কাছেপিঠে পর্ব-০৪

0
743

~কাছেপিঠে~
পর্বসংখ্যাঃ০৪

মিষ্টির ফোনে কথা বলার উচ্চ শব্দ,আর ক্রন্দন স্বর শুনে ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে থাকা ইভান আচমকা ধড়ফড়িয়ে শুয়া থেকে উঠে বসলো। চোখ কচলে পূর্ণদৃষ্টি মেলে তাকালো মিষ্টির দিকে। মিষ্টি তখন চেঁচিয়ে কার সাথে যেনো কথা বলছিলো। সাথে চোখের পানি আর নাকের পানি মিশে একাকার। আরামের ঘুমটা এভাবে ভেঙে যাওয়াতে রাগ লাগলো ইভানের। মিষ্টির পিঠে ঠাস করে চড় মেরে দিলো। তাতে এতোক্ষণের আহাজারি থামিয়ে অবাক চোখে তাকালো মিষ্টি। এ মুহূর্তে সে রাগের চেয়ে অবাক হলো বেশি।একটু আগে না ইভান মাথা ঘুরে পড়ে গিয়েছিলো।শরীর দুর্বল ছিলো অথবা কুত্তার তাড়ানি খেয়ে আতঙ্কিত হয়ে ছোটখাটো স্ট্রোক করেছিলো।এসবি মিষ্টির মনের ভাবনা ছিলো। কিন্তু সে তো দিব্বি বসে আছে।চোখেমুখে ক্রোধ নিয়ে। মিষ্টিকে ড্যাবড্যাব করে চেয়ে থাকতে দেখে ইভান বলল,

— মরে’ছেটা কে? কার মেজবানে পাড়াপড়শিকে
দাওয়াত দিচ্ছিলি এভাবে চেঁচিয়ে।

— হ্লা! তুই মরস নাই।

— আমি কেন মরতে যাবো।
আর কলেজের ম্যাডাম হয়ে এসব গালি
শেখাস নাকি স্টুডেন্ট রে?

—- ইভু বেয়াদবি করবি না আমার সাথে।

নিজের ঘা থেকে ঘামের গন্ধ্য আসছিলো তাই ইভান চট করে বসা থেকে দাঁড়িয়ে গেলো।ক্লোজেট থেকে তোয়ালে হাতে নিয়ে মিষ্টির দিকে চেয়ে বলল,

— জিন্দেগী তে আমার পা ধরে কদমবুসি করছিসলি? তোর সাথে কিসের আদব-কায়দা?

তর্কবিতর্কের মাঝে চোখের পানি এতক্ষণে শুকিয়ে এসেছে মিষ্টির।যাক,ইভানকে সুস্থ দেখে কলিজা ঠাণ্ডা হলো মিষ্টির। তারপরও চোখের অবশিষ্ট পানি মুছে বিছানা ছেড়ে উঠলো। ইভানকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— ভালো হয়ে যা মুফিস,ভালো হতে পয়সা লাগেনা।

— এক সেকেন্ড মুফিস কে? আমি ইভান।
তার ছিঁড়ছে নাকি তোর?

মিষ্টি বুঝলো ইভান ডায়লগটা আগে শুনেনি। যদিওবা,মিষ্টি ডায়লগটা কলেজের কিছু ছেলেপুলেদের বলতে শুনেছিলো।সেখান থেকেই আজ কথাটা বললো। কলেজের শিক্ষিকা হওয়ার সুবাদে অনেক উদ্ভট গালাগাল, কথাবার্তা তার কাছের কাছে এসে হালকা-পাতলা ধাক্কা খায়। মিষ্টি চলে যেতে যেতে বললো,

—- তোরে বলিনাই। আমার কথায় নাক ঢুকাবি না।

— এ্যাঁ মহিলা থাম।মুফিস কে বলে যা। এ্যাঁই মহিলা!

মিষ্টি শুনলো না। ত্যাঁড়ামি করে বেরিয়ে গেলো থেকে। ইভান গলা উঁচিয়ে বললো,

— হারামি। আত্মসম্মানীয় মহিলা। জামাইকে কখনো সম্মান দিয়েছিস? সব সময় তুইতোকারি। তোর চেহেরা দেখাবি না আমাকে। আগামি একসপ্তাহ তোর সাথে আমার এই মুখ কথা বলবে না।

মিষ্টি শুনলো সব ড্রয়িংরুম থেকে। আজ সম্মান খুঁজতে আসছে। কই সেও তো বউ হওয়ার পর থেকে কতো চেয়েছিলো ইভানের মুখ থেকে ‘তুমি’ ডাকটা শুনতে।ডেকেছে কখনো? ডাকেনি। স্বভাবিক সময় থেকে কখনো তারা দুজন দুজনের সাথে ঠিকমতো কথা বলেনি। সর্বক্ষণ ঝগড়াবিবাদ চলতো ভার্সিটিতেও। কয়েকদিন কথা বলা বন্ধ তারপর আবার পাগলের মতো একে অপরের কাছে ছুটে আসতো।প্রচণ্ড অধৈর্য হয়ে। ঘন্টা না গড়াতেই আবার ঝগড়া। এই ঝগড়া থেকে মুক্তি পেতে ইভান আর মিষ্টির বন্ধুরা তাদের বিয়ে পড়িয়ে দিয়েছিলো।যাতে ঝগড়াটা একটু হলেও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসুক।কিন্তু বিয়ের পর দুজন কাছাকাছি এসেও সর্বক্ষণ সাপ-নেউলের মতো লেগে তাকে। যখন আবার বন্ধুরা মিলে ছাড়াছাড়ির কথা বলে,তখনও তারা রাজি না। ফলে এক বাসার ছাদের নিচে সাপ-নেউলে হয়ে বসবাস করছে।আদৌও কি এই সম্পর্ক একটা স্বাভাবিক সম্পর্কে রূপ নিবে?

দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দু’কাপ চা ট্রে’তে নিলো।সময়ে-অসময়ে তার আর ইভানের চা’ খাওয়ার অভ্যাস আছে। বিশেষ করে তাদের কথা-কাটাকাটি হওয়ার পরের সময়টাতে দুজনে বেশ উপভোগ করে চা পান করে। মিষ্টি চায়ের কাপটা পিরিচ দিয়ে ঢেকে রুমে এসে ড্রেসিং টেবিলের উপর রেখে দিলো।গোসল শেষে ইভান আয়না দেখে দেখে চুল মুছছিলো। তখন চায়ের কাপটা চোখে পড়ে। মৃদু হাসলো ইভান।কাপটা হাতে তুলে সুড়ুৎ করে চায়ে চুমুক বসালো। এই কাজটা করলে মিষ্টি ভীষণ রেগে যায়। ইভান রুম থেকে বের হতে যাচ্ছিলো মিষ্টিকে রাগাতে, মনে পড়লো সে মিষ্টির সাথে আর কথা বলবে না। তাই ফিরে এসে বেলকনিতে চলে গেলো।

কলিংবেল বাজতেই মিষ্টি মনে পড়লো সে তাদের বন্ধুদের ফোন দিয়েছিলো। কথাটা একদম তার মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলো। মিষ্টি গেস্ট রুমে বসে থাকলো না। বেরুলো না। কলিংবেলের শব্দে ইভান এসে দরজা খুললো। দরজার সামনে আফিন,রাইদা,জুঁই আর মুহিতকে দেখে হকচকিয়ে গেলো। দরজার কপাট ধরে বললো,

— তোরা এসময়ে কেন এসেছিস?

ইভানের কথায় রাইদা রেগে গেলো। বললো,

— বেক্কল কোথাকার। তোর এখানে না আসলেও কৈফিয়ত দিতে হয়,আসলেও কৈফিয়ত দিতে হয়।

রাইদাকে শান্ত হতে বলে আফিন বলে উঠলো,

— শান্ত হো রাই! কি রে ইভান তুই নাকি মাথা ঘুরে পড়ে গেছিলি? এখন কেমন আছিস?

আফিনের কথা শুনে ইভানের কপালের সূক্ষ্ম একটা ভাঁজ পড়লো।তারমানে মিষ্টি সবাইকে ফোন দিয়ে জানিয়েছে। সত্যি বলতে তার মাথা আসলেই ঘুরেছিলো হঠাৎ। বিছানায় শুয়ার পর কি হয়েছে তার আর কিছু মনে নেই। যখন ঘুম ভাঙলো তখন মিষ্টিকে কাঁদতে দেখেছিলো। তার পরেই তো তাদের রোজকার কথা-কাটাকাটি।
আফিনের কথার পিঠে ইভান জবাবে বলল,

— এখন ভালো আছি দোস্ত,ভেতরে আয়।তোরাও আয়।

সবাই ভেতরে আসলো। জুঁই আশেপাশে তাকিয়ে বললো,

— কি রে ইভু, মিষ্টি কই রে?

জুঁইয়ের কথায় আফিন আর রাইদা একসাথে একে অপরের দিকে তাকালো। মুহিত বললো,

— বেচরি দেখ কোথাও গিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে কি-না।

ইভান বিরক্ত চোখে সবার দিকে চেয়ে বললো,

— সবাই বস, বল কি খাবি? পানি?

আফিন হাসলো ইভানের কথায়। বললো,

— তুই পানিই আন ভাই। তোর কাছে কিছু খেতে চাওয়ার মতো মুখ আমাদের নাই।আমরা শুধু পানিই খায়।

রাইদা হেসে এগিয়ে গিয়ে কিচেনে গিয়ে মিষ্টিকে খুঁজলো। জুঁই বসে পড়লো সোফায়। মিষ্টির সাথে দেখা করে কথা বলার মন তার নেই। সে শুধু ইভানকে এক নজর দেখতে এসেছে।ব্যস,

সারা ঘরময় খুঁজে মিষ্টিকে না পেয়ে রাইদা ফিরে এসে বললো,

— কি-রে ইভান মিষ্টিকে দেখছি না যে?

— গেস্টরুমে দেখ।

রাইদা ছুটলো গেস্ট রুমের দিকে। মিষ্টির সাথে রাইদার সম্পর্ক বেশ ভালো। ভার্সিটি লাইফটা তাদের বেশ আনন্দে একসাথে সময় কাটিয়েছিলো।তখন ব্যস্ততা ছিলো না তেমন। এখন তো কাজের জন্য ব্যস্ত,ইদানীং বিয়ের কাজকর্মেও বেশি ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে রাইদাকে। রাইদার বিয়ে আফিনের সাথেই হতে যাচ্ছে। দু’বছর ধরে সম্পর্কে চলছে। তবে তাদের মধ্যে লিমিটেশন আছে সম্পর্কের। ইতিমধ্যে তারা তুমি বলতেও শুরু করে দিয়েছে একে অপরকে। মিষ্টি শুনলে বেশ খুশী হবে।রাইদা দরজা নক করে ডাকতেই মিষ্টি দরজা মেললো। রাইদা ভেতরে প্রবেশ করে দেখলো মিষ্টির চোখমুখ লাল হয়ে আছে। রাইদা মিষ্টিকে জড়িয়ে ধরলো। পিঠে হাত বুলিয়ে দিতেই মিষ্টি ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। রাইদা মিষ্টিকে শান্ত হতে বললো।তারপরও মিষ্টি শান্ত হলেও ফুঁপানো থামেনা। রাইদা কিছু জিজ্ঞেস করার আগেই মিষ্টি নিচু স্বরে বললো,

— আমি আমার মা-বাবা, আর ভাইয়ার(মিষ্টির দুলাভাই) কথা অমান্য করে ইভানকে বিয়ে করেছিলাম রাইদা। বিয়ের পরও বাবা চেয়েছিলো আমি যেনো ইভানকে ভুলে ফিরে যায়। আমি যায়নি,ইভানের কাছে থেকেছি।এসবের পরিবর্তে ইভানের কাছে আমি কিছুই পায়নি রাইদা। ইভুটা কেন এমন করে?

রাইদা কি বলে মিষ্টিকে শান্ত করবে ভেবে পেলো না। কোন সান্ত্বনা বাণীও দেওয়ার মতো শব্দ তার কাছে নেই।কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর হঠাৎ চোখমুখ শক্ত রাইদা বলে উঠলো,

— তুই তোর গ্রামে চলে যা মিষ্টি।তোর বাবার কাছেই ফিরে যা। এরপর যা হবার তা হবে।

কথাটা শুনেই মিষ্টির হাত-পা অসাড় হয়ে আসতে লাগলো। কাঁপা স্বরে বললো,

—- তুই বাবাকে চিনিস না রাই, আমি যদি ফিরি তাহলে বাবা আমাকে আর ইভানের মুখও দর্শন করত দিবে না।আমি কি করবো?

— করিসনা ইভানের মুখ দর্শন। তোর সাথে এতো খারাপ ব্যবহার করে তারপরও কেন তোর এতো পুড়বে?

— খারাপ ব্যবহার আমিও করি,ইভুও করে।
এটা আমাদের সাক্ষাৎ হওয়ার শুরু থেকেই চলেছে। অভ্যাস হয়ে গিয়েছে। আমি নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখলেও ইভু একটুও শুধরায়নি। আমি বুঝতে পারছি না চাইছে টা কি সে?

রাইদা জানে ইভান কি চায়। শুধু সে নয়,মিষ্টিও জানে। ইভান চায় মিষ্টি সবসময় ঘরেই থাকুক ঘরবন্দী হয়ে।সে বুঝে বাইরে যাওয়ার প্রয়োজন মিষ্টির নেই। ঘরে ফিরে মিষ্টির সাথ যতোই সে ঝগড়া করুক। মিষ্টি পুতুলের মতো সুন্দর চেহারাটা দেখলে সে শান্ত হয়ে যায়। রাগের বসে মানুষ অনেক কথা বলে,বিশেষ কর স্বামীরা। রাগ ঝাড়ার মূল উৎস হচ্ছে তাদের কাছে স্ত্রী-। দিনের সব ক্লান্তি,চিন্তা,রাগ সব একটা খুঁনসুটিময় ঝগড়া মাধ্যমে মেটার চেষ্টা করতো। কিন্তু বাড়াবাড়ি পর্যায়ে এসে দুজনে সিরিয়াস হয়ে যায়। একে অপরের মুখও দেখেনা।এটাকে সম্পর্ক বলে?

রাইদা হাল ছেড়ে দেওয়ার ভঙ্গিতে বললো,

— দুনিয়ার কোন মানুষ তোদের বুঝাতে পারবে না।যদি না তোরা নিজ থেকে বুঝতে চেষ্টা করিস।ইগোস্টিক পিউপল। ছাড় এখন,চলো ড্রয়িংরুমে সবাই আছে।জম্পেশ আড্ডা চলবে।

— ইভু তো আমার মুখ দেখবেনা বলেছে রাইদা।

রাইদা উঠে দাঁড়িয়ে বললো,

— মুখ দেখতে না চাইলে মুখে নিকাব লাগা।
তারপরও আয়।

মিষ্টি গেলো না সাথে। দরজা আঁটকে ভেতরেই বসে থাকলো।আফিন আর মুহিতও ডেকেছে,তারপরও বের হয়নি। মিষ্টি রাগে অভিমানে শুয়ে পড়লো,যার ডাকার সে ডাকেনি।এদের ডাকে কি হবে?

মাঝরাতে যখন মিষ্টির ঘুম ভাঙলো।তখন সে অনুভব করলো তার গলা শুকিয়ে এসেছে। অদ্ভুত ব্যথাও করতে শুরু করলো।জরুরি প্রয়োজনে গলা ভেজাতে হবে। তারজন্য ঘর থেকে বের হতে হবে। মিষ্টি ফোনটা হাতে নিয়ে সময় দেখলো মাত্র এগারোটা। ওরনা ভালোমতো গায়ে জড়িয়ে দরজাটা মেললো সে। হঠাৎ দরজার সামনে ইভানকে দেখে ভয়ে দু’পা পিছিয়ে এলো।অন্ধকারের মধ্যে আবচা আলোতে ইভানের পুরুষালী অবয়ব চিন্তে সমস্যা হয় না তার। মৃদু আলোর ছটা তখন ফ্লোরে লুটোপুটি খাচ্ছিলো। ইভানকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে মিষ্টিও কিছু বললো না। ইভানের পাশ কেটে যাওয়ার সময় ইভান খপ করে মিষ্টির হাত ধরে ফেলে বললো,

— মশারী টাঙাস নাই কেন? আগে গিয়ে মশারী টাঙা,কামচোর!

হতভম্ব মিষ্টি ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকলো সেকেন্ড পাঁচেক।এরপর হনহনিয়ে রুমে গিয়ে বিছানায় উঠে মশারী টাঙাতে লাগলো। এ কেমন কপাল নিয়ে জন্মেছে সে। মিষ্টি যেতেই ইভান একটা প্লেটে করে ভাত,মুরগীর মাংস আর ডাল নিলো।একগ্লাস পানি সমেত হাত নিয়ে রুমে এসে দরজাটা ভেতর থেকে আঁটকে দিলো। খাবার টেবিলে রেখে মিষ্টিকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— কামচোর,ভাত খেয়ে নে।

________________
©তারিন _জান্নাত

(চলবে)

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে