~কাছেপিঠে~
পর্বসংখ্যাঃ০৫
মিষ্টি মশারী টাঙানো শেষে বিছানায় শুয়ে পড়লো। কাঁথা দিয়ে সর্বশরীর ঢেকে রাখলো,যাতে বদনজর থেকে তার শরীরটা রক্ষা পায়।এখন রুম থেকে গেস্ট রুমে যেতে চাইলেই ইভান নতুন নাটক শুরু করবে।
ইভান বেলকনি থেকে ফিরে এসে দেখলো মিষ্টি বিছানায় কাঁথা মুড়ি দিয়ে শুয়ে আছে। খাবারের প্লেট আগের জায়গায় আছে। তারমানে খায়নি। এই জিনিসটা ইভান সহ্য করতে পারে না। হাজার রাগ-ঝগড়া-অভিমান হোক।এসবের সাথে খাওয়ার কি সম্পর্ক? খেয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লে কি হয়। অনেক সময় ইভানকে না চাইতেও মিষ্টির সাথে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে হয়।সে নিজ থেকে কখনো কথা বলে না। তার উপর মিষ্টি না খেয়ে থাকলে সবচেয়ে বেশি কষ্ট ইভানের-ওই হয়,যেনো সে নিজে খায়নি। ইভান তেড়ে এসে মিষ্টির শিয়রে দাঁড়ালো। আপাদমস্তক চোখ বুলিয়ে বলল,
— এ্যাই মহিলা ওঠ ভাত খেয়ে নে। শুনতে পাচ্ছিস? ওঠ বলছি। এ্যাঁই ছদ্মবেশী কালনাগিনী!
ইভানের ডাকে মিষ্টি আলতো করে মাথা থেকে কাঁথা সরিয়ে ইভানের দিকে চেয়ে বললো,
— ভাত-মুরগী,ডাল এসব তুই তোর টাকায় হোটেল থেকে আনিয়েছিস। তাই আমি খাবো না।
— আজব প্রাণি তো তুই? আমার টাকায় বাজার করে আনা তরকারি রান্না করে খাস না? তখন মনে পড়েনা আমার টাকায় খাচ্ছিস?
— এটা তো তুই শর্ত দিয়েছিলি।
দু’জনের টাকায় বাজার করে রান্না করা হবে।
আমি তো চাইলে আমার নিজের বাজার নিজে করে রান্না করে খেতে পারি।তোর-ওই তো সবকিছুতে সমস্যা।
ইভান চোখ ছোট করে শান্ত দৃষ্টিতে তাকালো একবার মিষ্টির দিকে। এরপর আশেপাশে চেয়ে নিভু স্বরে বলল,
—- আমি তো কাজের বুয়ার হাতের রান্না খেতে পারি না।তাই শর্ত দিয়েছিলাম। তোর যখন এতোই সমস্যা তাহলে কাল থেকে সবকিছু আলাদাভাবে তোর মতো করে খা। আর আমি আমার মতো।
মিষ্টি কাঁথা সরিয়ে উঠে বসলো। তাচ্ছিল্য হেসে বললো,
— আলাদা খাওয়ার,থাকার,ডিভোর্স এসব কথা সবসময় তুই-ই আগে বলিস। আমি কখনো নিজ থেকে বলিনি। তুই যখন এতো বিরক্ত ঠিকাছে…
—- কি ঠিকাছে? সবসময় আমার কথার দোষ ধরিস।আমি রাগের মাথায় কি উল্টাপাল্টা বলি সেসব নিয়ে আমার সাথে ঝামেলা করিস।শান্তি জিনিসটা মনে হয় জীবনেও পাবো না তোর কাছে।
মিষ্টি তড়িৎ গতিতে বিছানা থেকে নেমে গেলো।
মিষ্টি ভাবলো আজ আর ইভানের কথায় মজে যাবেনা। শক্ত হয়েই কাজটা করতে হবে,দুর্বল হলে চলবে না। এ পর্যন্ত হাজার বার ছাড় দিয়ে এসেছে তাকে।
মিষ্টি চুপচাপ কেবিনেট খুলে ব্যাগ বের করলো। ব্যাগের ভেতর নিজের কাপড়চোপড় সব ভরে নিলো। ইভান বিছানায় বসে এক মনে চেয়ে থাকলো মিষ্টির দিকে। বিয়ের আগে সম্পর্কটা অনেক ভালো ছিলো,হাজার ঝগড়া অভিমানের মাঝেও তাদের মধ্যে দূরত্ব আসেনি। অথচ,বিয়ের পর সহজ সম্পর্কটা কেমন জটিল রূপ ধারণ করেছে। মিষ্টি ব্যাগ হাতে নিয়ে এগিয়ে এসে ইভানের সামনে দাঁড়ালো। ইভান তখন মাথা নিচু করে বসেছিলো। মিষ্টি আলতো করে কাঁধে হাত রেখে বললো,
— যাহ! জীবন তো একটাই ইভু,সে জীবনে যদি আমার জন্য তুই শান্তি না পাস, তাহলে সে জীবনে আমি থাকতে চাই না। ভালো থাকিস।
ইভান আগের ন্যায় মাথা নিচু রেখেই বললো,
— এতো রাতে কোথায় যাবি।
— মাত্র সাড়ে এগারোটা,এতোটাও রাত হয়নি।
সকাল হতে হতে পৌছে যাবো আমাদের গ্রামে।
মিষ্টি ইভানের সামনে থেকে সরার আগে ইভান কাঁধে মিষ্টির হাতের উপর হাত রেখে বললো,
—- তুই কখনো আমাকে ভালোবেসে ছিলি?
— এখনো বাসি,
— ভালোবাসা কখনো ছেড়ে যায় না, তুই যাচ্ছিস।
— তোরে শান্তি দিচ্ছি।
— আমি শান্তি পাবো এতে? আমার শান্তি তো তুই।
— ছাড়,এসব কথা। আমার ভালো লাগছে না।
তোর সব কথা মিথ্যে,দুইদিন যেতে না যেতেই তুই নতুন কিছু নিয়ে হাঙ্গামা করবি।
— করবো না,প্লিজ! আমার মাথা গরম হয়ে যায়
তাই কন্ট্রোললেস হয়ে যায়।তোর সাথে খারাপ ব্যবহার করে ফেলি।
মিষ্টি ইভানের পাশে এসে বসলো।এরপর শান্ত স্বরে বললো,
— শোন, সবার জীবন একটা।সেই একটা জীবনে নিজের শখ-আহ্লাদ,আনন্দ-উল্লাস নিয়ে বেঁচে থাকার ইচ্ছেও সবার মধ্যে আছে। কিন্তু সুখ-দুঃখ মিলেই তো মানুষের জীবন। আমার মনে হয়না আমরা আর একসাথে থাকতে পারবো। দেখ রাগের মাথায় নয়,আমি আজ ঠাণ্ডা মাথায় ভেবেচিন্তে এই সিদ্ধান্ত নিয়েছি। আমরা আলাদা হয়ে গেলেই ভালো হবে। এমন না যে তুই বা আমি আমরা কেউ একে অপরকে ভালোবাসি না।ভালোবাসাটা যথেষ্ট আছে, কিন্তু ইগো প্রবলেমটা আমাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি।
এখন আমরা কিশোর-কিশোরীও নয় যে আবেগে ভেসে বেড়াচ্ছি। বাস্তবতা অনেক কঠিন।কঠিন বাস্তবতার সাথে তাল মেলাতে গেলে আমাদের অনেক খারাপ অভ্যাস পরিহার করতে হবে। বিশেষ করে সংসার জীবনে। সংসার এমনি এমনি হয় না।তাতে অনেক ভালোবাসা,বিশ্বাস,যত্ন,শ্রম, আত্মত্যাগ দরকার। কিন্তু তুই আমি এখনো ফ্যান্টাসি জগতে বসবাস করছি।তাই পরিপূর্ণ সংসারটা আমাদের দ্বারা হচ্ছে না।
মিষ্টি একনাগাড়ে কথাগুলো বলে থামলো।বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে ইভানের এলোমেলো চুলে হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,
— আসছি।
ইভান জবাব দিলো না।হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বসে থাকলো।
— ইভু আসছি।
কথাটা শুনে ইভান ঝট করে মাথা থেকে মিষ্টির হাতটা ঝাড়া দিয়ে সরিয়ে দিলো। প্রচণ্ড আক্রোশে ফেঁটে পড়া মুখশ্রী রক্তাক্ত বর্ণ ধারণ করেছে ইতিমধ্যে। উঠে দাঁড়িয়ে বাঘের ন্যায় গর্জে উঠে বললো,
— অনেক কথা বুঝিয়ে দিয়েছিস। আর কিছু বলার না থাকলে বের হ এখনি। তোকে অনেক আঁটকে রেখেছি ভালোবাসার দোহাই দিয়ে। নূন্যতম ভালোবাসা যদি আমার জন্য তোর মনে থাকতো,এতবড় সিদ্ধান্ত তুই একা নিতে পারতিস না।
— ডিভোর্সের কথা তুই বলেছিলি আগে।
আমি তো ডিভোর্সও দিচ্ছি না তোকে।শুধু চলে যাচ্ছি যাতে তুই ভালো থাকতে পারিস।
— মিষ্টি যা আমার চোখের সামনে থেকে, আমার ভালো তোকে চাইতে বলিনি আমি।
মিষ্টি ব্যাগ হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। ইভান পেছন ফিরে চেয়ে থাকলো।যদি একবার মিষ্টি পেছন ফিরে দৌড়ে এসে থাকে জাপ্টে জড়িয়ে ধরে। তাহলে ইভান মিষ্টিকে একদম বুকের মধ্যে সিল বন্দী করে রাখবে। হায়,মিষ্টি পেছন ফিরেও তাঁকালোও না। চোখের অশ্রু লুকানোর প্রচেষ্টায় শেষবার পেছন ফিরেও তাঁকালো না মিষ্টি।
ইভান বেলকনিতে গিয়ে দাঁড়ালো। তার মনে পড়ে গেলো একবছর আগের মিষ্টিকে নিয়ে পালিয়ে আসার সময়কার ঘটনা। দুর্ভাগ্যক্রমে মিষ্টির বাবার লোকজনের হাতের খপ্পরে পড়েছিলো সে। মিষ্টির বাবা কৃষক,অথবা ধান চাষাবাদ করেন,সাথে ধান ব্যবসায়ী হিসেবে বেশ পরিচিত তাদের গ্রামে। উচ্চ-মধ্যবিত্ত পরিবারের না হলেও মধ্যবিত্ত জীবনযাপনে বেশ আয়েশে চলে তারা। তাঁর লোকজন সেদিন ইভানকে বেধড়ক মারধর করেছিলো। তারপরও ইভান হাল ছাড়েনি মিষ্টিকে নিয়েই ফিরেছিলো,তারপর তাদের বন্ধুরা মিলে দুজনের বিয়ে করিয়ে দেয়।শুরু এবং মাঝের সময়টা বেশ ভালোই চলছিলো তাদের।শেষের দিকে হঠাৎ কি হলো কে জানে।মধুর সম্পকর্টা তুমুলঝগড়া, আর তর্কবিতর্কের সম্পর্কে পরিণত হয়। ইভান নির্নিমেষ চেয়ে থাকলো মিষ্টির যাওয়ার দিকে। সে জানে মিষ্টি এখন আগে তার বড় বোনের বাসায় যাবে। সেখান থেকেই হয়তো কাল সকালে তাদের বাড়ির পথে রওনা দিবে।
__________
সকাল সকাল কলিংবেল বাজতেই চোখ মেলে তাকালো ইভান। চোখ মেলতেই সকালের মৃদু আলোর ছটা চোখের উপর এসে ঝাঁপটা মারলো। ঘুম থেকে ভালোভাবে সজাগ হতেই নিজেকে ফ্লোরে আবিষ্কার করলো। সাথে সাথে মনে পড়লো মিষ্টির চলে যাওয়ার কথা। অসহায় দৃষ্টিতে সিলিংয়ের দিকে তাকালো। চোখের কোণ আপনা-আপনি ভিজে এলো ইভানের। পূনরায় কলিংবেলের শব্দে হঠাৎ ইভানের মনে হলো যেনো মিষ্টি ফিরে এসেছে। সে যায়নি তাকে ছেড়ে।
তড়িঘড়ি করে ফ্লোর থেকে উঠে দাঁড়ালো। লুকিং গ্লাসে চোখ না রেখেই দরজাটা খুলে ফেললো।
হঠাৎ দরজার অপাশে মিসেস মারজিয়া চৌধুরীকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়লো ইভান।চোখেমুখে নেমে এলো গাঢ় অমাবস্যা। দৃঢ়কণ্ঠে বলল,
— মা তুমি?
মারজিয়া চোখের চশমাটা খোলে হাতে নিয়ে ব্যাগে রেখে এগিয়ে এসে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলো। ইভান আলতো করে জড়িয়ে ধরলো তার মাকে। মারজিয়া ছেলেকে ছেড়ে মুচকি হাসলো। আমোদিত দৃষ্টি চারপাশে বুলিয়ে বলল,
— শুনেছি ছোটলোকের বাচ্চাটা নাকি চলে গেছে।
— মা! তোমাকে কতোবার বলবো মিষ্টিকে ছোটলোক বলবে না।
— তো কি বলবো? এখন বল আপদটাকে বিদায় করেছিস কিভাবে?
ইভান চোখমুখ শক্ত করে তাকালো তার মায়ের দিকে। এরপর বললো,
— তোমাকে কে বলেছে মিষ্টির চলে যাওয়ার কথা?
মহিলা অপ্রস্তুত হয়ে নিজেকে সামলালো। এরপর মৃদু হেসে বলল,
— আমার ছেলের ঘাড় থেকে আপদ নেমেছে।
সে খবর আমি রাখবো না? যাক, বাদ দে,
তোকে বলেছিলাম না ওই মেয়ে যদি এখানে থাকে তাহলে আমি থাকবো না।এখন তো সে চলে গেছে তাই এখন থেকে আমি আমার ছেলের বাড়িতে থাকবো। ব্যস….
(চলবে)
_____________
©তারিন_জান্নাত