#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_৩১. [রহস্যের খন্ডাংশ.২]
#ইসরাত_তন্বী
❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌
মাঝে কেটে গেছে দুটো দিন।শেখ বাড়ির পরিবেশ এখন অনেকটাই স্বাভাবিক।আত্মীয়-স্বজন সবাই নিজের নীড়ে ফিরে গেছে।ভেঙে গুঁড়িয়ে যাওয়া অবনী শেখ হঠাৎ করেই আগের রুপে ফিরে এসেছেন।গ্রামের মানুষ এটা নিয়েও কম কানাঘুষা করেনি।এমনকি এখনও করে চলেছে।অবনী শেখের সেদিকে কোনো খেয়াল নেই।দুটো সন্তান বুকে নিয়ে তিনি তার নিজের জগতে আছেন।মেয়ে দুটো তার একদম নিশ্চুপ হয়ে গেছে সেই নিয়ে তার চিন্তার শেষ নেই।
আজ সকাল থেকেই গুঁড়ি গুঁড়ি বর্ষণ শুরু হয়েছে।সাথে মৃদু বাতাস বইছে।দুপুরের দিকে অম্বরে সূর্যের দেখা মিললেও বিকাল থেকে আগের মতোই বর্ষণ নেমেছে ধরনীর বুকে।এখন সন্ধ্যাবেলা।মেহরিমা মাগরিবের নামাজ আদায় করে বিছানায় শুয়ে আছে।শরীর টা আজ একটু বেশিই খারাপ লাগছে।গত পরশুদিন ডাক্তার কনফার্ম করেছেন মেহরিমা কনসিভ করেছে থ্রি উইক।এজন্য অবশ্য মেহরিমার এক্সট্রা কেয়ার নেওয়া হচ্ছে।এই কয়দিনে হৃদিত মেহরিমার পাশে থেকে একটুও নড়েনি।কুট্টুস পাখির আগমনের খুশিটা ঠিকমতো কেউই উপভোগ করতে পারেনি।হৃদিত একটা ট্রে তে বেদানার জুস আর ফল কেটে নিয়ে আসে।মেহরিমাকে শুয়ে থাকতে দেখে খাটের নিকট এগিয়ে আসে।আলতো করে কপালে হাত রাখতেই মেহরিমা চোখজোড়া খুলে তাকায়।দৃষ্টি উদাসীন।মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে আছে।মেহরিমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে হৃদিত।
“শরীর খারাপ লাগছে জান?”
“উহু।”
“তাহলে?”
“ভালো লাগছে না।”
“সব ঠিক হয়ে যাবে অ্যানাবেলা।শুধু সময়ের অপেক্ষা।একটু কষ্ট করে উঠে এগুলো খেয়ে নে।”
মেহরিমা জানে ও না বললেও হৃদিত ওকে খাইয়েই ছাড়বে।তাই কোনো তাল বাহানা না করে উঠে বসে।হৃদিত যত্ন সহকারে ওকে খাইয়ে দিতে থাকে।মেহরিমা খেতে খেতেই বলে,
“ভালোবাসেন আমায়?”
“প্রমাণ লাগবে?”
“চাইলে দিবেন?”
“প্রাণ টা চাইলেও হাসতে হাসতে দিয়ে দেবো।”
“আপনার প্রাণ চাইলে আমি আর কুট্টুস পাখি কাকে নিয়ে থাকবো?ছোট্ট একটা প্রমাণ চাই। দিবেন তো?”
“হুম।”
“বাবা মায়ের সাথে আর কখনও খারাপ ব্যবহার করিয়েন না কেমন?”
হৃদিত কিছুক্ষণের জন্য চুপ হয়ে যায়।পরক্ষণেই কিছু একটা ভেবে মৃদু হেসে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।মেহরিমা সন্তুষ্ট হয়।বাবা-মা যে কতটা মধুর জিনিস এখন খুব করে বুঝতে পারছে মেহরিমা।বাবা-মা ছাড়া জীবন টা বড়ই বেরঙিন।
______
সময় রাত এগারোটা টা বেজে পনেরো মিনিট।অবনী শেখ দুই মেয়েকে দুহাতে জড়িয়ে ব্যলকনিতে বসে আছেন।আকাশে মেঘ গর্জন করে চলেছে।মেহরিমা চোখ জোড়া বন্ধ করে রেখেছে।মাধবীর দৃষ্টি বাইরে।মেহরিমা চোখজোড়া বুজেই বলে,
“মা আমাদের সাথে এমনটা কেন হলো?”
“আল্লাহ উত্তম পরিকল্পনাকারী।”
“বাবার জন্য খুব কষ্ট হচ্ছে।বাবারও নিশ্চয় ওখানে একা থাকতে কষ্ট হচ্ছে।”
“ওটাই আমাদের আসল আর শেষ ঠিকানা। ওখানে সবাইকেই যেতে হবে।”
মায়ের কথায় মেহরিমা গভীর ভাবনায় মগ্ন হয়ে যায়।মাধবী নিরবে সবটা শুনতে থাকে। কথা বলতে ইচ্ছে করছেনা।
“আজ তোদের আমার আর আপার জীবনের গল্পগুলো শোনাবো।এই সমাজের কাছে হেরে যাওয়া অসহায় এক মেয়ের গল্প শুনবি তোরা?”
“বলো মা।”
মেহরিমার কথায় মলিন হেসে অবনী শেখ বলতে শুরু করেন।
“আমি আর হৃদিতের ফুপি আয়রা চৌধুরী ছিলাম বেস্ট ফ্রেন্ড। তোদের বাবা বলেছিল না একবার ওর মাথা ফাটিয়ে দিয়েছিলাম আমি।তারপর হঠাৎ একদিন ও আমার সাথে কথা বলতে আসে।সেদিন থেকেই ওর সাথে আমার ভাব জমে যাই।আয়রার সাথে মাঝে মাঝেই চৌধুরী বাড়িতে যাওয়া হতো আমার।আমার সাথে একদিন আপাও চৌধুরী বাড়িতে যান।তার একমাস পরে তোদের নানুর কাছে আপার হাত চায় আয়রার বাবা হান্নান চৌধুরী ওনার তৃতীয় পুত্র আয়মান চৌধুরীর জন্য। আপাকে দেখে আয়মান চৌধুরীর নাকি খুব পছন্দ হয়েছে।কখন কিভাবে আপাকে দেখেছিল আপা নিজেও জানতো না।আমার আপা ছিল চোখ ধাঁধানো সুন্দরী।তোদের নানু তো এক পায়ে খাড়া আপাকে বিয়ে দেওয়ার জন্য।প্রস্তাবে রাজি হয়ে যায়।বাড়ির সবাই তোদের নানুর সিদ্ধান্তের পক্ষে থাকলেও বিপক্ষে ছিল শুধু তোদের বাবা।তোদের বাবার সাথে যোগ দিয়ে তোদের দাদাও ঘাড় ত্যাড়ামো শুরু করে।কিন্তু বাবা সবার কথা অগ্রাহ্য করে ধুমধাম করে বিয়ে দেয় আপার।চৌধুরী বাড়ির বাকি তিন ছেলের তখনও বিয়ে হয়নি।বড় দুটো ভাই রেখে আয়মান চৌধুরী আগে বিয়ে করেন।আয়মান চৌধুরী দেখতে সুদর্শন ছিলেন অনেকটা হৃদিতের মতো।গ্রামের সকলের মুখে মুখে তখন এক কথা,’অতশীর রুপের মতো ওর ভাগ্যটাও সুন্দর।তাইতো এমন রাজপুত্রের মতো জামাই পেয়েছে।’ কিন্তু কে জানত ওই সুন্দর ভাগ্যের আড়ালে লুকিয়ে ছিল এক নির্মম পরিহাস!বিয়ের এক বছর পরেই আমরা সবাই জানতে পারি আয়মান চৌধুরীর দ্বিতীয় ওয়াইফ আপা।ওনার বউ বাচ্চা সব আছে।শহরে একটা বিয়ে করে বউ পালছেন।এটা উনি ছাড়া কেউ জানতো না।গ্রামে এসে আপাকে দেখে পছন্দ হয়ে যাওয়ায় বিয়ে করে ফেলেছেন।আপা ছিল নরম মনের মানুষ।সবটা জেনে খুব ভে ঙে পড়ে তখন।হান্নান চৌধুরী নিজের ছেলের কর্মে লজ্জিত হয়ে বারবার ক্ষমা চান আপার কাছে।সবাই মিলে আপাকে বোঝানো হয় তখন।আয়মান চৌধুরীও ক্ষমা চান আপার কাছে।কথা দেন আপাকে কখনও অবহেলা করবেন না।আপাকে তার ন্যায্য অধিকার দেবে।আপাকে শহরে নিয়ে যায় নিজের সাথে।অল্পতেই খুশি হওয়া মেয়েটা সবটা মেনে নিয়ে নিজের সংসারে মনোযোগ দেয়।তারপর সব ঠিকঠাক।তার ছয়মাস পরে হঠাৎ একদিন জানা যায় আয়মান চৌধুরী ড্রা গ অ্যাডিক্টেড।এটা তোদের বাবা জানতো বলেই বিয়েতে ঘাড় বেঁকিয়ে বসেছিল।তোদের নানুকে সবটা জানিয়েছিল।কিন্তু বিশ্বাস করেনি।আপাকে শহরে নিয়ে যেয়ে রিতিমত মারধর করতো ওই জা নো য়া র।আমার নরম আপা ছয়টা মাস দিনের পর দিন সব মুখ বুঁজে সহ্য করে গেছে। নিজের ছেলের এই অধঃপতনে ছেলেকে ত্যাজ্যপুত্র করেন হান্নান চৌধুরী।নিজে দায়িত্ব নিয়ে ঠিকভাবে আপাকে আমাদের বাসায় দিয়ে যান।আপা তখন তিন মাসের গর্ভবতী।নিজের ছেলের সব কীর্তি ধামাচাপা দেওয়ার জন্য গ্রামে ছড়িয়ে দেন আপা গর্ভবতী বলে এখানেই থাকবেন।ওনার ছেলের কাজের ব্যস্ততা অনেক তাই মাঝে মাঝে গ্রামে এসে দেখে যাবেন আপাকে।গ্রামের মানুষ তখন ভেতরের খবর কিছুই জানতো না।সহজেই সবটা বিশ্বাস করে নেয়।আপার শরীরে তখনও মারের দাগ স্পষ্ট।আপা পর্দা করতো বিধায় সেগুলো কখনো কারোর চোখে পড়েনি।”
একাধারে কথাগুলো বলে অবনী শেখ থামেন।মেহরিমা,মাধবী মায়ের মুখের দিকে উচ্ছুক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।অবনী শেখ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও বলা শুরু করেন।
“মাঝে কেটেছে চার মাস।আপা তখন সাত মাসের গর্ভবতী।আয়মান চৌধুরী একদিনের জন্যও আপার খোঁজ নেয় নি।গ্রামে শুরু হয় আপাকে নিয়ে নানা ধরনের কানাঘুষা।একসময় দেখা যায় আপাকে দেখলেই সবাই মুখ কালো করে ফেলতো। ঠিকমতো কথা বলতো না।সবার ধারণা আপার চরিত্রের সমস্যা।বাচ্চা টা অন্যজনের বলে আয়মান চৌধুরী আপার খোঁজ খবর নেয় না।আপা নিজেও সবটা বুঝতে পেরে নিজেকে ঘরবন্দি করে নেয়।আমি মা জোর করেও ঠিক মতো আপাকে খাওয়াতে পারতাম না।আমি আপার বিষয় নিয়ে বাবার সাথে কথা বলি।বাবা সেদিন কঠিন এক সত্য জানায় আমাকে।আপা নাকি বাবার নিজের মেয়ে না।শহরে ব্যবসার কাজ শেষ করে রাতে বাড়ি ফেরার পথে গ্রামের মাঠের মধ্যে আপাকে পেয়েছিল বাবা।এই কথা শুনে আমার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যায়।বাবা সাথে এটাও জানান আপাকে নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। এভাবেই চলছে চলুক।স্বামী ছাড়া মেয়েদের জীবনের কোনো দাম নেই।তাই উনি ডিভোর্সের পক্ষে না।সেদিন বাবার উপর চাপা অভিমান জন্মে আমার।সবথেকে কষ্ট পেয়েছিলাম তখন,যখন দেখেছিলাম আমার আপা দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছলছল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন।সেই দৃষ্টিতে কি নিদারুণ যন্ত্রণা!তারপর থেকে আমার আপা আরো চুপ হয়ে যায়।একদিন হঠাৎ করেই আপা হারিয়ে যান।কোথায় চলে যান আমরা কেউ জানি না।কোথাও খুঁজে পাই না আপাকে।আপা আর কখনও ফিরে আসেনি।আপা আমাকে একটা চিঠি লিখে যান।আপা আমাকে ভালোবেসে শিউলিফুল ডাকতো।আমাকে নাকি আপার কাছে শিউলি ফুলের মতো লাগতো।আমি নাকি শিউলি ফুলের মতো সুবাস ছড়ায় সবখানে।”
কথাগুলো বলে অবনী শেখ এলোমেলো ভাবে উঠে দাঁড়ান।ঘরের মধ্যে যেয়ে পুরনো একটা কাগজ নিয়ে ফিরে আসেন।মেয়েদের মাঝে কিছুক্ষণ থ মেরে বসে থাকেন।অতঃপর ধীরে ধীরে কাগজটা পড়ে শোনাতে শুরু করেন।
প্রিয় শিউলি ফুল,
প্রাণের চেয়ে প্রিয় বোন আমার।এই পৃথিবীতে আমাকে নিয়ে ভাবার মতো একমাত্র তুই আছিস।তাই তোকেই আমার মনের কিছু কথা বলতে চাই। নাহলে হয়তো আর কোনোদিন বলা হবে না।মনের অতৃপ্তি নিয়েই হারিয়ে যেতে হবে আমাকে।জানিস শিউলিফুল আজ একটা জিনিস খুব করে অনুভব করলাম।মানুষের চেহারা সুন্দর হওয়ার চেয়ে ভাগ্য টা সুন্দর হওয়া খুব বেশি প্রয়োজন।এ কেমন ভাগ্য আমার!না পেলাম স্বামী সোহাগ আর না পেলাম বাবার ভালোবাসা।ওইদিন বাবার সামনে না পড়ে কোনো প্রাণীর সামনে পড়লেও তো পারতাম।আমাকে ছিঁড়ে ছুড়ে খেয়ে ফেলতো।তবুও এমন জাহান্নামের মতো জীবন তো পেতে হতো না।বাবার কোন দোষ নেই।দোষ আমার জন্মদাতা বাবা,মায়ের।সন্তান পালতে না পারলে নিয়েছিল কেনো? আচ্ছা শিউলিফুল আমি কারোর জা র জ সন্তান না তো?আল্লাহ!জানিস এটা ভাবতেই আমার বুক কাঁপছে,নিজের প্রতি ঘৃণা লাগছে।বাবা,মায়ের কাছে আমি চির কৃতজ্ঞ আমাকে ছোট থেকে আগলে বড় করার জন্য।পড়াশোনা করার সুযোগ দেওয়ার জন্য।তোর কাছে আমি চিরঋণী থাকবো।তোর মতো করে আমায় কেউ কখনো বুঝেনি শিউলিফুল।আল্লাহ যেন তোর মতো বোন সবাইকে দেয়।আর ছোটাছুটি করিস না লক্ষ্মী বোন আমার। যাকে তিন কবুল পড়ে বিয়ে করেছি তাকে ডিভোর্স দিতে পারবো না আমি।এতো কঠিন মন যে আমার না!তবে হ্যাঁ এই পৃথিবীর বুক থেকে নিজেকে হারানোর আগে তাকে তার পাপের শাস্তি দিয়ে যাবো আমি।ওকে আমি শেষ বারের মতো বলেছিলাম,’জীবন তো খুব একটা বড় না।ছোট্ট একটা জীবন। কাটিয়ে দেওনা আমার সাথে।এতে কি খুব ক্ষতি হয়ে যাবে তোমার?’ওর উত্তর কি ছিল জানিস? বলেছিল,’তুমি আমার ক্ষণিকের মোহ ছিলে ভালোবাসা না।’ আচ্ছা ভালোবাসা কি খুব কঠিন জিনিস?আমি তো না চাইতেও ওকে ভালোবেসে ফেলেছি। তাহলে ও কেন আমায় ভালোবাসতে পারলো না?ও চাইলে তো আমাদেরও সুন্দর একটা জীবন হতো।সুন্দর একটা সংসার হতো।কিন্তু ও তো চাইনি তাই কিছুই হয়নি।শিউলিফুল সবসময় মনে রাখবি,’প্রতিবাদ না করলেই অপবাদ বাড়বে।চুপ থাকা ভালো কিন্তু সবসময় না।’ আজ আমি চুপ আছি বলে সবাই আমার গর্ভের নিষ্পাপ বাচ্চাকে জা র জ বলতেও দু’বার ভাবছে না। তাহলে আমার বাচ্চাটা পৃথিবীতে আসলে ওর কি হবে ভাবতে পারছিস? আমার শিউলিফুল তোর জন্য মন ঢালা দোয়া ও ভালোবাসা রইল।আল্লাহ যেন তোর জীবনে সত্যিকারের একজন রাজপুত্রকে পাঠায়।যে তোকে নিজের সবটা দিয়ে আগলে রাখবে।আমার মতো ভাগ্য যেন তোর না হয়।তোর মতো ফুলেরা বাগানে মানায়।আর আমার মতো ফুলেরা আঁস্তাকুড়ে।
ইতি,
বড় আপা।
চিঠি খানা পড়া শেষ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন অবনী শেখ।মেহরিমা মাধবীর চোখে পানি।এ কেমন ভাগ্য একটা মেয়ের!
“আপা হারিয়ে যাওয়ার তিন দিনের মাথায় আয়মান চৌধুরীর মৃত দেহ পাওয়া যায় ওনার নিজের বাড়িতেই।ওনার ওয়াইফ ওইদিন বাবার বাসায় ছিলেন।আয়মান চৌধুরীর লা শ গ্রামে এনে দাফনের কাজ সম্পন্ন করা হয়।দাফনের দিনে ওনার ওয়াইফও এসেছিলেন গ্রামে।আয়মান চৌধুরী মারা যাওয়ার দুই’দিন পর আপার লাশ পাওয়া যায় এই বিষ্ণু নদীতে।আমার আপা সাঁতার জানতো না।”
অবনী শেখ এবার ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠেন।সময় নিয়ে নিজেকে সামলিয়ে কয়েক বার টানা নিঃশ্বাস ফেলেন।মা’কে এই দিয়ে দুইবার এভাবে কাঁদতে দেখে মেহরিমা,মাধবী।খালামনিকে মা কতোটা ভালোবাসে সহজেই বুঝে যায়।খালামনিকে নিজের চোখে না দেখলেও বুকে তীব্র যন্ত্রণা অনুভব হয় দু’জনের।
“আপার মৃত্যুতে গ্রামের সবাই কমবেশি শোকাহত হয়।হান্নান শেখ নিজেই নিজের ছেলে কৃতকর্ম প্রকাশ করে প্রকাশ্যে সবার নিকট ক্ষমা চান। আপাকে নির্দোষ প্রমাণ করেন।কিন্তু তাতে কি আমার আপাকে আমি ফিরে পেয়েছি?পাইনি তো।এটা আগে করলে হয়তো আমার আপা বেঁচে থাকতো।বাবার উপর চাপা অভিমান নিয়ে আমি একাই আপার ডিভোর্স পেপার রেডি করার জন্য ছোটাছুটি করতে থাকি সেই সময়।তখন আমাকে সাহায্য করেছিলেন চৌধুরী বাড়ির বড় ছেলে আরিফ হাসান চৌধুরী।বয়সের ব্যবধান থাকলেও আমরা দু’জন বেশ ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছিলাম। দু’জনেই আদরের ভাই বোন হারিয়ে ভেঙে পড়েছিলাম।আয়মান কে অন্যদের তুলনায় একটু বেশিই ভালো বাসতেন আরিফ চৌধুরী।এতকিছুর পরেও আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের সম্পর্ক অটুট ছিল।ঢাবিতে পরিক্ষা দিতে যেতে আমাদের আরিফ চৌধুরীই সাহায্য করেছিলেন।ওনার বর্তমান ওয়াইফ শ্রেয়া চৌধুরীর মেসে থেকে আমি পরিক্ষা দিয়েছিলাম।বাবা ছিলেন আরিফ চৌধুরীর মেসে।তারপর এভাবে আরও সাত আট মাস কেটে যায়। হঠাৎ একদিন আরিফ চৌধুরী নিজে প্রস্তাব রাখেন বাবার কাছে। আমাকে নাকি বিয়ে করতে চান।বাবা আমার মতামত জানতে চাইলে আমি হ্যাঁ বলে দিই। আপার সাথে এতকিছু ঘটার পরেও কেনো যেন আরিফ চৌধুরীকে আমি ঘৃণা করতে পারতাম না।আমার মনে হতো হাতের পাঁচটা আঙুল তো সমান হয় না। উনি বন্ধু হিসেবে যেমন অমায়িক,হাসবেন্ড হিসেবেও নিশ্চয় তেমনই হবেন।বিয়ের দিন,তারিখ ঠিক হয়ে যায়। নির্দিষ্ট দিনে আমিও আর পাঁচটা মেয়ের মত একটা সুন্দর সংসারের আশায় বউ সাজি।কিন্তু বিয়ের দিন আরিফ চৌধুরী কোথায় যেন চলে যান।আমার স্বপ্ন আর পূরণ হয়না।গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে অবনীর চরিত্রে সমস্যা।তাই ওকে বিয়ে করার ভয়ে বর পালিয়েছে।আমার মতো চ রি ত্র হী ন মেয়েকে নাকি কেউ কখনও বিয়েই করবে না।অথচ ওনারা জানতো না আমি ছিলাম কারোর স্বপ্নের শখের নারী।ওই অবস্থায় আমি একদম ভেঙে পড়ি।আমার বারবার মনে হতে থাকে বোধহয় আপার মতোই কিছু হতে চলেছে আমার সাথেও!আমার বিয়ে পাকাপোক্ত হওয়ার দিনই তোদের দাদা তোদের বাবাকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন।তখন চিঠি যেতে সপ্তাহ খানেক সময় তো লাগতোই। তোদের বাবা আমার বিয়ের খবর পেয়ে ছুটে আসেন।আমাকে বিয়ে করে ক ল ঙ্কে র হাত থেকে রক্ষা করেন।তিনমাস পর আরিফ চৌধুরী বউসহ গ্রামে আসলে হান্নান চৌধুরী গ্রামের মোড় থেকেই ওনাকে তাড়িয়ে দেন।বাড়িতে পা টাও রাখতে দেন না।তারপর আরিফ চৌধুরী আর কখনও গ্রামে আসেননি।”
“উনি তোমার সাথে প্রতারণা করে শ্রেয়া চৌধুরী কে কেনো বিয়ে করেছিলেন মা?”
