কাছেপিঠে পর্ব-১২+১৩

0
740

~কাছেপিঠে~
পর্বসংখ্যাঃ১২

সকাল সকাল গোসলের পরের সময়টা ভয়াবহ রূপ ধারণ করলো আজ। মিষ্টি ওয়াশরুমের দরজায় দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসছে। তীক্ষ্ণ, শক্ত চেহারায় সূক্ষ্ম অভিমান স্পষ্ট। ভেজা শরীর নিয়ে দরজার দ্বারে দাঁড়িয়ে রইলো শক্ত হয়ে। দৃষ্টি ইভানের হাস্যজ্বল চেহারার দিকে। ইতিমধ্যে ইভান নতুন কেনা শার্ট আর প্যান্ট পড়ে ফেলেছে। শার্টের বাটন লাগাতে লাগাতে বিছানার উপর এসে বসলো। টাওয়েল হাতে নিয়ে ভালোভাবে চুল মুছতে লাগলো।
প্রচণ্ড শীত লাগছে এবার মিষ্টির। এতক্ষণ বাঘিনীর মতো গর্জালেও এবার গলার স্বরটাও কাঁপছে ঠাণ্ডায়। উপায়হীন হয়ে গলার স্বরটা মৃদুভাবে রেখে মিষ্টি বললো,

— তুই রাতে বলেছিলি আমার জন্যও কাপড় আনিয়েছিস।আর এখন বলছিস আমার জন্য কাপড় আনা হয়নি। মিথ্যে বলেছিলি কেন তাহলে?

ইভান টাওয়েল দিয়ে মুখ মুছতে মুছতে নিজের হাসিটাকেও আঁড়ালে চেপে রাখলো।টাওয়েল সরিয়ে মিষ্টির দিকে চেয়ে বললো,

— বলেছিলাম তো তোকে পাওয়ার জন্য।
এখন তো তোর প্রয়োজন নেই।তাই তোর জন্য এক্সট্রা পোশাক আনার কথাটাও খেয়ালে ছিলো না।স্যরি…

— তুই এতো নির্দয়? এখন আমি কি পরবো?
আগে বললে আমি অন্য উপায় খুঁজতাম। আচ্ছা থাক এভাবেই থাকি। একটু ঠাণ্ডা লাগবে।এ আর এমন কি?

মিষ্টির কোমল মোলায়েম স্বর শুনে ইভান ঠোঁট চেপে হাসি আঁটকে রেখে সুগভীর দৃষ্টিতে তাকালো,বললো,

— উফফ! আমার মিষ্টি এতো কিউট করে কথা বলতে পারে জানতাম না তো।আই লাভ ইট।
দাঁড়া দাঁড়া তোর জন্য কিছু আছে কি না দেখি।

ইভান খাটের নিচে হাত গলিয়ে একটা শপিংব্যাগ বের করলো। এরপর সটান হয়ে উঠে দাঁড়ালো। শপিংব্যাগ থেকে মিষ্টি ভেতরে ভেতরে খুশীতে ফেঁটে পড়লো। মিষ্টির বিশ্বাস হয়নি ইভান তারজন্যও একসেট পোশাক আনিয়ে রাখবে। মনে মনে ইভানের সারামুখে চুমুর বর্ষণ ঢেলে দিলো মিষ্টি। নিজেকে সামলে দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকালো মিষ্টি। এখন বাজে সকাল ছয়টা আটাশ।প্রায় দশমিনিট ধরে তাকে ভেজা কাপড়ে দাঁড়িয়ে ছিলো সে এতক্ষণ।

ইভান হাতের ব্যাগটা দাঁড়িয়ে থেকেই মিষ্টির দিকে ছুঁড়ে মারলো। সে একশোভাগ নিশ্চিত এখন মিষ্টির হাতের নাগালে গেলেই সে তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে,নয়তো তাকে ভিজিয়ে দিবে। কাপড় পাওয়ার সাথে সাথে মিষ্টি হন্তদন্ত হয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে পড়লো। মিনিট পাঁচ সময় না গড়াতেউ কাপড় পড়ে দরজার বাইরে হাজির। প্রচণ্ড অস্থির হয়ে আশেপাশে চেয়ে কিছু খুঁজতে লাগলো। ইভান মিষ্টিকে এদিক-ওদিক তাকাতে দেখে বললো,

— পাচ্ছিস না কিছু? ওয়েট আমি খুঁজে দিচ্ছি।

ইভানও ব্যস্ত হয়ে মিষ্টিকে কিছু খুঁজে দেওয়ার ভান করতে লাগলো।ইভানের ফাইজলামি চট করে ধরে ফেললো মিষ্টি। তাতেই তেতে উঠলো সে। আশেপাশে কিছু না পেয়ে দাঁতের সাথে দাঁত চেপে রাগ দমন করতে লাগলো। ইভান হাসতে হাসতে পূনরায় বিছানায় এসে বসে পড়লো। বললো,

— কি দুঃখ! এখন আমাকে মারবি কিভাবে?
কিছুই তো নেই। আহারে,বাইরে একটা বড়সড় ফুলদানি আছে।ওটা আনবো? মারতে পারবি?

মিষ্টি ইভানের কথার প্রত্যুত্তর করলো না। চুপচাপ অপরপাশে এসে টাওয়েল টা নিয়ে চুল বেঁধে ফেললো। মিষ্টি বিছানায় বসতে গেলেই ইভান বলে উঠে,

— কাপড় ফিট হয়েছে? জিজ্ঞেস করবি না মাফ কি করে জানলাম?

মিষ্টি এবারও চুপ মেরে থাকলো। বেশ ভালোই ঢঙ করতে জানে ইভান।তাই প্রতিক্রিয়া দেখালো না।

—- সোজা হয়ে দাঁড়াতো,তোকে দেখি একটু!

মিষ্টি ধপ করে বিছানায় বসে বললো,

—- অসভ্যের মতো থাকা’বিনা একদম।

ইভান পুরোপুরি মিষ্টির দিকে ফিরে মুখোমুখি হয়ে বসলো। এরপর বললো,

— অসভ্য তো তুই।কখনো ভালো হবি না।
সারাজীবন শুধু আমাকেই জ্বালিয়ে মারবি।

ইভান কথাটা মজার ছলে বললেও,ওষুধের মতো কাজে দিলো। মিষ্টি একটা কথা বললো না আর।
নাস্তার আসার পরও চুপচাপ খেলো,ইভান স্বভাব মতো তার কথা চালিয়ে রেখেছে। ইভান ফোনটা পকেটে রেখে দিলো।ঘড়ি হাতে নিয়ে মিষ্টির হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললো,

— পড়িয়ে দে।তোর দায়িত্ব এড়িয়ে যাচ্ছিস তুই।

ঘড়িটা পড়িয়ে দিয়ে হনহনিয়ে রুমের বাইরে চলে এলো মিষ্টি। এতক্ষণ পর ইভান বুঝলো মিষ্টি তার কথাটা সিরিয়াসলি নিয়ে ফেলেছে।কি মুশকিল!

ইভান পেছন পেছন বেরিয়ে এলো। মিষ্টি ততক্ষণে গেইট পেরিয়ে মেঠো পথে পা রেখেছে। কাল ভয়ে-আতঙ্কে মিঁইয়ে গিয়েছিলো, আর আজ?
মাটির রাস্তায় গিয়ে হাঁটার গতি কমিয়ে ফেললো মিষ্টি। সেটা দেখে হাসলো ইভান। রিসেপশনিস্টের কাছে বিল পেমেন্ট করে নিলো। গাড়িটা তাদের এখানেই রাখবে।যাওয়ার সময় নিয়ে যাবে।

মিষ্টি ইভানের চেয়ে দশকদম এগিয়ে হাঁটছে। ইভান একদম পেছনে। সেও একটা সলিট প্ল্যান করে ফেলেছে। সামনে কিছুটা দূরে এগুলেই চায়ের দোকান। মিষ্টিকে নাস্তানাবুদ বানানোর প্ল্যানটা তাহলে স্টার্ট করতেই হবে। ইভান পেছন থেকে গলার স্বরে জোর দিয়ে গেয়ে উঠলো,

~” বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে আমার!~
~বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে আমার,
লাগে না ভালো আর…~

গানটা শুনে মিষ্টির ইচ্ছে করলো ভুলটা শুধরে দিতে।নাকি ইভান ইচ্ছে করেই এভাবে গেয়েছে কে জানে। তারপরও নিস্তব্ধ থাকলো মিষ্টি।এতোই যখন তাকে জ্বালাচ্ছে,তাহলে এখন ফাঁকা লাগছে কেন?

দোকানের সামনে আসতেই মিষ্টির পা থেমে গেলো। পেছন ফিরে তাকালো। ইভান আসছে,হাতদুটো পকেটে রাখা,দৃষ্টি তার উপরেই তাক করা। মিষ্টি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মৃদু হেসে সামনে এগুতে লাগলো। বিধিবাম, ইভান চায়ের দোকানে গিয়ে ঢুকে পড়লো। ইভানের কন্ঠস্বর শুনে পেছন ফিরে তাকালো মিষ্টি। এবার মিষ্টি পড়লো বিপাকে, ইভান না আসলে এগোতেই পারবেনা সে।এতক্ষণ ইভান ছিলো তাই আলাদা একটা সাহসী-শক্তি তার।এখন সব শূন্যে নেমে এলো। মিষ্টি করুণ মুখ করে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকলো।

ইভান দোকানির সাথে আড্ডায় বসে গেলো। আরো এক কাপ চা দিতে বলে মশগুল হলো কথাবার্তায়।সেখানে আরো লোকজন আছে। ইভান মিটমিট হেসে মিষ্টিকে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলো। বেশ তো এতক্ষণ আগে আগে তাকে রেখে চলে যাচ্ছিলো। এখন ভয়ে আর এগোতে পারছেনা।চেনা পরিচিত জায়গা হলে এককথা,মিষ্টি এখানকার কিছুই চিনে না। এজন্য সে ভয়ে এগোতে পারছেনা।ইভানের বেশ মজা লাগছিলো মিষ্টিকে এভাবে দেখে।সাতাশ বছরের অত্যন্ত সুন্দরী কোমল হৃদয়ের রমণী। অথচ স্বামীর কাছকাছি থাকলে সে বাঘিনী হয়ে যায়,অথচ দুনিয়ার কাছে সে ভিতু। এতোটাও ভিতু নয় মিষ্টি,সবসময় নিজেকে শক্ত-সামর্থ্য, এবং তেজি রূপে ধারণ করে রাখতে চায়।অথচ এখন সে এক পাও নড়তে পারছে না।

দশমিনিটের জায়গায় পনেরো হলো ইভান দোকান থেকে বের হচ্ছেনা। শান্ত নিরিবিলি স্থান,লোকের আনাগোনা একদম কম,নেই বললেই চলে।শুধু দোকানের ভেতর কিছু লোক।দূর থেকে তারা ভালোভাবে খেয়াল না করলে মিষ্টিকে দেখতে পাবেনা। মিষ্টি অস্থির হয়ে পায়চারি করলো কিছুক্ষণ,এরপর পার্স থেকে ফোনটা বের করলো। ইভানকে চলে আসার জন্য মেসেজ দিলো। ইভান মেসেজ দেখেও আসলো না,বাধ্য হয়ে মিষ্টি কল দিলো। ইভান যেনো এতক্ষণ ফোনের আশায় ছিলো। চায়ের অতিরিক্ত বিল সহ দিয়ে সেও বাইরে এসে দাঁড়ালো। ফোন কানে ঠেকাতেই মিষ্টি বললো,

— তোকে জ্বালাবো না ভেবেছিলাম আর।বিরক্তও করতাম না।দুঃখীত বিরক্ত করার জন্য,আমি চলে যেতে চাচ্ছি।

ইভান লাইন কেটে দিলো।যত দ্রুত সম্ভব মিষ্টির কাছে চলে আসলো। এসেই শক্ত করে মিষ্টির হাতটা ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে বললো,

—- সবকিছু নিজের মতো করে ভাবতে
কে বলে তোকে?

— তুই বলেছিস।

ইভান থেমে গেলো। রাগের তোড়ে জঙ্গলের ভেতরে চলে এসেছে তারা। মিষ্টির হাত ছেড়ে দিলো। রাগে ইভানের চোয়াল ফুলে ফেঁপে উঠেছে। সে প্রস্তুত হচ্ছিলো আজ মিষ্টিকে কঠোরভাবে কিছু বলবে বলে।তার আগেই মিষ্টি ইভানের পেছনে গিয়ে একদম পেছন থেকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো। রাগ যেনো সাথে সাথে নেমে গেলো ইভানের। মিষ্টিকে পেছন থেকে টেনে এনে সোজা বুকের সাথে চেপে ধরলো। এরপর আবচা আওয়াজে বললো,

— আমাদের ভালো থাকার একটা মাত্র অপশন হলো হাজার রাগ-ক্ষোভ,অভিমান শেষে কাছাকাছি থাকা।
তোর মনে হয়, আমরা অন্য উপায়ে ভালো থাকতে পারবো? কখনো পারবো না রে। ঝগড়া, মারপিট রক্তে মিশে গেছে একদম। এসব ছাড়া ভালো থাকা আমার দ্বারা সম্ভব নয়।তুই বুঝতে পারছিস?

মিষ্টি ইভানের বুকের মধ্যে থেকেই মাথা ডানে-বামে নেড়ে বুঝালো, সে কিছুই বুঝেনি।

(চলবে)

~কাছেপিঠে~
পর্বসংখ্যাঃ১৩

সারা রুম তন্নতন্ন করে খুঁজেও ইভান আর মিষ্টির বিয়ের একটা ছবিও পেলো না মারজিয়া। রাগে নিজের সব চুল ছিঁড়ে ফেলতে মন চাচ্ছে তার। কিছুদিন আগেও যখন এ ঘরে এসেছিলো তখন একটা ছবির ফ্রেম দেখেছিলো। এবং সেটা তাদের বিয়ের ছবি। উত্তেজিত হয়ে গলা উঁচিয়ে সেঁজুতিকে ডাকলো মারজিয়া। সেঁজুতি দরজার পেছনেই লুকিয়ে ছিলো। ডাকার সাথে সাথে হাজির হলো। সেঁজুতিকে দেখে কর্কশ গলায় মারজিয়া বললো,

— তুই এসেছিলি এ ঘরে? এখানে টেবিলের উপর একটা ছবি ছিলো সেটা দেখেছিলি?

সেঁজুতি সাথে সাথে ডানে-বামে মাথা নেড়ে বললো,

— আমি ঘরে আসিনি ফুফি।
তাছাড়া কারো বেডরুমে অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করতে ভালো লাগে না আমার।

মারজিয়া ক্ষেপে উঠলো,বললো,

— কারো কি বলছিস হ্যাঁ? এটা আমার
ছেলের ঘর।আমার ছেলের রুম,কারো।বেডরুম নয়।

ঠোঁটের আঁড়ালে থাকা দন্তপাটি শক্তভাবে খিঁচলো। ঘর,রুম,বেডরুম এখানে পার্থক্য কোথায়? তার কথায় ও বা কি ভুল ছিলো। হালকা কেশে সেঁজুতি বললো,

— আসলে,আমি সেটা বলতে চাইনি ফুফি।
বলেছি ফ্ল্যাটটা তো ইভান ভাইয়া আর মিষ্টি ভাবির কেনা। এখানে আমরা বাইরের মানুষ হয়ে এভাবে ঘরদোরে দখলদারি তো করতে পারি না।

মারজিয়া দ্রুতপায়ে এগিয়ে এসে সেঁজুতির চুল খামচে ধরলো।ব্যথায় মুখ কুঁচকে ফেললো সেঁজুতি।তারপরও টানটান চোখে চেয়ে থাকলো মারজিয়ার মুখের দিকে। মারজিয়ার চোখমুখ ক্রোধের তোড়ে রক্তিমবর্ণ ধারণ করে আছে। অত্যন্ত ক্রোধান্বিত কন্ঠে বললো,

— তাদের কেনা হয়েছে তো কি হয়েছে?
আমার ছেলের সবকিছুতে আমার অধিকার থাকবে।সেখানে ওই মেয়ে কে? আর কখনো ওদের কথা বলতে আসলে সোজা তোর বাপ-মায়ের কাছে পাঠিয়ে দিবো।

