#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_২১
#ইসরাত_তন্বী
❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ❌
ঘড়ির কাঁটা দশটার ঘরে।গ্রামের মানুষের কাছে রাত দশটা মানেই মধ্যরাত।অথচ ইট পাথরে তৈরি যান্ত্রিক শহরের মানুষের নিকট রাত দশটা মানে রাতের প্রথম প্রহর।এই সময়ে গ্রামের অর্ধেক মানুষ তন্দ্রায় বিভোর।ইতোমধ্যে মেহরিমাদের রাতের খাবার পর্ব শেষ হয়েছে।মেহরিমা বাবা মায়ের রুমে বসে ওনাদের সাথে আড্ডা দিচ্ছে।হৃদিত মেহরিমার রুমেই আছে।মাধবী পড়াশোনা নিয়ে ব্যস্ত।দরজায় কড়া নাড়ছে ওর অ্যাডমিশন এক্সাম।
“এই নীলাক্ষী তুই নোজপিন পরিস না কেনো?”
“মা এখন কেউ নোজপিন পরে নাকি!”
“আমি তো ভুলেই গেছি আমার মেয়ে এখন বড় হয়ে গেছে।সে আপডেটেড।নোজপিন পরে না।”
মায়ের কন্ঠে সুক্ষ্ম অভিমানের আঁচ পেতেই মেহরিমার মুখে আঁধার নেমে আসে।মাকে জড়িয়ে ধরে বলে,
“আচ্ছা মা আমি ওনাকে বলবো একটা সুন্দর নোজপিন কিনে এনে দিতে।”
“আমাকে ছাড়।আলমিরার ডান সাইডের ড্রয়ারে দেখ একটা ছোট বক্স আছে।ওটা নিয়ে আয় যা।”
অবনী শেখের কথায় মেহরিমা চঞ্চল পায়ে আলমিরার নিকট এগিয়ে যায়। দ্রুত হাতে আলমিরার ড্রয়ার খুলতেই একটা সাদাকালো ছবি চক্ষু গোচর হয়।ছবিতে দু’জন কিশোরী মেয়ে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে দাড়িয়ে আছে।একটা অবনী শেখ অনায়াসেই বুঝতে পারে মেহরিমা।পাশের মেয়েটার চেহারা টা অবনী শেখ আর শাহীন শেখের সাথে অনেকাংশে মিলে যায়।মেহরিমা ছবিটার দিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকে।হঠাৎ করেই নিজের একমাত্র খালামনি অতশী শেখের কথা মাথায় আসে মেহরিমার।কিন্তু মা যে বলেছিলো খালামণির কোনো ছবি নেই নিজের কাছে।অনেক বছর আগে মারা গেছে অতশী শেখ কিন্তু কিভাবে মারা গেছে সেটা মেহরিমার অজানা।এই বিষয়ে কথা তুললেই অবনী শেখ সুকৌশলে এড়িয়ে যায় বিষয়টা।
“কিরে কি করছিস ওখানে?এতো সময় লাগছে কেনো?”
“হু? হ্যাঁ আসছি মা।”
মেহরিমা বক্সের সাথে ছবিটাও নিয়ে আসে। অবনী শেখের সামনে ছবিটা মেলে ধরে।
“এটা খালামনি মা?”
অবনী শেখ অপলক দৃষ্টিতে ছবিটার দিকে তাকিয়ে থাকে।হঠাৎ করেই ব্যথিত হয়ে ওঠে হৃদয়টা।
“হ্যাঁ।”
ম্লান কন্ঠস্বর অবনী শেখের।জলিল শেখ নিরস চাহনি দিয়ে ছবিটার দিকে তাকিয়ে আছে।অবনী শেখের ব্যথিত মুখমণ্ডল দেখতেই মেহরিমার মনটা খারাপ হয়ে যায়।তবুও সেই প্রতিবারের মতোই পুরোনো কথা তোলে।আজ যেনো জানার পণ করেছে!
“মা খালামনি কিভাবে মারা গেছিল?তুমি এই কথাটা কেনো লুকিয়ে রেখেছো আমাদের থেকে?আর এই ছবি কোথা থেকে আসলো?তুমি না বলেছিলে খালামনির কোনো ছবি নেই তোমার কাছে।”
কথাটা শুনতেই অবনী শেখের মুখমণ্ডল শক্ত হয়ে যায়।তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বরে বলে,
“সময় হলে সব জানতে পারবি।তোকে সত্য খুঁজে বের করতে হবে না।সত্যই তোকে খুঁজে বের করে নেবে।তবে নিজেকে সর্বদা প্রস্তুত রাখিস কঠিন সত্যের মুখোমুখি হওয়ার জন্য।তোর অস্তিত্ব যাদের সাথে মিশেছে তারা প্রতারক।”
“মা আমি কখনও কারোর ক্ষতির কারণ হবো না তো?”
“তুই আমার প্রিন্সেস।আমার বাগানের নিজের হাতে গড়ে তোলা সবচেয়ে আকর্ষণীয় গোলাপ হচ্ছে তুই।ঘ্রাণ বিহীন অথচ সৌন্দর্যের রাণী। তোকে ভালোবাসলে তুই তার হৃদয়ে সুঘ্রাণ ছড়ানোর ক্ষমতা রাখিস।আর যে তোকে আঘাত করার ইচ্ছা পোষণ করে তোর কাঁটার আঘাতে সে নিজেই ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়।”
“মা আমি গোলক ধাঁধায় আটকে গেছি।ওই চৌধুরী বাড়ির কিছু একটা ঠিক নেই।আমার মনে হয় ওই বাড়ির ইট পাথরগুলো আমাকে ডেকে বলে তুই রহস্যের বেড়াজালে আটকে গেছিস মেহরিমা।এর থেকে তোর মুক্তি নেই।”
মেহরিমার কথার পরিপ্রেক্ষিতে অবনী শেখ মুচকি হাসেন।
“হু রহস্যের বেড়াজালে আটকে পড়েছিস।সময় হলে গোলক ধাঁধা নিজে থেকেই খুলে যাবে।হৃদিত বাবা একা রুমে আছে।এই বক্সটা নিয়ে রুমে যা।ওকে পরিয়ে দিতে বলিস।”
মেহরিমা কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ছবিটা বিছানায় রেখে রুম থেকে বেরিয়ে আসে।মেহরিমা রুম থেকে বেরিয়ে যেতেই অবনী শেখ ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। জলিল শেখ নিজের উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে নেন প্রিয় অর্ধাঙ্গিনীকে।অবনী শেখের বলা প্রতিটা কথা মেহরিমার মাথার মধ্যে ঘোরপাক খাচ্ছে।মায়ের বলা কথা গুলোর সাথে কোনোভাবে কি চৌধুরী বাড়ির যোগসূত্র আছে? নিজের মনে হাজারও প্রশ্ন নিয়ে রুমে প্রবেশ করে মেহরিমা।ঘরে সবুজ রঙের ড্রিম লাইট মৃদু আলোয় জ্বলছে।রুমের মধ্যে শুনশান নিরবতা।দক্ষিণের জানালা দিয়ে ঠান্ডা ঝিরিঝিরি বাতাস ক্ষণে ক্ষণে প্রবেশ করছে রুমের মধ্যে।ব্যালকনি থেকে গানের আওয়াজ ভেসে আসতেই মেহরিমা মুচকি হেসে সেদিকে পা বাড়ায়।
একডুব দিয়ে সুবিশাল অম্বরে গোল থালার মতো বড় রুপালি চন্দ্র দেখা দিয়েছে।নিজের আলোয় ধরনী আলোকিত করে গৌরবে বুক ফুলিয়ে অম্বরে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে চন্দ্রমা।হৃদিত ব্যলকনিতে চেয়ারে বসে এক ধ্যানে চন্দ্রের দিকে তাকিয়ে আছে।
“সুন্দরী চন্দ্রমা যতই নিজের রুপ দেখিয়ে আমায় বশ করতে চাও না কেনো আমি ধরা দিচ্ছি না। আমার ব্যক্তিগত চাঁদের সৌন্দর্যের কাছে তুমি কিচ্ছু না।ওর স্নিগ্ধ নিষ্পাপ মুখের কাছে পৃথিবীর সবকিছু তুচ্ছ।আমার উপরে রাগ করলে সুন্দরী চন্দ্রমা?”
পরক্ষণেই গেয়ে ওঠে।
“আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি
আর মুগ্ধ এচোখে চেয়ে থেকেছি
বাজে কিনকিনী রিনিঝিনি
তোমারে যে চিনি চিনি
মনে মনে কত ছবি এঁকেছি
আমি দূর হতে তোমারেই দেখেছি
আর মুগ্ধ এচোখে চেয়ে থেকেছি।”
মেহরিমা স্লথ পায়ে এগিয়ে আসে।হৃদিতের ঠিক পিছনে দাঁড়ায়।মেহরিমার উপস্থিতি অনুভব করতেই হৃদিতের ঠোঁটে ক্ষীণ হাসির রেখা ফুটে ওঠে।
“সামনে আয়।”
মেহরিমা গুটিগুটি পায়ে হেঁটে হৃদিতের সামনে যেয়ে দাঁড়ায়।রিনরিনি কন্ঠে বলে,
“আমার উপস্থিতি কিভাবে বুঝতে পারলেন?”
“নিজের সত্ত্বার উপস্থিতিই যদি বুঝতে না পারি তাহলে আর কেমন ভালোবাসলাম তোরে!”
“আপনার গানটা খুব সুন্দর হয়েছে।আমার খুব পছন্দের একটা গান।আমার জামাই পুরাই একটা রাজপুত্তুর।কত্ত গুণ তার!”
“এগেইন?”
হৃদিতের কথায় মেহরিমা আলাভোলা হাসি দেয়।
“ইয়ে মানে আমি ইচ্ছা করে শুনিনি তো।এখানে আসতে আসতে শুনে ফেলেছি।এটা আমার কানের দোষ।”
হৃদিত মেহরিমার হাত ধরে হেঁচকা টান মেরে নিজের কোলের উপর বসিয়ে নেয়।আলতো হাতে কাঁধের উপর থেকে চুল সরিয়ে দেয়।হৃদিতের স্পর্শে মেহরিমা কেঁপে ওঠে।
“কাঁপছিস কেনো?”
মেহরিমাকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই গলায় মুখ ডুবিয়ে দেয়।ছোট ছোট ভালোবাসায় মেহরিমাকে ভরিয়ে দিতে থাকে।মেহরিমা যেন সুখের অনুভুতির জোয়ারে ভেসে যায়।কয়েক মিনিট পেরোতেই মেহরিমা তড়িৎ গতিতে পেছনে ঘুরে হৃদিতের অধরজোড়া নিজের অধর দিয়ে চেপে ধরে।সেকেন্ডের ব্যবধানেই নিজেকে শূন্যে অনুভব করে মেহরিমা।দু’জন নরনারীর উষ্ণ শ্বাস প্রশ্বাসে ক্রমস ভারি হয়ে ওঠে বদ্ধ ঘরের চারিপাশ।লজ্জায় মেঘের আড়ালে নিজের মুখ লুকায় সুন্দরী চন্দ্রমা।লজ্জায় নাকি মেহরিমার উপর হিংসায়?হৃদিতের ভালোবাসার পাগলামিতে আরও একটা সুন্দর রজনী পার করে মেহরিমা।মায়ের দেওয়া বক্সটা অযত্নেই পড়ে থাকে বিছানার এক কোণায়।
#চলবে
#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_২২
#ইসরাত_তন্বী
❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌
ইতোমধ্যে কেটে গেছে পাঁচদিন।মেহরিমা আর হৃদিত আজ চৌধুরী বাড়িতে এসেছে।এ বাড়িতে পা রাখতেই মেহরিমা নতুন চমক পেয়েছে!চৌধুরী বাড়ির মেয়ে অর্থাৎ হৃদিতের একমাত্র ফুপিমনি আয়রা চৌধুরী আমেরিকা থেকে পুরো পরিবার নিয়ে স্বয়ং উপস্থিত হয়েছেন চৌধুরী বাড়িতে।ওনারা গতকাল রাতেই এসেছেন।অথচ মেহরিমা এইসবের কিছুই জানে না।আয়রা চৌধুরীর সাথে পরিচিত হয়ে মেহরিমার বেশ ভালো লেগেছে। খুবই হাস্যোজ্জ্বল, মিশুক প্রকৃতির মানুষ তিনি। তবে ওনার দুই মেয়ে অলিভিয়া, অ্যামেলিয়া কে মেহরিমার একটুও ভালো লাগেনি। মানুষ হিসেবে অতিরিক্ত অহংকারী আর পোশাকের অবস্থা নাজেহাল।হৃদিত এসবে নির্বিকার রয়েছে।চোখ তুলে একবার তাকায় ও নি ওনাদের দিকে আর কথা বলা তো দূরের বিষয়!
সময় রাত দশটা।সবাই খাবার টেবিলে উপস্থিত হয়েছে।হৃদিতের একপাশে মেহরিমা বসেছে অপর পাশের চেয়ারটা খালি পড়ে আছে তৃধার জন্য।বেচারি লজ্জায় আজ সারাদিন হৃদিতের মুখোমুখি হয়নি।যেই মেয়ে সবার আগে খাবার টেবিলে উপস্থিত থাকে আর আজ তার কোনো খবরই নেই।আয়েশা চৌধুরী আর আতিয়া চৌধুরী দ্রুত হাতে খাবার পরিবেশনে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন।শ্রেয়া চৌধুরীও ওনাদের কাজে টুকটাক সাহায্য করছেন।
“আমার মেয়েটার হঠাৎ করে কি যে হলো!আজ সকাল থেকে কেমন ঘরকুনো হয়ে গেছে। সারাদিনে একটা বারের জন্যও ঘর থেকে বের হয়নি।ও মেহুমা একটু কষ্ট করে তৃধুকে ডেকে এনে দিবে গো।”
আয়েশা চৌধুরীর কথায় মেহরিমা মুচকি হেসে বলে,
“এভাবে বলছেন কেনো মেজোমা?আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।”
মেহরিমা তৃধাকে ডাকতে চলে যায়।হাঁটার ধপধপ শব্দ কর্ণগোচর হতেই সবাই শিড়ির দিকে তাকায়। অলিভিয়া আর অ্যামেলিয়া দোতলা থেকে নামছে। দুই বোনের পরনে ছোট্ট একটা টপস।যেটা উচ্চতায় হাঁটুর অনেকটা উপরে।ফর্সা কাঁধ,পা সবটাই উন্মুক্ত।আরিফ চৌধুরী,আজাদ চৌধুরী দ্রুত নিজেদের চোখ নামিয়ে নেন।হৃদিতের দৃষ্টি নিজের ফোনে স্থির।অলিভিয়া,অ্যামেলিয়া এসে কোনো অনুমতি ছাড়াই হৃদিতের দু’পাশের চেয়ারে দু’জন বসে পড়ে।হৃদিত ফোন থেকে দৃষ্টি সরিয়ে আয়রা চৌধুরীর দিকে দৃষ্টিপাত করে।
“বিদায় হচ্ছেন কবে?”
হৃদিতের এহেন কথায় উপস্থিত সবার চক্ষু ছানাবড়া হয়ে যায়।গোল গোল চোখ করে অবিশ্বাস্য চোখে হৃদিতের দিকে তাকিয়ে থাকে।আয়রা চৌধুরী মলিন হাসেন।
“মাত্রই গতকাল আসলাম বাবা।এবারে অনেক দিনের জন্য এসেছি।পুরো শীত কাটিয়ে তারপর যাবো।বহুবছর গ্রামের শীতের পরিবেশ উপভোগ করা হয়নি।”
হৃদিতের ঠোঁটে তাচ্ছিল্যের হাসি।
“শীত কাটাতে এসেছেন?খুব ভালো।আমি ভেবেছিলাম বোধহয় আগের বারের মতোই ভাইবউকে নিজের সঙ্গি বানিয়ে ভাইয়ের মাথা চিবোতে এসেছেন।”
শেষ কথাটা শ্রেয়া চৌধুরীর দিকে তাকিয়ে বলে।শ্রেয়া চৌধুরী দৃষ্টি নামিয়ে নেন।কিছুক্ষণ থেমে আবারও বলে,
“তবুও একটা ওয়ার্নিং দিয়ে রাখি আমার বউ কিন্তু সুবিধার না। সাবধানে থাকবেন।নিজের সব সঙ্গিদেরও সাবধানে রাখবেন।মেহরিমা আপনাদের মতো মানুষ কে ঘৃণা করে।”
“হৃদিত!”
গর্জে ওঠেন আরিফ চৌধুরী।নিজের একমাত্র আদরের বোনকে অপমান করেছে কিনা!উপস্থিত ছোট বড় সবার সামনে এমন কঠিন অপমানে ফুঁপিয়ে ওঠেন আয়রা চৌধুরী।আয়রা চৌধুরীর হাসবেন্ড আব্রাহাম তালুকদার অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন হৃদিতের দিকে।হৃদিত সেদিকে পাত্তাই দিলো না।ভাবটা এমন যে কিছুই হয়নি।চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়।
“আর এইযে তোরা দু’জন একটা কথা কান খুলে শুনে রাখ।নেক্সট টাইম যদি আমার আশেপাশেও তোদের দু’জন কে দেখেছি তাহলে পা দুটো কেটে হাতে ধরিয়ে দেবো।মাইন্ড ইট।”
হৃদিতের কন্ঠে কিছু একটা ছিলো।অলিভিয়া, অ্যামেলিয়া ভয়ে জড়সড় হয়ে তড়িৎ গতিতে হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।হৃদিত দোতলার উদ্দেশ্যে পা বাড়ায়।
“নিজেকে তুমি কি মনে করো?”
আরিফ চৌধুরী উচ্চস্বরে বলে ওঠেন।হৃদিতের চরণ যুগল থেমে যায়।পেছনে ঘুরে তাকায়।প্যান্টের পকেটে দুহাত গুঁজে আয়েশি ভঙ্গিতে দেওয়ালে হেলান দিয়ে সিঁড়িতে দাঁড়ায়।
“আপাতত নিজেকে কিছু মনে করছি না।”
“তোমার ব্যবহার দিনকে দিন প শু র মতো হয়ে যাচ্ছে।”
“আপনারই তো র ক্ত বইছে আমার শরীরে।”
হৃদিতের খাপছাড়া জবাবে আরিফ চৌধুরীর রাগ তিরতির করে বেড়ে যায়। উনি আবারও গর্জে ওঠেন,
“আমার চোখের সামনে থেকে দূর হয়ে যাও তুমি। তোমাকে এমন শিক্ষা দিয়ে বড় করিনি আমি।এ কেমন ব্যবহার তোমার?আমাদের সাথে যেটা করো সেটা মেনে নিয়েছি।কিন্তু তোমার একমাত্র ফুপিমনির সাথে কিভাবে এই জঘন্য ব্যবহার করো?”
“আপনার মতোই হয়েছি আমি।আর আপনার চোখের সামনে কে থাকতে চাই?হু?আমার পিছনে পড়ে আপনি নিজেই এখানে এসেছেন।ভুলে কেনো যাচ্ছেন?যে যেমন ব্যবহারের যোগ্য তার সাথে তো আমি তেমন ব্যবহারই করবো।”
সবসময়ের ন্যায় গম্ভীর কন্ঠস্বর হৃদিতের।ছেলের একরোখামিতে আরিফ চৌধুরী রিতিমত রাগে কাঁপছেন।আজাদ চৌধুরী এগিয়ে আসেন।
“ভাইজান শান্ত হোন।”
শ্রেয়া চৌধুরী এগিয়ে এসে এক গ্লাস পানি দেন। রাগান্বিত আরিফ চৌধুরীর সাথে কথা বলার মতো সাহস ওনার নেই।আরিফ চৌধুরী এক ঢোকেই সবটা শেষ করেন।
“আপনাদের নাটক শেষ?আমি কি যেতে পারি?ছোটো মা আমার আর মেহরিমার খাবার রুমে পাঠিয়ে দেবেন।”
“আমার কথা শেষ হয়নি এখনও।”
হৃদিত কপালে গুটি কয়েক ভাঁজ ফেলে তাকিয়ে থাকে।আরিফ চৌধুরী বলেন,
“তোমার লজ্জা করেনা?ওই বাড়ির মেয়েকে তুমি কিভাবে বিয়ে করলে?তুমিতো সবটা জানতে হৃদিত।কেনো এই ধ্বংস খেলায় নামলে?আমাকে আর কত শাস্তি দেবে?”
শেষের দিকে ওনার কন্ঠে অসহায়ত্ব ফুটে ওঠে।
“যেভাবে আপনার ভাই বিয়ে করেছিল সেভাবেই করেছি।আপনাদের ভুলের শাস্তি আমি কেনো পেতে যাবো?ভালোবাসি আমি মেহরিমাকে।আর আপনার শাস্তি হাহ্!সেটা স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা ছাড়া কেউ দিতে পারবে না।”
“অতীত পুনরাবৃত্তি করতে চাইছো?”
“উহু।মেহরিমার গায়ে একটা আঁচড় দেওয়ার আগে তাকে আমার মুখোমুখি হতে হবে।সবাইকে নিজের আর নিজের ভাইয়ের মতো কেনো ভাবেন বলুন তো?সবাই কি আপনার মতো বিশ্বাসঘাতক, কাপুরুষ নাকি?”
এদফায় দমে যান আরিফ চৌধুরী।সব রাগ এবার গিয়ে পড়ে শ্রেয়া চৌধুরীর উপরে।শ্রেয়া চৌধুরীর দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে কয়েক সেকেন্ড তাকিয়ে থেকে বাড়ির বাইরে চলে যান।শ্রেয়া চৌধুরী শব্দ করে কেঁদে ওঠেন।বাড়ির সকলে হতভম্ব হয়ে গেছে।কি থেকে কি হয়ে গেল!কেউই বুঝতে পারছে না।হৃদিত দীর্ঘশ্বাস ফেলে পিছনে ঘুরতেই মেহরিমার ভেজা চক্ষু যুগল,রক্তিম মুখমণ্ডল চক্ষু গোচর হয়।আর এক সেকেন্ডও না দাঁড়িয়ে মেহরিমা ওখান থেকে এক দৌড়ে ছাদে চলে যায়।এতক্ষণ ধরে কথোপকথনের সবটাই শুনেছে অবনী শেখ।মেহরিমা তখন তৃধা কে ডেকে নিয়ে আসার সময় পথিমধ্যে অবনী শেখ কল দেন।মেহরিমা রিসিভ করে কথা বলতে শুরু করে।হঠাৎ আরিফ চৌধুরীর চিৎকার শুনে ওরা দু’জন দ্রুত পায়ে দোতলার সিঁড়ির নিকট এসে দাঁড়ায়। তাড়াহুড়োতে কলটা কাটতেই ভুলে যায়। অবনী শেখের অধরে বাঁকা হাসি।ধীরকন্ঠে আওড়াই,
“সময় সবকিছু দ্বিগুণ রুপে ফিরিয়ে দেয়।প্রকৃতির বিচার বড়ই কঠিন।”
মেহরিমার পিছন পিছন হৃদিত ও দৌড়ে ছাদে আসে। চৌধুরী বাড়ির ছাদটা অপরূপ সৌন্দর্যে মোড়ানো।ছাদের অর্ধেক যায়গা জুড়ে ছাদবাগান করা। যেখানে আছে নাম না শত শত দেশি-বিদেশি ফুলের জাত। চাঁদের আলোয় চারি পাশ ঝলমল করছে।ছাদে পা রাখতেই একটা ঠান্ডা দমকা হাওয়া বয়ে যায়।মেহরিমার ক্ষীণ তনু মন শিরশির করে ওঠে।নাসারন্ধ্রে ভেসে আসে শিউলি,বেলি ফুলের সুবাস।মেহরিমা বড় একটা শ্বাস নিয়ে স্লথ পায়ে সামনে এগিয়ে যায়।একদম ছাদের রেলিং ঘেসে দাঁড়ায়।চোখ চলে দূরে,বহুদূরে।গ্রামের ছোট ছোট ঘরবাড়ি,গাছপালা সবমিলিয়ে দেখতে বেশ ভালো লাগছে মেহরিমার।চাঁদের আলোয় সবকিছু বড়ই মনোরম লাগছে।কিছুক্ষণ আগের মনের ব্যথাটা কিছুটা কমে আসে।প্রকৃতিপ্রেমীদের কাছে প্রকৃতিই যেনো শান্তির নীড়।তাইতো কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই মেহরিমার অসহনীয় বুক ব্যথাটা গিলে নিলো প্রকৃতি।হৃদিত এগিয়ে এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে মেহরিমাকে।উন্মুক্ত স্কন্ধে থুতনি রাখে। কিছুক্ষণ নিরবতা চলে দু’জনের মাঝে।একে অপরের শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শুনতে ব্যস্ত।হঠাৎ মেহরিমার চোখে জলে ওঠে অগ্নিশিখা। নিরবতা ভেঙে তীক্ষ্ণ কন্ঠস্বরে বলে,
“অতীতে চৌধুরী পরিবারের সাথে শেখ পরিবারের কি ঘটেছিলো?একে অপরের প্রতি এতো ভয়, সংকোচ,ঘৃণা কেনো?কিসের ধ্বংস খেলায় নেমেছেন সবাই? আপনাদের খেলায় আমায় কেনো দাবার গুটি বানালেন?”
#চলবে___