~কাছেপিঠে~
পর্বসংখ্যাঃ১৪
কালকের তুলনায় আজকের পরিবেশ একদম নিস্তব্ধ। নেই কোন হৈ-হুল্লোড়।একদম থমথমে পরিবেশ।সেঁজুতির অবশ্যই বেশ ভালো লাগছে। তার ফুফি এখন বাসায় নেই। এই সুযোগ, মিষ্টি ভাবিকে সব জানাতে হবে। কাঁচের গ্লাসগুলো ভালোমতো ধুয়ে টেবিলের উপর রাখলো সেঁজুতি। দরজার দিকে চোরা দৃষ্টিতে চাইলো।এরপর দৃষ্টিপাত করলো কিচেনে দাঁড়িয়ে পেঁয়াজ কাটতে থাকা মিষ্টির দিকে। অকারণেই মিষ্টির সাথে তার ভাব কম। সেঁজুতি যথেষ্ট চায় মিষ্টির সাথে ভাব জমাতে।মিষ্টিই তাকে এড়িয়ে গিয়েছে।হয়তো ফুফির জন্যেই মিষ্টির তার সাথে কথা বলতেই সাচ্ছন্দ্যবোধ করেনা।
সেঁজুতি দৃঢ়পায়ে এগিয়ে এসে মিষ্টির পাশে দাঁড়ালো। কড়াইয়ে গরম হতে থাকা তেলের দিকে দৃষ্টি রেখে সেঁজুতি নিভু স্বরে বললো,
— ভাবি একটা কথা বলবো?
আচানক সেঁজুতির এমন কথায় বুকের ভেতর একটা মোচড় খেলো মিষ্টি। কেটে রাখা পেঁয়াজ তেলে ছেড়ে দিয়ে বললো,
— হুম! বলো কি বলতে চাও শুনি।
সেঁজুতি খপ করে মিষ্টির হাতটা ধরলো।দরজার দিকে ভয়ার্ত দৃষ্টিতে চেয়ে বললো,
— ভাবি তুমি আমার কথাটা বিশ্বাস করো প্লিজ।
ফু-ফুফি,মানে আমার ফুফি তোমার ভালো চায়না। তোমাকে মে-মেরে ফেলতে চায়।
মিষ্টি ভ্রূ কুঁচকে অবাক চোখে তাকালো সেঁজুতির দিকে। ইভানের মা তার ভালো চায়না,সেটা সে অনেক ভালো মতো জানে।কিন্তু সেঁজুতির মুখে সেকথা শুনে অবাক হলো মিষ্টি। হাজার হোক,ফুফির ভাতিজি তো ফুফির পক্ষেই থাকবে। কিন্তু এমনটা কেন হয়েছে ভাবতে থাকলো মিষ্টি। মনেমনে সেঁজুতিকেও নিজের বিরোধী পক্ষের ভাবতো।অথচ আজ?
মিষ্টি সেঁজুতির হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে বললো,
— আমি জানি তোমার ফুফি আমার ভালো চায়না।
কিন্তু তুমি কেন সেকথা বলছো?
— বলছি কারণ আমি চাইনা চোখের সামনে এতো সুন্দর একটা সম্পর্কেের বিচ্ছেদ ঘটুক।
এ পর্যায়ে এসে মিষ্টির মুখটা কঠিনরূপ ধারণ করলো। সেঁজুতির কথাটা গায়ে লেগেছে তার। আন্দাজ করতে পারলো তার শাশুড়ি নিশ্চয় কোন তালগোল পাকাচ্ছে। যার সাক্ষী সেঁজুতি নিজে,আর সেজন্য তাকে সাবধান করতে এসেছে। বেশ,মিষ্টিও এবার দরজার দিকে তাকালো, এরপর বললো,
— কি বলতে চাইছো তুমি?
