কাউন্টডাউন

0
865
ফাইশাকে যখন বিয়ে করি, আমরা দুইজনাই জানতাম– আমাদের সন্তান হবে না৷ বাইরে থেকে ফিরে এসে প্রায়দিনই খেয়াল করতাম, ফাইশা জানলা দিয়ে তাকিয়ে আছে৷ বাইরে সারি সারি মেঘ, পাহাড়ের গা বেয়ে ওঠার দৃশ্যটা দেখে মনে হতো মেঘগুলা যেন হাপিয়ে উঠেছে। ফাইশার চোখে সমস্যা থাকায় দূরের জিনিস ভালো দেখতে পেতো না৷ তাহলে কী ফাইশা হাপিয়ে পড়া মেঘগুলোকে খুঁজতো? আমার হারিয়ে ফেলা অভ্যাস৷ তার উপর কোথায় কি রাখি, মনে থাকে না৷ খুটখাট শব্দ শুনে, আমার দিকে না তাকিয়েই ফাইশা বলে দেয়–ফোনের চার্জারটা টেবিলের বামপাশে, চশমার খাপ বিছানায় মাথার কাছে। আমি মুচকি হেসে লজ্জা লজ্জা গলায় বলি– তুমি দেখি এই কয়দিনেই সব নখ দর্পনে নিয়ে ফেলছো! ফাইশা ইদানীং বেশি কথা বলে না। চুপচাপ শুধু তাকিয়ে থাকে৷ যেন জানলাটাই ওর সংসার, পাহাড়ের গাছগুলো ওর সন্তান, আর হাপিয়ে পড়া মেঘগুলোই ওর নিত্যসঙ্গী। আমি দিনরাত ফাইশাকে বুঝাতে চাই, যতটা পারি সান্ত্বনা দেয়ার চেস্টা করি। ফাইশা হঠাত মেঘের সংসার ছেড়ে আমার দিকে তাকায়। ওর ফ্যাকাশে চোখে কী গভীর শীতলতা! আমি ভয় পেয়ে যাই। সেদিন বাজার থেকে একটা মাটির গহনা নিয়ে ওকে দিয়ে চোখ নাচিয়ে বললাম, মনে আছে দোয়েল চত্বরের সামনের সেই কারুরশিল্পের দোকানগুলার কথা? ফাইশা হঠাত হেসে দেয়, বলে– তুমি সারা সন্ধ্যা আমার ব্যাগগুলা দুই হাতে নিয়ে টানছিলা। একটু পর পর অতি সাবধানে মাটির জিনিসগুলাতে হাত দিয়ে আগলে রাখতে গিয়ে আরও বেশি ঠোকা লাগায়ে ভেঙে ফেলছিলা! আমি এবারো লজ্জা পেয়ে যাই৷
আহ কি দারুণ ছিলো সেইসব সন্ধ্যারা! আমরা দুইজনাই দীর্ঘশ্বাস ফেলি। সেই কতোদিনের কথা! একটা ক্যাম্পিং এ আমাদের পরিচয়। মনের দেনা লেনা। মাত্র সাতদিন হাতে ছিলো আমাদের। আমরা রোজ কাউন্টডাউন করতাম, আর মাত্র ছয় দিন বাকি। তারপরেই আবার কে কোথায় চলে যাবো, আর হয়ত দেখাই হবে না৷ ফাইশাও সাড়া দিতো, হুম, আর মাত্র পাঁচদিন। হুটহাট মনের লেনা দেনা হলেও আমরা যেন আমাদেরই ছিলাম। আমি যা যা বলতে চাইতাম কেমন করে ফাইশা যেন সব বুঝে ফেলতো৷ আর ও নিজেকে খুঁজে পেয়েছিলো, আমার দেখা পেয়েই৷ না, ভনিতা করে আমরা সময় নস্ট করিনি। সারাদিন ক্যাম্পিং শেষে যতটা সময় পেতাম, আমরা আমাদের দিতাম। কারণ, আমাদের হাতে সময় ছিলো কম। মুহুর্তগুলো খুব দ্রুত ফুরিয়ে আসছিল।
আমরা বারবার হিসাব করতাম, আর বাকী মাত্র তিনদিন। দুই, এক..ঘন্টা, মিনিট, সেকেন্ড.. সেইবার বিদায় নেবার সময় ফাইশা বলেছিলো ডাকবে৷ আমিও নিশ্চিত ছিলাম, আমি সাড়া দেবো৷ তারপরে সময়ের আড়ালে গড়িয়ে পড়ে দীর্ঘকাল আমাদের আর ডাকা বা ফেরা হয়নি। তাই বলে কী ফুরিয়ে গিয়েছিলো সব? ফাইশা কাঁপা হাতে চায়ের কাপটা আমার হাতে দিয়ে পাশে বসে। হঠাৎ হেসে বলে ওঠে– ত্রিশ বছর কি যথেস্ট? সেই তুমুল মুগ্ধতা ফুরিয়ে যাওয়ার জন্য? আমি কাপা বুক নিয়ে শ্বাস ফেলি, বুঝতে পারি আমার ভেতরে ঢুকে পড়ছে শীত৷ হ্যাঁ, সেই তুমুল যৌবনে আমাদের ডাকা বা ফেরা না হলেও এই ষাটে এসে , ফাইশার জেদটা পূরণ হলো। আর আমিতো অপেক্ষাতেই ছিলাম৷ তবে আবারও কাউন্টডাউন। খুব বেশি সময় নেই আমাদের। ডাক্তার বলছে ক্যান্সারের লাস্ট স্টেজ, ,বড়জোর দুই মাস৷ তারপরেই আমাকে যেতে হবে৷
মাঝে মাঝে রাতে, ফাইশার ঘুম ভেঙে গেলে– ওর দিকে টানা তাকিয়ে থাকা দেখে আমাকে বলে — কি দেখো এতো? আমি হাসি। কাউন্টডাউন মনে করিয়ে দেই– আর তো মাত্র একমাস! বিশ দিন, দশ, এক সপ্তাহ.. ফাইশা আমার মুখে হাত চাপা দেয়। কিছুক্ষণ চেস্টা করে নিজেকে শান্ত রাখার। তারপরে আর পারে না৷ ফুপিয়ে ডুকরে কেঁদে ওঠে৷ আমি ওর কান্না থামাই না। শুধু শক্ত করে হাতটা ধরে রাখি৷ আমাদের ছোট্ট বাড়ির পাশেই থাংঝাং ঝর্ণা৷ দিন নাই, রাত নাই শুধু বয়েই চলে। কলকলকল…

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে