~কাছেপিঠে~
পর্বসংখ্যাঃ১৮
চিরপরিচিত জন্মস্থানে ফিরে মনেপ্রাণে অদ্ভুত এক প্রশান্তির ঢেউ খেলে গেলো মিষ্টির মনে। সেই ভাঙা ইটের টুকরো মিলিয়ে তৈরি রাস্তা।ছোট্টো একটা নদী।গাছগাছালির গুলো আগের তুলনায় অনেক মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছে। হাতের ব্যাগটা হাঁটুর উপর শক্ত করে চেপে রেখে ডানে-বামে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে চলতে লাগলো মিষ্টি।মাঝে মাঝে রিকশার ঝাঁকুনি খেয়ে জায়গা থেকে নড়ে উঠলেই পূনরায় শক্তভাবে নিজেকে আঁটকে বসে থাকলো।
বাড়ির কাছাকাছি আসতেই ভয়ে বুকের ভেতর ধুকপুকানির শুরু হয়ে গেলো মিষ্টির। হৃদযন্ত্রের অস্বাভাবিক ছন্দ মনের ছন্দকে দূরে ঠেলে দিতে লাগলো। মিষ্টির মাও তো তার উপর এতদিন রেগে ছিলো। কাল নিশ্চয়ই রাগটা চলে যাওয়ার কারণে ফোন দিয়েছিলো। একটুর জন্য নিজেকে আশ্বস্ত করলো মিষ্টি।যে তার বাবার যদি কোনপ্রকার আচরণ করে তাহলে তার মা তার পাশে এসে দাঁড়াবে।
বিলের পাশেই সাদা রঙের একতলা বাড়িটি মিষ্টির। এই জায়গাটিতে আগে মাটির তৈরি ঘর ছিলো মিষ্টিদের।মিষ্টির বড় আফার স্বামী অর্থাৎ তার দুলাভাই এ বাড়িটা বানিয়ে দিয়েছিলো নিজ দায়িত্বে।খরচাপাতি জোর করে উনি অর্ধেকটা দিয়েছিলেন। ভদ্রলোক ভীষণ ভালো এবং সৎ মানুষ। এমন একজন জামাতা পেয়ে বেশ গর্ব করেন মিষ্টির বাবা। মিষ্টির বড় বোন হুমায়রার ইচ্ছে ছিলো মিষ্টিকে তার ছোট দেবরের সাথে বিয়ে দিয়ে একেবারে নিজের কাছে নিয়ে আসবেন। হুমায়রার মা-বাবা স্বামী সবাই রাজি ছিলো এ সম্পর্কে। মাঝখান থেকে পড়াশোনা করতে ঢাকা গিয়ে ইভানে প্রেমে যায় মিষ্টি।প্রেম-ভালোবাসার মাত্র ছাড়িয়ে তারা একেবারে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে গেলো। এতো বাঁধা,এতো হুমকি-ধমকি কিছুই কাজে লাগলো না।কোত্থেকে ইভান এসে মিষ্টিকে একেবারে চুরি করে নিয়ে যায়। মিষ্টির এ সম্পর্কে তার বাবা মায়ের সবথেকে দীর্ঘশ্বাসের কারণ হয়েছিলো।পাড়াপড়শির কাছে লজ্জায় চোখ মেলাতে পারেননি তিনি অনেকদিন। এই ক্ষোভ থেকে মিষ্টির বাবা মতিউর রহমানের মনে এখনো জায়গা দখল করে আছে।
মিষ্টিদের বাড়ির আশেপাশে তেমন নেই বললেই চলে। পাশেই একটা ছোটখাটো বাজার আছে। তাই আসার পথে তেমন কেউ মিষ্টিকে দেখেনি।তবে তাদের পুরাতন দাদার বাড়ির এলাকায় প্রচুর মানুষ জনের বসবাস তাদের মধ্যে কেউ মিষ্টির গ্রামের আসার কথাটা জানলেই পুরো এলাকা রটিয়ে দিবে।
বাড়ির ভেতরে পা রাখতেই তেমন কাউকে দেখলো দেখলো না। অবশ্যই বাড়িতে আছেই বা ক’জন? তার মা-বাবা আর একটা ছেলে। যে সবসময় বাবাকে চাষাবাদে সাহায্য করে। দিন শেষে আশ্রয়টা তাদের বাড়িতেই হয় তার। তিনবেলা খাবার,থাকার জন্য একটা নিরাপদ স্থান। বেশ ভালোই দিন কাটে রেজওয়ানের।
সে তখন দুপুরের ভাত খেতে এসেছিলো। দরজার মিষ্টিকে দেখে অবাক হয়ে যায় খুব। মুখ ফসকে উচ্চ আওয়াজে বলে উঠলো,
— মিষ্টি আপা?
রেজওয়ানের কন্ঠ শুনে হকচকিয়ে গেলো মিষ্টি।পেছনে ফিরে তাকালো। ততক্ষণে রেজওয়ানের আওয়াজ শুনে মিষ্টির মা ও তড়িৎ গতিতে রান্না ঘর থেকে এগিয়ে আসতো লাগলো। হন্তদন্ত পায়ে এগিয়ে এসে সজোরে জড়িয়ে ধরলো মিষ্টি। অনেকটা সময় জড়িয়ে ধরে রেখেই মুখে চুমু খান তিনি। মিষ্টি চুপচাপ মায়ের মমতা অনুভব করতে লাগলো। শেষে নিজেকে আঁটকাতে না পেরে কেঁদে ফেললো মিষ্টি। রোকসানা ও কাঁদছেন নিঃশব্দে। তাদের কান্নার দেখে রেজওয়ানের চোখেও পানও চলে আসলো। কি ছোঁয়াছে রোগ রে বাবা!
নিজেকে ছাড়িয়ে মিষ্টি তার মাকে জিজ্ঞেস করলো,
— বাবা কোথায় মা? এখন কেমন আছে?
রোকসানা আমতা আমতা করে রেজওয়ানের দিকে তাকালো। এরপর মিষ্টিকে কিছু বলতে যাবে তার আগেই রেজওয়ান বলে উঠলো,
— আপা, মামা তো এখন হাটে।রাতে হিমু আপা আর দুলাভাই আসবে।তার জন্য বাজার লাগবে।
মিষ্টি তার মায়ের দিকে চেয়ে বললো,
— বাবাকে এই শরীরে হাটে কেন পাঠালে মা?
রেজু ও তো বাজার করতে পারতো।
রোকসানা প্রসঙ্গ বদলাতে বললেন,
— ছাড় তোর বাবার কথা।আমার কোন কথা আজ অবধি শুনেছে? যা তো হাতমুখ ধুয়ে আয়,আমও খাবার বাড়ছি।একসাথে খাবো।রেজওয়ান তুইও খেয়ে আয়।
মিষ্টির হঠাৎ তার মায়ের আচরণ অদ্ভুত লাগলো।
কেমন যেনো কিছু লুকাচ্ছে তার কাছ থেকে। কিন্তু কি?
হাতমুখ ধুয়ে একসাথে খাবার খেলো মিষ্টি। অনেকদিন ওর মায়ের হাতের রান্না খেয়ে শান্তি পেলো মিষ্টি। এখন সব ঠিকঠাক।এবার বাবা মুখোমুখি হওয়ার পালা।কথাটা ভাবতেই ভয়ে শিউরে উঠছে মিষ্টি। কখন? কোন সময়ে দেখা দিবে? দেখা হলে সর্বপ্রথম কি কথা বলতে হবে? এসব ভেবেই যখন অস্থির তখনি ইভানের কল আসলো মিষ্টির ফোনে।শত দুশ্চিন্তার মধ্যে এক পশলা প্রশান্তি।চট করে ফোনটা ধরে কানে ঠেকালো সে। ইভান অত্যন্ত গম্ভীর স্বরে বললো,
— মিষ্টি।
— ইভু!
— উফফ্! কি শান্তি। কেমন আছিস বল?
— ভালো।তুই?
ইভান রসিকতাপূর্ণ স্বরে বললো,
— আমার ভালো থাকা এখন আপাততে বাপের বাড়িতে।সে সেখান থেকে আসুক।তারপর বলি?
মিষ্টি ফিক করে হেসে দিলো ইভানের কথায়,বললো,
— লাঞ্চ ব্র্যাক নিশ্চয়? যা কথা না বলে খেয়ে নে।
— আচ্ছা, রাতে ফোন দিবো?
— কাজ না থাকলে দিতে পারিস।
— ঠিকাছে,ফোনের কাছাকাছি থাকিস।
ইভান ফোন রেখে দিয়ে ক্যান্টিনে চলে গেলো লাঞ্চ করার জন্য। ফোনটা বিছানার পাশে রেখে দিলো মিষ্টি। চোখমুখে আঁধার ঘনিয়ে এসেছে তার। ঠিক তখনি তার মা তার পাশে এসে দাঁড়ালো।মিষ্টির ম্লানমুখের দিকে চেয়ে বললো,
— কি হয়েছে? কে ফোন দিয়েছে?
— তোমাদের জামাই মা।
মিষ্টির মায়ের মুখ শক্ত হয়ে গেলো হঠাৎ। কপাল কিঞ্চিৎ কুঁকচে বললো,
— ছেলেটা বেশ চালাক তাই না। কিভাবে যেনে তোকে বস করে রেখেছে।
মিষ্টি অবাক হলো মায়ের কথায়, বললো-
— এভাবে বলছো কেন মা? ইভান চালাক তাতে কি হয়েছে?
— যা হয়েছে একদম ভালো হয়নি।তোর চোখে কালো কাপড়ের পট্টি বেঁধে রেখেছে।সত্য-মিথ্যে তোর চোখে ধরা পড়ছে না।
— কিসের সত্য-মিথ্যে মা?
রোকসানা খেয়াল করলো মিষ্টির মুখ অস্বাভাবিক ভাবে লাল হয়ে উঠছে। রাগের পূর্বাভাস লক্ষ করে নিজেকে আঁটকালো রোকসানা। মেয়েটা এসেছে, থাকুক কিছুদিন।আস্তেধীরে যা বলার বলবে ভাবলেন তিনি৷
বিকেলের দিকে হুমায়রার আসার কথা থাকলেও তারা আসতে পারেনি। মিষ্টির বাবা মতিউর রহমান ফিরেছেন ঠিক সন্ধ্যায়।মসজিদ থেকে নামাজ আদায় করে তারপরে বাড়ি ফিরেছে। চা-পানি, পান খেয়েদেয়ে বসলেন টিভিতে খবর দেখতে। এদিকে মিষ্টির ঘর থেকে বারকয়েক উঁকি দিয়েও তার বাবার সাথে কথা বলার সাহস ফেলো না। তার মাও হঠাৎ কেমন যেনো নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন।কোন সাড়াশব্দও নেই। অথচ দুপুর থেকে এ বিকেল অবধি অনেক কথা বলেছিলেন।মিষ্টির ধম আঁটকে দরজা বন্ধ করে ঘরেই বসে থাকলো। অপেক্ষা করতে লাগলো কখন তার আসবে।কখন তাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে তার বাবার কাছে। শেষ পর্যন্ত মিষ্টি অনুধাবন করতে পারলো তার বাবা-মায়ের সম্পর্ক আর আগের মতো নেই। না থাকার কারণটা কি? কোনভাবে সে নয়তো? এসব হঠাৎই মনে পড়লো মিষ্টির। ভয়ে কুঁকড়ে গেলো মিষ্টি।তীব্র ভয়,অনুশোচনায় আঁকড়ে ধরলো তাকে।এমন একটা ভাবনা ও বা কেন তার মনে আসলো।
মিষ্টির বাবা চুপচাপ রাতের খাবার গেলেন। নিজের শারিরীক সুস্থতার কিছু নিয়মমাফিক ওষুধ সেবন করে শুয়ে পড়লেন বিছানায়। আর কোন সাড়াশব্দ নেই।কেমন নিস্তব্ধ একটা পরিবেশ। মিষ্টির কান্না ফেলো খুব করে। এমনটা একটা পরিবেশ তো আগে ছিলোনা। হাসিখুশীতে মেতে থাকতো সবসময়।কোলাহলের মজে থাকতো। আজ সব কেমন নেতিয়ে আছে।মিষ্টি এখানে না আসলে আজ এমন পরিবর্তন টেরও পেতো না।
দরজা ঠেলে রোকসানা ঘরে প্রবেশ করলো। হাতে এক প্লেট ভাত। দরজা বন্ধ করে দিয়ে মিষ্টির সামনে বসলেন তিনি। ভাত তরকারি মাংস মাখিয়ে নিয়ে মিষ্টির গালের সামনে ধরতেই মিষ্টি প্রশ্ন করলো,
— বাবা কি হয়েছে মা? কোন কথাবার্তা নেই যে?
রোকসানা একটা ভাতের লোকমা নিজের নিলো।খেয়ে নিয়ে বললো,
— তোর বাবার কথাবার্তা তো সে তুই চলে যাওয়ার পর থেকেই হারিয়ে গেছে।
— কি বলো মা?
— বাবা?
— তুই চলে যাওয়ার পর তোর বাবা আমার সাথে আর কথা বলেন না। উনার ধারণা আমার জন্যেই তুই খারাপ পথে গিয়েছিস,পালিয়ে গিয়ে একটা অপরিচিত ছেলেকে বিয়ে করেছিস।এরচেয়ে লজ্জার বিষয় আর কি হতে পারে? সবচেয়ে বড় দোষী আমি, তোকে ঢাকা পড়তে পাঠানোর কথা আমিই বলেছিলাম।
মিষ্টির চোখ ছলছল করে উঠলো তার মায়ের কথায়। এসব কথা শুনে অদ্ভুত ভাবে খারাপ লাগছে তার।তখন কেন সে এমন একটা পদক্ষেপ নিয়েছিলো।মিষ্টির এ মুহূর্তে মব চাচ্ছে অতীতে ফিরে গিয়ে নিজের করা সব ভুল শুধরে নিতে। তারপরও এতোকিছুর মাঝে মিষ্টিকে ইভানকে তার পাশে চাইছে। শক্ত করে ইভানের হাতটা ধরে রাখলে বোধহয় শান্তি পেতো। কি এক যন্ত্রণা।রোকসানা মূলকথাটা না বলেই টুকটাক কিছু কথাবার্তা বলে চলে গেলেন।
মিষ্টি দরজা বন্ধ করে ভাবলে বিষয়টা ইভানকে জানাবে। পরে ভাবলো এভাবে সমস্যার সমাধান হবেনা।বরং আরো জটিল হবে। মিষ্টি প্রথমবার শুধুমাত্র ইভানকে চ্যুজ করেছিলো।এ মুহূর্তে মিষ্টি তার মা-বাবা,আর ইভান উভয়কে একসাথে চ্যুজ করতে চাইছে।
ভাবতে না ভাবতেই ইভান ফোন দিলো। ফোনটা রিসিভ হতেই ইভানের কন্ঠে সর্বপ্রথম শুনলো,
— কাল কয়টায় বের হবি? আর আঙ্কেলের কি অবস্থা এখন?
মিষ্টি মনে মনে বললো,
— অবস্থার কথা কি বলবো তোকে।সবই খারাপ। তোর সাথে দেখা হওয়াটা খারাপ,প্রেম হয়ে যাওয়াটাও খারাপ। তোর সাথে চলে যাওয়াটা আরো বেশি খারাপ কাজ ছিলো আমার জীবনে।
মুখে বললো,
— দেখি কয়টায় বেরোতে পারি।
আর বাবার অবস্থাও মোটামুটি ভালো।
— আচ্ছা তাড়াতাড়ি চলে আসিস ঠিকাছে?
মিষ্টি আনমনা হওয়াতে অস্পষ্ট স্বরে বললো,
— ঠিকাছে।
— আরো কিছুক্ষণ বলবি কথা,নাকি রেখে দেবো?
— রেখে দে,তোর সকালে অফিস আছে।
— আচ্ছা,টেক খেয়ার। লাভ ইউ!
— লাভ ইউ টু…
(চলবে)
~কাছেপিঠে~
পর্বসংখ্যাঃ১৯
ভোর ছয়টা বাজতেই পশ্চিমাকাশ মৃদু হলদে বর্ণ ধারণ করতে শুরু করলো।ধীরে ধীরে তীক্ষ্ণ রূপ ধারণ করবে হলদে আকাশ।ঠিক তখনি ঝলমলিয়ে উঠবে গোটা ধরণী। নামাযের পর পরই চা-বিস্কুট লাগে মিষ্টির বাবার। রান্না ঘর থেকে চা-বিস্কুট এনে মামার সামনে রাখার দায়িত্ব রেজওয়ানের।সেও সাথে চা-বিস্কুট খায়। এই হলো তাদের সকালের নাস্তা। দশটার দিকে আলুসিদ্ধ ভর্তা আর পান্তাভাত তো অত্যবশ্যক। প্রতিদিনের রুটিন যে। কোন সময় হাট বাজার থেকে রুটি-পরোটা খাওয়া হলে সেদিনটা আর পান্তা মুখে নেওয়া হয়না উনার।
খাবারের পর সবেমাত্র পানের কিলিটা মুখে পুড়লেন মতিউর। ঠিক সেসময় উপস্থিত হলো মিষ্টি। ম্লানমুখ,রোগা চেহারা।চোখ যেনো ধেবে গেছে। মেয়েটা রাতভর কান্না করলেই এমনটা দেখাতো। চোখের সামনে মিষ্টির অভয়বটা দেখে প্রথমে মিষ্টির বাবা ভ্রম মনে রেজওয়ানের দিকে তাকালেন। রেজওয়ানও মিষ্টির দিকে তাকিয়েছিলো। হুট করে মতিউর পূনরায় তাকালো মিষ্টির দিকে।একটু আগের তাকানোতে শীতলতা থাকলেও,এই মুহূর্তে চোখেমুখে অস্বাভাবিক ক্রোধ বিদ্যমান। মিষ্টি হুট করে মাটিতে বসে তারা বাবার পা আঁকড়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো। মুহূর্তের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনায় অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন মতিউর। রাগটা ক্রমশই বেড়ে যেতে লাগলো। কান্নার শব্দে রান্না ঘর থেকে ছুটে এলেন রোকসানা। তড়িঘড়ি করে আসতে গিয়ে পায়ে একটা হোঁচট ও খেলেন।সেসবে তোয়াক্কা না করে প্রাণপনে ছুটে এলো মিষ্টিকে বাঁচাতে।
রোকসানা আসতে আসতে ততক্ষণে পা ঝাড়া দিয়ে মিষ্টির কাছ থেকে নিজের পা ছাড়িয়ে নিলেন মতিউর। মানসপটে পরিষ্কার ভাবে ভেসে উঠলো এক বছর আগের স্মৃতি। গ্রামের মানুষের কাছে তাঁর আলাদা একটা সম্মান ছিলো। সব সম্মান মাটিতে মিশিয়ে দিয়ে এই পেয়ে একটা অসভ্য ছেলের হাত ধরে পালিয়েছিলো। কতোমাস মানুষকে মুখ দেখাতে পারেনি লজ্জায়। মতিউর রাগে কাঁপতে লাগলেন। আচমকা উঠে দাঁড়িয়ে গর্জে বলে উঠলো,
— তুই কোন সাহসে আমার বাড়িতে পা দিয়েছিস?
বলতে বলতে মতিউর সোফার পেছন থেকে শক্ত মোটা একটা লাঠি বের করলেন।তিনি আজ অবধি কোন ভুলের শাস্তি এই লাঠি ছাড়া সংশোধন করেননি। স্ত্রী-মেয়েদের প্রচণ্ড ভালেবাসলেও লাঠি দ্বারা আঘাত তাদের তিনি কম করেননি। তারপরও তিনি তাদের ভালেবাসেন।সবচেয়ে বেশি ভালোবাসতেন মিষ্টিকে। একটা স্বার্থপর মেয়েকে। মতিউর রাগ দমন করতে না পেরে প্রচণ্ড আক্রোশে ফেঁটে পড়ে মিষ্টির পিঠে লাঠির আঘাত বসিয়ে দিলেন।ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলো মিষ্টি।সে জানতো তার বাবা মারা ছাড়া কোন বিষয়ের সমধান করতেন না।যতোই ভুল হোক মার তিনি মারবেনই।সে মারের ভয়ে সে এতদিন বাড়িতে আসার সাহস পায়নি।সহস করে যখন এসেই ছিলো।তখন মার খাওয়াটা মিষ্টি মেনে নিয়েছে।যদি এরপর রাগটা সংবরণ হয়।এবং তাকে ক্ষমা করে।
রোকসানা এসেই চেঁচিয়ে উঠলেন।অনেকদিন পর তিনি মুখে বললেন,
— খবরদার যদি আমার মেয়ের গায়ে আর একটা আঘাত করো।
— তুই কথা বলবিনা এর মাঝে। তোর সাথে আমার কোন কথা নেই।মেয়েকে আশকরা দিয়ে দিয়ে যতসব পাপ করেছিস।
— মুখ সামলে কথা বলো।এতদিন চুপ ছিলাম মানে আজ চুপ থাকবো না। কারণ,আজ আমার মেয়ে এখানে উপস্থিত আছে।
মতিউর রোকসানার কথা তোয়াক্কা না করে আবারও এগিয়ে এলেন মিষ্টিকে আঘাত করতে। প্রথম আঘাতেই মিষ্টির ডানবহু ছ্যাঁৎ করে জ্বলে উঠেছিলো ব্যাথায়।এবার মনে হয় সে ব্যাথায় মরেই যাবে। মার থেকে নিজেকে বাঁচাতে হাতজোড়া বাড়িয়ে দিলো।ফলস্বরূপ লাঠির আঘাত হাতে পড়লো।সাথে সাথে ব্যাথায় আর্তনাদ করে উঠলো মিষ্টি।রোকসানা হন্তদন্ত পায়ে এগিয়ে আসলে রোকসানাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিলো মতিউর।রেজওয়ান পাশেই ছিলো।সে রোকসানাকে ধরে ফেললো।ভয়ে সে কান্না করে দেওয়ার মতো অবস্থা। মামাকে সে প্রচণ্ড ভয়,তাই আজ সাহস করেও সে মিষ্টি আপাকে বাঁচাতে পারলো না। তার পরেই শুরু হয় তাণ্ডব।মিষ্টির বাবা যেভাবে পেরেছেন সেভাবে আঘাত করে গিয়েছে মিষ্টিকে।যে মেয়ে বাবার সম্মান রক্ষা করতে পারেনি, তার উপর কিসের দরদ। রোকসানা ডাল হয়ে মেয়েকে বাঁচাতে এসে নিজেও আঘাত পেলেন।মা-মেয়ের আর্তনাদে মতিউরের পুরুষালী মনকে গলাতে পারেনি।একসময় হাঁপিয়ে উঠে তিনি লাঠি ফেলে দিলেন। গামছা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতে বললো,
— এক্ষনি এই মেয়েকে আমার বাড়ি থেকে করে দিবি।আমি মুখ আর দ্বিতীয় বার দেখতে চায়না।
মার খেয়ে মিষ্টি তখন মায়ের কোলে শুয়েছিলো। বাবার কথা শুনে প্রচণ্ড অভিমান হলো তার।চোখের কর্ণিশ ভেয়ে অনবরত পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো।এতো কষ্ট কেন তার জীবনে। হঠাৎ দূর্বল শরীর নিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো মিষ্টি। চোখমুখ মুছতে মুছতে বললো,
— আমি এখানে থাকবোনা আর।
ভেবেছি মারার পর বাবা আমাকে ক্ষমা করে দিবে।
ক্ষমা তো করলো না উল্টো বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে বললো।
রোকসানা উঠে এসে মিষ্টির হাত ধরে বললো,
— পাগলামি করিস না তো।তোর বাবার রাগ তো তুই জানিস।মুখের কথা এক আর কাজের কথা আরেক।রাগের থেকে কথাটা বলেছে।
— রাগের থেকে বললেও কথাটা সত্যিই বলেছে মা।
রোকসানা মিষ্টিকে শান্ত করতে মাথায় হাত বুলাতে লাগলেন।সারা শরীর ব্যাথায় যন্ত্রণা করছে মিষ্টির।এমন মার তো বিয়ের আগে হাজার বার খেয়েছে।তখন সেসবের জন্য কখনো অভিমান হয়নি তার।আর না হয়েছিলো রাগ।তবে আজকের আঘাত কাম্য হওয়ার পর মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে মিষ্টির।এ মুহূর্তে ইভান যদি থাকতো তাহলে কি করতো।নিশ্চয় বাঁচাতো মারের হাত থেকে।
রোকসানা জোর করে মিষ্টিকে রুমে নিয়ে গিয়ে হাত মুখ ধুয়ে দিলো। এতোবড় মেয়ের গায়ের কেউ অমানুষের মতে আঘাত করে? আগে তো বাবা ছিলো সেজন্য শাসন করে মারতো।এখন তো মিষ্টি অন্যকারো বউ।তার গায়ে হাত তুলার আগে একশোবার চিন্তা করা উচিত ছিলো। রোকসানা এসব বলতে বলতে মিষ্টিকে শান্ত করলো। মিষ্টির জন্য চিড়ার পোলাও রান্না করেছিলো। সেটা এনে মিষ্টিকে খেতে দিলো।মিষ্টি খেতে না চাইলে জোর করে খাইয়ে দেয় রোকসানা।
রোকসানা মিষ্টিকে শুইয়ে দিয়ে বললো,
— একটু করে ঘুমানোর চেষ্টা কর। তাহলে ভালো লাগবে।
রোকসানা উঠে চলে যেতে নিলে,মিষ্টি তার মায়ের হাতটা ধরে ফেলে।অত্যন্ত করুণ স্বরে বললো,
— মা কি করলে বাবা আমাকে ক্ষমা করবে।
কোন উপায় কি নেই?
রোকসানা কিছুক্ষণ চুপ থাকলেন।অতঃপর বললেন,
— আছে,একটা উপায় আছে।
মিষ্টি উপায়টা জানার জন্য মুখিয়ে থাকলো। রোকাসানা আবারও বলে উঠলো,
—- ওই ছেলেটাকে তালাক দিয়ে একেবারে আমাদের কাছে চলে আয়। তাহলেই তোর অন্যায়ের ক্ষমা হবে।এটাই একমাত্র সমাধান।এটা আমার নয় তোর বাবার কথা। যে ছেলে একটা বাবার বুক খালি করে একটা মেয়েকে নিয়ে চলে যেতে পারে,অন্তত কোন বাবা চাইবেনা এমন ছেলের কাছে তার মেয়ে থাকুক।কথা কি বুঝেছিস?
আসল যন্ত্রণার শুরুটা হলো এইমাত্র। একটা অবাস্তব, অসম্ভব কথা শুনে। এমনটা হলে মিষ্টির আর বেঁচে থাকার উপায় থাকবেনা। শেষমেশ তার মাও তার বাবার পক্ষে। মিষ্টি উঠে বসলো,
— তাহলে এতক্ষণ আমাকে বাঁচানের জন্য বাবার সামনে এতো কথা কেন বলেছিলে মা? তুমিও..?
— আমিও কি? আমি শুধু তোকে মার থেকে বাঁচাতে চেয়েছি।সত্যি বলতে আমিও চায়না ওই ছেলের সাথে তোর কোন সম্পর্ক থাকুক।
এই বলে রোকসানা এগিয়ে গিয়ে টেবিল থেকে মিষ্টির ফোনটা হাতে নিয়ে নিলো। দরজার কাছে এসে দরজা আঁটকাতে আঁটকাতে বললো,
— আপাততে ঘরবন্দী থাক।দুপুরের খাবার পেয়ে যাবি। আমি চাই আমার সংসার,আমার সন্তান এবং তাদের বাবার সাথে সম্পর্ক ভালো থাকুক। বাইরের একটা ছেলে এসে আমাদের সব সুখ কেঁড়ে নিলো।আমরা কিছু করতেও পারলাম না। দেখি এবার সব ঠিক না হয়ে যায় কোথায়।
পুরোটা কথা মিষ্টি শুধু অবাক হয়ে শ্রবণ করলো। চোখের সামনে একটা উপায়হীন পরিস্থিতি দেখতে পেলো মিষ্টি।এমন দম বন্ধ করা পরিস্থিতি থেকে কিভাবে মুক্তি মিলবে?
_________
ইভান অনেক ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে স্টেশনে এসে পৌঁছালো। এখন সময় দশটা উনচল্লিশ। ট্রেন আসবে এগারোটা পনেরো তে। কিছুক্ষণ এখানে হাঁটাহাঁটি করবে। কিছু খাবে।মানুষদের অবস্থা দেখবে।ব্যস,সময় কেটে যাবে।
ভাবনা মতো সব করেও সময় কাটেনা ইভানের। সময় মতো মিষ্টি এসে যাবে ভেবে একটা ফোনও করেনি ইভান।যদি পথে হয়। আশা করলো সুস্থ ভাবেই ফিরে আসবে।
সময়মতো ট্রেন এসে স্টেশনে পৌঁছালো।বহু যাত্রী নামতে লাগলো ট্রেন থেকে। ইভান ড্যাব ড্যাব করে সব মহিলাদির দিকে তাকাতে লাগলো। কয়েকজন মহিলা ভুলবশত ইভানকে গলা কেঁকিয়ে ধমক দিলো এভাবে তাকানোর জন্য। ইভান তাদের বুঝাতেই পারলো না।মহিলাদের ভীড়ে সে শুধু তার বুক বরাবর লম্বা,পাতলা গড়নের দেখতে এক রূপসীকে খুঁজছিলো।যে তার বউ।তার একমাত্র একান্ত মানুষ।
আধঘন্টা অপেক্ষা করে মিষ্টিকে না দেখে এবার দ্রুত গতিতে ফোন দিলো মিষ্টির ফোন। অনেকক্ষণ সময় নিয়ে ফোনটা রিসিভ হলো।অত্যন্ত তীক্ষ্ণ কন্ঠে অপরপাশ থেকে কেউ বলে উঠলো,
— হ্যালো!
ইভান ভ্রুঁ কুঁচকে ফোনের দিকে তাকালো।নাম্বারটা তো মিষ্টির।ফোন কে ধরলো আবার? ইভান বললো,
— মিষ্টিকে ফোন দিন। আপনি কে?
— আমি মিষ্টির মা। মিষ্টিকে ফোন দেওয়া যাবেনা।
আর ভুলেও এখানে ফোন দিবেনা।তাহলে আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবেনা।
কথাটা শুনে রেগে গেলো ইভান।নিজেকে যথেষ্ট শান্ত রেখে বলে,
— আপনাদের থেকে কেউ খারাপ আর হবেও না।মিষ্টিকে ফোন দিন,সি ইজ মাই ওয়াইফ।
— চুপ করো বেয়াদব। আমার মেয়ে শুধু আমাদেরই মেয়ে ছিলো,আছে, এবং থাকবে। তুমি দুইদিনের প্রেমিক হও শুধু আর কিছু না। আরেকটা কথা মিষ্টি আর যাবেনা এখান থেকে।
ইভান ফোন কানে ঠেকিয়ে রেখেই ভাবতে লাগলো। ভেবেছিলো মিষ্টির বাবা আস্ত এক জল্লাদ।এখন দেখা যাচ্ছে মিষ্টির মাও একটা আস্ত জল্লাদী মহিলা।ইভান বললো,
— আপনাদের মেয়ে কোথায়? তার মুখ নেই কথা বলার? সাহস থাকলে আপনার বলা কথাগুলো আপনাদের মেয়ের মুখ দিয়ে বলান।দেখি আপনাদের কতো ক্ষমতা।
ইভানের মুখভাঙা জবাবে রোকসানা অপ্রস্তুত হয়ে গেলো।ফট করে লাইনটা কেটে দিলো। লাইন কাটার পরও শান্তি পেলো না। পর পর কয়েকটা মেসেজ আসলো। সাহস করে রোকসানা একটা মেসেজ পড়ার চেষ্টা করলো।
— “শাশুড়ি সাহেবা,
আপনার স্বামী এবং আপনি দুজনে সতর্ক থাকুন।আমি পুলিশ নিয়ে আসছি।
লেখাটা দেখেই রোকসানার হাত থেকে ফোনটা পড়ে গেলো। এখন এদের জন্য আবার গ্রামে পুলিশ আসবে? শহরের পুলিশ? গ্রামের পুলিশদের তো ঘুষ দিয়ে আঁটকানো যাবে। কিন্তু এদের কিভাবে আঁটকাবে। রোকসানা আতঙ্কে ভাতের মার ফেলে হাত পুড়িয়ে ফেললেন।একথা যদি মিষ্টির বাবার কানে যায় তাহলে তো তাকে খতমই করে ফেলবে।কারণ তিনি বলে দিয়েছিলেন মিষ্টিকে বাড়ি থেকে চলে যেতে। সব ঝামেলা ঠিক করার জন্য রোকসানা এই পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলো। না জানে ওই বেয়াদব ছেলেটা এবারে কি করে বসে।
— আল্লাহ! আল্লাহ! আমাকে বাঁচাও।
(চলবে)
©তারিন_জান্নাত