কাছেপিঠে পর্ব-২০+২১

0
738

~কাছেপিঠে~
পর্বসংখ্যাঃ২০

হাতে আর কোন কাজ উঠছে না রোকসানার।তারপরও অনেক কষ্টে পায়চারি করতে করতে চটজলদি দুপুরের রান্নাটা সেরে নিলেন। কাজ শেষ করে মিষ্টির ঘরে এসে দরজা খুলে ঢুকলেন। মিষ্টি তখন জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলো৷দরজা খোলার শব্দ শুনতেই উৎসুক দৃষ্টিতে পেছনে তাকালো।রোকসানাকে ফোন হাতে এগিয়ে আসতে দেখে ম্লান দৃষ্টিতে চেয়ে থাকলো। রোকসানা কপালের ঘাম মুছতে মুছতে ফোনটা মিষ্টির দিকে ফোনটা এগিয়ে দিলেন,দিতে দিতে বললেন,

— এই নে ফোন। ওই ছেলে ফোন দিয়েছে।আমাকে পুলিশের ভয় দেখাচ্ছে।শোন, অসভ্যটাকে এক্ষুনি ফোন দিয়ে বল যাতে এই গ্রামে পা না দেয়।তাহলে কিন্তু এখান থেকে আর প্রাণ নিয়ে যেতে পারবেনা।

— মা!

— মা! মা! করবিনা একদম।

অনেকটা চেঁচিয়ে উঠে বললেন কথাটা।হঠাৎ আবার রোকসানা চুপ হয়ে শান্ত রূপ ধারণ করলো।কিছুসময় পর নিজেকে শান্ত করে বললো,

— দেখ মা,প্রেমের সম্পর্ক হারাম।

— আমাদের বিয়ে হয়েছে তো মা।

— কিসের বিয়ে? তোরা আমাদের থেকে অনুমতি নিয়েছিলি?

— তোমরা অনমুতি-ই দিচ্ছিলে না।কিভাবে নিতাম?

— তো? অনুমতি দেয়নি বলে পালিয়ে বিয়ে করবি? এটার কোন বৈধতা আছে? আমরা তোকে জন্ম দিয়েছি,লালন-পালন করে বড় করেছি।আর দিনশেষে স্বার্থপর হলি কার জন্যে? ওই ছেলের জন্য? যার মা…

রোকসানা বলতে গিয়ে থেমে গেলেন। ইভানের মা-কে আগে থেকে চিনতো রোকসানা। মহিলাটার উপর প্রচণ্ড ক্ষিপ্ত আছেন রোকসানা। রোকসানাকে চুপ হতে দেখে মিষ্টি অসহায় গলায় বললো,

— মা,ইভানের মা কে টানছো কেন আমাদের মধ্যে।উনার সাথে আমাদের সে সম্পর্ক নেই। আর সব দোষ তো তোমাদেরই। আমার পছন্দটা মেনে নিলেই হয়ে যেতো। মেনে নাওনি, উল্টো আঁটকে রেখেছিলে।যখন পালিয়ে চলে গেলাম।তারপর তো আর খুঁজ নাওনি৷ একটা বছর অতিক্রম হওয়ার পর তোমার মনে হচ্ছে আমাদের আলাদা হয়ে যাওয়া দরকার? এই কাজটা আগে করতে পারলে না?

— আগে করিনি,তখন তোর উপর রাগ ছিলো। কিন্তু এখন তোর উপর আমার কোন রাগ নেই। শুধু তোর বাবা রেগে আছে।তাই আমি চাই তোদের বাবা-মেয়ের সম্পর্কটা যেনো আগের মতে হয়। ব্যস.

মিষ্টি তার ঠোঁটদুটো একত্রে চেপে ধরে কিছু একটা ভাবলো। উপায়হীন একটা পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে অকপটে বলে ফেললো,

— মা আমি প্রেগনেন্ট।

রোকসানা বিছানা ঝাড়ছিলো এতক্ষণ মিষ্টির সাথে কথা বলতে বলতে। কথাটা শুনেই বজ্রাহতর ন্যায় তাকালেন রোকসানা।চোখ বড়বড় করে চেয়ে বললো,

— কিহ? কি বলেছিস? ওই ছেলের সন্তান তোর গ…

রোকসানা আর কোন কথা বলতে পারলো না। হঠাৎ হুমায়রা চলে আসলো তার স্বামী, দেবর, সন্তানদের নিয়ে।রোকসানা ডাক পড়তেই ব্যস্ত পায়ে বেড়িয়ে যেতে যেতে মিষ্টির দিকে দৃষ্টি ছুঁড়ে বললো,

— আমার মেয়ে আর মেয়ের জামাই চলে এসেছে। দেখি তোর স্বামীর কতো সাহস। আর যদি তুই সত্যিই প্রেগনেন্ট হয়ে থাকিস তাহলে তাতে আমার কোন আপত্তি নেই।শোনে রাখ,বাচ্চাকে বাঁচাতে হলে বাচ্চার বাবাকে ত্যাগ করতে হবে।

রোকসানা নিজের কথাগুলো বলা শেষ করে তৎক্ষণাৎ ঘর ছাড়লেন।রাগ লাগছে রোকসানার।ছোট মেয়েটার উপর এতো পরিমান রাগ জমেছে যে না পারছে দূরে ঠেলে দিতে,না পারছে কাছে টেনে নিতে।তবে সংসারটা আর ওই ছেলের সাথে হতে দিবেন না তিনি।রোকসানার মনের নৃত্যনতুন ভাবনাটা হচ্ছে মিষ্টিকে ইভানের কাছ থেকে ছাড়িয়ে এনে একটা সুসম্পর্ক গড়বে পছন্দের কুটুমদের সাথে৷ পাড়ায় মহিলাদের খোঁচা আর সহ্য হয়না রোকসানার। প্রত্যেকে মেয়ের শশুড়বাড়ির তারিফ করতে করতে রোকসানার কানের পোকা বের করে ফেলেছে।অতিষ্ঠ হয়ে রোকসানা আজ এই পদক্ষেপটা নিয়েছে। যাতে এবার যেনো মহিলাগুলোর মুখের লাগাম টানতে পারে।

______

দুপুর দেড়টা। মিষ্টি গোসল, নামায সেরে চুপচাপ রুমের মধ্যে বসে থাকলো। দরজাটা সে আগেই বন্ধ করে রেখেছে। হুমায়রার এতোবার এসে ডাকলো তারপরও তাদের সাথে দেখা করেনি। চোখের পানি এখন আপাততে শুকিয়ে গেছে। মায়ের উচ্চস্বরে বলা কথাগুলো শুনেছে সে।তারপরও মিষ্টি কোন প্রতিক্রিয়া দেখাতে পারলো না। মাথায় অদৃশ্য এক যন্ত্রণা হচ্ছে মিষ্টির। সে চাইলে আজও পেছনের দরজার দিয়ে নিজের ব্যাগপত্র নিয়ে পালিয়ে যেতে পারে। কিন্তু পালিয়ে যাওয়ার মতো ভুল সে আর দ্বিতীয় বার করতে চাইছেনা। সিদ্ধান্ত ভালো-মন্দ যাই হোক না কেন এবার সে নিজে দাঁড়িয়ে মোকাবেলা করতে চায়।শুধু ইভানটা এখানে এসে কোন ঝামেলা না বাঁধায় সে দোয়াটা মনে মনে করতে লাগলো।

সবেমাত্র দুপুরের খাবার সেরে উঠে বসলো সবাই। ঠিক তখনি লোহার দরজায় সজোরে শব্দ হতে লাগলো। মতিউর মনে মনে চমকালেন একটু।এভাবে কখনো কেউ তাদের দরজায় আঘাত করে ডাকেনি। আজ এমন হওয়াতে শঙ্কিত হলেন ভেতরে ভেতরে।
হুমায়রার স্বামী আসাদ উঠে এসে দরজা খুলেন।দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলেন গ্রামের,মেম্বার,চেয়াম্যান,আর সর্দার। যাদের হাতে গ্রাম নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব রয়েছে। মতিউর উনাদের দেখে রেজওয়ানকে বললেন চা-পানির আয়োজন করতে। চেয়ারম্যান সাহেব সরাসরি বললেন,

— আমরা চা খেতে আসিনি মতিউর ভাই।

— তাহলে?

চেয়ারম্যান সঙ্গে আসা সঙ্গীদের দিকে চেয়ে বললেন,

— শুনলাম আপনার ছোটমেয়ে এসেছে।

মতিউর চোয়াল শক্ত হয়ে এলো কথাটা শুনেই। মতিউর গম্ভীর স্বরে বললেন,

— হুম!

চেয়ারম্যান সাহেব বসলেন।সাথে সাথে মেম্বার আর সর্দারও বসে পড়লেন। চেয়ারম্যান সাহেব বললেন,

—- ভাই মানলাম মেয়ে একটা ভুল করেছিলো।
এখন তো আর মেয়েটা আপনাদের নয়,অন্য একজনের স্ত্রী ও।

মতিউর পূর্বের ন্যায় কন্ঠে গম্ভীরতা ঢেলে বললেন,

— কি বলতে চাইছেন?

— বলতে চাইছি, আপনারা মেয়েকে আঁটকে রেখেছেন কেন?

মতিউর তখন আকাশ থেকে পড়লেন,এমন একটা অবস্থা। উনি জানেনই না কখন মিষ্টিকে আঁটকে রেখেছে।ছিঃ কতো অপমানজনক কথা।জীবনে আর কতো অপমানিত হতে হবে।নিজের মেয়েকে কে আঁটকে রাখবে। উল্টো চলে যেতে বলেছিলো। মতিউর বললেন,

— আমি বুঝতে পারছিনা আপনি কি বলছেন?। আমরা কেন মেয়েকে আঁটকে রাখতে যাবো।মেয়ে নিজ ইচ্ছেয় গিয়েছিলো,আর নিজ ইচ্ছেয় এসেছে। আবার চলেও যাবে তাতে আমাদের কোন হাত নেই।

মতিউরের কথা শেষ হতেই,মেম্বার সাহেব ফোনটা বের করে একটা রেকর্ডিং চালু করলো। রেকর্ডে ইভান এবং মিষ্টির মায়ের কথা স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। পর্দার আঁড়াল থেকে কথাগুলো শুনে মিষ্টির মা মাথায় হাত দিয়ে বসলো। এতোবড় বদমাইশ ছেলে। নূন্যতম সম্মান যদি এই ছেলের মধ্যে থাকতো তাহলে জীবনেও এমনটা একটা কাজ করতো না। হুমায়রা অবিশ্বাস্য চোখে মায়ের দিকে তাকালো।বললো,

— মা,দুনিয়ার সব প্যাঁচ এখানে লাগিয়ে তুমি এখন মাথায় হাত দিচ্ছো? আশ্চর্য! এটা কি করলে?

রোকসানা দাঁতের সাথে দাঁত চিপে বললো,

— তুই অন্তত এবার নিজের বোনের হয়ে আর কথা বলিস না দয়া করে।এবার আমাকে সব দেখতে দে।পরিস্থিতি সামলানোর দায় আমার। যাই হোক, আমি মিষ্টিকে আর যেতে দিবোনা। আমি আজ পর্যন্ত ওই ছেলের কাছ থেকে একফোঁটা সম্মান পায়নি।আজও আমায় অপমান করলো।দেখিস,এই ছেলের জীবনেও ভালো হবেনা।

হুমায়রা বিরক্ত চোখে তাঁকালো। মায়ের এই উগ্র স্বভাবটা মাঝেমাঝে বিরক্ত লাগতো হুমায়রার। কেউ কিছু বুঝাতে চাইলে বুঝতে চায়না।অথচ,নিজে নিজেই সবসময় সবটা বুঝে আসে। আর মায়ের মাথার উপর ছাতা হিসেবে যে ভাইদুটো আছে, তারা তো বোনের একডাকে ছুটে আসবে।সন্ত্রাসী করতে। আল্লাহ।

হুমায়রা তড়িৎ গতিতে মিষ্টির ঘরের কাছে আসলো।দরজা আধখোলা ছিলো।ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করে দেখলো মিষ্টি হাসিমাখা মুখে ব্যাগে কাপড় রাখছে। হুমায়রা নিজের ফোনটা মিষ্টির হাতে দিয়ে বললো,

— এখনো হাসার মতো কিছু হয়নি।পরিস্থিতি এখনো বিগড়ানো। তুই জলদি ইভানকে ফোন দিয়ে বল চলে যেতে। আমাদের শান্তশিষ্ট মাকে তো চিনিস? কিভাবে একডাকে ভাইদের হাজির করে।আমি চাইনা এবারও ইভানের কিছু হোক।তোরা দুজনেই আমার ভাই-বোন।তোদের খারাপ আমি কখনো চাইবোনা।

মিষ্টি নির্বাক হয়ে ফোনটা হাতে তুলে নিলো। ফোন দিবে কি দিবেনা দ্বিধায় পড়লো।
_____

মতিউর অনেক উত্তেজিত হয়ে উঠলেন।রাগের তাড়নায় পৃথিবী উল্টে দিতে মন চাচ্ছে। এমন একটা ঘটনা এবার চেয়াম্যান,আর মেম্বারদের কানে চলে গেলো। ঘরের অবশিষ্ট সম্মানটাও মনে হয় এবার মাটিতে মিলিয়ে যাবে।কি দরকার ছিলো এসব বলে কথা বাড়ানোর।মিষ্টিকে তো চলে যেতে বলেছিলো।এতো মারের পর মিষ্টির থাকার কথাও না।কেন যে আঁটকাতে গেলো। আরো আধঘন্টা মতো মতিউর কথাবার্তা বললেন চেয়ারম্যান, মেম্বারদের সাথে। কথা যেহেতু মিষ্টিকে না দেওয়ার থেকে শুরু হলো।বউয়ের সম্মান এবং নিজের অবশিষ্ট সম্মান রক্ষার্থে মতিউর বললেন,

— আমিই বলেছিলাম মেয়ের মাকে এসব বলতে।মেয়ে আমার এখানে চলে এসেছে।আর যেতে চাইছেনা।

সর্দার বললেন,

— কিন্তু আপনাদের জামাই তো বলছেন অন্যকথা।সকল প্রমাণ ও আমাদের হাতে দিয়ে দিয়েছেন উনি। তাদের মধ্যে কোন মনোমালিন্যের সম্পর্ক নেই।আপনারাই মেয়েকে শুধু শুধু আঁটকে রাখতে চাইছেন।

মতিউর মুখ ফুটে বলতেই পারলেন না যে,মেয়েকে সে নয়,মেয়ের মা আঁটকে রাখছে।কিছুসময়ের তর্কের মধ্যে রোকসানার ছোট ভাইরা হাজির হন।পাশের এলাকার জমিদারের বংশধর তারা।বাপ-দাদাদের হাতে যা ছিলো জমিদারি। কিন্তু ছেলেরা হয়েছে একেকটা জল্লাদ, সন্ত্রাস। তাদের দেখেই চেয়ারম্যান দাঁড়িয়ে গেলো।সালাম দিয়ে,মিষ্টির বাবাকে বললো,

— আগামীকাল সকাল দশটায় গ্রামের মুরুব্বি দের নিয়ে একটা বৈঠক হবে।চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত তখনই জানানো হবে।

মতিউরের বুকে ব্যাথা উঠতে লাগলো ধীরে ধীরে। শেষমেশ বৈঠক।কেমন বৈঠক? যে বৈঠকে মেয়ের কীর্তি কলাপ নিয়ে আলোচনা হবে, মেয়ে পালিয়ে গিয়ে ফেরত এসেছে এসব কথা হবে? নাকি আঁটকে রেখেছে এই কথা হবে। রোকসানার দুইভাই সোফায় বসতেই মতিউর বুকের মাঝখানে হাত রেখে দৃঢ়কণ্ঠে বললেন,

— ওই ছেলে এই গ্রামেই আছে। যেখানে যেভাবে পাও, সেভাবে সেখানেই মেরে পুঁতে দিয়ে এসো। মনে রাখবে, এ খবর যেনো বাইরে না যায়।তাহলে তোমাদের পুঁতে দিতে সময় লাগবে না আমার।

এবার মজার ছলে মতিউরের একদম ছোট শ্যালক রফিক বলেই ফেললো,

— দুলাভাই, মারতে বলেন আপনি,আর দোষ গিয়ে পড়ে আমার বোনের ঘাঁড়ে।

__________

ইভান সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠলো। দুপুর চেয়ারম্যানকে সব কথা বুঝাতে বুঝাতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলো সে। এখন আপাততে রিল্যাক্সে আছে।
প্রথম স্টেপে সে পুলিশদের বাদ রেখে চেয়াম্যান,আর মেম্বারদের টার্গেট করলো। তাদের দিয়ে ভালোভাবে সবকিছু ঘাঁটানোর জন্য এক্সট্রা টাকাও দিতে হয়েছিলো ইভানের।টাকা যাওয়ার, যাচ্ছে যাক।অন্তত বউটা ফেরত আসুক।প্রত্যাশায় প্রথম পদক্ষেপটা নিয়েছিলো ইভান। ঘুম ঘুম চোখে উঠে বসলো সে। আশেপাশে তাকিয়ে দেখলো ঘুটঘুটে অন্ধকার। মোমবাতি প্রায় নিভু নিভু।ইভান ফোনটা হাতে নিয়ে সময় দেখলো। রাত নয়টা সাতচল্লিশ। এতক্ষণে তো মিষ্টির চলে আসার কথা। নাকি তার বাপ-মা এখনো ঘুমায়নি। ইভান উঠে বসলো। একটা নিরাপদ স্থানে আছে সে। মিষ্টির পুরাতন দাদার বাড়িতে। কেউ ধারণাও করতে পারবেনা ইভানের উপস্থিতি। মিষ্টি কখন যেনো ফোনের মাধ্যমে বার্তা পাঠিয়ে দিলো ইভানকে। এরপর জানালো,সুযোগ বুঝে চলে আসবে এখানে। ইভান অপেক্ষা করতে লাগলো।
রাত এগারোটার দিকে দরজায় ছোট ছোট শব্দ হলেই তড়িৎ গতিতে উঠে গিয়ে দরজা খুললো ইভান।মিষ্টি তখন আস্তো কালো বোরখার আবরণে ঢাকা। মিষ্টিকে দেখেই শান্তির নিঃশ্বাস ছাঁড়লো ইভান। মিষ্টির হাতটা ধরে টেনে ভেতরে নিয়ে এলো।দরজা আঁটকে দিয়ে মিষ্টির মাথার কাপড়টা টেনে ফেলে দিলো। বোরখা ধরে টানতে লাগলো। মিষ্টি ইভানকে থামিয়ে দিতে দিতে বললো,

— অপেক্ষা কর, আমিই খুলছি।

ইভান দৃষ্টি তখন মিষ্টির শরীরের দিকে। গম্ভীর চোখে দৃঢ়ভাবে চেয়ে চেয়ে আঘাতের পরিমাণটা অনুভব করতে চাইলো। ইভানের হাতটা সরিয়ে দিয়েও মিষ্টি বোরখা খুললো না।উল্টো মাথার কাপড়টা পূনরায় দিয়ে বললো,

— তোর জন্য খাবার এনেছি।

মিষ্টি টিপিন বক্সটা সাইডে রেখে বললো,

— তুই অপেক্ষা কর…

ইভান বক্সটা হাতে নিয়ে পাশে রেখে দিলো। মিষ্টির দিকে চেয়ে বললো,

— খাবার আনতে বলিনি।তোকে আসতে বলেছিলাম।

— এসেছি তো।

— এসেছিস,তোর উচিত ছিলো আমাকে দরজায় দাঁড়িয়েই জড়িয়ে ধরা। তুই খাবার অফার করছিস।

— আজগুবি কথা। তোর ক্ষুধা পায়নি।

মার খেয়ে মাথা খারাপ হয়ে যাওয়া মিষ্টির কথার উত্তর দিলো না ইভান। প্রায় উন্মাদের মতো চেপে ধরলো মিষ্টিকে।পরমুহূর্তটা অনেক কষ্টে কাটলো মিষ্টির।শরীরে প্রচণ্ড ব্যাথা তারপর ইভানের এভাবে জড়িয়ে ধরাতেই ব্যাথাটা দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। এতো রুডলি ধরেছে যেনো দুনিয়ার সবার উপরের রাগটা তার উপর মেটাচ্ছে। পাষাণ।
মিষ্টি কোনমতে বললো,

— ছাড়বি? আমি সত্যিই চলে যাবো এরপর।
আমার কষ্ট হচ্ছে।

ইভান সাথে সাথে ছেড়ে দিলো।সর্বশেষ চুম্বনটা কপালে এঁকে দিয়ে বললো,

— চল এখনি চলে যায় আমরা?

— গতবার ভয় পেয়ে পালিয়েছিলাম।এবার পালাতে চাই না।প্লিজ আমাকে মেন্টালি সাপোর্ট দে। উল্টাপাল্টা কথা বলে আমাকে আমার প্রেসার বাড়িয়ে দিস না।

— তাহলে,আজ যেতে পারবিনা।কাল সকালে একেবারে একসাথে চেয়ারম্যানের বাড়িতে যাবো।

— ঝামেলাটা অনেক বড় রূপ ধারণ করেছে রে।আমি এসেছি হুট করে একদিনের জন্য,অথচ কি হয়ে গেলো। আমি বুঝতেই পারছিনা আসলে আমার সাথে কি হচ্ছে? কিসের ভিত্তিতে হচ্ছে।

— একদম ভিত্তিহীন।আমার বউ, এসেছে একদিনের জন্য।অসুস্থ বাবাকে সুস্থ করতে।সেখানে শুধু শুধু আমার বউকে আঁটকে রাখলো। কারণ কি? এসেছে,থেকেছে,তারপর আবার চলে যাবে।

মিষ্টি ইভানের গালে হালকাভাবে চড় দিয়ে বললো,

— তোর বউ হওয়ার আগে আমি তাদের মেয়ে।
আর তাদের মেয়ে হয়েও তোরজন্য মরছি।খারাপ তো তাদের লাগবেই…

হঠাৎ দরজায় ধড়াম ধড়াম শব্দ হতে লাগলো। বাইরে থেকে কেউ যেনো হিংস্রভাবে তাদের আক্রমন করার অপেক্ষায় আছে। মিষ্টি আতঙ্কিত হয়ে ইভানের দিকে তাকালো।ইভান নিজেও ভেবে পেলো না কোন আপদ তাদের এই টাইমে এসে বিরক্ত করছে…

(চলবে)
________
©তারিন জান্নাত।

~কাছেপিঠে~
পর্বসংখ্যাঃ২১

ইভান মিষ্টিকে ছাড়িয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালেই মিষ্টি ইভানের হাতটা আঁকড়ে ধরে ফেলে। মিষ্টির বেদনা মিশ্রিত চোখে ভয়ের রেশ।ভয় তো হবেই। দুজনে যে ভুলভাবে দুজনের সাথে সম্পর্ক জুড়ে দিয়েছে। ইভান চাপা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললো।নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিতে বললো,

— হাত ছাড়।

— না, প্লিজ এখন আপাততে এখানে থাকি।
দরজা পরে খুললে হবে।

— পরে না।এখনি খুলবো। কপালে যা
থাকবে তাই হবে।

মিষ্টি ইভানের হাতটা শক্তভাবে ধরে বললো,

— ওরা তোকে আবারও মারবে ইভু। হয়তো গতবারের তুলনায় আরো বেশি?

ইভানের ধৈর্যটা এবার ভেঙে পড়লো। সে পুরোপুরি মার খাওয়ার নয়,মার দেওয়ার প্রস্তুতি নিয়েই এখানে এসেছিলো।গতবার তার যেকোন উপায় মিষ্টিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য মারটা খেয়েছিলো। তখন তাদের সম্পর্কটা নড়বড়ে ছিলো।আজ তারা সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী। আজ একফোঁটা ভয়ও ইভানের মনে এসে বাসা বাঁধলো না।শুধু কর্কশ গলায় নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,

— মারলে মারবে।আমি মরলে তুই বিধবা হতে পারবি।এবং নিশ্চিন্তে তোর বাপ-মায়ের কাছে চলে যেতে পারবি৷সো,ছাড় এখন…

বলতে না বলতে হাতটা ছাড়িয়ে নিলো ইভান। আশেপাশে তাকিয়ে চকির পেছনে ফাঁকা জায়গা দেখলো। মিষ্টির বাহু শক্ত করে ধরে ঠেলেঠুলে চকির পেছনে পাঠিয়ে দিলো। মিষ্টি দুদিকে মাথা নেড়ে বেরিয়ে আসতে গেলেই,ইভান ফট করে একটা চড় বসিয়ে মিষ্টির গালে। চড় জোরে মেরেছে কিনা জানা নেই ইভানের।কিন্তু গালে হাত দিয়ে ততক্ষণে পেছনে চলে গেলো।চুপচাপ বসে রইলো নির্বাক দৃষ্টি নিয়ে। ইভান ভালোভাবে মিষ্টিকে কাপড়ের ব্যাগ দিয়ে আঁড়াল করে দিলো। হাত ভালোভাবে ঝেড়ে পরিষ্কার করলো ইভান। দরজা খুলতেই হুড়মুড়িয়ে দুই তিন জন লোক প্রবেশ করলো ভেতরে। প্রত্যেকের হাতে লাঠি। লাঠি দেখে ইভানের গা জ্বলে উঠলো।গতবার লাঠির মার খেয়ে অবস্থা খুব খারাপ হয়েছিলো।অনেক দিন ব্যথার জ্বালায় ছটফট করেছে। রাগের তোড়ে মিষ্টিকেও কম জ্বালায়নি সে।

শার্টের হাতা ফোল্ড করলো ইভান। আশেপাশে কয়েকজন পুলিশ কনস্টেবল রেখেছিলো সে যারা তাকে এদের হাত থেকে রক্ষা করতে পারবে। ইভান বেশি হলে দুজন বা একজন কে কিল-ঘুষি, থাপ্পড় মারতে পারে।যদি তিনজনে মিলে তাকে লাঠি দিয়ে একনাগাড়ে মারে? তখন সে কি করবে? সে তো আর সিনেমার হিরো না। ইভান নিজের নিরাপত্তার কথা ভেবে কয়েকজন কনস্টেবল কে টাকা দিয়ে এখানে রেখেছে।

মিষ্টির দুইমামা,আর সাথে একজন এলাকার সন্ত্রাস। মিলে এসেছে ইভানকে মারতে। মিষ্টির বাবা মোটা অংকের টাকা তাদের হাতে গুঁজে দেওয়ার প্রতিস্রুতি দিয়েছে।এখন এই ছেলেটাকে মারতে মারতে লাশ করে দিতে পারলেই তাদের আশা সফল হবে। ভাবনার তোড়ে যেই হাত উঁচিয়ে লাঠি তুললো ইভানকে আঘাত করতে। ইভান লাঠিটা ধরে ফেললো। পাশ থেকে একজন আঘাতটা করেই ফেললো। একদম পিঠ বরাবর মেরেছে।ব্যাথায় শরীর জ্বলে উঠলো ইভানের। অস্বাভাবিক ব্যাথাটা কোনমতে গিলে ফেললো শব্দহীনভাবে । আর বেশি ঝামেলা পোহাতে হয়নি ইভানকে, পুলিশ কনস্টেবল চার জন এগিয়ে এলো মিষ্টির মামাদের আর সঙ্গে থাকা সন্ত্রাসকে আঁটকাতে। পুলিশ দেখে তারা কেউ ভয় পায়না। মিষ্টির বড়মামা বললো,

— পুলিশ তো আমাদের হাতের মোয়া।টাকা খাওয়ালেই হয়।

ইভান দাঁতের সাথে দাঁত চেপে বললো,

— তাহলে যান। আপনাদের হাতের মোয়াদের সাথে করে নিয়ে গিয়ে স্থানীয় থানায় গিয়ে হাওয়া খান। তারপর আমি আপনাদের কোর্টে চালান করার ব্যবস্থা করছি।

পুলিশ তাদের টেনেটুনে নিয়ে গেলো।আশেপাশে তেমন কেউ কোন সাড়াশব্দ পেলোনা।বেশ খারাপ পরিস্থিতির সৃষ্টিও হলো না।যা হওয়ার সব কালকে হবে। ইভান দরজাটা আঁটকে চকির কাছে এসে মিষ্টিকে টেনে বের করলো। গরমে মিষ্টি তখন ঘেমে-নেয়ে একাকার। চুলের খোঁপা খুলে দেখতে একেবারে এলোমেলো পাগলী লাগছিলো। ইভান দেখেই হেসে ফেললো। তারপর মিষ্টিকে বসিয়ে দিলো। এরপর সেও মিষ্টির পাশ ঘেঁষে বসলো। মিষ্টির ওরনাটা হাতে নিয়ে ইভান ঘাম মুছে দিতে দিতে বললো,

— তোর কি মনে হয়? কাল বিচারে আমরা জিতবো?

— জানিনা। আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।
এখানে বৈঠক হওয়ার কোন দরকার ও তো দেখছি। না দেওয়ার হলে সাফ জানিয়ে দিবে,আর দেওয়ার হলে তাও জানিয়ে দিবে।

মিষ্টির কাঁধে মাথা রাখলো ইভান। হাতটা বাড়িয়ে মিষ্টির পিঠ অতিক্রম করে একদম পেটে রাখলো। এভাবে পেটে হাত রাখায় লাফিয়ে উঠলো মিষ্টি। তীক্ষ্ণ কন্ঠে বললো,

— হাত সরা বেয়াদব।

ইভান হাত সরালোনা৷ত্যাড়ামি করে আরো শক্তভাবে খামচে ধরলো মিষ্টিকে। বললো,

— ইম্যাজিন, কাল কোনভাবে চেয়ারম্যান,তোদের এলাকার মুরব্বিরা মিলে তোকে চিরতরে এখানে রেখে দেওয়ার সিদ্ধান্ত আমাকে জানালো। তখন কি করবি?

মিষ্টি কিছুক্ষণ চুপ থেকে কিছু ভাবলো। তার মনে একটা স্বার্থপর উত্তর আসলো এ কথার। যে উত্তরটা দেওয়ার সাহস এই মুহূর্তে মিষ্টির নেই।সবচেয়ে বড় কথা এখন ইভানের হাতের তলায় লেপ্টে আছে সে। এদিক-ওদিক কিছু বললেই অসভ্যটা রাগে কি করে বসে। তাই মিষ্টি চুপ থাকলো। ইভান মাথা তুললো।আচমকা মিষ্টিকে ধাক্কা দিয়ে চকিতে শুয়ে দিলো। শক্ত চকিতে শুধু কাঁথা বিছানো ছিলো। শক্ত জায়গায় শোয়ার অভ্যাস নেই মিষ্টির।ফলে পিঠে ব্যাথা অনুভব হলো তার। ইভান মিষ্টির পাশে শুয়ে পড়লো। টিনের চাউনির দিকে দৃষ্টি রেখে বললো,

— কেমন যেন ক্লান্ত হয়ে গেছি মিষ্টি।এতসব প্যাঁচাল আর ভালো লাগছেনা। দুজন মানুষ একসাথে থাকতে চাইছে অথচ দুনিয়ার সব মানুষের তাতে আপত্তি।কই ছয়মাস যখন আমরা আলাদা ছিলাম।তখন তো কেউ আসেনি। মানুষ এমন কেন?

ইভানের কথায় মিষ্টি ইমোশনাল হয়ে গেলো। ইভানের পেটের উপর হাত রেখে তাকে জড়িয়ে ধরলো। ইভানের গালে আলতো করে কয়েকটা চুমু দিলো। যাতে ইভানের নিজেকে একা অনুভব না হয়।ইভান বরাবরেই রিটার্ন গিফটা মিষ্টিকে মনে রাখার মতো দেয়।এবারও তাই। ইভান উঠে বললো,

— ডিসিশন ফাইনাল। তোকে রেখে দিতে চাইলে থেকে যাবি।আর যেতে দিলে আমার সাথে যাবি। বাট,নাউ, আই নিড ইউ ক্লোজলি।

মিষ্টি ইভানের কথায় অস্থির হয়ে গেলো।বারবার বাঁধা দিতে দিতে বললো,

— দেখ! আমি থাকবোনা এখানে।আমি তোর কাছে থাকবো। তুই যেভাবে পারিস সেভাবে নিয়ে যাবি। শালা-হারামি আমার কথা না শুনে…

_______

বেলা দশটা। উঠোনে গাছের ছায়াতলে চেয়ার রাখা হয়েছে বসার জন্য। সেখানে বসে মতিউর চা পান করছিলেন। অপেক্ষা করছিলো চেয়ারম্যান ভাইসাহেবের জন্য।রোকসানা সকাল থেকে মিষ্টির সাথে কর্কশ গলায় কথা বলছে,ধমকাচ্ছে। কিছু হলেই হুমায়রার সামনে মিষ্টিকে ইঙ্গিত করে কথা শোনাচ্ছে। দোষ,গতকাল রাতে মিষ্টি যখন ফিরলো তখন হাতেনাতে রোকসানার কাছে ধরা পড়ে গেলো । রাত বলে রোকসানা কিছু বলেনি।কিন্তু সকালে উঠেই তিরিক্ষি হয়ে সব কিছুতে মিষ্টির উপর রাগ ঝাড়ছেন। মিষ্টি অসহায় হয়ে শুধু চেয়ে আছে তার মুখের দিকে।এ মুহূর্তে ইভানের মা আর তার মার মধ্যে একটুও পার্থক্য খুঁজে পেলো না মিষ্টি। কি একটা কাণ্ড হচ্ছে তার সাথে। তার স্বামী-সংসারে স্বাধীনভাবে ফিরে যাওয়ার অধিকার তার নেই।

মতিউর ভেবেছিলো চেয়ারম্যান সাহেব সবাইকে নিয়ে বাড়িতে আসবেন।কিন্তু ভাবনায় জল ঢেলে দিয়ে চেয়ারম্যান মতিউরকে তাদের বাড়িতেই ডেকেছেন। মূলত,মিষ্টিদের বাড়িতে যাওয়ার সমস্যাটা ইভানের।ইভান চায়না মিষ্টিদের বাড়িতে যেতে। যে বাড়ির সদস্য তাকে বাড়িত ছোটকন্যার স্বামী স্বীকার করতে নারাজ,সে বাড়ির চৌকাটে পা রাখার কোন প্রশ্নই ওঠে না। ইভান সকালের নাস্তাটা সেরে চেয়ারম্যানের বাড়িতে আসলো। হাতভর্তি ছিলো নাস্তার প্যাকেট।তাতে চেয়ারম্যান সাহেব খুশী হলেন।
ইভানকে আলাদাভাবে খাতির যত্ন করতে লাগলো। বাকিরা আসার পূর্বে হাজার পাঁচ মতো টাকা ইভান চেয়ারম্যানের হাতে গুঁজে দিয়ে বললেন,

— আপনার বাকি পাওনা।আশা করি কাজটা হবে।

চেয়ারম্যান সাহেবের চোখেমুখে চওড়া হাসি। ইভানের কথাবার্তা বেশ পছন্দ হয়েছে উনার।উনি হেসে বললেন,

— তুমি নিশ্চিন্তে থাকো।তোমার বউকে তুমি ফিরে পাবে।

ইভান ছোট করে হাসলো। অপেক্ষা করতে লাগলো বাকিদর আশায়। সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করে লিভিংরুমে আয়েশ করে ইভানকে বসে থাকতে থেকে রাগে পিত্তি জ্বলে উঠলো মতিউরের।উনার ভাবনাটা ছিলো এমন যে,ইভান এতক্ষণে হয়তো মার খেয়ে এলাকা ছেড়েছে। মতিউরকে দেখেও ভ্রুক্ষেপহীন হয়ে বসে থাকলো ইভান।মতিউর এসে সামনের সোফায় ইভানের মুখোমুখি বসলো।রোকসামা,হুমায়রা আর মিষ্টিকে ইশারা করলো ভেতরে গিয়ে বসতে।কিছু জানার থাকলে তাদের অবশ্যই ডাকবে।তারা চুপচাপ চলে।ইভান চেয়েছিলো মিষ্টির দিকে একবার তাকাতে,তার আগে তারা ভেতরের কক্ষে চলে গেলো।কক্ষটা লিভিংরুমের পাশেই। চেয়ারম্যান সাহেব কাজের ছেলেটাকে সবার জন্য চা-পানির ব্যাবস্থা করতে বললেন।

চেয়ারম্যান সাহেব মতিউরকে বললেন,

— মতিউর ভাই। আপনি অনেক ভালো মনের একজন মানুষ।অনেক বুঝদার একজন ব্যাক্তি।তারপরও মেয়েকে আঁটকে রেখেছেন কেন?

মতিউর গলা খাঁকারি দিয়ে বললেন,

— আটকে রাখিনি মেয়ে যেতে চাইছেনা। কারণ সে অনেক অত্যাচারিত হচ্ছে।মেয়ে নিজের মুখে সব বলেছে।

চেয়ারম্যান অবাক হয়ে ইভানের দিকে তাকালো। ইভানের দৃষ্টি তখন কঠিন।মুখভাব দেখে বুঝা যাচ্ছে কথা সত্য নয়। চেয়ারম্যান সাহেব মিষ্টিকে ডাকলেন।মিষ্টির সাথে কথা বলে উনি নিশ্চিত হতে চান। সমস্যটা বেশ গণ্ডগোলের। বুঝা যাচ্ছে। দেখা যাক,কে জিতে? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, বাবা-মেয়ের সম্পর্ক? নাকি দুজন পুরুষের তীব্র অহমিকা।

হুমায়রা প্রচণ্ড বিরক্ত হলো তার বাবার কথা শুনে। সহজসরল একটা বিষয়ে ঘোলাটে করে মানসম্মান হারানোর পঁয়তারা মতিউরের বোধগম্য হচ্ছেনা।নিজের করা গর্তে নিজেই পা পিছলে পরবে সেটা খেয়াল করছেন না। কি হয় তাদের সম্পর্কটা মেনে নিলে।তবে হুমায়রা মনস্থির করে ফেললো।যে করেই হোক আজকে মিষ্টিকে ইভানের সাথে পাঠিয়ে দিবে। তার বাবা এখনো ক্ষোভের মধ্যে ডুবে আছে।ইভানের উপর রাগ,আর তীব্র বিতৃষ্ণাটা এখনো বিরাজমান।ভুল একটায়,তাঁর ছোট মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়াটা।

চেয়ারম্যান সাহেব ডাকলো মিষ্টিকে। মিষ্টিকে সাথে করে নিয়ে হুমায়রা ড্রয়িং রুমে আসলো। তাদের পেছনে এগিয়ে আসলো রোকসানা।চেয়ারম্যান সাহেব কথার প্যাঁচে না জড়ানোর জন্য সোজাভাবে জিজ্ঞেস করলো মিষ্টিকে,

— মিষ্টি মা! তোমার স্বামী কি সত্যিই তোমাকে অত্যাচার করে? আর করলেও বা তার ধরণ কেমন আমাকে বলো তো একটু।আমি সমাধানে আসতে চাইছি।

মতিউরের বিশ্বাস ছিলো মিষ্টি হয়তো তার কাছে ক্ষমা পাওয়ার জন্য মিথ্যােটা সায় দিবে। এই আত্মবিশ্বাসটা এসেছিলো এতো মারার পরও মিষ্টি একটা অভিযোগ করলো না।মতিউর সাহেব এটা জানেন না যে মিষ্টিকে রোকসানা যেতে দেয়নি। মতিউর হাস্যজ্বল মুখে চেয়ে আছে মিষ্টির মুখে দিকে।মিষ্টির উপর ইভানের পুরোপুরি বিশ্বাস থাকলেও,এ পর্যায়ে এসে ইভানের ভেতরটা কেঁপে উঠলো। দুর্ভাগ্যবশত মিষ্টি যদি মিথ্যা বলে তার বাবার জন্য।

কিন্তু বাবা আর স্বামীর মুখের দিকে চেয়ে মিষ্টি অস্থির হয়ে গেলো। সবার সামনে তার বাবাকে ছোট করতে চাইছেনা। এদিকে ইভানের ক্ষীণ শান্ত ভয়ার্ত মুখটাও তার সহ্য হচ্ছেনা।অতঃপর সব মিথ্যের সাথে সেও কৌশলে একটা মিথ্যে কাহিনী সাজিয়ে ফেললো,

— চাচা, আমি আসলে গত কয়েকদিন ধরে খুব বেশি অসুস্থ ছিলাম।আর আমার স্বামী ইভান একটা কাজে আমাকে না বলে কক্সবাজার চলে গিয়েছিলো।রাগের তোড়ে আমিও ইভানকে না জানিয়ে এখানে চলে এসেছিলাম।আর বাবাকে বলে ফেলেছি ইভান আমাকে অত্যাচার করে। আর বাবাও আমার মিথ্যােটা বিশ্বাস করে নিলো।এখন বুঝতে পারছি আমার মিথ্যে বলাটা উচিত হয়নি। এদিকে ইভান বাসায় এসে আমাকে না পেয়ে এখানে চলে আসলো। ভেবেছিলো আমাদের এখান থেকে কেউ আমাকে যেতে দিচ্ছেনা৷

মিষ্টির এমন স্পষ্ট মিথ্যে কথায় ভ্যাঁবাচ্যাঁকা খেয়ে গেলো রোকসানা। মিথ্যে বলে মিষ্টিকে তো সে-ই এনেছে এখানে। এতো সব মিথ্যের জালে জড়িয়ে আক্কেলগুড়ুম হয়ে গেলো রোকসানা।এরপর কি হবে সেটাই ভেবে পেলোনা।মতিউর হতবাক চাহনিতে চেয়ে থাকলো মিষ্টির দিকে। কেমন করে একটা কথা উভয়দিক দিয়ে সমাধানের ন্যায় বলে ফেললো?ইভান ঠোঁট চেপে নিজের হাসিটা আঁটকালো। শশুড়ের মুখের অবস্থা দেখে তার হাসি পাচ্ছে খুব।
চেয়ারম্যান সাহেব সবকিছু আঁচ করতে পেরেছেন। তাদের এলাকার কোন বিচারসভা এভাবে পালন হয়না।আরো কঠিনভাবে আলোচনা করে বিচার করেন তিনি। কিন্তু এখানে ইভান সব আগেভাগে জানিয়ে দিয়েছিলো তাঁকে।পরে সব শুনে চেয়ারম্যান সাহেব বুঝলেন এটা একটা পারিবারিক সমস্যা। এখানে তাদের কোন পরামর্শ কাটবেনা।যদি না মতিউর সাহেব নিজ উদ্যোগে ইভানকে গ্রহণ না করেন। তাই তিনি পাড়াপড়শির কানে এসব কথাবার্তা না পৌঁছানোর জন্য।তাতে ইভানের কড়াভাবে নিষিদ্ধ রয়েছে।
চেয়ারম্যান সাহেব হালকা কেশে মতিউর সাহেব কে বললেন,

— মতিউর ভাই,দেখছেনই তো সম্পূর্ণ বিষয়টা মিষ্টির ভুল বুঝার কারণে হয়েছে। আপনি মেয়েকে তার সংসারে পাঠানোর বন্দোবস্ত করে দিন।

রাগের তোড়ে মতিউর একটা কথা বলতে পারলেন না।শুধু স্মিত হাসলো চেয়ার সাহেবের দিকে চেয়ে। বসা থেকে উঠে তীক্ষ্ণ চোখে ইভানের দিকে এক নজর চেয়ে বেরিয়ে পড়লো চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি থেকে। বাড়ির বাইরে এসে ফোন বের করে রোকসানার ফোনে ফোন দিলেন। মতিউরকে বের হতে দেখে রোকসানাও হুমায়রাকে ইশারাকে বের হতে যাচ্ছিলো।তার আগে ফোনটা বেজে উঠলো। বহুদিন পর স্বামীর ফোন নিজের ফোনে পেয়ে আশ্চর্য হলেন রোকসানা। চটজলদি ফোনটা ধরে কানে টেকালো। মতিউর তীব্র রাগান্বিত স্বরে বললো,

— তোমার মেয়েকে বলো আর যেনো আমার বাড়ির চৌকাটে পা না রাখে। এবারে যেনো শেষবারের মতো চলে যায় এখান থেকে।আমি ওকে সারাজীবনের তাজ্য করলাম।সে যেনো ওই অসভ্য ছেলেটার সাথে চলে যায়।

বলেই ফোনটা রেখে দিলো মতিউর। তার এমন মেয়ের দরকার নেই।যে মেয়ে বাবা-মায়ের অনুগত নয়,সে মেয়েকে মেয়ে বলে স্বীকার করা অনর্থক।

রোকসানার চোখ ভিজে উঠলো। উপায়হীন হয়ে কথা মিষ্টিকে তার বাবার কথাটা বলেই ফেললেন তিনি।মৃদু আওয়াজে মায়ের বলা কথাগুলো শুনে বুকের ভেতর ধাক্কা লাগলো মিষ্টির। নিঃশব্দে চোখের অস্রু গড়িয়ে পড়লো তার।রোকসানা চলে গেলে হুমায়রা মিষ্টিকে নিয়ে বাড়ির বাইরে চলে আসে। ইভান হাসিমুখে চেয়ারম্যান সাহেবের থেকে বিদায় নিয়ে চলে আসলো। অবশেষে, মিষ্টিকে নিয়ে যেতে পারবে।এবার আর মার খেয়ে পালাতে হবেনা। একদম নির্ভয়ে যাওয়া যাবে। আহা!

মিষ্টি আর ইভানকে গাড়িতে তুলে দিয়েই হুমায়রা নিজের বাড়ির পথে রওনা দিলো। ভালোবাসার মানুষকে না পাওয়ার যন্ত্রণাটা তারচেয়ে বেশি কেউ বুঝবেনা। নিজের বাবা- মাও না।তার ও তো একটা ভালোবাসার মানুষ ছিলো। তার সাথে তো তার সংসারটা হয়ে উঠেনি।মিষ্টি আর ইভানকে দেখলে চোখের তৃষ্ণা মিটে যায় হুমায়রার। চাপা দীর্ঘশ্বাস হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে চলতে লাগলো বাড়ির পথে।

গাড়িতে বসেই শক্তভাবে মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরলো ইভান। উফ,ভেতরটা এখন শান্তিপূর্ণ হয়ে উঠেছে ইভানের। মিষ্টি তখনো চুপচাপ। নির্বিকার মিষ্টিকে পাথরের ন্যায় বসে থাকতে দেখে ইভান মাথা নিচু করে মিষ্টির গালে হাত রেখে বললো,

—- কি হয়েছে তোর? খুশী লাগছেনা তো? চলে যাবি তোর বাবার-মায়ের কাছে? যাবি? সময় আছে চলে যেতে চাইলে চলে যা।আমি বাঁধা দিবোনা।

কথাটা শুনেই মিষ্টি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো।এতক্ষণের চেপে রাখা কান্না এখন তীব্রবেগে বেরিয়ে আসলো। মিষ্টি কাঁদতে কাঁদতে বললো,

— আমার ভয় লাগছে ইভু।আমার মনে হচ্ছে বাবা আমাদের অভিশাপ দিয়েছে। মনে হচ্ছে আমাদের এরকম করার কারণে অনেক বড় একটা শাস্তি পেতে হবে আমাদের। আমার ভয় লাগছে ভীষণ।

— আরে আরে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।তোর বাবা তো এই জনমেও আমাকে মেনে নিবেনা যা বুঝলাম। তাই যদি আমি কখনো মরে যাই?পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় নিয়ে নিই,তাহলে তুই ফিরে আসিস এখানে।দেখবি তোর বাবা তোকে আগের মতো মেনে নিবে। এখন কান্নাটা বন্ধ করনা জান।

ইভানের কথাটা বিষাক্ত কাঁটা ফুটার ন্যায় মিষ্টির সর্বশরীরে যেনো ব্যাথা সৃষ্টি করলো।মিষ্টি হাঁসফাঁস করতে করতে বললো,

— তাহলে আমার মৃত্যুটাই নাহয় সর্বপ্রমথ হোক।

(চলবে)
______________
©তারিন_জান্নাত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে