কাঠগোলাপের আসক্তি পর্ব-০৩

0
7

#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#পর্ব_০৩
#ইসরাত_তন্বী

❌অনুমতি বিহীন কপি করা কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ ❌

গ্রামের নাম আনন্দপুর।আনন্দপুর নামটার মতোই গ্রামটাও আনন্দ,শান্তিতে ভরপুর।গ্রামের চারি পাশ সবুজে ঘেরা।চোখের দৃষ্টি যতদুর যায় ততদুর শুধু সবুজ আর সবুজে ভরপুর!প্রকৃতির এই সবুজ রুপ যেন চোখের প্রশান্তি বয়ে আনে!গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে বিষ্ণু নদী। নদীর ওপারে আরেক গ্রাম। আনন্দপুর শুধু নাম মাত্রই গ্রাম।শহরের আধুনিকতার ছোঁয়া পৌঁছে গেছে ইতোমধ্যেই।এমপি, মন্ত্রীর নিজের জন্মভূমি, নিজস্ব গ্রাম হওয়ায় উন্নয়নের দিকে অনেক এগিয়ে আনন্দপুর গ্রাম।প্রাইমারি স্কুল থেকে শুরু করে কলেজ, হসপিটাল, মার্কেট সব রয়েছে এই গ্রামে।

মেহরিমার কলেজ থেকে পূর্ব দিকে পনেরো মিনিট মতো আসলেই দেখা মেলে এক মনোরম পরিবেশের।রাস্তার দুই ধারে সারি বেঁধে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে শত শত মেহগনি গাছ।মেহগনি গাছগুলোর শাখা প্রশাখার মধ্য দিয়ে ক্ষণে ক্ষণে উঁকি দিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দিচ্ছে সূর্যি মামা।রাস্তার দুই পাশে ফাঁকা যায়গা গুলোতে সবুজ ফসলে ভরপুর।থেকে থেকে ঠান্ডা ঝিরিঝিরি বাতাস বইছে।চোখ,মন জুড়িয়ে যাওয়ার মতো পরিবেশ!হৃদিত মেহরিমাকে এই জায়গাটাতেই নিয়ে এসেছে।পাঁচ মিনিট ধরে একদৃষ্টিতে মেহরিমার দিকে তাকিয়ে আছে হৃদিত।
মেহরিমা ভয়ে,অস্বস্তিতে হাঁসফাঁস করছে।

উজ্জ্বল ফর্সা গায়ের রং।নাকটা শরু আর মাঝারি লম্বা।চোখ দু’টো টানা টানা তার মাঝে কুচকুচে কালো মণি টা জ্বলজ্বল করছে।চোখের পাপড়ি গুলোও তুলনামূলক বড় আর ঘন।কথা বলতে গেলেই থুতনিতে টোল পড়ে।আর সবচেয়ে আকর্ষণীয় হচ্ছে মেহরিমার চিকন পাতলা গোলাপী ঠোঁ টে র উপরের বাম সাইডের কালো তিল টা।এই তিলটা হৃদিত কে বড্ড টানে।সেকেন্ডের মাঝে ওকে এলোমেলো করে দেয়!দীর্ঘ আট মাস পর নিজের হৃদমোহিনী কে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে যেয়ে,হৃদিত নিজের অজান্তেই অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে।

“মা শা আল্লাহ।”

এখানে পৌঁছেই গাড়ির গ্লাস নামিয়ে দিয়েছে হৃদিত।তাতে যেন মেহরিমা একটু স্বস্তি পায়।কিন্তু হৃদিতের ওই নীল চোখের নে শা লো দৃষ্টিটা মেহরিমা ঠিক হজম করতে পারছে না।মেহরিমার শরীরটা কেমন অবশ হয়ে আসছে!ত ল পে টে ইতোমধ্যে প্রজাপতি রা উড়াউড়ি শুরু করে দিয়েছে।আর কিছুক্ষণ এভাবে থাকলে নির্ঘাত জ্ঞান হারাবে!নিজের মাঝে সাহস জুগিয়ে মেহরিমা বলে,

“আ..আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে। বাসায় যেতে হবে।”

মেহরিমার কথায় হৃদিত নড়েচড়ে বসে।তারপর চোখ দিয়ে ওর উরু ইশারা করে বলে,

“ডান পা রাখ এখানে।”

মেহরিমা চমকে ওঠে!চোখ গুলো মার্বেলের মতো গোল গোল করে হৃদিতের দিকে তাকায়।

“ওভাবে কি দেখছিস পা রাখ এখানে।”

“আ.. আপনি বড় আমার থেকে।আমি পারবনা।”

ব্যস অমনিই হৃদিতের মেজাজ বিগড়ে যায়। রাগে গজগজ করতে করতে হাতে থাকা ভায়োডিন আর তুলা গাড়ির জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয় মাটিতে। সেকেন্ডের ব্যবধানে কি ঘটে গেল সেটা মেহরিমার মস্তিষ্ক উপলব্ধি করতেই মেহরিমা হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে থাকে বাইরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা ভায়োডিন আর তুলার দিকে।হৃদিত গাড়ি স্টার্ট দিতে নিলেই মেহরিমা আঁতকে উঠে বলে,

“আপনার দোহাই লাগে গাড়ি স্টার্ট দিবেন না।আমি পা রাখছি।”

কথাটা শুনতেই হৃদিত অগ্নি দৃষ্টিতে তাকায় মেহরিমার দিকে।হৃদিতের ওমন দৃষ্টি লক্ষ্য করতেই মেহরিমার ছোট্ট হৃ ৎ পি ন্ড টা লাফিয়ে ওঠে।আজ আর বাঁচা হলো না!আজই বোধহয় জীবনের শেষদিন।মেহরিমার চোখের সামনে নিজের বাবা,মা,বড় বোন মাধবীর মুখটা ভেসে ওঠে।মনে মনে একনাগাড়ে দোয়া দরুদ পড়তে থাকে।হৃদিত কয়েক সেকেন্ড ওর দিকে তাকিয়ে থেকে গাড়ির দরজা খুলে,নেমে যেয়ে ওগুলো উঠিয়ে আনে।এবার আর মেহরিমা কে কিছু বলতে হয় না।হৃদিত বসতেই মেহরিমা ওর ডান পা টা উঁচু করে হৃদিতের উরুর উপর হালকা ভাবে রাখে।হৃদিত গম্ভীর মুখেই ড্রেসিং করতে থাকে।ভায়োডিন লাগাতেই মেহরিমা আহ্ শব্দ করে ওঠে।হৃদিত ওর দিকে এক পলক তাকিয়েই চোখ নামিয়ে নেয়।তারপর আস্তে আস্তে আঙ্গুলে ফুঁ দিতে থাকে।হৃদিতের মুখের ঠান্ডা বাতাসে মেহরিমার সারা শরীরে শীহরন বয়ে যায়। শিরদাঁড়া বেয়ে ঠান্ডা স্রোত নেমে যায়।ও পরম আবেশে চোখজোড়া বন্ধ করে নেয়।মেহরিমার দিকে তাকাতেই হৃদিতের ঠোঁটে বাঁকা হাসি ফুটে ওঠে।ব্যান্ডেজ করা শেষ হতেই মেহরিমা সাথে সাথে নিজের পা টা নামিয়ে নেয়।হৃদিত নিজের মুখটা তুলনামূলক আরও বেশি গম্ভীর করেই গাড়ি স্টার্ট দেয়।গাম্ভীর্যে ভরপুর পুরুষ মুখটাতে পুরুষত্বের ছাপ স্পষ্ট।হৃদিত এবার আস্তে আস্তেই গাড়ি চালাতে থাকে।হৃদিত কে ওমন গোমড়া মুখে দেখতে মেহরিমার একদম ভালো লাগছে না।হৃদিতের সাথে কথা বলার জন্য ওর মনের মধ্যে আঁকুপাঁকু করছে।কিন্তু সাহস করে উঠতে পারছে না।মেহরিমার অবস্থা দেখে হৃদিত মনে মনে হাসে।মুখটা গম্ভীর রেখেই বলে,

“কিছু বলবি?”

সুযোগ পেয়েছে মেহরিমা এতো সহজে হাত ছাড়া করবে নাকি!ও সাথে সাথেই বলে,

“আপনি এবার গ্রামে কতদিন থাকবেন?”

“অনেকদিন।”

কথাটা কর্ণগোচর হতেই মেহরিমার চোখ মুখ খুশিতে চিকচিক করে ওঠে।ও হাসিখুশি ভাবেই আবার জিজ্ঞাসা করে,

“আপনি আপনার গিটার, আর্টের সব সরঞ্জাম নিয়ে এসেছেন?”

মেহরিমার কথা শুনে হৃদিত কপালে ভাঁজ ফেলে এক ভ্রু উঁচু করে প্রশ্নাত্মক চাহনি দিয়ে বলে,

“তুই জেনে কি করবি?”

হৃদিতের এমন রিয়্যাকশন,চোখের এমন চাহনি তে মেহরিমা আরেকবার নতুন করে নিজেকে হারিয়ে ফেলে নীল চোখের ওই অসীম গভীরতায়।আবারও ঠিক এই মুহূর্তেই নতুন করে হৃদিতের প্রেমে পড়ল মেহরিমা!ও কোনোরকমে বলে,

“এ…এ..এমনিতেই।”

“আমাকে একটা কথা ক্লিয়ারলি বলতো আমি কি ভুত নাকি অন্যকিছু যে তোর মতো সাহসী, প্রতিবাদি মেয়ে আমাকে দেখে কোনো কারণ ছাড়াই ভয় পাস?কথা বলতে গেলেই তোতলাতে থাকিস!রিজন টা কি? সবসময় ছুটে বেড়াস আর আমার সামনে আসলে পি করে দেওয়ার মতো সিচুয়েশন ক্রিয়েট করিস!প্রবলেম টা কি তোর?”

লাস্টের লাইন টা শুনে মেহরিমা লজ্জায় মুখ নামিয়ে নেয়।মাথা নিচু করেই ছোট্ট করে জবাব দেয়,

“জা…. জানিনা আমি।”

হৃদিত বিরক্তিতে চোখ মুখ কুঁচকে ফেলে। নিজের বাসার একটু দূরেই মেহরিমা হৃদিত কে গাড়ি থামাতে বলে।গাড়ি থামাতেই ও তাড়াহুড়ো করে গাড়ি থেকে নেমে পড়তে যায়। কিন্তু তার আগেই হৃদিত ওর ডান হাত ধরে ভায়োডিন,তুলা ব্যান্ডেজের ব্যাগ টা ওর হাতে দিয়ে বলে,

“বাসায় যেয়ে পেইন কিলার নিবি।সকালে আর রাতে দুইবার করে ড্রেসিং করবি।কথার হেরফের হলে তোর কপালে দুঃখ আছে।এখন বাসায় যা।”

“আচ্ছা।”

কথাটা বলেই পায়ের দিকে খেয়াল না দিয়েই ওখান থেকে দৌড়ে দুই মিনিটেই বাসার মধ্যে ঢুকে পড়ে মেহরিমা।মেহরিমা বাসার মধ্যে চলে যেতেই হৃদিত দুই মিনিট মতো গাড়ির সিটে হেলান দিয়ে বড় বড় শ্বাস ফেলে নিজেকে সামলিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিয়ে ওখান থেকে চলে যায়।

সময় বিকাল বেলা।মেহরিমা তখন বাসায় এসে ফ্রেশ হয়ে পায়ের ব্যথার জন্য হৃদিতের কথা মতো পেইন কিলার খেয়েই ঘুমিয়েছে। হঠাৎ মাধবীর কান্নার আওয়াজে মেহরিমার ঘুম ভেঙ্গে যায়।ও চোখ ডলতে ডলতে উঠে বসে। মাধবীর কান্নার শব্দের উৎস খুঁজে মায়ের ঘরে যায়।মাধবী মেহরিমার মাত্র দুই বছরের বড়।এবার অ্যাডমিশনের জন্য কোচিং করছে।মাধবী কান্না করে চোখ মুখ ফুলিয়ে ফেলেছে।মেহরিমার মা অবনী শেখ মাধবী কে জড়িয়ে ধরে কিছু একটা বোঝাচ্ছে। অবনী শেখ পেশায় একজন টিচার। নিজেদের গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে হেড টিচার হিসেবেই কর্মরত আছেন।অবনী শেখ কঠিন সত্তার অধিকারী।মেহরিমাকেউ একদম নিজের মতো করেই গড়েছেন তিনি।

“মা কি হয়েছে?মাধুপু এভাবে কান্না করছে কেনো?”

“বখাটে পলাশ কে চিনিস?”

মেহরিমা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়। অবনী শেখ সেটা লক্ষ্য করতেই বলে,

“মাধবী কে টিজ করেছে ইভেন ব্যাড টাচ ও করেছে।”

অবনী শেখের কঠিন কন্ঠের কথাটা কর্ণগোচর হতেই মেহরিমার মুখভঙ্গি পাল্টে যায়।চোখ দিয়ে যেন আগুনের ফুলকি ঝরতে থাকে!মেহরিমা তেজস্বী কঠিন গলায় বলে,

“মাধুপু চলো।পশুকে তার প্রাপ্য শাস্তি দিয়ে আসি।”

মেহরিমার কথাটা শুনতেই মাধবী ভয় পেয়ে অবনী শেখের দিকে তাকায়। অবনী শেখ গর্বের সাথে মুচকি হেসে মাধবী কে যেতে ইশারা করে।মেহরিমা ততক্ষণে ওর হাঁটু সমান ভেজা চুল হাত খোঁপা করতে করতে ঘর ছেড়েছে। মাধবী আসতেই মেহরিমা মাধবীর এক হাত ধরে গ্রামের মোড়ের উদ্দেশ্যে হাঁটা ধরে।অবনী শেখ ও বোরকা পড়ে ওদের পিছন পিছন বাসা থেকে বের হয়ে আসে।

“ভাই,ভাই।ভাবি নির্ঘাত কোনো গন্ডগোল পাকাইবো।”

হৃদিত চৌধুরী বাড়ির সামনের বাগানের বড় একটা আম গাছের নিচে গাড়ির হুডের উপর বসে সিগারেট খাচ্ছে। সাথে অবশ্য তাবান আর তাইফ ও আছে।নিজের দলের এক সদস্য সাইম যে সবসময় মেহরিমার আপডেট দেয় তার মুখে এমন কথা শুনতেই প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকায় হৃদিত।

“ভাই মাধবী আপাকে পলাশ বাজে কথা বলেছে, আবার জোর পূর্বক হাত ও ধরেছে।সেটার প্রতিবাদ করতেই ভাবী,মাধবী আপু আর অবনী ম্যাডাম কে সাথে নিয়ে মোড়ের দিকে যাচ্ছে।”

হাঁপাতে হাঁপাতে এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে সাইম।ওর কথা শুনে তাবান বলে,

“ভাই তুমি যাবা না?যদি বড় কোন সমস্যা বেঁধে যায়!”

“উহু।আমি গেলে ও নিজের কাজ ঠিকভাবে করতে পারবে না। উল্টো কাঁপা কাঁপি শুরু করে দেবে।অবনী ম্যাম আছেন ও কে সামলে নেবে।সাইম তোর যেটা কাজ তুই সেটা কর।আর এমনিতেও মেহুর দিকে চোখ তুলে তাকানোর সাহস নেই ওই বা স্টা র্ডে র।”

লাস্ট লাইন টা একটু চাপা স্বরে রহস্যময় হেসে বলে হৃদিত।হৃদিতের কথা শুনে সাইম দৌড় লাগায় গ্রামের চার রাস্তার মোড়ের উদ্দেশ্যে।তাইফ কিছু একটা ভেবে তৎক্ষণাৎ বলে,

“ভাবী,ভাইয়ের পোষা আদুরে ব্রয়লার মুরগির বাচ্চা তো।তাই ভাইয়া কে দেখলেই কাছে আসার জন্য ছটফট করতে থাকে।”

কথাটা শুনতেই তাবান উচ্চস্বরে হেসে ওঠে।আর হৃদিত ভ্রু জোড়া কুঁচকে বাঁ দ র দুটোর দিকে তাকিয়ে থাকে।

#চলবে______

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে