কাছেপিঠে পর্ব-২৩ এবং শেষ পর্ব

0
994

~কাছেপিঠে~
পর্বসংখ্যাঃ ২৩

পরবর্তী সময়টা খুব স্বচ্ছন্দে কাটে ইভান আর মিষ্টির। ইভান সারাদিন অফিস করে।সন্ধ্যাবেলায় বাসায় ফিরে মিষ্টির সাথে মিলে রাতের খাবারের আয়োজন করে। সময়টা যেনো তখন থামানোই যাচ্ছিলো না। সুন্দর,অনুভূতিপূর্ণ মুহূর্তে যেনো দ্রুতই বয়ে যায়।ইভানের নাছোড়বান্দা মন চেপেচুপেই নিজেকে বিরত রাখছিলো মিষ্টিকে খোঁচানো থেকে। তারপর তার একঘেয়েমি লাগে। মাঝে মাঝে মন চায় মিষ্টিকে চড়াতে, ঠিক আগের মতোই।হুটহাট এসে মিষ্টির পিঠে চড় মেরে উধাও হয়ে যাওয়া।মিষ্টি রেগে আগুন হয়ে কোমড়ে ওরনা বেঁধে দৌড়ে এসে ইভানের পিঠেও একইভাবে কিল বসিয়ে দেওয়া।তারপরেই দুজনের তুমুল মারামারি,ঝগড়াঝাটি।দিন শেষে,আসে আবেগি সময়। আবেগের বেলায় তখন বেসে বেড়ায় দুজনে।উফফ কি চমৎকার দিন ছিলো। আর কোন সম্পর্কে এমন হয় কি-না ইভানের জানা নেই। তবে তার এই সম্পর্কে মারামারি, ঝগড়া ছাড়া অচল।প্রায় একমাস ধরে তাদের ঝগড়া হয়না। দুজনের মধ্যে ঝগড়ার সুর উঠলেই তা আবার থামিয়ে দেয় তারা।

আজগুবি চিন্তাভাবনা করতে করতে চায়ের কাপে লবণ দিয়ে চা বানিয়ে ফেললো ইভান। বিষয়টা সে প্রায় সময় করে। লবণ আর চিনির মধ্যে পার্থক্য খুঁজে পায়না। সেদিন মিষ্টি কোথা একটা প্রয়োজনে বাইরে গিয়েছিলো।এই মুহূর্তে মনে পড়ছেনা ইভানের। রান্নাটা তাকে করতে হতো। তার উপর লোডশেডিং এর জ্বালা। মৃদু অন্ধকারে ডাল সিদ্ধতে হলুদের গুঁড়োর বদলে মরিচের গুঁড়ো দিয়ে দিলো। মরিচের গুঁড়ো তীক্ষ্ণ ঝাঁজালো গন্ধটাও সে আঁচ করতে পারলো না যে সে মরিচের গুঁড়ো দিচ্ছে। ইশ,ডাল রান্নার সময় লবণ দেখতে গিয়ে ঝালের জন্য জিহ্বার আগার জ্বলতে লাগলো।তৎক্ষনাৎ ইভান বুঝলো সে কেলেংকারি টা কিভাবে ঘটালো। পরে খেতে বসে মিষ্টি যখন কিছু বলতে যাবে।ইভান আগেবাগে বলে দিলো,
– সবসময় হলুদের ডাল খেতে পাবি বলে কথা নেই।
মরিচের ডাল খাওয়া লাগে।

মুখের ভাবভঙ্গি এমন ছিলো যে ইভানকে কিছু বললেই তেতে উঠবে।মিষ্টি কথা বাড়ায় না।ইভানের রান্না করা ডাল নিশ্চুপ খেয়ে নিলো। কি যে শান্তি লেগেছিলো ইভানের বুকে সেদিন।

পেটে নরম হাতের শক্ত বাঁধনে আঁটকে গেলো ইভান। পেছন দিয়ে নাকের আলতো খোঁচা লাগছে।ইভান চট করে ফিরে শক্ত করেজড়িয়ে ধরলো মিষ্টিকে। এবার দমবন্ধ হওয়ার জোগাড়। মিষ্টি ছটফট শুরু করে দিলো। ইভানের বুকে ধাক্কা মারতে মারতে বলো,

— আব্যে, আস্তে, ছাড় বলছি।নইলে আস্তে ধর।
আমার দমবন্ধ লাগে।

— একটু আগে আসতে পারলি না?
আমি লবণ দিয়ে চা বানিয়ে ফেলেছি। এবার নতুন করে বানা।

— হাহ, পারবো না।
তোকে কে আগ বাড়িয়ে করতে বললো?
আমি করতাম না?

— এখন কয়টা?

— চারটা পঁচিশ দেখলাম।কেন?

— চল বাইরে যাই?

— না বাইরে না। আজ তো শুক্রবার ঘরেই থাকি?
তাছাড়া বাইরে কম যাওয়ার চেষ্টা করবো এখন থেকে।

ইভান অবুঝের মতো জিজ্ঞেস করলো,

– কেন?

মিষ্টি ইভানের কাছ থেকে সরে এসে ড্রয়িং রুমে যেতে যেতে বললো।

— তোকে বলা হয়নি। রেজাল্ট পজিটিভ।

— হোয়াট?

ইভান চোখ বড় বড় করে মিষ্টির পেছন পেছন ছুটে গেলো। বলতে লাগলো,

— টেষ্ট করিয়েছিস? রেজাল্ট সত্যি? নাকি মজা করছিস?

মিষ্টি হাসছে। গত দুইবার, ইভান কে পিরিয়ড হওয়ার পরও পিরিয়ড বন্ধ হয়েছে বলে বলে প্রচুর মানসিক অত্যাচার করেছে মিষ্টি। এবারে যা ঘটার তা ঘটেই গেলো।মিষ্টির জবাব না পেয়ে ইভান কাছাকাছি এসে মিষ্টির হাতটা ধরে নিজের দিকে ফেরালো,অন্ধকারচ্ছন্ন মুখে মিষ্টির দিকে চেয়ে বললো,
–প্লিজ, এবার অন্তত মিথ্যা বলে আমার মনটা ভেঙে দিস না। তুই জানিস,তোর মুখে এসব শুনলে আমার কনফিডেন্স লেভেল জিরো হয়ে যায়। আমার অক্ষম মনে হয়।

মিষ্টি বুঝলো,ইভান এবার পুরোপুরি ভাবে অস্থির হয়ে আছে সত্যিটা জানার জন্য। এবার ইভান অধৈর্য হয়ে যাবে।আগের তুলনায় তাকে আরও অতিষ্ঠ করে তুলবো। মিষ্টি ইভানের হাত ধরে রুমে নিয়ে আসলো। টেবিলের উপর থেকে প্রেগন্যান্সি টেষ্ট কিটটা হাতে তুলে ইভানকে দেখালো। উত্তেজনার চরম ধাপে তখন ইভান।চটজলদি কিটটা হাতে নিয়ে দেখলো ডাবল রেডমার্ক। তৎক্ষনাৎ খুশীতে আত্মহারা হয়ে কিটটা রেখে পূনরায় বাহুবন্ধনীতে মিষ্টিকপ আবদ্ধ করে নিলো।কি যে আনন্দ লাগছে ইভানের।এতো খুশীর মুহূর্ত যে আজ ইভানের কথা বলতে গলা কাঁপছে। নিজেকে বহু চেষ্টায় সামলালো।মিষ্টির উদ্দেশ্যে বললো,

— আমি আসলে বুঝতে পারছিনা তোকে কি বলবো।
আমার বাবা হওয়ার স্বাদ পূর্ণ হবে এটা ভাবতেই আমি নিজেকে সামলাতে পারছিনা।

মিষ্টি ইভানের পিঠে হাত বুলাতে বুলাতে বললো
— শান্ত হ। তোর উপর অনেক দায়িত্ব। আমি আর কোন কাজ কামে নেই। যা করার তুই করি।

ইভান মিষ্টিকে ছেড়ে পাশে বিছানায় বসলো।সেও মিষ্টির পাশ ঘেঁষে বসলো। তারপর বললো,
— তোকে কিছু করতেই দিবো না আমি।

এরপর একটু সময় চুপ থেকে বললো,

— বাসায় হেল্পিং হেন্ড আর কুকিং এর জন্য কাউকে রাখলে কেমন হয়?

ইভানের কথায় কিছু একটা ভাবলো মিষ্টি।এরপর মৃদু হেসে বললো,

— কাউকে রাখবি? আচ্ছা কাকে রাখবি বলতো?

ইভান মিষ্টির মুখের দিকে চাইলো। মিষ্টির ঠোঁটের কোণে তখন দুষ্টু হাসি।ইভান হাসির কারণটা বুঝতে পারলো। চিন্তিত মুখে বললো,

— কোন মেয়েকে রাখলে তুই সন্দেহ করবি। যদিও আমি পিউর পুরুষমানুষ,কোন ঘাপলা ছাড়া। আর ছেলে রাখা তো ইম্পসিবল। আর মধ্যবয়স্ক কাউকে রাখা তো আরও ঝামেলার, নয় তো চোর হয়,নয়তো নিজের মনমর্জিতে কাজ করবে এমন হয়।কাকে রাখা যায়? সেঁজুতি তো বিয়ে করে নিয়েছে।

মিষ্টি বললো,
— একটা সলিউশন আছে।

ইভান উৎসুখ মুখে চেয়ে বললো,
— কী?

— আমি বড় আপার কাছে চলে যাই?

— হোয়াট? বড় আপুর বাসায়? মাথামোটা কোথাকার ওই বাসায় কোন প্রাইভেসি নাই। তোর কাছে যেতে গেলেও সেখানের মানুষগুলো চেয়ে থাকবো।

— আজব, তুই এখানেই থাকবি।আমি আপার সাথেই থাকি?

— অসম্ভব। চড় খেতে না চাইলে চুপ থাক বেয়াদব।

ইভান রেগে গেলো অনেকটা। প্রায় উঠে ধুপধাম করতে করতে চলে গেলো কিচেনে। আজ থেকে,এখন থেকে সব কাজ সে-ই করবে। মিষ্টিকে একটা কাজও করতে দিবেনা। মিষ্টির কথাটায় রাগান্বিত স্বরে কিচেন থেকেই আওয়াজ করতে করতে বলতে লাগে,

— কত্তবড় সাহস,কত্ত বড় কলিজা। আপার বাসায় গিয়ে থাকবে। তোর আপাকে বল, এখানে এসে থাকতে। তোর খেয়ার করলেই হবে আমি বাইরে থাকা অবস্থায়। আমি আসার পর আর কারও দরকার নেই।
যা আমি চাকরিই ছেড়ে দিবো। যতদিন না আমার বাচ্চা আমার কোলে না আসছে ততদিন আমিই সব করবো।

মিষ্টির যে কি হাসি পাচ্ছে। ইভানকে যখন দূরত্বের কথা বলা হয়, সে তখন ভীষণ রেগে যায়। সে মুহূর্তটা প্রচণ্ড অনুভব করে মিষ্টি।একদম মন মতোন।ভাবতেই ভালে লাগে তাকে কেউ এতোটা ভালোবাসে।

দিন আস্তে আস্তে বাড়তে লাগলো। তাদের সমস্যার সমাধান তারমধ্যে হয়েই গেলো। মিষ্টির সাথে তার মায়ের সাথে কথা হতো সবসময় তার বাবার অগোচরে। মিষ্টি তার মা হওয়ার খবর তার মাকে জানালো। খুশীতে আটখানা হয়েই সে প্রচন্ড শক্ত একটা পদক্ষেপ নিয়ে ফেললো। প্রায় তেজি স্বরে মিষ্টির বাবাকে বলে দিলো সে যেনো তার বড় মেয়ের কাছে গিয়ে থাকে। সে তার ছোট মেয়ের কাছে চলে যাচ্ছে। তার মেয়ের এই অবস্থার সময় মা হিসাবে পাশে থাকা তার দায়িত্ব বলে মনে করেন তিনি। সব কিছু ঘুছিয়ে চলে আসলো মেয়ের বাসায়। মিষ্টি তার মাকে পেয়ে ঢের খুশী হয়,কিন্তু মনের মধ্যে একটা খচখচানি শুরু হয়। তার মনে হতে লাগলো সে একটা অনৈতিক কাজ করছে ইভানের মাকে দূরে রেখে।যতোই হোক ইভানে মা তো।মায়ের জন্য ছেলেরটা ভেতরে ভেতরে পুড়ছে হয়তো।ইভানকে জানাতেই সে নাকচ করে দেয়।কারণ তার মাকে সে ভালো মতোই চিনে।সবশেষে মাঝেমধ্যে এসে ছেলের আর ছেলের বউকে দেখে যাওয়ার প্রস্তাব পায় ইভানের মা। দিন ঘনিয়ে আসে সুদিনের। ইভান তীব্র অস্থিরতায় ভুগে সর্বক্ষণ।মনের মধ্যে অজানা আশঙ্কা, ভয়। সব মিলে সে প্রচুর কষ্ট পায় ভেতরে ভেতরে। সেসব মিষ্টি তার মোলায়েম হাতের ভালোবাসাময় জাদুকরি স্পর্শ ভুলিয়ে দেয় ইভানের সব চিন্তা।অবশেষে চলে এলো সেই মুহূর্ত যেদিন মিষ্টির প্রসব যন্ত্রণা উঠে। ইভানকে খবর দিতেই অফিস থেকে ছুটে আসে সে। মিষ্টির মা,ইভানের মা, ইভান একত্রে মিলে মিষ্টিকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। হুমায়রাও ছুটে আসে হসপিটালে।ছোট মেয়ের এই অবস্থার কথা শুনে হঠাৎ আল্লাহর রহমতে মতিউরের মনটা নরম হয়ে যায়।তিনি হুমায়রার পেছন পেছন ছুটে চলে আসে হসপিটালে। মতিউরকে দেখেই প্রচণ্ড অবাক হয় ইভান। চিন্তার কারণে মুখ দিয়ে একটা কথাও বের হচ্ছিলো না তখন। সবাই যখন চিন্তায় মত্ত। মতিউর একপাশে এসে ইভানের পাশে দাঁড়ালো। আলতো করে ইভানের কাঁধে হাত রাখলো।ইভান টের পেয়েও চুপ থাকলো। মতিউর ছোট মেয়ের জামাতার অভিমান বুঝতে পারলেন। নিজেই গলা পরিষ্কার করে বললো,
— এখনো রাগ করে থাকবে বাবা। মানলাম এই বুড়োটা রাগ বেশি।তাই তোমাদের বেশিই কষ্ট দিয়েছিলাম।তাই বলে ক্ষমা করা যায়না?

মতিউর সাহেবের কন্ঠ কাঁপছে। এতোদিনের রাগ, অভিমান যে আজ নিঃসৃত হয়েছে তা বেশ বুঝলো ইভান। মতিউর সাহেবের দিকে ফিরে বলল,
— এভাবে বলবেন না বাবা। দোষটা আমাদেরই ছিলো। আমরা একে অপরকে ভালোবাসতাম।বাবা হিসাবে আপনার যা করা উচিত তা করেছেন। আমরা লজ্জিত এবং ক্ষমাপ্রার্থী তার জন্য।

রোকসানা, হুমায়রা আর ইভানের মা দুজনের চেয়ে রইলেন। তাদের মুখে আজ হাসি। আজকের ঘটনার জন্য তারা একমদি অবাক হয়নি।কারণ তারা জানতো।একদিন না একদিন মতিউট ইভান আর মিষ্টির সম্পর্কটা মেনে নিবেন।

অতঃপর দুই ঘন্টা সময় অতিক্রম হওয়ার পর অপারেশন থিয়েটর থেকে বের হয় একজন নার্স। হাতে সুন্দর ফুটফুটে পুতুলের ন্যায় দেখতে ছোট একটি বাচ্চা। ইভান প্রায় দৌড়ে গেলো নার্সটির কাছে। নার্স ইভানের এগিয়ে আসা দেখে নিজেই ইভানের মেয়েটিকে হাতে তুলে দিলো। হাসিমুখে সবার দিকে চেয়ে বললো,

— মেয়ে হয়েছে। মিষ্টি খাওয়ান আমাদের।

সকলে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বলে উঠলো। ইভানের চোখের কোণে অস্রু এসে জমে। তার আর মিষ্টির ভালোবাসার চিহ্ন এই ফুটফুটে কন্যাটি। তার কলিজার আরেক টুকরো অংশ। ইভান হুমায়রার হাতে তার মেয়েটিকে দিয়ে নার্সের সাথে কথা বলতে চলে গেলো। মিষ্টিকে দেখার জন্য বড্ড ছটফট করছে তার হৃদয়। দেখতে পেলেই শান্ত হবে সে। নার্স জানালো একটু পরেই কেভিনে দেওয়া হবে। কেভিনে দিতেই ইভান কেউ কেভিনে আসার আগে সে চলে এলো। কাছে এসে আলতো করে হাতটা ধরে মিষ্টি গালে, কপালে চুমু এঁকে দিয়ে বললো,
— থ্যাংকস,থ্যাংকস,থ্যাংকস। আমি অনেক খুশী আজ। তার কারণ তুই। তোকে আর আমার মেয়েকে পেয়ে এখন আমার দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি সুখী মানুষ মনে হচ্ছে।
মিষ্টির মৃদু হেসে ইভানকে নিজের কাছে ডাকলো। ইভান ঝুঁকলে দৃঢ়ভাবে ইভানের গালে হাত রেখে বলো,
— তোকে পেয়ে আমি আগে থেকে পরিপূর্ণ ছিলাম রে। ব্যস,এভাবেই আমাকে সারাজীবন ভালোবাসবি।আমার কিছু চায়না।
ইভান হেসে মাথা নাড়ায়। মিষ্টির সুন্দর চোখজোড়ার দিকে চেয়ে সম্মতি দিলো।

(সমাপ্ত)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে