কাছেপিঠে পর্ব-০৩

0
807

~কাছেপিঠে~
পর্বসংখ্যাঃ০৩

কিচেনে এসে দেখলো ভাত পুড়ে ধোঁয়া ছড়াচ্ছে চারপাশে। দ্রুত চুলা বন্ধ করে ঢাকনা উল্টে দেখলো পুড়া পুড়া গন্ধ্য বেরুচ্ছে। অলরেডি অনেকটা সময় ব্যয় করে তরকারি কেটেকুটে তারপর ভাত বসিয়েছিলো। ভাতের অবস্থা দেখে তরকারি রান্না করার ইচ্ছেটা ফুড়ুৎ করে উড়ে চলে গেলো ইভানের।
সবশেষে চিন্তা করলো পাশে রেস্টুরেন্ট থেকেই খাবার কিনে আনবে। যদিওবা তাদের টাকা পয়সার হিসাব-নিকাশ আলাদা। তার কিনে আনা খাবার মিষ্টি খাবে নাকি তাতেই সন্দেহ।

ফোনে খাবার অর্ডার দিয়ে সোফায় এসে বসলো ইভান। মিষ্টি একচোট চোখ তুলে চেয়ে পূনরায় বইয়ে মনোযোগ দিলো। ইভান উশখুশ করতে লাগলো। টিভিতে তো এই টাইমি রেসলিং চলে। প্রতিদিন টাইমলি দেখা হয়।আজ কোন মুখে দেখবে। ফাজিল মেয়ে এখান থেকে আজ সরছেও না। বেশ বড় গলা করে বলেছিলো টিভি যার,বিল তার। এখন টিভি ছাড়লেই কখন না জানি ছেলেটাকে ডেকে নিয়ে আসে এই মেয়ে।

ইভানের ভাবনা চিন্তার মাঝে বিকট শব্দ তুলে ফোনটা বেজে উঠলো। ফোনের শব্দে সচকিত হয়ে ফোনটা হাতে নিলো। স্ক্রিনে জুঁইয়ের নামটা ভেসে উঠলো। যথাসময়ে ফোনটা রিসিভ করলো ইভান।
জুঁই বলে উঠলো,

— দোস্ত বৃহস্পতিবার তো আফিনের বিয়ে।
আসবি না তুই?

ইভান বিরক্ত হলো,বলল,

— আজ মাত্র মঙ্গলবার। বৃহস্পতিবারের কথা
তুই আজ জিজ্ঞেস করছিস কেন?

— না এমনিই জিজ্ঞেস করেছি। অফিসে তো
তোর সাথে তেমন আড্ডা দিতে পারিনি। আচ্ছা মিষ্টির সাথে তোর দেখা হয়েছিলো। ছেলেটা কে ছিলো?

জুঁইয়ের কথার প্রত্যুত্তরে ইভানের চেঁচিয়ে বলতে ইচ্ছে হলো,অফিস আমার কাজের জায়গা, সেখানে তোর সাথে আড্ডা কেন দিবো আমি।”
মিষ্টি শুনবে বলে আর কথাটা বললো না।তাই সোফা থেকে উঠো মিষ্টির কাছ থেকে কিছুটা সরে আসলো,মৃদু আওয়াজে শুধু বলল,

—- দোস্ত! অনেক হয়েছে তোর আমার পক্ষে
কথা বলা।প্লিজ আর আমাদের মধ্যে কোন কথা বলতে আসিস না। তুই তোর মতো হ্যাপি থাক।

ইভান লাইন কেটে এসে দেখলো,মিষ্টি বই বন্ধ করে তার দিকে তাকিয়ে আছে। ইভান বহুদিন পর মিষ্টিকে এভাবে তার দিকে তাকাতে দেখলো। বুকের ভেতর কেমন যেনো উত্তাল ঢেউ শুরু হয়ে গেলো। মন চাইলো সব ঝগড়াবিবাদ চুকিয়ে একে অপরের সান্নিধ্যে চলে আসতে।ডুবে যেতে মন চাইলো মধুর আলিঙ্গনে।

ইভান মিষ্টির মুখোমুখি বসে বলল,

— মিষ্টি চাকরিটা ছেড়ে দে না। দেখ এখানে
তোর তো কিছুর অভাব নেই।বা আমি তোকে খাওয়াতে পারবো না এমনটাও তো নয়।তাহলে কেন করছিস চাকরিটা। দরকার টা কি?

মিষ্টি ঈষৎ হাসলো। এরপর বলল,

— দরকারটা হচ্ছে আমার আত্মসম্মানের।
আমি তোর মতো অট্টালিকায় বড় হওয়া মানুষ নই।
আমার বাবা সামান্য একজন কৃষক। ছোট শহরে জীবনযাপন করা আমি যখন এই শহরে এসে তোদের মতো উচ্চবিত্ত পরিবারের বন্ধুদের সাথে মেলামেশা করি।তখন সবচেয়ে বড় ক্ষতিটা আমি আমারই করেছি।

ইভান বিরক্ত হয়ে বলল,

— এসব কি রচনা শুনাচ্ছিস।

মিষ্টি রেগে চোখমুখ লাল কর বলল,

— খবরদার রচনা বলবিনা।
আমি এখনো ভুলিনি তোর বলা কথাগুলো। অফিস থেকে ফিরেই তো বলতি আমি সারাদিন শুয়ে-বসে দিন কাটাচ্ছি।কাজের কাজ কিছু করছিনা। তোর টাকা নষ্ট করছি।

—- আগের কথা এখন তুলে লাভ কি?

— তুই আমাকে ছোটলোক বলেছিলি।
তুই ভুলতে পারিস এসব, আমি না। এজন্য করছি চাকরি।যাতে তোর টাকায় চলতে না হয়।

মিষ্টি উঠে দাঁড়িয়ে চলে যেতে নিলে ইভান দ্রুত দাঁড়িয়ে বলল,

— তুই কি বলেছিস আমাকে সেগুলো কেন বাদ রেখেছিস? দোষ শুধু আমার।আমি অহংকারি। আর কি যেনো বলছিলি আমার জন্মের…

মিষ্টি ইভানের কথা সম্পূর্ণ কর্ণগোচর করলো না।মিষ্টির উপেক্ষা ইভানের রাগ আরো দ্বিগুন বেড়ে গেলো। সোফার সামনে থাকা সেন্ট্রল টেবিলটায় সজোরে লাথি মারলো সে। এরপর রুমে আসলো মানিব্যাগ নেওয়ার জন্য। রুমে এসে দেখলো মিষ্টিও তৈরি হচ্ছে কোথায় যাওয়ার জন্য। তা দেখে ইভানের মেজাজ তুঙ্গে। সে দ্রুতপায়ে মানিব্যাগ হাতে নিয়ে দৌড়ে রুম থেকে বের হয়ে দরজাটা বাইরে থেকে আঁটকে দিলো যাতে মিষ্টি বেরুতে না পারে।

বাইরে থেকে দরজা আঁটকাতে দেখে মিষ্টি দৌড়ে এলো।কিন্তু কাজের কাজ কিছু হলো না। ইভান ততক্ষণে দরজা আঁটকে দিয়ে চলে গিয়েছে। মিষ্টি দ্রুত বেলকনির দিকে পা বাড়ালো। ইভানকে গেইট দিয়ে বের হতে দেখে চেঁচিয়ে বললো,

—- হারামখোর! বাসায় আসিস আজ তুই।

নিচ থেকে ইভান পেছন ফিরে বলল,

— আসবো তোর জন্য সতীন নিয়ে।
দেখি তুই কি করতে পারিস।

— বরণডালা সাজায় রাখবো তোদের জন্য।
বাসায় আয় আজ শুধু।

দুজনের চেঁচামেচিতে আশেপাশে ফ্ল্যাটের ভাবিরা এবং তাদের বাচ্চারাও বেলকনি দিয়ে উঁকিঝুঁকি মারতো লাগলো। ইভান তাদের তাদের দিকে এমনভাবে তাকালো,যেটা দেখে তারাও সুর সুর করে স্থান ত্যাগ করলো।

ইভান ভারাক্রান্ত মন নিয়ে দানব আকৃতির বিল্ডিংয়ের সামনে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলো। লোকজন তেমন নেই এদিকে। ইভান মনে মনে নতুন ভাবনার চক খসলো। আজ খেয়েদেয়ে একদম রাত বারোটার দিকে বাড়ি ফিরবে। ক্ষুধায় কাতর হয়ে যাক মিষ্টি। তাও একটা ভাতের দানাও নিয়ে যাবে না আজ। আধঘন্টা ঘুরলো ফিরলো রাস্তায়।নিরিবিলি পথ দিয়ে রেস্টুরেন্টের রাস্তা ধরার জন্য যেই না এগোতে যাবে,ওমনি দশটা মতো কুকুর তেড়ে আসতে লাগলো ইভানের দিকে। ইভান ছোট বেলা থেকে কুকুরকে ভীষণ ভয় পায়।ভার্সিটি লাইফেও মিষ্টির সামনে কম লজ্জায় পড়েনি। ভাগ্যটা ঘুরেফিরে মিষ্টির সামনেই তাকে কুত্তা তাড়ানি খাওয়াতো। নির্মম ভাগ্যের পরিহাস,আজও এই জনমানবহীন রাস্তায় কুত্তার তাড়ানি খেতে চলেছে সে। মিষ্টি একটা বুদ্ধি শিখিয়ে দিয়েছিলো তাকে। কুকুর দেখলেই যেনো মাটিতে হাত দেয়।তাতে কুকুররা ভয় পেয়ে পেছনের দিকে ছুট লাগায়। আজও মিষ্টির কথানুযায়ে ইভান মাটিতে হাত রাখলো। কিন্তু মাতাল কুত্তাগুলো দ্বিগুন ঘেউ ঘেউ করতে করতে ইভানের দিকে প্রচণ্ডবেগে ছুটে আসতে লাগলো।
আজীবন কুত্তাকে ভয় পাওয়া ইভানের,সময়টা আজও ব্যাতিক্রম গেলোনা। এক তাড়ানিতে একেবারে বাসার সামনে এনে দিয়েছে। সর্বশরীর ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেলো৷ এতো বড় দামড়া ছেলে কুকুর দৌড়ানি খেয়েছে শুনলে মানুষের সামনে মুখ দেখাতে পারবে না। ইভান চারপাশে উঁকি দিতে দিতে উপরে তাকালো।ঠিক তৎক্ষনাৎ মিষ্টিকে সেখানে দাঁড়িয়ে হাসতে দেখে চট করে বুঝতে পারলো এই অকাজটা কে করিয়েছে। মিষ্টি হাতের তর্জনী উঁচু করে দেখালো গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা দারওয়ানকে। দারওয়ানটা একদম হালকা বয়সের। ইভান আর মিষ্টির বছর দুয়েকের বড় হবে। তার শরীর জ্বালানো হাসি দেখে ইভানের চতুর মস্তিষ্ক বুঝলো দারওয়ানের সাহায্য নিয়ে মিষ্টি কুত্তাগুলাকে হায়ার করে তাকে তাড়ানি খাইয়েছি।
ইভান মিষ্টির দিকে চেয়ে বলল,

— এ জীবনে যদি আমি বেঁচে থাকি,
তাহলে এর শোধ আমি নিবোই।

— শ্লা! দরজা খোল আগে। তোর সাথে
কোস্তাকুস্তি করার মতো চর্বি আমার নেই।
চট করে দরজা খোল।

— এ্যাই ভাষা ঠিক কর।

— আমি ছোটলোক।আমার ভাষাও
হবে ছোটলোকি।

ইভান চুপচাপ সিঁড়ি বেয়ে দ্বিতীয় তলায় উঠতে লাগলো।একগ্লাস ঠাণ্ডা পানি পান করা দরকার।গলা শুকিয়ে এসেছে। উফফ!

ইভান ঠাণ্ডা পানি খেয়ে তাদের ঘরের দরজাটা খুললো। হঠাৎ অস্থির লাগতে শুরু করলো ইভানের। মাথা চক্কর দিতে শুরু করলো। ঘামের পরিমাণ আরো বাড়তে লাগলো। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসার আগেই ধপ করে বিছানার উপর গিয়ে গড়িয়ে পড়লো। ইভানকে হঠাৎ এভাবে বিছানায় পড়ে যেতে দেখে মিষ্টি আতঙ্কিত হয়ে হাতের ব্যাগ ছুঁড়ে মেরে তড়িৎ বেগে ইভানের কাছে ছুটে আসলো। ইভান তখন চোখ বন্ধ অবস্থায় মিষ্টির হাতের স্পর্শ পেয়ে হাতটা শক্তকরে চেপে ধরলো। ইভানকে এমন অস্বাভাবিক রূপে দেখে মিষ্টি কেঁদে ফেললো। উৎকন্ঠিত হয়ে ইভানের মাথায় হাত বুলিয়ে ডাকতে লাগলো।ইভানের সাড়া না পেয়ে মিষ্টি পাগল হয়ে যাওয়ার জোগাড়। আগের তুলনায় গলার স্বর বাড়িয়ে ডাকতে লাগলো।তাতেও ইভানের সাড়া না পেয়ে মিষ্টি হিতাহিত জ্ঞ্যান হারিয়ে ফোনটা বের করে কাদের যেনো ফোন দিলো।
_______________
©তারিন_জান্নাত

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে