কাকতাড়ুয়া পর্ব-০৩

0
1016

#কাকতাড়ুয়া
#পর্ব_৩
#লেখিকা_নূরজাহান_ফাতেমা

আমার প্রতিউত্তরের অপেক্ষা না করে নিসা উঠে গিয়ে ফোনটা বের করে ফেলল।আমার কাছে ব্র্যান্ড নিউ ফোন দেখে অবাক হল নিসা।

“এই ফোন কই পেলি তুই?”

নিশান ভাই এর নাম বলতে গিয়েই থেমে গেলাম আমি।মনে পড়ল উনি কাউকে জানাতে বারণ করেছেন।চুপ হয়ে গেলাম আমি।মিথ্যা বলা পাপ না হলে একটা বলে ফেলতাম এখন।নিসা সুক্ষ্ম দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।খুব অসস্তি হচ্ছে আমার।এক ঝামেলার রেশ না কাটতেই আগুনে ঘি ঢালাতে আরেক ঝানেলার শুরু।নিসা এইটা মামির কাছে দিবে।তার পরবর্তী পরিস্থিতির চিন্তা করেই গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছে আমার।এর মাঝেই নিসা ধরে ফেলল ফোনটা কোথায় পেয়েছি আমি।সে চট করে বলল,

“ভাইয়ার কাছে আবদার করেছিলি তাই না?”

এবার আমি কেঁদে উঠলাম।আমার কান্না দেখে কিঞ্চিৎ বিরক্ত হল নিসা।খেঁকিয়ে বলল,

“কি করবি এই ফোন দিয়ে।ভাইয়ার কাছে আমাদের নামে নালিশ,জানাবি?নাকি তোর বাবার পাঠানো টাকার অবশিষ্ট কিছু বাঁচে কিনা জানতে নিজের নামে বিক্যাশ একাউন্ট খুলবি এবং তোর বাবাকে তোর একাউন্টে টাকা দিতে বলবি?”

ক্রমাগত কেঁদেই চলেছি আমি।সারাজীবনে কান্নাটাই হয়ত আমার কপালের লিখন ছিলো।জানি কাজ হবে না তাও নিসার পা জড়িয়ে ধরলাম।

“তুই মামিকে কিছু বলিস না দয়াকরে।আমাকে যা শাস্তি দেওয়ার দে।যা করতে বলবি করব আমি।নিশান ভাইয়ের সাথে মামির অশান্তি হোক আমি চাই না।”

“আচ্ছা বলব না।তবে এই শর্তে যে,আমি যখন যা বলব বিনা বাক্যে তাই করে দিতে হবে এবং ভাইয়া কিছু জানবে না।এই ফোন এখন থেকে আমার কাছে থাকবে।”

এক ঝটকায় পা সড়িয়ে বলল নিসা।হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমি।ওর শর্তটাও মেনে নিলাম।ও আমার সমবয়সী।ওই বড় আমার।কয়েক মাস আগে পিছে জম্মেছি আমরা।যখন আব্বু আম্মু একত্রে ছিলো ওর সাথে খুব ভালো সখ্যতা ছিলো আমার।এখানে এলেই দুইজন সারাদিন খেলতাম।কত আদরের ছিলাম তখন।কত মজা করতাম একসাথে।নানা-নানি জীবিত থাকাকালীনও ভালোই চলছিলো।মামি আমাকে আর নিসাকে এক নজরে দেখতো।তুলে খাওয়াতো তিন বেলা।কিন্তু একটা এক্সিডেন্টে গত হন তারা।যার দ্বায় আমার কাঁধেই চাপানো হয়।আমার উপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় সবাই।বদলে যায় মামা-মামি।তাদের সমান তালে পাল্লা দিয়ে নিসাও পরিবর্তন হয়ে যায়।

_________
শীতের সকাল।পিঠাপুলির আয়োজন করা হয়েছে।গরম গরম চিতই পিঠা ডুবানো হয়েছে দুধের হাড়িতে।মামি চুলোয় বসে ভাপা পিঠা বানাতে ব্যস্ত।আম্মু রুটি বেলে ছোট ছোট গোল চাক করে এগিয়ে দিচ্ছে আমার দিকে।হাতে হাত লাগিয়ে দুইজন সমান তালে কাজ করছি।দেখে কেউ বুঝবেই না কয়েক বছর আমাদের মাঝে কথা চলে না।আমার পুলি পিঠার ডিজাইন সুন্দর হয় বলে সে দ্বায়িত্ব বর্তেছে আমার উপর।আম্মুর বর্তমান বর তার আদরের ছেলেকে নিয়ে আসবে জন্য এতো আয়োজন।পাশের পাটিতে বসে ছোট্ট আয়াত গভীর মনোযোগ দিয়ে দেখছে এসব।আয়াত আমার সৎ বোন।বছর ছয় হবে।বড় রুটির উপর টিনের রাউন্ড শেপের বস্তু দিয়ে চাপ দিলেই হয়ে যায় অনেক গুলো ছোট অংশ।তার ভিতরে পুর ঠেলে ছোট ছোট চাপ দিয়ে গড়ছি আকর্ষনীয় ডিজাইন।যা দেখে বেশ মজা পাচ্ছে সে।আমি একটা পুলির ডিজাইন দিতে দিতে আয়াতকে বললাম,

“আয়াত সোনা।এসব তোমার পছন্দ হয়েছে?”

আয়াতের বয়স ছয় হলেও সে এখনো স্পষ্ট করে কথা বলতে পারে না।কথা কিছুটা নাসিক্য ঝংকার তুলে উচ্চারন করে।প্রতেকটা কথায় সে ন আর ত ঢুকিয়ে দেয়।সামনে পাটির একটা দাঁত পড়েছে ওর।ফোকলা দাঁতে হাসি দিয়ে বলল,

“হ্যাঁ খুব পছোন্তো হয়েছে।তুমি এমন কনছো কিভাবে?”

“বড় হলে তুমিও এসব শিখে যাবে।তখন দেখবে এটা কতো সহজ।”

“আয়াতের বড় হয়ে ওসব করে খেতে হবে না।যথেষ্ট আদরের সন্তান সে।রাজকীয় কপাল ওর।অন্যের মতো পোড়া কপাল না।রাজকন্যার মতোই থাকবে।”

কথাগুলো পাশ থেকে উচ্চারণ করল মামি।আম্মুর মুখেও আনন্দরেখা ফুটে উঠল।নিজের সন্তান সুখ কেই না কামনা করে।এক সন্তানের সুখের আশ্বাসে যে অন্য সন্তানকে কতোটা ছোট করা করা হয়েছে তা হয়তো আম্মুর মাথায়ই কাজ করে নি।করবেই বা কি করে।এই জ্ঞানটুকু থাকলে তো আমাকে এই ভাবে কথা সহ্য করতে হত না।আমি কোন প্রতিবাদ করলাম না।যারা বুঝেও অবুঝ তাদের বুঝ দেয়ার কিছু নেই।

“কার কপাল কেমন তা কি আর আগেই বোঝা যায় মামি?আম্মুও তো বিয়ের আগে রাজকন্যার মত ছিলো।বাড়ির সবচেয়ে আদরের প্রান ছিলো সে।অথচ তার কপালে কিন্তু দুই বিয়ে জুটেছে।কেউ কি খুনাক্ষরেও ভেবেছিলো এটা?”

আকাশ মোবাইল স্ক্রল করতে করতে বলল কথাটি।ওর এহেন বক্তব্যে ভ্যাবাচ্যাকা খেল উপস্থিত সকলে।নিজের মাকে কেউ এভাবে বলে।তাও সৎ বোনের সাপোর্ট টেনে।আম্মু নিমিষেই মুখ কালো করে বলল,

“কেমন ছেলে যে পেটে ধরেছি আল্লাহ।নিজের বোনকে এইভাবে বদদোয়া দিচ্ছিস তুই?”

আকাশ অধর যুগল ফাঁক করে বলল,

“আমি কি ভুল বলেছি নাকি।মেয়ে মানুষের কপাল হল গাড়ির চাকার মত।যতদিন ব্রেক আছে তো আলহামদুলিল্লাহ।কিন্তু একবার ব্রেক ফেল হলে কোন দিকে ঘুরবে কেউ জানে না।তাই অগ্রিম অহংকার করতে নেই।”

আকাশের কথায় ফুঁসে ওঠে আম্মু।

“কি বলতে চাচ্ছিস তুই?আমার অতীতকে বারবার স্মরণ করাতে চাস?আমাকে অপমানিত করতে যে নিজের বোনকে ছোট করছিস তা একবারো ভাবলি না?”

“হুবহু একই ভাবে এরিন আপু অপমানিত হয়েছে তুমি খেয়াল করনি আম্মু।”

আম্মু চড়ম প্রতিবাদ করতে অধর কিঞ্চিৎ পরিমান ফাঁক করল।কিন্তু তার আগেই ওনার বর্তমান স্বামী আফাজ মাহমুদ গম্ভীর কণ্ঠে উত্তর দিলো,

“মেয়েরা কন্যা থেকে বধু হলেই কাজে হাত দিতে হয়।যত ভালো ক্যারিয়ারেরই হোক বা যত ভালো ঘরেরই হোক না কেন নিজের কাজটুকু নিজেকেই সামলাতে হয়।তাই চলার ক্ষেত্রে সব কাজ শিখে রাখা উচিত।কার কখন কোন পরিস্থিতি হয় বলা যায় না।আমার মেয়ে সব কাজ শিখবে।আমাদের অবর্তমানে যেন ওর কষ্ট না হয় একারণে সব শিখাবো ওকে।”

ওনার কথায় দমে গেলেন আম্মু।আকাশ হালকা হেসে প্রস্থান করল।মামি লজ্জিত হলেন।লজ্জা ঢাকতে হালকা হেসে বললেন,

“তা তোমাদের মেয়ে তোমরা যা ভালো বোঝ তাই করবে।তারপরও তুমি তো অমানুষ না।মেয়েকে তো আর পরের বাড়ি অবহেলায় ফেলে রাখবে না।তাই ও ভালোই থাকবে সবসময়।”

প্রতিউত্তরে মুচকি হাসলেন আফাজ মাহমুদ।অতঃপর আয়াতকে কোলে তুলে নিয়ে আদর একে দিলেন তার ছোট কপালে।আদুরে ভঙ্গিতে বললেন,

“আমার মেয়ের সুখের জন্য আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করব।আমার একমাত্র মেয়ে বলে কথা।আমার ভালোবাসার জিনিস।”

আয়াত তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে আধো আধো করে বলল,

“আমিও তোমাকে অনেক ভানোবাতি(ভালোবাসি) আব্বু।কিন্তু তুমি আমান জন্য কিছু আনোনি কেন?”

“আমার সোনামনির জন্য আমি কি কিছু না এনে থাকতে পারি?এই দেখো তোমার প্রিয় জিনিস এনেছি।”

হাস্যোজ্জল মুখে একটা কিটক্যাট চকোলেট পকেট থেকে বের করলেন তিনি।আয়াত চকোলেট পেয়ে খুশিতে খিলখিল করে হেসে দিলো।এক হাতে ধরে নাড়িয়ে আম্মুকে বলল,

“এ এ আম্মু দেখো কত বনো(বড়) চকোনেত।”

আম্মু চিরচেনা একটা হাসি দিলেন।আয়তকে চকোলেট খেতে বলে আবারও কাজে লেগে পড়লেন।আফাজ মাহমুদ আয়াতের উৎফুল্ল মুখ দেখছে এবং মুচকি হাসছে।এই মানুষটার চিরন্তন অভ্যেস এটা।সবসময় হাসিমুখে থাকেন।দেখে মনে হয় সৃষ্টিকর্তা দুনিয়ার সব সুখ ওনাকে দান করেছেন।আমারও মাঝে মাঝে এমন সুখী হতে ইচ্ছে করে।উনি যখনই এখানে আসেন আমি মুগ্ধ হয়ে দেখি ওনাকে।এই হাসি মুখ দেখতেও ভালোলাগে।সুখ,দুঃখ এগুলো অনেকটা ভাইরাসের মতো।আশেপাশের সবাইকে সংক্রমিত করে।যেমন এখনও করছে।একটু আগের ছোট ঝামেলার রেশও কারো মাঝে বিদ্যমান নেই।সবাই আয়াত এবং আফাজ মাহমুদের খুনসুটি দেখে আনন্দ পাচ্ছে।আয়াতের কাছে তিনি বার বার চকোলেট খেতে চাচ্ছেন আর আয়াত বারবার দিবো না দিবে না করে লুকিয়ে ফেলছে।এই ক্ষুদ্র বিষয়ই প্রশান্তির ঢেউ ছড়িয়ে দেয়।
আয়াতের মুখের দিকে পূর্ণ ভালোবাসা নিয়ে তাকিয়ে আছে আফাজ মাহমুদ।মেয়েটার গায়ের রঙ কিছুটা চাপা গড়নের হলেও চেহারায় মায়ার কোন কমতি নেই।ওর ডাগর ডাগর চোখ দুটি দিয়েই সবার মাঝে মায়া সৃষ্টি করে। আচ্ছা আমি কি এই মায়া সৃষ্টি করতে অক্ষম ছিলাম?হয়তো আব্বু আম্মুর মায়াটা শুধুমাত্র সৃষ্টি করতে পারি নাই।পাষাণের মনে কি আর সবার জন্য মায়া জন্মে?মায়াটা ঠিকই আছে।তা না হলে কীসের টানে নিশান ভাই আমার সব খেয়াল রাখে।
_______
প্রয়োজনীয় কিছু শিট নিতে কলেজে যাচ্ছি।বাইরে বেড়িয়ে দেখি নিশান ভাই মোটরসাইকেল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন।আমাকে এগোতে দেখে বললেন,

“তোদের মেয়ে মানুষের কোথাও যাওয়ার আগে কি পায়ের তলায় বেলের আঠা লাগে নাকি?কি এমন করিস যে এতো দেরী হয়?”

“বোরকার উপর দিয়ে হিজাব লাগিয়েছি জাস্ট।বড়জোড় পাঁচ মিনিট সময় লেগেছে।তাতেই এতো অধৈর্য হলে চলে?বিয়ের পর বউ যখন সেজেগুজে বের হবে তখন দেখবেন পায়ের তলায় কিসের আঠা লাগে।”

মোটরসাইকেল এর পিছে বসতে বসতে বললাম আমি।নিশান ভাই হাতের ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন,

“পাক্কা আধা ঘন্টা হল বসে আছি।আর তুই বলছিস পাঁচ মিমিট ও লাগেনি।আর আমার বউ তোদের মতো এমন মেয়ে হবে না।সে হবে ইউনিক।সবার থেকে অনন্যা।”

নিশান ভাইয়ের কথায় মুখ টিপে হাসলাম আমি।দুষ্টুমি করে বললাম,

“আমাদের মতো মেয়ে বিয়ে না করে আপনার বউ হিসেবে ছেলে মানুষ বিয়ে করেন।দুই মিনিটে রেডি হবে।পুরাই ইউনিক।সবার থেকে অনন্যা।”

বলেই খিলখিল করে হাসতে লাগলাম আমি।নিকাব দিয়ে মুখ ঢাকা আমার।তারপরও আমার হাসিমাখা মুখ দেখতে নিশান ভাই লুকিং গ্লাস আমার দিকে ঘুড়িয়ে রেখেছেন।নিচের ঠোঁট কামড়ে চোখ ছোট ছোট করে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন নিশান ভাই।মটর সাইকেল চলছে তার আপন গতিতে।আমি এখনো হেসেই চলেছি।নিশান ভাই কিছু একটা বলতে অধর নাড়ালেন।কিন্তু তার আগেই ঘটে গেল বিপত্তি।পিছন থেকে একটা সি. এন. জি. এর ধাক্কায় সিটকে পড়লাম আমরা।চোখ মেলে দেখার চেষ্টা করলাম নিশান ভাইকে।পাকা রাস্তার উপর পড়ে রয়েছেন নিশান ভাই।লাল তরলে মাখামাখি ওনার শার্ট।ছয় বছর পর একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটলো আবার।অন্ধকার হয়ে গেল আমার পুরো পৃথিবী।

চলবে

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে