#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_২৯ [ছোট্ট ধামাকা]
#ইসরাত_তন্বী
❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌
মেহরিমা সাজুগুজু করে হৃদিতের অপেক্ষায় বসে আছে।আজ কালো রঙের একটা জর্জেট শাড়ি জড়িয়েছে শরীরে।হৃদিত বিকালে এসে শাড়ি সহ অর্নামেন্টস দিয়ে গেছে।সেগুলো দিয়েই নিজেকে সাজিয়েছে। ইতোমধ্যে বিয়ের একমাস পেরিয়েছে।বিয়ের পরে আজ দ্বিতীয় বারের মতো শাড়ি পরেছে মেহরিমা।
“নীলাক্ষী বাসায় ফিরবি আজকে?”
মায়ের কথায় মেহরিমা লজ্জা পেয়ে যায়।লাজুক হেসে বলে,
“না মা।কাল সকালে ফিরবো।”
“আচ্ছা সাবধানে থাকিস।”
“ঠিক আছে মা।”
অবনী শেখ ঘর থেকে চলে যেতেই হৃদিতের কল আসে।মেহরিমা দ্রুত রিসিভ করে।
“বাইরে আয়।আ’ম ওয়েটিং।”
“পাঁচ মিনিট অপেক্ষা করুন।বাবার সাথে দেখা করেই চলে আসছি।”
“ওকে।”
হৃদিত কল কেটে দিতেই মেহরিমা বাবার রুমে যায়।জলিল শেখ বসে ফল খাচ্ছেন।মেহরিমা কে দেখতেই মুচকি হাসেন।সেই চিরচেনা মধুর কন্ঠে আম্মা ডাকেন।আজ বাবার আম্মা ডাকটা শুনে মেহরিমার বুকের মাঝে কেমন একটা করে ওঠে।
“বাবা সাবধানে থাকবে।রাতের খাবার খেয়ে ঠিকমতো মেডিসিন গুলো খাবে।একা একা হাঁটবে না।ওয়াশ রুমে মায়ের সাথে যাবে।একা ভালো না লাগলে মাধুপুকে ডেকে আড্ডা দেবে নাহলে আমাকে কল করবে মনে থাকবে?”
মেয়ের আদুরে শাসনে জলিল শেখ হো হো করে হেঁসে ওঠেন।অনেক দিন পর বাবার মুখে সেই পুরোনো হাসি দেখতেই মেহরিমার মনটা ভালো হয়ে যায়।
“আচ্ছা আমার আম্মা আপনার সব কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে চলবো।”
মেহরিমা বাবার থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে আসতেই জলিল শেখ ডেকে ওঠেন।
“আম্মা!”
মেহরিমা পিছু ফিরে চায়।জলিল মুচকি হেসে কিছুক্ষণ মেহরিমার দিকে তাকিয়ে থাকেন। অতঃপর বলেন,
“সাবধানে যেও আম্মা।”
মেহরিমার হঠাৎ কি হয় কে জানে!দৌড়ে এসে বাবাকে ঝাপটে ধরে।জলিল শেখ ব্যথা পেলেও সহ্য করে নেন।মিনিট দুয়েক ওভাবেই বাবার বুকে থাকে মেহরিমা।জলিল শেখ মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেন।তারপর ধীর কন্ঠে বলেন,
“হৃদিত বাবা তোমাকে খুব ভালোবাসে আম্মা।ওই বাড়ির সবাই মুখোশধারী হলেও হৃদিত বাবা নির্ভেজাল আম্মা।মন দিয়ে সুখে শান্তিতে সংসার করবে।কখনো কারোর কথায় কান দেবে না।মনে রাখবে মানুষ যখন কথায় পারে না তখন তার অতীত টেনে কথা বলে।নিজের অতীত ভুলে বর্তমান,ভবিষ্যৎ নিয়ে বাঁচতে শেখো।তোমার বর্তমান ভবিষ্যৎ সবটা হৃদিত বাবা।পড়াশোনা টা মনোযোগ দিয়ে করবে ঠিক আছে আম্মা?অনেক বড় হতে হবে তোমায়।বিয়ে হয়ে গেছে বলে গিভ আপ করবে না।তোমাকে নিয়ে অনেক স্বপ্ন আমার।তোমার মায়ের জীবনটা খুব কষ্টের আম্মা।কখনও তোমার মাকে কষ্ট পেতে দিওনা কেমন?”
মেহরিমা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।আবারও হৃদিতের কল আসতেই বাবার থেকে বিদায় নিয়ে বাইরে চলে আসে মেহরিমা।কেনো যেনো আজ বাবাকে ছেড়ে আসতে মন চাইছে না।গাড়ির নিকট আসতেই দরজা টা একাই খুলে যায়।মেহরিমা গাড়িতে উঠে বসে।সিটবেল্ট বাঁধতেই হৃদিত গাড়ি স্টার্ট দেয়।মেহরিমার দিকে তাকানোর প্রয়োজন বোধটুকু করে না।কিছুক্ষণ ড্রাইভিং করার পর প্রশ্ন করে,
“এতো দেরি হলো কেনো আসতে?”
“বাবার সাথে কথা বলছিলাম। আচ্ছা আমরা কোথায় যাচ্ছি?”
“গেলেই দেখতে পাবি।”
মেহরিমা বুঝতে পারে হৃদিত ওর উপর খেপে আছে তাই আর কথা না বাড়িয়ে চুপ হয়ে যায়। দুইঘন্টা ড্রাইভিং করে হৃদিত একটা লেকের কাছে এসে গাড়ি থামায়।মাঝে একবার গাড়ি থামিয়ে রেস্টুরেন্ট থেকে ডিনার কমপ্লিট করে এসেছে।হৃদিত নিজে নেমে মেহরিমাকে কোলে উঠিয়ে নেয়।চারিদিকে শূনসান নিরবতা।মানুষের একটা চিহ্ন ও নেই।শুধু পাশেই একটা কটেজ দেখতে পাচ্ছে মেহরিমা।শীতের রাতে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক শোনা যাচ্ছে।অদূরেই কোথাও শেয়াল নিজস্ব কন্ঠে ডেকে চলেছে।মেহরিমা লেকের চারপাশটা তাকিয়ে দেখতে থাকে।লেকের চারিপাশে পার্পল কালারের ছোট ছোট লাইট দিয়ে ডেকোরেশন করা।সেই আলো খুব মৃদু।তাছাড়া এক্সট্রা কোনো লাইট অর ল্যাম্পপোস্ট নেই।এমন ভুতুড়ে পরিবেশে মেহরিমার গায়ে কাঁটা দিয়ে ওঠে।চারি পাশে সারি সারি সুউচ্চ গাছপালা।শীতের ঠান্ডা ঝিরিঝিরি হাওয়া এসে তনু মনে লাগতেই মেহরিমা শিউরে উঠে হৃদিতের বুকের সাথে লেপ্টে যায়।হৃদিত মুচকি হাসে।লেকের সামনে আসা মাত্রই মেহরিমার চোখজোড়া কপালে উঠে যায়!লেকের পানিতে শত শত ক্যান্ডেল জালানো।লেকের ঠিক সামনেই লাল, সাদা গোলাপের পাপড়ির কম্বিনেশনে লাভ শেপ করা।তার মাঝে বড় করে লেখা ‘মাই অ্যানাবেলা।’ তার একটু নিচে ছোট্ট করে লেখা ‘ডু ইয়্যু রিমেম্বার দিস নিকনেইম সানসাইন?’।হৃদিত এগিয়ে যেয়ে মেহরিমাকে লাভ শেপের মধ্যে নামিয়ে দেয়।পেছন থেকে কোমর জড়িয়ে কাঁধে থুতনি রেখে দাড়ায়।আর সাথে সাথেই উপর থেকে গোলাপের পাপড়ির বর্ষণ শুরু হয়।মেহরিমা হতভম্ব হয়ে যায়!ওর কাছে সবটা স্বপ্ন মনে হয়।খুশিতে আঁখি জোড়া জ্বলজ্বল করে ওঠে।মেহরিমা দুদিকে দু’হাত মেলে দেয়।দশ মিনিট ধরে গোলাপের পাপড়ির বর্ষণ শেষে মেহরিমা হৃদিতের বুকে মাথা এলিয়ে দিয়ে চোখ জোড়া বুজে নেয়।ভালো লাগা খারাপ লাগা সব মিলিয়ে বক্ষস্থলে অদ্ভুত এক অনুভূতি হয়।হৃদিত ওর কাঁধে ছোট্ট ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়।
“সারপ্রাইজ ভালো লেগেছে?”
“বেস্ট সারপ্রাইজ এভার।”
“শীতে গরম কাপড় পরিসনি কেনো?”
“ভুলে গেছি।”
“আচ্ছা এখানে দুই মিনিট বস।আমি গাড়ি থেকে তোর জন্য গরম কাপড় নিয়ে আসি।”
“না,না আমিও যাবো আপনার সাথে।”
মেহরিমা ভয় পাচ্ছে হৃদিত সেটা বুঝতে পেরেই ওর নরম হাত নিজের শক্ত খসখসে হাতের মুঠোয় পুরে নেয়।
“ভয় কিসের?আমি আছি তো।”
ব্যস অমনিই মেহরিমার সাহস বেড়ে যায়।ছোট্ট একটা বাক্য অথচ কতো শক্তিশালী!হৃদিত মেহরিমাকে সাথে করে গরম কাপড় আর চাদর নিয়ে আসে।মেহরিমাকে গরম কাপড় পরিয়ে দিয়ে দু’জনে লেকের পাশে এক চাদরের মধ্যে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে বসে।হৃদিতের বুকে মাথা রাখে মেহরিমা।মেহরিমার দৃষ্টি নিবদ্ধ লেকের পানিতে।হৃদিতের দৃষ্টি নিবদ্ধ অ্যানাবেলার সুশ্রী মুখমন্ডলে।পার্পল কালারের মৃদু আলোয় নিজের প্রেয়সীকে দেখতে বড্ড আদুরে লাগছে।আঁখি জোড়ায় চিকন করে কাজলরেখা টানা।ঠোঁটে নুড কালারের লিপস্টিক দেওয়া।অতোটা বোঝা যাচ্ছে না।নাকফুল টা জ্বলজ্বল করছে।হৃদিত নাকফুলের উপর ছোট্ট একটা চু মু খায়।
“আমাদের জীবনের সেরা দিন গুলোর মধ্যে এই দিনটাও যুক্ত হলো।”
মেহরিমার কথায় হৃদিত হেসে বলে,
“তাই নাকি?”
“হুম।
“আজকাল তোকে হারানোর ভয়টা একটু বেশিই পাই আমি।তোর সাথে কিছু সুন্দর স্মরণীয় মূহুর্ত কাটাতে চাই।তোর সাথে আমি না থাকলেও আমার এই স্মৃতি গুলো সবসময় থাকবে।এগুলো নিয়ে দিব্যি একটা জীবন কাটিয়ে দেওয়া যাবে।”
“চন্দ্রের মতো আলো দিয়ে আমার জীবন টা সুন্দর করে সাজিয়ে অগ্নিকাণ্ডে নিক্ষেপের কি খুব প্রয়োজন ছিল?নিজের আসল চেহারা বিয়ের আগে কেনো প্রকাশ করলেন না?”
“আমার সব মিথ্যের মাঝেও চিরন্তন সত্য হচ্ছে তুই,আমার ভালোবাসা।”
“ওই ভালোবাসার কাছেই হেরেছি আমি।”একটু থেমে আবার বলে,”নিশান,পলাশ,শিহাব কে আপনিই মেরেছেন?”
“হৃদিতের অ্যানাবেলাকে টাচ করার সাহস দেখালে সে অক্ষত অবস্থায় থাকবে নাকি?”
“মানুষ হ ত্যা পা প।”
“কিন্তু ওরা তো ম রে নি।”
“শিহাব কে তো মে রে দিয়েছেন।”
“প শু হ ত্যা পাপ নয়।আর আমি না মা র লে ও কেউ একজন মে রে দিতো।”
“কে মে রে দিতো?”
হৃদিত জবাব না দিয়ে চুপচাপ বসে থাকে।মনের মাঝে কি চলছে কে জানে?ঠোঁটে ফুটে ওঠে বাঁকা হাসি।নিজের এতটুকু সত্য প্রকাশ না করলে অ্যানাবেলা নির্ঘাত ভুল বুঝতো।পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যেতো।সকাল থেকে যেভাবে সত্যি জানতে উঠে পড়ে লেগেছিল!এতটুকু একটা মেয়ে পারেও বটে।সেদিনের রাতে পানি দেওয়ার ঘটনা নিয়ে তাবান,তাইফ পর্যন্ত পৌঁছে গেছে!মেহরিমা নিজে থেকেও আর কোনো কথা বলে না।এতো এতো রহস্য,এতো এতো সত্য সব মিলিয়ে মস্তিষ্ক বিক্ষিপ্ত হওয়ার উপক্রম।মেহরিমার মায়ের বলা একটা কথা মনে খুব মনে পড়ে।’আমাদের সবার ভালোবাসা একরকম নয়।ঠিক তেমনভাবেই আমাদের সকলের ভালোবাসা প্রকাশের ধরণ টাও একরকম না।এই পৃথিবীতে একেক জন একেক ভাবে নিজেদের ভালোবাসা প্রকাশ করে।কেউ মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে প্রকাশ করে,কেউ রাগ দেখিয়ে,কেউ অভিমান করে আরও অনেক ভাবে একেকজন একেকজনের ভালোবাসা প্রকাশ করে থাকে।ভালোবেসে কেউ হয় প্রেমিক আবার কেউ হয় খলনায়ক।ভালোবাসার মানুষ কে নিয়ে কয়েকজন আবার অত্যধিক পজেসিভ মাইন্ডের হয়।তারা নিজেদের ভালোবাসার জন্য পৃথিবী ধ্বংস করার ক্ষমতা রাখে।ভালো খারাপ হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে।তাদের কে একমাত্র ভালোবাসা দিয়েই সঠিক পথে আনা যায় বুঝলি নীলাক্ষী।’ মায়ের কথামতো দাঁড়ায় হৃদিত অত্যধিক পজেসিভ মাইন্ডের একজন মানুষ।স্পেশালি মেহরিমাকে নিয়ে।মেহরিমা তৎক্ষণাৎ সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয় নিজের সবটুকু ভালোবাসা দিয়ে হৃদিতকে পরিবর্তন করবে।খুব করে বোঝাবে।আর এভাবে অন্যায় কোনো কাজ করতে দেবে না।দুটো মানুষ নিজেদের আলাদা আলাদা ভাবনায় বিভোর থাকে।এভাবেই সেকেন্ড পেরোয়,মিনিট পেরোয়,ঘন্টা পেরোয়। দু’জনের মাঝে বিরাজ করে এক নিবিড় নিরবতা।হৃদিত নিরবতা ভেঙে বলে,
“তোর কাছে কিছু একটা চাই দিবি আমায়?”
“সাধ্য থাকলে অবশ্যই দেবো।”
“তোর বাচ্চার বাবা হতে চাই।”
মেহরিমা সবটা ভুলে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে হৃদিতের শক্তপোক্ত সুদৃঢ় বক্ষস্থলে মুখ লুকায়।কিছুক্ষণ চুপ থেকে মৃদু কন্ঠে বলে,
“আই থিংক ইটস অলরেডি ডান।”
“ওহ দ্যাটস গুড নিউজ।”
জবাব দেয় হৃদিত।পরক্ষণেই কথাটার অর্থ মস্তিষ্ক উপলব্ধি করতেই চোখে এক আকাশ সমান বিষ্ময় নিয়ে মেহরিমার দিকে তাকায়!উৎফুল্ল কন্ঠে বলে,
“আর ইয়্যু শিওর জান?”
“নোপ বাট মে বি।”
“কালকেই টেস্ট করবি বাটারফ্লাই।”
“আচ্ছা।”
হৃদিত মেহরিমা কে কোলে উঠিয়ে নিয়ে কটেজের দিকে হাঁটা ধরে।হঠাৎ হৃদিতের এমন কান্ডে মেহরিমা ভয়ে হৃদিতের গলা জড়িয়ে ধরে।
“কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?”
“কটেজে।বাইরে ঠান্ডা বাড়ছে।এখানে তোর থাকা ঠিক হবে না জান।”
কটেজের দরজার সামনে মেহরিমাকে নামিয়ে দেয়।দরজা খুলে দু’জনে ভেতরে প্রবেশ করে।
হৃদিত লাইট জ্বালিয়ে দেয়।মেহরিমা ঘুরে ঘুরে কাঠের তৈরি সুন্দর ঘরটা দেখতে থাকে।কি সুন্দর কারুকাজ খচিত তৈরি ঘরের প্রতিটা আসবাবপত্র!মেহরিমা মুগ্ধ নয়নে সবটা ঘুরে ঘুরে দেখতে থাকে।হৃদিত দরজা লক করে এসে মেহরিমার পিছনে দাঁড়ায়।শাড়ি গলিয়ে উন্মুক্ত কোমরে হাত রাখে।মেহরিমার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,
“অ্যানাবেলা আর ইয়্যু রেডি ফর টুনাইট?”
লজ্জায় মেহরিমা কুঁকড়ে ওঠে।গালে রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়ে।হৃদিত মেহরিমা কে কোলে উঠিয়ে নেয়।যত্ন সহকারে বিছানায় শুইয়ে দেয়।মেহরিমা লজ্জায় হাঁসফাঁস করতে থাকে।
_____
সকাল সাতটা বেজে পনেরো মিনিট।শীতের সকাল সাতটা মানেই চারিপাশ কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকা।পূর্ব আকাশে উঁকি দিচ্ছে প্রভাকর।কটেজের চারিপাশ কুয়াশায় ঘেরা।দূরের কিচ্ছু দেখার উপায় নেই।শোনা যাচ্ছে নাম না জানা কতশত পাখির ডাক।মেহরিমা ব্যালকনিতে দাড়িয়ে আছে।ভেজা চুল দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে।হৃদিত মেহরিমার জন্য এক্সট্রা ড্রেস নিয়ে এসেছিল সেটাই পড়েছে মেহরিমা।ব্যালকনির সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে মাঝারি আকারের লেক টা।মেহরিমা যখন মুগ্ধ চোখে শীতের সকালের প্রকৃতির সৌন্দর্য দেখতে ব্যস্ত সেইসময় হঠাৎ ওর ফোনটা বেজে ওঠে।এতো সকালে আবার কে কল দেবে?কথাটা ভাবতে ভাবতেই মেহরিমা দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে নাম্বার না দেখেই কল রিসিভ করে।ওপাশ থেকে ভেসে আসে মাধবীর কান্নারত কন্ঠস্বর।
“মে..মেহু আমাদের বাবা আর নেই।”
মাধবীর কথাটা মেহরিমার শ্রবণেন্দ্রিয়ে বজ্রপাত ফেলে।মাথায় উপর যেন পুরো আকাশ ভেঙ্গে পড়ে।পৃথিবীটা দুলে ওঠে।ক্রমশ সামনের সবকিছু অস্পষ্ট হতে থাকে।অস্ফুট স্বরে ‘বাবা’ ডেকে দু’চোখ বন্ধ করে নেয় মেহরিমা।কিছু পড়ে যাওয়ার বিকট শব্দে হৃদিত শোয়া থেকে ধড়ফড় করে উঠে বসে।মেহরিমার সাথে গোসল সেরে মাত্রই চোখজোড়া বন্ধ করেছিল।হৃদিত দৌড়ে ব্যালকনিতে আসে।মেহরিমাকে অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে দিশেহারা হয়ে পড়ে।
#চলবে__
