~কাছেপিঠে~
পর্বসংখ্যাঃ০৬
টেবিলে আজ হরেক রকমের নাস্তার প্লেট সাজানো।
ছেলের জন্য নাস্তায় কোন কিছুর কমতি রাখেননি। নিজ হাতে সব বানিয়েছেন মারজিয়া। কতোদিন ধরে ছেলেটা তাঁর কাছে থাকে না।শুধুমাত্র ওই মেয়ের জন্যে ছেলেটা তাঁর থেকে এতোদিন দূরে ছিলো। তবে যাওয়ার পূর্বে মেয়েটা নিজেই মারজিয়াকে ফোন দিয়ে জানিয়েছিলো,এখান থেকে চলে যাওয়ার কথা। সর্বক্ষণ অভিশাপ দিতে দিতে ক্লান্ত মুখ হঠাৎ ফসকে মেয়েটির জন্য আপনা-আপনি দোয়া চলে আসলো মারজিয়ার। এরপর সকাল হতে না হতেই তৃতীয় স্বামীর বাসা থেকে সব গুটিয়ে ছেলেমেয়েদের বুঝ দিয়ে এখানে চলে এসেছেন।
ইভান হাতে ঘড়ি পড়তে পড়তে এগিয়ে এসে চেয়ারে বসলো। টেবিলের কাছে এসে অবাক হলো না। নানা পদের নাস্তা এ মুহূর্তে তার মুখ দিয়ে প্রবেশ করবেনা। তারপরও তার মায়ের কষ্টের কথা ভেবে সবজি দিয়ে দু’টো রুটি খেয়ে সাথে এক গ্লাস পানি পান করেই দাঁড়িয়ে পড়লো। মারজিয়া হন্তদন্ত হয়ে ইভানের পাশে এসে বললো,
— কি-রে বাবা,কিছুই তো খাসনি।
— খেয়েছি, আর জোর করো না প্লিজ, খাবো না।
—- আরে আজব তো,তোর ক্ষুধা লাগেনি?
— নাহ..
ইভান কোন প্রকার কথা বাড়ানোর ইচ্ছে পূষন করলো না। দ্রুতপায়ে বেরিয়ে এলো বাসা থেকে। নিচে এসে গ্যারেজের দিকে গেলো গাড়ি বের করার জন্য। কিন্তু হঠাৎ কিছু মেয়েলি স্বরের হাসি দেখে ডানদিকে উপরে তাঁকালো ইভান। চার-পাঁচ জন মহিলা তার দিকে চেয়ে মিটমিট হাসছে। বয়স বেশি নয়,তার চেয়ে কয়েক বছর বেশি হবে।হয়তো মিষ্টির চলে যাওয়ার ব্যাপারটা তারা ইতিমধ্যে জেনে গিয়েছে।কারণ তাদের রোজকার ঝগড়াবিবাদের স্বাক্ষী তারাও ছিলো। চাপা দীর্ঘশ্বাস ফেললো ইভান।
অফিসে আসার পূর্বে একবার মিষ্টির কলেজের সামনে এসে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলো ইভান। যদি কাকতালীয় ভাবে দেখাটা হয়ে যায়। বুকের ভেতরের তীব্র অসহনীয় যন্ত্রণা অনুভব হচ্ছে ইভানে। তাদের একসাথে থাকার সময়সীমা একবছর।তন্মধ্যে গত তিনমাস একি ছাদের নিচে বসবাস করেছে অনেকটা প্রতিবেশির মতো, একে অপরের কাছাকাছি থেকেও দূরত্ব ছিলো খুব। সেদিনের হওয়া ঝগড়াটা মারাত্মক ছিলো। ইভান সত্যি সত্যিই সেদিন বলে ছিলো সে মিষ্টিকে নিয়ে অতিষ্ট। সহ্য করতে পারছে না।এমন অনেক কথায় রাগের মাথায় বলেছিলো। তারপরও তাদের মধ্যকারা অদৃশ্য সম্পর্ক এতোদিন তাদের বেঁধে রেখেছিলো। মূলত ইভানই মিষ্টিকে কোথায় যেতে না পারার মতো অবস্থায় রেখেছিলো।কারণ মিষ্টির বাড়ির সবাই মিষ্টির উপর অনেক ক্ষেপে আছে।শুধুমাত্র ইভানের সাথে সম্পর্ক রাখার জন্য। মিষ্টির বাবা-মা সমবয়সী সম্পর্কের উপর বিশ্বাস করেন না। তাদের ধারণা এদের মধ্যে ভালোবাসার ছিঁটেফোঁটাও থাকেনা।যা থাকে তা হচ্ছে অসম্মান, একে অপরের দোষ খুঁজার গুণ। মিষ্টির আব্বা আলী আব্দুল সেজন্য চেয়েছিলন মেয়ের অন্যত্রে বিয়ে দিতে। কিন্তু মেয়ে তাদের মুখে চুনকালি মেখে দিয়ে প্রেমিকের হাত ধরে পালিয়ে এসেছে।এজন্যই ইভান মিষ্টিকে বেশি জ্বালাতো,কারণ সে জানতো দিনশেষে মিষ্টির থাকার একমাত্র জায়গা থাকবে তার কাছে।
আধঘন্টা অপেক্ষা করেও মিষ্টিকে দেখলো না ইভান।তখন সে পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে যায় মিষ্টি তাদের বাড়িতে চলে গিয়েছে। না জানি তারা কি করবে মিষ্টিকে? যদি মিষ্টির গায়ে হাত তুলে?
এখন ইভানের ইচ্ছে করছে নিজেরই মাথা ফাঁটিয়ে ফেলতে। কাল ঘোরের মধ্যে সে মিষ্টিকে আঁটকানোর একটা চেষ্টা অবধি করেনি। ড্রাইভিং সিটের সামনে থাকা মিষ্টির ছবিটার দিকে চেয়ে বললো,
—- বেয়াদব,স্বার্থপর মহিলা। অসভ্য মহিলা।
_________
আজ হঠাৎ দরজায় নক করে এরপরেই ইভানের কেবিনে প্রবেশ করলো জুঁই। ইভানের মা মারজিয়া জমজমাট একটা নিউজ দিয়েছে জুঁইকে। মিষ্টির বাসা ছেড়ে চলে যাওয়ার খবরটা শুনে জুঁইয়ের শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আনন্দের স্রোত বইছে। ইভানকে জুঁই কলেজ লাইফ থেকে পছন্দ করতো। ইভান,জুই,আফিন, রাইদা, আর মুহিত তারা উভয়ের বন্ধুত্বরে শুরু কলেজ জীবন থেকে। মাঝখানে ভার্সিটি জীবনে গ্রাম থেকে উঠে আসা ক্ষ্যাত মেয়েটা ইভানের মনোযোগ সম্পূর্ণ নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়েছিলো।এমন না যে, তাদের গলায় গলায় ভাব ছিলো। ইভানের খোঁচা মেরে কথা বলার স্বভাব নিয়ে তীব্র প্রতিবাদ করতে এসে মিষ্টি নিজেই ফেঁসে গিয়েছিলো ইভানের মধ্যে। জুঁই তখন তাদের ঝগড়া দেখে বেশ উপভোগ করতো। হঠাৎ একদিন শুনলো তাদের প্রেমের সম্পর্কের দুই বছর পূর্ণ হয়েছে। সেদিন যেনো জুঁইয়ের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিলো। সারাদিন কাকের মতো কা কা করতে থাকা দুই পাখি প্রেমে পড়লোটা কখন।তখন আর হাতের কাছে করার মতো কোন উপায় ছিলো না বলে চুপচাপ থাকলো জুঁই।কিন্তু ইভানের আশেপাশে থাকা থেকে বিরত থাকলো না। চাকরিটাও নিয়েছে ইভানের অফিসে।
জুঁই চেয়ারে বসেই ইভানকে উদ্দেশ্য করে বললো,
— শুনেছি মিষ্টি নাকি তোকে ছেড়ে চলে গিয়েছে?
ইভান ফাইলে চোখ নিবদ্ধ রেখে গম্ভীর স্বরে বলল,
— জানিস যেহেতু জিজ্ঞেস করছিস কেন?
— আরে রেগে যাচ্ছিস কেন? আমি এমনিতেই
জিজ্ঞেস করলাম। আচ্ছা একটা কথা বলি?
ইভানের অনুমতির অপেক্ষা না করেই জুঁই বললো,
— মিষ্টিটা অদ্ভুত কিসিমের মেয়েমানুষ। আরে স্বামীর মুখে মুখে তর্ক করা কি খুবই ভালো ব্যাপার? এটা কি বাহবা পাওয়ার মতো কাজ?
হঠাৎ ইভান ধমকে বলে উঠলো,
— চুপ কর। আমি জানি মিষ্টি কেমন।
সে সম্পূর্ণ সাদাসিধে একটা মেয়ে ছিলো। ওর
সব রকমের কু-অভ্যাস আমার থেকে পাওয়া।দোষ আমার, সহজ সরল মেয়েটাকে খুঁচিয়ে একেবারে বদমেজাজী বানিয়ে ফেলেছি।ওর বিপক্ষে আর একটা কথাও বলবি না।যাহ এখন…
— তুই শুধু শুধু আমাকে ধমকাচ্ছিস।আমি সিউর
মিষ্টির অন্যকোথাও এফেয়ার আ…
ইভান দাঁতের সাথে দাঁত চেপে পেপার ওয়েট হাতে নিয়ে বললো,
—- যাবি নাকি তোর মাথা ফাঁটিয়ে দিবো।
______________
গত দুইদিন ধরে মিষ্টি রাইদার বাড়িতেই আছে। বাড়িতে যাওয়ার সাহস একদমি নেই মিষ্টির। মিষ্টি সিদ্ধান্ত নিলো,রাইদার বিয়ের পরেই সে একটা ছোটখাটো বাসা ভাড়ায় নিবে। ততদিন অবধি ইভানের নজর থেকে দূরে থাকতে পারলেই হয়। শুধুমাত্র মিষ্টিই ইভানের থেকে লুকিয়ে থাকবে।কিন্তু লুকিয়ে ইভানকে দেখাটা মিস করবে না। দুইদিন ধরে ইভানের শ্যামবর্ণের চেহারাটা দেখা হচ্ছেনা,কণ্ঠস্বর শুনতে পাচ্ছেনা। তাকে বিরক্ত করছেনা,রাগাচ্ছেনা।জীবনটা কেমন ছন্দহীন লাগছে মিষ্টির।
এসব অসভ্য ভাবনা মনে আসতেই মিষ্টি নিজেকে ধমকালো।সে তো সম্পূর্ণভাবে ইভানকে ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করছিলো। কিন্তু তার দ্বারা কঠিন কাজটা হয়ে উঠছেনা। অসহায় মিষ্টি বেখেয়ালিতে মজে হাতের মেহেদীতে দিয়ে ইভানের নামটা লিখে দিতে বলে ফেললো।মেহেদী পড়ানো মেয়েটি ডিজাইন চ্যাক করতে বললে, মিষ্টির মনে পড়লো সে ইভানকে ভুলে যাওয়ার জন্য আলাদা হয়ে এসেছিলো। ততক্ষণে মেহেদীর ডিজাইনের মাঝে ইভানের নামটা মুছার ইচ্ছে হলো না আর তার। তবে গর্জিয়াস ডিজাইনের মাঝে নামটা তেমন স্পষ্ট নয় দেখে স্বস্তি পেলো।
আজ রাতে আফিন আর রাইদার মেহেদী অনুষ্ঠান। মিষ্টি পার্লারে এসেছে রাইদার সাথে সাজার জন্য। ছোটবেলা থেকে সাজসজ্জার প্রতি বিশেষ আকর্ষণ আছে মিষ্টির। আজ যেহেতু একটা সাজার উপলক্ষ পেয়েছে,তাই সেটা ক্যান্সেল করবে না ভাবলো মিষ্টি।
রাত নয়টার দিকে রাইদার রুমে এসে উপস্থিত হলো জুঁই আর মুহিত,রাইদার সাথে দেখা করেই বেরিয়ে যায় ঘর থেকে। তাদের বেরিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পর ইভান এসে প্রবেশ করলো। রংবেরঙ ফুলের গয়নায় সজ্জিত রাইদাকে দেখে ইভান তার পাশে বসলো। মিষ্টি আপাততে অন্যঘরে বসে আছে, সেজন্য ইভান,জুঁই আর মুহিত কেউ তাকে দেখতে পায়নি। ইভান হালকা হেসে বললো,
—- কি অবস্থা দোস্ত!
রাইদা ইভানের দিকে একপলক চেয়ে পূনরায় ফোনের ভেতর মনোযোগ দিলো। ইভানের সাথে কথা বলার ইচ্ছে তার এ মুহূর্তে নেই। মনে মনে ইভানকে খাটাশ বলে গালি দিলো। তার জন্যেই আজ মিষ্টির এমন অবস্থা। ইভান ভ্রূঁ কুঁচকে চেয়ে বললো,
— কথা বলছিস না কেন?
— তোর সাথে কিসের কথা।ইগোস্টিক কোথাকার।
—- আশ্চর্য! তোদের শুধু আমাকে ইগোস্টিক মনে হয়? ওই বেয়াদবটাকে ইগোস্টিক মনে হয়না?ফাজিলটার কত্তবড় সাহস হয়েছে তুই জানিস? আমাকে রেখে চলে যায়। আমাকে নাকি শান্তি দিচ্ছে।
ইভানের কথায় মৃদু হাসলো রাইদা। এরপর বললো,
— তোরা দু’জনেই হচ্ছিস উন্নতমানের ঘাঁড়ত্যাড়া বলদ। তোরা এই পৃথিবীতে বসবাসের যোগ্য মানুষ নস। যা তো ভাই, তুই আর তোর বউ অন্যকোন গ্রহে গিয়ে ইচ্ছেমতো ঝগড়া করগে যাহ্।
মিষ্টি রুম থেকে বের হতেই তার কলেজের এক মেয়ে স্টুডেন্টের ভাইকে দেখতে পেলো।এডমিশনের ব্যাপারে তাদের মধ্যে কলেজে অনেকবার দেখা হয়েছিলো।পূর্বে পরিচিত হওয়া ছেলেটি মিষ্টিকে দেখেই হাসিমুখে এগিয়ে এসে সালাম দিয়ে কথাবার্তা বললো। ছেলেটা স্বাস্থ্য এবং উচ্চতায় বেশ ভালো,এবং দেখতেও ভালো। কথার ফাঁকে জানতে পারলো ছেলেটি আফিনের ফুফাতো ভাই।রাইদাকে এখনো অবধি দেখেনি সে। মিষ্টিকে অনুরোধ করলো রাইদার সাথে যেনো দেখা করিয়ে দেয়। মিষ্টির খেয়াল ছিলো না ইভানের কথা। হাসিমুখে কথা বলতে বলতে ছেলেটিকে সাথে নিয়ে রাইদার ঘরে প্রবেশ করার আগে হুট করে ইভান বেরিয়ে এলো সে ঘর থেকে। চোখের সামনে এমন একটা দৃশ্য দেখে সাথে সাথে মাথায় আগুন ধরে গেলো ইভানের। মিষ্টিও অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো।এভাবে ইভানের সামনে পড়তে হবে সেটা কল্পনাও করেনি সে। তারপরও নিজেকে সামলে ইভানকে না দেখার ভান করে ঝটপট রাইদার ঘরে ঢুকে পড়লো। বুকের ভেতর ধড়ফড় করছে মিষ্টির। ইভানের চোখ দেখে বুঝতে পারলো সে বিষয়টা সহ্য করতে পারেনি। ইভান শুধু ঘাঁড় ঘুরিয়ে জলপাই সবুজ রঙের শাড়ি পরিহিত মিষ্টির দিকে তাকালো। এমনভাবে তাকালো যে মিষ্টি চোখাচোখি হতেই ভয়ে চোখ সরিয়ে নেয়। ইভান তীর্যক দৃষ্টিতে আপাদমস্তক গাঢ় সজ্জায় সজ্জিতে সুন্দরী বউটির দিকে চেয়ে এরপর হনহনিয়ে চলে আসলো লিভিংরুমে। যেখানে তাদের আরো কিছু পরিচিত ঘনিষ্ঠ ছেলে বন্ধু উপস্থিত আছে।
(চলবে)
_____________
©তারিন_জান্নাত