাস্তা।
মেহরিমা গাড়ি থেকে নামতেই মুগ্ধ চোখে চারিপাশটা দেখতে থাকে।পৌষের হাওয়া পাহাড় জুড়ে।মুক্ত দানার মতো স্বচ্ছ শিশিরের ফোঁটা।বেশ অনেক মানুষের আগমন এখানে।কেউ কেউ প্রকৃতির মাঝে মিশে গেছে আবার কেউ কেউ ছবি তুলতে ব্যস্ত।এ যেন কবিদের বর্ণনা দেওয়া সেই সবুজের সমাহার।চোখ যতদূর যায় সবুজে আচ্ছন্ন সবটা।একটা পাহাড়ের গায়ে হেলে দাঁড়িয়ে আছে আরেকটা পাহাড়।মাকড়সার জালে কুয়াশার স্বচ্ছ ফোঁটাগুলো দেখতে একদম মুক্তোর মালার মতো দেখাচ্ছে।পাহাড়ের গা কেটে কেটে সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে।এতে পাহারপ্রেমীদের হয়রানি অনেকটাই কমে গেছে।অনায়াসেই উপরে উঠতে পারে।যদিও সকাল সকাল কুয়াশার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ফোঁটার জন্য সিঁড়ি গুলো পিচ্ছিল হয়ে আছে।হৃদিত মেহরিমাকে কোলে উঠিয়ে নেয়।মেহরিমা আঁতকে ওঠে!
“এই কী করছেন আপনি?নামান আমাকে।”
“উহু,তুই চোখ দুটো বন্ধ কর জান।সারপ্রাইজ পেতে চাস না?”
মেহরিমা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়।হৃদিত মুচকি হেসে কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়।অতঃপর সাবধানে উপরে উঠতে থাকে।আধা ঘন্টা তো লাগবেই উপরে উঠতে।পাঁচ মিনিট পেরোতেই মেহরিমা চোখজোড়া খুলে তাকায়।
“আর কতক্ষন?”
“আরেকটু।”
মেহরিমা আবার চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়। এভাবে প্রতি পাঁচ মিনিট পরপর চোখ খুলতে থাকে।হৃদিত একটুও বিরক্ত হয়না বরং মেহরিমার এক্সাইটমেন্ট দেখে মজা পায়। অবশেষে মেহরিমার অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে ওরা পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছায়।মেহরিমা চোখজোড়া বন্ধ করে আছে।হৃদিত আস্তে করে মেহরিমাকে নামিয়ে দেয়।মেহরিমার পিছনে দাঁড়িয়ে ফিসফিস করে বলে,
“চোখ খুলতে পারিস জান।”
মেহরিমা নিজের আঁখি জোড়া খুলতেই বিস্ময়ে ওর ঠোঁট দুটো দুদিকে সরে যায়।এ যেন মায়াবীপুরীর অন্যদেশ!পাখির কলকাকলিতে মুখরিত চারপাশটা।পাখির কলকাকলি আর দিগন্ত মিশ্রিত সবুজ মিলে মিশে তৈরি করেছে এক মনোরম দৃশ্য।পেঁজা তুলোর ন্যায় সাদা মেঘের ভেলা পাশেই ছুটে চলেছে নিজেদের মতো।এ যেন মেঘেদের বাড়ি!মেহরিমা হাত বাড়িয়ে ছুঁতেই অদৃশ্য হয়ে যায়।পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে।এখানকার সূর্যোদয় কুয়াশার ধূম্রজালে মড়ানো।প্রকৃতির উজাড় করা সৌন্দর্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাহাড় গুলো।তার’ই ফাঁক ফোকড় দিয়ে দেখা মিলেছে সূর্যের।মেহরিমা মন্ত্রমুগ্ধের ন্যায় সবটা দেখতে থাকে।
“আমার জীবনের বেস্ট সকাল এটা।এতো সুন্দর একটা সকাল উপভোগ করানোর জন্য ভালোবাসা আমার কুট্টুসের বাবাকে।”
“আপনাকেও ভালোবাসা মহারানী। এবার চলুন।জলদি বাসায় ফিরতে হবে। আপনার ঠান্ডা লেগে গেলে সমস্যা।”
মেহরিমাও আর না করে না।আর পাঁচ মিনিট দাঁড়িয়ে থেকে নেমে আসে। এবার মেহরিমা একাই আস্তে আস্তে হৃদিতের হাত ধরে অর্ধেক সিঁড়ি নামে।বাকি অর্ধেক সিঁড়ি কোলে চড়ে।বাসায় ফিরতেই হ্যানসেল হ্যারিকে দেখে মেহরিমা।খুশি দ্বিগুণ বেড়ে যায়।ওদের নিয়ে খুনসুটিতে মেতে ওঠে।বাগান বাড়িতে ওদের সময়গুলো স্বপ্নের মতোই কাটতে থাকে।
___
অন্ধকার ছোট্ট একটা কাঠের রুমে পড়ে আছে অ র্ধ মৃ ত এক মানব।চোখ, হাত,পা মুখ সবটাই বাঁধা। আশেপাশের জঙ্গল থেকে ভেসে আসছে জীব জ ন্তু র হিং স্র গর্জন।শোনা যাচ্ছে নিশাচর পাখিদের ডাক।অদূর থেকেই ডেকে চলেছে জঙ্গলের মানুষ খে কো প্রাণীগুলো।সেই হাড়হীম করা ডাকে মানুষটার গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যায়।ভয়ে ছটফট করতে থাকে।মুখ দিয়ে বেরিয়ে আসে গোঙানির আওয়াজ।
জঙ্গলের মাঝের অন্ধকার রাস্তা ধরে হেঁটে চলেছে হৃদিত।গায়ে হাঁটু সমান কালো কোট।মাথায় কালো হুডি তুলে দেওয়া।মুখে কালো মাস্ক।হাতে কালো গ্লাভস পরা।চাঁদের সোনালী আলোয় সর্ব কালোর মাঝে ওই নীল রঙের চোখ দুটো জলজল করছে।তারা যেন বহুদিনের ক্ষু ধা র্ত।এক হাতে হ্যানসেল আর হ্যারির রশি ধরা।অপর হাতে ছোট্ট একটা কুড়াল।হ্যানসেল আর হ্যারি ক্ষণে ক্ষণে ডেকে উঠছে।নিস্তব্ধতার মাঝে সেই ডাক খুবই ভ য়ং ক র শোনাচ্ছে।
মেহরিমা গভীর ঘুমে মগ্ন।হঠাৎ ওর ফোনটা কর্কশ শব্দে বেজে ওঠে।মেহরিমা ঘুমের মধ্যেই বালিশের পাশে হাতরায়।ফোনটা পেয়েও যায়। নাম্বার না দেখেই রিসিভ করে বসে।
“টিং, টিং, টিং হৃদিতের অ্যানাবেলা তোমার ভালোবাসার মানুষটার আসল রুপ দেখবে না?”
মধ্যরাতে হঠাৎ অপরিচিত পুরুষালি কন্ঠ শুনতেই মেহরিমার ঘুম ঘুম ভাব কেটে যায়। তড়িৎ গতিতে উঠে বসে।
“ক..কে আপনি?”
“তোমার কোনো এক শুভাকাঙ্ক্ষী হবো হয়তো।তোমার হৃদিত কোথায়? নিজের জামাইয়ের খবর একটুও রাখো না যে!মেয়ে ঘটিত কিছু করে বেড়ালেও তো টের পাবে না।”
কথাগুলো শুনে মেহরিমা হতভম্ব হয়ে যায়! তৎক্ষণাৎ উঠে রুমের লাইট জ্বালিয়ে দেয়।হৃদিত কে খুঁজতে থাকে। কিন্তু কোথাও খুঁজে পায় না। ওয়াশ রুম চেক করেও পায়না।দরজা খুলতে নিলেই বুঝতে পারে দরজা টা বাইরের থেকে লাগানো।মেহরিমা ঘাবড়ে যায়।মনের মাঝে হাজারো চিন্তা, প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দিতে থাকে।তক্ষুনি শোনা যায় অপরপ্রান্তের মানুষটার অট্টহাসির শব্দ।
“খুঁজে পাবে না তো। তোমার হৃদিত তো ওখানে নেই। তাহলে কীভাবে পাবে মেয়ে?”
“হৃদিত কোথায়?ওর সাথে কী করেছেন আপনি?”
“আহা হাইপার হয়ো না মেয়ে।হৃদিতকে পেতে চাও তো নাকি?”
“হু…হ্যাঁ। কোথায় আমার হৃদিত?”
“আমার কথামতো সবটা করলেই হৃদিতকে পেয়ে যাবে।বোনাসসহ কিছু চমকও অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।”
মেহরিমার মস্তিষ্ক এলোমেলো।হৃদিতের চিন্তায় ছটফটিয়ে ওঠে। ওনার সাথে খারাপ কিছু ঘটেনি তো!এদফায় মনে সাহস সঞ্চয় করে বলে,
“বলুন কী করতে হবে।”
“তোমার ব্যালকনিতে একটা দড়ি লাগানো আছে দেখো।ওটা বেয়ে নিচে নেমে এসো।তারপর আমার বলা রাস্তা দিয়ে এগিয়ে যাবে।”
“ওকে।”
কথাটা বলেই মেহরিমা গায়ে একটা সাদা রঙের শাল জড়িয়ে নেয়।হাতে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে ফোনটা নিয়ে অপরিচিত ব্যক্তির কথামতোই ব্যালকনি দিয়ে দড়ি বেয়ে অনেক কষ্টে নিচে নেমে আসে।কাজটা মেহরিমার জন্য মোটেও সহজ ছিল না।কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে মনে দ্বিগুণ সাহস জুগিয়ে ফোনটা লাউড স্পিকারে দিয়ে অপরিচিত ব্যক্তির কথামতো হাঁটতে থাকে।মেইন গেইটের নিকট আসতেই মেহরিমা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে! দরজাটা খোলা।চোখের সামনে সব ধোঁয়াশা।মেহরিমা যত সামনে এগোচ্ছে ততই গা ছমছম করে উঠছে। কুয়াশার চাদরে ঢাকা প্রকৃতি।অন্ধকারে আচ্ছন্ন হয়ে আছে চারিপাশ।মোমবাতির ক্ষীণ আলোয় রাস্তাটাও অস্পষ্ট দেখাচ্ছে।চাঁদের আবছা আলোয় জঙ্গলটা ভুতুড়ে রুপ ধারণ করেছে।গাছের উঁচু ডালে বসে মনের সুখে ডেকে চলেছে পেঁচা।গাছের পাতা থেকে টপ টপ করে কুয়াশা ঝরে পড়ছে।সেই শব্দে মেহরিমা কেঁপে উঠছে বারবার।হঠাৎ কাঁটা জাতীয় একটা গাছের সাথে মেহরিমার শালটা আটকে যায়।মেহরিমা জোর পূর্বক শালটা টানতেই ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দে শালটা ছিঁড়ে যায়।নিস্তব্ধ পরিবেশে সেই শব্দে মেহরিমার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। ফোনের ওপাশের ব্যাক্তি তখন নিরব।কয়েক সেকেন্ড পেরোতেই মেহরিমা আবারও অপরিচিত ব্যক্তির নির্দেশ মতো হাঁটতে শুরু করে।একসময় গহীন জঙ্গলের মিডল পয়েন্টে চলে আসে।অদূর হতেই কয়েক জোড়া চোখ জলজল করতে দেখে।ভয়ে মেহরিমার হাত,পা অবশ হয়ে আসে।বুঝতে আর বাকি নেই সামনের প্রাণীগুলো কী!পিছু ফিরে দৌড় দিতে নিলেই কিছু একটার সাথে হোঁচট খেয়ে ওখানেই মুখ থুবড়ে পড়ে যায়।দু’হাতের উপর ভর দিয়ে পড়াতে পেটে কোনো ব্যথা পায় না।নিচের ঠোঁটের একাংশ চিঁ ড়ে গলগলিয়ে র ক্ত বের হয়ে আসে।মেহরিমা প্রাণ বাঁচাতে দ্রুত উঠে ফোনটা হাতে নিয়েই ছুটতে থাকে।পেছনে বুনো শেয়াল গুলোও দৌড়াতে থাকে।হঠাৎ অন্ধকারের ডিঙিয়ে কয়েকটা তীর এসে লাগে শেয়ালগুলোর পায়ে।শেয়ালগুলো ওখানেই থেমে যায়।ব্যথায় কাতরাতে থাকে।মেহরিমা তখনও দৌড়াচ্ছে।পায়ের চটি জোড়া ততক্ষণে ছিঁড়ে কোথাও পড়ে গেছে।মেহরিমা ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে ফিরে কিছু দেখতে না পেয়েই বড় একটা গাছের নিচে লুকিয়ে বসে পড়ে।ডুকরে কান্না করে ওঠে।ডান পাশ থেকে পাতার খসখস আওয়াজ শুনতে পেতেই মেহরিমা নড়েচড়ে বসে।বুঝতে পারে এটা কোন প্রাণী চলাচলের শব্দ।মেহরিমা নিজের মুখে হাত দিয়ে শ্বাস বন্ধ করে বসে থাকে।তৎক্ষণাৎ ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসে অস্পষ্ট কন্ঠস্বর,
“নড়াচড়া কোরো না মেয়ে।ওভাবেই বসে থাকো। ওদের রাস্তায় ওরা চলে যাবে।তোমায় কিছু করবে না ঠিক আমার মতোই।”
#চলবে___