#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_৩০
#ইসরাত_তন্বী
❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌
জলিল শেখের প্রাণহীন নিথর দেহ খানা খাটিয়াই পড়ে আছে।চারি পাশে হাজার হাজার মানুষের সমাগম।শেখ বাড়িতে তিল পরিমাণ জায়গাও ফাঁকা নেই।গ্রামের প্রায় সকলেই উপস্থিত হয়েছে।তাছাড়া শহরের পরিচিত অনেকেই এসেছেন। স্বনামধন্য একজন ব্যক্তি ছিল কি না!শেখ বাড়িসহ পুরো গ্রামেই হাহাকার বিরাজমান।তাদের সকলের দুঃখের সঙ্গি ছিল এই মানুষটা।জলিল শেখের খাটিয়ার একপাশে মাধবী চিৎকার করে কান্না করে চলেছে।ওকে জড়িয়ে ধরে বসে আছেন অবনী শেখ।উনি প্রথমে কান্না করলেও এখন পুরোপুরি নিস্তেজ হয়ে গেছেন।অপর পাশে পুরোপুরি নিস্তব্ধ হয়ে বসে আছে মেহরিমা।সকাল থেকে এখনও পর্যন্ত একটা কথাও বলেনি আর না করেছে একটুও কান্না। বাবার দিকে একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। মুখে যন্ত্রণার ছাপ স্পষ্ট।কেউ জোর করেও বাবার পাশে থেকে সরাতে পারেনি। জলিল শেখকে ধোয়াতে নিয়ে যাওয়ার সময়ও একই যায়গায় ঠাঁয় বসে ছিল।মেহরিমা কে জড়িয়ে ধরে আছেন আয়েশা চৌধুরী।হৃদিত অদূরেই দাঁড়িয়ে ব্যথিত হৃদয় নিয়ে একদম ভেঙে দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া প্রেয়সীর মুখের দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।কোনো কিছুকে তোয়াক্কা না করা ছেলেটাও আজ কেমন যেনো সবকিছুতেই তালগোল পাকিয়ে ফেলছে।
তখন সকালে মেহরিমা কে ওই অবস্থায় দেখে হৃদিতের দেহে প্রাণ ছিল না।পাঁচ মিনিট ধরে ডেকে যখন সেন্স ফিরছিল না তখন ডক্টরকে ইনফরম করে।ততক্ষণে জলিল শেখের মৃত্যুর সংবাদ হৃদিতের নিকট পৌঁছে গেছে।ডক্টর এসে চেক আপ করে জানায় এত বড় স্ট্রেস নিতে না পারায় সেন্স হারিয়েছে। পুরো একঘন্টা সময় নিয়ে সেন্স ফিরে মেহরিমার। তারপর আর ওকে ঠেকিয়ে রাখা যায়নি।হৃদিতও অসুস্থ মেহরিমাকে নিয়েই শেখ বাড়িতে ছুটেছে।
সময় দুপুর বেলা।ঘড়ির কাঁটা এখন দুটো বেজে পঁয়ত্রিশ মিনিটে।জানাজা অনুষ্ঠিত হবে ঠিক তিনটা বেজে পনেরো মিনিটে।মেহরিমার এই নিস্তব্ধতা কেউ মেনে নিতে পারছে না। অনেকেই কথা বলানোর চেষ্টা করেছে কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে।এভাবে আর কিছুক্ষণ থাকলে নির্ঘাত বড় কোনো সমস্যা হয়ে যাবে।জীবনে এই প্রথম হৃদিতের নিজেকে খুব অসহায় লাগে।চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।তক্ষুনি কাঁধে কারোর স্পর্শ অনুভব করে।ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকায়।আরিফ চৌধুরীর মলিন মুখখানা চক্ষু গোচর হয়।হৃদিতের আজ আর খারাপ ব্যবহার করতে মন টানে না।চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।বাবা ছেলের মাঝে কিছুক্ষণ নিরবতা চলে।
“ভেঙে পড়ো না বাবা।তোমাকে শক্ত থাকতে হবে।এখন এই পরিবারের একমাত্র ভরসার স্থল, একমাত্র খুঁটি শুধু মাত্র তুমি বাবা।”
আরিফ চৌধুরীর কথায় হৃদিতের মনে কোথাও একটু মনোবল বাড়ে।ওনার কথার পরিপ্রেক্ষিতে অনেক কিছুই বলা যেতো তবুও হৃদিত কোনো প্রত্যুত্তর করে না।সেভাবেই দাঁড়িয়ে থাকে।ছেলের এই ব্যবহার নতুন কিছু না।তবুও বাবার মনটা আজ ব্যথিত হয়। ছেলের ব্যবহারে নাকি অন্য কোনো কারণে উনি ঠিক বুঝে উঠতে পারেন না।আশেপাশের ভিড় গলিয়ে ওনার দৃষ্টি যেয়ে থমকায়,কয়েক ঘন্টার ব্যবধানে নিজের সর্বস্ব হারিয়ে পাথর বনে যাওয়া স্বর্বহারা এক নারীতে।যার এই পৃথিবীতে সব থেকেও আর কিছুই নেই।এতোটা করুণ পরিণতি উনি তো কখনোই চাননি।কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে তৎক্ষণাৎ ওখান থেকে প্রস্থান করেন।নিজের মনের মতো এই গ্রামের বাতাসও যেন আজ ক্রমশ বিষাক্ত হয়ে উঠছে।বাবার প্রস্থানের দিকে নিরশ চোখে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে হৃদিত।
সময় দুপুর দুটো বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট।গ্রামের বড় মসজিদের মুয়াজ্জিন আসেন কাফন বাধতে। লাশ এক্ষুনি কবরস্থানে নিয়ে যেতে হবে।শেষ বারের মতো সবাই দেখে নেয় জলিল শেখের নিষ্পাপ মুখখানা।মাধবী হুড়মুড়িয়ে উঠে এসে বাবাকে ঝাপটে ধরে।বাবাকে সে কিছুতেই নিয়ে যেতে দিবে না।
সাইমা শেখ সহ গ্রামের কিছু মহিলা এগিয়ে এসে মাধবী কে জলিল শেখের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। অবনী শেখ যন্ত্রের ন্যায় এগিয়ে আসেন। জলিল শেখের কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলেন,
“অনেকগুলো বছর আমাকে নিজের করে পাওয়ার জন্য অপেক্ষা করেছো।সারাটা জীবন আমার মুখে ‘ভালোবাসি’ কথাটা শোনার জন্য অপেক্ষা করলে।এবার ওপারে যেয়েও আমার জন্য অপেক্ষা কোরো কেমন?আমি শিঘ্রই তোমার কাছে চলে আসবো। এবার আর বেশি অপেক্ষা করাবো না।তুমি তো জানো তোমার অবনীমালা কথা দিলে তা রাখে।”
অবনী বেগম কথা গুলো বলে যেভাবে এগিয়ে এসেছিলেন সেভাবেই দুই কদম পিছিয়ে যেয়ে ধপাস করে মাটিতে বসে পড়েন। চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়তে থাকে।গ্রামের মহিলারা এগিয়ে এসে ওনাকে ধরেন।শেষ বারের মতো দু’চোখ ভোরে নিজের বাবাকে দেখে নেয় মেহরিমা। হঠাৎ করেই মস্তিষ্ক উপলব্ধি করে বাবাকে ওর কাছে থেকে কেড়ে নিতে চাচ্ছে সবাই।সাথে সাথে দুহাতে খাটিয়া আঁকড়ে ধরে।
“আমার বাবার মুখ বাধলেন কেনো চাচা? দেখছেন না আমার বাবা ঘুমাচ্ছে। বাবার নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হবে তো।তাড়াতাড়ি খুলে দিন।”
কথাটা বলে নিজেই হাত বাড়ায় বাবার মুখের কাফন খোলার উদ্দেশ্যে।আয়েশা চৌধুরী,আতিয়া চৌধুরী,তৃধা মেহরিমাকে ঝাপটে ধরে আটকায়।মেহরিমার কথায় উপস্থিত সবার বুকটা কেঁপে ওঠে।গ্রামের সবাই কমবেশি জানে মেহরিমা খুব বাবা ভক্ত ছিল।জলিল শেখের জানের টুকরো ছিল দু’টো মেয়ে।পাশ থেকে এক মহিলা বলেন,
“তুমার আব্বার আর কষ্ট হইতো না মা।হেই তো না ফিরার দ্যাশে চইলা গ্যাছে।তোমগোর বাবা আর লাই মা।”
মহিলার কথাটা বিদ্যুতের গতিতে মেহরিমার মস্তিষ্কে পৌঁছে যায়।সেই মধুর কন্ঠে আর কখনও আম্মা ডাক শুনতে পাবে না ভাবতেই মেহরিমার বুক কেঁপে ওঠে। চোখে জলেরা ভীড় জমায়। জানাজায় দেরি হয়ে যাবে দেখে মুয়াজ্জিন চাচা জলিল শেখের হয়ে সবার নিকট ক্ষমা চেয়ে নেন।উপস্থিত সবার চোখে পানি।হৃদিত,শাহিন শেখ আর মেহরিমার দুই চাচা দ্রুত জলিল শেখের খাটিয়া কাঁধে তুলে নেয়।তক্ষুনি মেহরিমা নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সবাইকে এক ধাক্কায় ফেলে দিয়ে ওর মামা শাহিন শেখের পা জোড়া জড়িয়ে ধরে।চিৎকার করে বলতে থাকে,
“আমার বাবাকে নিও না তোমরা।আমার বাবা ওখানে একা থাকতে পারবে না।আমার বাবা অন্ধকারে ভয় পায়।আমার বাবার ঠান্ডা সহ্য হয় না।”
মেহরিমাকে সবাই ঝাপটে ধরে রাখে।আজ সবাই মিলেও ওকে সামলিয়ে রাখতে পারছে না।ওর গায়ে যেন কোনো অশরীরী ভর করেছে।মেহরিমার কষ্টে হৃদিতের বুকে তীব্র রক্তক্ষরণ শুরু হয়।এই পৃথিবীর সবকিছুই কেমন অসহ্য লাগে ওর কাছে।কাঁধে শ্বশুর নামক আরেক বাবার লাশটা আজ যেন খুব ভারী ঠেকছে।চোখের সামনে গতকালের আড্ডা দেওয়ার স্মৃতি গুলো ভেসে উঠছে বারংবার।কি সুন্দর করে হাসছিল মানুষটা অথচ আজ!পা জোড়া চলার জন্য কোনো শক্তি পাচ্ছে না।এ কেমন যন্ত্রণা!পৃথিবীর সবচেয়ে কঠিন সত্য মেনে নিতে আমাদের অবুঝ মন এতো তাল বাহানা কেনো করে!
“বাবা!তুমি না বলেছিলে সবসময় আমার পাশে থাকবে।তাহলে আজ কেনো ছেড়ে যাচ্ছো? তোমাকে আমার প্রয়োজন বাবা।তোমার মতো করে আমায় আম্মা কে ডাকবে বাবা?আমার বাবাকে তোমরা নিয়ে যেও না।বাবা ওখানে একা থাকতে পারবে না।বাবার ভয় করবে।”
মেহরিমার আর্তনাদে কেঁপে ওঠে আকাশ,বাতাস সহ ভূমি।কেঁপে ওঠে উপস্থিত সকলের অন্তরাত্মা। সবাই সাক্ষী হয় বাবা হারা এক এতিমের আর্তনাদের।চোখের সামনে থেকে ক্রমশ বাবার শেষ চিহ্ন বিলীন হয়ে যেতেই মেহরিমা নিজের চোখজোড়া বুজে নেয়।অবনী শেখ সেভাবেই পাথর হয়ে বসে আছেন।দৃষ্টি নিবদ্ধ মাটিতে।দেহে প্রাণ আছে কি না বোঝা মুশকিল।মাধবী মাটিতে হাত পা ছড়ায়ে ছিটায়ে চিৎকার করে কান্না করছে।মেহরিমা জ্ঞান হারাতেই শেখ বাড়িতে দ্বিগুণ হৈচৈ পড়ে যায়।কয়েক জন দৌড়ে পানি আনতে চলে যায়।
#চলবে____