সেঁজুতির চেঁচিয়ে বলতে মন চাইলো,দাও পাঠিয়ে,তোমার সাথে থেকে পাপ করা চেয়ে,তাদের হাতের মার-ই সই। কথাটা বললো না সেঁজুতি, অত্যন্ত শীতল কন্ঠে বললো,

— এভাবে আমার চুল ধরে সময় নষ্ট না করে কাপড়ের টুকরো জোগাড় করা উচিত ফুফি। আমার চুল পরে নাহয় ধরো।

হাত আলগা হয়ে এলো মারজিয়ার। সেঁজুতির কথা ঠিক। ছবি না পাওয়ার টেনশানে কাপড়ের কথা ভুলে বসেছে সে। তড়িৎ গতিতে ইভান আর মিষ্টির পরিহিত কাপড়ের টুকরো জোগাড় করলো মারজিয়া। সেঁজুতি তখন মনে মনে দোয়া করছিলো যাতে কেনপ্রকার ছবি মারজিয়ার হাতে না আসে। কিন্তু পুরনো কাপড়ের মাঝে একটা পুরনো ছবি পেয়ে গেলো মারজিয়া। চোখেমুখে আনন্দের আভা ফুটে উঠলো মারজিয়ার। ছবি আর কাপড় একসাথে একটা কালো কাপড়ের সাথে পেছিয়ে ব্যাগে ভরে রাখলো। সেঁজুতি ছলছল চোখে মারজিয়ার দিকে চেয়ে রুম ঘুছাতে লাগলো। মারজিয়া বের হওয়ার সময় সেঁজুতিকে বললো,

— তাড়াতাড়ি ঘুছিয়ে আয়,আমরা বেরুবো।

সেঁজুতি চুপচাপ বিছানা ঘুছিয়ে ফেললো।দরজার দিকে এক নজর চেয়ে ডাস্টবিন থেকে ইভান আর মিষ্টির ছবিগুলো বের করলো। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই সে এখানে এসে ছবিগুলোকে ডাস্টবিনের ভেতরে রেখে দিয়েছিলো যাতে মারজিয়া খুঁজে না পায়। সেঁজুতি ছবি ফ্রেমদুটো ধুয়েমুছে বালিশের তলায় রেখে দিলো।এতবড় একটা পাপ করতে তার মন সাই দিচ্ছিলো না। তাই মারজিয়ার দৃষ্টির আঁড়ালে সে যথা সম্ভব এই পাপ টেকানোর চেষ্টা করবে।

পয়তাল্লিশ মিনিট ধরে একজায়গায় বার বার হাঁটতে হাঁটতে পা ব্যথা শুরু হয়ে গিয়েছে মিষ্টির। পা যেনো অচল,অবস হয়ে গিয়েছে তার। শেষপর্যায়ে একটা বড়সড় মোটা গাছের হাঁড়ির উপর বসে মিষ্টি। জোরপ জোরে নিঃশ্বাস ফেলে ইভানের দিকে তাকালো। মিষ্টির তীর্যক চাহনিতে অপ্রস্তুত ইভান এদিক-ওদিক চেয়ে দৃষ্টি লুকাতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মিষ্টি ফিক করে হেসে উঠলো। ইভান যখনি অপ্রস্তুত,বিব্রত হয়,অথবা কোন কারণে নজর লুকানোর চেষ্টা করে তখন অসম্ভব সুদর্শন দেখায় তাকে। শ্যামবর্ণ চেহারাও এতোটা সুদর্শন হয় সেটা ইভানকে না দেখলে কেউ বিশ্বাস করবে না। এই ইভানের প্রেমে ঘায়েল হয়ে হাজারবার মরতে রাজি আছে মিষ্টি,তবে ছাড়তে নয়। যতোই হোক, এ পুরুষটার থেকে দূরে থাকা তার পক্ষে সম্ভব নয়।

দৃষ্টি জোড়া লুকিয়ে মাথা চুলকাতে লাগলো ইভান।আড়ষ্ট হয়ে আছে এই বুঝি মিষ্টি তাকে কথা শুনিয়ে দিবে। কিন্তু হলো উল্টো। মিষ্টি হেসে ইভানকে হাতের ইশারায় ডাকলো পাশে বসতে।যেনো এই ডাকের অপেক্ষায় ছিলো ইভান।সাথে সাথে মিষ্টির পাশে এসে ঘা ঘেঁষে বসলো। মিষ্টি ইভানের কাঁধা মাথাটা রাখলো,এরপর বললো,

— এতক্ষণ যাবৎ চরকির মতো ঘুরিয়েছিস,
কোথায় সেই ভাল্লুকের পাহাড়?

ইভান দৃঢ়কণ্ঠে বললো,

— পথ ভুলে গিয়েছি।রাস্তা খুঁজে পাচ্ছিনা।
অনেক ছোটবেলায় এসেছি তো।

— তাহলে ফিরে যাই?

— না না,এতোটা পথ এসে ফিরে যেতে পারবোনা।

— জায়গাটা নাম কি? গুগল ম্যাপে খুঁজে দেখ?

— আরে গুড আইডিয়া তো। ওয়েট খুঁজে নিচ্ছি।
আমার তো ম্যাপের কথা মনে নেই।

ইভান ফোন হাতে নিয়ে ‘সৈদুরখীল’ লিখে সার্চ দিলো। সাথে সাথে জায়গাটা চলে আসলো ম্যাপে। এরপর সেখানে গিয়ে ভাল্লুকে পাহাড়ের লোকেশনটা দেখে নিলো।যদিও স্থানীয়রা ভাল্লুকের পাহাড় বলে। পাহাড়ের উপর মসজিদ আছে। মসজিদের নামটাই ম্যাপে দেওয়া আছে। লোকেশন পেয়ে চট করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো ইভান। পাহাড়ের উপর পথটা যে কতোটা দুর্গম সেটা এখনো মিষ্টিকে বলেনি।মিষ্টির হাতটা ধরে এগিয়ে যেতে লাগলো গন্তব্যের উদ্দেশে…

তিন’শো বিশ তাক সিঁড়ি বেয়ে উপরের উঠতে হবে শুনে মিষ্টির মাথা ঘুরে উঠলো। পাহাড়ের উপরে কি আছে দেখা যাচ্ছেনা। তবে সাদা রঙের কিছু একটা দেখা যাচ্ছে। আর সিঁড়ির আকৃতিও ছোট।ভয়ে গলা শুকিয়ে এলো মিষ্টির। ইভান এতো আশা করে এতোটা পথ এনেছে। মুখ ফুটে যাবে না সে কথাও বলতে পারছেনা। ইভানের কষ্ট হবে ভেবে। মিষ্টি ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকলো। ইভান পানির বোতল কিনে এনে মিষ্টি হাতে দিলো। পানি খেয়ে গলা ভিজিয়ে নিলো মিষ্টি। কিন্তু ভয়টা দূর করতে পারলো না। অকস্মাৎ, পিঠে ও হাঁটুর নিচের শক্তহাতের স্পর্শ পেলো। হকচকিয়ে উঠলো মিষ্টি। মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলো আর্তনাদ। নিজেকে শূন্যে ভাসতে দেখে ভয়ের মাত্র দ্বিগুণ বেড়ে গেলো তার। ইভান মিষ্টির কুঁচকানো মুখের দিয়ে চেয়ে বললো,

— রিল্যাক্স থাক। আমি থাকতে ভয় কিসের?

মিষ্টি দু’হাতে ইভানের গলা জড়িয়ে ধরে বললো,

— আমাকে নামিয়ে দে,প্লিজ,এভাবে উপরে উঠতে গেলে ভয়ে আমার কলিজা বেরিয়ে আসবে।

— আরে ধূর,তোর কলিজা আমার বুকের চাপ খেয়ে বেরুতে পারবেনা। ইজি থাক।

— মশকরা করিস না তো। এখান থেকে পড়লে আর বাঁচতে পারবো না।

— সিরিয়াসলি,এখান থেকে পড়ে যদি মরেও যাই তাহলে আমার আফসোস থাকবেনা। কারণ তুই সাথে আছিস। এখন চোখ বন্ধ করে শাহরুখ আর দীপিকার সিনটা মনে কর। ওই যে ফিল্মে? এখন তুই নিজেকে দীপিকা ভাব আর মুখ বন্ধ রাখ।

মিষ্টি সহজ থাকতো পারলো না।কোথাকার কোন ফিল্ম।তার চোখের সামনে ভাসছে,ইভান পা ফসকে হঠাৎ পড়ে গেছে, আর সাথে তাকেও ফেলে দিয়েছে।শুধু তাই নয় দুজন দুইদিকে ছিঁটকে পড়েছে। যারজন্য তাদের আর দেখা হবেনা। মিষ্টি ইভানের দিকে চেয়ে মনে মনে বললো,– আমি এতে তাড়াতাড়ি মরতে চাইনা রে। আরো অনেকদিন বাঁচতে চাই, তোর সাথে থাকতে।

মনের কথাটা মনেই থেকে গেলো মিষ্টির। মুখ দিয়ে বেরুলো না।ইভান ততক্ষণে সিঁড়ির কয়েক ধাপ অতিক্রম করে ফেললো। পথে পথে যে চুপ ছিলো তাই নয়। মিষ্টি হেস্তনেস্ত করে ছাঁড়লো। প্রথমে বললো,কাকে কোলে নিয়েছি? মনে হয় বাচ্চা কোলে নিয়েছি।এরপর পর মাঝের ধাপে এসে বললো,
দিন দিন মুটিয়ে যাচ্ছিস।এতো ওজন কি করে হলো তোর শরীরের? এখান থেকে গিয়ে ডায়েট করে নিবি। এরপর বলছে, আমার দিকে চেয়ে না থেকে মুখের ঘাম মুছে দিতে পারছিস না? আরো কতো কথা। মিষ্টি তওবা করে ফললো জীবনেও আর এই হারামিটার কোলে উঠবেনা।নিজ থেকে কোলে নিয়ে দুনিয়ার সব কথা শুনিয়ে দিলো। পাহাড়ের উপর উঠে অভিমানে ফুলে ফেঁপে থাকা মিষ্টি পাহাড়ের সৌন্দর্য্য উপভোগ করলো। সত্যি অনেক সুন্দর জায়গাটা। আপনমনপ ধন্যবাদ দিলো ইভানকে।সবচেয়ে সুন্দর দৃশ্য ছিলো মসজিদের এতিম বাচ্চাদের সাথে দুপুরের ভোজনবিলাসটা। এখানে এলে নাকি খালি মুখে ফিরে যেতে পারে না কেউ।খেয়েই যেতে হয়। খাবারের ম্যনুতে ছিলো মজাদার খিচুরি আর ভর্তা।

ছবিটা হাতে নিয়ে গভীর দৃষ্টিপাত করলো হুজুর সাহেব। ইভানের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ানো মিষ্টিকে দেখে ভীষণভাবে মনে ধরে গেলো তার। সুন্দরমুখ দেখতে কার না ভালো লাগে? সে যদি নিজের সঙ্গীনি হয় তবে? হুজুর সাহেব মারজিয়ার দিকে চেয়ে মৃদ্যু হাসলে। দাঁড়িতে হাত বুলাতে বুলাতে বললো,

— একেবারে মেরে ফেলতে চাইলে চেষ্টাটা সফল না ও হতে পারে? ধীরেধীরে আগালে বেশ ভালো হয়?

মারজিয়া ভ্রূ কুঁচকে চেয়ে বললো,

— ধীরেধীরে বলতে?

— আমি বাসায় যান,আমি রাতের দিকে ফোন দিয়ে জানাবো। গোপন আলোচনা আরকি।তখন বড়হুজুর সাথে থাকবেন।

কথাটা শুনেই সেঁজুতির কলিজা মোচড় দিয়ে উঠলো। হাতপা ইতিমধ্যে কাঁপছে তার। কিভাবে কি করবে সেটা ভাবতেই ঘা শিউরে উঠছে।তবে কিছু একটা তো করতেই হবে। সেঁজুতি আসার সময় নিজের প্রচেষ্টায় কিছু জিনিস এনেছে। সেগুলো এই হুজুরের হাতে পৌছাতে পারলেই তার সব ভয় দূর হবে।

(চলবে)
____________
©তারিন_জান্নাত

[রি-চ্যাক দেওয়া হয়নি।লেখায় টাইপমিস্টেক থাকলে দুঃখীত]

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে