কাঁটামুকুট পর্ব-০৮ এবং শেষ পর্ব

0
6

#কাঁটামুকুট
পর্ব- ৮ (শেষ পর্ব)

খুব ছোটোবেলায় একবার সিমরানের জ্বর হয়েছিল। জ্বরের ঘোরে সে বাবাকে ছাড়া কিছুই বুঝত না। এদিকে বাবার দু’দিন অফিস কামাই হয়ে গিয়েছিল। তার তখন নতুন চাকরি। তৃতীয় দিন যেতেই হলো। সকালবেলা সিমরানকে ভুলিয়ে ভালিয়ে তিনি চলে গেলেন ঠিকই, কিন্তু দুপুরে সিমরানের কাঁদতে কাঁদতে হেঁচকি উঠে গেল, বাবাকে তার এক্ষুনি চাই। মা চেষ্টা করছিলেন ওকে নিজেই কোনোভাবে বুঝিয়ে থামাতে, কিন্তু কিছুতেই মেয়ে থামছিল না। শেষে তিনি যখন ওর বাবাকে ফোন করতে গেলেন, তখন কলিংবেল বাজল। দরজা খুলে দেখলেন তার স্বামী বাড়ি চলে এসেছে৷ বাবা দৌড়ে ঘরে ঢুকে সিমরানকে কোলে তুলে নিয়ে কান্না থামালেন। তার নাকি অফিসে বসে মনে হচ্ছিল মেয়ে কেঁদে কেঁদে তাকে ডাকছে। নতুন চাকরির মায়া না করেই তিনি চলে এসেছেন।

আজও যখন সিমরান শেষরাতে কেঁদে কেঁদে বাবাকে ডাকছিল, তার পক্ষে বাড়িতে থাকা কোনোভাবেই সম্ভব ছিল না। সেই ছোটোবেলার মতো মেয়ের টানে তিনি সেই সময়েই বাড়ি থেকে রওনা দিলেন ইশতিয়াকের বাড়ির উদ্দেশ্যে। এমনকি স্ত্রীকেও কিছু বললেন না।

বেল বাজলে দরজাটা সিমরানই খুলল। খুলেই জড়িয়ে ধরল বাবাকে। কাঁদতে থাকল ফুঁপিয়ে। বাবা জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে? লোকটা কী করেছে তোর সাথে?”

সিমরান কোনো উত্তর দিতে পারল না৷ সে শুধু বলল, “আমাকে নিয়ে যাও এখান থেকে। এখানে থাকলে আমি মরে যাব।”

বাবা তাকে তখনই নিয়ে রওনা দিলেন। ইশতিয়াক তখন বাড়িতে নেই। আর মুশফিক পড়ে পড়ে ঘুমাচ্ছে।

সিমরানকে দেখে মা ভয়ানক আশ্চর্য হলেন। রেগেও গেলেন। রাগ ঝাড়তে শুরু করলেন স্বামীর সাথে, “তোমার দরদ দেখে তো আমি বাঁচি না! এই মেয়ের শোকে স্ট্রোক করলে, মেয়ে তোমার খোঁজও নিল না৷ আর তার এক ডাকে শেষ রাতে পাগল হয়ে চলে গেলে? তোমার লজ্জা নেই?”

সিমরান এদিকে মেঝেতে বসে পাগলের মতো কাঁদছে।

মা এগিয়ে এলেন ওর দিকে, “আবার কী করে এসেছিস? তাড়িয়ে দিল নাকি? এত তাড়াতাড়ি মিটে গেল শখ?”

বাবা মাকে থামিয়ে সিমরানের কাছে এসে ওকে ধরে সোফায় বসালেন। ওর মাথায় হাত রেখে জিজ্ঞেস করলেন, “কী হয়েছে মা? বল আমাকে? কী করেছে ও তোর সাথে?”

সিমরান একটু ধাতস্থ হয়ে আস্তে আস্তে সবটা বলল। মা দাঁড়িয়ে থাকতে না পেরে বসে পড়ে কাঁপতে লাগলেন। আর বাবার চোখ টকটকে লাল হয়ে গেল। তার ইচ্ছে হতে লাগল পৃথিবী থেকেই চলে যেতে। কিংবা আগুন জ্বালিয়ে দিতে পুরো জগতে। এমন কেন হচ্ছে তার সাথে? সে কোন অপরাধ করেছিল?

*********

ইশতিয়াক তার বহুদিনের প্রেমিকা যামিনীর কাছে গিয়েছিল। মহিলা পেশায় অভিনেত্রী, স্বামী নেই, ডিভোর্সড। ইশতিয়াক তার অসংখ্য প্রেমিকের একজন। তবে ইশতিয়াকের সাথে তার কিছু ইমোশনাল সম্পর্ক আছে। দু’জনেই বেশি স্ট্রেসেড হয়ে পড়লে দু’জনের কাছে আশ্রয় খুঁজে নেয়। দু’জন দু’জনার স্ট্রেস দূর করতে পারে চমৎকারভাবে। এমনিতে এদের মাঝে কোনো মান অভিমানের সম্পর্ক নেই।

যামিনী তার নতুন বিয়ের খবর শুনে, বিশেষত এত ছোটো একটা মেয়ে বিয়ে করেছে শুনে একটু বিরক্তই হয়েছে। ইশতিয়াক তাকে সব খুলে বলায় সে সারারাত ওকে বুঝিয়েছে, মেয়েটাকে তার রাখা উচিত না৷ অল্পবয়সী মেয়েরা প্রচুর ঝামেলা বাঁধাতে পারে। এই সুযোগে যেন মেয়েটাকে সে ডিভোর্স দিয়ে দেয়। এমন মেয়েদের দামী গিফট দিয়ে প্রেম করা যায়, বিয়ে করাটা একটু বাড়াবাড়িই। এই মেয়ে তাকে চুষে খেয়ে নেবে, আর ওদিকে দেখা যাবে ঘুরে বেড়াচ্ছে কমবয়সী প্রেমিকের সাথে।

ইশতিয়াকের মনে ধরেছে যামিনীর প্রস্তাব৷ এদিকে অনেকদিন পর যামিনীকে পেয়ে তার ভালোও লাগছে। গতরাত কথায় কথায় কেটে গেছে। আজ জমিয়ে প্রেম করা যাবে ভেবে সে পরের রাতও সেখানেই রয়ে গেল। যামিনীর কাছে থাকার সময় সে পৃথিবী থেকে যাবতীয় কানেকশন বন্ধ করে শুধুই ওর মাঝে ডুবে থাকতে পছন্দ করে।

রাত কাটিয়ে পরদিন সকালে সে যখন বাড়ি ফিরল তখন জানতে পাগল মুশফিককে রেপ কেসে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। কেস করেছে সিমরান। তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল।

*********

মুশফিকের বেইল ইশতিয়াক সেদিনই করিয়ে ফেলল। কিন্তু কেস সময়মতো কোর্টে পৌঁছে গেল। শুনানি শুরু হলো। সিমরানের পক্ষে জোরালো প্রমান আছে। তার শরীরে মুশফিকের সিমেন পাওয়া গেছে। উকিলও আশা দিয়েছেন তিনি অপরাধীকে শাস্তি পাইয়ে ছাড়বেন।

কিন্তু ইশতিয়াকের হায়ার করা নামীদামী উকিল দানই পাল্টে দিলেন। দোষ সব সিমরানের ঘাড়ে এসেই পড়তে লাগল একটা একটা করে।

ইশতিয়াকের বাড়ির সকল কাজের লোকের বয়ান থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গেল যে সিমরান আর মুশফিকের ভালো সম্পর্ক ছিল। তারা একসাথে এক ঘরে যথেষ্ট সময় কাটাতো, একসাথে ঘর অন্ধকার করে সিনেমা দেখত, সেজেগুজে কাপলের মতো ঘুরতে যেত। মুশফিকের উকিলের দাবি হলো সিমরান মুশফিককে সিডিউস করত। সে বাড়িতে ছোটো ছোটো পোশাক পরে ঘুরে বেড়াত। এসবের কোনোটাই সিমরানের অস্বীকার করার উপায় নেই। যদিও সে কখনোই মুশফিককে সিডিউস করার চেষ্টা করেনি। সে মুশফিকের প্রতি কিছুটা ঝুঁকে পড়েছিল এটা অবশ্য সত্য। তবে সময় থাকতেই সে সেদিক থেকে নিজের মনোযোগ সরিয়ে নিয়েছে।

ইশতিয়াকের সেই মেয়েদের সাথে ছবিগুলোর কথাও কোর্টে উঠল, তবে সেগুলো সিমরান নিজের কাছে নিয়ে রাখেনি বলে কোনোকিছুই প্রমাণ হলো না।

সবশেষ চালটা এবার মুশফিকের উকিল চেলেই ফেলল।

সে রাতের ঘটনায় মুশফিক জানাল, সিমরান নিজে তাকে ডেকে নিয়েছিল। তার মোবাইলে মেসেজ আছে। মেসেজটা পেশ করা হলো আদালতে। তাতে লেখা, “ইশতিয়াক আজ বাড়িতে নেই। আসবেও না বোধহয়। চলে এসো আমার ঘরে। পাগল হয়ে আছি তোমার জন্য।” সিমরানের মোবাইলে মেসেজটা নেই। তবে সিম কোম্পানি থেকে তার সিমের সব তথ্য সংগ্রহ করে আনা হয়েছে। সেখানেও দেখা গেল মেসেজটা গেছে।

আসলে মেসেজটা মুশফিকই পাঠিয়েছিল সিমরানের ফোন থেকে, সিমরানের হাতগুলো বেঁধে দেবার পর। পাঠিয়ে আবার ডিলিটও করে দিয়েছিল। মুশফিকের ধারণা ছিল না ঘটনা আদালত পর্যন্ত গড়াবে৷ সে বাবার কাছে নিজেকে পরিষ্কার রাখতে কাজটা করেছিল। সেটাই কাজে লেগে গেল।

আদালতে সিমরানের অভিযোগ মিথ্যে ঘোষণা করে মুশফিককে বেকসুর খালাস করে দেয়া হলো।

বাপ ছেলে হাসতে হাসতে কোর্টের চত্ত্বর থেকে বিদায় নিল।

হেরে যাওয়া মেয়ে আর তার বাবা মা বাড়ি ফিরে এলো। ক্লান্ত পায়ে সিঁড়ি বাইতে বাইতে মনে হলো এভারেস্টে চড়তে হচ্ছে, শরীরটা বড় ভারী হয়ে গেছে। পৃথিবী এত নিষ্ঠুর!

সিমরান এতক্ষণ কিছু বলেনি। তার মনে হচ্ছিল মেসেজের ব্যাপারটায় বাবা মাও তাকে অবিশ্বাস করেছে, যদিও তারা কিছুই বলেননি।

সিমরান বাড়ি ফিরে নিজের ঘরে ঢুকে চুপ করে বসে রইল। সময় যেতে থাকল, সে জায়গা থেকে নড়ল না, কিছু খেল না। বাবা মায়েরও মনের অবস্থা নেই তাকে জোর করার। কিন্তু তিনদিন পার হয়ে গেলেও সে যখন অনঢ় হয়ে রইল, তখন বাবা মা তার ঘরে গিয়ে বোঝাতে শুরু করলেন। অনেকক্ষণ বোঝানোর পর সিমরান নড়ল। দুই হাতে মুখ ঢেকে চিৎকার করে কেঁদে বলল, “তোমরা বিশ্বাস করো, আমি মুশফিককে সেই রাতে ডাকিনি। আমি জানি আমি অনেক খারাপ, আমি লোভী, আমি বেয়াদব, কিন্তু বিশ্বাস করো, আমার এত দুশ্চরিত্র নই। আমি সত্যি কথা বলছি। সবাই যাই ভাবুক না কেন, তোমরা আমাকে খারাপ ভাবলে আমি মরে যাব। সত্যিই মরে যাব।”

বাবা সিমরানকে জড়িয়ে ধরে বললেন, “আমি ওটা কোনেদিন বিশ্বাস করিনি মা। একবারের জন্যও বিশ্বাস করিনি।”

“ওদের কোনো শাস্তি হলো না বাবা। শুধু আমিই কেন শাস্তি পেলাম বলো তো?”

বাবা ধীর স্বরে বললেন, “সবার শাস্তি পৃথিবীতে হয় না রে মা। দেখবি ইবলিশগুলো ঠিকই হেসেখেলে দুনিয়ার জীবন পার করে। কিন্তু আল্লাহ তাদের ছেড়ে দেন না রে মা। মরনের আগে হোক বা পরে, শাস্তি তারা পাবেই।”

**********

অনেক বছর কেটে গেল। ইশতিয়াকের সাথে ডিভোর্সের পর সিমরান আর বিয়ে করল না। পড়াশুনা শেষ করল। বেশ চমৎকার রেজাল্ট হলো। ডাবল মাস্টার্স আর পিএইচডি শেষ করার পর একটা প্রাইভেট ভার্সিটির শিক্ষক হিসেবে জয়েন করল সে। প্রতি বছর ফার্স্ট ইয়ারের ছাত্রছাত্রীদের একদিন এক্সট্রা ক্লাস নিয়ে সে নিজের গল্পটা শোনায়। বিশেষ করে ছাত্রীদের উদ্দেশ্যে গল্পটা বলে সে। নিজের জীবনের ঘটনা হিসেবে বলে না, বলে বন্ধুর নাম নিয়ে। চরিত্রগুলোর নামও থাকে অন্য। তার উদ্দেশ্য একটাই, তার মতো ভুল যেন আর কেউ না করে।

এমনই একদিন ঘটনাটা বলে শেষ করল সে। ক্লাস থেকে বের হয়ে করিডোর দিয়ে যাবার সময় একটা মেয়ে দৌড়ে এলো তার কাছে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “ম্যাম, থ্যাংক ইউ সো মাচ!”

“ফর হোয়াই?”

চমৎকার দেখতে মেয়েটা মিষ্টি হেসে বলল, “এমনি।”

সিমরান ওর চিবুক ধরে একটু আদর করে দিয়ে বললেন, “ওকে মাই গার্ল! সাবধানে থেকো।”

মেয়েটা ফিরে এসে ঠান্ডা মাথায় একটা নাম্বারে মেসেজ পাঠাল, “স্যরি মি. মুশফিক, আমি আপনার সাথে কোথাও যেতে ইন্টারেস্টেড নই। আপনার উপহারগুলো আপনার অফিসের ঠিকানায় পাঠিয়ে দেব৷ আমার সাথে আর যোগাযোগের চেষ্টা করবেন না।”

(সমাপ্ত)

সুমাইয়া আমান নিতু

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে