#সূচনা_পর্ব
#কাঠগোলাপের_আসক্তি
#ইসরাত_তন্বী
দুপুর বেলায় অতিরিক্ত সূর্যের উত্তাপে সৃষ্টি হয়েছে ভ্যাপসা গরম। প্রকৃতির সবুজ গাছপালা গুলোও যেনো নিরব নিস্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।কোনো গাছের একটা পাতাও নড়ছে না। গাছগুলোকে দেখে মনে হচ্ছে ওরা বাধ্য হয়ে তীব্র সূর্যের অসহনীয় তাপদহ নীরবে সহ্য করে যাচ্ছে।
এই প্রখর সূর্যের তাপ সহ্য করে রাস্তা দিয়ে হেঁটে চলেছে মেহরিমা আর ওর জানেজিগার বেস্টি তৃধা। মাত্রই কলেজের ক্লাস শেষ করে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিয়েছে ওরা।কিন্তু আজ পাঁচ মিনিট হাটতে যেয়েই হাঁপিয়ে উঠেছে দু’জন।ঘেমে খুবই বাজে অবস্থা।রাস্তায় একটা ভ্যানের ও দেখা নেই!মেহরিমার বাড়ি থেকে হেঁটে কলেজে আসতে বিশ মিনিট সময় লাগে আর তৃধার আসতে দশ মিনিট মতো সময় লাগে।আজ ছাতা না নিয়ে আসাতে নিজেকে নিজেই কয়েক দফা বকা দিয়ে নিল মেহরিমা।কিন্তু গতরাতে দীর্ঘ বর্ষণের পর এতটা প্রখর উত্তাপ নিয়ে সূর্য উঠবে কে জানতো!সকালেও তো প্রকৃতি ঠান্ডা ছিলো। দু’জন ক্লান্ত থাকায় আজ আর কেউ তেমন কথা বলে না।মুখে বিরক্তি ভাব ফুটিয়ে তুলে দিব্বি হেঁটে চলেছে দু’জন।
আরও দুই মিনিট হেঁটে গ্রামের মোড়ে আসতেই ওদের থেকে পাঁচ/ছয় হাত দূরে কিছু একটা লক্ষ্য করতেই থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে মেহরিমা। দীর্ঘ আট মাস পর সেই চিরচেনা সাদা বিএমডব্লিউ টা চক্ষুগোচর হতেই মেহরিমার বক্ষ স্থলে ভয়,ভালো লাগার সংমিশ্রনে এক অদ্ভুত অনুভূতির শিহরণ বয়ে যায়।ওর মনে পড়ে যায় সেই পাঁচ বছর আগের কথা।
মেহরিমা তখন সবে ক্লাস সেভেনে উঠেছে।তৃধার জ্বর আসায় সেদিন স্কুলে আসতে পারেনি।তাই মেহরিমা একা একাই এসেছে স্কুলে।স্কুল ছুটির পরে ওদেরই পাড়ার এক ছেলে বন্ধু রাকিবের সাথে রাস্তায় হাসাহাসি করতে করতে বাড়ি ফিরছিল ছোট্ট মেহরিমা।ওদের স্কুল থেকে তিন মিনিট মতো হাঁটলেই একটা বড় বটগাছের দেখা পাওয়া যায় রাস্তার পাশে।সেটার পাশে দিয়ে হাঁটার সময় হঠাৎই একটা গম্ভীর পুরুষালি কন্ঠস্বর শুনে কেঁপে ওঠে ছোট্ট মেহরিমার বক্ষ স্থল।মেহরিমা কন্ঠস্বর লক্ষ্য করে পাশে তাকাতেই দেখতে পাই গ্রামের অনেক গুলো ছেলে একসাথে একজন কে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে।তাদের সাথে চৌধুরী বাড়ির দুই ছেলে তাবান আর তাইফ কে লক্ষ্য করতেই মেহরিমার মুখে হাসি ফুটে ওঠে।বিনিময়ে তাবান আর তাইফ ও মুচকি হাসে। কিন্তু গাড়ির হুডের উপর বসে থাকা ছেলেটার হালকা নীল চোখের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি লক্ষ্য করতেই মেহরিমার হাসি বন্ধ হয়ে যায়।ছেলেটাকে চিনতে একটুও সময় লাগেনি মেহরিমার। তাহমীদ হৃদিত চৌধুরী। এই ছেলেকে শুধু মেহরিমা কেনো গ্রামের প্রতিটা মানুষ হাড়ে হাড়ে চেনে!
“এই পুঁচকে মেয়ে এদিকে আয়।”
মেহরিমা ভয়ে ভয়ে পালিয়ে যেতে নিলেই এক ধমক লাগায় হৃদিত। ততক্ষণে রাকিব দৌড়ে পালিয়েছে।মেহরিমার এবার আরও বেশি ভয় লাগতে থাকে।মেহরিমা ভয় পাচ্ছে বুঝতে পেরে হৃদিত ওর গম্ভীর কন্ঠস্বর হালকা নরম করে বলে,
“নাম কি?”
“মেহরিমা শেখ নীলাক্ষী।”
“টাকলু চেয়ারম্যান জলিল শেখের ছোট মেয়ে?”
হৃদিতের কথা শুনে সবাই হো হো করে হেসে ওঠে।নিজের বাবাকে নিয়ে এমন কথা শুনে মেহরিমার মুখ টা মলিন হয়ে যায়। বাবাকে বড্ড ভালোবাসে কি না! তবুও মলিন মুখেই হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়ায়।
“কোন ক্লাস?”
“সেভেন।”
“বড্ড ছোট।পাশের ছেলেটা কে ছিলো?”
“আপনাকে কেন বলবো?”
মেহরিমার কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ওর গালে পাঁচ টা আঙ্গুলের ছাপ বসে যায়।গালে হাত দিয়ে এবার বেশ শব্দ করেই কেঁদে দেয় মেহরিমা।
“আমার মুখে মুখে তর্ক করা একদম পছন্দ না।নেক্সট টাইম যেনো ওই ছেলের সাথে আর না দেখি।বাসায় যা।বরফ লাগিয়ে নিস গালে।”
হৃদিতের কথাগুলো মেহরিমা আদৌও শুনলো কি শুনলো না কে জানে!সেই থাপ্পড় খেয়ে দীর্ঘ এক সপ্তাহ জ্বরে ভুগে ছিলো মেহরিমা।সেদিন থেকেই ওই মানুষটা কে যমের মতো ভয় পায় মেহরিমা।তবে সেই এক থাপ্পড়ে কাজ ও হয়েছিল বটে।তারপর থেকে মেহরিমা আর কোনো ছেলের সাথে কথা বলা তো দূরে থাক তাকাই ও না।তাকাবেই বা কি করে মনে যে শুধু এক জনেরই রাজত্ব চলে।থাপ্পড় খেয়ে প্রেমে পড়েছে এই কথা শুনলে মানুষ নির্ঘাত মেহরিমা কে পাগলী বলবে।তাতে মেহরিমার কী! কথাগুলো মনে করে মুচকি হাসে মেহরিমা।
“এই এই মেহু বেইবি এটা হৃদিত ভাইয়ার গাড়ি না?”
“জানি না।”
মেহরিমার উত্তর শুনে তৃধা ভ্রু জোড়া কুঁচকে ওর দিকে তাকায়।তারপর বেশ খুশি খুশি মনে মেহরিমার হাত ধরেই গাড়ির দিকে হেঁটে যায়।গাড়ির কাছে পৌঁছাতেই গাড়ির ভেতরে কাউকে দেখতে না পেয়ে হতাশ হয় তৃধা। কতদিন ভাইয়া কে দেখেনি তৃধা।ভাবলো এখন হঠাৎ দেখা হতেই সারপ্রাইজ দেবে ভাইয়াকে! কিন্তু ভাইয়া গেলো কোথায়?
মেহরিমা কি যেন মনে করে রাস্তার অপোজিট সাইডে থাকা চায়ের দোকানে তাকায়।আর সাথে সাথে সেই চেনা পরিচিত মুখ টা দর্শন হয়।হৃদিত দোকানে দাঁড়িয়ে আছে।ঠিক মেহরিমার সামনাসামনি ওর দিকেই মুখ দিয়ে।ও সিগারেট খেতে খেতে ধোঁয়া ছেড়ে শান্ত অথচ শানিত দৃষ্টিতে মেহরিমার দিকে তাকায়।আর তক্ষুনি ওর নীল চোখের ধারাল দৃষ্টির সাথে মেহরিমার দৃষ্টি মিলে যায়।মেহরিমার হৃদপিন্ড টা যেন কিছু সময়ের জন্য থমকে যায়! হার্ট বিট ফাস্ট হয়ে যায়!মেহরিমা সাথে সাথেই চোখ নামিয়ে নেয়।এখান থেকে তাড়াতাড়ি ও কে সরে পড়তে হবে।নাহলে নির্ঘাত হার্ট টা বের হয়ে মারা যাবে ও।এত লাফালাফি করার কি আছে আজব!ততক্ষণে তৃধা তার সবচেয়ে প্রিয় হৃদিত ভাইয়ের দিকে দৌড় লাগিয়েছে।
“ভাইয়াআআআআ! কেমন আছো তুমি?বড়মা,বড় বাবা,আয়াশ ভাইয়া আরিশা ভাবী সবাই কেমন আছে?এতো দিন পরে আমাদের কথা মনে পড়লো তোমার?জানো তোমাকে কত্ত মিস করেছি।”
তৃধার কথায় হৃদিত মুচকি হাসে।
“আস্তে আস্তে বল আমি তো আর হারিয়ে যাচ্ছি না।সবাই ভালো আছে।”
“এতো দিন আসলে না কেন তাই বলো আগে?”
“স্টাডি নিয়ে একটু বিজি ছিলাম।”
“তোমার না মাস্টার্স শেষ ভাইয়া?”
“উহু, এইবার শেষ হলো।কি খাবি?”
“আইসক্রিম।”
হৃদিত চকলেট ফ্লেভারের দশটা আইসক্রিম কিনে দেয় তৃধা কে। এত্তগুলো আইসক্রিম পেয়ে তৃধা তো মহাখুশি।
মেহরিমা জানে এই মেয়ে এখন ভাই পেয়েছে না! ভাইকে রেখে আর নড়বে না।তাই মেহরিমা দেরি না করে ছোট ছোট কদমে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরে। কিন্তু এভাবে হাঁটতে ওর খুব অস্বস্তি হচ্ছে।ওর ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় জানান দিচ্ছে ওর দিকে কেউ একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে।মেহরিমা খুব সতর্কতার সাথে ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকায়।না কেউ তো তাকিয়ে নেই!হয়তোবা নিজের মনের ভুল।মেহরিমা আনমনে হাঁটতে যেয়েই রাস্তায় পড়ে থাকা ছোট্ট ইটের টুকরার সাথে পা বেঁধে মুখ থুবড়ে রাস্তার পাশে থাকা কাঁদার মধ্যে পড়ে যায়।কয়েক সেকেন্ড অতিক্রম করে নিজের সাথে কি ঘটেছে সেটা মস্তিষ্ক জানান দিতেই ওভাবেই পড়ে থেকে ব্যথায়,লজ্জায় কেঁদে দেয় মেহরিমা।হঠাৎ রাস্তার পাশে মেহরিমাকে ওভাবে পড়ে থাকতে দেখেই তৃধা সহ তাবান,তাইফ ও দৌড় লাগায় মেহরিমার দিকে।হৃদিত বিরক্তিতে চোখ,মুখ কুঁচকে কিছুক্ষণ ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রয়।হাতে থাকা সিগারেট টা একপ্রকার ছুড়ে ফেলে দেয় মাটিতে।অতঃপর মেহরিমার দিকে হাঁটা ধরে।
#চলবে__________