কাছে_কিবা দূরে পর্ব-১৭+১৮

0
285

#কাছে_কিবা দূরে
#পর্ব-১৭
শুভ্র কক্সবাজার থেকে আসার পর তানিকে এড়িয়ে চলছে। খুব সূক্ষ্মভাবে খেয়াল করলে সেটা চোখে পড়ে। বাড়ির সবাই হঠাৎ ওদের ফিরে আসায় অবাক হলো। কিন্তু শুভ্র একদম স্বাভাবিক রইলো। জার্নি করে এসে দুটো দিন প্রায় ঘুমিয়ে ই কাটালো। হাতে গোনা কয়েকটা কথা হলো এই দুদিনে। এক বার খাবার সময় তানিকে উদ্দেশ্য করে বলেছিল, ডালের বাটি দিতে। আর ঘুমাতে যাবার সময় বলেছিল, বেড লাইট টা অফ করে দিতে৷ তানি খেয়াল করলো, শুভ্র স্বাভাবিকের তুলনায় কথা বলা কমিয়ে দিয়েছে। একবার ওর মনে হলো যে হয়তো কোনো কারনে আপসেট হয়ে আছে তাই কথা কম বলছে। আবার মনে হলো হয়তো ওর কোনো আচরনে কষ্ট পেয়েছে। দিন চারেক পর তানি এক রাতে ঘুমাতে যাবার সময় বলল,

“শুনছেন?”
শুভ্র তানির দিকে পিঠ দিয়ে ঘামাচ্ছিল। সেভাবেই বলল, হ্যাঁ বলো।

“একটু আমার দিকে ফিরুন না!”

শুভ্র উঠে বসে লাইট টা জ্বালিয়ে দিয়ে বলল, এখন বলো।

তানিও উঠে বসলো। মুখোমুখি হয়ে বসা দুজনেই। তানি আদুরে গলায় বলল, আপনি কী কোনো কারনে আমার উপর রেগে আছেন?

শুভ্র’র উত্তর দিতে এক সেকেন্ড সময় ও লাগলো না। বলল, না।

“তাহলে কী কোনো কারনে আপসেট? ”

“হ্যাঁ। ”

“আমাকে কী বলা যায়, কী কারনে আপনি আপসেট।”

“না বলা যায় না।”
শুভ্র কাটাকাটা গলায় জবাব দিলো।

তানির খুব খারাপ লাগলো। এতটা রুক্ষভাবে যে শুভ্র কথা বলতে পারে সেটা ওর ধারনায় ছিলো না। চোখে পানিও এসে গেল। এতো অল্পে আগে তানির চোখে পানি আসতো না, কিন্তু আজকাল অল্পেই চোখে পানি এসে যাচ্ছে।

তানি আস্তে করে বলল, ইটস ওকে।

“উঁহু ইটস নট ওকে। তুমি কী তোমার সব কথা আমাকে বলো বা বলেছ! তাহলে আমাকে কেন সব কথা বলতে হবে? ”

তানি বিস্মিত গলায় বলল, মানে?

শুভ্র হঠাৎই নরম হয়ে গেল। বলল, না কিছু না। স্যরি একটু বেশী ই মিসবিহাভ করে ফেলছি। এক্সট্রেমলি স্যরি।

কথাগুলো বলে উত্তরের অপেক্ষা না করেই শুভ্র শুয়ে পড়লো। তানি কিছু বুঝতে না পেরে খানিক সময় বসে থেকে তারপর শুয়ে পড়লো। সেই রাতে তানি দু’চোখের পাতা এক করতে পারে নি। সকাল হতেই যখন রান্নাঘরে গিয়ে চায়ের পানি চাপালো তখন মাহফুজা বুঝে গেল যে তানি সারারাত ঘুমোয় নি। বারবার জিজ্ঞেস করলো, যে কিছু হয়েছে কি না। তানি প্লাস্টিকের হাসি মুখে ঝুলিয়ে বলল, কিছু হয় নি। মাহফুজা সরল মনে বিশ্বাস করে নিলো।

মাহফুজা সরে যেতেই তানি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কি যে হয়েছে তা তো আমি ই জানি না।

******
কাজের বাহানা দিয়ে কক্সবাজার থেকে ফিরলেও তেমন কোনো কাজ শুভ্র’কে করতে দেখা যায় নি। ভার্সিটি অফ আছে তাই বাইরেও খুব একটা যায় না। বাসায় থেকে বই পড়ছে, মুভি দেখছে, ইন্টারনেট ব্রাউজ করছে। ব্যাপার টা তানির চোখে পড়লেও ও কিছু জিজ্ঞেস করলো না। সেদিন রাতের ঝাঝালো কথাগুলো কানের কাছে এখনো বেজে চলছে।

অভ্র খেয়াল করলো শুভ্র আর তানির ভিতরে কিছু একটা চলছে। দেখা গেল, সবাই মিলে একসাথে আড্ডা দিচ্ছে। শুভ্র’ও হেসে হেসে গল্প করছে। কিন্তু যেই তানি সেখানে উপস্থিত হয় শুভ্র উঠে চলে যায়। ব্যাপার টা একবার দু’বার হলে কাকতালীয় বলে মানা যেত। কিন্তু বার বার হওয়ায় অভ্র তানিকে জিজ্ঞেস করলো,

“ভাবী বলোতো ঘটনাটা কী?”

“কোন ঘটনা?”

“তোমার আর ভাইয়ার মধ্যে কোনো ঝগড়াঝাটি চলছে? তোমরা ফিরে এলে ভাইয়ার আর্জেন্ট কাজ আছে তাই। কিন্তু ভাইয়া তো বিন্দাস খাচ্ছে ঘুমাচ্ছে।”

তানির সেদিন রাতে শুভ্র’র বলা কথাগুলো মনে পরে গেল। অভ্র’কে সব বলে নিজেই কেঁদে ফেলল।

অভ্র অবাক গলায় বলল, ভাইয়া মিসবিহাভ করছে! সত্যি?

তানি নাক টেনে বলল, আমি মিথ্যে বলি না।

অভ্র ভীষণ অবাক হলো। বলল, আচ্ছা কক্সবাজারে কী এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে যে কারনে ভাইয়া রেগে থাকতে পারে?

“না।”

“একটু মনে করে দেখো”।

তানি একটু ভেবে শুভ্র’র বন্ধুর সাথে দেখা হবার ঘটনা খুলে বলল।

সব শুনে অভ্র বলল, ভাইয়ার সেই বন্ধুকে তুমি চেননা কিন্তু সে তোমাকে চেনে তাই তো?

“হ্যাঁ “।

“আচ্ছা সে কী তোমার আগের হাজবেন্ডের পরিচিত কেউ হতে পারে?”
কথাটা জিজ্ঞেস করার সময় অভ্র কিছুটা বিব্রতবোধ করলো।

তানি রীতিমতো ধাক্কা খেল। শুকনো গলায় বলল, হতে পারে।

অভ্র চিন্তিত গলায় বলল, হতে পারে না ভাবী। আমার মনে হয় তাই ই হয়েছে। হয়তো এমন কিছু বলেছে যেটা ভাইয়া মেনে নিতে পারে নি।

“কিন্তু সেটা আমাকে ক্লিয়ার করে বলবে তো!”

“আচ্ছা আমি জিজ্ঞেস করে দেখি ভাইয়া কী বলে।”

“আচ্ছা”।

****
অভ্র শুভ্র’কে সরাসরি জিজ্ঞেস করলে শুভ্র খুব মেজাজ দেখালো। সব ব্যাপারে অভ্র’র ইন্টারফেয়ার নিয়ে এক দফা রাগ ও দেখালো। কিন্তু অভ্র দমে গেল না। বারবার জিজ্ঞেস করলো, কী হয়েছে স্পষ্ট করে বলতে। শুভ্র এক পর্যায়ে রেগে গিয়ে টেবিলে রাখা গ্লাস সেট ভেঙে ফেলল। শব্দ পেয়ে মাহফুজা, তানি, আনিকা সবাই ই ছুটে এলো।

মাহফুজা অবাক গলায় বলল, এসব কী হচ্ছে?

শুভ্র তখনও রাগে ফুসছে। চোখ, মুখ রাগে লাল হয়ে গেছে। গমগমে গলায় বলল, নাথিং সিরিয়াস।

“সিরিয়াস কিছু না হলে এভাবে ভাঙচুর কেন করছিস সব? ”

শুভ্র জবাব দিলো না। মাহফুজা অভ্র’র দিকে তাকিয়ে বলল, কী হয়েছে বল তো?

অভ্র নির্লিপ্ত গলায় বলল, মা ভাইয়া কয়েকদিন ধরে ভাবীর সাথে স্বাভাবিক আচরণ করছে না? কিছু একটা গন্ডগোল আছে সেটা জানার চেষ্টা করছি।

শুভ্র রক্তচক্ষু নিয়ে তানির দিকে তাকালো। বলল, আমি তোমার সাথে কী অস্বাভাবিক আচরণ করেছি?

তানি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রইলো। কিছু বলার খুঁজে পেল না। অভ্র ঠান্ডা গলায় বলল,

“ভাইয়া মাথা ঠান্ডা করো তো প্লিজ। ”

শুভ্র আচমকাই অভ্র’র নাক বরাবর একটা ঘুষি মেরে বলল, এতো বেশী বুঝিস কেন সবসময়?

তানি আর আনিকা ছুটে গিয়ে অভ্র’কে ধরলো। শুভ্র রাগে কাঁপছে অনবরত। মাহফুজা ছেলের এই রাগের সাথে পরিচিত। সহজে রাগে না ঠিকই, কিন্তু রেগে গেলে কুরুক্ষেত্র বাধিয়ে ফেলে।

মাহফুজা শীতল গলায় ডাকলো, শুভ্র!

শুভ্র মাথা নিচু করে রাখলো।

“কী হয়েছে? ”

অভ্র নাক চেপে ধরে বলল, মা কক্সবাজার ভাইয়ার এক বন্ধুর সাথে তার দেখা হয়েছে। সে নাকি ভাবীর পূর্বপরিচিত। তার সাথে দেখা হবার পর থেকেই ভাইয়া ভাবীকে এড়িয়ে চলছে।

তানি মাথানিচু করে কাঁদতে লাগলো।

মাহফুজা জিজ্ঞেস করলো, কী বলেছে তানির নামে?

শুভ্র তানির দিকে এক পলক তাকালো। সেই দৃষ্টি দেখে তানির অন্তরাত্মা কেঁপে উঠলো।

শুভ্র তীর্যক হেসে বলল, আমার বউ তার আগের হাজবেন্ডের সাথে সুখী ছিলো না তাই প্রেগন্যান্ট অবস্থায় বয়ফ্রেন্ডের সাথে বেরিয়ে এসে বাচ্চা এবোর্শন করিয়েছে। সেটা বলেছে। বিয়ের এতো মাস পর জানলাম যে আমার বউ চরিত্রহীনা।

তানির জগৎ টা দুলে উঠলো। পরে যেতে গেলে অভ্র ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিলো।

মাহফুজা আগের মতো ই স্বাভাবিক। বলল, ব্যাস এইটুকুই?

“হ্যাঁ। ”

“আর তাতেই তুই জানোয়ারের মতো আচরণ শুরু করলি?”

“সেটা কী স্বাভাবিক না?”

মাহফুজা উত্তর দিলেন না। সশব্দে শুভ্র’র গালে একটা চড় মেরে বলল, রাস্তার লোকের কথায় বিশ্বাস করে নিজের বউয়ের সাথে অসভ্যতা করার জন্য এই থাপ্পড় টা দিলাম।

শুভ্র মাথানিচু করে ফেলল।

মাহফুজা রাগে কাঁপতে কাঁপতে বলল, একটা ব্যাপার পুরোটা না জেনেই একজনের ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট দিয়ে ফেললি? কেন সত্যি জানতে আমাকে বা ওকে জিজ্ঞেস করতে পারলি না?

শুভ্র চুপ করে রইলো।

মাহফুজা শান্ত গলায় বলল, যদি নিজের অনাগত সন্তান আর নিজের ভালোর জন্য সহপাঠী বন্ধুর সহায়তায় বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসে তানি চরিত্রহীনা হয় তাহলে তোর বাবাকে ভালোবেসে পালিয়ে বিয়ে করে যে তোকে জন্ম দিয়েছে সেও চরিত্রহীনা।

চলবে……

#কাছে_কিবা_দূরে
#পর্ব-১৮
মাহফুজা নিজেকে শান্ত করতে কিছু সময় নিলেন। বললেন,
“ঠিক কী কী বলেছে তোর বন্ধু সব টা বলবি। ”

শুভ্র তানির দিকে এক পলক তাকালো। মাহফুজা বলল,
“উঁহু। তানি এখানেই থাকবে। ওর সব টা শোনার দরকার আছে।

শুভ্র গলার শ্লেষ্মা পরিষ্কার করে বলতে শুরু করলো।

ঘটনা হলো, শুভ্র’র যে বন্ধু সে ছিলো তানির প্রাক্তন স্বামীর দুঃসম্পর্কের আত্মীয়। তার ভাষ্যমতে, তানির প্রাক্তন স্বামী ছিলো পেশায় একজন ইঞ্জিনিয়ার। বাবা মায়ের একমাত্র ছেলে। বড় তিনজন বোন ও আছে। অবস্থাপন্ন ফ্যামিলি দেখে তারা তানির বিয়ে দেন এবং পরবর্তীতে তারা বুঝতে পারেন যে মেয়ে মোটেও সংসারী টাইপ না। সংসার, স্বামী কারও প্রতিই কোনো মন নেই। এরমধ্যে তানি প্রেগন্যান্ট হলো। বাচ্চা নেয়ার পর পর ই নাকি তারা টের পেল তানির এ্যাফেয়ার আছে। সেটা ফ্যামিলির সবাই জেনে যাওয়ায় এক রাতে তানি ননদ দের মেরে বয়ফ্রেন্ডের সাথে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে শোনা যায় এবোর্শন করিয়ে স্বামীকে নাকি ডিভোর্স দিয়ে দিয়েছে।

সব শুনে মাহফুজা বলল, ব্যাস! এইটুকুই?

শুভ্র কোনো কথা বলল না। তানি নিজেও কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। এতো বড় ধাক্কা খেয়ে বাকশক্তি হারিয়ে ফেলল যেন। শুভ্র’র সব কথা শুনতেও পেল না। তানি উঠে দাঁড়ালো। মাহফুজা বলল, তানি এখানে বস চুপচাপ। আমার কথা এখনো শেষ হয় নি। তানি শুকনো গলায় বলল, আমার শরীর ভালো লাগছে না মা। আমি একটু শোব। আর ওনাকে সত্যিই আমার বলার কিছু নাই। যার কাছে আমার কোনো গুরুত্ব ই নেই। তাকে আর নতুন করে কী বলার থাকতে পারে।

মাহফুজা আরও কিছু বলতে গেলে অভ্র বাধা দিলো। বলল, মা ভাবী একটু বিশ্রাম করুক। তাকে দেখে মনে হচ্ছে সে অনেক টায়ার্ড।

আনিকা তানিকে নিজের ঘরে নিয়ে গেল। ঘরে গিয়ে তানি বিছানায় শুয়ে থাকলো।

মাহফুজা শান্ত গলায় বলল, বিয়ের আগে আমি যখন বলেছিলাম তানির সাথে কথা বল, খোঁজ খবর নে। তখন বলেছিলি মা তোমার উপর ভরসা আছে। তা আজ তো মনে হচ্ছে আমার কিংবা তানির চেয়ে বন্ধুর কথায় তোর বেশী ভরসা।

“মা আমার বন্ধুটা অনেক দিনের পরিচিত। ও যে মিথ্যে বলবে না সেটা আমার বিশ্বাস ছিলো “।

“কিন্তু মা যে মিথ্যা বলতে পারে এ ব্যাপারেও নিশ্চয়ই বিশ্বাস ছিলো?”

শুভ্র অস্ফুটস্বরে বলল, মা!

মাহফুজা হাত দিয়ে থামিয়ে দিয়ে বলল, আগে আমাকে শেষ করতে দে।

তানির বাবা পাত্রের ভালো চাকরি আর পরিবার দেখে বিয়ে দিয়েছিলেন। একবারও বুঝতে পারেন নি যে তার বিশ বছরের মেয়ে সংসারের মারপ্যাঁচ শিখে ওঠে নি। শুধু তানি কেন! ওই বয়সী কোনো মেয়েরাই শিখে আসে না। আমার বিয়ে যখন হয়েছে তখন আমি কলেজে পড়ি। ঠিকঠাক এক কাপ চা’ও বানাতে পারি না। হাত কেটে, পুড়িয়ে সংসারের রান্নাবান্না, কাজ শিখেছি। কিন্তু তানির কাছ থেকে ওর আগের স্বামী আর তার পরিবার সবকিছু একবারে চেয়েছেন। একটা বিশ বছরের মেয়ে তার পক্ষে কী প্রথমেই সব কাজ পারা সম্ভব? তাছাড়া তানি ওর মায়ের আদরের মেয়ে। পৃথিবীর কোনো মায়েরাই তাদের মেয়েকে রান্নাঘরে ঢুকিয়ে কাজ শেখায় না। মায়েদের মন মেয়ের জন্য সব সময় উতলা থাকে। তুই তোর বোন কে জিজ্ঞেস করতো চুলা জ্বালিয়ে এক কাপ চা বানাতে পারে কি না!

ঘরের মধ্যে সবাই চুপচাপ মাহফুজার কথা শুনছে। একটু থেমে মাহফুজা আবারও বলল,
বিয়ের দুইমাসের মাথায় তানির গায়ে প্রথমে হাত তুলল স্বামী। দোষ হলো, বন্ধুদের জন্য তানি রান্না করেছিল। সেই রান্না মুখরোচক না হওয়ার কারনে কষে থাপ্পড় মেরে বলেছিল, আজকের এই থাপ্পড় তোকে সারাজীবনের জন্য ভালো রান্না করা শিখিয়ে দেবে।

শাশুড়ী ছাড়াও তিন ননদ ছিলো যাদের একজন ঘরে আর বাকী দুজন ওই একই বিল্ডিং এ থাকতো। এরা গায়ে হাত দিতো না ঠিক ই। কিন্তু এরা কথা দিয়েই মেরে দিতো। কথায় কথায় বাপের বাড়ির দূর্বলতার খোটা, কাজ না জানার খোটা এসব প্রতিদিন ভাত খাওয়ার মতো করেই শুনতে হতো।

আরেকটা কথা মিস হয়ে গেছে। তানিকে বিয়ে করার কারণ মূলত এটাই ছিলো যে ছোট ঘরের মেয়ে ঘরে আনলে পায়ের তলায় পিষে মারতে সুবিধা হবে। এরা ছেলের জন্য বউ না, বাসার পার্মানেন্ট কাজের লোক এনেছিল। কনসিভ করার পর শুরু হলো এদের আরেক ঝামেলা। ছেলে এতো তাড়াতাড়ি বাচ্চা চায় না। তার বন্ধুদের এখনো বাচ্চা হয় নি। বাচ্চার বাপ হওয়া মানে তার কাছে বুড়ো হয়ে যাওয়া। অথচ তার মা, বোনদের বাচ্চা লাগবে। এই নিয়ে ঝামেলার কোনো শেষ নেই। শেষমেস তারা নিজেরাই সিদ্ধান্ত নিলো যে বাচ্চা হয়ে গেলে বোনেদের মধ্যে একজন আছে যার বাচ্চা নেই, সে নিয়ে নেবে। অর্থাৎ বাইরের মানুষ কে জানতে দিবে না যে তানি প্রেগন্যান্ট ছিলো। ঠিক সেকারনে এক প্রকার গৃহবন্দি করে রাখা হতো তানিকে। অল্প বয়সী মেয়েটা তখন একটু সাহস করে ওই কয়েদখানা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করেছিল। ওদের ব্যাচের একটা গ্রুপ ছিলো যাদের খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিলো। তাদের একজনের ফোন নম্বরে ফোন করে সব টা বললে সে মানবতার খাতিরে ঝুঁকি নিয়ে পুলিশের সাহায্যে তানিকে উদ্ধার করেছিল। শেষ পর্যন্ত পুলিশের সাহায্যে ও রাজশাহী পৌছেছিল। কিন্তু কপাল খারাপ থাকায় সেই বাস জার্নিতেই মিসক্যারেজ হয়ে যায়।

এরপরে তানি একটা ভয়ংকর কাজ করেছিল। সুস্থ হয়ে পুরো পরিবারের বিরুদ্ধে মামলা করেছিল মা, খালার সহযোগিতায়। সেই মামলায় তাদের অনেক ভোগান্তিও হয়েছে শুনেছি। তা তোমার বন্ধু বুঝি সেটুকু বলে নি?

শুভ্র লজ্জায় মাথানত করে রাখলো। তানির কাছে মাফ চাওয়ার ও মুখ নেই।

মাহফুজা এক নিঃশ্বাসে অনেক কথা বলে ফেলায় গলা শুকিয়ে গেছে। এক গ্লাস পানি ঢক ঢক করে খেয়ে ফেলল। বড় করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
“অবন্তী তো সবাইকে বলতো আমি খারাপ। আমি ওর উপর টর্চার করি। সেগুলো কী সত্যি ছিলো? অবন্তীর কথা অনুযায়ী আমিও তো খারাপ মানুষ। আমাকে মা বলতে তোর ঘেন্না হওয়া উচিত। ”

শুভ্র কাতর গলায় বলল, মা আমি ভুল করে ফেলেছি।

মাহফুজা থামিয়ে দিয়ে বলল, না বাবা ভুল আমার হইছে। তোমার জন্য অবন্তীর মতো মেয়েরাই ঠিক, তানি বেমানান।

অভ্র সাফাই গেয়ে বলল, মা ভাইয়া ভুল করে ফেলেছে। দেখো যে বলেছে সে কিন্তু ভাইয়ার বন্ধু ছিলো।

“আর আমি মা। ও যতটা তানিকে অপমান করেছে ততটা অপমান আমাকেও করেছে।”

শুভ্র’র কিছু বলার মতো মুখ নেই। মাথানিচু করে থাকা। ইশ! তানি বিয়ের আগে দেখা করতে চেয়ে এই কথাগুলোই হয়তো বলতে চেয়েছিল। আর ও তখন বারন করে দিয়েছিল যে ও কিছু শুনতে চায় না। আর সেই ও কী না আজ এরকম একটা বিশ্রী কাজ করলো। তানির পা ধরে ক্ষমা চাইলেও হয়তো কম হয়ে যাবে।

অভ্র’র যতটা খারাপ তানির জন্য লাগছে, তারচেয়ে বেশী লাগছে শুভ্র’র জন্য। আর কেউ না জানুক ও জানে যে, আজকের এই অবিশ্বাস করার ঘটনার পিছনে যে ওর অতীতের কোনো ঘটনার মিল আছে।

মাহফুজা চলে যেতেই আনিকা শুভ্র’র একটা হাত ধরে বলল, ভাইয়া ঘরে চলো। তোমার হাত কেটে গেছে অনেকখানি।

অভ্র খেয়াল করলো যে দেয়ালে ঘুষি দেয়ার সময় যে লেগে গিয়েছিল সেখান থেকে চুইয়ে চুইয়ে রক্ত পড়ছে। এতক্ষন সেটা কেউ খেয়াল করে নি।

অভ্র উঠে এসে ভাইয়ের কাঁধে হাত রেখে বলল, ভাইয়া ওঠো।
আনিকাকে ইশারায় ফার্স্ট এইড বক্সের কথা বলল।

শুভ্র উদ্ভ্রান্তের মতো তাকিয়ে রইলো কিছু সময়। বলল, তানির কাছে ক্ষমা চাওয়ার যে কোনো মুখ রইলো না। এখন আমি কী করব?

চলবে…..

সাবিকুন নাহার নিপা

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে