~কাছেপিঠে~
পর্বসংখ্যাঃ০২
ইভান দশ মিনিটের পথটা পায়ে হেঁটে অতিক্রম না করার সিদ্ধান্ত নিলো আজ। গাড়িতে করে ছড়ে পৌছালো ‘দাওয়াত রেস্তোরাঁয়’। পরিচ্ছন্ন ফরমাল পোশাকে সাহেবী ভাব দৃশ্যমান হয় তার। রেস্তোরাঁর পূর্ব দিক থেকে পশ্চিম দিক পর্যন্ত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে মিষ্টিকে খুঁজলো। সবশেষে হঠাৎ মাঝের সারিতে মিষ্টিকে দেখতে পেলো। মেজাজ দ্বিগুণ গরম হলো তার এবার। এজন্যই চাকরি করার এতো শখ মেয়ের। কোথায় ঘর-সংসার করবে,বাচ্চা সামলাবে তা নয়। মূলত মিষ্টির চাকরি করা,এবং স্বাধীনতা চাওয়ার পর থেকেই দুজনের সম্পর্কের মধ্যে দূরত্ব আসে। মিষ্টি চেয়েছিলো নিজের পায়ে দাঁড়াবে,যাতে তার সকল চাহিদার জন্য ইভানের কাছ থেকে টাকা নিতে না হয়। দিন অথবা মাস শেষে কিছু আয় সঁচয় করা যায়। লাভটা তো তাদেরই হতো।
ইভান মিষ্টির কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালো। আশেপাশে লোকজনের দিকে যেনো তাদের ভ্রুক্ষেপ নেই। কি এমন গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা চলছে? শুনার জন্য আরেকটু এগিয়ে গেলো তাদের নিকটে। ইভানকে দেখে মিষ্টির সামনে বসে থাকা মানুষটি হুট করে বলে উঠলো,
—- আর কিছু লাগবে না ওয়েটার!
ইভান অবাক হয়ে বলল,
—- কে ওয়েটার?
— আপনি, যান এখান থেকে, প্রয়োজন হলে ডাকবো।
অপমানে মুখ থমথমে হয়ে যায় ইভানের। সে তীর্যক চানহিতে মিষ্টির দিকে তাকালো। ঠিক তখনি মিষ্টিও তাকালো। ইভানকে দেখে অবাক হলো না। অত্যন্ত শীতল কন্ঠে বলল,
— বসে পড়। আমাদের সাথে লাঞ্চটা করে নে।
ক্ষেতাপুরি তোর লাঞ্চের। বিড়বিড় করে বলল ইভান।
মিষ্টির সামনে বসে থাকা লোকটি সরল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
— উনি তোমার কে হয় মিষ্টি।
— উনার সাথেই আমার ডিভোর্সের আলোচনা
হচ্ছিলো এতক্ষণ।
লোকটি ঠোঁট চোখা করে বলল,
—- ওওও!
ইভান ভড়কে গেলো মিষ্টির কথায়। তার মনেই নেই সকালে সে মিষ্টিকে ডিভোর্সের কথা বলেছিলো।
তাই কন্ঠে একরাশ বিষ্ময় ঢেলে ইভান বলল,
—- কিসের ডিভোর্স মিষ্টি।
মিষ্টি বিরক্তি চোখে তাকালো ইভানের দিকে। ইভানের তীব্রভাবে ভুলে যাওয়ার স্বভাব আছে। এরজন্য কম ঝগড়া হয়নি তাদের মধ্যে। যারজন্য সম্পর্কের আজ এই অবস্থা। একটা সম্পর্কে যেমন ভালোবাসা, বিশ্বাস দরকার। তেমনি দরকার যত্নের।তাদের মধ্যে ভালোবাসাটা থাকলেও বিশ্বাস এবং যত্নটা কম ছিলো।
মিষ্টি দৃষ্টি ঘুরিয়ে সামনে বসে থাকা তার ভাইয়ের সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বন্ধু তাসিনের দিকে চেয়ে ইশারা করলো যেনো তার পরিচয়টা দেয়।
তাসিন করমর্দনের জন্য হাত বাড়িয়ে বলল,
— হ্যালো মিস্টার ইভান।আমি ডিভোর্স লয়ার
তাসিন আহমেদ।
ইভানের বেয়াদবি করার একটা স্বভাব আছে।সে স্বভার থেকে সে হাত তো বাড়ালোই না, মিষ্টির দিকে চেয়ে অত্যন্ত কঠিন স্বরে বলল,
— বাসায় চল, তোর সাথে কথা আছে।
— যা বলার এখানেই বল। আমার ক্লাস আছে।
—- ছুটি নে।
— অসম্ভব!
আধখাওয়া খাবার রেখেই মিষ্টি উঠে পড়লো। ইভান অস্থির হয়ে গেলো। সাথে সাথে দাঁড়িয়ে বলল,
— না খেয়ে উঠিস না।আমি চলে যাচ্ছি।
পেটপুরে খা তুই।
ইভান চলে গেলো। তাসিন মিটমিট হেসে বলল,
— তোমার স্বামী তো তোমাকে প্রচুর ভালোবাসে।
শুধু একটু ত্যাঁড়ামি স্বভাব আছে তাই না?
মিষ্টি নিরলস ভাবে বলল,
— একটু নয়,অনেকটাই!
—- আচ্ছা সমস্যাটা কি খুলে বলো আমাকে।
— আমি আমাদের ব্যাক্তিগত সমস্যাটা
বলতে চাচ্ছি না। আপনার কাজ শুধু পেপার্স রেডি করা।
— আর ইউ সিউর। তোমাদের মধ্যে আমি তেমন
কোন সমস্যা দেখতে পাচ্ছি না। তাহলে ডিভোর্স নিতে চাচ্ছো কেন?
মিষ্টি চুপ থাকলো কিছুক্ষণ। তাদের সাংসারিক জীবনটা কেমন যেনো খাপছাড়া হয়ে আছে। শুধুমাত্র নিজের স্বাধীনতা দাবি করার জন্য কেউ সম্পর্কের বিচ্ছেদ চায়? সমস্যার শুরুটাতে তো তৃতীয় কেউ ও তো আছে,যেটা মিষ্টি আঁচ করতে পারছে। সন্দেহজনক কাউকেই সে দেখেনি এখনি অবধি। ইভানকে চোখে চোখে রাখার জন্য তার অফিসের কাছে কলেজের চাকরিটা নিয়েছিলো সে। অদ্ভুত অদ্ভুত চিন্তার আগমন ঘটার কারণে মিষ্টি মাথা এলোমেলো হয়ে গেলো৷ অস্থির,অবিচল হৃদয়ের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে আচমকা বলে উঠলো,
— আমি আরো একটা মাস সময় চাই।
একমাস পর আমি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাই?
তাসিন আহমেদ বিচক্ষণ দৃষ্টিতে মিষ্টিকে পর্যক্ষণ করে কিছু ভাবলো। এরপর মিষ্টির সিদ্ধান্ত সায় জানাতে মাথা নাড়ালো।
________
আজ মঙ্গলবার, সেজন্য বাজারে জমজমাট হাট বসে। স্বল্পমূল্যে তরতাজা তরিতরকারি কিনতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন জায়গা থেকে কাঁচাসবজি আসার ফলে সবকিছুর দাম কমই বলা চলে। যখন রুটিন অনুযায়ে ইভান রান্না করে,তখন কাঁচা বাজার ,মুদি বাজার সব মিষ্টিকে করতে হয়। রান্নাটা ইভান সন্ধ্যায় ফিরলে করবে। কাঁচা তরকারির দিকে চেয়ে মিষ্টির মন খারাপ হলো। এতো সুন্দর তরতাজা সবজিকে ইভান অখাদ্য বানিয়ে ফেলে। অনেক কষ্টে গিলতে হয়। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বাসার পথে রওনা দিলো সে।
ইভান বাসায় ফিরলো ঠিক সন্ধ্যে সময় ছয়টা। মিষ্টির তখন ঘরদোর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে ফেলে।শুধু কিচেন বাদে। কারণ কিচেন পরিষ্কারের দায়িত্ব আপাততে ইভানের। ডোরবেল বাজতেই মিষ্টি দ্রুতপায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা মেললো। দরজার মেলতেই ইভান মিষ্টির দিকে চেয়ে মুখ মুছড়ালো। এমনভাবে মুছড়ালো যেটা দেখে মিষ্টির রাগে দাঁতের সাথে দাঁত চেপে ধরলো। মিষ্টি তেড়ে কিছু বলবে তার আগে ইভান বলে উঠলো,
— সর সর সামনে থেকে। ঘামের গন্ধ আসছে
তোর গা থেকে।
—- তুই আমার গায়ের গন্ধ শুঁকছিস কেন?
— আমার অকাল পড়েনি, তোর গা শুঁকতে যাবো।
ইভান হনহনিয়ে ভেতরে চলে গেলো। দুপুরের রাগটা এখনো তার মস্তিষ্ক জুড়ে দখল করে আছে। মন চাইছে ঠাস ঠাস ছড়িয়ে মিষ্টির গাল লাল করে দিতে। দামী গাল, একটা চড় মারা যায় না,উল্টো পাঁচটা চড় তার গালে এসে পড়ে।
ফ্রেস হয়েই কাজে লেগে পড়লো। মিষ্টি সোফায় বসে মনোযোগ দিয়ে বই পড়ছিলো। কিচেন থেকে ভেসে আসা কাটকুটির শব্দে মনোযোচ্যুত হয় মিষ্টি। তন্মধ্যে কলিংবেল বেজে উঠলো। মিষ্টি গিয়ে দরজা খুলে দেখলো একটা কম বয়সী ছেলে দাঁড়িয়ে আছে।
মিষ্টি প্রশ্নাত্বক চোখে তাকিয়ে থাকলে ছেলেটি বলে,
— আফা,তিনমাস ধরে ডিসের বিল দিচ্ছেন না।
লাইন কি কেটে দিবো?
বিলের কথা শুনে মিষ্টির চোখ চড়কগাছ। তার হাতে একটা টাকাও আর অবশিষ্ট নেই।মাসের শেষ দিকে প্রচুর হাতে টান পড়ে তার।ধার নিয়ে চলতে হয়।টাকা কোথায় পাবে এখন।
ইভান কিচেন থেকে কলিংবেল বাজার শব্দ শুনেছিলো। কথার আওয়াজ না পেয়ে তার তীব্র সন্দিহান মনটা চেঁচিয়ে কিছু একটা জানালো। দ্রুতপায়ে কিচেন থেকে বেরিয়ে এলো। মিষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিকে দেখে ভ্রূ কুঁচকালো। হাত মুছে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,
— কি সমস্যা?
—- ডিসের বিল দিস নাই কেন?
—- আশ্চর্য, আমি ডিসের বিল কেন দিবো?
টিভি কি আমি কিনেছি?
— তুই কিনিস নি। কিন্তু খেলা দেখে কে?
— তুই!
মিষ্টি রেগে বলল,
— আমি খেলা দেখি না।তুই দেখছ। মনে নাই ঝগড়া হওয়ার পর থেকে সন্ধ্যার পর রাত অবধি বসে বসে খেলা দেখতিস।তাও তিনমাস ধরে,তাহলে আমি কেন বিল দিবো?
— টিভি যার,বিল ও তার। এ্যা ভাই,
এই মহিলাকে পুলিশে ধরিয়ে দেন। প্রচণ্ড জ্বালাচ্ছে।
—- মাথা খারাপ করবি না।জলদি টাকা দে।
— তুই দে।
তাদের এহেন কথোপকথনের মাঝে ছেলেটি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে থাকলো। অতঃপর গলা হিক দিয়ে বলল,
—- আমি কাল-পরশু আবার আসবো।
ততক্ষণে আপনারা সিদ্ধান্ত নেন কে বিল দিবেন।আসি। স্লা’মালাকুম!
ছেলেটি যেতেই ভাত পুড়া গন্ধ্য নাকে আসলো ইভানের। হঠাৎ দিক বেদিক ভুলে মারলো এক দৌড় কিচেনের দিকে। ইভানের দৌড় দেখে মিষ্টি হাসি আঁটকাতে পারলো না। হাসতে হাসতে পূনরায় সোফায় গিয়ে বসলো।
___________
©তারিন_জান্নাত
(চলবে)