#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_০৭
#ইসরাত_তন্বী
❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌
সময় বিকাল বেলা। সূর্য পশ্চিম আকাশে অস্ত যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে। প্রতিদিনের মতো আজও প্রকৃতি হাস্যোজ্জ্বল।মেহরিমা শুয়ে শুয়ে ছটফট করছে।আজ ইচ্ছে করেই বাহানা দিয়ে কলেজে যায়নি যার ফলে হৃদিতের সুদর্শন পুরুষালি গম্ভীর মুখটাও দর্শন করতে পারেনি।মেহরিমার মনটাও যেনো আজ কেমন অস্থির লাগছে।শান্তি পাচ্ছে না।মন চাচ্ছে এক ছুটে চৌধুরী বাড়িতে চলে যেতে।মেহরিমা নিজের মনের চাওয়া কে প্রশ্রয় দিলো।যেই ভাবা সেই কাজ। বিছানা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ঝটপট ফ্রেশ হয়ে এসে নিজেকে পরিপাটি করে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। উদ্দেশ্যে কিচেন।
“মা!”
অবনী শেখ রাতের রান্না বসিয়েছেন।মেহরিমার ডাকে পেছনে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলেন,
“বল মা।কোনো দরকার?”
“মা আগামীকাল ম্যাথ ক্লাস টেস্ট আছে।তৃধার কাছে যাওয়ার দরকার ছিলো একটু। আজকের ম্যাথ নোট কালেক্ট করতে হবে।”
চৌধুরী বাড়ির কথা শুনতেই অবনী শেখের মুখমণ্ডল শক্ত হয়ে যায়।উনি কিছুটা গম্ভীর কন্ঠে বলেন,
“তোর ফোন কি হয়েছে?তৃধাকে নক দিয়ে হোয়াটসঅ্যাপে নিয়ে নে।”
“মা আজ তো ওয়াইফাই বন্ধ। লাইনে কি একটা সমস্যা হয়েছে।কালকের আগে আসবে বলে মনে হয় না।”
কথাটা শুনে অবনী শেখ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মেহরিমার দিকে তাকায়।ব্যস অমনিই মেহরিমার ভেতরের সাজানো সব কথা তালগোল পাকিয়ে যায়।
“শুধু কি ম্যাথ নোট কালেক্ট করতেই যাচ্ছিস?”
অবনী শেখের এমন কথাতে মেহরিমা থতমত খেয়ে যায়। অবনী শেখ তখন ও নির্বিকার ভাবে তাকিয়ে রয়েছে।মেহরিমা শুকনো ঢোক গিলে বলে,
“হুম মা।”
অবনী শেখ মিনিট দুয়েক সময় নিয়ে বলে,
“আচ্ছা যা। সন্ধ্যার আগে বাসায় চলে আসবি। আমার ব্যাগের সাইডে টাকা আছে নিয়ে যা।ভ্যানে যাবি ভ্যানে আসবি।”
মেহরিমা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে তাড়াতাড়ি করে টাকা নিয়ে বের হয়ে পড়ে।খুশিতে মেহরিমার লুঙ্গি ডান্স দিতে মন চাচ্ছে।গোমড়া মুখো টা হঠাৎ মেহরিমা কে দেখলে হয়তো খুব অবাক হবে!সেই সুদর্শন মুখের অবাক চাহনি নিশ্চয় নজরকাড়া!
মেহরিমা বাসা থেকে বেরিয়ে যেতেই অবনী শেখ দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। মনে মনে আওড়াই।
“ভয়ঙ্কর খেলায় মেতে উঠেছে সবাই।এর শেষ কোথায়?তোর সুখের কথা ভাবতে যেয়ে মায়ের মতো আমিও কোনো ভুল করে ফেলছি না তো নিলাক্ষী!”
তরকারি পোড়ার গন্ধ নাকে আসতেই অবনী শেখ নিজের ভাবনা থেকে বেরিয়ে তাড়াতাড়ি গ্যাস বন্ধ করে দেয়। অতঃপর রান্নায় মনোযোগী হয়।
_______
মেহরিমা ভ্যান থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে গুটি গুটি পায়ে বাড়ির দিকে এগিয়ে চলে।দারোয়ান শামসুল চাচা মেহরিমা কে দেখতেই হাসিমুখে বলেন,
“আরে মেহু মা যে! কতদিন পর এই বাড়িতে আইলা।তা কেমন আছো মা?”
মেহরিমা হাস্যোজ্জ্বল মুখে বলে,
“আলহামদুলিল্লাহ চাচা।আপনি,চাচি সবাই কেমন আছেন?”
“আমরা ভালা আছি মা।”
“চাচা ভেতরে যায় ।একটু পরেই সন্ধ্যা নেমে আসবে। বাসায় ফিরতে হবে তাড়াতাড়ি।”
“আচ্ছা মা যাও।”
মেহরিমা এবার দ্রুত পা চালিয়ে চৌধুরী বাড়িতে প্রবেশ করে।মেহরিমা এই বাড়ির ভেতরে ঢুকলেই কেমন যেন রাজপ্রাসাদের ফিল পাই!ও ড্রয়িং রুমে ঢুকতেই দেখতে পাই আয়েশা চৌধুরী আর আতিয়া চৌধুরী সোফায় বসে মুড়ি মাখানো খেতে খেতে গল্প করছে।চৌধুরী বাড়িতে আসলে এই দুই জনের মিল দেখে মেহরিমার মন প্রাণ জুড়িয়ে যায়।ওদের দেখে কখনো মনেই হবে না ওরা দু’জন একে অপরের জা!আপন বোনের মতো বন্ডিং দুজনের মধ্যে বিরাজমান।আতিয়া চৌধুরী গল্পের ফাঁকে সদর দরজার দিকে তাকাতেই মেহরিমা কে দেখতে পাই।আর তাতেই ওনার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। উনি এগিয়ে আসেন।
“আরে মেহু মা যে!আজকাল তো অমাবস্যার চাঁদ হয়ে গেছো তুমি।মাসে একবারও এই বাড়িতে পায়ের ধুলো দেও না।”
মেহরিমা মিষ্টি একটা হাসি দিয়ে বলে,
“আমার কথা বাদ দেন ছোট আন্টি।আমি তো ছয়মাস পরে একদিন হলেও এই বাড়িতে পা রাখি আপনাদের তো সেটুকু খবরও পাওয়া যায় না।”
মেহরিমার কথায় আয়েশা চৌধুরী এগিয়ে এসে বলেন,
“ঠিক বলেছিস মেহু মা।মায়েরা খোঁজ না নিলে মেয়ের খোঁজ কিভাবে পাবে?”
আয়েশা বেগমের কথা শুনে মেহরিমা উৎফুল্ল হয়ে ওনাকে জড়িয়ে ধরে।
“ঠিক বলেছন আন্টি।আজ না আমি আড্ডা দিতে পারবো না।বড্ড তাড়া আমার। সন্ধ্যার আগে বাসায় চলে যেতে হবে।তৃধা কোথায় আন্টি?”
“ও আর কোথায় থাকবে?দেখ গিয়ে রুমের কোথাও ফোন নিয়ে মটকা মেরে পড়ে আছে।”
“আচ্ছা।”
কথাটা বলেই মেহরিমা দৌড় লাগায় তৃধার রুমের উদ্দেশ্যে।তৃধার রুম দোতলার একদম সামনের টাই।আর হৃদিতের টা একদম কোনার দিকে। নিজের অন্ধকার রুমে হঠাৎ লাইট জ্বলে উঠতেই তৃধা চরম বিরক্ত হয়।আয়েশা চৌধুরীকে ভেবে কিছু বলতে যাবে তার আগেই চোখ খুলে মেহরিমা কে দেখে তৃধা চমকে এক লাফে শোয়া থেকে উঠে বসে। কন্ঠে অবিশ্বাস্যতা মিশিয়ে বলে,
“আমি কি স্বপ্ন দেখছি!নাকি হ্যালুসিনেশন হচ্ছে আমার?”
“আরে ভাই কিছুই হচ্ছে না তোর সাথে।আমি সত্যিই এসেছি। তাড়াতাড়ি আজকের ম্যাথ নোট দে।ফটাফট কয়টা ছবি তুলে নিই।”
তৃধা নিজেকে ধাতস্থ করে বলে,
“মেহু বেইবি এতদিন পরে আসলি আমার বাসায়। কিছু তো খেতেই হবে। তারপর বাকি সব।”
“না রে,মা সন্ধ্যার আগে বাসায় ফিরতে বলেছে। মাগরিবের আজানের আর মাত্র আধাঘণ্টা বাকি আছে।”
অবনী শেখের কথা শুনতেই তৃধা দমে গেলো। স্টাডি টেবিলের সামনে এসে ব্যাগ থেকে একটা খাতা বের করে মেহরিমাকে দেয়।মেহরিমা ছবি তুলতে নিলেই তৃধা বলে ওঠে,
“আরে আরে ছবি তুলোস কেন?কলেজে একটা ক্লাস মিস দিয়ে তোর জন্য আলাদা করে নোট করে রেখেছি আমি।খাতা সহ নিয়ে যা।”
মেহরিমা খুশি হয়ে তৃধাকে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে।অতঃপর তৃধাকে সঙ্গে করে আয়েশা চৌধুরী আর আতিয়া চৌধুরীর থেকে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।মেহরিমার মনটা খারাপ হয়ে যায়।যার জন্য আসলো তার দেখাই পেলো না।হুদাই এতো কষ্ট করে আসা।বাড়ির সদর দরজা পার হতেই তৃধা মেহরিমার হাত থেকে পার্স আর খাতা নিয়ে নেয়।মেহরিমা জিজ্ঞাসা সূচক দৃষ্টিতে তাকাতেই তৃধা বলে,
“তোর হ্যান্ডসাম বাড়ির পিছনে পুকুর পাড়ে আছে।যার জন্য এসেছিস তার সাথে দেখা না করেই চলে গেলে হবে বেইবি!আমি সামনের দোলনায় বসছি। চটজলদি নিজের কাজ সেরে আয় যা।”
তৃধার কথায় মেহরিমা লজ্জা পেয়ে যায়।তবে সুযোগ টা হাত ছাড়া করে না।গুটি গুটি পায়ে বাড়ির পেছনের দিকে হাটা ধরে।মেহরিমা প্রস্থান করতেই তৃধা উচ্চস্বরে হেসে ওঠে।সেই হাসির শব্দ মেহরিমা নিজেও শুনতে পায়।
মেহরিমা বাড়ির পেছনে পুকুর পাড়ে আসতেই দেখতে পাই চোখ ধাঁধানো এক সুন্দর দৃশ্য। সুদর্শন এক যুবক পুকুরের সিঁড়িতে তার নিজস্ব স্টাইলে বসে গিটারে দক্ষতার সাথে সুর তুলছে।সে যেনো নিজের মতো করে নিজস্ব এক দুনিয়ায় বিরাজ করছে!হৃদিতের একপাশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে।সন্ধ্যার লালাভ আলোতে ফর্সা মুখটা খুবই মোহনীয় লাগছে। চোখের লীল মণিতে লালাভ আবছা আলো পড়ে যেনো জ্বলজ্বল করছে!গান গাওয়ার তালে তালে অ্যাডামস অ্যাপেল ওটা নামা করছে।ব্যান্ডেজ করা হাতের লম্বা চওড়া আঙ্গুল গুলো দিয়ে সুনিপুণ ভাবে গিটারের তার নাড়িয়ে চলেছে।মেহরিমার কানে বেজে ওঠে এক সুমধুর কন্ঠস্বর থেকে ভেসে আসা গানের কিছু লাইন।
“দুরে কোথাও আছি বসে
হাত দুটো দাও বাড়িয়ে।
বিরহ ছুঁ তে চায় মনের দুয়ার
দু’চোখ নির্বাক আসো না ছুটে।
তুমি এলে রংধনু রং ঢেলে দেয়
তুমি এলে মেঘেরা বৃষ্টি ছড়ায়।
এ মনের আহ্লাদ আসো না ছুটে।
দুরে কোথাও আছি বসে
হাত দুটো দাও বাড়িয়ে।
বিরহ ছুঁ তে চায় মনের দুয়ার
দু’চোখ নির্বাক আসো না ছুটে।
(সংক্ষেপিত)
মেহরিমা দু’চোখ বন্ধ করে গানটা অনুভব করতে থাকে।হৃদিত মেহরিমার উপস্থিতি আগেই অনুভব করেছিল।হৃদিত যেন জানতো মেহরিমা আসবে!তাই তো এতো আবেগ ভালোবাসা মিশিয়ে গান গাইলো।হৃদিত মেহরিমার মুখের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে।অতঃপর মুখটা স্বভাবগত কঠিন করে গম্ভীর কন্ঠে বলে,
“চুরি করা পাপ।”
হঠাৎ হৃদিতের গম্ভীর কন্ঠ কর্ণগোচর হতেই মেহরিমা চমকে চোখজোড়া খুলে তাকায়।গানের মধ্যে এতোটাই মজে ছিলো যে গান কখন শেষ হয়ে গিয়েছে সেটাও টের পাইনি।মেহরিমা চোখ নামিয়ে নেয়।এভাবে চুরি করে গান শুনে ধরা পড়ে যাওয়াতে লজ্জার সাথে একরাশ অস্বস্তি এসে জেঁকে ধরে মেহরিমাকে।পরক্ষণে চোখ তুলে তাকাতেই মেহরিমার দৃষ্টি যেয়ে পড়ে হৃদিতের হাতের দিকে।মেহরিমা আঁতকে ওঠে!ও কোনোরকমে বলে,
“আ..আমি চুরি করিনা হৃদিত ভাই। আপনার হাতে কি হয়েছে হৃদিত ভাই?সেদিন ও না সব ঠিক ছিলো!”
“অনেক বড় কিছু চুরি করেছিস তুই।সেটার শাস্তিই এখনো দিতে পারলাম না তোকে।নতুন করে এখন তুই আমার পারমিশন ছাড়া চুরি করে গান শুনলি। আবার কানের কাছে কি এক ভাই ডাক লাগিয়ে রেখেছিস।তোর কোন জন্মের ভাই লাগি আমি? এতগুলো ভুলের জন্য তোকে কি শাস্তি দেওয়া উচিত বল?”
“আ.. আমার ভুল হয়ে গেছে।আর কখনো এমন হবে না।”
“উহু তা বললে তো চলবে না।তবে তোর শা স্তি কমানোর জন্য আমি একটু সাহায্য করতে পারি যদি তুই আমার কথা শুনিস।”
মেহরিমা যেন একটু আশার আলো দেখতে পাই।ওর চোখ মুখ ঝলমলিয়ে ওঠে।চোখে মুখে তীব্র আগ্রহ নিয়ে জানতে চাই ,
“কি করলে আমার শা স্তি কমবে?”
“চল বিয়ে করে ফেলি।তখন তুই আমার অর্ধাঙ্গিনী হয়ে যাবি।তোর সবকিছুই আমার হয়ে যাবে।সেই হিসেবে তোকে একটু কম শাস্তি দিয়ে সাহায্য করতেই পারি। অনেক বড় অফার। ভেবে দেখতে পারিস।লাভ ছাড়া লস নাই।”
হৃদিতের মুখে এমন কথা শুনে মেহরিমা তব্দা খেয়ে চোখগুলো রসগোল্লার মতো গোলগোল করে হৃদিতের দিকে তাকিয়ে থাকে।হৃদিত কৌশলে হাতের কথাটা এড়িয়ে যায়।নিজের কথার জালে মেহরিমা কে আবদ্ধ করে রাখে।বোকা মেহরিমা আদৌও সেটা বুঝলো কি?হয়তো না!পাঁচ মিনিট মতো সময় নিয়ে মেহরিমা মনের ভেতরের জমানো কথাগুলো যখনই উজাড় করতে যাবে সেই মূহূর্তে তড়িৎ গতিতে ফ্যাকাশে মুখ নিয়ে হাজির হয় তৃধা।
“মেহরিমা তোর চাচারা আঙ্কেল কে মেরে মাথা ফাটিয়ে দিয়েছে। আন্টি,মাধুপু আর গ্রামের কিছু মানুষ মিলে ওনাকে হসপিটালে নিয়ে গেছে। মাথা থেকে অনেক ব্লি ডিং হচ্ছে।মাধুপু তোকে তাড়াতাড়ি হসপিটালে যেতে বললো।”
কথাটা শুনতেই মেহরিমার পুরো পৃথিবী দুলে ওঠে! ‘ব..বাবা’ অস্ফুট স্বরে উচ্চারণ করেই নিজের হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ওখান থেকে ছুটে চলে যায়। গন্তব্যস্থল হসপিটাল।
“আরে…আরে মেহু বেইবি তোর পার্স আমার কাছে।”
কথাটা বলে তৃধাও দৌড় দেয় মেহরিমার পিছন পিছন।হৃদিত গিটার কাঁধে ঝুলিয়ে উঠে দাঁড়ায়। মেহরিমার ইগনোর টা হৃদিত ঠিক মেনে নিতে পারলো না।হৃদিতের এতো ইম্পর্ট্যান্ট কথার উত্তর না দিয়েই ছুটে চলে গেলো!ওকে কি কোনোভাবে রিজেক্ট করে দিলো?মেহরিমা ওর থেকে অন্য কাউকে বেশি প্রায়োরিটি দেয় কথাটা মস্তিষ্ক জানান দিতেই হৃদিতের মুখমণ্ডল শক্ত হয়ে কঠিন রুপ ধারণ করে।হাতজোড়া মুঠো করে ফেলে।
#চলবে_______