মেহরিমার কন্ঠে ক্রোধ স্পষ্ট। মেয়ের কথায় অবনী শেখ মুচকি হাসেন।
“সেটা যে করেছে সেই ভালো জানবে মা ।যাই হোক একটা কথা কি জানিস মা?আল্লাহ যা করেন ভালোর জন্যই করেন।তুই কিছু বছর পর পিছু ফিরে তাকাবি।দেখবি তোর সাথে যা যা হয়েছে ভালোই হয়েছে।আমার ক্ষেত্রেও ঠিক সেটাই।তোর বাবার মতো কখনো কেউ হতে পারবে না।ওকে পেয়ে আমি পরিপূর্ণ ছিলাম।আমার আর কিছু চাওয়ার ছিল না জীবনে।”
“তোমার প্রথম ভালোবাসা কি তবে আরিফ চৌধুরী ছিলেন মা?”
মাধবীর কথায় অবনী শেখ হেসে ওঠেন।
“আমার পাগলি মেয়ে তা কেনো হতে যাবে? আরিফ চৌধুরী কেবল আমার একজন ভালো বন্ধুই ছিলেন।ওনার জন্য কখনো ওমন কোনোকিছু অনুভব করিনি আমি।শুধু প্রতারণার স্বীকার হয়েছিলাম বলে তোর বাবাকে ভালোবাসতে একটু সময় লেগে গেছিল।এই যা তাছাড়া ওমন কিছু না। আমার প্রথম ভালোবাসা তোর বাবা।”
মায়ের কথাগুলো শুনে মেহরিমা নিজের ভাবনার জগতে চলে যায়।কি এতো ভাবছে?মন,মস্তিষ্কে কি চলছে কে জানে?হয়তো ওর সব প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেছে।তবুও কোথাও একটা কিন্তু থেকে যায়!মুখে বলে,
“মা এই জন্যই কি উনি ওনার পরিবারের কাউকে সহ্য করতে পারেন না?”
“হৃদিতের কথা বলছিস?”
“হুম।”
“হয়তোবা।তোর বাবার মৃত্যু হার্ট অ্যাটাকে হয়েছে জানিস?”
“কিহ্!বাবার না অপারেশন করা হলো মা?”
“হ্যাঁ।তোর বাবা অতিরিক্ত টেনশড ছিল বিজনেস নিয়ে।তাই দ্বিতীয় বার বড়সড় হার্ট অ্যাটাক হয় ওর।হসপিটালে নিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই ওর পালস রেট কমে আসে।পাঁচ মিনিট পর নার্স এসে বলে তোর বাবা আর নেই।”
“বাবা বিজনেস নিয়ে টেনশড ছিল তুমি আমাকে আগে জানাও নি কেন মা?”
“আমিই গতকাল জেনেছি তোর বাবার ডায়েরি পড়ে।রিজন টা কি ছিল সেটা তুইও সময় হলে জানতে পারবি।শুধু এতটুকুই বলবো ওই চৌধুরী বাড়ির পাপের ঘড়া পূর্ণ হয়েছে।তোকে শক্ত থেকে সবটা মোকাবেলা করতে হবে নীলাক্ষী।”
“আই সোয়্যার মা।বাবার মৃত্যুর পিছনে যদি চৌধুরী বাড়ির কারোর হাত থাকে।তাকে আমি নিজে হাতে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করাবো।এমনিতেও আমার সহজ সরল খালামনিকে বাঁচতে দেয়নি ওরা।তোমাকে কষ্ট দিয়েছে ওরা।আমার কেন যেন মনে হচ্ছে তুমি সবটা বলোনি মা।কোথাও একটা কিন্তু রেখে দিয়েছো!”
মেহরিমার চোখে মুখে আলাদা তেজ ফুটে উঠেছে।অবনী শেখ মুগ্ধ চোখে নিজের মেয়েকে দেখেন।এ যেন ওনারই প্রতিচ্ছবি।অবনী শেখের কথাগুলো শুনে দরজার নিকট দাঁড়ানো হৃদিত কিছুক্ষণের জন্য থমকায়।তবে কি ওর ধারণায় সঠিক!যেটা ভেবেছিল ঠিক সেটাই হয়েছে!নিজের পাপের শা স্তি এবার সবাইকেই পেতে হবে।হৃদিত নিজে হাতে দেবে শা স্তি।
#চলবে
#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_৩২ [১১১+ এলার্ট]
#ইসরাত_তন্বী
❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌
অমানিশা নিজের মুখ লুকিয়েছে ধরনীর বুকে। জ্যোতির দেখা মিলেছে।নতুন একটা দিনের সূচনা।চারিপাশে কুয়াশার ধূম্রজাল।শেখ বাড়ির আঙ্গিনা শিউলি ফুলের সুগন্ধে ম-ম করছে।বাড়ির উঠান শিউলির সাজে সেজেছে।ভূমি ধূসর রুপ ধারণ করেছে।চোখ ধাঁধানো সুন্দর এক সকালের আগমন!কুয়াশার ধূম্রজাল চিরে পূর্ব আকাশে দিবাকর নিজের অস্তিত্ব জানান দিতে ব্যস্ত।
জলিল শেখের মৃত্যুর আজ চারদিন।গ্রামের প্রাইমারি স্কুলের ফিল্ডে বড় করে মিলাদের আয়োজন করা হয়েছে।শহর থেকে বড় মাওলানা আনা হচ্ছে।চৌধুরী বাড়ির পুরুষেরা সকাল থেকে সেখানেই নজরদারি করে চলেছে। মিলাদের রান্নার আয়োজন হচ্ছে সেখানেই।মিলাদ শুরু হবে মাগরিবের নামাজ পরে।মেহরিমার চাচারা জলিল শেখের লা শ মাটি দিয়ে আসার পরে আর শেখ বাড়ি মুখো হয়নি।মামা,মামি এসেছে আজ সকালে।মামাও অবশ্য স্কুলের ফিল্ডেই আছে তদারকির কাজে।মেহরিমার একটা মামাতো ভাই আছে।সে ঢাকা সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত।ছুটি না পাওয়ায় একমাত্র ফুফাকেও শেষ বারের মতো দেখতে আসতে পারেনি।
সময় দুপুর বেলা।মেহরিমা দুপুরের খাবার খেয়ে বিছানায় বসে আছে।বেশ রৌদ্রজ্জ্বল একটা দিন। রোদের তাপ ইতোমধ্যে সহনীয় মাত্রা ছাড়িয়েছে।বেলা এগারোটা নাগাদ চৌধুরী বাড়ির সকলে শেখ বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে।ঘর্মাক্ত অবস্থায় তড়িঘড়ি করে রুমে আসে হৃদিত।টাওয়াল নিতে যেয়ে মেহরিমাকে মুখ ফুলিয়ে বসে থাকতে দেখে চোখ দুটো ছোট ছোট করে মেহরিমার দিকে তাকায়।
“কী হয়েছে আমার মহারানীর?গাল দুটো এভাবে টমেটোর মতো করে রেখেছে কেনো?”
হৃদিতের কথায় মেহরিমা কোনো প্রত্যুত্তর করে না। চুপচাপ বসে থাকে। হঠাৎ মেহরিমার এহেন ব্যাবহারের কারণ হৃদিতের মাথার তিন হাত উপর দিয়ে যায়।এগিয়ে আসে সামনে।মেহরিমার গালে হাত রেখে কিছু বলতে নিলেই মেহরিমা ছ্যাত করে ওঠে।
“আমাকে ছুবেন না একদম।দূরে থাকুন আমার থেকে।”
মেহরিমার কথায় হৃদিতের কপালে ভাঁজের সৃষ্টি হয়।ভ্রু জোড়া কুঁচকে বলে,
“কেনো?আমি আবার কি করলাম?”
“জানি না।”
“মহা মুশকিল!না বললে জানবো কিভাবে?”
“বলবো না।”
“কেন বলবি না?”
“আমার ইচ্ছা।”
“আজব!হঠাৎ এমন বিহেভ কেনো করছিস জান?টেল মি দ্য রিজন।”
“এইসব জান,টান আমায় ডাকবেন না।আপনার তো এইসব ডাকার জন্য অনেক মানুষ আছে।তাদের গিয়ে ডাকেন যান।”
“কে আছে?”
“কে আবার?আপনার ওই শাকচুন্নী ফুফাতো বোন অলিভিয়া।”
“অলিভিয়া কি কিছু করেছে তোর সাথে?”
“আমার সাথে আবার কী করবে?যা করার আপনার সাথে করেছে।আপনাকে গি লে খেয়েছে।”
মেহরিমার আজগুবি কথায় হৃদিতের মাথাটা চক্কর দিয়ে ওঠে।নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
“জান আর ইয়্যু ওকে?আমাকে গি লে খেলে আমি এখানে কি করে থাকবো?এতক্ষণে তো ওর পেটের মধ্যে থাকার কথা ছিল তাই না?”
“আরে এই গি লে খাওয়া সেই গি লে খাওয়া না।এটা হচ্ছে চোখ দিয়ে গি লে খাওয়া।তখন আপনার দিকে কিভাবে তাকিয়ে ছিল!এখন থেকে আপনার কপালে কালো টিকা দিয়ে রাখবো।সুদর্শন জামাই পাওয়ার এই এক জ্বালা বাপু।”
“আর ইয়্যু জেলাস অ্যানাবেলা?”
“জামাই আমার তাহলে আমি জেলাস হবো না তো অন্য কেউ হবে?”
“এখন কী করতে মন চাইছে?”
“ওই শা ক চু ন্নী কে পানিতে চোবাতে।চোখ দুটো তুলে লুডু খেলতে।কত বড় সাহস আমার জামাইয়ের দিকে ওভাবে তাকায়।”
“আর তাকাবেনা।”
“সত্যিই তো?”
“তিন সত্যি।”
কথাটা বলে মেহরিমার কপালে আলতো করে একটা ভালোবাসার পরশ দিয়ে ওয়াশ রুমে চলে যায় হৃদিত।মেহরিমা মুচকি হেসে বিছানায় মাথা এলিয়ে দেয়।মিনিট দুয়েক পর গায়ে কিছুর টোকা অনুভব করতেই মেহরিমা চোখজোড়া মেলে তাকায়।কোলের উপরে একটা কাগজের টুকরো দেখতেই মেহরিমার কপালে ভাঁজ পড়ে। দৃষ্টি ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকায়। কিন্তু কাউকেই দেখতে পায় না।কাগজ মেলে দেখে ছোট্ট একটা বার্তা লেখা।
‘তুমি বড্ড বোকা মেয়ে।অলিভিয়াকে তুমি মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছো।এবার ওকে আর কেউ বাঁচাতে পারবে না।তোমার করা একটা ভুলের জন্য আজ অন্য কারোর জীবন সংকটে।”
মেহরিমা কিছুক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে চিরকুট টার দিকে তাকিয়ে থাকে।চিরকুটে লেখা কথাটার অর্থ মস্তিষ্ক উপলব্ধি করতেই মেহরিমার বুক কেঁপে ওঠে।সেই প্রথম দিনের চিরকুটের মতোই লেখাটা।চিরকুটদাতা তাহলে একজনই।এর মানে সেই মানুষটা সবসময় ওদের উপর নজর রাখছে। চিরকুটদাতা যে কাছের কেউ সেটা খুব ভালো করেই বুঝতে পারে মেহরিমা।নাহলে এত পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে নজর রাখা বাইরের কারোর পক্ষে সম্ভব না।মেহরিমার সন্দেহের তীর যেয়ে পড়ে খুব কাছের একজনের উপর।মেহরিমা শিওর এই চিরকুটদাতাকে ধরতে পারলে চৌধুরী বাড়ির রহস্যের গভীরে যাওয়া যাবে।মনে মনে পণ করে চিরকুটদাতাকে খুঁজে বের করেই ছাড়বে।আর এ কাজে সাহায্য করতে পারে একমাত্র হৃদিত। নিজের ভাবনায় ইতি টেনে মেহরিমা কাগজ টা আলমিরাতে লুকিয়ে রেখে রুমের বাইরে চলে আসে।তৎক্ষণাৎ জানালার নিকট থেকে একটা মানব ছায়া সরে যায়।
_____
সময় সন্ধ্যাবেলা।গ্রামের প্রায় সবাই মিলাদে এসেছে।মহিলা,পুরুষের জন্য আলাদা আলাদা ভাবে বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে।ইতোমধ্যে চৌধুরী ও শেখ বাড়ির সকলে ফিল্ডে উপস্থিত হয়েছে।হৃদিত মেহরিমাকে যত্ন করে গাড়ি থেকে নামিয়ে দেয়।গায়ে পরিধান করা গরম কাপড়ের উপর সুন্দর করে একটা শাল জড়িয়ে দেয়।
“বাইরে খুব ঠান্ডা।তোকে নিষেধ করলাম তবুও এসেই ছাড়লি।সাবধানে থাকবি।খোলা যায়গায় আর নিচে বসবি না।চেয়ারে বসবি।মহিলাদের ওইদিকে তো আমি যেতে পারবো না।নাহলে আমার সাথেই রাখতাম তোকে।আচ্ছা এখান থেকে তো সবটাই শোনা যাচ্ছে।ইভেন দেখাও যাচ্ছে।আমি একটা চেয়ার এনে দেই।এখানেই বসে শোন। তাহলে আমিও তোর পাশে থাকতে পারবো।”
হৃদিতের বাচ্চামো কথাবার্তায় সকলে ঠোঁট টিপে হাসে।আতিয়া চৌধুরী বলেন,
“তোর বউকে যত্ন করার জন্য তোর মায়েরা আছে বাবা।এতো চিন্তা কিসের?বউ তো আর হারিয়ে যাচ্ছে না।এইতো কয়েক ঘণ্টার ব্যাপার।এতটুকু সময় একা থাকতে পারবি না?আর ওর ঠান্ডা লাগবে টা কিভাবে?শরীরের মধ্যে মুখটা ছাড়া আর কোনো যায়গা কি ফাঁকা আছে?হাতে পায়েও মোজা পরিয়ে এনেছিস।”
আতিয়া চৌধুরী নিজের কথা শেষ করে হৃদিত কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই মেহরিমার হাত ধরে গটগট করে সামনে এগিয়ে যায়।মেহরিমার যাওয়ার দিকে অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে হৃদিত।মেহরিমা একবার পিছু ফিরে তাকিয়ে হৃদিত কে আশ্বাস দেয় ও নিজের খেয়াল রাখবে। তবুও হৃদিতের মন মানে না।ভেবে রাখে আগামীকালকেই আবার ডক্টরের কাছে নিয়ে যাবে অ্যানাবেলাকে।
মিলাদ শেষ হয় রাত নয়টায়।মিলাদের সকল কাজ শেষ করে বাসায় ফিরতে ফিরতে দশটা বেজে যায়।শেখ বাড়িতেই রাতের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে।হৃদিত ফ্রেশ হয়ে এসে ক্লান্ত শরীর টা সোফায় এলিয়ে দিয়েছে।ঠিকমতো ঘুম না হওয়ায় সাথে অতিরিক্ত মাথা যন্ত্রণার ফলে চোখজোড়া লাল টকটকে হয়ে আছে।মেহরিমা নিজের ঘরে আছে।ফ্রেশ হচ্ছে।অলিভিয়া এসে হৃদিতের পাশেই গাঁ ঘেঁষে বসে পড়ে।
“মাথা যন্ত্রণা করছে তোমার?টিপে দেবো?”
হৃদিত নিজের রক্তের ন্যায় লাল চক্ষুজোড়া মেলে তাকায়।অলিভিয়ার শরীর ভয়ে শিউরে ওঠে।সাথে সাথে লাফিয়ে দুই হাত দূরে গিয়ে বসে।
“তুই কে ভাই?সবসময় এভাবে আমার পিছনে লেগে থাকিস কেনো?তোরে না সেদিন বললাম আমার থেকে দূরে থাকবি?”
“আমি তোমায় ভালোবাসি হৃদিত।এতো সহজেই সবটা ভুলে কিভাবে তোমার থেকে দূরে থাকবো?”
“এখন এগুলো বলে কোনো লাভ আছে আপাই?আপনার ভালোবাসার মানুষটা তো এখন সেকেন্ড হ্যান্ড হয়ে গেছে।আমার নামে বুকড।আর কয়েক মাস পর দেখবেন একটা লেজও থাকবে সাথে। সবসময় পাপ্পা,পাপ্পা বলে ওনার পিছনে দৌড়ে বেড়াবে।আপনার তো রুচি ভালো না দেখছি।লেজ ওয়ালা ছেলেদের কেউ আবার পছন্দ করে নাকি?”
মেহরিমার কথায় হৃদিত হো হো করে হেসে ওঠে। হাসির সেই শব্দে বাসার সবাই হৃদিতের দিকে দৃষ্টিপাত করে।সবাই মুগ্ধ চোখে হৃদিতের হাসি দেখে।অনেকে তো এই প্রথম হৃদিতকে হাসতে দেখে।হাসলে মানুষটাকে কত্তো সুন্দর লাগে অথচ মানুষটা হাসেই না।হৃদিতের হাসি দেখা আর অমাবস্যার চাঁদ দেখা একই বিষয়।হঠাৎ মেহরিমার এমন কথায় অলিভিয়া থতমত খেয়ে যায়।এই মেয়েটা তো এখানে ছিল না।আসলো টা কখন? অলিভিয়া দ্রুত বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।
“এবার বেশি বাড়াবাড়ি করলে হ্যানসেল,হ্যারিকে পিছে লাগিয়ে দেবো একদম।তখন বাবা ডেকেও কুল পাবি না।অ্যান্ড লাস্ট ওয়ার্নিং দিচ্ছি।স্টে এওয়ে ফ্রম আস্।”
হৃদিতের করা তীব্র অপমানে অলিভিয়ার মুখটা থমথমে হয়ে ওঠে।দ্রুত ওখান থেকে সরে পড়ে।তবে মনের মধ্যে জেদ ঠিকই থাকে।
রাতে খাওয়ার পর্ব শেষ হয়েছে।সবাই মিলে ড্রয়িং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে।সবার কথার মাঝে অলিভিয়া বলে ওঠে,
“এই মেহু তুমি তো নিজেই এখনও একটা বাচ্চা।আবার আরেক বাচ্চা নিয়ে বসে আছো।কয়েক বছর পরে নিলেও তো পারতে বাচ্চা টা?তোমার সামান্য হেয়ারের যত্নই তুমি একা নিতে পারো না।একটা বাচ্চার যত্ন কিভাবে নিবে?এই দেখো আমার কি সুন্দর হেয়ার অ্যান্ড এটার যত্ন আমি একাই নিই।অথচ আমি এখনও বিয়েই করলাম না।তাছাড়া আরিশা ভাবীও তো এখনও বাচ্চা নেয়নি।ওনাদের তো বিয়ের থ্রি ইয়ার্স রানিং।”
“আজব তো!তুমি তোমার কথার মাঝে আমাকে কেনো টানছো?অন্যের পার্সোনাল ম্যাটারে ইন্টারফেয়ার করা বন্ধ করো।”
আরিশা কথাটা বলে আয়াশের দিকে একপলক তাকিয়ে ওখান থেকে উঠে বাইরে চলে যায়।আয়াশ দীর্ঘশ্বাস ফেলে।সকলের সামনে এমন প্রশ্নে মেহরিমা লজ্জা পেয়ে যায়।সাথে অপমানবোধও করে।অলিভিয়ার ঠোঁটে কুটিল হাসি। সুযোগ পেয়েছে এতো সহজে ছেড়ে দিবে নাকি।মেহরিমা কিছু বলার আগেই হৃদিত নিজের গম্ভীর তীক্ষ্ণ কন্ঠে বলে,
“বাচ্চা পালবে আমার ওয়াইফ।তোর এতো টেনশন কিসের?নাকি নিজের নোং রা মি করার চান্স হারিয়েছিস বলে মাথায় কাজ করছে না?আর তোর মতো মেয়েকে বিয়েটা কে করবে শুনি?কোটি টাকা দিয়েও কারোর গলায় ঝুলাতে পারবে না তোকে।”
“হৃদিত অলিভিয়া তো ঠিক কথায় বলেছে।তুমি সব সময় এভাবে আমাদের অপমান করতে পারো না।”
“নিজের মেয়েকে ভদ্রতা শেখান এমপির বোন।আপনাদের পরিবারের কারোর মধ্যেই ম্যানারস নেই।মেহরিমা রুমে চল।রাত হয়েছে অনেক।তোর ঘুমের সময় হয়ে গেছে।”
হৃদিত মেহরিমাকে নিয়ে রুমে চলে যায়।অবনী শেখ আয়রা চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসেন।আর তাতেই আয়রা চৌধুরী তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠেন।
______
সকাল সকাল তাবান,তাইফ আর তৃধা হাজির হয়েছে মেহরিমাদের বাসায়।সবার মুখে চাঁপা হাসি।মেহরিমা রুম থেকে বেরিয়ে আসে।হৃদিত এখনও গভীর ঘুমে মগ্ন।
“মেহু বেই..না না শুধু মেহু তাড়াতাড়ি এদিকে আয়।একটা হেব্বি কথা আছে তোর সাথে।”
মেহরিমা এগিয়ে এসে সোফায় বসে।
“বল।”
“জানিস অলিভিয়া পেত্নীর কি হয়েছে?”
“না বললে জানবো কিভাবে?”
“ওও তাইতো।তাহলে শোন।পেত্নী পুরো টাক হয়ে গেছে। মাথায় আর একটা চুল ও নেই।হাতের পায়ের সুন্দর নখ গুলো নেই।বোচা হয়ে গেছে।চোখের উপর ভ্রু নেই।দেখতে পুরাই সার্কাসের মতো লাগছে।আবার মাথার টাকের উপর পুকুরের নোংরা পানি আর শেওলা লেগে আছে।পেত্নীর পুরো রুমে পুকুরের কর্দমাক্ত শেওলা পড়ে আছে।ছিহ্ কি দুর্গন্ধ!”
নাকমুখ সিঁটকায়ে কথাগুলো বলে উচ্চস্বরে হেসে ওঠে তৃধা।সাথে তাবান তাইফ ও যোগ দেয়।সবটা মেহরিমার মাথার উপর দিয়ে যায়।
“হঠাৎ এমন হওয়ার কারণ?”
“তা জানি না।সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই নিজের ওমন সার্কাস চেহারা আর রুমের ওই অবস্থা দেখে পুরো বাড়ি মাথায় তুলে ফেলেছে পেত্নী।মা মেয়ে মিলে কান্না জুড়ে দিয়েছে।”
আচ্ছা তোরা বস আমি দুই মিনিট আসছি।মেহরিমা দ্রুত পায়ে রুমে এসে হৃদিতকে ডাকে।
“এ্যাই শুনছেন?”
হৃদিতের কোনো নড়চড় না দেখে গায়ে হালকা ধাক্কা দেয়।
“এই শুনুন না।”
হৃদিত নড়েচড়ে উঠে ঘুমু ঘুমু কন্ঠেই বলে,
“হুমম জান।”
“আমি ঘুমানোর পরে আপনি গতরাতে বাইরে গেছিলেন?”
“উহু।হোয়াই?”
“না,এমনিতেই।আপনি ঘুমান।”
মেহরিমা আর কিছু না বলে রুমের বাইরে চলে আসে।ঠোঁটের কোণে মুচকি হাঁসির দেখা মেলে।মেহরিমা রুমের বাইরে যেতেই হৃদিতের ঠোঁটে ক্ষীণ বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে।আরামছে আবার গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে।
#চলবে