~কাছেপিঠে~
পর্বসংখ্যাঃ১০
লাঞ্চ টাইমে আজ হঠাৎ করে ছুটি নিয়ে নিলো ইভান। মনটা আঁকুপাঁকু করছে মিষ্টির সাথে দেখা করার জন্য। না গেলে বোধহয় জানটা আর থাকবেনা। ফাইলপত্র ঘুছিয়ে সব একপাশে রাখলো।ফোন আর গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে আসলো ইভান। পেট এখন শান্ত আছে আপাততে। জুঁইয়ের মায়ের রান্না করা মাটন বিরিয়ানি খেয়েছে ইভান। এতো ভালো রান্না আগে কখনো করেননি উনি। আজকের অনেকটা অবাক হয়েই খেয়েছে ইভান।কেমন হোটেলের বিরিয়ানির স্বাদ মনে হচ্ছিলো। জুঁই বলেছিলো রান্নাটা তার মা করেছে। অহেতুক চিন্তা বাদ দিয়ে ইভান তৎক্ষনাৎ খেয়ে নিলো।
কলেজের পাশেই একটা রেঁস্তোরা।খাবারের আইটেমের স্বাদ বেশ ভালো এখানকার। তাই লাঞ্চ টাইমে পেটের ক্ষুধা নিয়ে এখানে ছুটে আসে মিষ্টি।
শুনেছে আজকে এখানে একটা স্পেশাল বাঙালি আইটেম রান্না হয়েছে। গরম গরম ভাত, সাথে ইলিশ মাছের লেজের ভর্তা,ইলিশ এবং ডিম একসাথে ঝাল করে রান্না করা। মিষ্টি খাবারের দিকে চেয়ে থাকলো এক ধ্যানে। ইভানকে রেখে একা খেতে ইচ্ছে করছিলো না।তাই ফোন বের করে ইভানকে ফোন দিলো মিষ্টি।
তৎক্ষনাৎ সামনের জায়গা দখল করে বসলো ইভান। ফোন টেবিলের উপর রাখতে রাখতে বললো,
— জলদি খেয়ে নে। আমাদের বেরুতে হবে।
মিষ্টি ইভানকে দেখে হাসলো। এরপর ডান হাত ধুতে ধুতে বাম হাতে একটা প্লেট মিষ্টির দিকে এগিয়ে দিয়ে বললো,
— তুইও স্টার্ট কর।
— উহু! আমি খেতে পারবো না। খেয়ে এসেছি।
— পারবি, পারবি, দেখ তোর আর আমার প্রিয় আইটেম। না খেলে আফসোস করবি।
ইভান খাবারের দিকে দৃষ্টি ছুঁড়লো। সত্যিই তাদের প্রিয় আইটেম দেখে সেও হাত ধুয়ে অল্প খাওয়ার উদ্দেশ্যে খাওয়া শুরু করলো।তন্মধ্যে তার একটা আরো একটা কাজ হলো মিষ্টিকে মাছ বেছে দেওয়া। এই কাজটাতে মিষ্টি অপটু। তাই বরাবরের মতো ইভান মাছ বেছে বেছে মিষ্টির পাতে রাখলো।
খাওয়া-দাওয়ার পর্ব শেষে জোরপূর্বক মিষ্টিকে ছুটি নেওয়ালো ইভান। আজ কেমন যেন সে অস্থির হয়ে আছে।মনে হচ্ছে আবরও কোন এক রকম বিপদ এসে আঁচড়ে দিবে তাদের। নতুন করে কোন সমস্যা চাচ্ছেনা ইভান।তাই আজ ছুটি নিয়ে কোথাও যাওয়ার পরিকল্পনা করলো সে।তাতে যদি একটু তার ভেতরকার অস্থিরতা কমে।
শান্তিপূর্ণ একটা জায়গা খুঁজে পেলো ইভান। শহরাঞ্চল থেকে অনেকটা দূরে গ্রামাঞ্চলে কাছাকাছি। মিষ্টি এখানে আসার একদম ইচ্ছে করছিলো না। ইভানের জোরাজোরি তে আসতে হলো। ছেলেটা আজ পাগলামি ও করছে বেশি।কি হয়েছে সেটা মিষ্টি বুঝতে পারছে না। আবারও গাড়ি থামিয়ে ইভান মিষ্টির দিকে চেয়ে বললো,
— আরেকটা চুমু দে তো। মন ভরছেনা।
মিষ্টি এবার রেগে আগুন হয়ে তাকালো ইভানের দিকে।ইভানের চেহারার মুখভাব কঠিন। তারচেয়ে দ্বিগুন মুখ শক্ত করে মিষ্টি বললো,
— দেখ,মেজাজ খারাপ করবিনা।
কখন থেকে জ্বালিয়ে মারছিস। সমস্যা কি বল?
— আজব, বউয়ের কাছে বৈধ চুমু চাচ্ছি।
এখানে খারাপের কি দেখলি? তুই দিতে বাধ্য।
— দিতে বাধ্য বুঝলাম।কিন্তু একটা লিমিট থাকে।
তুই সেই দেড় ঘন্টা ধরে…
ইভান গাড়ি স্টার্ট দিলো চুপচাপ। দৃষ্টি সামনের রাস্তার দিকে। সবাই সব পায়না, সেটার প্রমাণ ইভান অনেক আগেই পেয়ে গেছে। মিষ্টির সবকিছুতে লিমিট লাগে। এদিক-ওদিক হওয়া যায় না। ইভান নিজেকেও শাসাতে লাগলো। কেন হুট করে এমন আচরণ করছে। আজ হঠাৎ তার উৎকন্ঠিত ভাবও বেড়ে গিয়েছে। মাথাটাও ঝিমঝিম করছে।
ইভানের চেহারার এমনভাব দেখে মিষ্টি নিজের আর ধরে রাখতে পারলো। মুখ বাড়িয়ে আলতো করে ইভানের চোয়ালো ঠোঁট ছুঁয়ালো দৃঢ়ভাবে। ইভান অল্পস্বল্প শান্ত হলেও মিষ্টির দিকে তাকালো না। মিষ্টি হাসলো মৃদুভাবে।
ওয়াশরুমে এসে মুখে বেশ ভালোভাবে ফেস পাউডার লাগালো জুঁই।ঠোঁটে হালকা গোলাপি লিপস্টিক। চুল পরিপাটি করে বাঁধলো। আর গায়ে ছড়ালো লোভনীয় সুগন্ধি। যার সুভাসে মুহূর্তে পুরুষমানুষের হৃদয় ব্যাকুল করে দিতে সক্ষম। মিরপুরে একটা মিটিংয়ের আয়োজন করা হয়েছিলো লাঞ্চের পর। ইভানের সাথে জুঁইয়ের যাওয়ার কথা। সেজেগুজে ইভানের কেবিনে এসে দরজা খুলে দেখলো সম্পূর্ণ কেবিন ফাঁকা। জুঁই চোখ বড়বড় করে তাকালো। দ্রুতপায়ে এগিয়ে গিয়ে ওয়াশরুমে খুঁজলো। অস্থিরতায় ঘাম ছুটে এলো জুঁইয়ের কপাল ভেয়ে। আজকের পরিকল্পনা এভাবে ভেস্তে যাবে তা সে কল্পনাও করেনি।
ইভানের কেবিন থেকে জুঁইকে বের হতে দেখে অফিসের সি.ও মি.রায়হান এসে জুঁইকে বললো,
— মিস জুঁই আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম কোথায় গিয়েছিলেন?
— আ..আসলে স্যার আমি ওয়াশরুমে ছিলাম।
— ওহ আচ্ছা। যেজন্য আপনাকে খুঁজছিলাম।
আজকের মিটিং ক্যান্সেল করা হয়েছে। আপনি আপনার বাকি কাজগুলো করে নিন।
— ইভান স্যার?
— ইভান তো লাঞ্চ আওয়ারের পর ছুটি নিয়েছে আজ।
বলেই রায়হান চলে গেলো। জুঁইয়ের মেজাজ খিঁচে গেলো। সব দোষ মিষ্টির।এই মেয়ের কবল থেকে কিছুতে ইভানকে বের করতে পারছেনা সে। আজকের পরিকল্পনাটা ঠিকমতো সফল হলে মিষ্টির সাধ্য থাকতো না আর ইভানের কাছে থাকার। জুঁইয়ের মব চাচ্ছে আশেপাশের সব কাঁচের দরজা জানালা ভেঙে চুরমার করে দিতে। হোটেল থেকে কিনে আনা বিরিয়ানিতে আজ যৌ**উত্তেজক ওষুধ মিশিয়েছিলো জুঁই। কাজের কাজ কিছু হলো না।উল্টো সব গণ্ডগোল হয়ে গেলো। মাথা কাজ করা বন্ধ হয়ে গেলো জুঁইয়ের৷
খুব সুন্দর একটা রিসোর্টে এসে উঠেছে ইভান মিষ্টি।
রিসেপশনিস্ট লোকটির কাছে যখন ইভান নিজেদের পরিচয় দিয়ে রুম বুক করছিলো তখন মিষ্টির মনের মধ্যে অদ্ভুত একটা ভয় এসে ঢুকে পড়লো। রিসেপশনিস্ট লোকটি কেমন যেনো আঁড়নজরে তাকাচ্ছিলো মিষ্টির দিকে। সেটা দেখেই মিষ্টির গায়ে কাটা দিয়ে উঠলো।ইভানটাও মাঝে মাঝে অদ্ভুত আচরণ করে। হিতাহিত জ্ঞ্যান হারিয়ে সে উল্টাপাল্টা কাজকর্ম করে ফেঁসে যায়। এতোই যখন তার প্রেম পাচ্ছিলো তাহলে বাসায় ফিরলেই তো হতো। রুমের দরজা লাগিয়ে ইচ্ছাখুশী আনন্দ করা যায়।ইডিয়েট টা নিয়ে এলো এমন অচেনা জায়গায়।
রুমে যেতে যেতে মিষ্টি পেছন ফিরে তাকালো। এরপর ইভানের কাঁধে হাত রেখে মিষ্টি বললো,
— তুই আগে এখানে এসেছিস?
ইভান জবাবে বললো,
— আসবো না কেন? এখান কিছুটা দূরে গেলেই আমার দাদার বাড়ি। চিনি বলেইতো এখানে আসলাম।আমার প্রিয় জায়গা।
রুমে এসে ইভান মিষ্টিকে ছুঁতে এলেই,মিষ্টি ইভানকে ধাক্কাতে ধাক্কাতে ওয়াশরুমে পাঠিয়ে দিলো। ইভান আহাম্মক বনে গেলো এভাবে তাকে ওয়াশরুমে ঢুকিয়ে দিয়ে দরজা আঁটকানোতে। দরজা ধাক্কিয়ে ইভান বললো,
— দরজা খুল মিষ্টি। আমার মুড নষ্ট করিস না।
তাড়াতাড়ি দরজা খোল।
— তোর মুডের ক্ষেতাপুরি বেক্কল কোথাকার।
আসার আর জায়গা পাস নাই? এখানে লোকগুলো কেমন অদ্ভুদ লাগছে আমার। সোজা গোসল করে বের হ।
— আরে এক্সট্রা কাপড় আনিনি।গোসল করবো কিভাবে? আর এখন করবো না আমি গোসল।দরজা খোল।
মিষ্টি কিছু বলতে যাবে আগেই ধড়াম ধড়াম শব্দ করে দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ কানে আসলো মিষ্টির।ভয়ার্ত চোখে দরজার দিকে চেয়ে ওয়াশরুমের দরজাটা খুলে দিলো মিষ্টি। হুড়মুড়িয়ে বের হলো ইভান। ঠাস করে মিষ্টির গালে চড় লাগিয়ে দিলো। চড়টা হজম হলো না মিষ্টির। সেও কষে চড় মেরে দিলো একটা। ইভান গালে হাত রেখে মিষ্টির দিকে তাকালো।মিষ্টি বললো,
— বলেছিলাম না, ভুলেও আমার গায়ে হাত তুলবিনা। তাহলে তার শোধ আমিও নিবো।
পূনরায় দরজা ধাক্কানোর শব্দ কানে আসলে মনোযোগ ছুটে যায় ইভান মিষ্টির।
সন্ধ্যার পরের সময়। হাজীবাড়ির মোড়ে একটা ছোটখাটো বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো মারজিয়া।সাথে আছে সেঁজুতি। চুপিচুপি বাড়িটিতে প্রবেশ করলো তারা। বৈঠকখানায় দেখা মিললো একজন হুজুরবেশের লোকের সাথে। যিনি মূলত কালোযাদু বিদ্যাকে নিজের আয়ত্তে রেখেছেন। এ সময়ে হুজুর রঙ চা পান করেন। মারজিয়াকে আসতে দেখে তিনি পাশে দাঁড়ানো ছেলেটিকে ইশারায় চা-নাস্তার আয়োজন করার হুকুম দিলো।
মারজিয়া সোফায় বসতে বাসতে সালাম দিলো। সালাম নিয়ে হুজুর সেঁজুতির দিকে একচোট চেয়ে মারজিয়ার দিকে তাকালো। এরপর বললো,
— কি সমস্যা আপনি আবার এখানে?
মারজিয়া মুখ কাঁদোকাঁদো করে বললো,
— আপনি যে তাবিজটা দিয়েছিলেন ওটার গুন মনে হয় শেষ। আমার ছেলে এখন আবারও তার বউয়ের আঁচল ধরেছে।
লোকটি হাসলেন স্মিথ্য।বললেন,
— স্বামী তার স্ত্রীর আঁচল না ধরে পরস্ত্রী আঁচল ধরবে? কেমন চিন্তাভাবনা আপনার।
— আমি সেসব শুনতে চাই না। আমি চাই আমার ছেলে যেনো ওই মেয়েকে ছেড়ে দেয়। দরকার হলে আপনি জ্বিন দিয়ে মেয়েটিকে একেবারে সরিয়ে দিন।যত টাকা লাগে আমি দিবো।
হুজুরের চোখে টাকার তৃষ্ণা দেখা গেলো। মারজিয়া তা দেখে আলগোছে হাসলো। লোকটি তারপরও ভালো সাজার বান করে বললো,
— মেয়েটির সাথে আপনার ছেলে সুখে থাকলে আপনার কেন সমস্যা হচ্ছে। আপনিও ভালো শাশুড়ি হয়ে দেখিয়ে দেন আপনার ছেলেকে।
— এতো ভালো সাজার নাটক আমি করতে পারবো না।আমি চাই আমার ছেলে যা আয় রোজকার করে তা আমার হাতে তুলে দিক।
— আপনার স্বামী কি করেন?
— কিছু করেন না। মদ গিলে ভুসভাস করে দিনরাত ঘুমাবে।আমার তিন ছেলেমেয়ে। তাদের অনেক খরচপাতি আছে।যা আমি পরিপূর্ণ ভাবে করতে পারছি না। আমার বড় ছেলের ইনকাম কতো জানেন? প্রায় উনসত্তর হাজার টাকা।
হুজুরটির মনে নেশা ধরে গেলো টাকার। লোভী-পাপী মন সায় জানালো কাজটা করে দিতে।তাই উনি হেসে বললেন,
— ঠিকাছে,আপনি তাহলে আপনার ছেলের এবং তার বউয়ের কাপড়ের কোণার এক টুকরো অংশ কেটে আনবেন।এবং সাথে তাদের একত্রে থাকা ছবি।
মারজিয়া আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন।পাশ থেকে সেঁজুতিকে খুঁচিয়ে ফিসফিস কন্ঠে বললো,
— একবার সফল হই।তখন তোরে স্বর্ণের মুখুট বানিয়ে দিবো আমার মা। চল এখন।
সেঁজুতি ভাবলেশহীন হয়ে উঠে দাঁড়ালো। এরপর বেরিয়ে এলো মারজিয়ার পিছুন পিছুন।
(চলবে)
~কাছেপিঠে~
পর্বসংখ্যাঃ১১
দরজা ধাক্কানোর শব্দে মনোযোগচ্যুত হয় ইভান আর মিষ্টির। ইভান দরজা খুলতে পা বাড়ালে মিষ্টি আতঙ্কিত হয়ে ইভানের হাতটা খপ কর ধরে ফেললো। মিষ্টির আতঙ্কিত মুখ, ঘর্মাক্ত চেহারা দেখে মৃদু হাসলো ইভান। বলিষ্ঠ হাতটা বাড়িয়ে মিষ্টিকে কাছে টেনে এনে জড়িয়ে ধরলো।মিষ্টিও চুপচাপ ইভানের বাহুতে ঘাপটি মেরে দাঁড়িয়ে রইলো।প্রিয় মানুষটির সান্নিধ্য পেয়ে ক্ষণিকের জন্য সব ভয় দূর হয়ে যায়। মিষ্টিকে ছেড়ে এগিয়ে এসে দরজাটা খুললো ইভান। দরজার অপাশে দাঁড়ানো কম বয়সী ছেলেটির দিকে ইভান দৃষ্টিপাত করলেই ছেলেটি হাসিমুখে বলে,
— স্যার, নাস্তায় কি দিবো আপনাদের?
ইভান পিছুন ফিরে মিষ্টির দিকে চেয়ে বললো,
— কি খাবি নাস্তায়।
— যা খুশী অর্ডার দে।
— দু কাপ গরুর দুধের চা,এবং
চারপিস চকলেট কেক!
— স্যার আর কিছু?
— না আপাততে আমাদের এতেই চলবে।
ছেলেটি যেতেই ইভান দরজা আঁটকালো। এরপর বিছানার কাছে এসে মিষ্টির পাশে বসলো। মিষ্টি তখনো ফ্যালফ্যাল চোখে ইভানকে পর্যবেক্ষণ করছিলো। ইভান চোখ তুললেই মিষ্টির চোখাচোখি হয়। চোখজোড়া অসম্ভব লাল হয়ে আছে। মিষ্টি বিচলিত হলো সাথেসাথেই। হাত বাড়িয়ে ইভানের কপালে রাখলো, কপালে হাত রেখে আৎকে উঠলো মিষ্টি।এরপর গলায়, গালে রাখলো।মিষ্টির হাতটা শক্ত করে ধরলো ইভান।মিষ্টি উৎকন্ঠিত হয়ে বললো,
— তোর ত জ্বর এসেছে।
ইভান ঘন ঘন নিঃশ্বাস ফেললো কয়েকবার। নিজের ইচ্ছেশক্তিকে নিজের আয়ত্তে এনে বললো,
— ধূর পাগল, জ্বর আসেনাই।
— জ্বর না আসলে তোর গা এমন পুড়ে যাচ্ছে কেন?
ইভান চিৎ হয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো। মিষ্টির লম্বা চুলে আগা হাতের মুঠোয় নিয়ে অভিযোগের স্বরে বললো,
— তুই হচ্ছিস বউ নামের কলঙ্ক!
স্বামীর ইমোশন,ফিলিংস,নিড কিছুর কদর করিস না।
মিষ্টি ঝট করে নিজের চুল টেনে ইভানের হাত থেকে ছাড়িয়ে নিলো, এরপর বললো,
— হারামি! মুখে বললে আমি বুঝি না,চুল ধরে টানছিস কেন?
ইভান প্রচুর ঘাঁড়ত্যাড়া স্বভাবের ছেলে।ভালো মন্দ সব কিছুর বুঝজ্ঞান তার সময় মতো হয় না। সে পূনরায় মিষ্টির চুলের আগা ধরে টান মারলো। চুলে টান পড়াতে হুড়মুড়িয়ে বিছানায় শুয়ে পড়লো মিষ্টি। দু’জনে পাশাপাশি শুয়ে আছে। ইভান অত্যন্ত মোলায়েম স্বরে বললো,
— অহেতুক ভয় পাচ্ছিলি তুই তখন।
আমি বা তুই কখনো কারো ক্ষতি করেছি?
মিষ্টি ইভানের কথায় চুপ মেরে ভাবলো এরপর বলল,
— না তো,কেন?
— ব্যস, মনে রাখবি যতদিন আমরা কারো ক্ষতি করবো না।ততদিন আমাদের ও কোন ক্ষতি হবে না।
আর রইলো কথা বিপদ-আপদের, সেটা একটা পরীক্ষা মাত্র৷
ইভানের কথাটা বেশ মনে ধরলো মিষ্টির। তারপর সে বললো,
— আমার কেন জানি মনে হয়েছিলো রিসেপশনের লোকটা কোন কিছুর প্ল্যান করছিলো।বার বার চোখের ইশারা..
— শোন, আঘাত যন্ত্রণা সবসময় আপন বা কাছের মানুষের কাছ থেকে পাওয়া হয়। যার সাথে বা রক্তের সম্পর্কও থাকে।এখানে আমাদের কোন ক্ষতি হবেনা।এই রিসোর্টটা আমার এক পরিচিত ফ্রেন্ডের। সো, চিন্তা করিস না।
মিষ্টির ভেতরকার চাপা আতঙ্ক মিঁইয়ে গেলো ইভানের কথা শুনে।মুহূর্তেই ভালো লাগায় ভরে উঠলো চারপাশ। মিষ্টি এবার নিজ থেকে ইভানের পাশে গিয়ে ঘেঁষলো। ইভান তখন চোখ বুঁজে ছিলো।বেশ আন্দাজ করলো মিষ্টির ঘনিষ্ঠ হওয়া। তারপরও মৌন থাকলো। মিষ্টি হাত তুলে ইভানের বুকের উপর রেখে জড়িয়ে ধরলো। তখনি চট করে ইভান চোখ খুললো। চোখ পাকিয়ে মিষ্টির দিকে চেয়ে বললো,
— সর সর, এখন আমার মুড নেই।
তোরে খুশী করতে পারবো না।
ইভানের কথায় মিষ্টির মেজাজ ছ্যাৎ করে গরম হয়ে গেলো। ধড়মড়িয়ে উঠে বসলো। ক্রোধান্বিত হয়ে বললো,
— সোনায় বাঁধানো কপাল বল তোরটা।আমি মিষ্টি তোর পাশে এখনো বসে আছি।অন্য কেউ হলে তোর চাপার সব দাঁত ফেলে দিতো। হারামি কোথাকার।
মিষ্টি বিছানা থেকে উঠে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেলো। ইভান সেদিকে চেয়ে হেসে ফেললো। মিষ্টি আদূরে গালের আদূরে রাগ তাকে সবসময় পৈশাচিক আনন্দ দেয়। মিষ্টিকে রাগাতে পারলে,কাঁদাতে পারলেই ইভানের মনটা শান্ত হয়।তবে মাঝে মাঝে মিষ্টি একটু বেশিই কেঁদে ফেলে তার জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে।তখন ইভানের বেশ খারাপ লাগে ।
রাত নয়টা, বাসায় এসে ঘরদোর পরিষ্কার করলো মারজিয়া। সেঁজুতিকে পাঠালো গরুর মাংস দিয়ে বিরিয়ানি রাঁধতে। আজ বান্ধবীদের নিয়ে জমজমাট একটা খানাপিনার আয়োজন করবে ভাবলো মারজিয়া। অবশেষ,অবশেষে তার ছেলের ঘাঁড় থেকে ওই আপাদটাকে দূর করতে পারবে, ভেবেই মনের মধ্যে খুশীর জোয়ার উঠছে মারজিয়ার। যথাসময়ে চার-পাঁচ জন মধ্যবয়স্ক বান্ধবী হাজির হলো বাসায়। আজকের সুযোগটা ইভান ওই করে দিয়েছে মারজিয়াকে। সন্ধ্যায় জানিয়েছে ইভান আর মিষ্টি ফিরবে না। ব্যস তারপর থেকে লেগে পড়লো মারজিয়া বান্ধবীদের নিমন্ত্রণ জানাতে।
ড্রয়িংরুম থেকে বেশ হট্টগোল শুনা যাচ্ছে। সেঁজুতির বেশ বিরক্ত লাগছে। আরে কি দরকার ছিলো এসব কুটনি মহিলাদের দাওয়াত দেওয়া। ছেলে এবং জামাই খেয়ে তাদের বদনাম গাইবে সারাদিন। সেঁজুতি বেশ অবগত তার ফুফির স্বভাব আচরণের সাথে। সে তো পরিস্থিতির স্বীকার। তার বাবার এতো সামর্থ্য নেই যে তাকে ভালো ঘরে বিয়ে দিবে।সেই দায়িত্বটা তার ফুফিই নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলো।তার পরিবর্তে এতোসব ঝামেলা পোহাতে হবে সেটা সেঁজুতির কল্পনায়ও ছিলো না।
ড্রয়িংরুম থেকে হাসাহাসির মাঝ থেকে একটা কথা ভেসে আসলো সেঁজুতির কানে।
— সমবয়সী ছেলেমেয়ে দিয়ে সংসার হয়না মারু,
যা হয় তার শুধু আধিক্যেতা। সম্পর্কে তো সম্মান নেই,আছে তুই-তোকারি।কেউ কাউকে মূল্যায়ন করেনা। আমার বাবা এসব অপছন্দ।তাই তো ছেলের বিয়ে দিয়েছি ষোল বছরের এক পুচকে মেয়ের সাথে। জানিস, আমার কথায় বসে,আর আমার কথায় উঠে। কি-যে ভালো লাগে।
বান্ধবী শায়লার কথায় প্রচণ্ড মন খারাপ হয় মারজিয়ার। আফসোসের স্বরে বললো,
— তোর কপাল ভালো। আমার ছেলের বউটা তো আমার ছেলেটাকেও শান্তিতে থাকতে দেয়না। মাথা খেয়ে ফেলেছে আমার ছেলের।ছেলে ভাগিয়ে এনে বিয়ে করেছে। ছেলের শশুড় বাড়ির মুখ অবধি দেখলাম না।খাতিরদারি তো দূরের কথা। আর উপহার সামগ্রী পাওয়া তো স্বপ্নের মতো।
সেঁজুতি চুপচাপ শ্রবণ করলো কথাগুলো। কে কেমন,কোন ধাঁচের বা মানসিকতার মানুষ তা তাদের কথাবার্তায় বুঝা যায়।সালাদের জন্য শষা কাটতে কাটতে একটা ভাবনার চক মনে মনে খসে ফেললো সেঁজুতি।
সকাল ছয়টা। ইভান গরম গরম পরোটা আর ডাল-মাংসের অর্ডার দিয়ে এসেছে। খাবার তৈরি হলেই তাদের রুমে এনে দিবে। ইভান যখন এসবে ব্যস্ত, মিষ্টি তখন ঘুমে বিভোর। হাতমুখ ধুয়ে ইভান মিষ্টির পাশে এসে দাঁড়ালো। ইভনের হাত সবসময় নিসপিস করে মিষ্টিকে চড় দিতে। তার এখনো মনে আছে তাদের মধুচন্দ্রিমার রাতটাও শুরু হয়েছিলো একে অপরের চড় খেয়ে। মিষ্টির হাতে সে কি জোর। ইভান শুধু আলতো করে চড় দিয়েছিলো,তাতে সাথে সাথে মেয়েলি হাতের বলিষ্ঠ চড় খেতে হয়েছিলো তাকে। পুরনো স্মৃতিচারণে মনটা নিমিষেই আমোদিত হয়ে উঠলো৷ বিছানায় বসে ইভান মিষ্টির পিটে আলতোভাবে চাপড় দিয়ে ডাকতে লাগলো, ইভানের ডাকে চোখ মেলে তাকালো মিষ্টি, ইভানের দিকে ফিরে আবারও চোখ বন্ধ করলো।
ইভান মিষ্টির মুখ থেকে চুল সরিয়ে ডাকলো। মিষ্টি সাড়া দিলো না। এরপর ইভান নিচু হয়ে মিষ্টির কপালে চুমু দিলো। বহুদিন পর কপালে গুডমর্নিং কিস পেয়ে তড়াক করে চোখ মেলে তাকালো মিষ্টি।
সন্দিগ্ধ চোখে চেয়ে ঘুম জড়ানো কন্ঠে বললো,
— কি ব্যাপার বলতো ইভু, কি অকাম করে এসেছিস।আজ এতো সকাল সকাল ভালো হওয়ার নাটক করছিস।
— ধূর,ভালো হতে যাবো কেন? আমি ইভান অলওয়েজ খারাপ। তবে কথা হচ্ছে তোকে নিয়ে একটা জায়গায় যেতে চাই,প্লিজ উঠতো জান।
মিষ্টি কপালে তীক্ষ্ণ ভাঁজ তুলে উঠে বসলো।এলোমেলো চুল ঘুছিয়ে হাত খোঁপা করলো। বললো,
— কোথায়?
— ধর মোবাইল। আজকের দিনটা ছুটি নে।
— আরে সম্ভব না।এভাবে হুট করে ছুটি নেওয়া যায়না।
— আরে যাবে, বলবি তুই অসুস্থ।
— মিথ্যা বলবো?
— প্লিজ বল। আমার জন্য।
— যাবিটা কোথায় সেটা আগে বল?
ইভান ঠোঁট চেপে কিছুক্ষণ চেয়ে থাকলো মিষ্টির দিকে।এরপর চারপাশে চাইলো।অতঃপর মিষ্টির দিকে চেয়ে বললো,
— ভাল্লুকের পাহাড়ে!
— হোয়াট!
(চলবে)
___________
©তারিন_জান্নাত