কাছেপিঠে পর্ব-১৬+১৭

0
657

~কাছেপিঠে~
পর্বসংখ্যাঃ১৬

জুঁইয়ের কোমড় থেকে পা অবধি সাদা বেন্ডেজে জড়ানো।চোখেমুখে অসহ্যনীয় ব্যথা দৃশ্যমান।চোখমুখ ফুলে একাকার। মুহিত আগে আগে এসে কেবিনে প্রবেশ করেো।তার চোখমুখের অবস্থা করুণ। জুঁইয়ের পাশে রাইদা বসে ছিলো। মুহিতকে দেখে বললো,

— মিষ্টি আর ইভান আসেনি?

মুহিত জুঁইয়ের কপালে হাত রেখে জ্বরের মাত্রাটা দেখে নিলো।আগের চেয়ে অনেকটা কমে এসেছে। রাইদা প্রশ্নের জবাবে বললো,

— ফোনে তো জানিয়েছি,আসবে বলেছিলো।
এতক্ষণ হয়তো চলেও এসেছে। রাফিন নিয়ে আসবো নে।

মুহিতের কথা শেষ হতে না হতেই দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলো ইভান। ডান হাতটা সবসময়ের মতো মিষ্টির হাত চেপে রেখেছে। দুজনকে একসাথে দেখে জুঁইয়ের শারীরিক বেদনার চেয়ে মানসিক বেদনাটা বেশি বেড়ে গেলো। তৎক্ষনাৎ মনে চিন্তা আসলো কি করলে এই দুটোকে আলাদা করা যাবে।মনে চিন্তাটা আসতেই মাথায় ব্যথা শুরু হয়ে গেলো জুঁইয়ের। পরক্ষণে মনে পড়লো,আগে নিজের সুস্থ হওয়াটা জরুরি। তারপর এ দুটোকে দেখে নিবে।এদের কথা ভাবতে ভাবতেই তো সে সিঁড়ি থেকে হোঁচট খেয়ে একেবারে শক্ত ফ্লোরে গড়িয়ে পড়েছিলো কাল রাতে।

মিষ্টি দেখলো জুঁই চুপচাপ চোখ বন্ধ করে আছে।হয়তো ব্যথায় কথা বলতে কষ্ট হচ্ছে সেজন্য চুপ মেরে আছে।তাই মিষ্টি জুঁইকে ডাকলোনা আর।আশেপাশে উঁকি দিয়ে চেয়ে জুঁইয়ের মা কে খুঁজলো।
এরপর বললো,

— আন্টি কোথায় দেখছিনা যে।

রাইদা বললো,

— আন্টি আঙ্কেল নাকি ইন্ডিয়া গিয়েছেন
ট্রিটমেন্টের জন্য।

— ওহ,

ইভান সবার দিকে একনজর চেয়ে জুঁইয়ের দিকে তাকালো।জুঁইয়ের ব্যথাতুর মুখটা দেখে অদ্ভুত প্রশান্তি এসে জমেছে মনের কোণে। ঠোঁটের কোণে শ্লেষাত্মক হাসি। অতঃপর ইভান কিছু সময়ের মধ্যেই তাড়া শুরু করলো। তাই মিষ্টিকেও বেরিয়ে আসতে হলো ইভানের সাথে সাথে।

ইভান গাড়িতে উঠতে উঠতে বললো,

— দেখেছিস কি অবস্থা হয়েছে? খারাপ মানুষগুলোর এমনি শিক্ষা হয়। তাই বলছি ভালো হয়ে যা।

মিষ্টি সবেমাত্র গাড়িতে উঠতে যাচ্ছিলো। ইভানের কথায় অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। জিজ্ঞেস করলো,

— আমি খারাপ?

— আমি কখন বলেছি তুই খারাপ? যদি ভেতরে ভেতরে খারাপ থেকে থাকিস তাহলে ভালো হয়ে যা। সেটা বললাম।তুই কথার উল্টোপিঠটা বুঝিস সবসময়।

মিষ্টি গাড়িতে বসে পড়লো নীরবে। ইভান নিজের সিটে বসলো। বসে মিষ্টির দিকে তাকালেই মিষ্টি ফিক করে হেসে দিলো।হাসিটা দেখেই ইভান কপোকাত। হৃদপিণ্ডে জ্বালা ধরে দেয় মিষ্টির সব রকমের হাসি।
ইভান গাড়ি স্টার্ট দিলো,উদ্যেশ্য তাদের কর্মস্থল।

বিকেলে ছুটির পর রাস্তায় এসে দাঁড়ালো মিষ্টি। ছাত্র-ছাত্রীরা ইতিমধ্যে রওনা দিয়ে দিয়েছে বাড়ির উদ্দেশ্যে। মিষ্টি একপাশে দাঁড়িয়ে রিকশা খুঁজছিলো। হঠাৎ একটা ভদ্রলোক এসে মিষ্টির পাশে দাঁড়ালো। মিষ্টি প্রথমে খেয়াল না করলেও পরবর্তী সময়ে খেয়াল করলো কেউ একজন তারপাশে দাঁড়িয়ে আছে৷ লোকটি মিষ্টির দিকে তাকালো না। হুট করে পাশে থেকে একটা রিকশা লোকটির সামনে এগিয়ে আসতেই লোকটি আঙুলের ইশারায় মিষ্টিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ইঙ্গিত করলো। মিষ্টি লোকটির দিকে তাকালো না।মনে মনে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো শুধু। মুখেও কিছু বললো না। নিজ থেকে কোনো পুরুষ মানুষের সাথে কথা বলেছে ইভান জানলে তুলকালাম কাণ্ড ঘটাবে। আর মিষ্টিরও তেমন কোনো আগ্রহ নেই অপরিচিত কারো সাথে কথা বলার।

মিষ্টি যখন বাড়িতে এসে পৌঁছালো তখন শেষ বিকেল। দরজায় নক করতে হয়নি।খোলা ছিলো।
বুঝলো ইভান চলে এসেছে। ড্রয়িংরুমে পা রাখতেই দেখলো মারজিয়া চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খাচ্ছে। দৃষ্টি টিভির দিকে। মারজিয়াকে দেখলে মিষ্টির অবাক লাগে এমন মানুষও হয়? এ জীবনে মারজিয়ার কোনো ক্ষতি করেছে বলে মিষ্টির মনে হয়না।তারপরও কেন তার উপর এতো রাগ? এতো হিংসা?
শুধুমাত্র উনার ছেলেকে বিয়ে করেছে বলে? উনার ধারণা মিষ্টি ইভানকে তার মায়ের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছে।অথচ মিষ্টি ভার্সিটি লাইফে কখনো ইভানকে তার বাবা-মার কথা বলতে শুনেনি। শুধু জানতো সে পড়াশোনার জন্য পরিবার থেকে আলাদা থাকে। পরে এসে জানলো,ইভান তার পরিবারের সাথে যোগাযোগই রাখতো না। তার মা এসে মাঝেসাঝে আদর-যত্ন,খাতিরদারি করতো ছেলের, এরপর চলে যেতো নিজের নতুন সংসারে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলে যেই রুমের দিকে এগোতে যাবে,তার আগেই মিষ্টির ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের শব্দে মারজিয়া আঁড়চোখে তাকালো।একটা বছর পর নিজের ফোনে অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে মায়ের ফোন দেখে ভীষণ অবাক হলো মিষ্টি। তড়িঘড়ি করে দরজা দিয়ে বেরিয়ে ছাদের পথে পা বাড়ালো। বুকের ভেতর অচেনা ভয়ে ব্যথা শুরু হয়ে গেলো। দ্রুতই ফোনটা রিসিভ করে কানের পাশে ঠেকালো প্রচণ্ড উত্তেজিত হয়ে ডেকে উঠলো,

— মা…?

মিষ্টির মা রোকসানা বেগম ফুস করে নিঃশ্বাস ফেললেন। বহুদিন পর কলিজার টুকরাটার কণ্ঠস্বর শুনে বেচেইন মনটা শান্ত হয়ে গেলো আচানক। মিষ্টি দ্বিতীয় বার ভীতু গলায় বললো,

— ম-মা,মা তুমি কেমন আছো? এতদিন পর
আমার কথা মনে পড়েছে তোমার?

রোকসানা আকুল গলায় বললেন,

— এতদিন পর নয়,তোর কথা আমার রোজ
মনে পড়তো।শুধু খবর নিতে পারতাম না তোর বাবার ভয়ে।

— এখন কিভাবে করছো মা?
বাবা কোথায়? বাবা কেমন আছে মা?

মিষ্টির এ কথা শুনে কিছুসময়ের জন্য চুপ মেরে গেলেন রোকসানা বেগম।অকস্মাৎ, বলে উঠলো,

— তোর বাবা ভালো নেই,অসুস্থ। একটা বারের জন্য তোর বাবাকে দেখতে আয়। আমি জানি তোর মুখ দেখলে তোর বাবা আর রাগ ধরে রাখতে পারবে না। তুই যতো দ্রুত সম্ভব গ্রামে চলে আয়।

কথাটা শুনতেই যেনো মিষ্টির সর্বশরীর কেঁপে উঠলো। তার বাবা অসুস্থ। কেমন মেয়ে সে,যে বাবা তার সর্বস্ব দিয়ে লালন-পালন করে মানুষ করেছিলো।সে বাবাকে ছেড়ে আসতে তার বুক একটুর জন্য কাঁপলো না। কিভাবে এতোটা স্বার্থপর হয়েছিলো সে।অপরাধ বোধের কারণে চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়তে লাগলো মিষ্টির। ভালোবাসার নেশায় অন্ধ হয়ে পরিবার ছেড়ে এসেছিলো।এতে কি আদৌ সে ভালো কাজ করেছিলো? দোটানায় পড়ে গেলো মিষ্টি।কাঁধের উপর স্পর্শ পেয়ে ভয় পেয়ে গেলো মিষ্টি। গায়ের ঘ্রাণে ইভানের উপস্থিতি বুঝে গেলো সে। সময় নষ্ট না করে ইভানের বুকের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লো।কাঁদতে কাঁদতে বললো,

— তোকে কেন যে ভালোবাসতে গেলাম। তোর জন্য আমাকে আমার বাবাকে ছেড়ে আসতে হয়েছে।কেন এসেছিলি আমার জীবনে?

ইভান বুঝতে পারলো মিষ্টি রাগের মাথায় কথাগুলো বলছে। তাই সে মিষ্টির পিঠে হাত রেখে আরো গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে বললো,

— তাহলে চলে যাই?

— আমি চলে যাওয়ার কথা বলিনি।কেন এসেছিস জানতে চেয়েছি।

— মানুষের সম্পর্ক বিভিন্ন কারনে ছিন্নভিন্ন হয় এবং আলাদা হয়ে যায়। আমাদের তো আত্মার সম্পর্ক, এক তো হতেই হতো।

কথাটা শুনে হঠাৎ অনেক শান্তি পেলো মিষ্টি। ইভানের বক্ষস্থল থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলো। কান্নামিশ্রিত কন্ঠে ফট করে একটা আবদার করে ফেললো ইভানের কাছে। বললো,

— তাহলে আমি আমার বাবার কাছে যেতে চাই।
কালকে,কালকের মধ্যেই আমি বাবাকে দেখতে যেতে চাই। প্লিজ আমাকে যাওয়ার অনুমতি দেয়।

বাবা-মায়ের সাথে সম্পর্ক কম থাকায় তাদের জন্য ইভানের কোন প্রকার অনুভূতি হয়না।কিন্তু মিষ্টির হাহাকার দেখে সে চিন্তায় পড়ে গেলো। হালকা কেশে ইভান বললো,

— তোর বাবা আমাকে অনেক অপমান করেছে মিষ্টি। বখাটেদের দিয়ে মার খাইয়েছে।আমার এতো অপমানের কথা ভুলে গিয়ে থাকলে তুই যেতে পারিস।

মিষ্টি ভেজা কন্ঠে বললো,

— ইভান,উনি আমার বাবা হয়।প্রত্যেক বাবারা সন্তানের ভালো কামনা করে। সন্তানের থেকে ভালো কিছু প্রত্যাশা করে। আমার বাবা আমার কাছে প্রত্যাশা করেও কিছু পায়নি।তাহলে উনার রাগটা কি জায়েজ না?

ইভান জবাব দিলো না মিষ্টির কথায়।মুখটা অন্যদিকে ঘুরিয়ে রাখলো প্রচণ্ড রাগে। সেটা দেখে মিষ্টি আবারও বলে উঠলো,

— আল্লাহ না করুক,আমি যা করেছি আমার বাবার সাথে।সেটা যদি আমাদের মেয়ে করে? পরম মমতা,স্নেহ,ভালোবাসা সব উপেক্ষা করে যদি প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে যায় তখন তোর কেমন লাগবে?

কথাটা যেনো ধনুকের তীরের মতো কাজ করলো ইভানের বুকে।এমন একটা কথা সে কোনকালেই চিন্তা করেনি। মিষ্টির কাছে না শুনলে সে হয়তো বুঝতেই পারতো না প্রকৃতির নিয়ম বলেও একটা কথা আছে। যে নিজের মর্জিতে চলে। আজ সে যে ভুলটা করেছিলো,কাল হয়তো অন্য কেউ করতে পারে তার সাথে।এই ব্যাপারটা অনুধাবণ করতে এতো দেরী হয়েছে তাদের?
ইভান চাপা নিঃশ্বাস ফেললো,এরপর মিষ্টির দুই বাহু ধরে বললো,

— ঠিকাছে, কিন্তু শুধু কালকের রাতটায় থাকতে পারবি। আঙ্কেল দেখেই পরদিন চলে আসবি।

মিষ্টি দ্রুত মাথা নেড়ে সায় জানালো। ইভান তা দেখে বললো,

— এখন চল তাহলে। মুখটার কি অবস্থা করেছিস।

ইভান মিষ্টিকে ছাদ থেকে নামিয়ে বাসায় আসলো। তারপর সোজা চলে আসলো তাদের রুমে। তাদের মধ্যাকার হওয়া কথা তাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকলো। আর কেউ জানতেও পারলো না। মারজিয়া বাইরে বসে সিরিয়াল দেখলেও,বুঝতেও পারলো না তার পরিকল্পনায় পানি ঢালতে সৃষ্টিকর্তা অন্য একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছেন।

(চলবে)
_____________
©তারিন_জান্নাত

কাছেপিঠে~
পর্বসংখ্যাঃ১৭

সুন্দর পূর্ণিমার আলো মাখানো রাত নামলো আজ। ব্যস্ত নগরীর উঁচুনিচু দালানের ভীড়, বাসায় বাসায় জ্বলতে থাকা বাল্বের আলো সুন্দর পূর্ণিমার চাঁদটাকে আড়ালে ঠেলে রেখেছে যেনো। কোন সুনসান খোলামেলা গ্রাম্য পরিবেশ হলে এতক্ষণে চাঁদের আলো মাটির সাথে মিশে লুটোপুটি খেতো। ইভান বারান্দার মেঝেতে বসে বাইরের দৃশ্য অবলোকন করছে।মাঝে মাঝে ঘরের ভেতরে থাকা সুন্দরী স্ত্রীকেও দেখতে ভুলছেনা সে। ঘরের ভেতর মিষ্টি মাঝারি সাইজের একটা ব্যাগে তিন সেট কাপড় রাখলো।সাথে রাখলো একটা ছোট্ট টাওয়াল।ইভান চোখ বড় বড় করে চেয়ে বললো,

— কি রে? তিন সেট কাপড় নিচ্ছিস কেন?
থাকবি তো একদিন।

— তুই বুঝবিনা। তোরা ছেলেরা একটা শার্ট এক সপ্তাহ ধরে পড়তে পারলেও,আমরা মেয়েরা সেদিক থেকে পিছিয়ে।

ইভান তেতে উঠা কন্ঠে বললো,

— ছেলেরা মানে? কয়জন ছেলেকে দেখেছিস
একটা শার্ট একসপ্তাহ ধরে পড়তে? আমাকে দেখেছিস?

ইভানকে রেগে যেতে দেখে ভ্রূঁ কুঁচকালো মিষ্টি।বিরক্ত হয়ে বললো,

— দেখিনি।কথার কথা বলেছি।

—বলবি কেন? না দেখলে সে কথা আমাকে
বলেছিস কেন?জিজ্ঞেস করলাম,তিনসেট কাপড় কেন নিয়েছিস? জবাবে কি শুনালি?

— আশ্চর্য! এমন পাড়ার ক্ষেপাটে রুস্তমের মতো করছিস কেন? চুপ থাকা যায় না?

এ পর্যায়ে ইভানের রাগটা কান বেয়ে মাথায় তীব্র রূপে ছড়ে বসলো। মেঝ থেকে রুমে আসতে গেলেই,মিষ্টি কাপড়চোপড় ফেলে রেখেই ওয়াশরুমের দিকে দৌড় লাগালো। ইভান হন্তদন্ত পায়ে ঘরে এসে সব কাপড় নিয়ে নিজের ওয়ারড্রবে লকড করে রেখে দিলো। ইভানের তেমন আশানুরূপ সাড়াশব্দ না পেয়ে মিষ্টি ওয়াশরুমের দরজা মেললো। ইভান তখন পা লম্বা করে টানটান হয়ে বিছানায় শুয়ে থাকলো। মিষ্টি যখন দেখলো পরিবেশ একদম স্বাভাবিক। তাই বেরিয়ে এলো। মেঝ থেকে কাপড়ের ব্যাগ তুলে দেখলো ব্যাগে তার কাপড়গুলো নেই। চোখ তুলে ইভানের দিকে তাকালো। ইভান মিষ্টির দিকে তাকিয়েই ছিলো।যেনো সে মিষ্টির কাছে কিছু প্রত্যাশা করেছে। মিষ্টির ব্যাগটা রেখে দিলো। দৃঢ় গতিতে এগিয়ে ইভানের পাশে দাঁড়ালো। ইভান চোখের পলক না পেলেই চেয়ে থাকলো। মিষ্টি হঠাৎ ইভানের শরীরের উপর ঝাপিয়ে পড়লো,ইভানের গালে বুকে এলোপাতাড়ি চুমু দিতে লাগলো। সাথে বলতে লাগলো,

— একদিন তোর দেখা পাবো না। অনেক মিস করবো তোকে। তোরজন্য আমার কলিজা এখন থেকেই জ্বলেপুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে রে ইভু। আমার কলিজা…

— ধুরো! থামতো।

ইভান চটজলদি মিষ্টিকে আঁকড়ে ধরে বসা থেকে উঠে গেলো। জোরে নিঃশ্বাস নিতে নিতে বললো,

— এটা কোন লেভেলের অসভ্যতামি মিষ্টি?
দিন দিন বেয়াদব হয়ে যাচ্ছিস।আরেকটু হলে তো আমার জান বেরিয়ে যেতো।

মিষ্টি বিছানায় শুয়ে পড়লো, হাত পা মেলে দিয়ে বললো,

— তোরে একদিনের আদর দিয়ে যেতে চাইছিলাম।
তোর তো আবার ভালো কিছু হজম হয়না।

ইভান পাতলা চাদরটা টেনে নিজের এবং মিষ্টির গায়ে জড়াতে জড়াতে বললো,

— এসব তোর দ্বারা সম্ভব নয়।

মিষ্টির সশরীর বুকে টেনে এনে গলায় মুখ গুঁজলো।এবং বললো,

— ল্যাট স্টার্ট দ্যা আওয়ার এক্টিভিটিস?

_______

সকাল সাড়ে আটটায় ইভান আর মিষ্টিকে ঘর থেকে বের হতে দেখে বিরক্ত চোখে তাকালো মারজিয়া। ফ্লোরে ছিটিয়ে রাখা পানি সব শুকিয়ে গিয়েছে। মনে মনে গালমন্দ করতে লাগলো মিষ্টিকে। মারজিয়া হাসিমুখে ইভানের দিকে চেয়ে বললো,

— আয় নাস্তা করে নে।

ইভান ছোট করে সৌজন্য হাসলো। চেয়ার টেনে বসে দেখলো টেবিলে কয়েক পদের নাস্তা বানানো। তখনি আরো এক প্লেট ‘ডিম সুন্দরী’ পিঠা বানিয়ে এনে টেবিলে রাখলো সেঁজুতি। শেষ পদটা দেখে মারজিয়া হাসিমুখে বললো,

— খেয়ে দেখ ইভান। সব নাস্তা আমি বানিয়েছি।
সব তোর জন্য। কোন সকালে উঠেছি আজ জানিস?

ইভান ইচ্ছে হলোনা তার মাকে লজ্জায় ফেলতে। তারপরও কথাটা মুখে আঁটকে রাখতে না পেরে বলে ফেললো,

— কিন্তু মা আমি তো সেঁজুতিকে দেখেছিলাম নাস্তা বানাতে। তুমি তো ঘুমিয়েছিলে তখন।

মারজিয়া ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে সেঁজুতির দিকে তাকালো। মারজিয়ার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দেখে সেঁজুতি মাথা নিচু করে রাখলো। সকালে সেঁজুতি যখন পানি খেতে এসেছিলো,তখনি ইভান তাকে ডেকে বলেছিলো আজকের নাস্তাটা যেনো সে বানায়। মিষ্টিভাবি নাকি কোথায় যাবে। সে অনুযায়ে সেঁজুতি সব নাস্তা বানিয়েছে।মাঝখানে এসে মারজিয়া এমন একটা মিথ্যে বলবে তা ঘুনাক্ষরেও টের পায়নি সেঁজুতি।নাহলে আগেবাগেই সাবধান থাকতো।এখন সব দোষ এসে তার গায়ে পড়বে। পরে ননস্টপ বকাবকি শুরু করবে মারজিয়া যখন ইভান আর মিষ্টি চলে যাবে। মারজিয়া অপ্রস্তুত হয়ে হাসলো।সেঁজুতির থেকে নজর সরিয়ে তীর্যক চানহি ছুঁড়লো মাথা নিচু করে মন দিয়ে নাস্তা খেতে থাকা মিষ্টির দিকে।এই মেয়ের সামনে লজ্জায় মাথা হেট হয়েছে ভাবতেই গা শিউরে উঠছে তার। হালকা কেশে ইভানকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— ওহ হ্যাঁ হ্যাঁ! আসলে বয়স বাড়ছে তো, সব কথাবার্তা এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে আমার।কিছু মনে করিস না।

মারজিয়া দ্রুতপায়ে জায়গা প্রস্থান করলো। মারজিয়া যেতেই মিষ্টি একগ্লাস পানি ঢেলে খেয়ে নিলো।মারজিয়ার সম্পর্কে কোনপ্রকার মন্তব্য ইভানের কাছে পেশ করলো না। হাজার হোক মারজিয়া ইভানের মা,সম্পর্কে তার শাশুড়ী। এতোটুকু সম্মান মিষ্টির মনে আছে বলেই মারজিয়ার সাথে কোনপ্রকার ঝগড়াবিবাদে অংশ নেয়না সে। এ পর্যন্ত অনেক চেষ্টা করেছে মারজিয়া,মিষ্টি যেনো মুখ ফুঁটে তাকে কিছু বলুক।মিষ্টি কিছু বলেওনা,মারজিয়া কোন সুযোগ ও পাচ্ছেনা।একটা কথায় সবসময় মিষ্টির মাথায় ঘুরে,সেটা হচ্ছে।’বোবার কোন শত্রু নেই।’ তাই যতো কিছুই হোক মারজিয়ার সাথে গলাবাজি করেনা সে।তবে ইভানের সাথে সবরকমের খুঁনসুটিতে সে সর্বদা প্রস্তুত।

মিষ্টি যখন নিজের ব্যাগ নিয়ে রুম থেকে বের হয়ে আসলো।তখন সেঁজুতি এসে মিষ্টির সামনে দাঁড়ালো।জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,

— কাপড়ের ব্যাগ নিয়ে কোথায় যাচ্ছো ভাবি?

সেঁজুতির কথাটা রুম থেকে শুনতে পেলো মারজিয়া।অবাক হয়ে দরজার কাছে এসে দাঁড়ালো।
মিষ্টি হালকা হেসে সেঁজুতিকে বললো,

— আমাদের বাড়িতে যাচ্ছি। আমার বাবা অসুস্থ?

— ওহ,ভাইয়া যাচ্ছে?

— না তোমার ভাইয়া যাবেনা। আমি কাল চলে আসবো আবার।

— ঠিকাছে তাহলে।

মিষ্টির কথাটা শুনে মারজিয়া হাফ ছেড়ে বাঁচলো যেনো৷মারজিয়া হুজুরকে কথা দিয়ে এসেছিলো।যেভাবেই হোক মিষ্টিকে তার হাতে তুলে দিয়ে,তার ছেলেকে চিরতরে এই মেয়ের থেকে আলাদা করে ফেলবে। এরপর সেঁজুতির সাথে বিয়েটা দিয়ে আরাম আয়েশে জীবন পার হয়ে যাবে তার। ইভানের কাছ থেকে মাস শেষে মোটা অংকের টাকা,আর সেঁজুতি নিয়মমাফিক ঘরের সব কাজকর্ম করবে। দিনশেষে সেঁজুতি থাকবে ইভানের দ্বিতীয় মাত্র স্ত্রী। যার জীবনে মিষ্টি নামের কোন নারীর বসবাস ও থাকবে না। জীবনে অনেক কষ্ট পোহাতে হয়েছে মারজিয়াকে,শুধু নিজের অশালীন স্বভাব আচরণের জন্য।এখন সেসবের দিন নেই। ছেলেমেয়ে থাকতে তার আবার কিসের কষ্ট?

ইভান গাড়ি করে স্টেশন অবধি নিয়ে এসেছে। মিষ্টি বাকিটা পথ ট্রেনে করেই যাবে। গাড়ি থেকেই নামতেই মিষ্টি উচ্ছ্বসিত কন্ঠে বলে উঠে,

— আমার আর তর সইছেনা ইভু। কতোদিন পর মা-বাবা দেখবো। আমার চিরপরিচিত জন্মস্থান। ঘরবাড়ি, আমার প্রিয় জায়গা। উফফ্…

ইভান মিষ্টির কথা একদম না শোনার ভান ধরে অন্যদিকে চেয়ে থাকলো। দশটা পনেরো ট্রেন যাত্রা শুরু হবে।হাতে আরো পনেরো মিনিট সময় আছে।ইভানের ইচ্ছে করছে এই পনেরো মিনিটে মিষ্টিকে ইচ্ছেমতো থাপড়াতে। ফাজিলটা খুশীতে আত্মহারা হয়ে আছে। ইভান বিরক্ত চোখে চেয়ে বললো,

— কি আছে তোর বাপের বাড়িতে?
আমি আছি? না আমার আদর-ভালোবাসা আছে? কিসের টানে এমন পাগলামি করছিস?

— কিসের টানে মানে? আমার মা-বাবার টানে।উনারা আমার জন্মদাতা। মাঝে মাঝে কিসব কথা বলিস না তুই।শুনলে রাগ চলে আসে।

বলেই মিষ্টি অন্যদিকে তাকালো। তার মনের মধ্যে যে আনন্দের জোয়ার উঠেছে সে জোয়ার ইভানের এমন অসভ্য কথায় নামাতে চাচ্ছে না। তার নিজের বাবা-মায়ের সাথে সম্পর্ক ভালো নেই বলে,মিষ্টিরও খারাপ হতে হবে। দুনিয়ার সব আজগুবি ভাবনা ইভানের মনে।

ট্রেন আসার সাথে সাথেই সবাই হৈচৈ করে ছুটতে লাগলো ট্রেনে উঠার জন্য। তাদেখে ইভানের বুকটা ধড়ফড় করে উঠলো। সাথে সাথে চেহারা হঠাৎ লাল হয়ে উঠেছে। মিষ্টি সেটা লক্ষ করে তাড়াতাড়ি ইভানের হাত আঁকড়ে ধরলো।

— আল্লাহ! কি হয়েছে?

আচমকা এতো লোকালয়ের মাঝখানে ইভান মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরে ফেললো। নিজেকে শান্ত রাখতে রাখতে বললো,

— কিছু হয়নি। কাল চলে আসিস প্লিজ।

— চিন্তা করছিস কেন? আমি চলে আসবো।

ইভান মিষ্টিকে ছেড়ে দিলো। এরপর মৃদ্যু হাসার চেষ্টা করলো। বললো,

— কাল আমি এখানে আবারও আসবো।
সময় মতে চলে আসবি।তুই যতক্ষণ আসবি না,আমি ততক্ষণ এখানেই থাকবো। মনে থাকবে?

— থাকবে, থাকবে,থাকবে। হ্যাপি?
এখন যা তোর অফিসে লেট হবে।

মিষ্টিকে ট্রেনে তুলে দিয়েই ইভান অনেক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলো। বুকের মাঝখানে ফাঁকা হয়ে আসছে ধীরে ধীরে। মিষ্টি জানালা দিয়ে যতদূর দেখা যায় ইভানকে ততদূর দেখতে লাগলো। ইভানের ম্লানমুখটা দেখতে কেমন যেনো হৃদপিণ্ডটা ধুকপুক করতে লাগলো।এভাবে বিদায় নিয়ে কখনো ইভানের কাছ থেকে আসা হয়নি। আজ প্রথম।সেজন্য ইভানের অবস্থাটা এমন হয়েছে। মিষ্টি মনে পড়ে গেলো তাদের সম্পর্কের ছয়মাসের মাঝামাঝি সময়ের একটা ঘটনা।হঠাৎ একদিন কাউকে না জানিয়েই মিষ্টিকে গ্রামে আসতে হয়। মিষ্টির দাদির অসুস্থতার কারণে।মাঝে তিনদিন গ্রামে কেটে গেলো। সবচেয়ে খারাপ ঘটনা হলো মিষ্টির ফোন হারিয়ে যাওয়াটা। ঢাকা ফিরতেই সেদিন ইভানের মুখোমুখি হতেই ইভানের শক্ত হাতের চার-পাঁচটা চড় খেতে হয়েছিলো মিষ্টিকে। মিষ্টির দোষ সে ইভানকে বলে যায়নি। সাথে ফোন দিয়ে জানানো ও হয়নি। ক্ষেপাটে ইভান এতোগুলো চড় মেরে সেদিন কেঁদেই দিয়েছিলো। এরপর থেকে মিষ্টি উপলব্ধি করলো সে কখনোই ইভানকে ছাড়তে পারবেনা।যদি জীবনে এমন কোন সময় আসে যে ইভানকে ছাড়তে হবে তখন হয়তো ইভান তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়ে ফেলবে। অতীতের স্মৃতিপাতা উল্টাতে উল্টাতে নিজের গন্তব্যের দিকে ছুটতে লাগলো মিষ্টি।

(চলবে)
___________
© তারিন _জান্নাত।

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে