#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-১৩
কথা ছিলো শুভ্র কাউকে তানির প্রেমের গল্প টা বলবে না। কিন্তু অভ্র, আনিকা বাড়ি ফিরতেই শুভ্র সব বলে দিলো। বলার ভঙ্গিটাও বেশ নাটুকে ছিলো। বিকেলে সবাই পিয়াজু, আর ছোলা মাখানো খাচ্ছিলো তখন তানি ছিলো রান্নাঘরে। সবার জন্য চা করছিলো। মাহফুজা তখন বাড়িতে নেই। দুঃসম্পর্কের আত্মীয় অসুস্থ, তাই তাকে দেখতে গিয়েছিল। সুযোগ পেয়ে ইরাও আজ এসেছে। শুভ্র সিরিয়াস গলায় বলল, লেডিস এন্ড জেন্টেলম্যান আজ তোমাদের একটা দুঃখের গল্প বলবো। কিন্তু দেখা গেল দুঃখের গল্প শুনতে কেউ ই তেমন আগ্রহী না। শুভ্র বলল, দুঃখের গল্পটা তানিকে নিয়ে।
সবাই নড়েচড়ে বসলো। অভ্র সিরিয়াস গলায় বলল, কী হইছে ভাইয়া?
শুভ্র আগের মতো ই সিরিয়াস গলায় বলল, আজ তানির একটা সিক্রেট জানতে পেরেছি।
ইরা বলল, সিক্রেট? তাহলে সেটা আমাদের কেন বলছ?
“বলছি কারন তোমরা পুরো ঘটনা শুনে তানিকে যদি হেল্প করতে পারো।”
সবাই ই খুব সিরিয়াস হয়ে গেল। শুভ্র অত্যন্ত সিরিয়াস গলায় হাত নেড়ে নেড়ে তানির প্রেমের গল্প বলতে লাগলো।
তানি চা নিয়ে ফিরলে অভ্র বলল, ভাবী ভাইয়া এসব কী বলছে?
তানি অবাক গলায় বলল, কী বলছে?
“তুমি নাকি এক ড্রেনওয়ালার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছ?”
তানি কটমট চোখে শুভ্র’র দিকে তাকালো। শুভ্র দাঁত বের করে হেসে বলল, তোমার সুবিধার জন্যই ওদের বললাম আর কী।
“কিন্তু আপনি তো কথা দিয়েছিলেন যে কাউকে বলবেন না।”
শুভ্র আমতা আমতা করে বলল, আসলে এমন একটা ব্যাপার। না বলতে পেরে পেটের ভিতর গুরগুর করছিল।
সবাই কে অবাক করে দিয়ে তানি কেঁদে ফেলল৷ বলল, ছিঃ আপনি এতো খারাপ! আগে জানলে জীবনেও বলতাম না আপনাকে।
শুভ্র হকচকিয়ে গেল। অভ্র আর আনিকা মিটিমিটি হাসছে। ইরা চিন্তিত গলায় বলল, এবার কী হবে ভাইয়া?
শুভ্র করুন গলায় বলল, আমি কী একটু বেশী ই বলে ফেললাম?
অভ্র হাই তুলতে তুলতে বলল, এবার যাও তুমি সামলাতে।
শুভ্র বলল, কেন যে তোরা জোর করলি আমাকে।
একসাথে তিনজন ই লাফিয়ে উঠে বলল, এই ভাইয়া একদম মিথ্যা দোষ চাপাবে না। আমরা শুনতে চাই নি, তুমিই জোর করে শুনিয়েছ।
যেহেতু অপরপক্ষের দলভারী তাই শুভ্র আত্মপক্ষ সমর্থন করলো। বলল, এবার রাগ ভাঙাতে হবে? মেয়েদের রাগ ভাঙানোর চেয়ে বিল্ডিং বানানো বেশী সহজ।
অভ্র বলল, ঠিকাছে তুমি বিল্ডিং ভাঙো আমরা আজ আসি।
****
তানি ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদছে। ব্যাপার টায় ওর খুব কষ্ট লেগেছে। ও শুভ্র কে একটা কথা বলল আর শুভ্র সেটা নিয়ে সবার সাথে মজা করলো! তাছাড়া শুভ্র কথা দিয়েছিল যে কাউকে বলবে না। কিন্তু সবাই কে বলে দিয়েছে। আশ্চর্য ব্যাপার স্বামী, স্ত্রীর সিক্রেট কথাবার্তা অন্য কাউকে কিভাবে বলে! এতো বড় দামড়া একটা ছেলে অথচ এতো নির্বোধ।
শুভ্র ওই ব্যাপার টা সবাইকে বলে দেয়ায় তানির যতটা কষ্ট লেগেছে। তারচেয়ে বেশী কষ্ট লেগেছে তানিকে ভুলে যাওয়ায়। তানি এখনও ওকে মনে রেখেছে আর ও কী না ভুলে গেল! আর যাবেই না কেন! ওর লাইফে তো তখন অবন্তী ছিলো। অবন্তীর জন্য যে হ্যাংলামি করেছে তাতে করে অন্য মেয়েকে মনে রাখবে কী করে!
তানি সিদ্ধান্ত নিলো শুভ্র’র সাথে দুদিন কথা বলবে না। যত ই সরি বলুক তানি কথা বলবে না। এবার একদম উচিত শিক্ষা দেবে৷
*****
ইরা বলল, আচ্ছা ভাইয়া আর ভাবীর প্রেম টা কতদূর এগিয়েছে?
অভ্র বলল, কী জানি!
আনিকা বলল, বেশীদূর এগোয় নি আপু৷ ভাবী এখনো ভাইয়াকে আপনি করে বলে।
ইরা বলল, আসলেই তো! ব্যাপার টা খেয়াল করিনি।
অভ্র বিরক্তির সুরে বলল, যেমন দেবা তেমনি তার দেবী৷ দুটো ই আনরোমান্টিক। তোরা মাঝেমধ্যে ঘুরতে যাবি, সিনেমা দেখবি, তা না করে ঘরের মধ্যে চিপকে থেকে বস্তাপঁচা প্রেমের গল্প বলে। তাও যদি ঘরের মধ্যে থেকে কোনো কাজের কাজ করতি।
ইরা চিমটি কেটে বলল, কী সব বলছ আনু আছে তো আমাদের সাথে।
আনিকা ঠোঁট টিপে বলল, ইরা আপু সমস্যা নেই। আর দু’মাস পর আমার আঠারো হয়ে যাবে।
ইরা আনিকার মাথায় চাপড়ে দিয়ে বলল, চুপ। তুই কান বন্ধ করে থাক।
আনিকা চুপ করে থাকলো না। বলল, আচ্ছা ভাইয়া আর ভাবীকে হানিমুনে পাঠালে কেমন হয়?
অভ্র’র চোখ দুটো জ্বলে উঠলো। ইরা চিৎকার করতে গিয়েও থেমে গেল। আনিকা মিটিমিটি হাসছে যেন সে এভারেস্ট জয় করে ফেলছে।
******
তানি রুমের দরজা যে সেই বন্ধ করেছে আর খোলে নি। শুভ্র দরজায় ধাক্কা দিয়ে অনেকবার সরি বলেছে কিন্তু তানি দরজা খোলে নি। রাতের রান্নাও করে নি। ঘরের দরজা বন্ধ করায় শুভ্র ঘরেও যেতে পারে নি। কিছু সময় স্টাডিতে ছিলো। বই পড়ায়ও মন দিতে পারে নি। শেষমেস বের হয়ে রান্নাঘরের দিকে গেল তানির জন্য কিছু একটা বানাবে। যেভাবেই হোক আজ বিল্ডিং মানে তানির রাগ ভাঙাবে।
আনিকা আজ অভ্র’র পকেট থেকে অনেকগুলো টাকা খসিয়েছে। বার্গার খেয়েছে, কিছু নেইলপলিশ কিনেছে। এতো ভালো বুদ্ধি দিয়েছে সে তুলনায় এসব কম ই। ও ভেবে নিয়েছে ভাইয়া আর ভাবীর প্রেম হয়ে গেলে তাদের কাছ থেকেও ট্রিট নিবে।
বাড়ি ফিরে দেখলো শুভ্র রান্নাঘরে রীতিমতো যুদ্ধ করছে। অভ্র বলল,
“কী করছ?”
শুভ্র বলল, তোরা দুই মীর জাফর আমার সাথে কথা বলবি না।
আনিকা বলল, তুমি নিজের দোষে ফেঁসেছ। আমাদের দোষ কই?
শুভ্র ছুড়ি উঁচিয়ে অভ্রর দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল, এই ব্যটা মীর জাফর যদি না বলে দিতো তাহলে এতো কেস খেতে হতো না।
অভ্র বলল, আচ্ছা শোনো আমি একটা আইডিয়া দিতে পারি। দেখবে তাতে ভাবীর রাগ একদম গলে যাবে।
“কী?”
তানির খুব খিদে পেয়েছে এখন৷ কিন্তু রাগ করে আছে, এই অবস্থায় খেতে গেলে রাগ টা থাকবে না। শুভ্র দুই তিনবার ডেকে গেলেও এখন আর কোনো খবর নেই। তানির মেজাজ আরও খারাপ হলো। এই হলো রাগ ভাঙানোর নমুনা। খেতে পর্যন্ত ডাকছে না। নিজে নিশ্চয়ই খেয়েদেয়ে ঘুমিয়ে গেছে।
অভ্র তানিকে ডাকছে। বলল, ভাবী দরজা খোলো, আমরা না খেয়ে বসে আছি।
তানির এবার রাগের সাথে সাথে দুঃখ ও হলো। দেবর, ননদ, শাশুড়ী সবাই এতো ভালো! অথচ বর টা হলো কী না একটা গোয়ার টাইপ। তানি দরজা খুলল৷ আনিকা এসে জড়িয়ে ধরে বলল, ভাবী ভাইয়া আজ তোমার জন্য রান্না করেছে। চলো খেতে চলো৷
তানি এক নজর শুভ্র’কে দেখে বলল, না আমি খাব না।
অভ্র বলল, তুমি না খেলে আমাদের ও ফর্মালিটি দেখিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে। কিন্তু আমরা তো না খেয়ে থাকতে পারি না ভাবী।
শুভ্র বলল, তানি তোমাকে এক লক্ষ বার সরি। আর কোনোদিন ওই ড্রেনওয়ালার নাম মুখে আনবো না। চলো এবার খেতে চলো। নাহলে তোমার শাশুড়ী আমার গর্দান টা নিয়ে নেবে।
তানি মুখ ফিরিয়ে রইলো। শুভ্র দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, অভ্র, আনু তোরা টেবিলে গিয়ে একটু চোখ বন্ধ করে বস তো।
দুজনেই টেবিলে গিয়ে চোখ বন্ধ করে বসলো। শুভ্র এসে তানিকে কোলে তুলে নিলো। তানি হকচকিয়ে গেল। বড়, বড় চোখ করে তাকিয়ে রইলো শুভ্র’র দিকে। শুভ্র হাসছে, হাসার সময় চোখ ও হাসছে। তানি মনে মনে বলল, কবে আপনাকে একটু ছুঁয়ে দিতে পারব!
চলবে….
সাবিকুন নাহার নিপা
#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-১৪
টেবিলে খেতে বসে তানি একটাও কথা বলে নি। লজ্জায় মাথানিচু করে ছিলো। কোনোরকম নাকেমুখে খাবার গুজে দ্রুত প্রস্থান করলো। তানি যেতেই অভ্র আর আনিকা শব্দ করে হেসে ফেলল। শুভ্র’র লজ্জা শরমের কোনো বালাই নেই। সে নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে খেয়ে যাচ্ছে। আনিকা পিঞ্চ করে বলল, ভাইয়া কতো রোমান্টিক দেখেছ?
অভ্র চোখ কপালে তুলে বলল, মোটেও না, এইসব আমার বুদ্ধি। ভাইয়ার কম্ম নয়।
শুভ্র খেতে খেতে বলল, হ্যাঁ বস তোমার তো অনেক এক্সপেরিয়েন্স আছে।
“আমার এক্সপেরিয়েন্স কীভাবে থাকবে? আমার তো আর বউ নেই। ”
“পাতানো বউ আছে তো।”
আনিকা লাফ দিয়ে উঠে বলল, জানো বড় ভাইয়া, ছোট ভাইয়া তো বিয়ের প্ল্যান করছে।
অভ্র আনিকার দিকে তাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল, তুই ঠিক কার দলে বলবি?
আনিকা দাঁত বের করে বলল, আমি তোমাদের কারোর দলেই না। আমি শুধু ভাবীর দলে।
শুভ্র বলল, প্রতি মাসে আমাদের পকেট হাতিয়ে, এখন বলছিস তুই কী না ভাবীর দলে! বুঝলি অভ্র, ঘরে এর মতো একটা মীর জাফর থাকলে আর কিছু লাগে না। দেখবি যেকোনো সময় সৈন্য সামন্ত এনে পলাশীর যুদ্ধ শুরু করে দিবে। একে দিয়ে এক ফোঁটা বিশ্বাস ও নেই৷
অভ্র সায় দিয়ে বলল, একদম ঠিক বলেছ।
আনিকা অভ্র’র হাতে চিমটি কেটে ফিসফিস করে বলল, এরকম করলে আমি কিন্তু আর কোনো বুদ্ধি দেব না।
শুভ্র স্পষ্ট শুনতে না পেয়ে বলল, ঘষেটি বেগম কী বলছে রে?
অভ্র বোকার মতো হাসতে হাসতে বলল, না মানে বলছে যে ভাইয়া আর ভাবীর প্রেম তো জমে পুরো আইসক্রিম হয়ে গেছে।
শুভ্র হাসলো শুধু কিছু বলল না।
খাওয়া দাওয়ার পর্ব চুকিয়ে শুভ্র যখন ঘরে গেল তখন তানি পাশ ফিরে শুয়ে পড়েছে। শুভ্র ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলো তানি ঘুমোয় নি, কিন্তু ঘুমের ভান করে আছে। শুভ্র বুঝতে দিলো না যে ও তানির ভান ধরে ফেলেছে। লাইট অফ করে মোবাইল নিয়ে বসলো। ইমেইল চেক করতে করতে আড়চোখে তানিকে দেখতে লাগলো। তানি আগের মতো ই চোখ বুঝে শুয়ে আছে।
তানি লজ্জায় চোখ বন্ধ করে আছে। ভেবেছিল শুভ্র’র উপরে রেগে থেকে শোধ নেবে। টানা এক সপ্তাহ কোনো কথা বলবে না। কিন্তু শুভ্র কী করলো! একদম বেহায়ার মতো কোলে তুলে নিলো! তাও আবার ছোট ভাই, বোনদের সামনে। ইশ! একটুও লজ্জা, শরম নেই। শুভ্র যখন ওকে কোলে তুলে নিলো তখন ওর কয়েক সেকেন্ডের জন্য মাথা খারাপ হয়ে গেল। লাজ লজ্জা ভুলে ও তখন গলা জড়িয়ে ধরলো। ছিঃ ছিঃ কী লজ্জার ব্যাপার! ইশ লজ্জায় এক্ষুনি তানির মাটির নিচে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করছে। শুভ্র না’হয় বেহায়া, তাই বলে ও এরকম বেহায়া হয়ে গেল কীভাবে! ছিঃ ছিঃ।
তানি হঠাৎ হাতের উপর শীতল কিছুর স্পর্শ অনুভব করলো। কিছু সময় বাদে বুঝতে পারলো যে ওটা শুভ্র’র হাত। শীতকাল প্রায় চলে গেছে। এখন বসন্তকাল। দিনের বেলায় ভ্যাপসা গরম আর রাতে হালকা শীত। শেষ রাতে শীত একটু বেশী ই লাগে৷ এই ঘরে মাহফুজা পাতলা কম্বল একটা’ই দিয়েছে। বড় কম্বল বলে একটা দিয়েছে। লজ্জায় তানি আরেকটা কম্বল চাইতে পারে নি। এক কম্বলে দুজন থাকতে গিয়ে কখনো কখনো কাছাকাছি চলে আসে। আজ তাই শুভ্র’র স্পর্শ পেয়ে তানি ভাবলো শুভ্র ঘুমের ঘোরে হাত রেখেছে। তানির ভালো লাগলো। হাত টা’কে আলতো করে চেপে ধরলো। শুভ্র’র কোনো সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। আরেকটু নিশ্চিত হবার জন্য তানি পাশ ফিরে শুভ্র’র মুখোমুখি হলো। মোবাইলে টর্চ জ্বালালো। টর্চের আলোটা সাহস করে শুভ্র’র চোখের উপর ফেলল। যদি জেগে থাকে কিংবা জেগে থাকার ভান করে তবে চোখের উপর আলো পড়লে কপাল কুচকে যাবে। সেসব কিছুই হলো না। শুভ্র একদম স্বাভাবিক রইলো। ঘন ঘন নিঃশ্বাস পড়তে লাগলো। তানি এইবার নিশ্চিত হলো যে শুভ্র গভীর ঘুমে মগ্ন। তানির এখন একটু শয়তানি করতে ইচ্ছে করছে। করবে কী করবে না এই নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। শেষমেস সিদ্ধান্ত নিলো যে করবে। তাছাড়া বর টা যেহেতু ওর তাহলে একটু বেহায়া হয়ে ঢং তো করাই যায়।
তানি শুভ্র’র কপালের চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে দিলো। সরিয়ে দিয়েও ক্ষ্যান্ত হলো না। চুলে বিলি কাটতে লাগলো। এতো নরম সিল্কি চুল! এই চুলে সারাদিন বিলি কেটে গেলেও কোনো ক্লান্তি আসবে না।
এরপর শুভ্র’র হাতের আঙুলের ভাজে নিজের আঙুল গুজে দিলো। একা একা লজ্জা পেয়ে নিজেই হাসলো। এতো টা দুঃসাহস শুভ্র জেগে থাকলে জীবনেও পারতো না। এভাবে কিছু সময় কেটে গেল। হঠাৎই আচমকা শুভ্র হাত বাড়িয়ে তানিকে কাছে টেনে নিয়ে জড়িয়ে ধরলো। তানির নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে যাবার উপক্রম। শরীরে রক্ত চলাচল বন্ধ হয়ে গেল যেন। তানি কেঁপে কেঁপে উঠছে, সেই সাথে এক অদ্ভুত ভালোলাগার অনুভূতি হচ্ছে। চোখ বন্ধ করে তানি দু’হাতে শুভ্র’কে জড়িয়ে ধরলো।
তানি যখনই শুভ্র’কে জড়িয়ে ধরেছে তখন ই শুভ্র চোখ খুলল। মটকা মেরে এতক্ষণ যে ঘুমানোর অভিনয় করে গেছে সেটা তানি ঘূনাক্ষরেও টের পায় নি। পাবে কী করে! শুভ্র কী চিজ সেটা কী এখনো ও জানে নাকি!
*****
প্রতিদিন ই তানির ঘুম ভাঙে দেরিতে। কিন্তু আজ শুভ্র এখনো জাগে নি। ঘুম ভাঙতেই তানি নিজেকে আবিষ্কার করলো শুভ্র’র বুকের উপর। গত রাতের কথা মনে পরে গেল। লজ্জা, আর ভালোলাগার মিশ্র অনুভূতি তৈরী হলো। উঠে বসে শুভ্র দিকে তাকালো৷ কী নিঃষ্পাপ লাগছে! কে বলবে যে এই ছেলে জেগে থাকলে সবাই কে উলটা পালটা কথা বলে জ্বালিয়ে মারে। তানি শুভ্র’র চুলে আবারও হাত বুলিয়ে দিলো আর সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, এখন থেকে প্রতিদিন শুভ্র’র আগে ঘুম থেকে উঠে ওর মুখ দেখে দিন শুরু করবে।
মাহফুজা ফিরে এসেছে সকালেই। ফিরে আসার পর পর ই অভ্র আর আনিকার কাছে হানিমুন প্ল্যান সম্পর্কে শুনেছে এবং তার ও এই ব্যাপারে সায় আছে। সত্যিই তো বিয়ের পর ওরা একান্তে সময় কাটানোর সুযোগ ও পায় নি। ছেলে মেয়েদের মাথায় যে ব্যাপার টা এসেছে এই ব্যাপার টা তার মাথায় কেন এলো না। এবং সিদ্ধান্ত নিলো অতি শিগগিরই শুভ্র’র সাথে কথা বলবে।
তানি রান্নাঘরে রান্না করছিলো। মাহফুজা গিয়ে বলল, আমাকে কিছু একটা করতে দে। সব কাজ তো তুই ই করছিস।
তানি মৃদু হেসে বলল, তুমি একটা দিন ছুটি পেয়েছ বিশ্রাম করো।
মাহফুজা হেসে বলল, তুই তো দিন দিন আমার অভ্যাস খারাপ করে দিচ্ছিস।
তানি শাশুড়ীর দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হেসে আবারও কাজে মন দিলো।
মাহফুজার মন টা খুশিতে ভরে উঠলো। এই মেয়েটা এতো লক্ষী! শুভ্র’র জন্য একদম ঠিকঠাক। তার খাটি সোনা চিনতে একটুও অসুবিধা হয় নি৷ এই মেয়েটা সংসারে আসার পর থেকে সংসার যেন একদম কানায় কানায় পরিপূর্ণ হয়ে গেছে। মাহফুজা বলল, তোদের বিয়ের তো অনেক দিন হয়ে গেল। কোথাও ঘুরতে টুরতে তো যাওয়া হলো না।
তানি কিছু না বলে শুধু হাসলো।
“শুভ্র’কে বলি কোথাও তোকে নিয়ে ঘুরে আসুক। তোর যেতে আপত্তি নেই তো”?
তানি মাথা নেড়ে না বলল। মাহফুজা বলল, কোথায় যেতে চাস বল তো?
তানি মাথানিচু করে বলল, ওনার যেখানে ইচ্ছে সেখানেই যাব।
মাহফুজা হাসলো। বলল, আচ্ছা তাহলে তোর ওনার সাথে কথা বলি।
তানি লজ্জা পেয়ে হাসলো। মাহফুজার চোখ আনন্দে চকচক করে উঠলো। এতোদিনে তার ছেলের জীবন টা গুছিয়ে আসতে শুরু করেছে। সব কৃতিত্ব এই মেয়েটার।
*****
শুভ্র’র ইউনিভার্সিটিতে সেমিস্টার ফাইনাল চলছে। এরপর ব্রেক পাবে। সেই ব্রেকে দুজন কে ঘুরতে পাঠানোর প্ল্যান করেছে অভ্র, আনিকা আর ইরা। অভ্র ঘোষণা দিয়েছে হানিমুন ট্রিপের সব খরচ সে দেবে। এটাই হবে তানিকে দেয়া তার পক্ষ থেকে বিয়ের উপহার। কিন্তু হিসেব নিকেশ করে দেখলো ওর সেভিংস যা আছে তাতে সব টা ঠিকঠাক হবে না। ভালো রিসোর্ট বুক করতে হবে। হানিমুনে গিয়ে তো আর সস্তা রিসোর্টে থাকা যায় না। ইরা অনলাইনে সব খোঁজ খবর নিচ্ছে। আপাতত সবাই মিলে ঠিক করেছে দুজন কে কক্সবাজার পাঠাবে। যে রিসোর্ট পছন্দ করেছে সেখানের কস্ট টা একটু বেশী হয়ে যাচ্ছে। এছাড়া আর কোনোটা’ই ইরার পছন্দ হচ্ছে না। অভ্র চিন্তিত গলায় বলল, খরচ টা তো একটু বেশি মনে হচ্ছে।
ইরা বলল, হোক বেশী। আমার জমানো টাকা আছে আমি সেটা দেব।
সেই শুনে আনিকাও তার সিন্ধুক খুলে বসলো। শেষমেস তিনজন মিলে হানিমুন ট্রিপের সব বন্দোবস্ত করে ফেলল। কিন্তু শুভ্র’কে কিছু জানতে দিলো না। তানি একটু একটু জানলেও পুরোটা জানেনা।
শুভ্র আজ খেয়েদেয়ে তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছে। তানি শুয়ে শুয়ে বই পড়ছিল। অভ্র তানিকে ম্যাসেজ দিলো, ভাবী একটু বাইরে এসো।
তানি তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে এলো। ভেবেছে এতো রাতে ডেকেছে নিশ্চয়ই জরুরী কিছু বলবে। অভ্র’কে পেল রান্নাঘরে। রাত জেগে ফোনে কথা বলতে বলতে মাঝেমধ্যে তার খিদে পেয়ে যায় তাই নুডলস কিংবা পাস্তা বানিয়ে খায়। আজও নুডলসের যোগাড় করছে। তানি ব্যস্ত গলায় বলল,
“কী হয়েছে ভাইয়া?”
অভ্র হেসে বলল, কিছু হয় নি ভাবী। দেখলাম তোমার ঘরের লাইট জ্বলছে তাই ভাবলাম তোমার সাথে একটু গল্প করি।
তানি স্মিত হেসে বলল, তুমি সরো আমি বানিয়ে দেই।
অভ্র সরে গিয়ে দেয়ালে হেলান দিয়ে বলল, আচ্ছা ভাবী একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
“হ্যাঁ। ”
“সত্যি বলবে কিন্তু। ”
“আচ্ছা। ”
“তুমি কী ভাইয়াকে ভালোবাসো?”
তানি বিস্মিত চোখে অভ্র’র দিকে তাকিয়ে সাথে সাথে চোখ নামিয়ে ফেলল। মিথ্যে বলা ওর পক্ষে সম্ভব না। তাই চুপ করে থাকলো।
অভ্র বলল, নীরবতা সম্মতি ভেবে নেব?
তানি লজ্জা পেয়ে বলল, জানিনা।
অভ্র হাসলো। বলল, আচ্ছা ঠিক আছে জানতে হবে না। তবে একটা কথা শোনো, তুমি আর ভাইয়া যে ঘুরতে যাচ্ছ এই সময় টা ভালোভাবে কাটাবে। মোটেও রাগারাগি করবে না।
তানি কপট রাগ দেখিয়ে বলল, আমার অতো রাগ নেই।
অভ্র ব্যাঙ্গাত্মক সুরে বলল, রাগ নেই তাতেই নাকের ডগা সবসময় লাল থাকে। রাগ থাকলে না জানি কী হতো!
“আচ্ছা! আর তোমার ভাইয়া যে আমাকে লেগপুলিং করে! ”
অভ্র অনুরোধের সুরে বলল, আর যাই করো দয়া করে ঝগড়াঝাটি করবে না প্লিজ। পারলে এবার ভালোবাসার কথাটা বলে দিও।
তানি চোখ কপালে তুলে বলল, আমি বলব?
“হ্যাঁ। তাতে সমস্যা কী?”
“প্রেম ভালোবাসার কথা মেয়েরা আগে বলে না।”
“মেয়েরা বলে না ঠিক আছে, কিন্তু বউয়েরা বলতে পারে। ভাবী প্লিজ প্লিজ আমাদের এতো কষ্টে জল ঢেলে সব ঘেটে ঘ’ করে দিও না। একটু দয়া করো। কথা দিচ্ছি প্রথম ছেলে, মেয়ের নাম তোমাদের নামে রাখব।”
তানি হেসে ফেলল। বলল, তুমিও তোমার ভাইয়ের চেয়ে কম না। বরং একটু বেশী ই।
চলবে…..
সাবিকুন নাহার নিপা