কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-২৫+২৬

0
6

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_২৫
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌

হসপিটালের করিডোরে পেতে রাখা একটা চেয়ারে বসে আছে মেহরিমা।দৃষ্টি নিবদ্ধ ফ্লোরে।পাশের চেয়ারে বসে ফ্যাচ ফ্যাচ করে কেঁদে চলেছে মাধবী।সকালের প্রথম প্রহরে হার্ট অ্যাটাক করেছেন জলিল শেখ।সেই সকালেই শহরের হসপিটালে নেওয়া হয় ওনাকে।শহরের ডক্টরেরা নিজেদের অপারগতা প্রকাশ করতেই তৎক্ষণাৎ ওনাকে নিয়ে চৌধুরী পরিবার আর শেখ পরিবার ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা দেন।বড় একটা প্রাইভেট হসপিটালে অ্যাডমিট করানো হয় জলিল শেখকে।এখন অপারেশন চলছে ওনার।

গতকাল রাত থেকে হৃদিতের উপরে একটা চাপা রাগ জমে আছে মেহরিমার।কোটি কোটি টাকা,গাড়ি,বাড়ি সব আছে বলেই যে রাগ উঠলেই ঘরের জিনিসপত্র ভাংচুর করতে হবে এ কেমন কথা?এই বিষয়ে গতরাতে দু’জনের মাঝে একটু কথা কাটাকাটি হয়েছে।হৃদিত হার মেনে নিয়েছে।গতকাল রাত থেকে সহস্র বার ছরিও বলে ফেলেছে ইতোমধ্যে।তবুও মেহরিমার রাগ কমেনি। আসলে সোনার চামচ মুখে দিয়ে জন্ম নেওয়া পোলাপান টাকার মর্ম বুঝবে কিভাবে?বড়লোকদের ছেলেমেয়েরা মূলত এই টাকার জন্যই উচ্ছন্নে যায়।মেহরিমার মনের মাঝে হাজারও প্রশ্ন জমা হয়েছে। কিন্তু এর উত্তর কোথায় পাবে?কে দেবে?কে এই মনের ভার কমাবে?হৃদিতের সমস্যা কিছুটা আঁচ করতে পেরেছে মেহরিমা।এই নিয়ে যে তাবান,তাইফের সাথে একটু কথা বলবে সেই সুযোগও হয়ে ওঠেনি। সারারাত না ঘুমিয়ে ভেবেছিল সকালে এই বিষয়ে কথা বলবে কিন্তু তার আগেই ঢাকায় ছুটতে হয়েছে।সকালে কোরআন শরিফ পড়ার সময় বাবার হার্ট অ্যাটাকের খবর পেতেই মেহরিমার পুরো পৃথিবী থমকে যায়।সেই এক কাপড়েই চৌধুরী বাড়ি ত্যাগ করে শেখ বাড়িতে উপস্থিত হয়। বাবার জন্য বুক ফেটে কান্না আসছে।খুব কষ্টে গলায় আঁটকে থাকা কান্নাটা গিলে ঠাঁয় বসে আছে মেহরিমা।মেয়েদের যে এতো সহজে ভেঙে পড়তে নেই।এই কয়দিনে খুব করে এটা বুঝে গেছে মেহরিমা‌।নিজের ভাবনার মাঝেই চোখের সামনে একটা পানির বোতল ধরা দেখতেই হাতের মালিকের দিকে দৃষ্টিপাত করে।হৃদিতের মলিন মুখমণ্ডল।মেহরিমার খুব মায়া হয়।কিন্তু মুখ ফুটে কিছুই বলতে ইচ্ছে হচ্ছে না।মূলত এই জগৎ সংসারের প্যাঁচে পড়ে মন, মস্তিষ্ক,শরীর ক্লান্ত হয়ে পড়েছে।এজন্যই বোধহয় মা বলত ‘আমরা মানুষেরা কল্পনাতেই সুখী।বাস্তবতা বড়ই কঠিন।’

“কি ভাবছিস এতো?এভাবে থাকলে অসুস্থ হয়ে পড়বি তো।”

“হুম?”

হৃদিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে।তার মানে অ্যানাবেলা কিছুই শোনেনি।

“আমার উপর রাগ,অভিমান যত মন চাই কর। তবে এটার জের ধরে নিজের প্রতি অবহেলা, অযত্ন করিস না প্লিজ।নিজেকে বড্ড অপরাধী লাগে আমার।আমাকে একটু সময় দে তোর রাগ ,অভিমান সব ভাঙিয়ে দেবো। দুপুর গড়িয়ে বিকাল হতে চললো।অথচ এখনো কিছুই মুখে দিলি না।এ কেমন অভিমান তোর?”

হৃদিতের কথায় মেহরিমা হতবাক হয়ে যায়!হৃদিতের উপর করা রাগ থেকে ও তো কিছুই করেনি।মন ভালো না থাকায় খাবার খাইনি।খেতে মন না চাইলে খাবেটা কিভাবে?আর এই মানুষটা কতদূর পর্যন্ত ভেবে নিয়েছে।কিন্তু ক্লান্ত মস্তিষ্ক সত্যটা বলতে একটুও ইচ্ছে প্রকাশ করলো না।

“বাবার অপারেশন ঠিকঠাক ভাবে শেষ হোক। তারপর খাবো।আপাতত খেতে ইচ্ছে করছেনা।”

“পানিটা নিয়ে মাধবীর সাথে ওয়াশ রুমে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে আয়।ভালো লাগবে।আমি খাবার নিয়ে আসছি।”

কথাটা বলে পানির বোতল মেহরিমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে দ্রুত পায়ে ওখান থেকে প্রস্থান করে হৃদিত।মেহরিমা হৃদিতের একরোখামিতে না চাইতেও মুচকি হাসে।ভালোবাসা বোধহয় এই ছোট ছোট কেয়ার গুলোর মধ্যেই লুকায়িত থাকে।এই দিক দিয়ে নিঃসন্দেহে মেহরিমা অনেক ভাগ্যবতী।মেহরিমা ঘাড় ঘুরিয়ে মাধবীর দিকে তাকায়।সেই সকাল থেকে কেঁদেকুটে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে মেয়েটা।

“এভাবে আর কতো কাঁদবে?কান্না করলেই কি সব কিছু ঠিক হয়ে যাবে?”

“আমার খুব কষ্ট হচ্ছে মেহু।বাবা ঠিক হয়ে যাবে তো?”

“কান্না না করে আল্লাহর কাছে দোয়া করো।দোয়া ইউনুস পড়তে থাকো।আল্লাহ যেনো এই বিপদ থেকে শিঘ্রই আমাদেরকে মুক্তি দেন।বাবাকে সুস্থ করে দেন।”

মাধবী কাঁদতে কাঁদতে মেহরিমাকে জড়িয়ে ধরে।

“আর কাঁদে না মাধুপু।ওয়াশ রুমে চলো হিজাব খুলে চোখে মুখে ভালো করে পানি দেবে।আমিও হিজাব ঠিক করবো।তখন তাড়াহুড়োতে হিজাবটাও ঠিকভাবে মারতে পারেনি।”

ওরা দু’বোন ওয়াশ রুমে চলে যায়।সেদিকে তাকিয়ে অবনী শেখ মলিন, বিষন্ন মুখেই হাসেন। ছোট্ট মেহরিমাটা এতো তাড়াতাড়ি এভাবে বড় হয়ে যাবে উনি কি তা কখনো ভেবেছিলেন।যেখানে মাধবীর শক্ত থাকার কথা সেখানে মেহরিমা শক্ত হয়ে বড়বোন কে আগলে রাখছে।দৃশ্যটা খুবই মনোমুগ্ধকর লাগে ওনার কাছে।মন জুড়িয়ে যায়।এজন্যই বোধহয় মানুষ বলে ‘সময় আর দায়িত্ব মানুষ কে সবচেয়ে বেশি ম্যাচিউর করে তোলে।বয়স!সে তো দুটো সংখ্যা মাত্র।”

মেহরিমা,মাধবী ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে হৃদিত খাবার হাতে দাড়িয়ে আছে। ওদের দেখতেই সামনে এগিয়ে আসে।

“এই করিডরের লাস্টেই খাওয়ার জন্য আলাদা একটা হলরুম আছে।ওখানে যেয়ে তোরা দু’জন খেয়ে নে।আমি বাকিদের খাওয়ানোর ব্যবস্থা করি।”

“আপনি খেয়েছেন?”

“হ্যাঁ।তোরা তাড়াতাড়ি খেয়ে আয় যা।”

হৃদিতের কথাটা মেহরিমার ঠিক বিশ্বাস হয়না। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে তাকিয়ে থাকে।হৃদিত আবারও তাড়া দিতেই তীব্র অনিচ্ছা নিয়ে খাবার গুলো হাতে করে হলরুমের উদ্দেশ্যে চলে যায় মেহরিমা,মাধবী।হৃদিত অবনী শেখের কাছে আসে।অবনী শেখ,আয়েশা চৌধুরী,আতিয়া চৌধুরী একসাথে বসে আছেন।তৃধা,তাবান,তাইফ বাইরে খেতে গেছে।হসপিটালে বসে খেতে পারবে না সেজন্য।আজাদ চৌধুরী আরিফ চৌধুরীর সাথে কি একটা কাজে বাইরে গেছেন।আয়াশ,আরিশা কে নিয়ে ওর বাবার বাসায় গেছে।ওদের সাথে আয়রা চৌধুরীর পুরো পরিবারও আছে।হসপিটালে থাকতে যেয়ে নাকি ওনাদের দম বন্ধ হয়ে আসছে।ঢাকাতে এসেছে সবে এক ঘন্টা।এসেই নিজেদের ঢং শুরু করে দিয়েছে।আয়াশ এক প্রকার বিরক্ত হয়ে ওনাদেরকে রেখে আসতে গেছে।আর এমনিতেও প্রয়োজন ছাড়া হসপিটালে ভিড় না জমানোই বেটার।শ্রেয়া চৌধুরী নিজেদের বাসায় গেছে।কেনো গেছে সেটা অবশ্য সকলের নিকট অজানা।

“মা,মেজোমা,ছোটমা তোমরা খাবে না?হসপিটালে পেশেন্টের পাশে থাকে সুস্থ সবল মানুষ।”

“আমরা ঠিক আছি বাবা।”

অবনী শেখের কথায় হৃদিত মলিন হেসে বলে,

“এখন নাহয় ঠিক আছেন মা।এভাবে না খেয়ে থাকলে কতক্ষন ঠিক থাকতে পারবেন?বাবার কাছে কিন্তু আমি অসুস্থ কাউকে অ্যালাও করবো না।”

হৃদিতের কথা বলার ধরন দেখে উপস্থিত তিন মায়েরই মুখে হাসি ফুটে ওঠে।আয়েশা চৌধুরী হৃদিতের হাত ধরে নিজের পাশে বসিয়ে দেন।

“পাগল ছেলে আমার।সবাই কে যে এতো খাওয়ানোর চেষ্টা করছিস,তা তুই খেয়েছিস কিছু?”

হৃদিত অকপটেই মিথ্যা বলে।

“হ্যাঁ আমি খেয়েই মেহরিমাদের জন্য খাবার নিয়ে আসলাম।তোমরা বসো আমি খাবার নিয়ে আসি।”

হৃদিত উঠতে নিলেই সেখানে উপস্থিত হয় শ্রেয়া চৌধুরী।ওনার সাথে দাঁড়িয়ে আছে একটা বিশ/একুশ বছরের মেয়ে।মেয়েটার হাতে খাবারের বড় একটা ব্যাগ।

“খাবার আনতে যেতে হবে না বাবা।আমি রান্না করে এনেছি।বাইরের তৈলাক্ত খাবার খাওয়ার দরকার নেই তোমাদের।অসুস্থ হয়ে পড়বে তো।”

“আপনাকে রান্না করতে কে বলেছে?এখানে কেউ খেতে চেয়েছে আপনার হাতের রান্না?”

মূহুর্তেই শ্রেয়া চৌধুরীর মুখে আঁধার নেমে আসে।ছলছল চোখে নিজের ছেলের দিকে তাকিয়ে থাকেন।

“আহা হৃদিত বাবা আমার,রাগ করেনা।আপা তো ভালোই করেছে।আপা আপনি এদিকে আসুন।ওর কথায় কিছু মনে কইরেন না।বোকা ছেলেটা আমার
কখন কোথায় কি যে বলে তার ঠিক নেই।”

আয়েশা চৌধুরীর বলা কথাটা তীরের মতো বিঁধে শ্রেয়া চৌধুরীর বুকে।শ্রেয়া চৌধুরী তখনও ছেলের দিকে তাকিয়ে আছেন।ওনার দৃষ্টি যেনো চিৎকার করে বলছে।’আমি জন্মদাত্রী মা হয়েও তোমার কাছে এতোটা পর হয়ে গেলাম বাবা?আমার থেকে অন্যদেরই তোমার উপর বেশি অধিকার হয়ে গেলো?এ কোন পাপের শাস্তি দিচ্ছ তুমি আমায়?’হৃদিত নিজের দৃষ্টি নামিয়ে নেয়।মায়ের করুণ দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকার ক্ষমতা ওর নেই।যতই হোক মা তো!এক সময় এই মানুষটাই ওর পৃথিবী ছিলো।তাই এই দৃষ্টিতে এখনও বুক কাঁপে।বুকটা ভার হয়ে ওঠে।মা তো পবিত্র,নিষ্পাপ হয় তাহলে ওর মা কেনো পাপী হলো?মা ছেলের মাঝে এমন আকাশ ছোঁয়া প্রাচীর কেনো উঠল?হৃদিতের দিকে তাকিয়ে অবনী শেখ মুচকি হাসেন।ছেলেটাকে বড্ড অদ্ভুত লাগে ওনার কাছে। ভেতরে এক আর বাইরে এক।শক্ত খোলসে মোড়ানো মানুষ গুলোই বোধহয় এমন।সবাই মিলে এক প্রকার জোর করে অবনী শেখকে খাওয়ানোর জন্য নিয়ে যান।অবনী শেখ হৃদিতের কথা ফেলতে না পেরে অনিচ্ছা নিয়েই ওনাদের সাথে যান।হৃদিত ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে বসে আছে।শ্রেয়া চৌধুরী ধীর পায়ে হেঁটে এসে দুরত্ব রেখে হৃদিতের পাশের চেয়ারে বসে।হাতে থাকা খাবারের বক্স টা দু’জনের মাঝের চেয়ারটাতে রাখে।

“আমি জানি তুমি এখনও কিছুই খাওনি।তোমার পছন্দের কাচ্চি রান্না করে এনেছি। তুমি আমার হাতের রান্না খাবেনা বলে শেফালিকে দিয়ে রান্না করিয়েছি।আমার কথাটা রাখো প্লিজ।খেয়ে নেও বাবা।”

হৃদিত ফ্লোরে দৃষ্টি রেখেই জবাব দেয়।

“ক্ষুধা নেই।”

“আমি খাইয়ে দিই?”

“প্রয়োজন নেই।”

কথাটা বলেই হৃদিত উঠে দাঁড়ায়। ততক্ষণে মেহরিমা, মাধবী উপস্থিত হয়েছে।

“এখানেই থাকিস।ডক্টর,নার্সদের কখন কি দরকার হয় না হয় বলা তো যায় না।কোনোকিছু দরকার পড়লেই আমাকে কল করবি।আমি কাছেই আছি।”

মেহরিমাকে জবাব টুকু দেওয়ার সুযোগ না দিয়েই ওখান থেকে দ্রুত কদম ফেলে চলে যায় হৃদিত। পিছনে ফেলে যায় এক জোড়া ছলছল চোখের ব্যথিত হৃদয়ের জননীকে।যে মানুষটার বুকের মাঝে বয়ে চলেছে ঘূর্ণিঝড়।শ্রেয়া চৌধুরী চোখে জল মুখে মলিন হাসি দিয়ে নিজের প্রাণের টুকরো ছেলের প্রস্থানের দিকে তাকিয়ে থাকে।আহ্ জীবন!এই জীবন যেন নাটকের চেয়েও নাটকীয়।যাদের জন্য সব ভুলে নতুন করে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছিলো।আজ যেনো এক নিমিষেই সবটা মিথ্যা হয়ে গেলো।শ্রেয়া চৌধুরী এই মূহুর্তে উপলব্ধি করলেন এই জীবনের আর কোনো মূল্য নেই।

“আমার বাবাটা সকাল থেকে এখনও কিছু খাইনি বউমা।ওর না খেয়ে থাকার অভ্যাস নেই।না খেয়ে থাকলে ও অসুস্থ হয়ে পড়ে।ওকে জোর করে হলেও খাইয়ে দিও।”

ভাঙা গলায় কথাগুলো বলেই ওখান থেকে চলে যান শ্রেয়া চৌধুরী।মেহরিমা শ্রেয়া চৌধুরীর যাওয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।পরক্ষণেই অযত্নে পড়ে থাকা খাবারের বক্সটার দিকে চোখ পড়তেই দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

#চলবে___

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_২৬
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌

গোধূলি লগ্নে আকাশে ছুটে চলেছে কালো মেঘের ভেলা।বৈরী বাতাসে গাছপালার সাথে সাথে যেনো সুউচ্চ বিল্ডিং গুলোও দুলে উঠছে।প্রকৃতি তমসাচ্ছন্ন।সময় বিকালের শেষ ভাগ হলেও প্রকৃতি দেখে তা বোঝার উপায় নেই।দেখে মনে হচ্ছে মধ্যরাত।হঠাৎ আকাশ ফেটে ঝিরিঝিরি বর্ষণ শুরু হয়।বর্ষণের হাত থেকে বাঁচতে সবাই দ্রুত পায়ে ছুটে চলেছে এদিকে ওদিকে।শীতের আগমন কে দ্বিগুণরুপে অনুভব করানোর জন্যই ধরনীর বুকে এই বর্ষণ।

হৃদিত রাস্তার পাশে একটা ছাতিম গাছের নিচে একমনে দাঁড়িয়ে আছে।হাতের দু’আঙুলের ভাঁজে জ্বলন্ত সিগারেট।অর্ধেকটা আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।মনের ভেতরটাও ঠিক এভাবেই পুড়ে চলেছে অনিমেষ।হাহ্!সেই খবর কি কেউ রাখে?সবাই তো শুধু কঠিন,গম্ভীর হৃদিত টাকেই দেখতে পাই।হৃদিত সিগারেটে একটান দিয়ে দৃষ্টিপাত করে মাথার উপরে থাকা গাছটার শুভ্র রঙা গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলগুলোর দিকে।

শীতের শুরুতেই ফোটে ছাতিম ফুল। স্থানীয়ভাবে কোনো কোনো যায়গায় ছাতিয়ান,ছাত্তিয়ান নামেও পরিচিত এই গাছ।গোধূলি বেলা থেকে সারা রাত ঝাপটা বাতাসে সুন্দর মধুমাখা মাদকতাময় সুগন্ধ ছড়িয়ে থাকে এই ফুল।হৃদিত গাছের নামটা মনে করার চেষ্টা করে।পরক্ষণেই ওর মনে পড়ে যায় গাছটার নাম ‘ডেভিলস ট্রি’।ওর বাগান বাড়িতেও দুটো এই গাছ লাগানো আছে।একটা ওর দোলতার বেডরুমের ব্যালকনি বরাবর আরেকটা মেইন গেইটের সামনে।শুভ্র রঙা ফুল গুলো দেখতে হৃদিতের খুব ভালো লাগে।প্রকৃতির নৈস্বর্গিক সৌন্দর্যৈর বাহার দেখে মনটা হালকা হয়। পরক্ষণেই কিছু একটা মনে পড়তেই চোখদুটো ছলছল করে ওঠে।ততক্ষণে জোরালো বর্ষণ শুরু হয়েছে।যার ফলে অনায়াসেই চোখের পানি লুকিয়ে ফেলতে পারে।হৃদিতের গায়ে থাকা সফেদ রঙা শার্টটা ভিজে চুপচুপে হয়ে শক্ত পোক্ত সুঠাম পুরুষালি দেহের সাথে লেপ্টে আছে।বৃষ্টির ফোঁটা সুদর্শন মুখখানার সৌন্দর্য আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

“রাস্তায় দাঁড়িয়ে নিজের সৌন্দর্য দেখিয়ে মেয়ে পটাচ্ছেন?এই কয়দিনেই বুঝি পুরোনো হয়ে গেলাম?”

মেহরিমার কন্ঠে স্পষ্ট অভিমান। নিজের প্রেয়সীর অভিমানী কন্ঠ শুনতেই মুচকি হাসে হৃদিত।ঘাড় ঘুরিয়ে মেহরিমার দিকে দৃষ্টিপাত করে।একটা পার্পল কালারের ছাতা নিয়ে মুখটা ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।শরীরে জড়ানো ডিপ মেরুন কালারের থ্রি পিচ।তীব্র বৃষ্টির ফলে মাথার উপর ছাতা থাকা সত্ত্বেও অনেকটা ভিজে গেছে।দেখতে মোহনীয় লাগছে।হৃদিত ঠোঁট কামড়ে আবারও মুচকি হাসে।মুখে বলে,

“তাই বুঝি?”

“আজ্ঞে হ্যাঁ।”

“বৃষ্টির মধ্যে আসতে গেলি কেনো?কল‌ দিলেই পারতিস।”

“আপনার ফোন বন্ধ দেখাচ্ছে। অনেক বার ট্রাই করেছি।”

হৃদিত পকেট হাতড়ে ফোন বের করে। সত্যিই ফোনটা বন্ধ হয়ে গেছে।

“সরি জান। চার্জ শেষ।আমি খেয়াল করি নাই।”

মেহরিমা এগিয়ে এসে হৃদিতের মাথার উপর ছাতাটা ধরার চেষ্টা করে।অনেক কষ্টে দু’পায়ের পাতার উপর ভর দিয়ে ছাতা ধরতে সফল হয়।মেহরিমার কান্ড দেখে এ পর্যায়ে হৃদিত হেসে ওঠে।মেহরিমা লজ্জা পেয়ে যায়।দু’জনের মাঝে এক ইঞ্চি ব্যবধান।

“আমি মাঝে মাঝে অবাক হই!এতটুকু একটা মেয়ে আমাকে দিব্যি হাতের ইশারায় নাচিয়ে চলেছে।”

কথাটা বলে হাতে থাকা জ্বলন্ত সিগারেট টা ছুঁড়ে ফেলে দেয় মাটিতে।মেহরিমার নরম কোমর আকড়ে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয়।চারপাশে ঘুটঘুটে অন্ধকার।বৃষ্টির ঝাপটায় ল্যাম্পপোস্টের নিয়ন আলোয় চারিপাশটা অস্পষ্ট দেখাচ্ছে।আশেপাশে মানুষের কোনো চিহ্ন নেই।হঠাৎ হৃদিতের ঠান্ডা হাতের স্পর্শে কেঁপে ওঠে মেহরিমা।কোনোরকমে বলে,

“কেউ দেখে ফেলবে ছাড়ুন।”

“এখানে কেউ আছে নাকি?আর থাকলেও হু কেয়ারস?”

মেহরিমা কে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ন্যানো সেকেন্ডের ব্যবধানে উঁচু করে তুলে গাছের সাথে চেপে ধরে।হাতে থাকা ছাতাটা রাস্তার দিকে ধরে নিজেদের আড়াল করে অধরে অধর মিশিয়ে দেয়।মেহরিমা ছটফটিয়ে ওঠে।শক্ত পোক্ত শরীরের মাঝে থেকে ছাড়া পেতে অনবরত মোচড়া মুচড়ি করতে থাকে।কিন্তু হৃদিতের সুঠাম পুরুষালি দেহের কাছে ও নেহাতই একটা মশা।এভাবে হুদাই মোচড়া মুচড়ি করে কোনো কাজ হবে না বুঝতে পেরেই একসময় নিজে থেকেই শান্ত হয়ে যায়।হৃদিতের অবাধ্য হাতের বিচরণ ও থেমে যায়।সময় নিয়ে ছাড়ে মেহরিমাকে।মেহরিমা লজ্জায় চোখ মুখ খিচে বন্ধ করে রেখেছে।হৃদিতের ঠোঁটে আত্মতৃপ্তির হাসি।

“তোর ভালোবাসা ছাড়া এতক্ষণ নিজেকে অসম্পূর্ণ লাগছিল।নাউ আ’ম ফুলফিল।”

“সিগারেট খেয়ে চু মু খেতে আসবেন না।আই হেইট সিগারেট।ওটার গন্ধ আমার সহ্য হয়না।”

“তাহলে কি খেয়ে চু মু খেতে আসবো? হুইস্কি খেয়ে?ওটা বুঝি ভালো লাগে তোর?”

“দেখুন…”

মেহরিমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে হৃদিত বলে,

“উইল ইয়্যু শো আপ হেয়ার?আ’ম…”

মেহরিমা দ্রুত হৃদিতের মুখ চেপে ধরে।হৃদিতের কথা অসম্পূর্ণই থেকে যায়।

“আর একটাও উল্টাপাল্টা কথা না।আপনি আমায় একটুও ভালোবাসেন না তাই না?এজন্যই আমার কথা শুনতে চাচ্ছেন না।”

“আ’ম সরি লিটল কিটি।আর হবে না।”

হৃদিতের অসহায় চাহনি।সেটা দেখতেই মেহরিমা ফিক করে হেসে ওঠে।গতকাল রাতের পর থেকে এই প্রথম একটু হাসে মেহরিমা।হৃদিতের বক্ষস্থলে প্রশান্তি অনুভূত হয়।মেহরিমা হাসি থামিয়ে নিজে থেকেই বলে,

“জানেন,আল্লাহর রহমতে বাবার অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছে।ডক্টর আঙ্কেল জানিয়েছেন দুই,এক ঘন্টার মাঝেই বাবার সেন্স ফিরে আসবে।”

“ভালো তো।”

“ভালো কি হু?বলুন আলহামদুলিল্লাহ।”

হৃদিত মৃদু হেসে আলহামদুলিল্লাহ বলে।মেহরিমা চুপচাপ হৃদিতের হাত ধরে সামনে হাঁটতে থাকে।হৃদিত ও চুপচাপ ভদ্র ছেলের মতো মেহরিমার সাথে তাল মিলিয়ে হাটে।লিফটে উঠে সাত তলার বাটন চেপে হৃদিতের দিকে পূর্ণ দৃষ্টিতে তাকায় মেহরিমা।

“আমাকে মিথ্যা কেনো বলেছেন?”

মেহরিমার কথায় হৃদিত ভ্র যুগল কুঁচকে ফেলে।

“কিসের মিথ্যা?”

“আপনি আজ সারাদিন না খেয়ে আছেন কেনো?”

“ইচ্ছে হয়নি তাই।”

“আমিও না খেয়ে আছি।”

কথাটা শুনতেই হৃদিতের ভ্রু জোড়া শিথিল হয়ে যায়।অবাক কন্ঠে বলে,

“তখন তুই খাস নি?”

“না।”

“কিন্তু কেনো।”

“ইচ্ছে নেই তাই।”

হৃদিতের কন্ঠে এবার অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে।এগিয়ে এসে মেহরিমার মুখটা দু হাতের মাঝে নিয়ে বলে,

“তাই বলে তুই সারাটা দিন না খেয়ে থাকবি জান?সব ভুল আমার।তোর দিকে আরও ভালোভাবে খেয়াল রাখা উচিত ছিলো।আমায় ক্ষমা করে দে।খুব কষ্ট হচ্ছে তাই না সোনা?”

হৃদিতের এতো ভালোবাসা পেয়ে মেহরিমা আপ্লুত হয়ে পড়ে।চোখের কোণায় জলেরা চিকচিক করে ওঠে।অভিমানী কন্ঠে বলে,

“আরেকজন ও তো না খেয়ে আছে সেই বেলায় কিছু না তাই না?তাকে বলে দিবেন তিনি না খেলে এই মেহুও খাবে না হু।সে কি শুধু একাই ভালোবাসতে জানে নাকি!”

মেহরিমার বাচ্চামিতে হৃদিত না চাইতেও হেসে ওঠে।চোখের পানি মুছে দিয়ে কপালে ভালোবাসার পরশ এঁকে দেয়।

“মহারানী,আমার বড় ভুল হয়ে গেছে।এখন কি ভুলের জন্য এই অধমের গর্দানটা নিয়ে নিবেন? আপনি চাইলে নিতে পারেন।”

“এইবার প্রথম ভুল সেজন্য ক্ষমা করা হলো। পরবর্তীতে কিন্তু আর ক্ষমা পাবেন না।সত্যিই গর্দান নিয়ে নেবো।”

“যথা আজ্ঞা মহারানী।”

দু’জন দু’জনের দিকে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে পরক্ষণেই হেসে ওঠে। নিজেদের ফ্লোরে পৌঁছাতেই ওরা লিফট থেকে বের হয়ে আসে।মেহরিমা হৃদিতকে নিজের পিছু পিছু আসতে বলে সোজা হলরুমের দিকে চলে যায়।

দু’জন কে অর্ধভিজে অবস্থাতে দেখতেই করিডোরে উপস্থিত বাড়ির সবাই চাঁপা হাসে।জলিল শেখের অপারেশনটা ঠিকঠাক ভাবে হওয়াতে সবাই অনেকটা টেনশন ফ্রি এখন।মেহরিমা হাত ধুয়ে আসে।হৃদিত ততক্ষণে মেহরিমার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে।ওর ওড়না নিয়ে মাথা মুছতে মুছতে বলে,

“খেয়ে আমার সাথে বাসায় যাবি। ড্রেস চেঞ্জ করতে হবে।এভাবে বেশিক্ষণ থাকলে তোর ঠান্ডা লেগে যাবে।”

“আর নিজের যে ইতোমধ্যে নাকমুখ লাল হয়ে গেছে সেদিকে খেয়াল আছে?”

“এইতো এখন তুই খেয়াল করলি।তুই আর আমি তো একই হলাম তাই না?”

“থাক আর ঢং করতে হবে না।জলদি খেয়ে নিন‌।”

কয়েক সেকেন্ড পেরোতেই হৃদিত হাঁচি দিতে শুরু করে।মুখমণ্ডল লাল টকটকে হয়ে ওঠে।মেহরিমা হৃদিতের কপালে হাত দিয়ে দেখে তাপমাত্রা তুলনামূলক অনেকটা বেশি।মেহরিমার রাগে কষ্টে কান্না পায়।

“বৃষ্টির পানি যখন সহ্য হয়না তখন ভিজতে যান কেনো?এক ঝামেলার মধ্যে আরেক ঝামেলা না বাধালে আপনার ভালো লাগে না তাই না?”

“বৃষ্টির পানির সাথে নিজের মনের সব ক্ষত,বিষাদ ধুয়ে নিঃশেষ করে দিতে।দেহের জ্বর হলে কেয়ার করার জন্য তুই আছিস,আরও কতশত মেডিসিন আছে।কিন্তু মনের ক্ষত!সেটা ঠিক করার জন্য তো কেউ নেই,কোনো মেডিসিন নেই।সেটা তো দিনশেষে আমাকেই সারতে হবে জান।”

মেহরিমা অবাক হয়ে সবটা শোনে।ঠোঁটে হাসি টেনে বলে,

“ক্ষত সারতে চাইলে বারবার সেটাকে স্পর্শ করা বন্ধ করুন।আমাদের জীবন মায়ায় আটকে যাওয়া এক অবরুদ্ধ কারাগার।আর কথা যখন মা বাবা পরিবার কে নিয়ে তখন সেই মায়া অসীম। চেষ্টা করুন আপনিও ক্ষত সেরে উঠতে পারবেন। আপনাদের ভেতরের কোনো কিছুই আমি জানিনা তবে সব সময় আপনার পাশে আমাকে পাবেন।”

“আমার জীবনের গল্পটা ভূমিকাহীন অ্যাঞ্জেলা।তুই খুব সহজেই সবটা পড়তে পারবি কিন্তু বুঝে উঠতে পারবিনা।”

“আপনাকে বোঝার জন্য জানার জন্য আমার সারাটা জীবন পড়ে আছে।প্রতিদিন একটু একটু করে জানবো,বুঝবো তাহলে তো হবে?”

প্রত্যুত্তরে হৃদিত মুচকি হাসে।মেহরিমা আর কথা না বাড়িয়ে শ্রেয়া চৌধুরীর আনা বক্স থেকে খাবার তুলে হৃদিতের মুখের সামনে ধরে।আর অমনিই হৃদিতের চোয়াল শক্ত হয়ে যায়।

“এটা ওনার আনা খাবার তাই না?”

“কার?”অবুঝের ন্যায় বলে মেহরিমা।

“শ্রেয়া চৌধুরীর।”

“খাবার তো খাবারই।এখানে কি কোথাও মায়ের নাম লেখা আছে?কথা কম বলে খেয়ে নিন তো। আমার প্রচন্ড ক্ষুধা পেয়েছে।”

হৃদিত কথা বলার জন্য মুখ খুলতেই মেহরিমা ওর মুখে খাবার পুরে দেয়।হৃদিতের হাবভাব দেখে তৎক্ষণাৎ বলে ওঠে,

“খাবার ফেলে দিলে কিন্তু আমি আর খাবো না।”

ব্যস অমনিই অগত্যা হৃদিতকে অনিচ্ছা নিয়েই খেতে হয়।মেহরিমা মনে মনে হাসে।এই ছেলেকে সোজা করা ওর বাম হাতের ব্যপার।

“বাবার সেন্স আসলে তারপর বাসায় যাই প্লিজ।”

“নো।তোকে নিয়ে আমি কোনো রিস্ক নিতে পারবো না জান।এখান থেকে এমপির বাসা মাত্র দশ মিনিটের রাস্তা।”

“কিন্তু ওখানে যেয়ে আমি পরবো টা কি?”

“ওয়েল লিভ ইট।ইয়্যু ডোন্ট হ্যাভ টু অয়্যার অ্যানিথিং।এমনিতেও একটু আগেই তো তুই বললি..”

মেহরিমা কটমট করে তাকায়।হৃদিত চুপ হয়ে যায়।ঠোঁটে দুষ্টু হাসি।

জানালার নিকট দাঁড়িয়ে থাকা শ্রেয়া চৌধুরীর মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে ওঠে।ওদের কথা শুনতে না পারলেও নিজের হাতে রান্না করা খাবার ছেলেকে খাওয়াতে পেরে মনে মনে মেহরিমার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।হৃদিত মায়ের হাতের খাবারের স্বাদ খুব সহজেই বুঝে যায়।তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে জানালার দিকে তাকায়।

“ভেবো না এসব করে নিজের পাপকে মুছতে পারবে।মেহুমা অতীত জানে না বিধায় এগুলো করছে।জানলে তোমার প্রাপ্য শাস্তি ও নিজেই দেবে।”

নিজের স্বামীর কথায় শ্রেয়া চৌধুরী হেসে উঠে বলেন,

“আমার সাথে তুমিও তো সমান দোষী।সমস্যা নেই দু’জনে একসাথে মিলে শাস্তি ভোগ করবো কেমন?”

আরিফ চৌধুরীর মুখটা থমথমে হয়ে যায়।রক্তচক্ষু দিয়ে শ্রেয়া চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে থাকেন।শ্রেয়া চৌধুরীর মুখে কুটিল হাসি।

#চলবে___

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে