কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-২৩+২৪

0
72

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_২৩
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

অম্বরে কালো মেঘের ভেলা ছুটে চলেছে এদিকে ওদিকে।মেঘের আড়ালে নিজের সুন্দর মুখখানা লুকিয়েছে শশী।বইছে বৈরী পবন।সুবিশাল অম্বরে নিজের উপস্থিতি জানান দিতে ক্ষণে ক্ষণে ডেকে চলেছে কাদম্বিনীর দল।চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার।থেকে থেকে ভেসে আসছে শেয়ালের ডাক।শীতের কুয়াশামাখা রাত।আশেপাশে সবটা কুয়াশায় আচ্ছন্ন।ছাদে দোলনায় বসে আছে মেহরিমা।ধ্যান, জ্ঞান কোথায় পড়ে আছে বোঝা মুশকিল।মেহরিমার দৃষ্টি যেয়ে থেমেছে চৌধুরী বাড়ির ডান পাশের জঙ্গলে। যেথায় মনের আনন্দে ছুটে চলেছে একঝাঁক জোনাকি।ওর কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে হৃদিত।দৃষ্টি অ্যানাবেলার মুখমণ্ডলে।তখন মেহরিমার প্রশ্নের কোনো জবাব দেয় নি হৃদিত।মেহরিমার হাত ধরে নিয়ে এসে দোলনায় বসিয়ে কোলে মাথা রেখে শুয়ে পড়েছে।আর কোনো টুঁশব্দ করেনি।মেহরিমাও আগ বাড়িয়ে কথা বলেনি।এভাবে নিরবতায় কেটেছে বেশ কিছুক্ষণ।

“আমায় বিশ্বাস করিস?”

মেহরিমার ধ্যান ভাঙে।হৃদিতের মুখের দিকে দৃষ্টিপাত করে।সময় নিয়ে জবাব দেয়।

“নিজের থেকেও বেশি।”

“তাহলে আমার উপর ভরসা রাখ।খুব শিঘ্রই সবটা ঠিক হয়ে যাবে।আমাদেরও সুন্দর একটা সংসার হবে।”

“আচ্ছা রাখলাম ভরসা।”

“তুই সবচেয়ে বেশি কাদের ঘৃণা করিস?”

“বিশ্বাসঘাতক,পাপী দের।”

“যদি আমিও তাদের মধ্যে একজন হয়ে থাকি?”

মেহরিমা চুপ হয়ে যায়।আবারও নিস্তব্ধতায় ছেয়ে যায় চারিপাশ।আকাশ চিরে আলোর ঝলকানি রেখা ফুটে ওঠে।মেহরিমা আঁখিযুগল বন্ধ করে নেয়।সেভাবেই মৃদু কন্ঠে উত্তর দেয়।

“আমার কাছে সব পাপীরা সমান।”

“যদি কখনও আমাকে তোর পাপী মনে হয়।ডিরেক্ট বুকে ছু রি চালিয়ে দিবি।কখনো বিচ্ছেদ চাইবি না।বিচ্ছেদের যন্ত্রণা আমি সইতে পারবো না।তোর হাতে
ম র তে সদা প্রস্তুত আমি।তবুও একান্ত তোর হয়েই
ম র তে চাই।”

“পাপীকে একবারেই মে রে ফেলাতে কোনো শান্তি নেই।প্রতি সেকেন্ড,প্রতি মিনিট,রোজ নিয়ম করে
মা রা তে আলাদা শান্তি আছে।”

হৃদিতের হৃদয় কিছু সময়ের জন্য থমকায়। অবিশ্বাস্য চাহনি দিয়ে মেহরিমার দিকে তাকিয়ে থাকে।এই মেহরিমা তো হৃদিতের মেহরিমা না। সম্পূর্ণ নতুন ভিন্ন এক মেহরিমা।মেহরিমা মুচকি হাসে।

“আপনি তো আর বিশ্বাসঘাতক,পাপী নন।আপনি আমার ভালোবাসার পবিত্র একজন মানুষ। আপনার ভালোবাসায় আমি মুগ্ধ হই প্রতিক্ষণ। আপনার ভালোবাসা আমার হৃদয়ে ছড়ায় ফুলের সুবাস।আল্লাহর দেওয়া সেরা উপহার আপনি।”

“আমার দ্বারা কখনো কোনো ভুল হলে একবার সুযোগ দিস।যেভাবেই হোক নিজের করে রেখে দিস।জীবন তো একটাই।পুনর্জন্ম তো আর হবে না তোকে আবার নিজের করে পাওয়ার জন্য,তোকে দু’চোখ ভরে দেখার জন্য।”

মেহরিমা স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।হৃদিত নিজেকে সামলায়।মেহরিমার ডানহাত দুহাতের মুঠোয় নিয়ে টপাটপ চু মু বসিয়ে দেয়।মেহরিমাকে হারানোর ভয় চারিদিক থেকে জেঁকে ধরে।ভেতরে ভেতরে দিশেহারা হয়ে পড়ে।

“আপনার সেজো বাবা আয়মান চৌধুরী কিভাবে মারা গেছিল?”

“খু ন করা হয়েছে ওনাকে।”

হৃদিতের কথায় মেহরিমার ঠোঁট দুটো নিজে থেকেই দুদিকে সরে যায়।নিজের হতভম্ব ভাব কাটাতে কয়েক মিনিট সময় লাগে মেহরিমার।

“কে করেছে খু ন? আপনাদের মতো শক্তিশালী মানুষেরা তাকে শাস্তি না দিয়ে যুগ যুগ ধরে ঘটনা লুকিয়ে রেখেছেন কেনো?”

“সময় হলে জানতে পারবি।তাড়াহুড়ো করে জানাতে স্বস্তি পাবি না।সময় নিয়ে সবটা জানলে তবেই স্বস্তি পাবি।মনের আগুন নিভাতে পারবি।তুই যেটা জানতে চাচ্ছিস সেটা তো ঘটনার মধ্যস্থান।আর খু ন সেটা তোর খুব কাছের একজন করেছে।আয়মান চৌধুরী ওনার প্রাপ্য শাস্তি পেয়েছেন।”

মেহরিমার চোখদুটো অক্ষীকোটর থেকে বেরিয়ে আসার উপক্রম।ওদের কথার মাঝেই অম্বর চিঁড়ে ধরনীর বুকে ঝমঝমিয়ে বৃষ্টি নামে।ততক্ষণে দু’জনে উঠে দাঁড়িয়েছে।সেকেন্ডের ব্যবধানে দু’জনে কাকভেজা হয়ে যায়।মেহরিমার গায়ে থাকা শুভ্ররঙা কামিজ বাঁকানো তনুর সাথে লেপ্টে গেছে।মুখে বৃষ্টির ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা লেগে আছে।বিদ্যুতের ঝলকানির আলোয় চারিপাশ আলোকিত হয়ে ওঠে।সেই আলোয় মেহরিমাকে দেখতে বড্ড আবেদনময়ী লাগে।মুখে লেগে থাকা বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু কণা গুলো ঝলমল করছে।মায়ের দেওয়া ছোট্ট নাকফুলটা মুক্তোর দানার মতো চকচক করে উঠছে।সৌন্দর্য আরও কয়েকগুণ বেড়ে গেছে।বৃষ্টির কণাগুলোর উপর হৃদিতের খুব হিং সা হয়।কেমন নির্লজ্জের মতো অ্যানাবেলাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে প্রতিক্ষণ।ক্ষমতা থাকলে এক্ষুনি এই বৃষ্টির কণাগুলোকে কে টে কুচি কুচি করতো।হৃদিত কয়েক কদম এগিয়ে এসে মেহরিমার গা ঘেঁষে সামনাসামনি দাঁড়ায়।মেহরিমা কিছু বলতে নিলেই ওর কামিজ গলিয়ে আলতো হাতে নরম কোমর খামচে ধরে নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় হৃদিত।মেহরিমা চোখজোড়া বন্ধ করে ফেলে।নিজের ভার ছেড়ে দেয় হৃদিতের উপর।হৃদিত মেহরিমার ঠোঁটে থাম্ব দিয়ে আলতো করে স্লাইড করতে করতে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

“আমার স্নিগ্ধ পবিত্র কাঠগোলাপ।
মায়াবতী শুভ্র রঙা বেলি ফুলের মায়া ছেড়েছি সেদিন,
স্নিগ্ধ পবিত্র কাঠগোলাপের আসক্তি আমায় নিঃস্ব করেছে যেদিন।”
কলমে~ইসরাত তন্বী

মেহরিমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই কোলে তুলে নেয়।মেহরিমা লজ্জায় হৃদিতের সুদৃঢ় বক্ষস্থলে মুখ লুকায়।সিঁড়ির দরজার নিকট থেকে একটা মানব ছায়া দ্রত কদমে সরে যায়।মুখে তার কুৎসিত হাসি।খেলার ছক উল্টিয়ে দেওয়ার হাতিয়ার পেয়ে গেছে কি না!এবার জয় তার হবেই।

________

সকাল সকাল চৌধুরী বাড়িতে উপস্থিত হয়েছে আয়াশ।মূলত আয়রা চৌধুরীদের সাথে দেখা করতে এসেছে।থাকবে দিন দুই মতো।বাড়ির সামনে পুকুরের পাড়ে বানানো বেঞ্চ গুলোতে বসে ছোটরা আড্ডা দিচ্ছে।হাসি ঠাট্টায় মেতে উঠেছে আড্ডার আসর।হঠাৎ সেখানে আরিফ চৌধুরী উপস্থিত হন।

“আয়াশ শহরের *** হসপিটালে যেতে হবে। আমার বেস্টফ্রেন্ড লিয়াকত হাওলাদারের একমাত্র মেয়ের উপর অ্যাসিড অ্যাটাক হয়েছিল জানো তো তুমি।ঐশী মায়ের অবস্থা শোচনীয়।আজ দুপুর দু’টোই ওদের ফ্লাইট।লন্ডন নিয়ে যাবে ট্রিটমেন্টের জন্য।”

“এখনই যাবে তুমি?”

“হ্যাঁ।”

“আচ্ছা বসো আমি রেডি হয়ে আসছি। থানায় যেতে হবে একটু।শপিং কমপ্লেক্সের অ্যাসিড অ্যাটাক টা নিয়ে এসআই এর সাথে কিছু আলোচনা করতে হবে।এতো বড় একটা ক্রা ই মে র কোনো ক্লু পাওয়া যাবে না এটা কোনো কথা হলো!”

আয়াশ বাড়ির ভেতরে চলে যায়।আরিফ চৌধুরীর দৃষ্টি যেয়ে পড়ে মেহরিমার উপর।কোনো এক অদৃশ্য বেদনায় বুকটা চিনচিন করে ওঠে।মেহরিমা সবটা নিরব হয়ে শোনে।আয়াশ,আরিফ চৌধুরীর কথোপকথন শুনে সেদিন শপিং কমপ্লেক্সে দেখা হওয়া মেয়েটার কথা মনে পড়ে যায়।ওই মেয়েটাও তো বলেছিল উনি বাবার বেস্ট ফ্রেন্ডের মেয়ে।তবে কি ওই মেয়েটাই ঐশী?মেহরিমা দুইদিন আগে হৃদিতের থেকে জেনেছে ওই শপিং কমপ্লেক্সটা হৃদিতদের।

“মেহুমা সেদিন শপিং কমপ্লেক্সে তোমাদের সাথে কারোর কোনো ঝামেলা হয়েছিল কি?”

মেহরিমা সময় নিয়ে আস্তে ধীরে সেদিন ওদের সাথে ঘটে যাওয়া সবটা খুলে বলে।মূলত ও যতটুকু জানে ততটুকুই বলে।সন্দেহের মতো কেউ কিছুই খুঁজে পাই না।সবটা শুনতেই আরিফ চৌধুরীর মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়।যেটা মেহরিমার চোখ এড়ায় না।আয়াশ ও ততক্ষণে হাজির হয়েছে।অতঃপর বাবা ছেলে মিলে নিজেদের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়ে।ওদের সামনে পিছনে গার্ডসহ পুলিশের আরও দুটো গাড়ি বের হয় চৌধুরী বাড়ি থেকে।আড্ডাটাও ভেঙে যায়।যে যার মতো নিজেদের ঘরের দিকে হাঁটা ধরে।নিজের রুমের জানালার পাশে দাঁড়িয়ে সবটা লক্ষ্য করে হৃদিত।ঠোঁটে বাঁকা হাসি।পকেট থেকে ফোন বের করে কল লাগায় আনসেইভ এক নম্বরে।অ্যানাবেলার চোখে ভালো হওয়ার জন্য,অ্যানাবেলাকে সারাজীবন নিজের করে রাখার জন্য সব করতে প্রস্তুত হৃদিত।কিন্তু আমরা চাইলেই কি আর সব হয়?কে জানে হৃদিতের পরিকল্পনা কতটুকু সফল হবে!মেহরিমা সদর দরজায় পা রাখতেই ওর পিঠে কিছু একটা এসে পড়ে।ও পিছু ফিরে চায়।নিচে তাকাতেই একটা কাগজের খন্ডাংশ দেখতে পাই।কাগজ টা উঠিয়ে নেয় মেহরিমা।আশেপাশে তাকিয়ে কাউকেই দেখতে পাই না।ওটা খুলতেই চক্ষুগোচর হয় ছোট ছোট অক্ষরে লেখা ক্ষুদ্র বার্তা।

“ভালোবেসে বিশ্বাস করা ভালো তবে অন্ধবিশ্বাস না।দেইখো শেষ পর্যন্ত যেন তোমাকে ঠকে যেতে না হয়!মানুষ বাইরে যেমন দেখায় আসলে কিন্তু তেমন না।”

লেখাটুকু পড়ে মেহরিমা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।কথাগুলোর মর্মার্থ বুঝতে মস্তিষ্ক কিলবিল করে ওঠে।

#চলবে___

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_২৪
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

মেহরিমা উদাসীন হয়ে ব্যালকনির দোলনায় বসে আছে।নিজের জীবনের হিসাব মেলাতে বড়ই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে।কয়েকদিনের ব্যবধানেই জীবনটা এতো জটিল হয়ে পড়বে মেহরিমা কি তা কষ্মিনকালেও ভেবেছিল!মেহরিমার আকাশ কুসুম ভাবনার মাঝেই ওখানে হৃদিত উপস্থিত হয়।

“এখানে একা বসে কি করছিস?”

মেহরিমা ধ্যান চ্যুত হয়।রয়ে সয়ে জবাব দেয়,

“কিছু না।”

“মন খারাপ?”

“উহু।”

“তাহলে?”

“আপনি কখনো আমার বিশ্বাস ভেঙ্গে দিবেন না তো?”

“এমনটা মনে হওয়ায় কারণ?”

“জানি না।তবে অজানা এক ভয় আমাকে চারিদিক থেকে জেঁকে ধরেছে।”

“একটা সম্পর্কে রাগ,অভিমান,জেদ, ভালোবাসা, কষ্ট সবটা থাকে লিটল কিটি।যেই সম্পর্কে এইসব কোনো কিছু নেই শুধু ভালোবাসা আছে ওগুলো লোক দেখানো সম্পর্ক।আর একটা সম্পর্কের ভিত্তি হচ্ছে একে অপরের প্রতি বিশ্বাস।যখনই কোনো তৃতীয় পক্ষ প্রবেশ করবে একটা সম্পর্কে,তখনই সম্পর্ক ভাঙতে শুরু করবে।অ্যাক্চুয়ালি আমি বোঝাতে চাচ্ছি তুই কোনো তৃতীয় পক্ষের কথায় নাচিস না। আমাকে নিয়ে যত অভিযোগ সেটা আমার কাছেই করবি।এই দেয়ালের বাইরে যেনো না যায় সেই অভিযোগ।তোকে ভালো রাখার দায়িত্ব আমি নিয়েছি কোনো তৃতীয় পক্ষ না।”

মেহরিমা নির্বিকার চাহনি দিয়ে তাকিয়ে থাকে। কথাগুলো খুব করে মস্তিষ্কে গেঁথে নেয়।হৃদিত কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে এগিয়ে আসে।মেহরিমার মুখোমুখি হয়ে ফ্লোরে হাঁটু মুড়ে বসে।মেহরিমার ঠান্ডা কনকনে হাত দুটো নিজের উষ্ণ হাতের মুঠোয় পুরে নেয়।

“ঠিকমতো নিজের যত্ন নিচ্ছিস না কেনো?”

“তার জন্য আপনি আছেন তো।”

“ঠান্ডায় কোনো গরম কাপড় পরিসনি যে?”

“ঠান্ডা লাগছে না তো।”

“আমার তো লাগছে।”

“ঘরে যেয়ে গরম কাপড় পরে আসুন।”

“ওই কাপড়ে হবে না।তোকে লাগবে।তুই না হট? মাত্রই তো বললি!”

মেহরিমা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।এটা আবার কখন বললো?হৃদিতের কথার উদ্দেশ্যে বুঝতেই মূহুর্তেই মেহরিমা লজ্জা পেয়ে যায়।এই মানুষ টা আজকাল একটু বেশিই লজ্জা দেয় যেন।কোন কথা কোথায় নিয়ে গেছে ভাবা যায়!মেহরিমার মুখের দিকে তাকিয়ে সুক্ষ্ম হাসে হৃদিত।মেহরিমার হাতে অধর ছুঁয়ে দিয়ে নরম কন্ঠে বলে,

“আমাকে কখনো ছেড়ে যাবি না তো?”

“কাউকে ভালোবাসলে ছেড়ে যাওয়া যায় নাকি?”

“ভালোবাসিস আমায়?”

“মন তো বলে বাসে।”

“কতটুকু?”

“জানিনা।তবে যতটুকু ভালোবাসলে আপনাকে জান্নাতেও পাবো ঠিক ততটুকুই ভালোবাসতে চাই।”

“ইহজীবনেই আমার সাথে নিজের সব শখ আহ্লাদ মিটিয়ে নে।ওই জীবনে আমাকে নিজের সঙ্গী হিসেবে পাবি না।তুই পবিত্র,স্নিগ্ধ।অথচ আমি,নি..”

হৃদিতের অধর জোড়া আঙ্গুল দিয়ে চেপে ধরে মেহরিমা।হৃদিতকে নিজের কথা শেষ করতে না দিয়েই বলে,

“আপনি ভালো খারাপ যেমনই হন না কেনো। ইহকাল,পরকাল সব কালেই আপনাকেই লাগবে আমার।আর এমন কথা কক্ষনো বলবেন না।”

হৃদিত মেহরিমা কে নিয়ে উঠে দাঁড়ায়।মেহরিমার বোকামিতে,সরলতায় মুচকি হেসে ওকে বুকে জড়িয়ে নেয়।

“আচ্ছা বলবো না।মধুচন্দ্রিমা কোথায় করতে চাস? বাংলাদেশ?নাকি অ্যাব্রোড?তোর যেখানে ইচ্ছা।”

“মধুচন্দ্রিমা শব্দটা কর্ণগোচর হতেই মেহরিমার মনে বসন্তের দোলা দিয়ে ওঠে।ছড়িয়ে পড়ে ফুলের সুবাস।কেমন অদ্ভুত অনুভূতি হয়।লজ্জায় হৃদিতের শক্তপোক্ত বুকে মুখ লুকায়।”

“লজ্জা পেলে ছোট্ট মেহরিমা আসবে কিভাবে?আমি অ্যাট ফাস্ট বাবা হতে চাই।”

মেহরিমা এবার লজ্জায় মিইয়ে যায়।হৃদিত হাতের বাঁধন আরও দৃঢ় করে।

“সমুদ্র পছন্দ নাকি পাহাড়?”

“বোথ।এমন যায়গায় যেতে চাই যেখানে পাহাড়, সমুদ্র একে অপরের সাথে মিলে মিশে একাকার। নিজেদের সুখ দুঃখের কথা অনায়াসে বলতে পারে একে অপরকে।সাথে জঙ্গল হলে মন্দ হয়না!”

মিনমিনে কন্ঠস্বর মেহরিমার।হৃদিত হেসে ওঠে।

“যথা আজ্ঞা মহারানী।আপনি যা বলবেন।ওয়ান উইক টাইম লাগবে সব অ্যারেঞ্জ করতে।”

“কোথায় যাবো আমরা?”

“ইটস সারপ্রাইজ।”

মেহরিমার মনটা হঠাৎই খুশিতে ভরে ওঠে। হয়তোবা খুব কাছে থেকে প্রকৃতি কে ছুঁয়ে দিতে পারবে বলে এই খুশি।নিজের বুকের মাঝে থাকা লিটল কিটির খুশি অনুভব করতে পেরেই হৃদিতের মুখের হাসি প্রসারিত হয়।এই ছোট্ট অ্যানাবেলা অল্পতেই কতো খুশি হয়ে যায়!হৃদিত মুখটা নামিয়ে কানের কাছে নিয়ে ফিসফিস করে বলে,

“ওখানে শুধু তুই আর আমি থাকবো।আমাদের ডিস্টার্ব করার মতো কেউ থাকবে না। আমাকে একদম নিজের করে পাবি।এই জন্যই কি তোর এতো খুশি?”

হৃদিতের কথায় মেহরিমা লজ্জা পেয়ে হৃদিতকে এক ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে ওখান থেকে দৌড়ে রুমে চলে আসে।মূহুর্তেই হৃদিতের মুখমণ্ডল পরিবর্তন হয়ে যায়।মুখটা হিংস্র হয়ে ওঠে। উত্তর না দিয়ে ধাক্কা দেওয়া টা নিজের ইগোতে লাগে।তবে কি মেহরিমার আর হৃদিতের ভালোবাসা ভালো লাগে না?হৃদিত এই কয়দিনেই পুরনো হয়ে গেলো?বড় বড় পা ফেলে রুমে উপস্থিত হয় হৃদিত।মেহরিমা ততক্ষণে ওয়াশ রুমে ঢুকে পড়েছে।মেহরিমাকে আঘাত করার মতো বোকামি হৃদিত কখনোই করবে না।অত্যধিক ভালোবাসে কি না!রাগগুলো যেয়ে পড়ে ঘরের নিরপরাধ জিনিসগুলোর উপর।একে একে সব ভাঙতে শুরু করে। হঠাৎ জিনিস পত্র ভাঙচুরের শব্দ কানে আসতেই মেহরিমা দ্রুত ওয়াশ রুম থেকে বের হয়।কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই ঘরের লন্ড ভন্ড অবস্থা দেখতেই মেহরিমা হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে।তার থেকে বেশি ভয় পায় হৃদিতের আচরণ,রাগ কে।সব তো ঠিকই ছিল। হঠাৎ করে কি এমন হয়ে গেলো?এতো রেগেই বা গেলো কেনো?মেহরিমার মাথায় কিছুই ঢোকে না। ততক্ষণে শব্দ শুনে নিচে থেকে সবাই দৌড়ে উপরে উপস্থিত হয়েছেন।তাবান,তাইফ দ্রুত হাতে দরজা ধাক্কাতে থাকে।

“ভাবী,ভাবী আপনি ঠিক আছেন? দরজা খুলুন তাড়াতাড়ি।”

তাবানের কন্ঠস্বর শুনতেই মেহরিমা কাঁপা কাঁপা পায়ে দরজার নিকট এগিয়ে যায়। দরজাটা হালকা খুলতেই তাবান দ্রুত এক গ্লাস পানি এগিয়ে দেয় মেহরিমার দিকে।ভাবী ভাইয়াকে পানিটা খাওয়ান। শান্ত করুন।মেহরিমা ভয়ে ভয়ে হৃদিতের দিকে তাকায়।দিন দুনিয়া ভুলে ঘরের জিনিসপত্র ভাংচুর করতে ব্যস্ত।মুখ দিয়ে একাধারে কিছু বলেই চলেছে।হৃদিতের হিংস্রতা দেখে মেহরিমা শুকনো ঢোক গেলে।

“উনি রেগে আছেন।আমি পারবোনা।”

“ভয় পাবেন না। আপনাকে কিছুই করবে না। তাড়াতাড়ি যান পানি টা দেন ভাইয়া কে।”

মেহরিমা কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থেকে বুকে সাহস জমিয়ে ধীর পায়ে হৃদিতের দিকে এগিয়ে যায়।তাবান দরজা বন্ধ করে পিছনে ঘুরতেই বাড়ির সকলের প্রশ্নাত্মক দৃষ্টির সম্মুখীন হয়। মুখে জোরপূর্বক হাসি টেনে বলে,

“ভাই একটু রেগে আছেন।তাই হয়তো কিছু ভাংচুর করছে। ভাবী কল দিয়ে পানি চাইল সেটা দিতেই এসেছিলাম।টেনশন করো না তোমরা।তেমন বড় কোনো ঝামেলা না।”

হৃদিতের রাগ সম্পর্কে কমবেশি সবাই জানে।তাই সবাই খুব সহজেই সবটা বিশ্বাস করে নিলো।সহসায় প্রস্থান করলো।থেকে গেলো শুধু আয়াশ আর আরিফ চৌধুরী। দু’জনে কিছুক্ষণ বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রস্থান করে।তাবান,তাইফ হাঁফ ছেড়ে বাঁচে।দৌড়ে নিজেদের ঘরে চলে যায়।

মেহরিমা এগিয়ে যেয়ে ধীর কন্ঠে ডেকে ওঠে,

“শুনছেন?একটু শান্ত হোন।”

হৃদিত পিছনে ফিরে তাকায়।মেহরিমা কাঁপা কাঁপা হাতে পানি টা এগিয়ে দেয়।মেহরিমা কিছু বলার আগেই হৃদিত গ্লাস উঠিয়ে এক ঢোকেই সবটা শেষ করে।বড্ড পানির পিপাসা পেয়েছিল কি না!মেহরিমাকে আশ্চর্য করে দিয়ে দশ মিনিটের ব্যবধানে হৃদিত একদম শান্ত হয়ে যায়।মেহরিমা কে হাজার বার ছরি বলে ফেলেছে ইতোমধ্যে ।আধা ঘন্টার মধ্যে নিজেই রুম পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করে ফেলে।মেহরিমা কেবল অবাক চোখে সবটা দেখেই চলেছে।মনের মাঝে হাজারও প্রশ্ন খচখচ করতে থাকে।মস্তিষ্কে আসন্ন কথাটা উপলব্ধি করতে পেরেই বুকটা কেঁপে ওঠে।
______

আরিফ চৌধুরী,আয়াশ বাড়ির সামনে মেইন গেইট বরাবর রাস্তায় দাঁড়িয়ে আছে।শীতের রাতের ঠান্ডা বাতাসে ক্ষণে ক্ষণে কেঁপে উঠছে দুটো পুরুষালি শরীর।দু’জনেই নিশ্চুপ।আয়াশ নিস্তব্ধতা ভেঙে বলে,

“মানুষ এক ভুল কতবার করে বাবা?”

নিজের ছেলের কথায় ছেলের দিকে দৃষ্টিপাত করে আরিফ চৌধুরী।মুখে হাসি।কথাটা কোনদিক মিন করে বলেছে খুব করেই বোঝেন উনি। এমপি তো আর মুখ দেখে হননি।

“যতদিন না তার শক্তপোক্ত একটা শিক্ষা হয় ততদিন।”

“তবে কি মায়ের এখনও শিক্ষা হয়নি বাবা?”

“অন্যকে নিচে নামানোর প্রতিযোগিতায় নামলে মানুষ নিজের বিবেক,জ্ঞান সব হারিয়ে ফেলে।”

“বড় কোনো সমস্যা বাঁধার আগেই মাকে নিয়ে ঢাকায় ফিরে চলো।হৃদিত কে একটা সুন্দর,সুস্থ জীবন কাটাতে দেও।”

“এবার যে পাপিকে তার শাস্তি পেতেই হবে।”

“মেহু কে তোমরা যেমন ভাবছো ও কিন্তু তেমন না।অবনী আন্টির সেকেন্ড ভার্শন মেহু।ও সব সত্যি জানলে,না আমরা রক্ষা পাবো আর না হৃদিত।”

“মেহুমা হৃদিতকে ভালোবাসে।কখনো বিচ্ছেদ চাইবে না এটা শিওর থাকো।আর আমার?পাপের বোঝা বয়ে বেড়ানোর চেয়ে শাস্তি পাওয়া শ্রেয়।”

“একটা মেয়ের জীবন নষ্ট করতে একটুও বুক কাঁপেনি বাবা?তোমার নেওয়া একটা ভুল সিদ্ধান্তে এই ভরা সমাজে একটা মেয়েকে কলঙ্কিত হতে হয়েছে।পাল্টেছে সময়,পাল্টেছে সবকিছু।কিন্তু মনের ক্ষত সেটা কি একটুও পাল্টেছে?একটুও কমেছে?”

“আয়মানের মৃত্যুর সত্যিটা আমার মনে প্রতিশোধের আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল।সত্য মিথ্যা যাচাই করার অবস্থায় ছিলাম না।”

“মানুষ কিভাবে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারে সেটা তোমাকে না দেখলে কখনো জানতেই পারতাম না বাবা।বড্ড আফসোস হয় তোমার জন্য।অবশ্য মায়ের বুদ্ধির কাছে তুমি নেহাতই একটা চুনোপুঁটি।”

“তুমিও তো ভালোবেসে ঠকে গেছো আয়াশ।”

“আমি চাইলে এক্ষুনি ওকে ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারি।”

“তাহলে ছুঁড়ে ফেলছো না কেনো?”

“আমার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারে এটার ইফেক্ট পড়বে।”

“সত্যিই কি তাই?”

বাবার কথায় আয়াশ চুপ হয়ে যায়। আহ্ আয়াশের ভালোবাসা সেটা যে এতোটাও ঠুনকো না।সেটা তো গভীর ভালোবাসা।চাইলেও ছুঁড়ে ফেলা সম্ভব না।বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায় নিরবতায়।

“ভালোবেসে ঠকে যাওয়ার মাঝেও শান্তি আছে বাবা।কিন্তু ভালোবেসে ঠকানোর মাঝে কোনো শান্তি নেই।আছে শুধু আক্ষেপ,এক বুক ভরা কষ্ট।যেটা না কাউকে বলা যায় আর না নিজের কাঁধে বয়ে বেড়ানো যায়।”

আয়াশের কথায় আরিফ চৌধুরী আঁখি জোড়া বন্ধ করে ফেলে।চোখের পাতায় ভেসে ওঠে সুন্দর অতীত।এক কিশোরীর মায়াবী মুখাবয়ব।কি সুন্দর তার হাসি!এখনও এই হৃদয়,এই কানে ঝংকার তোলে সেই হাসি।এক পাক্ষিক ভাবে এতোটা ভালোবেসেও নিজের করা একটি ভুলে নিজের ভালোবাসা,নিজের ভালো থাকা সব হারিয়েছে এক নিমিষেই।কাউকে ঠকালে বিধাতা বোধহয় তার ভাগ্যেও ভালো থাকাটা আর লেখে না। ভালোবাসার কাছে হেরে যাওয়া দু’জন পুরুষের কষ্টে খুশিতে মেতে ওঠে এক নারী মন।পৈশাচিক হাসি দিয়ে পরক্ষণেই গুনগুনিয়ে কেঁদে ওঠে বলে,

“এই চৌধুরী বাড়ির কেউ কখনো ভালোবেসে সুখী হতে পারবে না।আমার মতোই বুকে ভালোবাসার আগুন নিয়ে সবাই কে জ্বলতে হবে,পুড়তে হবে।”

#চলবে___

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে