কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-১৫+১৬

0
170

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_১৫
#ইসরাত_তন্বী

(গল্পের নাম পরিবর্তন করা হয়েছে)

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

সময় মধ্যরাত।চৌধুরী পরিবারের সকল সদস্য ড্রয়িং রুমে বসে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে চৌধুরী বাড়ির বড় ছেলে আরিফ হাসান চৌধুরীর জন্য।দীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বছর পর আজ চৌধুরী বাড়িতে পা রাখবেন তিনি।তার নিজের জন্মস্থান ছাড়ার পিছনে রয়েছে এক কঠিন গল্প।আয়াশ হাত ঘড়িতে সময় দেখে নেয়‌।রাত বারোটা বেজে পঁয়তাল্লিশ মিনিট। আরিফ চৌধুরীর আসতে সর্বোচ্চ আর পাঁচ মিনিট সময় লাগতে পারে।ঘড়ি ধরে ঠিক তিন মিনিটের মাথায় গাড়ির শোঁ শোঁ শব্দ শোনা যায় চৌধুরী বাড়ির আঙ্গিনায়।সবাই ছুটে বাইরে চলে যায়।আরিফ হাসান চৌধুরী আর শ্রেয়া চৌধুরী গাড়ি থেকে নেমে আসে।বিয়ের পরে এই প্রথম শ্বশুর বাড়িতে পা রাখেন শ্রেয়া চৌধুরী। চৌধুরী বাড়ির মাটিতে পা রাখতেই আরিফ চৌধুরীর বুক কেঁপে ওঠে।সেই চিরচেনা নীড়।হাজারও স্মৃতি জমে আছে এই বাড়িকে ঘিরে,এই গ্রামকে ঘিরে,এই গ্রামের মানুষকে ঘিরে।আজাদ চৌধুরী এগিয়ে এসে জড়িয়ে ধরেন আরিফ চৌধুরী কে।আরিফ চৌধুরী আজাদ চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে কান্না করে দেয়। উপস্থিত সকলের চোখে পানি।

“কেমন আছেন ভাইজান?”

“আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ ভালো রেখেছে।তুই কেমন আছিস?আবরার আসবে না?”

“আমিও ভালো আছি ভাইজান। আবরার ছুটি নিতে চেয়েছে ভাইজান।ও নিশ্চয় আসবে।”

তারপর সবার সাথে ভালো মন্দ অনেক কথা বলে আরিফ চৌধুরী।কয়েক মিনিটের ব্যবধানেই শ্রেয়া চৌধুরীর সাথে মিশে গেছে আয়েশা চৌধুরী আর আতিয়া চৌধুরী।যেনো নিজেদের আপন বোন। শ্রেয়া চৌধুরী দুজনের ব্যবহারে মুগ্ধ হন।দোতলা থেকে সবটাই তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখছে হৃদিত।ঠোঁটে বাঁকা হাসি।যেখান থেকে সব শুরু হয়েছিল সেখানেই শেষ করবে হৃদিত।হঠাৎ হোয়াটসঅ্যাপ নোটিফিকেশনে হাতে থাকা ফোন টা কেঁপে ওঠে।হৃদিত ফোনের স্ক্রিনে নজর রাখে।আনসেইভ নাম্বার থেকে টেক্সট এসেছে।

“নিজের ধ্বংস দেখতে নিশ্চয় কারোর ভালো লাগে না!আফসোস সেই দিন সন্নিকটে।”

টেক্সট টা পড়ে হৃদিত তাচ্ছিল্যের হাসি দেয়। নিজের ধ্বংস কেউ যদি নিজে ডেকে আনে তাহলে হৃদিতের আর কি করার!ধীর পায়ে বিছানার দিকে এগিয়ে যায়।হৃদিত জানালা থেকে সরে যেতেই আরিফ চৌধুরী নিজের দৃষ্টি নামিয়ে বাড়ির ভেতরে চলে যায়।মেহরিমা কমফোর্টার মুড়ি দিয়ে ঘুমাচ্ছে।গায়ে হৃদিতের সাদা শার্ট যেটা মেহরিমার হাঁটু ছুঁয়েছে।হৃদিত এক লাফে বিছানায় উঠে মেহরিমার কমফোর্টারের মধ্যে ঢুকে পড়ে। কপালে ভালোবাসার পরশ দিয়ে দুহাতে জড়িয়ে নেয় নিজের সাথে।মেহরিমা একটু নড়েচড়ে উঠে হৃদিতের উন্মুক্ত বুকে মুখ গুজে আবারও গভীর তন্দ্রায় তলিয়ে যায়।হৃদিত এক দৃষ্টিতে মেহরিমার দিকে তাকিয়ে থাকে।

_____

সময় সকাল আটটা বেজে পাঁচ মিনিট।মাধবী মন ভার করে ড্রয়িং রুমের সোফায় বসে আছে।অবনী শেখ রান্না শেষ করে ড্রয়িং রুমে এসে দাঁড়ায়। জলিল শেখ ও বাইরে যাওয়ার জন্য একেবারে রেডি হয়ে রুম থেকে বের হয়।

“মাধু আম্মা তোমার কোচিং থেকে পিকনিকের অ্যারেঞ্জ করেছে শুনলাম।তুমি পিকনিকে অ্যাটেন্ড করবে না?”

“না বাবা।”

মাধবীর কথার পৃষ্ঠে জলিল শেখ প্রশ্ন করার আগেই অবনী শেখ জিজ্ঞাসা করে,

“কেনো?কোনো সমস্যা?”

মাধবী সময় নিয়ে জবাব দেয়,

“মা শিহাব ভাইয়ের করা ওই ঝামেলার পর থেকে কোচিংয়ের,গ্রামের সবাই কেমন একটা নজরে তাকায় আমার দিকে।আমার ভালো লাগে না একদম।ওদের নজর দেখে মনে হয় আমার গায়ে নোং রা লেগে আছে‌।”

কথাগুলো বলতে বলতে মাধবী ফুঁপিয়ে ওঠে। অবনী শেখ এগিয়ে এসে মাধবীর পাশে বসে। মাধবীর হাতজোড়া নিজের হাতের মুঠোয় নিয়ে নেয়।

“তোর ইচ্ছে আছে পিকনিকে অ্যাটেন্ড করার?”

“হ্যাঁ মা। কিন্তু আমি অ্যাটেন্ড করবো না।ওরা আবার যদি উল্টা পাল্টা কিছু বলে বসে!”

“মানুষ কি বলবে তুই সেটা নিয়ে ভয় পাচ্ছিস?বোকা মেয়ে আমার।আজ তোকে কিছু কথা বলবো মনোযোগ দিয়ে শুনবি ঠিক আছে?”

“আচ্ছা মা।”

“সাপোজ তুই এখন মারা গেলি।তুই মারা যাওয়া মাত্রই মানুষ তোর নামটাও আর মুখে নিবে না।বলবে,লা শ টা কে গোসল করাও,লা শ টা কে খাটিয়ায় তোলো,লা শ টা কবর দেও,অনেকে তো রাতে ভয় পাবে বলে তোর মৃ ত মুখ টাও দেখতে চাইবে না ব্যাস।আর এই ‘মানুষ কি বলবে’ভেবে তুই গোটা একটা জীবন কাটিয়ে দিতে চাচ্ছিস?আশ্চর্য!জীবনটা তোর অন্যের না।তাই যতদিন বেঁচে থাকবি নিজের মতো করে বাঁচবি। সমালোচনাকারী তোর সমালোচনা করবেই সেটা তুই ভালো কাজ করলেও করবে খারাপ কাজ করলেও করবে।তাই নিজের আত্মতৃপ্তির কথা আগে ভাববি।এই জীবন টা খুব ছোট্ট রে মা।নিজের আত্মতৃপ্তি নিয়ে বাঁচবি অলওয়েজ।”
কলমে~ ইসরাত তন্বী

অবনী শেখের কথাগুলো মাধবীর মস্তিষ্কে তড়িৎ গতিতে প্রভাব ফেলে।সেকেন্ডের ব্যবধানে মাধবীর চোখেমুখে কাঠিন্যের ছাপ ফুটে ওঠে। তেজস্বী কন্ঠে বলে,

“ঠিক বলেছো মা। জীবন টা আমার। তাই আমি নিজের মতো করে আত্মতৃপ্তি নিয়ে বাঁচব।”

“এই তো আমার সোনা মা সহজেই বুঝে গেছে।”

অবনী শেখ মাধবী কে দু’হাতে বুকে আগলে নেয়। জলিল শেখ ওদের দিকে মুগ্ধ নয়নে চেয়ে থাকে কিয়ৎকাল।এই মানুষ টার কথা জাদুর মতো কাজ করে সবসময়।ভাগ্যিস এই মানুষ টা কে জীবনে পেয়েছিল নাহলে এই ছোট্ট জীবন টা বোধহয় আর উপভোগ করা হতো না জলিল শেখের।এক পাক্ষিক ভাবে ভালোবেসে সেই স্বপ্নের রাজকুমারীর সাথে আজ সংসার করছে।তার দুটো কন্যা সন্তানের জনক হতে পেরেছে।একটা হাসিখুশি পরিবার পেয়েছে। জলিল শেখের জীবন পরিপূর্ণ।একজন মানুষের এর থেকে আর কিই বা চাওয়ার থাকে!

________

চৌধুরী পরিবারের সবাই নাস্তার টেবিলে বসে আছে।অপেক্ষা করছে হৃদিত আর মেহরিমার জন্য।আজ চৌধুরী বাড়ি যেনো নতুন করে প্রাণ ফিরে পেয়েছে।সেই আগের মতই খুশিতে ছেয়ে গেছে বাড়ির চারিপাশ।সবার মুখে হাসি।বিশ মিনিট অপেক্ষা করার পর হৃদিত আর মেহরিমা নিচে আসে।মেহরিমা গতকাল আয়াশ আর আরিশার সাথে পরিচিত হয়েছে।ইভেন আরিশার সাথে বেশ ভাব ও জমে গেছে মেহরিমার।আজ নাস্তার টেবিলে আরও দুটো অপরিচিত মুখ দেখতেই মেহরিমা ভাবুক হয়ে পড়ে।পরক্ষণেই হৃদিত আর আয়াশের সাথে ফেইসের মিল খুঁজে পেতেই মেহরিমা যা বোঝার বুঝে যায়।ওনাদের সাথে মিষ্টি কন্ঠে সালাম বিনিময় করে।আরিফ চৌধুরী মেহরিমার মুখের দিকে তাকাতেই কিছুক্ষণের জন্য থমকায়!সেই চিরচেনা পরিচিত এক মায়াবী মুখ মানসপটে ভেসে ওঠে। মেহরিমাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়েই এক প্রকার টেনে এনে নিজের পাশের চেয়ারে বসিয়ে দেয় হৃদিত।হৃদিতের কাজে মেহরিমা লজ্জা পেয়ে যায় সাথে অবাক ও হয়!হৃদিত নিজের মা বাবাকে দেখেও যেন দেখলো না।হৃদিতের এহেন ব্যবহারে শ্রেয়া চৌধুরীর চোখজোড়া ছলছল করে ওঠে।মেহরিমা সহ সবাই সেটা লক্ষ্য করে।আরিফ হাসান চৌধুরী মলিন মুখে ঠাঁয় বসে রয়।কেউ আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ বসে নাস্তা করতে শুরু করে।খাওয়ার শেষের দিকে আয়াশ আরিফ চৌধুরীর উদ্দেশ্যে বলে,

“বাবা আগামীকাল আমাকে ঢাকা ব্যাক করতে হবে।এভাবে কাজ ফেলে এখানে বসে থাকা আমার পক্ষে সম্ভব না।আমার কাঁধে অনেক দায়িত্ব।নাস্তা শেষ করে বাইরে যাবো।চেয়ারম্যান জলিল আংকেলের সাথে দেখা করে গ্রামের সমস্যা গুলো জেনে সেগুলো ঠিক করার পরিকল্পনা করতে হবে।তুমি ও যাবে আমার সঙ্গে।”

“আচ্ছা ঠিকাছে।আরিশা মামনি আমাদের সাথে থাকুক কিছুদিন এখানে।”

“হ্যাঁ বাবা আরিশা এখানেই থাকবে।আমি একটু শান্তি চাই।”

আয়াশের শেষ কথাটা শুনে সবাই ওর দিকে দৃষ্টিপাত করে।আরিশা অগ্নি দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে।সেটা লক্ষ্য করতেই আয়াশ আমতা আমতা করে বলে,

“আই মিন আরিশা এখানে থাকলে অনেক ভালো থাকবে।ওর তো গ্রাম খুব পছন্দ।আর ও শান্তিতে থাকলে আমিও শান্তিতেই থাকবো।”

আয়াশের কথা শুনে সবাই মুচকি হাসে।কেবল হৃদিত ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে থাকে আয়াশের দিকে।

“এমপি স্যার নতুন বেয়াইয়ের সাথে দেখা করতে যাবেন।আই হোপ কিপটামো করে আমার সম্মান নষ্ট করবেন না।আপনাদের সম্মান না থাকলেও আমার সম্মান আছে।”

কথাগুলো বলে বেসিনে হাত ধুতে চলে যায় হৃদিত।হৃদিতের ব্যবহারে মেহরিমা সহ সবাই যেন অবাকের উপর অবাক হচ্ছে!আরিফ চৌধুরী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন।এর শেষ কোথায় উনি নিজেও জানেন না।তবে উনি বুঝতে পারছেন ওনার ছেলে খেলার ছক পুরোপুরি উল্টে দিয়েছে।যার ফলস্বরূপ ওনাকে বার বার আবারও সেই বিভৎস অতীতের সম্মুখীন হতে হবে।

#চলবে______

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_১৬
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

চৌধুরী পরিবারের ছোট সদস্যেরা সবাই একসাথে পুকুর পাড়ে বসে আড্ডা দিচ্ছে।হৃদিত ওর বাগান বাড়িতে গেছে প্রায় দুই ঘন্টা হতে চলল।সূর্যি মামার অবস্থান ঠিক মাথার উপরে।ভ্যাপসা গরমে অস্থির হয়ে উঠেছে সকলে।রাতে ঠান্ডা আর দিনে গরম এভাবে মানুষের জীবন রিতিমত অসহনীয় হয়ে পড়েছে।মেহরিমা কে পেয়ে চৌধুরী পরিবারের সবার আনন্দ দ্বিগুণ বেড়ে গেছে।আরিশা বড় বোনের মত হয়ে উঠেছে মাত্র দু’দিনেই।

“মেহু বাবার বাসায় যাবে না? বিয়ের পরে হাসবেন্ডের সাথে বাবার বাসায় যায় তো মেয়েরা ।”

আরিশার কথায় মেহরিমা মুখের হাসি বজায় রেখেই বলে,

“উনি গেলে যাবো।”

“এটা কেমন কথা মেহু!এগুলো বিয়ের রুলস।আর তোমাদের বিয়েটাও তো ঠিকভাবে হয়নি।বউভাত ও হবে না।অ্যাটলিস্ট এই রুলস গুলো তো মানতেই পারো।”

“ভাবী আমি ওনার সাথে কথা বলবো বিষয় টা নিয়ে।”

“এখানে কথা বলার কি আছে?আজব!তুমি যা বলবে হৃদিত শুনতে বাধ্য।তুমি কি মেরুদন্ডহীন মেয়ে নাকি?আচ্ছা সত্যি করে বলোতো হৃদিত কি সত্যিই তোমায় ভালোবেসে বিয়ে করেছে নাকি তোমার সম্মান রক্ষা করতে?আর শোনো বড়পু হিসেবে একটা কথা বলি সময় থাকতে হৃদিতরে শাড়ির আঁচলে বেঁধে ফেলো।ব্যাটা মানুষের মন কখন কোনদিকে চলে যায় বলা তো যায় না।”

আরিশার কথায় উপস্থিত সবাই হতভম্ব হয়ে যায়!চোখ বড় বড় করে একবার মেহরিমার দিকে তাকায় আর একবার আরিশার দিকে তাকায়।আরিশার ঠোঁটের কোণে হাসি।মেহরিমার তাজা ক্ষত আরও তাজা করে দেওয়ার জন্য এই কথাগুলোই যথেষ্ট ছিলো।চোখে জলেরা এসে ভিড় জমায় পরক্ষণেই অবনী শেখের বলা কথাটা মনে পড়ে যায় ‘মেয়েদের আত্মসম্মান সবকিছুর ঊর্ধ্বে’।মেহরিমা গলায় আটকে আসা কান্না টুকো গিলে নেয়। চঞ্চল হাতে চোখমুখ মুছে কাঠিন্যতার সহিত বলে,

“উনি আমাকে ভালোবেসে বিয়ে করেছে নাকি অন্য কোনো রিজনের জন্য বিয়ে করেছে সেটা আমাদের পার্সোনাল ম্যাটার ভাবী।আর যে পাখি আমার তাকে খাঁচায় বন্দি করে রাখলেও আমারই থাকবে,মুক্ত আকাশে উড়তে দিলেও দিনশেষে আমার কাছেই ফিরে আসবে।কারণ তার শেষ গন্তব্যস্থল শুধুই আমি।”

মেহরিমার জবাব শুনে আরিশার তোতা মুখ ভোঁতা হয়ে যায়।তৃধা,তাবান,তাইফের মুখে মুচকি হাসি ফুটে ওঠে। নিস্তব্ধতার মাঝেই হৃদিতের গম্ভীর স্বর ভেসে আসে,

“তৃধা মেহরিমা কে নিয়ে বাড়ির ভেতরে যা।”

সবাই তৎক্ষণাৎ কন্ঠস্বর লক্ষ্য করে সেদিকে দৃষ্টিপাত করে।হৃদিতের গায়ে থাকা সাদা শার্ট টা ভিজে শক্তপোক্ত শরীরের সাথে লেপ্টে গেছে।ঘাড় ছুঁই ছুঁই বড় চুলগুলো কপালের উপর অযত্নে পড়ে আছে।পুরুষালি শাণিত চোয়াল আরও বেশি শাণিত লাগছে।মুখমণ্ডল রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।দেখেই বোঝা যাচ্ছে বাইরে থেকে সোজা এখানেই এসেছে।হৃদিত বাগান বাড়িতে গেছিল হ্যানসেল আর হ্যারি কে সঙ্গে নিয়ে আসতে।এখন থেকে নিজের সাথেই রাখবে।হৃদিত বাসায় এসেছে পাঁচ মিনিট হতে চললো।দুই ঘন্টা যাবৎ অ্যানাবেলা কে না দেখতে পেয়ে হৃদিতের মনে অশান্তি শুরু হয়ে গেছিল।সেই অশান্তি কমাতেই দ্রুত ড্রাইভিং করে বাসায় এসেছে।দৌড়ে দোতলায় উঠে নিজের রুমে যেয়ে সেখানে মেহরিমা কে দেখতে না পেতেই মাথা খারাপ হয়ে যায় হৃদিতের।ঘরের জিনিসপত্র পুরো লন্ডভন্ড করে ফেলে।ব্যালকনিতে খোঁজার উদ্দেশ্যে পা বাড়াতেই পুকুর পাড়ে মেহরিমা কে দেখতে পাই।তারপর এক ছুটে পুকুরপাড়ে উপস্থিত হয়।আর উপস্থিত হতেই আরিশা,মেহরিমার সব কথোপকথন শুনতে পাই।হৃদিতের কথায় সবাই উঠে চলে যেতে নিলেই হৃদিত বলে,

“ভাবী আপনাকে যেতে বলিনি।তৃধা মেহরিমাকে আমার রুমে দিয়ে আসবি।তাবান গাড়িতে হ্যানসেল,হ্যারি আছে।ওদের বের করে বাগানে নিয়ে আয়।”

নিজের কথা শেষ করে তাবানের দিকে গাড়ির সুইচ ছুড়ে মারে হৃদিত।তাবান সেটা নিয়ে তাইফের সাথে ওখান থেকে প্রস্থান করে।তৃধাও মেহরিমা কে নিয়ে বাড়ির দিকে চলে যায়।মেহরিমা যাওয়ার আগে ছলছল চোখে হৃদিতের দিকে তাকায়।মেহরিমার চোখের পানি লক্ষ্য করতেই হৃদিতের বুকে আগুন জ্বলে ওঠে।আরিশার দিকে অগ্নি দৃষ্টিতে তাকিয়ে হিসহিসিয়ে বলে,

“ইয়্যু নো আই হেইট স্লাট।আই ডোন্ট ওয়ানা টক টু ইয়্যু।আই জাস্ট ওয়ানা সে,স্টে এওয়ে ফ্রম মাই অ্যানাবেলা।”

তীব্র অপমানে আরিশার চোখমুখ শক্ত হয়ে ওঠে।ভেতরে ভেতরে রাগে ফুঁসতে থাকে।তবুও মুখে হাসি টেনেই বলে,

“পারলে তোমার বউ কে আমার থেকে দূরে রাখো।”

“আমাদের মাঝে মেহরিমা কে নিজের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করার মতো ভুল নিশ্চয় করবে না? ছয়মাস আগের কথা এতো সহজেই ভুলে গেলে?সংসার করার ইচ্ছা আছে তো নাকি?”

হৃদিতের ঠোঁটে বাঁকা হাসি।আরিশা হৃদিতের কথায় কিংকর্তব্যবিমূড়!এই ছেলেকে হালকা ভাবে নেওয়া মানেই নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারা‌। পরক্ষণেই ছয় মাস আগের কথা মনে পড়তেই আরিশার বুক কেঁপে ওঠে।হৃদিত আর কিছু না বলে বাড়ির উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরতেই আরিশা উঁচু কন্ঠে বলে,

“ফুপিমনি আসবে নেক্সট উইকে।”

আরিশার কথায় হৃদিতের পা জোড়া থেমে যায়। ঠোঁট কামড়ে কিছু একটা ভাবে।

“তোমার শুভাকাঙ্ক্ষী ঠিক তোমার মতোই মাথামোটা।”

কথাটা বলেই সামনের দিকে হাঁটা ধরে হৃদিত।আরিশা চোখমুখ কুঁচকে হৃতিতের যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে।হৃদিতের রুমের ব্যালকনি থেকে সবটাই দেখে মেহরিমা।ব্যস্ত পায়ে রুমে প্রবেশ করে।রুমের অগোছালো অবস্থা দেখে মেহরিমা কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়িয়ে থাকে।কিছুক্ষণ আগে দৌড়ে ব্যালকনিতে যাওয়ার সময় কিছুই খেয়াল করেছিল না।তবে ওর খুব ভালো করে মনে আছে যখন রুম থেকে বের হয় তখন সব ঠিকঠাক ছিল। তাহলে এখন এরকম অবস্থা কি করে হলো?

______

রাত দশটা বেজে পাঁচ মিনিট।শেখ পরিবার রাতের খাওয়ার আয়োজন করছে।অবনী শেখ খাবার সার্ভ শেষ করে একটা চেয়ার টেনে বসে।নিজেও খেতে শুরু করে।জলিল শেখের চোখ মুখ কেমন শুকনো লাগছে।খাবারও খাচ্ছে না তেমন।অবনী শেখ সেটা লক্ষ্য করতেই বলে,

“কি হয়েছে তোমার?কোনো কিছু নিয়ে তুমি কি টেনশড?”

জলিল শেখ সময় নিয়ে জবাব দেয়,

“আগামীকাল চৌধুরী পরিবারের সবাই কে দাওয়াত করেছি।আজ সকালে আমার সাথে দেখা করেছে এমপি আরিফ হাসান চৌধুরী আর ওনার বড় ছেলে মন্ত্রী আয়াশ চৌধুরী।নতুন আত্মীয় আমার।ভদ্রতা বজায় রাখতে দাওয়াত করেছিলাম ওনারা গ্রহণ করেছে।”

জলিল শেখের কথায় অবনী শেখ মুচকি হেসে বলেন,

“হ্যাঁ তো এখানে টেনশন করার কি আছে?দাওয়াত দিয়েছো ভালো করেছো।এমনিতেও দাওয়াত দিতেই হতো ওনাদের।এই সুযোগে নীলাক্ষী আর হৃদিত ও এসে কিছুদিন এখানে থেকে যাবেনে।”

“তুমি এতো সহজেই সব ভুলে গেলে অবনী?”

“অতীত মনে রেখে নিজেকে কষ্ট দেওয়ার মতো মেয়ে আমি না।আর ওই পরিবারের সাথে আমার মেয়ে জড়িয়ে আছে এখন।এতটুকু তো করতেই হবে আমাদের।”

অবনী শেখের কথায় জলিল শেখের বুক থেকে পাথর নেমে যায়।এতো সহজেই যে সবটা মেনে নেবে সেটা জলিল শেখ ভাবতেও পারেনি। অবশ্য অবনী শেখের দ্বারা সব পসিবল।মাধবী নিরব দর্শক। মনোযোগ দিয়ে খাবার খাচ্ছে আর বাবা মায়ের কথোপকথন শুনছে।মেহরিমা আসবে শুনেই মাধবীর মনটা ফুরফুরে হয়ে যায়।

______

মেহরিমা ঠান্ডা ফিরফিরে বাতাসে ব্যালকনির দোলনায় বসে অন্ধকারাচ্ছন্ন আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে।মনটা হঠাৎ করেই কেমন বিষাদে ছেয়ে গেছে।মনের মাঝে হাজারো প্রশ্ন,চিন্তা ঘোরপাক খাচ্ছে।এই বাড়িতে এসে কেমন যেনো গোলক ধাঁধার মধ্যে আটকে পড়েছে!তখন দুপুরে হৃদিত রুমে এসে একাই সব পরিষ্কার করে গোছগাছ করে আবারও আগের মতো ঝকঝকে করে ফেলে রুম।মেহরিমা হেল্প করতে চাইলেও না করে দেয়।ইভেন ওই টপিকে প্রশ্ন করলেও হৃদিত বার বার ইগনোর করছে টপিক টা।মনের মাঝে বড্ড অশান্তি অনুভব হচ্ছে মেহরিমার।ইতোমধ্যে ফোনে তিনবার অবনী শেখের সাথে কথা বলেছে।তবুও শান্তি পাচ্ছে না।মায়ের কোলে মাথা রেখে শুতে পারলে বোধহয় একটু শান্তি অনুভব হতো।মেহরিমার ভাবনার মাঝেই ওর পাশে হৃদিত এসে বসে।মেহরিমা ধ্যান চ্যুত হয়।পাশে বসা হৃদিতের দিকে চোখ তুলে তাকায়।

“মন খারাপ?”

“উহু।”

“শরীর খারাপ?”

“উহু”

“পেইন কিলার নিয়েছিলিস?”

“হুম।”

“মায়ের কথা মনে পড়ছে?”

মেহরিমা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।হৃদিত মুচকি হেসে মেহরিমাকে নিজের উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে নেয়।হৃদিতের প্রশস্ত বুকে প্রশান্তিতে মাথা রাখে মেহরিমা।

“কাল নিয়ে যাবো।খুশি?”

মেহরিমার মুখে হাসি ফুটে ওঠে।খুশিতে গদগদ হয়ে বলে,

“সত্যিই!”

“তিন সত্যি।”

“একটা কথা জিজ্ঞাসা করবো?”

“হু।”

“ওই দরজা টা কিসের?”

ব্যালকনির সাথে লাগোয়া কাঁচের একটা দরজা হাতের ইশারায় দেখিয়ে বলে।হৃদিত মেহরিমার কপালে ছোট্ট করে ভালোবাসার পরশ দিয়ে বলে,

“আমার পার্সোনাল লাইব্রেরী,আর্টরুম ওটা।”

“আমি দেখতে চাই।”

“আচ্ছা দেখাবো।”

হৃদিত কিছুক্ষণ থেমে আবারও বলতে শুরু করে,

“দুপুরে রুমে এসে তোকে না পেয়ে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম।তাই রাগের মাথায় ওরকম টা করে ফেলেছি।তোকে এক সেকেন্ড না দেখলে আমার অস্থির লাগে খুব।আই ওয়ানা স্পেন্ড মাই হোল লাইফ উইদ ইউ।”

মেহরিমা তৃপ্তির হাসি দিয়ে বলে,

“ডোন্ট প্রমিজ জাস্ট প্রুভ।”

“অবভিয়াসলি আই উইল প্রুভ ইট।”

ওদের কথার মাঝেই হ্যানসেল আর হ্যারি ছুটে এসে ওদের সামনে বসে লেজ নাড়াতে থাকে।এই একদিনেই মেহরিমার ভক্ত হয়ে গেছে দুটো।

“ঘুমাবি না?”

“হ্যাঁ।”

কথা শেষ করার সাথে সাথেই নিজেকে শূন্যে অনুভব করে মেহরিমা।ভয়ে হৃদিতের গলা জড়িয়ে ধরে।হৃদিত রুমে এসে মেহরিমাকে শুইয়ে দেয় বেডে।রুমের দরজা,জানালা,লাইট সব অফ করে দিয়ে এসি অন করে দেয়।মেহরিমার গায়ে কমফোর্টার তুলে দিয়ে নিজেও ওটার মধ্যে ঢুকে পড়ে।মেহরিমাকে জড়িয়ে ধরে কপালে দীর্ঘ ভালোবাসার পরশ দিয়ে চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়।মেহরিমা মুচকি হেঁসে হৃদিতের বুকে মাথা রেখে ঘুমের দেশে পাড়ি দেয়।মূহুর্তের মধ্যেই কিছুক্ষণ আগের নিজের আকাশ পাতাল ভাবনা ভুলে যায়।

#চলবে_____

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে