কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-৩৫+৩৬

0
71

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_৩৫
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌

তমসাচ্ছন্ন প্রকৃতি।অম্বরের নক্ষত্রেরা শীতল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ধরনীর দিকে।অম্বরে দেখা মিলেছে এক ফালি চন্দ্রের।সেই চন্দ্রের নেই নিজস্ব আলো ছড়ানোর ক্ষমতা।আছে শুধু এক বুক ব্যথা গিলে নীরবে সবটা সয়ে যাওয়ার ক্ষমতা।বাঁশের পাতার কড়মড় শব্দ শোনা যাচ্ছে।অদূরেই ডেকে চলেছে শেয়ালের দল।ভেসে আসছে দূরের কোনো গাছে বসে ডাকতে থাকা পেঁচার ডাক।পরিবেশ থমথমে।বইছে শীতের উত্তরের হিমেল ঠান্ডা ঝিরিঝিরি হাওয়া।যা ক্ষণে ক্ষণে মন প্রাণকে সতেজ করে তুলছে।

বিষ্ণু নদীর তীরে গাড়ির হুডের উপর বসে আছে হৃদিত।হাতে জ ল ন্ত সিগারেট।যা কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে বারংবার পি ষে চলেছে দু’ঠোটের মাঝে।সময় মধ্যরাত। ঘড়ির কাঁটা বারোটার ঘরে।সেই সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে আর বাড়ি মুখো হয়নি।সারাদিন এদিক সেদিক ঘুরেছে।ঘন্টাখানেক হলো নদীর পাড়ে এসে বসেছে। কঠিন মানুষটা হঠাৎ করেই কীভাবে ওতোটা নরম হয়ে গেলো সেটাই ভেবে পাচ্ছে না হৃদিত। তার উপর মেহরিমাকে হারানোর ভয় জেঁকে ধরেছে।এখন তো মেহরিমা সব সত্য জানে।যদি হৃদিতকে ছেড়ে চলে যায়!বাসায় গেলেই যদি ডিভোর্সের কথা বলে বসে!একটা আধ পাগলের সাথে সংসার করতে কেই বা চায়!সেই ভয়েই আরও বাসায় যায়নি হৃদিত।নিজের আকাশ কুসুম ভাবনার মাঝেই হৃদিতের ফোনটা ঝংকার তুলে বেজে ওঠে।নিস্তব্ধ পরিবেশে সেই শব্দ বড্ড বী ভৎ স শোনায়।হৃদিত পকেট হাতড়ে ফোনটা বের করে।ফোনের স্ক্রিনে জলজল করছে ‘অ্যানাবেলা’ নামটা।এতো দুঃখ,হতাশার মাঝেও হৃদিতের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে।কল রিসিভ করে।আর সাথে সাথেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে মেহরিমার বাজখাঁই গলা।

“এই আপনি কোথায়?রাত কতো হলো খেয়াল আছে?সকাল থেকে কতবার কল,মেসেজ দিয়েছি আমি?আমাকে মানুষ মনে হয়না?নাকি এই কয়দিনেই পুরোনো হয়ে গেলাম?তখন ওভাবে বাসা থেকে বেরিয়ে গেলেন।কোথায় আছেন,কী করছেন একটা খোঁজ খবর নেই আপনার।এভাবে চলতে থাকলে আমি কিন্তু খারাপ কিছু ঘটিয়ে ফেলবো।”

মেহরিমার কথায় হৃদিতের মুখের হাসি আরও প্রসারিত হয়। জবাবে ছোট্ট করে বলে,

“পাঁচ মিনিটের মধ্যে তোর কাছে সমর্পণ করতে আসছি অ্যানাবেলা।”

হৃদিত কল কেটে দেয়।ঝড়ের গতিতে ড্রাইভ করে একদম চার মিনিট চল্লিশ সেকেন্ডে বাড়ির ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হয়।ড্রয়িং রুমে পা রাখতেই রাগে রক্তিম হয়ে ওঠা মেহরিমার চাঁদের ন্যায় মুখখানা চক্ষুগোচর হয়।হৃদিতের বুকের মাঝে তোলপাড় করতে থাকা ঝড় কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে শান্ত হয়ে যায়।এক বুক প্রশান্তি মেলে।হৃদিত ঠোঁট টিপে হাসে।মেহরিমা সোফায় বসে আছে।মুখ দিয়ে হৃদিতের চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে চলেছে।হৃদিত ধীর পায়ে সামনে এগিয়ে যায়।ধপাস করে মেহরিমার কোলে মাথা রেখে লম্বালম্বিভাবে শুয়ে পড়ে।বাড়ির সবাই তখন নিজেদের রুমে।হঠাৎ হৃদিতের এহেন কান্ডে মেহরিমা চমকে ওঠে!পরক্ষণেই হৃদিতকে দেখতে বুকে থু থু দেয়।মুখটা গোমরা করে দৃষ্টি অন্যদিকে রেখে বসে থাকে।

“রাগ করেছিস জান?”

মেহরিমা নিরুত্তর।হৃদিত মেহরিমার ডান হাতটা নিজের পুরুষালি খসখসে হাতের মুঠোয় পুরে নেয়।গুনে গুনে দশটা চু মু দেয়।মেহরিমা তখনও নিশ্চুপ।

“আরো ভালোবাসা লাগবে জান?স্পিক আপ অ্যানাবেলা।”

মেহরিমার কোনো নড়চড় না দেখে হৃদিত হতাশ হয়।আজ অভিমানটা বোধহয় একটু বেশিই করেছে!হৃদিতের’ই বা কী করার!ও তো খেয়াল’ই করে নাই কখন কখন ওতো গুলো কল মেসেজ দিয়েছে।ফোনটা গাড়ির ব্যাক সিটে পড়ে ছিল।

“এ্যাই মেয়ে আমার লেজটা যদি তোর মতো এমন অভিমানিনী হয় তাহলে তোর খবর আছে বলে দিলাম।আমি এতো..”

হৃদিতের কথা শেষ না হতেই মেহরিমা ফিক করে হেসে ওঠে।হৃদিত সেই হাসি দেখে মুচকি হাসে।অ্যানাবেলার মুখের এই হাসিটাই হৃদিতের ভালো থাকার কারণ।

“এতক্ষণ তো কথায় বলছিলিস না।এখন আবার হাসছিস কেনো?”

“আমার ইচ্ছা।”

“সব তোর ইচ্ছা তাই না?ওয়েট আ মিনিট।”

কথাটা বলেই হৃদিত মেহরিমার ঘাড়ের পিছনে হাত দিয়ে মাথাটা একটু নামিয়ে অধরে অধর মিলিয়ে দেয়।মেহরিমা হতবাক হয়ে যায়!পরক্ষণেই মুচকি হাসে।

“বাড়িতে তিনটা বেডরুম ফাঁকা আছে।কেউ চাইলে সেখানে যেতে পারে।”

হঠাৎ আয়াশের আকস্মিক কন্ঠস্বরে মেহরিমা সিটকে দূরে চলে যায়।লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে মুখটা নামিয়ে রাখে।হৃদিত নির্বিকার সেসবে।আয়াশ বাড়ির সামনে বাগানে ছিল।নিজের কাজ ফেলে গ্রামে বসে আছে।দায়িত্ব নিজের পিএ এর উপর দিয়ে এসেছে।সেটাই ঠিকঠাক মতো হচ্ছে কী না খোঁজখবর নিচ্ছিল।সিড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে উঠতে আবারও বলে,

“ক্যারি অন।সরি টু ডিস্টার্ব।”

“তুমি রুমে যাও আগে।রাত শেষ হতে চললো। আগামীকালকেই না ডিভোর্স দিবা?”

হৃদিতের কথার মানে বুঝতেই মুচকি হাসে আয়াশ। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে হৃদিতের দিকে তাকায়।

“এখনও চান্স আছে ব্রো।সবে রাত বারোটা পঁয়তাল্লিশ।”

“তোমার মায়ের কী অবস্থা?খেয়েছে কিছু?”

হৃদিতের কথায় আয়াশের মুখে মলিন হাসি ফুটে ওঠে।মা হয়ে এতকিছু করার পরেও হৃদিত তার খোঁজ নিচ্ছে।সন্তান বুঝি এমনই হয়!আয়াশের চোখের সামনে হৃদিত আর শ্রেয়া চৌধুরীর খুনসুটির মুহূর্তগুলো ভেসে ওঠে।কতোই না সুন্দর ছিল সেইদিন গুলো!আমরা মানুষেরা এতো তাড়াতাড়ি কিভাবে পরিবর্তন হয়ে যায়!অন্যদেরকে ঠকাতে তাদের কী একটুও বুক কাঁপে না?আয়াশ বলে,

“খেয়েছে।আমি জোর করিয়ে রাতে একটুখানি খাইয়েছি।মা একদম নিশ্চুপ হয়ে গেছে।হয়তোবা নিজের ভুল বুঝতে পেরেছে।”

“উনি মা অথচ দুইটা ছেলেকেই নিজের সুখের জন্য ব লি দা ন দিয়েছেন।তোমার মা শুধরানোর মানুষ না।আরিশাকে সুযোগ দিও আরেকটা।”

“ওর আর কোনো সুযোগ নেই।যে ভালো হওয়ার সে এক সুযোগেই ভালো হয়ে যায়।তিনটা সুযোগের প্রয়োজন পড়ে না।”

কথাটা বলেই আয়াশ উপরে উঠে চলে যায়।মেহরিমা অবাক চোখে আয়াশের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।ভালোবাসার মানুষকে নিজের হাতে কিভাবে ত্যাগ করবে এই মানুষটা?আরিশার প্রতি আয়াশের গভীর ভালোবাসা মেহরিমা নিজের চোখে দেখেছে।

“ভালোবাসার মানুষকেও বুঝি ত্যাগ করা যায়?”

“হয়তোবা!”

“মনের টান থাকলে বিচ্ছেদ কিভাবে সম্ভব?”

“মনের টান হাহ্!সেটাতো দু’জনের দিক থেকেই থাকতে হয়।”

এই প্রথম আয়াশের জন্য হৃদিতের বুক ভার হয়। মানুষটা এতো ভালোবেসেও তার বিনিময়ে একটুও ভালোবাসা পেলো না।ভালোবাসা দিয়ে নাকি সবকিছু পরিবর্তন করা যায়।তাহলে আয়াশ কেনো ব্যর্থ হলো?তবে কী এই কথাটা মিথ্যা!আরিশার সাথে থাকলে আয়াশ কখনও ভালো থাকতে পারবে না।যে অন্যের কথায় বশীভূত হয়ে নিজের স্বামীর ক্ষতি করতে চায় আর যাই হোক সে কখনও একজন ভালো স্ত্রী হতে পারেনা। ভালোবাসলে একে অপরকে হারানোর ভয় থাকে হৃদয়ে।যেই ভয়টা আরিশার মধ্যে নেই।কিছু সময় ভালো থাকার জন্য হলেও ভালোবাসার মানুষকে ত্যাগ করতে হয়।প্রথমে কষ্ট হলেও একসময় সয়ে যায়।আমরা মানুষ দুঃখ কষ্ট ভুলতে না পারলেও সেগুলো সয়ে নেওয়ার ক্ষমতা আমাদের আছে।

“আমরা মানুষেরা বারবার ভুল মানুষকে কেনো ভালোবাসি?”

“এটার উত্তর আমার থেকেও তুই ভালো জানিস।এইযে যেমন তুই ভালোবেসেছিস আমাকে।এটা দুর্ভাগ্য তোর।”

“কে বলেছে আমার দুর্ভাগ্য? আমার তো বড় সৌভাগ্য। আপনার মতো করে এই পৃথিবীতে কয়জন ভালোবাসতে পারে?দুর্ভাগ্য তো সেই ভাগ্য, যেই ভাগ্যে একটা হৃদিত লেখা নেই।স্বার্থের এই দুনিয়াতে সবাই নিঃস্বার্থ ভালোবাসা পায়না।আর যারা পায় তারা ভাগ্যবতী।যেমন আমি।”

হৃদিত মুগ্ধ চোখে মেহরিমার দিকে তাকিয়ে থাকে।ও কী ভেবেছিল আর কী হচ্ছে!ওর অ্যানাবেলা সবার থেকে আলাদা।সম্পূর্ণ আলাদা।মেহরিমা মুচকি হেসে বলে,

“আমি খাবার গরম করতে যাচ্ছি।আপনি ফ্রেশ হয়ে আসুন।”

মেহরিমার কথায় হৃদিত কিছুক্ষণ থ মেরে বসে থেকে ফ্রেশ হতে চলে যায়।পনেরো মিনিটের ব্যবধানে ফ্রেশ হয়ে নিচে নামে।মেহরিমা তখন খাবার সার্ভ করে টেবিলে বসে আছে।টেবিলে দুটো প্লেট দেখতেই ভ্রু কুঁচকায় হৃদিত।

“তুই খাস নি?”

“না।”

“তোকে নিষেধ করেছিলাম…”

হৃদিতের মুখের কথা শেষ করতে না দিয়েই মেহরিমা জবাব দেয়,

“এটা আপনার ঘাড় ত্যা ড়া মো র পা নি শ মে ন্ট।এরপর থেকে এটাই হবে আপনার জন্য বেস্ট পা নি শ মে ন্ট।আর একটাও কথা না বলে জলদি খেতে বসুন।আমি জানি আপনি সারাটা দিন না খেয়ে আছেন।”

আজ আর হৃদিত তর্কাতর্কি করার সাহস পায় না। বউটা এমনিতেই রেগে আছে।বেশি বাড়াবাড়ি করলে দেখা যাচ্ছে বোম ব্লাস্ট হয়ে গেছে।তাই কথা না বাড়িয়ে চুপচাপ ভদ্র ছেলের মতো খেতে বসে পড়ে।মেহরিমা মনে মনে হেসে গড়াগড়ি খায়। অতঃপর দু’জনে একসাথে ডিনার কমপ্লিট করে।

_____

সময় রাত একটা বেজে চল্লিশ মিনিট।মেহরিমা বিছানায় শুয়ে এপাশ ওপাশ করছে।ঘুম আসছে না।মনে বড্ড অশান্তি অনুভব হচ্ছে।মাথার উপর ওতো গুলো টাকার টেনশন নিয়ে কার’ই বা ঘুম আসে?আসল সত্য আদৌও কী কারোর সামনে আসবে? মাথায় হাজারও টেনশন দৌড়ে বেড়াচ্ছে।হৃদিত মেহরিমার কোমরে হাতে রেখে নিজের কাছে টেনে নেয়।আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে।মেহরিমা হৃদিতের বুকে মাথা রাখে।

“শরীর খারাপ লাগছে জান?”

“উহু।”

“তাহলে?সকালের বিষয়টা নিয়ে টেনশড?”

“এতো গুলো টাকা আমরা কিভাবে দেবো?আমাকে,মাকে,মাধুপুকে বিক্রি করলেও তো এতগুলো টাকা হবে না।”

“হুশশ,আর একটাও বাজে কথা না।আমি আছি তো।”

“কিন্তু আমার বাবাকে যে মিথ্যা অভিযোগে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিলো। আমার বাবা নির্দোষ। আমার বাবা কখনও কারোর কোনোকিছু দেখে লোভ করেনি।আর আজ তাকে…”

মেহরিমা নিজের কথা শেষ করতে পারে না। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।হৃদিত সযত্নে মেহরিমার চোখের পানি মুছিয়ে দেয়।কপালে শিক্ত ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়।কৌশলে টপিক চেঞ্জ করে বলে,

“আমরা কালকে যাচ্ছি।”

“কোথায়?”

“ঘুরতে।”

“আমার ইচ্ছা নেই।এমন অবস্থায় কে ঘুরতে যায়?”

“কে যায় না যায় ইটস ডাজন্ট ম্যাটার।আমরা যাবো মানে যাবো।”

“এই অবস্থায় মাকে একা ফেলে গেলে মা কষ্ট পাবে।”

“উহু পাবেনা।মা নিজেই বলেছে আমাকে।কাল সকালে আমরা ও বাড়িতে যেয়ে মা আর মাধবীর সাথে দেখা করে রওনা দেবো।”

“তাহলে এদিকের কী হবে?”

“তোর জন্য সকালে একটা সারপ্রাইজ আছে।এই বিষয় নিয়ে আর একটাও কথা না।”

“থাকবো কয়দিন?”

“তোর যতদিন ইচ্ছা।”

“আপনার বাগান বাড়িতে দু’দিন থাকবো।”

“যথা আজ্ঞা মহারানী।”

“আপনার আর্টরুম দেখবো।”

“এখনই?”

“হুম।”

“এখন না জান। অনেক রাত হয়েছে ঘুমিয়ে পড়।”

“না এখন’ই।”

হৃদিতের আর কী করার!খাটের পাশে থাকা বক্সের উপর থেকে রুমের দরজার সুইচটা হাতে নিয়ে মেহরিমাকে কোলে উঠিয়ে নেয়।ব্যালকনিতে এসে মেহরিমাকে নামিয়ে দেয়।সুইচ দিয়ে দরজা ওপেন করতেই মেহরিমা ভেতরে প্রবেশ করে।মেহরিমার পিছু পিছু হৃদিত আসে।রুমের সবগুলো লাইট অন করে।আলোর তীব্রতায় মেহরিমা চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে।পরক্ষণেই‌ আস্তে আস্তে চোখজোড়া মেলে তাকায়।পুরো রুমের সৌন্দর্য দেখতেই মেহরিমার চোখজোড়া বড় বড় হয়ে যায়!রুমের এক পাশের দেওয়াল জুড়ে কাঠের তৈরি বইয়ের বড় একটা ওয়াল বুক সেলফ।যেখানে রাখা আছে হাজার হাজার বই।অপর পাশে দেওয়ালটা পুরোই কাঁচের তৈরি।যার সামনে একটা ডিভান রাখা।আরেকটা দেওয়ালে ওয়াল সেলফ তৈরি করে আর্টের ইনস্ট্রুমেন্ট রাখা।দরজার সাথে থাকা দেওয়ালে তিনটা গিটার রাখা।পুরো ঘরে এক্সট্রা বলতে জাস্ট একটা ডিভান রাখা আছে আর কিচ্ছু না।ঘরটা অত্যধিক পরিপাটি করে রাখা।ঘরের ডেকোরেশন সাধারণের মাঝেও অসাধারণ।মেহরিমা বুক ভরে শ্বাস নেয়।ঘরটার মাঝে যেন স্বস্তি মিলে।মেহরিমা কাঁচের দেওয়ালটার নিকট ধীর পায়ে এগিয়ে যায়।এখান থেকে চৌধুরী বাড়ির পিছনের পুকুর,বাগান সব স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। দিনের আলোয় হয়তো দেখাও যাবে।তবে মেহরিমার যত টুকু মনে পড়ে ও নিচে থেকে অনেকবার এদিকে তাকিয়েছে কিন্তু এই দেয়ালটা দেখা যায়নি।বাইরে প্রকৃতি অন্ধকারাচ্ছন্ন।অন্ধকার গলিয়ে ভেসে আসছে নাম না জানা কতশত পোকা মাকড়ের ডাক।মেহরিমার গা ছমছম করে ওঠে।তখনই কোমরে হৃদিতের হাতের গাঢ় স্পর্শ অনুভব করে।ঘাড়ে উষ্ণ নিঃশ্বাস পড়ছে।শুনতে পায় হৃদিতের নরম শীতল কন্ঠস্বর,

“এই পৃথিবীর সবাই আমার হিংস্র রুপটা দেখেছে।এক কঠিন হৃদিতকে দেখেছে।আমার দুঃখ, কষ্টগুলো কেউ কখনও উপলব্ধি করেনি ইভেন বোঝেও নি। আমার দুঃখ,কষ্ট গুলো বোঝার জন্য হলেও আমার হয়ে থেকে যাস।অন্যদের মতো আমারও একটা আশ্রয় প্রয়োজন।যেখানে আমি নিজের দুঃখ কষ্ট অনায়াসেই প্রকাশ করতে পারবো।হতে পারবি না আমার আশ্রয়?তুই না বলিস মানুষের আসল সৌন্দর্য তার মনে?আমার অবুঝ মনটা একটাবার পড়ার চেষ্টা করিস মায়াবতী।হিংস্রতার মাঝে রয়ে গেছে অনেক অব্যক্ত অনুভূতি।”

#চলবে__

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_৩৬ [রহস্যের খন্ডাংশ.৩]
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌

“আমার বেস্ট ফ্রেন্ড ছিল কৌশিক।তুই তো চিনিস ওরে।আমি তখন বাবার সাথে সবে রাজনীতিতে যোগ দিয়েছি।তখনই ওর সাথে পরিচয় হয় আমার।মামুন তালুকদারের একমাত্র আদরের ছেলে ছিল কৌশিক তালুকদার।বাবার সাথে বানিজ্য মন্ত্রী মামুন তালুকদারের সম্পর্ক সবসময়ই খুব ভালো ছিল।সেই সম্পর্কের জের ধরেই আমার আর কৌশিকের সম্পর্কটাও বন্ধু থেকে প্রিয় বন্ধুতে পরিণত হয়। আমাদের বন্ধুত্বের দুই বছরের মাথায় কৌশিকের লা শ পাওয়া যায় বাবার পার্টি অফিসের সামনে।তখন আমি আর কৌশিক দু’জনেই রাজনীতির মাঠে ধূর্ত খেলোয়াড়।সবে মন্ত্রীত্ব পেয়েছি আমি।ওই সময়টাতে মামুন তালুকদার আর বাবার মাঝেও কিছু একটা নিয়ে ঝামেলা চলছিল।বাবার ডান হাত আমি ছিলাম।তাই সবাই ভেবে নেয় খু ন টা আমিই করেছি।কিন্তু উপযুক্ত প্রমাণ না থাকায় কেউ কোনো পদক্ষেপ নিতে পারেনা। মামুন তালুকদার অবশ্য আমাকে ফাঁ সা নো র চেষ্টা করেছিলেন বাট পারেনি।এরপর কেটে যায় একটা বছর।হঠাৎ বর্ষার একদিনে বৃষ্টির মধ্যে আমার গাড়ি জ্যামে আটকা পড়ে।সেদিন দেখা মিলেছিল এক শুভ্র পরীর।তাকে দেখে আমার হৃদয় কিছু সময়ের জন্য থমকে ছিল।মেয়েটার অনুমতি ব্যতীত’ই সেদিন ওর পিক তুলেছিলাম।বাসায় এসে মেয়েটার সব ডিলেইলস কালেক্ট করি।জানতে পারি মামুন তালুকদারের একমাত্র মেয়ে আরিশা তালুকদার।এইসব কালো জগৎ থেকে নিজের মেয়েকে সরিয়ে রেখেছিলেন উনি।তাই আমি চিনতাম না আরিশাকে।নিজের মনে জন্ম নেওয়া এক টুকরো অনুভূতি ওই বদ্ধ ঘরের মধ্যেই মাটি চাপা দিলাম।তার ঠিক এক সপ্তাহ পরে মেয়েটা নিজে থেকেই আমার সাথে কথা বলতে আসে।আমি সেদিন অবাকের সপ্তম পর্যায়ে পৌঁছেছিলাম! তারপর নিজেদের মাঝে টুকিটাকি কথা বলা,নিয়ম করে দেখা করা শুরু হয়।একসময় নিজের অজান্তেই ভালোবেসে ফেলি আরিশাকে। নিজের অনুভূতি বোঝার জন্য আমি আরও কিছুদিন সময় নিই। দিনশেষে সেই একই ফলাফল।তাই আমি কোনো ভনিতা না করেই আরিশাকে মনের কথা জানায়।ভেতরে ভেতরে আপসেট ছিলাম প্রত্যখানের ভয়ে কিন্তু এমন কিছুই ঘটেনি। ওকে প্রোপোজাল দিয়ে জানতে পারি ও নিজেও আমাকে ভালোবাসে।ব্যস আর কীসের অপেক্ষা? বাবাকে জানায়।বাবা মামুন তালুকদারের নাম শুনে নাকচ করে দেন।আমি সবটা আরিশাকে জানাতে আরিশা আমাকে বলে,’ও সবটা ম্যানেজ করে নিবে।’ ঠিক তার পরেরদিন মামুন তালুকদারের সঙ্গে আরিশা আমাদের বাসায় আসে তাও বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। মামুন তালুকদার আর বাবার সম্পর্কটাও ঠিক হয়ে যায়।ধুমধাম করে আমাদের বিয়ে হয়।”

একাধারে কথাগুলো বলে থামে আয়াশ।সময় সকাল ছয়টা।চারি পাশ কুয়াশায় আচ্ছন্ন হয়ে অস্পষ্ট দেখা যাচ্ছে সবকিছু।ঠিক আয়াশের ভবিষ্যতের মতো।হৃদিত আর আয়াশ চৌধুরী বাড়ির ফুলের বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে আছে।শীতকালীন ফুলের সুবাসে ভরে উঠেছে বাড়ির আঙ্গিনা।দুই ভাইয়ের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয়ে আছে হাজারও ফুলের মাঝে।আয়াশের জন্য আজকের সকালটা একটু অন্যরকম।ক্ষণে ক্ষণে বুকটা অযথাই ভার হয়ে উঠছে।

“এগুলো তো জানি নতুন কিছু বলো।”

হৃদিতের কথায় আয়াশ হাসে।

“তো বিয়ে ঠিকঠাক ভাবেই হয়।বিয়ের রাতে জানতে পারি আমার ভালোবাসার মানুষটা আমাকে বিয়ে করেছে তার প্র তি শো ধ নেওয়ার জন্য।তার ভাইয়ের মৃ ত্যু র প্রতিশোধ নিতে।এতদিনের ভালোবাসাবাসি সবটাই ছিল তার অভিনয়। ওইসময় একদম ভেঙ্গে পড়েছিলাম।পরক্ষণেই নিজেকে নিজেই সামলিয়ে কৌশিকের মৃ ত্যু র রহস্য উন্মোচনের কাজে লেগে পড়ি।তিনমাস সময় নিয়ে সব সত্য জানতে পারি।সত্য জেনে আমি অবাক কম ব্যথিত হয়েছিলাম বেশি। মামুন চৌধুরী নিজের স্বার্থের জন্য নিজের ছেলেকে খু ন করিয়েছেন।যাতে আমাকে খু নি বানিয়ে আমার ক্যারিয়ার ন ষ্ট করতে পারে।কিন্তু এমন কিছুই তো হয়নি।কৌশিকের প্রাণ ছিল আরিশা।ওরা ভাই, বোন কম বন্ধু ছিল বেশি।তাই ওই জা নো য়া র নিজের মেয়েকে কাজে লাগায়।আরিশাকে মিথ্যে বলে ওর মধ্যে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে আমাকে, আমাদের চৌধুরী বংশকে ধ্বং স করতে পাঠায়।কিন্তু আফসোস ওই জা নো য়া র জানে না ভালোবাসার কাছে এইসব প্র তি শো ধ বড়ই তুচ্ছ।”

“তাহলে স্বীকার করছো?”

“কী?”

“তুমি এখনও আরিশাকে ভালোবাসো।”

“ভালোবাসা তো পাপ না।ভালোবাসা কী আর ভালো খারাপ দেখে হয়?কতই তো নিজেকে আটকাতে চেষ্টা করলাম। শেষ রক্ষা আর হলো কোথায়? বরং আগের থেকেও এখন বেশি ভালোবাসি।”

আয়াশের কথায় হৃদিতের দু’চোখের পাতায় মেহরিমার মুখটা ভেসে ওঠে।এই জন্যই বোধহয় মেহরিমা হৃদিতকে নিজের অজান্তেই এতোটা ভালোবেসে ফেলেছে।

“আরিশাকে সত্যিটা বলছো না কেনো?”

“ও বিশ্বাস করবে না।আর বিশ্বাস করলেও এত বড় সত্যি ও কখনও মেনে নিতে পারবে না। বাবা ভক্ত মেয়ে কি না!”

“সত্যিটা জানাও।আরেকটা সুযোগ দেও।এতগুলো বছর একসাথে কাটালে। ওকে ছাড়া হয়তো তুমি ভালো থাকতে পারবে না ।”

হৃদিতের কথায় আয়াশের বুক থেকে ভারী দীর্ঘশ্বাস বের হয়।ম্লান হেসে বলে,

“ভালো থাকা হাহ্!যে যেতে দেয় একমাত্র সেই জানে কতটুকু চেষ্টার পরেও একটা মানুষ হাল ছেড়ে দিয়ে তার ভালোবাসার মানুষটাকে যেতে দেয়।”

“যেতে দিচ্ছো কেনো? নিজের করে রেখে দেও।সে তো যেতে চাচ্ছে না। তুমি জোর করছো।”

“যে আমার দুঃখ কষ্টগুলো বোঝে না,সে আমারে কী বুঝবে?আর আমারে না বুঝলে সেখানে ভালোবাসা রইলো কোথায়?ভালোবাসা ছাড়া একটা সম্পর্ক বয়ে বেড়ানো মোটেও সহজ নয়। একতরফা ভালোবাসায় সব হয়না।”

আয়াশের কথায় হৃদিত সুক্ষ্ম হেসে বলে,

“বিশ্বস্ত আর বিশ্বাসঘাতক দুইটা কিন্তু খুব কাছের মানুষেরাই হয়। তোমার চোখ,কান,মুখ আরও খোলা রাখা উচিৎ মন্ত্রী সাহেব।আর হ্যাঁ আরিশা আমার ক্লাসমেট ছিল।”

হৃদিতের কথায় আয়াশের কপালে ভাঁজের সৃষ্টি হয়।তবে কী ওর জানার এখনও বাকি আছে!হৃদিত ততক্ষণে সদর দরজার দিকে হাঁটা ধরেছে।ওর কাজ শেষ।কিছুটা দূরেই আরিশা দাঁড়িয়ে আছে।সবটা শুনে বুক ফেটে কান্না আসছে।বাবা এতোটা নিচে কীভাবে নামতে পারলো?নিজের ক্যারিয়ারের জন্য ভাইয়া কে বলিদান দিয়ে দিল?মানুষের জীবন এদের কাছে কী এতোটাই তুচ্ছ!পরক্ষণেই আয়াশের বলা কথাগুলো মনে পড়ে।মানুষটাকে তিনটা বছর অযথাই কষ্ট দিলো!একটা সুন্দর জীবন নষ্ট করে দিলো! নিজেকে বড্ড অপরাধী মনে হয় আরিশার।ভাগ্যিস হৃদিত ওকে এখানে নিয়ে এসেছিল।নাহলে সত্যটা তো কখনোই জানা হতো না আরিশার।

_____

সময় দশটা। চৌধুরী বাড়ির সকলে ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হয়েছে।হৃদিত ব্যতীত সবার চোখে পানি।অ্যাডভোকেট এসেছে আয়াশ আরিশার ডিভোর্স পেপার হাতে নিয়ে।আয়াশের হাতে কলম।হাতটা থরথর করে কাঁপছে। তিনবার চেষ্টা করেও সাইন করতে পারেনি। হঠাৎ করেই কলমটা শব্দ করে টেবিলে রেখে চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়।মাথাটা সোফায় এলিয়ে দেয়।আরিশা মনে মনে খুশি হয় এই ভেবে যে আয়াশ ডিভোর্স দেবে না। সকাল সাতটার সময় যখন আয়াশের মুখ থেকে শুনেছিল আজ দশটাই ওদের ডিভোর্স হবে তখন থেকেই বুকে চাপা কষ্ট অনুভব হচ্ছে আরিশার।এই কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে ও বুঝে গেছে ওর মনের কোথাও একটু ভালোবাসার জন্ম হয়েছে আয়াশের জন্য।আর এটা সম্পূর্ণ নিজের অজান্তেই হয়েছে।তাইতো এতদিন বুঝতে পারেনি। কিন্তু শেষ সময় সেটা বুঝে আদৌও কী কিছু করার আছে!

অদূরেই দাঁড়িয়ে নিরব চোখে সবটা দেখছে হৃদিত।দেখছে ভালোবেসে ব্যর্থ হওয়া একটা ছেলের জীবন শেষ।আয়াশ নিজের লালচে চোখজোড়া খুলে তাকায়।সবাইকে অবাক করে দিয়ে সাইন করে দেয়।অতঃপর আর এক সেকেন্ডও না দাঁড়িয়ে দোতলায় উঠে চলে যায়।আরিশা অনুভূতিশূন্য চোখে আয়াশের যাওয়া দেখতে থাকে।উপস্থিত সকলের চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে।আরিশাকে সাইন করতে বলা হলে ও হাউমাউ করে কান্না করে দেয়।ডিভোর্স দিতে পারবে না।দৌড়ে উপরে চলে আসে।জোরে জোরে দরজা ধাক্কাতে থাকে।আয়াশের কোনো সাড়াশব্দ নেই।আরিশা কাঁদতে কাঁদতে বলে,

“আমাকে আরেকটা সুযোগ দেও আয়াশ।তোমাকে ভালোবাসি আমি।আমি তোমাকে ডিভোর্স দিতে পারবোনা আয়াশ। আমার হাত দিয়ে ওই সাইন হবে না।”

তৎক্ষণাৎ দরজাটা খুলে যায়। দরজায় বিধ্বস্ত অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছে আয়াশ।চোখে পানি নিয়েই মুচকি হাসে।

“তোমার মন থেকে বলা ভালোবাসি কথাটা শোনার খুব ইচ্ছা ছিল আমার।সেই ইচ্ছা আজ পূরণ হলো। আমাকে করুণা করার জন্য ধন্যবাদ।সাইন টা করে দিও। আমার ড্রাইভার তোমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে আসবে।”

“আমাদের এতো স্মৃতি তুমি ভুলে ভালো থাকতে পারবে?”

“একটা সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য কিছু খারাপ স্মৃতি থাকা প্রয়োজন।”

“এমনটা করোনা আয়াশ।আমি বাঁচতে পারবো না।”

“পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর দৃশ্য কি জানো?”

আরিশা চোখে জল নিয়েই না বোধক মাথা নাড়ায়।তা দেখে আয়াশ হাসে।মেয়েটা সত্যিই বোকা।

“চেনা মানুষের অচেনা রুপ।”

আয়াশ মুখের উপর দরজা বন্ধ করে দেয়।যেটার অর্থ বহন করে আরিশার জন্য আয়াশের জীবনের দরজাটা সারাজীবনের জন্য ঠিক এভাবেই বন্ধ। মস্তিষ্ক কথাটা উপলব্ধি করতেই ওখানেই ধপ করে বসে পড়ে আরিশা।সেকেন্ড পেরোয়,মিনিট পেরোয়, ঘন্টা পেরোয় আরিশা একইভাবে বসে থাকে।ভেতর থেকে আয়াশের কোনো সাড়াশব্দ পাওয়া যাচ্ছে না।কী করছে কে জানে! অ্যাডভোকেট ভেতরে ভেতরে বিরক্ত হলেও মুখে কিছু বলার সাহস নেই।দুই ঘন্টা পেরোতেই আরিশা অগোছালো ভাবে উঠে দাঁড়ায়।এটা ওর করা পাপের শা স্তি।আর এটা ওর প্রাপ্য।নিচে নেমে এসে কাঁপা কাঁপা হাতেই সাইন টা করে দেয়।সেকেন্ডের ব্যবধানে একটা সাইন দুটো জীবনের গন্তব্য পরিবর্তন করে দেয়।আরিশা উঠে দাঁড়ায়।আজ আর পা টা যেন চলছে না।ভেঙে আসছে বারংবার। তবুও শরীরের সাথে জোর করে সকলের নিকট যেয়ে ক্ষমা চায়।মেহরিমার কাছে যেতেই মেহরিমা বলে,

“আপনার যখন মন চাইবে তখনই চলে আসবেন আপি।এই বাড়ির দরজা সবসময় আপনার জন্য খোলা।আমরা সবসময় একটা পরিবার ছিলাম,আছি,থাকবো।কখনো আমাদের পর ভাববেন না।”

মেহরিমার কথায় আরিশা শব্দ করে কান্না করে দিয়ে জড়িয়ে ধরে। কাঁদতে কাঁদতে বলে,

“তুমি খুব ভালো মেহু।তোমার কতো ক্ষতি করতে চাইলাম আমি আর তুমি কি না আমাকে এখনও আপি ডাকছো!আল্লাহ তোমায় খুব ভালো রাখবে। আমার দোয়া সবসময় তোমার সাথে থাকবে।”

মেহরিমাকে ছেড়ে দিয়ে শ্রেয়া চৌধুরীর নিকট আসে।মলিন হেসে আস্তে করে বলে,

“নিজে হাতে আপনার দুটো ছেলের জীবন নষ্ট করার চেষ্টা করেছেন আপনি।একটার জীবন তো শেষ পর্যন্ত ন ষ্ট করেই দিলেন।মা নামের ক ল ঙ্ক আপনি।আয়াশ সত্যটা জানলে আপনাকে মা বলে কখনও পরিচয় দেবে না।তবে ভয় পাবেন না আমি কিচ্ছু বলবো না।আপনার ছেলে যথেষ্ট বুদ্ধিমান।নিজেই সব সত্য খুঁজে বের করে নিবে।”

কথাগুলো বলেই কাঁপা কাঁপা পায়ে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায় আরিশা। ড্রাইভার সাহায্য করতে চাইলে না করে দেয়।দোতলার একটা রুমের জানালা থেকে সিক্ত দুটো চোখ একদৃষ্টিতে চেয়ে থাকে আরিশার প্রস্থানের দিকে।বুকে তার তীব্র রক্তক্ষরণ হচ্ছে।আহ্ পেয়ে হারানোর যন্ত্রণা বোধহয় একেই বলে।আরিশা মেইন গেইটের সামনে এসে থামে।গাড় ঘুরিয়ে শেষ বারের মতো চৌধুরী বাড়িটাকে দেখে নেয়। দৃষ্টি যেয়ে আটকায় নির্দিষ্ট একটা ঘরের দিকে।পরিচিত দুটো চোখের সাথে দৃষ্টি মেলে যায়।বুকটা কেঁপে ওঠে!মলিন হেসে কিছুক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে থাকে।অতঃপর সোজা রাস্তা বরাবর হাঁটা ধরে।গন্তব্যস্থল অজানা।আরিশা শুধু এটুকু জানে ও আর কখনও হাওলাদার বাড়িতে ফিরবে না।

শ্রেয়া চৌধুরী পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।মস্তিষ্কে বারবার আরিশার বলা কথাগুলো পুনরাবৃত্তি হয়ে চলেছে।চোখের সামনে নিজের করা পাপ গুলো ভেসে উঠছে।কানের কাছে কিছু অস্পষ্ট আওয়াজ ভেসে আসে।আশেপাশের সবকিছু ক্রমশ অন্ধকার হতে থাকে।হঠাৎ কিছু পড়ে যাওয়ার শব্দ শুনতেই সবাই সেদিকে তাকায়।শ্রেয়া চৌধুরী ফ্লোরে পড়ে আছেন।সবাই সেদিকে ছুটে যায়।আরিফ চৌধুরী সেসবে নির্বিকার।হাঁটা ধরে বাড়ির বাইরের দিকে।দুদিনের এই জীবন এত অদ্ভুত কেনো!এত বিচ্ছেদের সুর কেন চারিদিকে?কেন মানুষ চেনা যায় না?শ্রেয়া চৌধুরী সজ্ঞানে থেকে যদি সবটা দেখত তাহলে নিশ্চয় বুঝতো সবার ক্ষতি করে কখনোই নির্দিষ্ট একজনের ভালোবাসা পাওয়া যায়না।অথচ মানুষটা সেই ভুলটাই করেছে।যেই মানুষটিকে নিজের করে পাওয়ার জন্য সবার কাছে খারাপ হলো আজ সেই মানুষটাই তার খারাপ সময়ে পাশে নেই।প্রকৃতি সবকিছু দ্বিগুণ রুপে ফিরিয়ে দিতে পছন্দ করে।হোক সেটা ভালোবাসা অথবা একাকিত্ব।

#চলবে____

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে