কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-০৯

0
81

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_০৯
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

ভোর ছয়টা বেজে সাত মিনিট।নিকষ কালো রজনী কেটে যেয়ে ধীরে ধীরে ধরনীর বুকে আলোরা হানা দিচ্ছে।রাত থেকে এখনো বৃষ্টি থামেনি।সে তার নিজ ধারায় বর্ষণ হয়েই চলেছে।বৃষ্টি প্রকৃতির এক অপূর্ব রহস্য। সকাল সকাল মেঘের গর্জন, বাতাসের ঝাপটা,ঠান্ডা বৃষ্টির ফোঁটা সব মিলিয়ে এক অপার সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে।আশেপাশের ছোট ছোট ডোবা গুলো এখন পানিতে থৈ থৈ করছে।

মেহরিমাদের উঠানের ঠিক মাঝখানে একটা বড় বকুল ফুল গাছ আছে।মেহরিমা সেই বকুল ফুল গাছটার নিচে কর্দমাক্ত অবস্থায় থ মেরে বসে আছে!ওর একপাশে র ক্তা ক্ত রাম দা পড়ে আছে। এই বৃষ্টির পানিও যেনো ওই নি কৃ ষ্ট তাজা র ক্ত স্পর্শ করতে দ্বিধাবোধ করছে!আর অন্য পাশে মাধবী বসে বসে কান্না করছে।মেহরিমার চোখে এক বিন্দু পরিমাণ পানি নেই।দেহে প্রান থেকেও যেনো নেই।চোখদুটো ফুলে বালিশ হয়ে আছে।পরনের জামাটার দুই হাতাই ছেঁড়া।হাঁটু সমান দীঘল কালো কেশ গুলো অবহেলায় কাঁদার মধ্যে পড়ে আছে।গলা,গালে,হাতে কামড়ের দাগ নখের আঁচড়ের দাগ গুলো নীল বর্ণ ধারণ করেছে।ঠোঁট,কপাল ফেটে র ক্ত জমে গেছে।সেই মধ্যরাত থেকে এভাবেই বৃষ্টির বর্ষণে নিজেকে সঁপে দিয়ে মাটির দিকে একইভাবে তাকিয়ে আছে মেহরিমা।এই পৃথিবীর কোনো কিছুই যেনো ওর চোখে পড়ছে না!এই পৃথিবীতে থেকেও যেনো কোনো এক অজানা ভাবনার গহীনে হারিয়ে ফেলেছে নিজেকে।বৃষ্টি নাকি মনের যত যন্ত্রণা,কষ্ট সব ধুয়ে মুছে নিজের সাথে নিয়ে যায় তাহলে আজ মেহরিমার সব যন্ত্রণা কেনো নিয়ে যাচ্ছে না?নাকি আজ মেহরিমার মতো বৃষ্টিও অপারগ!

মেহরিমার ঠিক দুই হাত দূরে সটান হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হৃদিত।হাজার হাজার বৃষ্টির ফোঁটা মাথায় নিয়ে মেহরিমার দিকে নির্বিকার ভাবে চেয়ে আছে।মেহরিমা সেটাও খেয়াল করেনি।হৃদিতের মনের ভেতরে কি চলছে সেটা তার অতি সাধারণ দৃষ্টি দেখে বোঝার উপায় নেই।অনেকক্ষণ বৃষ্টিতে ভেজার দরুন নীল রঙের মণি জোড়া দেখতে ফ্যাকাশে লাগছে।আজ পুরো হৃদিতটাই যেনো শান্ত হয়ে গেছে।ঠিক ঝড় ওঠার আগে প্রকৃতি যেমন শান্ত হয়ে যায়!হৃদিতের এই স্বাভাবিক রুপ দেখে তাবান,তাইফ শুকনো ঢোক গিলছে বারবার।হৃদিতের হিং স্র তা র সাথে খুব ভালোভাবেই পরিচিত ওরা।শিহাব হসপিটালে অ্যাডমিট আছে।

তখন সেই মধ্যরাতে শিহাবের সাথে ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে মেহরিমা শান্ত হয়ে যায়।শিহাব তখন নিজের কার্য হাসিলে লেগে পড়ে।মিনিট দুয়েক পর শিহাব এক গগন বিরোধী চিৎকার দিয়ে নিজের চোখ ধরে মেহরিমার পাশেই পড়ে যায়। শিহাবের চোখ দিয়ে অনবরত র ক্ত ঝরছে।মেহরিমা নিজের মাথায় থাকা সরু চিকন ক্লিপ দিয়ে সুযোগ বুঝে শিহাবের চোখে আঘাত করেছে।মেহরিমা তখন চটজলদি উঠে পড়ে এক দৌড়ে কিচেন থেকে রাম দা এনে শিহাবের কাতরানো অবস্থায়ই ওর ডান বাহুতে কো প বসায়।পরপরই দুই পায়ের থাইয়ের উপর অনেক গুলো কো প বসায়। শিহাব একের পর এক চিৎকার দিয়ে নিজের প্রাণভিক্ষা চেয়েই চলেছে কিন্তু মেহরিমার থামার কোনো নাম ই নেই। মধ্যরাতের বৃষ্টির শব্দের সাথে সেই করুণ চিৎকারের শব্দ পরিবেশ ক্রমশ আরও ভারী করে তুলছে!মেহরিমার ভেতরে যেনো কোনো এক অদৃশ্য শক্তি ভর করেছে।মেহরিমার রুদ্রমূর্তি দেখে মাধবীও মেহরিমার নিকট আসার সাহস পাচ্ছে না।বুকে আরও কয়েক টা কো প বসাতেই ওখানেই সেন্সলেস হয়ে যায় শিহাব।ততক্ষণে শিহাবের চিৎকার শুনে শেখ বাড়ির মেইন গেইটের তালা ভেঙে আশেপাশের সবাই উপস্থিত হয়েছে।ঘরের মেইন ডোরে সবাই মিলে করাঘাত করেই চলেছে। মাধবী এবার অতিরিক্ত ভয় পেয়ে যায়।সাথে সাথে দৌড়ে এসে মেহরিমা কে জাপটে ধরে কান্না করতে করতে বলে,

“মেহু মায়ের ফোন বন্ধ।আমি অনেক বার চেষ্টা করেছি কিন্তু কল ঢোকেনি।বাবা তো ফোন ই নিয়ে যায়নি। পাড়ার সব মানুষ চলে এসেছে আমাদের বাড়ি।এখন কি হবে মেহু?এ..এ..এই শিহাব কি মা রা গেছে?”

মেহরিমা কোনো উত্তর না দিয়ে আলগোছে মাধবীর থেকে নিজেকে ছাড়িয়ে রাম দা হাতে নিয়েই বিধ্বস্ত অবস্থায় ড্রয়িং রুমের দরজা খুলে দেয়।পাড়া প্রতিবেশীরা মেহরিমার এহেন রুপ দেখে কিংকর্তব্যবিমূঢ়!মেহরিমা সবার দিকে এক পলক চেয়েই বাইরে বের হয়ে যায়।মেহরিমার হাতে রাম দা থাকায় কেউ আর কিছু বলার সাহস পাই না।মেহরিমার পিছন পিছন মাধবী ও এক ছুটে বের হয়ে যায় ঘর থেকে।তৎক্ষণাৎ সবাই ঘরে ঢুকে নিজেদের কানে শোনা সেই বি ভৎ স চিৎকারের উৎস খুঁজতে লেগে পড়ে।অচেতন অবস্থায় র ক্তা ক্ত শিহাব কে বিছানায় পড়ে থাকতে দেখেই হৈচৈ পড়ে যায় সেকেন্ডের ব্যবধানে।কয়েকজন মিলে তক্ষুনি শিহাব কে শহরের হসপিটালে নিয়ে চলে যায়।

মেহরিমাদের ঘরের সামনে থাকা বাল্বের সাদা আলোয় বাড়ির আঙ্গিনা ঝলমল করছে।মেহরিমা বকুল গাছের নিচে এসে হাতে থাকা দা ফেলে দিয়ে ধপ করে ওখানেই বসে পরে।শিহাবের করুণ অবস্থার কথা শুনতেই মেহরিমার চাচি রা এক প্রকার ছুটে আসে শেখ বাড়িতে।আর চাচারা শহরের হসপিটালের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।শিহাবের মা তীব্র আক্রোশ নিয়ে মেহরিমার চুলের মুঠি ধরে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতে থাকে আর থাপড়াতে থাকে।শিহাবের ছোট চাচি মেহরিমা কে কাঁদায় ফেলে ইচ্ছেমতো লাথাতে থাকে।মেহরিমা একদম নিশ্চুপ।মাধবী হাতজোড় করে,সবার পায়ে পড়েও থামাতে পারে না।গ্রামের মানুষ তখন তামাশা দেখতে ব্যস্ত।অথচ সবার নিজেদের দুর্দিনের সঙ্গি জলিল শেখের দুটো প্রাণকে বাঁচাতে কেউ এগিয়ে আসে না।তখনই হঠাৎ হৃদিতের আগমন ঘটে শেখ বাড়িতে।শেখ বাড়িতে এই প্রথম পা দেয় হৃদিত।ওর পদধ্বনির শব্দে প্রতিটা মানুষের হৃদয় ভয়ে কুঁকড়ে ওঠে।হৃদিত কে দেখতেই সকলের হৈচৈ থেমে যায়।মেহরিমার দুই চাচিও মেহরিমা কে ছেড়ে দেয়।হৃদিত ওদের দিকে এক পলক তাকাতেই ওরা ভয়ে কেমন জুবুথুব হয়ে তৎক্ষণাৎ শেখ বাড়ি ত্যাগ করে।সেই তখন থেকে এভাবেই বসে মেহরিমা।আর ওর ঠিক সামনে একইভাবে দাঁড়িয়ে আছে হৃদিত।

অবনী শেখ আর জলিল শেখ দৌড়ে এসে বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে।রাতে ফোনে চার্জ না থাকায় অবনী শেখের ফোনটা বন্ধ হয়ে গেছিল তাই এই সবের কিছুই জানতে পারেনি ওনারা।প্রায় ঘন্টা খানেক আগে হসপিটালের পরিচ্ছন্নতাকর্মীর থেকে সবটা শুনে তৎক্ষণাৎ বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেন ওনারা।হসপিটাল থেকে বাসায় আসতে আধাঘণ্টা মতো সময় লাগে।এতো সকালে কোনো ভ্যান না পাওয়ায় পায়ে হেঁটে আসতে ওনাদের প্রায় পঁয়তাল্লিশ মিনিট মতো লেগে গেছে। বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করতেই দুই মেয়েকে বিধ্বস্ত অবস্থায় দেখতে পেয়েই ওদিকে ছুটে চলে যান অবনী শেখ। দুই মেয়েকে নিজ হাতে আগলে নিতেই হাউমাউ করে কেঁদে ওঠে মাধবী।অনেকক্ষণ ধরে একইভাবে বৃষ্টিতে ভিজে অতিরিক্ত কান্নার ফলে কথা বলতে পারছে না মাধবী।মেহরিমা তখনও নিশ্চুপ।ওর কোনো হেলদোল ই নেই।জলিল শেখ ধীর গতিতে এগিয়ে এসে কাদার মধ্যে বসে মেহরিমা কে আগলে নিতেই মেহরিমার শরীরের অতিরিক্ত তাপমাত্রা অনুভব করতে পারে। নিজের প্রাণের চেয়ে প্রিয় দুটো ফুলের এতোটা করুণ অবস্থা দেখতেই বাবা নামক মানুষটার মন হু হু করে কেঁদে ওঠে। যাদের গায়ে কখনো একটা ফুলের টোকা ও লাগতে দেয়নি আজ এক রাতের ব্যবধানে তাদের এ কি অবস্থা!তবে কি নিজের দূর্বলতার শিকার নিজের ফুল দুটো হলো!জলিল শেখের চোখ দিয়ে অনবরত পানি পড়তে থাকে।অবনী শেখ রাগে থরথর করে কাঁপছে।রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে নিজের হাতে রক্তাক্ত রাম দা তুলে নিয়ে সকলের উদ্দেশ্যে বলে,

“আমার আল্লাহর কসম এক মিনিটের মধ্যে আমার বাড়ি ফাঁকা না করলে সব কয়টার লা শ পড়ে যাবে এখানে।”

অবনী শেখের রাগ সম্পর্কে কম বেশি সবাই অবগত।তাই দেরি না করে তাড়াতাড়ি বাড়ি খালি করে দেয় সকলে।কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে বাড়ির আঙ্গিনা খালি হয়ে যায়।সবাই চলে গেলেও থেকে যায় হৃদিত,তাবান আর তাইফ। অবনী শেখ শব্দ করে মাটিতে দা ফেলে এগিয়ে আসে হৃদিতের নিকট।হৃদিতের থেকে কয়েক হাত দূরে দাঁড়িয়ে বলে,

“আমাকে দেওয়া তোমার কথা রাখার সময় এসেছে হৃদিত।আশাকরি তুমি চৌধুরী পরিবারের বাকিদের মতো কাপুরুষ নও।”

অবনী শেখের কথায় হৃদিত মেহরিমার থেকে দৃষ্টি সরিয়ে অবনী শেখের দিকে দৃষ্টিপাত করে।হীম শীতল দৃষ্টি হৃদিতের।কয়েক সেকেন্ড মতো অবনী শেখের দিকে তাকিয়ে থাকে।হৃদিতের অধরে তখন বাঁকা হাসি ফুটে উঠেছে।অবনী শেখের কথায় কোনো প্রত্যুত্তর না করেই তাবান,তাইফ কে হাতের ইশারায় ডেকে তৎক্ষণাৎ শেখ বাড়ি ত্যাগ করে হৃদিত।অবনী শেখ হৃদিতের বক্র হাসির কারণ টা ঠিক ধরতে পারলো না। তবে উনি আশাবাদী হৃদিত নিজের দেওয়া কথা রাখবে।অবনী শেখের কথায় জলিল শেখ তব্দা খেয়ে যান!মেহরিমা আর মাধবী কে জড়িয়ে ধরে বসে থেকেই চোখ বড় বড় করে অবনী শেখের দিকে তাকিয়ে আছেন। জলিল শেখের মনে তখন হাজারও প্রশ্ন।নতুন করে কি আবারও ধ্বংস খেলায় নামতে চাচ্ছে অবনী? তবে কি অতীতের আবারও পুনরাবৃত্তি হবে?কথাটা ভাবতেই জলিল শেখের আত্মার পানি শুকিয়ে যায়।

অবনী শেখ এগিয়ে এসে মেহরিমার মাথায় হাত রাখতেই এক গোছা চুল উঠে আছে অবনী শেখের হাতে। অবনী শেখ চুলগুলোর দিকে পলকহীন চেয়ে থেকে হাত জোড়া মুঠো করে ফেলে। চোখ থেকে দু’ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়ে।সময় নিয়ে নিজেকে সামলিয়ে মেহরিমা আর মাধবী কে ঘরে নিয়ে যায়।মেহরিমা তখনও নিশ্চুপ। দুই মেয়েকে তাড়াতাড়ি গোসল করিয়ে দিয়ে অবনী শেখ নিজেও ফ্রেশ হয়ে নেয়।ততক্ষণে জলিল শেখ নিজেও ফ্রেশ হয়ে ডক্টরকে ইনফরম করেছে।ডক্টর সিয়ামের আসতে বিশ মিনিট মতো সময় লাগবে।মেহরিমা একদম পাথর বনে গেছে।কান্না টা পর্যন্ত করছে না।অবনী শেখ মেহরিমার জন্য ভেতরে ভেতরে চিন্তিত হলেও মেহরিমা কে সময় দিচ্ছেন উনি। তারপর না হয় সবটা জানা যাবে।অপরদিকে মাধবী কেঁদেই চলেছে।অবনী শেখের কোলের উপর মাথা রেখে মেহরিমা আর মাধবী কাঁথা গায়ে দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুয়ে আছে।অবনী শেখ ওদের মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে।হঠাৎ তখনই শেখ বাড়িতে পুলিশের আগমন ঘটে।

#চলবে______

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে