#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_৩৩.[সারপ্রাইজ পর্ব]
#ইসরাত_তন্বী
❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌
সময় বিকালবেলা।হৃদিত,মেহরিমাকে নিয়ে ডক্টরের কাছে এসেছে।ডক্টরের অ্যাপোয়েনমেন্ট আগে থেকেই নেওয়া ছিল।অবশ্য মেহরিমা একা না ওদের সাঙ্গপাঙ্গরাও সাথে এসেছে।মেহরিমা,মাধবী, আর তৃধা হৃদিতের গাড়িতে এসেছে।তাবান,তাইফ হৃদিতের বাইক নিয়ে এসেছে।মেহরিমা আর হৃদিত ডক্টরের কেবিনে আছে।বাকি ওরা চারজন হসপিটালের করিডোরে বসে আছে।সবাই নিজের ফোন নিয়ে ব্যস্ত।মাঝে মাঝে একটু নিজেদের মধ্যে ফুসুরফুসুর করছে।
“মাধবী তোমার অ্যাডমিশন টেস্টের প্রিপারেশন কেমন?”
তাইফের প্রশ্নে মাধবীর ফোনের স্ক্রিনে চলা হাতটা থেমে যায়।এই প্রথম তাইফের সাথে কথা বলা হবে।এতদিন দুই এক বার চোখে চোখ পড়লেও কেউ মুখ দিয়ে একটা শব্দও উচ্চারণ করেনি।
“আলহামদুলিল্লাহ ভাইয়া।”
“এক্সাম ডেইট কবে?”
“এইতো আর পনেরো দিন পরে।”
“ঢাকাতে কে কে যাবে?”
“আমি আর মা।”
“থাকবে কোথায়?”
“মামানির বোনের বাসায়।”
“বলো কি!ওখানে কেনো থাকবে? ভাইয়ার নিজের বাসা আই মিন বড় চাচ্চুর বাসা আছে তো ঢাকাতে।”
“এইসব আমি জানি না।মা জানে।”
“এই ভাইয়া তুমি যে মাধুপুর পড়াশোনার এত্তো খোঁজ নিচ্ছো তা তোমার পড়াশোনার কি খবর?হুদাই প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি তে ভর্তি হলে।ঢাকাতেও তো যাও না?তোমার আর তাবান ভাইয়ার উচিত ছিল মাঠে বসে ঘাস কাটা।”
তৃধার কথা শেষ হতেই ওর পিঠে দুম করে এক কিল বসিয়ে দেয় তাবান।তাইফ মনে মনে শান্তি পায়।এই কিল টা বসানোর জন্য এতক্ষণ ওর হাত নিশপিশ করছিল।নেহাতই এখানে মাধবী আছে নাহলে এতো ভদ্র থাকার ছেলে নাকি তাইফ হুহ্!তাবান বলে,
“শাকচুন্নী কথা কম ক।ফার্স্ট ইয়ারে আমাদের দুই ভাইয়ের রেজাল্ট থ্রি পয়েন্ট।ভাবতে পারছিস? অবশ্য তোর মতো মাথা মোটা এটা বুঝবে কিভাবে?”
“ভাইয়া খবরদার আমাকে মাথামোটা বলবে না। তোমাদের মতো ফেল্টুস না আমি।আর তোমাদের ওগুলো তো ঘুষ দেওয়া পয়েন্ট।”
ওদের কান্ড কারখানা দেখে মিটিমিটি হাসে মাধবী। হঠাৎ তাইফের চোখে চোখ পড়তেই মাধবীর হাসি বন্ধ হয়ে যায়।তাইফ মুচকি হাসে।মাধবী চোখ নামিয়ে নেয়। দু’জনের এই লুকোচুরি দেখে তৃধা,তাবান ঠোঁট টিপে হাসে।
“এই তোমলা একানে কী কচ্ছো?”
একটা বাচ্চা কন্ঠ শুনতেই সবাই সেদিকে তাকায়।দেখে ছোট্ট একটা কিউট গুলুমলু বাচ্চা ওদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে আছে।তাবান চারপাটি দাঁত বের করে হেসে বলে,
“আড্ডা দেই।তুমি দেবে?”
“মাম্মা,পাপ্পা বকা দিবে তো।আমি একানে পালিয়ে এছেতি।ইটত থিকলেট।”
বাচ্চাটার কথা বলার ধরণ দেখে সবাই হেসে ওঠে।তৃধা এগিয়ে এসে কোলে উঠিয়ে নেয়।গালে টপাস টপাস করে কয়েক টা চুমু বসিয়ে দেয়।
“উপপপপপ!তোমলা শুদু আমার গালে তুমু খাও কেনো?আমি ডিস্তার্ব হই।”
ছোট্ট একটা বাচ্চার মুখে এমন কথা শুনে সবার চোখজোড়া মার্বেলের মতো গোল গোল হয়ে যায়। তক্ষুনি সেখানে উপস্থিত হয় বাচ্চার মা,বাবা। নিজের ছেলেকে দেখে বাচ্চার মা দ্রুত এগিয়ে আসে।
“অদৃজ বাবা তুমি এখানে কী করছো?তোমাকে কত খুঁজেছি জানো?একটুর জন্য আমার প্রাণটাই বের হয়ে যাচ্ছিলো।”
“থলি মাম্মা।আল হবে না।”
কথাটা বলেই মায়ের কোলে ঝাঁপিয়ে চলে যায় অদৃজ।ঘাড়ে মাথা রাখে লক্ষী বাচ্চার মতো।
“ও আপনাদের নিশ্চয় খুব জ্বালিয়েছে।আসলে আমরা ডক্টরের কেবিনে ছিলাম।ও খেলছিল ওখানেই।আমরা ডক্টরের সাথে একটু কথা বলতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম।ও সেই সুযোগে বাইরে চলে এসেছে।আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত।”
“না ভাইয়া ও মোটেও দুষ্টুমি করেনি।খুব মিষ্টি একটা বাচ্চা।মা শা আল্লাহ।”
তাবানের কথার পরিপ্রেক্ষিতে অদৃজের বাবা,মা মুচকি হাসে।ততক্ষণে ডক্টর দেখিয়ে করিডরে হৃদিত আর মেহরিমা উপস্থিত হয়েছে। খুব পরিচিত একটা মুখ দেখতেই হৃদিত মৃদু হেসে সামনে এগিয়ে আসে।
“আরে এমপি তিহান এহসান ব্রো যে?সাথে তরু ভাবী আর অদৃজ বাবাটাও আছে দেখছি?”
হৃদিতের কথা শুনে ওর দিকে তাকায় তিহান,তরু। তিহান মুচকি হেসে বলে,
“হ্যাঁ,ডক্টরের কাছে এসেছিলাম তোমার ভাবীকে নিয়ে।তুমি এখানে যে?গ্রামে থাকো নাকি?পাশের টা কে?ওয়াইফ?”
“হুম ব্রো আপাতত গ্রামেই আছি।শি ইজ মাই ওয়াইফ মেহরিমা শেখ।আপনারা এখানে হঠাৎ?”
“বাবার ফ্রেন্ডের বাসায় এসেছিলাম।এখানে এসে তোমার ভাবী একটু অসুস্থ হয়ে পড়েছে তাই ডক্টরের কাছে আসা।”
“ব্রো আমাদের সাথে যেতে হচ্ছে কিন্তু।”
“আজ তো যাওয়া হচ্ছে না।আগামীকাল সকালে ব্যাক করতে হবে খুলনাতে।আয়াশ কেমন আছে?ও কোথায় এখন?”
“আপনার ফ্রেন্ড গ্রামেই আছে।”
“এই মিত্তি আন্তি তোমাল ছাতে যাবো আমি।নিবে আমাকে?”
অদৃজের কথায় মেহরিমা হেসে উঠে দুহাত বাড়িয়ে দেয়।অদৃজ কোলে চলে আসে।মেহরিমা অদৃজের গালে চু মু দিতে নিলেই দৃষ্টি মিলে যায় হৃদিতের দৃষ্টির সাথে।সেই দৃষ্টিতে মেহরিমার অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে।আর সাহস হয়না চু মু দেওয়ার।মেহরিমা মুখের হাসি বজায় রেখেই বলে,
“তুমিও খুব মিষ্টি একটা বাচ্চা বাবা।তোমাকে আমার সঙ্গে নিয়ে যাবো আমি।”
“আমি মোতেও বাত্তা নই মিত্তি আন্টি।”
“শুধু পাকা পাকা কথা।বাসায় ব্যাক করতে হবে বাবা।চলে আসো।”
কথা বলেই তিহান অদৃজকে নিজের কোলে নিয়ে নেয়।তরু মুখে হাসি টেনে প্রাণোচ্ছল কন্ঠে বলে,
“মেহরিমা খুলনাতে সময় সুযোগ করে একবার এসো কেমন? তুমি সত্যিই খুব মিষ্টি একটা মেয়ে। আমার বাচ্চাটা সবাই কে পছন্দ করে না।তোমাকে পছন্দ করেছে মানে ওর ভালো লেগেছে।”
“ইন শা আল্লাহ ভাবী যাবো।এখানে আর কখনও আসা হলে অবশ্যই গ্রামে যাবেন কিন্তু।”
“ইন শা আল্লাহ।হৃদিত বাসার সবাই কে নিয়ে একদিন আমাদের বাসার এসো।এই পিচ্চি বাচ্চা গুলো তোমরাও এসো আমাদের বাসায়।”
“আচ্ছা ভাবী।”
সবাই একসাথে জবাব দেয়।তরুর মুখের হাসি আরও প্রসারিত হয়।
“টেক কেয়ার হৃদিত।আই হোপ উই মিট এগেইন সুন।”
তিহান কথাটা বলেই মুচকি হেসে হৃদিতের দিকে ডান হাতটা বাড়িয়ে দেয়।হৃদিত ও মুচকি হেসে ডান হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে।দু’জনের ঠোঁটেই রহস্যময় হাসি।সকলের সাথে আরও কিছুক্ষণ টুকটাক কথা বলে তিহান,তরু চলে যায়।
“ভাইয়া এই তিহান ভাইয়ার ওয়াইফ’ই তো এসপি ছিল তাই না?”
তাবানের কথায় হৃদিত হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।তিহান,তরু চলে যেতেই মেহরিমার মুখে আঁধার নেমে আসে।তৃধা বিস্মিত হয়ে বলে,
“দেখে তো মনেই হলো না।কি মিষ্টি মিশুক একটা মেয়ে!আর ব্যবহার তো অমায়িক ভালো।”
তৃধার কথায় ওর মাথায় গাট্টা মারে তাইফ।
অতঃপর ইশারায় চুপ থাকতে বলে।তাবান মৃদু হেসে বলে,
“তৃধু তোরে একদিন তরু ভাবীর পাস্ট শোনাবনি।তখন সব শুনে বলিস ভাবী কেমন?দেখতে সাধারণ হলেও তরু ভাবী অসাধারণ একজন মানুষ।”
_____
রাতের খাওয়ার পর্ব শেষ করে নিজের রুমের ব্যলকনিতে বিষন্ন মন নিয়ে বসে আছে মেহরিমা।হৃদিত ছাদে গেছে স্মোকিং করতে।চারি পাশ ঘুটঘুটে অন্ধকারে আচ্ছন্ন।অদূরেই শেয়াল ডেকে চলেছে।রাতের ঝিরিঝিরি বাতাসের সাথে ভেসে আসছে শিউলি ফুলের মন মাতানো সুঘ্রাণ।মেহরিমা বুক ভরে শ্বাস নেয়।তবুও আজ বুকের ভারটা কমে না।
“মন খারাপ?”
মায়ের কথায় মেহরিমা ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকায়। মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বলে,
“না তো মা। এমনিতেই বসে আছি এখানে।”
“কার থেকে কথা লুকাচ্ছিস তুই?আমি তোর মা নীলাক্ষী।”
“মা এই কয়দিনেই তোমার চেহারার এই অবস্থা কেনো? ঠিকমতো শরীরের যত্ন নিচ্ছো না?”
“মানুষের মন মরে গেলে দেহের চিন্তা করে না।কথা ঘুরাচ্ছিস কেনো?”
মায়ের কথায় মেহরিমার চোখজোড়া ছলছল করে ওঠে।এই মানুষটা ছাড়া ওকে ঠিক করে কেউ বোঝে না।পৃথিবীতে মায়ের মতো কেউ হতে পারে না।মেহরিমা ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে।অবনী শেখ দু’হাতে মেয়েকে আগলে নেন।কপালে স্নেহের চুমু এঁকে দেন।
“আমার আর কোনো কিছু ভালো লাগছে না মা। জীবনের সবকিছু কেমন বিষাদে ভরে গেছে।”
“আমাদের জীবন টা খুব সীমিত।এই জীবনের প্রতিটা পর্বে ওঠা নামা থাকবে।মানুষের ভাগ্য সব সময় এক থাকে না। ভাগ্য পরিবর্তনশীল।মনে রাখবি যাদের মস্তিষ্কে রাগের পাহাড়,তাদের মস্তিষ্কেই ভালোবাসার ভান্ডার।রাগী মানুষগুলো সবসময় বেশি কেয়ারিং হয়।তোকে বাইরের কারোর কথায় কান দিতে নিষেধ করেছিলাম আমি।”
“মা আমার আশে পাশের মানুষ গুলো সবাই মুখোশধারী।আমি ওদের চিনতে অপারগ।”
“তাদের থেকে দূরে থাকবি যারা ছোট্ট করে মিথ্যা বলে তোকে ব্যবহার করে।তোকে অসম্মান করে। মানুষ চেনা খুব কঠিন আবার খুব সহজও।”
“আমি ক্লান্ত মা।কুট্টুস পাখি কী আদৌও একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন পাবে মা?ওর বাবা-মা কী ওকে একটা সুন্দর জীবন উপহার দিতে পারবে?”
“জীবন যুদ্ধে এতো তাড়াতাড়ি ক্লান্ত হয়ে পড়লে বাকি জীবন পাড়ি দিতে পারবি না।জীবন এতো সহজ না।একদিন হসপিটালে,ফুটপাতে যারা থাকে তাদের সাথে কথা বলে দেখিস।ওই হসপিটালের বেডে শুয়ে থাকা মানুষটা জানে জীবনের কী মূল্য। ফুটপাতে রাত কাটানো বাচ্চাটা জানে এই জীবন মানেই প্রতি সেকেন্ড,প্রতি মিনিট সংগ্রাম করে বেঁচে থাকা।”
“তুমি এতো কিছু জেনেও তো জীবনের কাছে হেরে গেলে মা।এই জীবন তোমায় কী দিল?”
“তোর বাবাকে দিয়েছে,তোকে দিয়েছে,মাধবীকে দিয়েছে।একটা সুন্দর পরিবার দিয়েছে।আমি পরিপূর্ণ।”
“তুমিও অন্যদের মতো মুখোশধারী মা।তোমাকে আমি আজও ঠিকভাবে না চিনতে পারলাম আর না বুঝতে পারলাম।”
অবনী শেখ মেহরিমার কথাটা শুনেও যেন শুনলো না।
“এই বাড়িতে থাকলে তোর মনটা অলওয়েজ খারাপ’ই থাকবে।হৃদিতের সাথে কোথাও কিছুদিনের জন্য ঘুরতে যা।আমি হৃদিতের সাথে কথা বলবো এটা নিয়ে।”
নিজের কথা শেষ করে কিছুক্ষণ নিস্তব্ধ থেকে ওখান থেকে চলে যান অবনী শেখ।মেহরিমা নিজের ভাবনার সাগরে ডুব দেয়।আজ সন্ধ্যায় ওরা চৌধুরী বাড়িতে ছিল এক ঘন্টার জন্য।সেখানেও মেহরিমা একটা চিরকুট পায় যেখানে লেখা ছিল।’হৃদিত মানসিক ভাবে অসুস্থ।আর ওর এই অসুস্থতা শুধু মাত্র মেহরিমাকে ঘিরে।’ মেহরিমা এগুলো বিশ্বাস করতে না চাইলেও মস্তিষ্ক বারবার ওই কথাগুলোই জপে চলেছে।আজ বিকালে হৃদিতের করা ব্যবহার মেহরিমার মোটেও ঠিক লাগেনি।ছোট্ট একটা বাচ্চাকে নিয়ে জেলাস নিশ্চয় কোনো সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ হবে না!যন্ত্রণায় মেহরিমার মাথা ফেটে যাওয়ার উপক্রম।দুহাতে চুল খামচে ধরে চুপচাপ বসে থাকে।
অবনী শেখ নিজের রুমে এসে আলগোছে দরজাটা বন্ধ করে দেন।টেবিলের নিকট এগিয়ে এসে ড্রয়ার খুলে জলিল শেখের ডায়েরি টা বের করেন।ওটা নিয়েই ফ্লোরে বসে পড়েন।ডায়েরিটা খুলে প্রথম পৃষ্ঠা উল্টাতেই চোখে পড়ে ‘আমার অবনীমালা’ লেখাটা।ডায়েরিটা বুকে জড়িয়ে ধরেই ডুকরে কেঁদে ওঠেন।সবার সামনে কঠিন সত্তায় থাকা মানুষটাও ভেতরে ভেতরে গুমরে মরছে প্রতিক্ষণ।সেই খবর কি কেউ রাখে?আমরা মানুষেরা তো একজনের বাইরের দিকটা দেখেই তাকে জাজ করি।ভেতরটা পড়ার ক্ষমতা কয় জনের থাকে আর কয়জনই বা ভেতরটা পড়তে চেষ্টা করে! অবনী শেখ কাঁদতে কাঁদতেই বিড়বিড় করে বলেন,
“এই পৃথিবী আমায় কিচ্ছু দেই নি।শুধু কেড়ে নিয়েছে।এই পৃথিবী নিষ্ঠুর।এই পৃথিবী আমায় একটুও ভালো থাকতে দেয়নি।”
_____
হৃদিত দু’আঙ্গুলের ভাঁজে জলন্ত সিগারেট নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।নাক মুখ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তে ব্যস্ত।জীবনের শেষ পরিণতির কথা কল্পনা করতেই তাচ্ছিল্যের হাসি দেয় হৃদিত।একটু ভালো থাকা তো ওর ও কাম্য ছিল।কিন্তু বিষধর সাপের মাঝে থেকে সেটা আশা করা নেহাতই বোকামি।যেখানে নিজের জন্মদাত্রী মা’ই নিজের শত্রু।সেখানে পরাজয় নিশ্চিত।তাই ভালো থাকা,সেটা তো একটুও আশা করে না হৃদিত। হঠাৎ পাশে কারোর উপস্থিতি অনুভব করতেই মুচকি হাসে হৃদিত।সামনের অন্ধকারেই দৃষ্টি রেখে বলে,
“এতো ঠান্ডায় ছাদে আসলি কেনো?”
“আপনি রুমে যাচ্ছেন না কেনো?কখন থেকে এখানেই আছেন।”
“ইন ফিউচার তো একাই থাকা লাগবে তোকে।অভ্যাস করে নে।”
হৃদিতের কথায় মেহরিমার বুক কেঁপে ওঠে।এমন কিছু ও কখনও ভুলেও ভাবতে পারে না।এই মানুষ টাকে ছাড়া বেঁচে থাকা সেটা তো মৃত্যুর সমতূল্য!
“এমন কথা আর কখনও বলবেন না। আপনাকে ছাড়া আমার একটুও চলবে না।”
“তাহলে আজ সামান্য একটা চিরকুট পড়ে নিজেকে,আমাদের কুট্টুস পাখি টাকে কষ্ট কেনো দিচ্ছিস?”
হৃদিতের কথায় মেহরিমা চমকে ওঠে!এই চিরকুটের কথা হৃদিত জানলো কিভাবে!মেহরিমার হতভম্ব ভাব দেখে হৃদিত ক্ষীণ হেসে বলে,
“চিরকুটের কথাটা হয়তোবা সত্য।হতে পারে অ্যাট লাস্ট এটাই তোকে হারানোর কারণ হয়ে দাঁড়াবে।”
“আপনি খু ন,মারামারি এগুলো ছেড়ে দেন।আমি পর্দা করবো।কেউ আমাকে দেখতে পারবে না।আর আমিও কারোর দিকে তাকাবো না।ভালোবাসায় থাকে কোমলতা।সেখানে হিংস্রতার কোনো যায়গা নেই।অথচ আপনি সেটাই করে চলেছেন।”
“চেষ্টা করবো।”
“চেষ্টা নয় আপনাকে ছাড়তে হবে।আমাদের কুট্টুস পাখির জন্য হলেও আপনাকে ছাড়তে হবে।”
হৃদিত নিজের হাতে থাকা সিগারেট টা ছুঁড়ে ফেলে দেয়। অতঃপর মেহরিমার নিকট এগিয়ে এসে ওর দু গালে হাত রেখে বলে,
“ভালোবাসি তোকে।মৃ ত্যু ব্যতীত এর চেয়ে কঠিন সত্য আমার জীবনে আর দুটো নেই।তোর বলা কথাটা আমি রাখার চেষ্টা করবো অ্যানাবেলা।আই ক্যান ডু এভ্রিথিং ফর ইয়্যু জান।”
মেহরিমা কিছুক্ষণ ছলছল চোখে হৃদিতের দিকে তাকিয়ে থাকে।অতঃপর শক্ত করে হৃদিতকে জড়িয়ে ধরে।যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে।মেহরিমার কাজে হৃদিত মুচকি হেসে নিজের সাথে আরও ঘনিষ্ঠ করে জড়িয়ে নেয়।খুব ব্যক্তিগত ভালোবাসা এঁকে দেয়।
#চলবে___
#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_৩৪
#ইসরাত_তন্বী
❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌
আজ শুক্রবার।শেখ পরিবারের সকলে খাবার টেবিলে বসে আছে।ঘড়ির কাঁটা নয়টার ঘরে। অবনী শেখ খাবার সার্ভ করছেন।
“হৃদিত তুমি কি ফ্রি আছো এখন?”
অবনী শেখের কথায় হৃদিত জানালার বাইরে থেকে দৃষ্টি সরিয়ে বলে,
“জি মা।”
“নীলাক্ষীকে নিয়ে কিছুদিন অন্য কোথাও থেকে ঘুরে আসো।ওর মাইন্ড রিফ্রেশের দরকার।”
“আচ্ছা মা। তাহলে আগামীকালই রওনা দেই?”
অবনী শেখ মুচকি হেসে মাথা নাড়ান।অবনী শেখের খাবার সার্ভ করা শেষ হতেই সকলে একসাথে খেতে শুরু করে।ওদের খাওয়ার মাঝেই ঘরের কলিং বেল বেজে ওঠে।অবনী শেখ দরজা খুলতে এগিয়ে যান।দরজা খুলতেই অপরিচিত তিন জন মধ্যবয়স্ক পুরুষের মুখ চক্ষুগোচর হয়।অবনী শেখ কোনো ভাব ভণিতা ছাড়াই ওনাদের ঘরের ভিতরে আসতে বলেন।যেনো ওনারা আসবে এটা অবনী শেখ আগে থেকেই জানতেন।ওনারা তিনজন একটু অবাক হলেও স্বাভাবিক ভাবেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেন। অপরিচিত তিনজন পুরুষকে দেখতেই মেহরিমা আর মাধবী একে অপরের দিকে চাওয়াচাওয়ি করে।হৃদিত নির্বিকার ভাবে খেতে ব্যস্ত।যেনো এখানে ও ছাড়া আর কারোর উপস্থিতি নেই।
“জি ভাই বলুন।আপনাদের অভিযোগ কী?”
লোকগুলোর মধ্যে ফর্সা করে একজন বলে,
“আপনার হাসবেন্ড কোম্পানি থেকে এক কোটি টাকা সরিয়েছে এটা কি আপনি জানেন?”
লোকটার আকস্মিক এহেন কথা ড্রয়িং রুমে ছোট খাটো একটা বজ্রপাত ফেলে।মেহরিমার মুখে থাকা খাবার গলায় আটকে যায়।হৃদিত দ্রুত যত্ন সহকারে পানি খাইয়ে দেয়।মাধবী অবিশ্বাস্য চোখে ওনাদের দিকে তাকিয়ে আছে।অবনী শেখ স্বাভাবিক ভাবেই জবাব দেন,
“এটা তো আমার হাসবেন্ড নিজেই জানতো না। তাহলে আমি কিভাবে জানবো?সো রিডিকিউলাস।”
অবনী শেখের কথায় ওনারা তিনজন থতমত খেয়ে যান।সেই লোকটা আবারও বলে,
“আপনার হাসবেন্ডের বিরুদ্ধে অভিযোগ আছে এবং প্রমাণ সহ।আমরা একসাথে বসে আপোষে এটা মিমাংসা করতে চাই।”
“আমার হাসবেন্ড কে টাকা সরাতে দেখেছেন আপনারা? উইদাউট অ্যানি স্ট্রং প্রুফ আপনারা একজনের নামে চুরির অভিযোগ কিভাবে দিতে পারেন?”
“টাকা সরাতে দেখতে কেনো হবে?আপনার হাসবেন্ডের হিসাব থেকেই এক কোটি টাকা মিসিং।তাহলে এর দায়ভার কে নেবে?কোম্পানি?নেভার।”
“আমার বাবা এমন টা কখনও করতে পারে না আংকেল। আপনাদের কোথাও ভুল হচ্ছে।”
মেহরিমার কথায় বেটে করে একজন বলে,
“প্রমাণ আছে বিধায় আমরা বলছি।তোমার বাবা একজন চোর।আর এটা তোমাদের মানতেই হবে। টাকার তো আর পা নেই।এতো গুলো টাকা না সরালে নিশ্চয় হাওয়া হয়ে যাবে না?”
লোকটার বলা ‘চোর’ কথাটা কর্ণগোচর হতেই মেহরিমার মুখমণ্ডল কঠিন রুপ ধারণ করে। অবনী শেখ আগুন দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকেন।মেহরিমা রেগে যেয়ে উঁচু স্বরে বলে,
“একদম মিথ্যা কথা বলবেন না।প্রমাণ কোথায় দেখান আগে।একজন মৃত মানুষের নামে মিথ্যা অভিযোগ দিতে আপনাদের লজ্জা করছে না?এর পেছনে কার হাত আছে বলেন?”
“এই মেয়ে আওয়াজ নিচে।চোরের মেয়ের বড় গলা।এতগুলো টাকা গি লে আবার বড় বড় কথা আসে কোথা থেকে?”
লোকটা নিজের কথা শেষ করার সাথে সাথেই নাকের উপর ভারি কিছু অনুভব করে।চোখে মুখে ঝাপসা দেখতে থাকে।নাক দিয়ে তরল র ক্ত গড়িয়ে পড়ে।হৃদিতের হাত তখনও মুষ্টি বদ্ধ করা।গর্জে উঠে বলে,
“এ্যাই চোখ আর আওয়াজ নিচে।নাহলে চোখগুলো তুলে লুডু খেলবো আমি।শি ইজ মাই ওয়াইফ।তোর সাহস কী করে হয় ওর দিকে চোখ রাঙিয়ে উঁচু গলায় কথা বলার?ইয়্যু ব্লাডি বিচ।ওর দিকে কারোর তাকানোর সাহস নেই আর তুই!”
কথাটা বলে নাকের উপর আবারও পাঞ্চ মারতে নিলে মেহরিমা হৃদিতকে আটকায়।বেচারা নাকের যন্ত্রণায় ছটফটাতে থাকে। তবুও জোর দেখিয়ে বলে,
“এই তুই কে?তোর সাহস কী…”
লোকটাকে নিজের কথা শেষ করতে না দিয়েই হৃদিত আগের থেকে দ্বিগুণ গর্জে বলে,
“গেট আউট অফ হেয়ার ইন ফাইভ সেকেন্ডস। পাঁচ সেকেন্ডের এক সেকেন্ডও বেশি দাঁড়ালে আই সোয়্যার একটাও বেঁচে ফিরতে পারবি না।”
হৃদিতের ভ য়ং ক র কন্ঠস্বরের সাথে হিং স্র মুখমণ্ডল লক্ষ্য করতেই ওনারা তিনজন ভয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যান।মেহরিমা সোফায় ধপ করে বসে পড়ে। মাধবীর চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়তে থাকে।অবনী শেখ স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।হৃদিতের এই রুপ দেখে উনি শিহরিত!হৃদিত মেহরিমার দিকে এক পলক তাকায়।কয়েকবার জোরে শ্বাস নিয়ে নিজেকে শান্ত করে।
“ব্রেকফাস্ট পুরোটা শেষ চাই।তারপর যা মন চায় করিস।বাবাই সোনাকে একটুও কষ্ট দিলে তোর অবস্থাও খারাপ হবে।”
কথাগুলো বলেই গটগট পায়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যায় হৃদিত।মেহরিমা বুঝতে পারে বড় ঝড় আসতে চলেছে।
____
চৌধুরী বাড়িতে ইতোমধ্যে সকালের নাস্তার পর্ব শেষ হয়েছে।বাড়ির পুরুষেরা ড্রয়িং রুমে বসে আছে। নিজেদের মধ্যে কিছু একটা নিয়ে আলোচনা করছে।বাড়ির মহিলারা রান্না ঘরে নিজেদের হাতের কাজ সারছে।হৃদিত হনহনিয়ে ড্রয়িং রুমে প্রবেশ করে।মুখমণ্ডল কঠিন হয়ে আছে। নীল মণির চোখজোড়া লাল হয়ে ভয়ংকর রুপ ধারণ করেছে।শানিত চোয়াল আরও তীক্ষ্ণ দেখাচ্ছে।হৃদিত হাঁটতে হাঁটতেই টেবিল থেকে ফ্লাওয়ার ভেজ উঠিয়ে নেয়।অতঃপর এগিয়ে এসে সোফায় বসা আব্রাহাম তালুকদারের মাথার উপর ভেজ দিয়ে জোরে আঘাত করে।সাথে সাথে বিকট শব্দে ভেজটা ভেঙে কয়েক টুকরো হয়ে ফ্লোরে পড়ে যায়।আব্রাহাম তালুকদারের করুণ আর্তনাদে বাড়ির সকলে ড্রয়িং রুমে উপস্থিত হয়।আরিফ চৌধুরী, আজাদ চৌধুরী,আয়াশ হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে!কি থেকে কি হয়ে গেল বুঝে উঠতে পারে না।আয়রা চৌধুরী হায় হায় করতে করতে দৌড়ে স্বামীর কাছে আসেন।পুরো মাথা র ক্তা ক্ত হয়ে গেছে।
“এই জানোয়ারকে আমি আজ মেরেই ফেলবো।ওর সাহস কি করে হয় বাবাকে মিথ্যা জালে ফাঁসানোর?আই সোয়্যার তুই যদি টাকাগুলো কোম্পানিতে জমা দিয়ে নিজের ভুল স্বীকার না করিস তাহলে তোকে আমি নিজে হাতে পু ত বো বা স্টা র্ড।”
কথাটা বলে মারার জন্য সামনে অগ্রসর হতে নিলেই আয়াশ পথ আটকায়।
“কী হয়েছে?খুলে বল?”
“তোমরা নিজেদের মধ্যে কথা পরে বইলো আগে ওনাকে ডক্টরের কাছে নিয়ে চলো। আমার কি বড় ক্ষতি হয়ে গেল আল্লাহ!”
আয়রা চৌধুরীর আহাজারি যেন শুনেও শোনে না হৃদিত।
“এখানেই থাকবে এই জা নো য়া র।যে এক পা এগোবে তার খবর আছে।আর একটা কথা সবাই কান খুলে শুনে রাখুন শেখ পরিবারের দিকে হাত বাড়ালে তার হাত আমি ভে ঙ্গে গুঁড়িয়ে দেবো।এই বাড়ির বাকি দুটো পুরুষের মতো কাপুরুষ নই আমি।ওইসব পুলিশ বা ল ছাল দেখে ভয় পাই না আমি।”
ব্যস আর কেউ ডক্টরের কাছে নিয়ে যাওয়ার সাহস পায় না। আব্রাহাম তালুকদার ব্যথায় কাতরাতে থাকে।আয়রা চৌধুরী মরা কান্না জুড়ে দেয়।আরিশা ভয়ে ভয়ে কেটে পড়তে নিলেই হৃদিত হুংকার দিয়ে ওঠে।
“এই তুই কোথায় যাচ্ছিস?সবসময় আমাদের ফলো করে,আমার বউয়ের কাছে চিরকুট দিয়ে নিজেকে খুব জ্ঞানী ভাবিস?অন্যের চামচামি আর কত করবি?নিজের ভাইয়ের মৃত্যুর মিথ্যা ইস্যু নিয়ে তোর মতো বস্তির মেয়েরাই হাসবেন্ড কে নিয়ে খেলতে পারে আমার মেহরিমা না।সবাই কে তোর মতো নোং রা মস্তিষ্কের ভাবিস নাকি?আই ওয়ার্ন ইয়্যু ফর দ্য লাস্ট টাইম।স্টে এওয়ে ফ্রম হার।এরপর থেকে কিন্তু আমার হাত চলবে,মুখ না।”
হৃদিতের কথায় আরিশা হতবাক হয়ে যায়!নিজের উদ্দেশ্যের কথা হৃদিত কিভাবে জানলো?এটা তো আয়াশ আর নিজের বাবা ছাড়া কেউ জানে না।প্রশ্নটা মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে সাথে এক বুক ভয় জন্মে।এক বছর আগে নিজের চোখে দেখা হৃদিতের সেই নৃ শং স হ ত্যা কা ণ্ড মানসপটে ভেসে ওঠে।হৃদিতের কথার মানে বুঝতে আয়াশের খুব একটা সময় লাগে না।যেটা ভেবেছিল ঠিক সেটাই ঘটিয়েছে আরিশা।আয়াশ রাগে নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সবার সামনে সজোরে থাপ্পড় মারে আরিশার গালে।বাড়ির সবাই হতভম্ব হয়ে যায়!আরিশার চোখজোড়া ছলছল করে ওঠে।গালের থেকে যেন মনে বেশি ব্যথা পেয়েছে।গালে হাত দিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে!
“এই তুই আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যা।তোর কাছে আগামীকালকেই ডিভোর্স পেপার পৌঁছে যাবে।এখান থেকে দ্রুত সর।আই সোয়্যার আমার হাত দিয়ে কিন্তু আজ খারাপ কিছু ঘটে যাবে।”
আয়াশ রাগে থরথরিয়ে কাঁপছে।হৃদিত আরিশার দিকে তাকিয়ে সবার আড়ালে বাঁকা হাসে।যেই হাসির অর্থ আরিশার ছোট্ট মস্তিষ্ক বুঝতে ব্যর্থ।তবে ওর সাথে খারাপ কিছু ঘটতে চলেছে এটা খুব করে বুঝতে পারে।আরিশা চোখে পানি নিয়ে রাগে হনহন করে নিজের রুমে চলে যায়।এতক্ষণ সবকিছু নিরব চোখে দেখলেও এবার আর চুপ থাকতে পারেন না আরিফ চৌধুরী।
“হৃদিত বাবা আমার,কী হয়েছে সবটা একটু ক্লিয়ারলি বলো?”
“আপনার বোন-জামাইয়ের থেকে সবটা ভালোভাবে শুনে নেবেন এমপি সাহেব।ওই জা নো য়া রে র হাতে জাস্ট দুইদিন সময় আছে।যদি দুইদিনে সবটা মিটমাট করে নিতে না পারে তাহলে ওর আর শান্তিতে থাকা হবে না।সারাজীবন জেলে পচিয়ে মারবো।এতো কাঁচা খেলোয়াড় হৃদিত চৌধুরী না।”
কথাগুলো বলে হৃদিত বাসা থেকে বেরিয়ে যেতে নিলেই চোখ যেয়ে পড়ে শ্রেয়া চৌধুরীর দিকে।হৃদিত এদফায় একটু নরম হয়।মায়ের দিকে তাকিয়ে মলিন হেসে বলে,
“আমি তো তোমার নিজের ছেলে মা।অন্যদের মতো তুমিও কেনো আমার ভালো থাকাটা সহ্য করতে পারছো না?পাপ করেছো তুমি আর বাবা।সেই পাপের শাস্তি আমাকে কেনো দিচ্ছো?আরিশাকে আর খারাপ বানিও না।এই পর্যন্তই থেমে যাও।নাহলে তোমার আর শেষ রক্ষা হবে না।ছোট্ট বেলায় আমাকে আমার এক ফ্রেন্ড বলেছিল ‘নো পাওয়ার ইজ গ্রেটার দ্যান আ মাদার প্রেয়ার।’ আমি কী এতোটাই অভাগা মা?যে তোমার দোয়াটাও আমার ভাগ্যে নেই।মেহরিমা,অবনী মায়ের তো কোনো দোষ নেই।সব দোষ তোমাদের।অবনী মা তো নিজের সব হারিয়েছে আর কী কেড়ে নিতে চাও ওনার থেকে?তোমার ছেলে বাইনোপোলার ডিসঅর্ডারে অ্যাফেক্টেড।আর তুমি কি না তোমার ছেলের অসুস্থতা নিয়ে তার সংসার ভাঙতে চাচ্ছো?মা তো কখনও এতোটা নির্দয় হতে পারে না!একজন সন্তানের কাছে শেষ আশ্রয়স্থল তার প্যারেন্টস।তাহলে আমার তো আর কোনো শেষ আশ্রয়স্থল রইল না মা।তুমি মানুষটা আমার কাছে এতোটা অপরিচিত হয়ে গেলে কেনো মা?তুমিও অন্যদের মতো আমায় বুঝলে না।তাহলে আমায় বুঝবে টা কে?আমি কি এতোটাই কঠিন মানুষ মা?কেউ আমায় কেনো বোঝে না? দিনশেষে আমিও একজন মানুষ মা।আমি বাবা হতে চলেছি মা।আমি একজন ভালো বাবা হতে চাই।একটা সুন্দর জীবন চাই।আমাকে একটু শান্তি দেও মা।নিজের নোং রা খেলা বন্ধ করো।আমার মেহরিমার কিছু হয়ে গেলে আই সোয়্যার তোমাদের সবকিছু আমি জ্বালিয়ে ধ্বং স করে দেবো।মেহরিমা ছাড়া আমার কোনো পিছুটান নেই।ভাগ্যের কঠিন কাঠগড়ায় আমাকে দাড় করিও না।তোমার’ই ছেলে আমি।”
শীতল ভঙ্গুর কন্ঠস্বর হৃদিতের।শেষ কবে মায়ের সাথে এভাবে কথা বলেছিল হৃদিতের ঠিক মনে পড়ে না।সম্পর্কে ফাটল ধরেছে সে তো অনেক গুলো বছর হলো।পরিচর্যা ছাড়া সেই ফাটল প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।পরিচর্যা ছাড়া একটা গাছ ও ধীরে ধীরে মৃ ত্যু র দিকে ঢলে পড়ে।আর সেখানে এটা তো একটা সম্পর্ক!হৃদিত বাবার দিকে এক নজর তাকায়।বাবার ব্যথিত দৃষ্টির সাথে দৃষ্টি মিলে যায়।হৃদিত আর কিছু না বলে সদর দরজার দিকে তাকাতেই মেহরিমার মলিন মুখখানা দেখতে পায়।মেহরিমার পাশেই মাধবী দাঁড়িয়ে আছে।হৃদিত হতাশার শ্বাস ফেলে।মেহরিমার মুখের দিকে কিছুক্ষণ একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে এলোমেলো পায়ে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।ছেলের এক বুক আর্তনাদ মেশানো কথাগুলোতে শ্রেয়া চৌধুরীর বুকটা ভার হয়ে ওঠে।ধীর পায়ে হেঁটে নিজের রুমে চলে যান।কয়েক মিনিটের ব্যবধানে পুরো বাড়িটা অগোছালো হয়ে যায়।চৌধুরী বাড়ির একটা সদস্যও আজ পর্যন্ত হৃদিতকে এতোটা নরম হতে দেখেনি।তবে কী ছেলেটা ভেতর থেকে একদম ভে ঙে চু র মা র হয়ে গেছে!নিজেদের মস্তিষ্ক সচল করতে কয়েক মিনিট সময় লেগে যায় সকলের।আর সময় নষ্ট না করে আয়রা চৌধুরী এবং আজাদ চৌধুরী দু’জনে মিলে দ্রুত আব্রাহাম তালুকদারকে হসপিটালের উদ্দেশ্যে নিয়ে চলে যায়।সাথে অবশ্য অলিভিয়া,অ্যামেলিয়াও যায়।আরিফ চৌধুরী শান্ত চোখে সবটা শুধু দেখতেই থাকেন।নিজের করা একটা ভুলের জন্য আজ সবশেষ।এই জন্যই হয়তোবা মানুষ বলে, ‘ভুল মানুষকে বিশ্বাস করলে আজীবন পস্তাতে হয়।’ এখন সেটা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছেন আরিফ চৌধুরী।
#চলবে