~কাছেপিঠে~
পর্বসংখ্যাঃ ২২
প্রায় দুটো দিন পর মারজিয়ার থমথমে বদনখানি দৃষ্টিগোচর হলো মিষ্টির। বাসায় ঢুকেই সর্বপ্রথম মহিলাকে বসা অবস্থায় দেখলেন। ইভান মিষ্টিকে নামিয়ে দিয়ে সোজা চলে গেলো অফিসে। মিষ্টির সাথে মারজিয়ার সুমিষ্ট আলাপ কখনো হয়নি।সে সুবাদে মিষ্টির মারজিয়াকে দেখে কোন কথা না বলে নিজের রুমে যেতে উদ্যত হলো। মারজিয়া হঠাৎ শান্ত গলায় মিষ্টির দিকে চেয়ে বললো,
— খেয়ে এসেছো?
কথাটা শুনেই যেনো আকাশ থেকে পড়লো মিষ্টি। মিনিট দুয়েক কাটলো নিস্তব্ধ হতভম্বতায়। এতো সুন্দর করে কথা কখনো বলেনি আজ পর্যন্ত। আজ হঠাৎ? বিষয়টা ভাবাচ্ছে তো।তারপর দৃঢ়ভাবে হেসে বললো,
— খেয়েছি,
— ইভান কোথায়?
—- অফিসে।
এতটুকুই কথোপকথন হলো আজ তাদের মধ্যে।মিষ্টি ঘরে যেতে যেতে সেঁজুতিকে খুঁজলো চারপাশে দৃষ্টি ছুঁড়ে। সেঁজুতিকে দেখা গেলো না। মারজিয়ার থেকে আগ বাড়িয়ে জিজ্ঞেস ও করলো না। লিভিংরুম হতে নিজের ঘরে চলে গেলো মিষ্টি।
রুমে এসে সর্বপ্রথম গোসলটা সেড়ে নিলো মিষ্টি। খিদে লেগেছে খুব। কিন্তু খাওয়ার ইচ্ছেটুকু আজ নেই। কেমন যেন সবকিছু ফাঁকা ফাঁকা লাগছে। বাবা-মার কাছে যখন ছিলো তখন হাজারো কষ্টের মধ্যে ভালো লাগা কাজ করছিলো।অন্তরের একটা কোণায় আশার আলো ছিলো। নিজের পরিবারের সাথে একটা সুসম্পর্কের।কিন্তু ভাগ্যে উপর তো কারো হাত নেই। ভাগ্যের চাকা যেদিকে ঘুরে। সেদিকেই সবাইকে চলতে হয়।
চুল মুছতে মুছতে বিছানায় বসলো মিষ্টি। ফোমটা হাতে নিতেই মারজিয়া বেগম হঠাৎ দরজায় দাঁড়িয়ে নক করলেন। মিষ্টির হতভম্বতা এবার আকাশ ছুঁই ছুঁই। আজ কি হচ্ছে তার সাথে।তার শাশুড়ি, ইভানের মা আজ নিজে থেকে এ ঘরে এসেছে। মিষ্টি এবার নিজেই বলে ফেললো,
— কিছু বলবেন আপনি?
মারজিয়া মলিন হেসে ভেতরে এসে মিষ্টির পাশে বিছানায় বসলো। মিষ্টির চোখ পড়লো মারজিয়ার গালে,গলায়,ঠোঁটের কোণায় মারের দাগ।আশ্চর্য হলো খুব। সাহসা জিজ্ঞেস করতে পারলো না।মারজিয়া হালকা কেশে বললো,
— তোমার বাবা কেমন আছে?
— আলহামদুলিল্লাহ,
মিষ্টি চুপ মেরে গেলো।কথা বলার মতো শব্দ তার ভাণ্ডারে নেই আপাততে। মারজিয়া নিজেই বললো,
— আমি অনেক পাপ করেছি মিষ্টি,তোমার সাথে অনেক অন্যায় করেছি।এজন্য আমার সুখটা আসলে কোথাও হয়নি।
— আপনি এভাবে বলছেন কেন?
কি হয়েছে।
— আমার সব শেষ হয়ে গেলো মিষ্টি। তোমার শশুর এ বয়সে এসে আবারও একটা বিয়ে করে নিয়ে এসেছে।আমি বাঁধা দেওয়াতে আমার গায়ে হাত তুলেছে।
মিষ্টির মুখের থমথমে ভাবটা সরলোনা।সে আগের ন্যায় করে রাখলো মুখটা।যেনো সে জানতো এসব হতে পারে। মিষ্টি বললো,
—- কখন হলো এসব। আপনি এখানে ছিলেন না?
— এই দুইদিনেই হয়েছে সব।তুমি যাওয়ার পর পরেই আমি গিয়েছিলাম আমার ছেলেমেয়েদের দেখতে।নিজের পেটের সন্তানও আজ আমার সাথে বেইমানি করলো। নতুন মহিলার আঁচলে ধরে দাঁড়িয়ে থাকলো।একটা হতচ্ছাড়াও আমার সাথে আসেনি।উল্টো দামী দমী উপহার পেয়ে সবাই ওই মহিলার সাথে থেকে গেলো।ওই মহিলা আমার বাচ্চদের হাত করে নিয়েছে।
মিষ্টির এ পর্যায়ে প্রচুর হাসি পাচ্ছিলো। শাশুড়ির শুভবিবাহ, বিবাহবিচ্ছেদ কাহিনী শুনতে শুনতে অতিষ্ঠ মিষ্টি।তবে একটা জিনিস সে ভালোই লক্ষ করলো। অন্যের সংসারে আগুন লাগাতে আগুনটা কোন এক সময় নিজের সংসারেই এসে পড়ে।যা আজ চোখের সামনে প্রমাণিত। মিষ্টি বললো,
— ইভান জানে?
— না,ওকে জানানোর জন্যই তখন খুঁজেছিলাম।
আসলে তুমি বলে দিও।আমার বলার মুখ নেয়।
মিষ্টি মৃদু আওয়াজে বললো,
— আচ্ছা। এখন কি করবেন।
— চিন্তা করোনা তোমাদের সংসারে থাকবো না আর।বিকেলে ইভান অফিস থেকে আসলে আমি সন্ধ্যায় চলে যাবো। মহিলাদের হোস্টেলে।
— আপনাকে কোথাও যেতে হবেনা।এখানেই থাকুন।আমাদের সমস্যা নেই।
— আমার আছে,আমি থাকতে চাচ্ছিনা।
মারজিয়া উঠে দাঁড়ালো। বললো,
— সেঁজুতি কে তোমার এখানে রেখে যাবো।
ও তোমার সব কাজ করে দিবে। একটু দেখে রেখো।
মারজিয়া বের হতে গেলেই মিষ্টি বললো,
— মা আরেকবার ভেবে দেখেন।
— আমি আমার পাপে প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই। একা থেকে তা করবো। ইনশাআল্লাহ।
মারজিয়া চলে গেলেন। দুইদিনে ত্রিশ বছরের যৌবন ধরে থাকা মহিলার রূপ পঞ্চাশে ধারণ করেছে। মারজিয়া চলে গেলো। মিষ্টি ফোনটা হাতে নিয়ে সময় দেখে নিলো। এরপর উঠে চলে গেলো কিচেনের দিকে।পেটে কিছু একটা দিতে নাহলে সে আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারবেনা। রান্নাঘরে গিয়ে মিষ্টি দেখলো সব গুছানো রয়েছে।বুঝলো এটা সেঁজুতির কাজ।
বিকেলে সেঁজুতি আসলে মিষ্টির সাথে দেখা করতে আসে।মিষ্টি তখন জানালার পাশ দাঁড়িয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিলো।সেঁজুতি এলেই তার সাথে গল্প জুড়ে দিলো। তার পনেরো মিনিট পর ইভান এসে হাজির। সে কোনদিক না চেয়ে শার্টের বোতাম খুলতে খুলতে মিষ্টিকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— এই মিষ্টি তাড়াতাড়ি আয়, আজ গরম আছি অনেক। ঠাণ্ডা কর।
সেঁজুতি নিচে বসে ছিলো,ইভানের কথা শুনে লজ্জায় পড়ে যায় সে। মিষ্টি অবশ্যই সেঁজুতির সামনে নিজেকে অপ্রস্তুত না করে বললো,
— ফ্যান ছেড়ে দে।
— ধূর,তুই আয়।
ইভান হঠাৎ চমকে গেলো কথাটা বলে।এইমাত্র সেঁজুতি দৌড়ে রুম থেকে হয়ে গেলো।সে স্তব্ধ হয়ে মিষ্টির দিকে চোখ বড় বড় করে তাকালো।
— আল্লাহ! ও এখানে আছে আগে বলবিনা?
দিলি তো আমার মানসম্মান ডুবিয়ে।
মিষ্টি মুখ থেকে হাত সরিয়ে হাসতে হাসতে নিচে বসে গেলো। এরকম কারো সামনে বলেনি ইভান।আজই প্রথম হয়েছে। বেচারা লজ্জায় মুখের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে ভুলে গেলো। মিষ্টি হাসি না থামিয়ে বললো,
— আয় ঠাণ্ডা হয়ে যা।
ইভান নাক ফুলিয়ে তোয়ালে হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে চলে গেলো। কি একটা মুড নিয়ে এসেছিলো। সব নষ্ট। পার্কের পাশের রাস্তা দিয়ে বাড়ি ফেরার পথে কয়েকটা খোলামেলা দৃশ্য দেখেছিলো ইভান।তাই সে ভেবেছিলো আজ বাসায় এসেই মিষ্টিকে জ্বালাবে। কিন্তু হলো উল্টোটা।ইভান নিজেই জ্বলতে লাগলো।
মিষ্টি উঠে গিয়ে কফি করে আনলো ইভানের জন্য। সাথে হালকা স্ন্যাকস।ওয়াশরুম থেকে উদাম গায়ে বের হলো ইভান। টি-শার্ট হাতে করে এনে মিষ্টিকে দিয়ে বললো,
— পড়িয়ে দে।
মিষ্টি ইভানকে ইশারা করলো বসতে। টি-শার্ট হাতে নিয়ে ইভানকে পড়িয়ে দিলো। টি-শার্ট পড়েই চমৎকার একটা হাসি উপহার দিলো মিষ্টিকে। মিষ্টি গালে হাত রেখে বললো,
— হায়, এভাবে যদি প্রতিদিন একটা করে হাসি আমাকে উপহার দিস,তাহলে আমি প্রতিদিনই তোরে কাপড়চোপড় পড়াই দিবো। এ টু জেড যা প্রতিদিন পড়িস সব পড়িয়ে দিবো।
ইভান একহাতে কফির মগটা হাতে নিলো। অন্য হাতে মিষ্টির মাথায় চাপড় মেরে বললো,
— বেশ অসভ্য কথা বলতে শিখে গিয়েছিস।
তা গালিটালি ভুলে গেছিস এখন? শুনতে পাইনা যে।
মিষ্টি ইভানের গালের পাশে জমে থাকা পানি মুছে দিয়ে বললো,
— অস্ত্র জমা দিয়েছি, ট্রেনিং ভুলিনি।প্রয়োজন পড়লে আবার ব্যাবহার করবো।
মিষ্টির কথায় ইভান হেসে ফেললো। মগটা রেখে দিয়ে মিষ্টির পাশে বসে বললো,
— আজ খুব মুড নিয়ে বাসায় এসেছিলাম।একদম হার্ড ফিলিংস নিয়ে।সব শেষ হয়ে গেলো।
— আচ্ছা আচ্ছা, মন খারাপ করিস না।
— শোন, একটা বাচ্চা দে আমাকে।
— এখন বাচ্চা কই পাবো? সময় লাগবে তো।
— লাগলে নে,যতো ইচ্ছে। পিল খাওয়া বন্ধ করে দেয় এখন থেকে।
— এটাতো অলরেডি বন্ধ। অনেকদিন ধরে।মনে নেই,গত ছয়মাস।
— স্টপ, মনে করিয়ে দিস না আর। কি একটা পাগলামি করেছিলাম দুজনে। অসহ্য!…
— হুম!
— ওয়ান সেকেন্ড,মিষ্টি তুই খেয়াল করেছিস আমরা এখন আর ঝগড়া করছিনা। আগের মতো।
— হ্যাঁ তাইতো।নাকি একদিন ছিলাম না বলে।
তুই তো আবার শুধু ঝগড়া করিস।
ইভান মিষ্টির গাল ধরে টেনে নিজের কাছে এনে বললো,
— আর করবো না রে,পাগলি।অনেক জ্বালিয়েছি।এবার আমার কোলে আমার বাচ্চাটা তুলে দে।তোকে আর একফোঁটাও জ্বালাবো না।
মিষ্টি বুঝলো ইভান এবারে বাচ্চার জন্য প্রচণ্ড ব্যাকুল হয়ে আছে। এবার বাঁধা দিলে মেরে তক্তা বানিয়ে দিবে শিউর। গতবার কি চড়টাই না খেতে হয়েছিলো পিল নেওয়ার কারণে।
মিষ্টি চাপা দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললো,
— ঠিকাছে এখন আমি প্রস্তুত,মানসিকভাবে এবং শারীরিক ভাবে।
— আল্লাহ! তাহলে তোকে এবারে রাজি করানো গেলো।আলহামদুলিল্লাহ!
মিষ্টি এগিয়ে এসে ইভানের গলা জড়িয়ে ধরে বুকে মাথা গুঁজে দিলো।শান্তি লাগছে এখন তার। এই বুকটা তার জন্য সারাজীবনের জন্য শান্তিপূর্ণ।
(চলবে)
___________
©তারিন জান্নাত