— ভাবি তুমি হয়তে জানোনা,ফুফি ইভান ভাইয়ার জন্য সবসময় তাবিজ করে,যাতে তোমার সাথে সম্পর্ক ভালো না হয়ে খারাপের দিকে যায়।
মিষ্টির বিষ্ময় আকাশ ছুঁয়ে গেলো। সে চোখ বড় করে চেয়ে বললো,
—- কি বলো? কিভাবে সম্ভব এসব?
— ফুফির জন্য সব সম্ভব।
একটা কথা বলি কাউকে বলবেন না। ফুফির মানসিক সমস্যা আছে।কারো একটা ভালো সুন্দর নির্ভেজাল বৈবাহিক জীবন দেখলে ফুফির হিংসা হয়। উঠেপড়ে লেগে যায় সে সম্পর্ককে শেষ অবধি নিয়ে যেতে।
মিষ্টি বললো,
— এটাকে তোমার মানসিক সমস্যা মনে হচ্ছে?
আরে এটা তো হিংসাপরায়ণ মহিলার নমুনা মাত্র।আমি ভেবেছি শুধু আমাকে সহ্য করতে পারেনা,এখন দেখছি আরো কয়েকজনের সাথে এমন করেছে।
আর কার সাথে করেছে এমনটা তুমি জানো?
— জানি, ফুফির ছোট বোনের সাথে।যিনি এখন ইভান ভাইয়ার আব্বুর দ্বিতীয় স্ত্রী। সেসব অনেক কাহিনী ভাবি তোমাকে বলে শেষ করা যাবে না।তুমি আমার কথা মন দিয়ে শুনো।
বাহ্যিক কথা বলে সময় নষ্ট করে, মূল কথাটা বলার সময়ে হঠাৎ হাজির হলো মারজিয়া। ফুফিকে দেখে ভয়ে আত্মা শুকিয়ে এলো সেঁজুতির।উপায় না পেয়ে হঠাৎ চেঁচিয়ে মিষ্টিকে বলে উঠলো,
— কখন থেকে তোমাকে বলছি, আমায় নুডুলস বানিয়ে দাও।আমার কথা কানে যায় না,আশ্চর্য!
তুমি নিজের মতোই রান্না করে যাচ্ছো।
মিষ্টির মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো সেঁজুতির কথায়। এতক্ষণ ভালোমানুষি হওয়ার অভিনয় করছিলো তাহলে। হঠাৎ চোখের ইশারায় দরজার দিকে তাকাতেই সব পরিষ্কার বুঝলো মিষ্টি।জাদরেল মহিলা। আসার সময় একটা শব্দ পর্যন্ত হয়না।
সেঁজুতি হনহনিয়ে ড্রয়িং রুমে চলে আসলো। ধপ করে বসে পড়লো সোফায়। সেঁজুতি অভিনয় দেখে ঠোঁট চেপে হাসলো মিষ্টি। এক মুহূর্তের মধ্যেই হঠাৎ সেঁজুতিকে নিজের ছোট বোনের জায়গায় বসিয়ে ফেলেছিলো মিষ্টি।এখন দেখলো,কাজটা তার করা ভুল হয়নি।এমন একটা ছোটবোন তার আসলেই প্রয়োজন।
মারজিয়া আগুন চোখে মিষ্টির উপর চেয়ে সেঁজিতির পাশে বসলো। মারজিয়া সেঁজুতির পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললো,
— তোর নুডুলস খেতে মন চাচ্ছে,আমাকে বলবিনা।
অথবা,নিজে বানিয়ে খেতে পারলিনা? পরের আশায় কেন বসে ছিলি?
— পরের আশায় নয় ফুফি। আমার নিজের হাতে বাননো খেতে আর ভালো লাগছেনা।তাই ভাবিকে বলেছিলাম।থাক বাদ দাও কাল বানিয়ে খাবো। আমি তো আসলে এমনিই খেতে চেয়েছিলাম।
এরপর মৃদু আওয়াজে সেঁজুতি মারজিয়াকে জিজ্ঞেস করলো,
— ফুফি কি কথা হয়েছে হুজুরের সাথে?
মারজিয়া আলতো করে সেঁজুতির গালে চড় লাগালো। ঠোঁটের কোণে দাম্ভিক হাসি। বললো,
— রুমে আয়,বলছি।আজ আমার মন ভীষণ ভালো।
রান্নাবান্না শেষে মিষ্টি রুমে আসলো। গায়ের ওরনাটা পাশে রেখে শরীরের ঘাম শুকাতে লাগলো। কারণ একটু পরেই সে গোসলে ঢুকবে। বাইরে থেকে ফিরেছে মাগরিবের পর।তখন নামাযের সময়টা ছিলোনা। তাই কিচেনে গিয়েছিলো সব ঠিকঠাক আছে কিনা দেখতে।কিন্তু কিচেনের অবস্থা ভালো থাকলেও রান্না করা তরকারি সব নষ্ট হয়ে পড়েছিলো। সব ফেলে দিয়ে, পরিষ্কার করে একেবারে রান্না সেরে রুমে আসলো।
মিষ্টি কাপড় নিতে নিতে ইভানের দিকে তাকালো।ঘুমে বিভোর হয়ে থাকা ইভানের দিক থেকে চোখ সরিয়ে নিলো। ওয়াশরুম এসে কাপড় রেখে সর্বপ্রথম ফেইস ওয়াশ দিয়ে হাতমুখ ভালোভাবে ধুয়ে নিলো। দরজায় হালকাভাবে ঠোকা পড়লো। মিষ্টি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো এখন আর দরজা খুলবেনা। বিধিবাম,
তৎক্ষনাৎ উচ্চ শব্দে দরজা ধাক্কাতে লাগলো ইভান।
মিষ্টি গলা আওয়াজ বাড়িয়ে বললো,
— গোসল করছি,বিরক্ত করিস না তো।
—আরে আজব! তোর জন্য আমি গোসল না করে বসে আছি।আর তুই আমাকে না ডেকেই গোসলে ঢুকে পড়েছিস।
— কখন বসেছিলি? তুই তো ঘুমোচ্ছিলি।
— দরজা খুলতো। মেজাজ খারাপ হচ্ছে কিন্তু আমার।
— হোক তো,যা এখন।মাথা আমারটা তোর চেয়ে আরো গরম বেশি।
ইভান সত্যি সত্যি মিষ্টির কথায় মন খারাপ করে চলে আসলো।ফোন হাতে নিয়ে বিছানায় বসলো। ভীষণ কষ্ট পেয়েছে আজ মিষ্টির কথায়। মিষ্টির সাথে আর কখনো কথা বলবেনা এমন একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলো।তখনি দরজা খুলে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে আসলো মিষ্টি৷ বিছানার কাছে মনমরা হয়ে বসে থাকা ইভানকে দেখে বেশ হাসি পেলো তার। তবে হাসা যাবেনা। ইভান টের পেলে তার আর আস্ত রাখবেনা। মিষ্টি ইভানের সামনে এসে দাঁড়ালো।ইভান মনোযোগ দিয়ে ফোন দেখে যাচ্ছে। চোখ তুললো না৷
মিষ্টি বুঝলো ইভানের রাগ হয়েছে। তাই ফ্লোরে বসে ইভানের পা দুটো ধরে ফেললো। অকস্মাৎ, ফোন ফেলে দিয়ে হুড়মুড়িয়ে পা তুলে ফেললো ইভান।মিষ্টির দিকে তীক্ষ্ণ চোখে চেয়ে বললো,
— পা ধরছিস কেন?
— আমার স্বামীর পা আমি ছুঁয়েছি।
তাতে তোমার কি সমস্যা? স্ত্রী-রা তো স্বামীর পা ছুঁতেই পারে।
—- স্ত্রীরা ধরুক’গে তাদের স্বামীর পা।তুই ধরবিনা।
মিষ্টি ঠোঁট চেপে হাসি আঁটকালো। এরপর ন্যাকা স্বরে পূনরায় কথা বলতে শুরু করলো।তার ভালো জানা আছে ন্যাকা স্বরে,ন্যাকাভাবে কথা বলা ইভানের একদম পছন্দ না। মিষ্টি ইভানের পাশে বসে বললো,
— ওগো,তুমি রাগ করে থেকোনা।
তুমি রাগ করলে আমার বুক ফেঁটে যায়।
— উফফ! কি শুরু করেছিস বলতো?
তুমি বলছিস কেন? মাথা খারাপ হচ্ছে আমার।
এটা শুনতে ভালো লাগছেনা।
— না না,তুমি মাথা খারাপ করো না।আজ থেকে
আমি তোমাকে তুমি বলেই ডাকবো ইভান সাহেব। হ্যাপি?
ইভানের চোখ জ্বলতে শুরু করলো।কষ্টটা কোথায় এবং কি নিয়ে হচ্ছে বুঝতে পারছেনা। তবে মিষ্টির এই ‘তুমি’ সম্বোধনটা সে মানতে পারছে না। বুকের ভেতর অস্বাভাবিক যন্ত্রণা হচ্ছে।যেনো বহু পুরনো দিনের শখের কিছু হারিয়ে ফেলেছে। শেষে এসে ইভান ভালো মতো বুঝতে পারলো তার এমন কেন লাগছে। অনেকদিনের অভ্যাসটা মিষ্টি আজ প্রথমবারের মতো পরিবর্তন করেছে। যে পরিবর্তনটা ইভান মন থেকে মানতে পারছেনা। ইভান কেন,মিষ্টিও মানতে পারবেনা এই পরিবর্তন কখনো।শুধু ইভানকে বাজিয়ে দেখতে কথাটা বললো।মিষ্টির ও কেমন দমবন্ধ হয়ে আসছিলো এতক্ষণ ধরে।’তুমি’ শব্দাটা এতো ভারী কেন তাদের জন্য?
ইভান আলগোছে মিষ্টির হাতটা ধরে বললো,
— তওবা করছি।আর কোনদিন আমাকে ‘তুমি’ করে বলতে বলবো না। আমি জানি তুই সেদিনের কথাটা মনে রেখে দিয়েছিস আজও।সেজন্যেই আজ ‘তুমি’ করে বলছিস। বিশ্বাস কর, আমি সহ্য করতে পারবো না,আমার মিষ্টি আমাকে তুমি করে ডাকলে। তারচেয়ে আমার জন্য ‘তুই’-ই বেটার।
মিষ্টি হাসলো সুন্দর করে। এতো সুন্দর হাসিটা দেখে ইভানের মাথা ঘুরে গেলো। সে শক্ত করে ধরে রাখলো মিষ্টির হাতটা। হাতের বলিষ্ঠ চাপের ভাষা বুঝতে দেরী হয়না মিষ্টির। সেও সায় দিলো ইভানের ইঙ্গিতে।
(চলবে)
____________
©তারিন_জান্নাত
~কাছেপিঠে~
পর্বসংখ্যাঃ১৫
ভোর অনুমানিক পাঁচটা। সেঁজুতি দাঁড়িয়ে আছে ইভান আর মিষ্টির দরজার সামনে। হাতের সবুজ রঙের প্লাস্টিকের একটা বোতল। এ বোতলে হুজুরের পড়ানো পানি আছে। পানি জায়গা মতো ছিটাতে হবে তাকে।অর্থাৎ তার ফুফির কড়া আদেশ,পড়ানো পানি অবশ্যই যেনো ইভানের দরজার সামনে ছিটিয়ে দেয়। মিষ্টি যখন সকাল বেলা রুম থেকে বেরুবে। তখন যেনো পানির স্পর্শ তার পায়ে লাগে। এ কাজটা টানা দিনদিন ধরে করতে হবে।
সেঁজুতি ঘুম ঘুম চোখে মারজিয়ার ঘরের দিকে তাকালো। তার এই মুহূর্তে ইচ্ছে করছে পানি সব মারজিয়ার ঘরের সামনে ঢেলে দিতে। অথবা বাইরে ফেলে দিতে। কিন্তু সেটা নাকি সম্ভব নয়। পানি যদি অন্যত্রে ফেলে দেয়া হয় তাহলে নাকি হুজুর প্রচণ্ড ক্ষেপে যাবেন। হুজুরকি তাকে চোখে চোখে রাখছে?
সেঁজুতি ভেতরে উথাল-পাতাল ঝড় শুরু হয়ে গেছে।এই কাজটা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। তারপরও সে একটা ক্ষুদ্র প্রচেষ্টা চালাতে প্রস্তুত।মারজিয়া ওয়াশরুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করতেই সেঁজুতি বোতলটা সোফার তলায় লুকিয়ে রাখলো। এরপর জগ থেকে পানি এনে সব দরজার সামনে ঢেলে দিলো। অন্য একটা সবুজ বোতলে অর্ধেক করে পানি ভরে নিলো ঝটপট। একটু পর মারজিয়া এসে দেখলো দরজার সামনে পানি ছিটানো। তা দেখেই হাসলো মারজিয়া৷সেঁজুতির হাত থেকে বোতলটা নিয়ে বললো,
— যাক ঢেলেছিস তাহলে। তোকে দিয়ে কেন ঢালিয়েছি জানিস?
সেঁজুতি উত্তরে ছোট করে বললো,
— না।’
মারজিয়া হেসে বললো,
— হুজুরের নিষেধ ছিলো।
— ওহ! এখন কি হবে ফুফি?
— বেশি কিছু নয়, টানা তিনদিন এই পানি দিয়ে ওই মেয়ে হেঁটে বেরুলে আসল কাজটা হয়ে যাবে। শরীর ধীরে ধীরে অকেজো হয়ে যাবে। মানসিক চাপ বাড়বে। দুর্বল হয়ে যাবে।এরপর আস্তে আস্তে…
সেঁজুতি একটা ঢোক গিললো। মিষ্টির যদি কিছু হয়ে যায় তাহলে তার কি হবে? তার তো একটা সুন্দর পরিপাটি এবং পরিপূর্ণ সংসারে আশা-আকাঙ্ক্ষা আছে। তার ভালোবাসার মানুষটা তার অপেক্ষায় আছে। এমতাবস্থায়, মিষ্টি ভাবির কোন ক্ষতি হলে তার কি হবে?
সেঁজুতি একজনকে ভালোবাসে। ছেলেটা বেকার। বেকার বলতে পাকাপোক্ত কোন চাকরি নেই।শুধু চার-পাঁচটা টিউশনি করায়। সেঁজুতির বাবা এ সম্পর্কের কথা জানতে পেরে সেঁজুতিকে প্রচুর মারধর করে। এবং পাঠিয়ে দেয় বড়বোন মারজিয়ার কাছে। মারজিয়া বলেছিলো সেঁজুতির বিয়ে উচ্চ কোন এক পরিবারে দিবে। ছেলের অবশ্যই টাকা-পয়সা থাকবে। লোভে পড়ে সেঁজুতির বাবা মেয়েকে বোনের কাছে পাঠিয়ে দেয়,যাতে বোনের সংসারে কাজকর্ম করতে পারে।আর ওই বেকার ছেলেটাকে ভুলতে পারে। এসবের মধ্যে সেঁজুতি শুধুমাত্র এহসানের সাথে ঘর করতে চায়। আর সেজন্য ইভান আর মিষ্টির সাহায্য প্রয়োজন।যাদের সাহায্য তার প্রয়োজন তাদের ক্ষতি তো সে মেনে নিতে পারেনা।
মিষ্টি আজ সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠলো। কলেজে যাওয়ার আগেই তাকে রান্নাবান্নাটা করে রাখতে হবে। আজ আফিন আর রাইদার আসার কথা।সাথে জুঁই আর মুহিত। মাছ-মাংসের আইটেম এখন রেঁধে রাখলে,বিকেলে এসে নাস্তাপানি আর পোলাও,আর সাদা ভাতটুকু রাঁধবে।
মনে মনে হরেক রকম পরিকল্পনা করার পর, নিজেকে ইভানের বাহুবন্ধন থেকে ছাড়ানো শুরু করলো। চোখের ঘুমটা একেবারে নেই। কিন্তু ইভানটা যেভাবে ধরে আছে। মিষ্টি আলতো করে মৃদু আওয়াজে ডাকলো কয়েকবার। পিঠে হালকা চাপড় মারলো। হাত শক্ত করে ধরে ছাড়াতে চাইলো। ইভান কোনপ্রকার সাড়া দিলো না। সে চোখবুঁজে রাখলো। বাকি থাকলো ইভান ক্লিনসেভ করা গালটা। মিষ্টি এবার ইভানের গালে সজোরে থাপ্পড় মেরে দিলো। হালকা হয়ে আসা ঘুমটা এক থাপ্পড়ে ভেঙে গেলো ইভানের। মিষ্টিকে ছেড়ে হুড়মুড়িয়ে উঠে বসলো সে। চোখ টান টান রেখে মিষ্টির দিকে দৃষ্টিপাত করলো। মিষ্টি তখন গোল গোল চোখ করে চেয়ে আছে।
—- বেয়াদ্দপ কোথাকার। এভাবে চড় মারলি কেন?
— চড় না মেরে চুমু খাবো? কতক্ষণ ধরে ডাকছি শুনতে পাচ্ছিলি না?
— আস্তে ডাকলে কি করে শুনবো?
জোরে ডাকিসনি কেন?
মিষ্টি উঠে বসলো। খোলা চুলে খোঁপা করতে করতে বললো,
— তোকে জোরে ডাকবো?
মনে নেই শেষবার কিভাবে আমার গলা চেপে ধরেছিলি?
ইভান আর একটা কথাও বললো না।হঠাৎ করে চুপ হয়ে গেলো। মন খারাপ করে বিছানা থেকে নেমে গেলো। তখন তার কি হয়েছে সে নিজেই জানেনা। শুধু মিষ্টিকে সহ্য করতে পারতো না।মিষ্টিকে দেখলেই রাগ চলে আসতো মনে। মিষ্টির একটা ভালো কথাও তখন বিষাক্ত লাগতো। আজ এতদিন পর খোঁচাটা খেয়ে মন খারাপ হয়ে গেলো ইভানের। এখন তো সেই আগের মতো রাগটা নেই,এখন তো সে চোখে হারায় মিষ্টিকে।তখন সমস্যাটা কোথায় ছিলো সেটা অজানা থেকে গেলো ইভানের। সকাল সকাল ইভানের ম্লান হয়ে যাওয়া মুখটা দেখে মিষ্টিরও খারাপ লাগলো। সে ভাবলো ইভানকে কিছু না কিছু বলে মন খারাপ দূর করে দিবে।কিন্তু ইভান সেই সুযোগটাও দিলো না। সোজা বারান্দায় চলে গেলো।
হাতমুখ ধুয়ে ওজু করে নামাযটা পড়ে নিলো মিষ্টি।এরপর তোড়জোড় শুরু করলো রান্নার।তন্মধ্যে দরজার নিচে অবহেলায় পড়ে থাকা পানির স্পর্শ পায়ে লেগে গেলেও,ফ্লোরে পানি আসার কারণটা মনে আসলো না মিষ্টির।
নাস্তা হাতে নিয়ে রুমে আসলো মিষ্টি।ইভান তখন অফিসে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছিলো। বেচারা,মুখের অবস্থাটা করুণ করে রেখেছে। অতীতের করা ভুলটা বর্তমানেও তাকে বেশ পুড়াচ্ছে। তার লক্ষণ ইভানের চেহারায় দৃশ্যমান। ইভান নিজের সমস্যাটা কোথায় বুঝতে পারছেনা। ঘটনাতো অনেক আগের,মিষ্টির কাছে সে ক্ষমা চেয়েই এতদূর এসেছে। আজ হঠাৎ সূক্ষ্ম একটা চাপা রাগ কেন আসছে মিষ্টির প্রতি বুঝতে পারলো না।
ইভানের মুড ওফ্ফ দেখে মিষ্টি আর কথা বাড়িয়ে৷ পরিস্থিতি জটিল করলো না। নাস্তার প্লেটটা ড্রেসিং টেবিলের সামনে রেখেই চলে আসলো। গোসল করে আজ আর শাড়ি পরলো না। কুচকুচে কালো রঙের একটা থ্রি-পিস পড়লো। কালো রঙটা মিষ্টিকে বেশ মানায়। ইভান আঁড়চোখে দেখতে লাগলো। মিষ্টির হাবভাব দেখে বুঝলো মিষ্টি আজ তার সাথে যাবেনা। ইভান চুপচাপ নাস্তার প্লেট হাতে নিয়ে বিছানায় বসলো। মিষ্টি হিজাব বাঁধতে বাঁধতে চাপা হাসলো।
সেটা লক্ষ্য করে ইভান বললো,
— তুই কি ভাবছিস? এভাবে সাজলে তোরে যুবতী লাগবে? তোরে তো হরহামেশা দেখতে বুড়ির মতো লাগে।তারচেয়ে শাড়ি পড়ে নিজেকে বুড়ি বানিয়ে রাখা বেটার।
— উহুম! আমার বয়স কতো রে?
— আটাশ বছর তিনমাস?
— হুম,আর তোর?
— আটাশ বছর এগারো মাস।
— তো কে বুড়ো? বয়সের দিক দিয়ে?
— ধূর! পুরুষমানুষ বুড়ো হয় নাকি? পুরুষদের বয়স সহজে ধরা যায় না।
— আমার বয়স নিয়ে চিন্তা করিস না।
তোর বয়সের দিকটা খেয়াল রাখ।কোনদিন না-জানি দাঁড়ি-চুল সাদা হয়ে যায়।
— সর তো, মেজাজ খারাপ হয় তোর কথা শুনলে।
ইভান প্লেটটা নিয়ে বেরিয়ে গেলো। ইভান যেতেই মিষ্টি হেসে ফেললো। ইভান নিচে মিষ্টির জন্য দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো। মিষ্টি এসে দাঁড়াতেই হঠাৎ ইভানের ফোনে একটা কল এলো। বেজায় বিরক্ত হয়ে ফোনের স্ক্রিনের দিকে তাকালো।মুহিতের ফোন দেখে রিসিভ করলো সে। অপাশ থেকে অত্যন্ত অস্থির কন্ঠে মুহিত বললো,
— হ্যালো ইভান! শুনতে পাচ্ছিস? শোন,
দ্রুত তুই আর মিষ্টি এভার খেয়ার হসপিটালে চলে আয়।
— কেন কি হয়েছে?
— আর বলিস না,সিঁড়ি থেকে পড়ে গিয়ে জুঁইয়ের পা আর কোমড় ভেঙেছে। ইমিডিয়েটলি ওকে হসপিটালে নেয়া হয়েছে।
ইভানের বলতে ইচ্ছে করছে,- আলহামদুলিল্লাহ, শুধু পা আর কোমড় ভেঙেছে? হাত-মুখ এগুলা ভাঙতে পারে নাই৷ অন্তত তার চিপকামির স্বভাবটা দূর হতো।
শুধুমাত্র মিষ্টি পাশে আছে বলে বলার সাহস পেলো না।নাহয় আবার তার দিকে সন্দেহের তীর ছুঁড়বে।
মুখে বললো,
— আচ্ছা রাখ,আসছি আমরা।
(চলবে)