#কাঁটামুকুট
পর্ব- ৭
শেষ মুহূর্তে সিমরানের হঠাৎ মন বদলে গেল। কেমন করে কয়েক সেকেন্ডে সে সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলল বুঝতে পারল না৷ শুধু মনে হলো কাজটা খুব ভুল হবে। চোখের সামনে সিনেমার পর্দার মতো ভেসে উঠল দু’জনের চেহারা, একজন ইশতিয়াক, অন্যজন বাবা৷ ইশতিয়াক যদি এখানে থাকত তাহলে সে তাকে কী ভাবত? কত ভালোবাসে ইশতিয়াক তাকে! আর বাবা! বাবা সারাজীবন তাকে শিখিয়েছে, চিটিং ইজ ভেরি ব্যাড! বাবার তোতাপাখির মতো কথাটা তাকে এমনভাবে মুখস্থ করাতো যে পরীক্ষায় অন্য কারো খাতা দেখে লিখতে গিয়েও বারবার কথাটা মনে পড়ে যেত, আর নকল তো অনেক দূরের বিষয়। আজকের ঘটনাটা বিশ্লেষণ করার জন্য তার মস্তিষ্ক কয়েক মুহূর্তই সময় পেল। এত দ্রুত মগজ কেমন করে চলে? দরজার ঠিক সামনে দাঁড়িয়ে নবের দিকে বাড়িয়ে দেয়া হাতটা সরিয়ে নিল সিমরান। যত দ্রুত সম্ভব জামাটা ছাড়িয়ে নিল গা থেকে। একটা ঢিলা কুর্তা পড়ল। ততক্ষণে বাইরে অস্থির হয়ে গেছে মুশফিক। “দরজা খুলবে না নাকি? চলে যাব? হট কফি কোল্ড হয়ে গেছে।”
দরজা খোলার সময় সিমরানেরও কথাটা চিন্তা করে খুব হাসি পেয়ে গেল, হট সিমরানও কফির সাথে সাথে কোল্ড হয়ে গেছে।
সেদিনের গল্পটা তেমন জমল না৷ সিমরান বারবার অন্যমনষ্ক হয়ে যাচ্ছে দেখে মুশফিক খানিক পরেই চলে গেল নিজের ঘরে। জিজ্ঞেস করে গেল সন্ধ্যায় একসাথে মুভি দেখবে কি না৷ সিমরান তাতেও না করে দিলে মুশফিক বেশ অবাক হলো। মুভির ব্যাপারে সিমরান কখনো না করে না৷ সে মারাত্মক সিনেমা ফ্রিক। আজ কী হলো?
সেদিন রাতে ইশতিয়াক ফিরল সিমরানের জন্য দারুণ একটা সারপ্রাইজ নিয়ে। ইশতিয়াকের হাতে সাদা গোলাপের বিশাল এক বুকে। সিমরান বুকেটা জড়িয়ে ধরে বলল, “থ্যাংস! তুমি জানলে কী করে আমার সাদা গোলাপ পছন্দ? কখনো তো বলিনি।”
ইশতিয়াক চোখ মটকে বলল, “ম্যাডাম, আমি এখন আপনাকে ইন্সটাগ্রামে ফলো করি!”
সিমরান খিলখিল করে হেসে ফেলল। তারপর খেয়াল করল বুকের সাথে আছে দুটো প্লেনের টিকিট! লাফিয়ে উঠল সিমরান। “আমরা তাহলে যাচ্ছি!”
“হ্যাঁ আগামী সপ্তাহেই।”
“তোমার শরীর..”
“ডক্টরের সাথে কথা বলে নিয়েছি। আই অ্যাম অ্যাবসলুটলি ফাইন ডার্লিং!”
সিমরান খুশিতে জড়িয়ে ধরল ইশতিয়াককে।
ইশতিয়াক আজ আলাদাই মুডে রয়েছে। ভীষণ খুশির আমেজে যেন দুজনেই বাকবাকুম হয়ে আছে। সিমরানের মনটা খুশিতে নেচে উঠছে বারংবার৷ সে সেই রাতে গোলাপি নাইট ড্রেসটা আবার পরল। হ্যাঁ, ইশতিয়াকের জন্যই পরল। ইশতিয়াক যখন ওকে দেখল তখন তার মুখ হা হয়ে রইল। এত সুন্দর লাগছে সিমরানকে! তার এখনো বিশ্বাস হতে চায় না এই বয়সে এসে সে এরকম একটা মেয়েকে নিজের করে পেয়েছে! আর মেয়েটাও তাকে পাগলের মতো ভালোবাসে!
সে রাতে সিমরানের শখ পূরণ হলো। তার বিয়ে করা বর তার জামার প্রত্যেকটা ফিতে খুঁজে বের করে একটা একটা করে খুলল। সেজন্য ঝক্কিও কম পোহাতে হলো না ইশতিয়াকের। তবে দু’জনে যেন আরো বেশি করে সময়টা উপভোগ করল। ঘুমানোর আগে সিমরানের নিজের বিকেলে নেয়া সিদ্ধান্তের কথাটা ভেবে খুব শান্তি লাগল।
পরদিন ব্রেকফাস্ট টেবিলে বসে সিমরানের ঘাড়ের কাছে একটা সদ্য তৈরি গাঢ় দাগ দেখতে পেয়ে মুশফিকের শরীরের ভেতরটা কেমন যেন এলোমেলো হয়ে গেল। তার ইদানীং আর সহ্য হয় না৷ ইচ্ছে করে সিমরানকে পিষে ফেলতে, নিজেও মরে যেতে৷
সেদিন আর ক্লাসে গেল না মুশফিক৷ প্রেমিকাকে নিয়ে একটা হোটেলে চলে গেল। একান্ত সময় কাটাবার সময়ও তার ভালো লাগল না। এই মেয়েটাকে কোনোভাবেই সিমরানের সাথে তুলনা করা যায় না৷ সিমরানের তুলনা সে নিজেই৷ সে অনেক চেষ্টা করল মেয়েটাকে সিমরান ভাবতে। কিন্তু সিমরানের গলার স্বর, দুষ্টু মিষ্টি হাসি, ওর ফিগার, সব যেন অধরাই থেকে যাচ্ছে। মাঝপথে থেমে গেল মুশফিক। হচ্ছে না তার। মেয়েটাকে হোটেলে ফেলে চলে এলো সে।
সিমরানের সাথে খাতির জমাবার বহু চেষ্টা সে এরপর থেকে করতে লাগল। রীতিমতো পেছনে পেছনে ঘুরতে শুরু করল। কিন্তু সিমরান যেন আজকাল তাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। কোনো একটা ঘোরের মধ্যে আছে মেয়েটা। কোনো কথা, কোনো ঘটনা যেন ওর গায়ে লাগছে না।
আগে সিমরানের সাথে হাতের ছোঁয়া লাগলে মেয়েটা লজ্জা পেত। গতকাল কিচেনে সে কফি বানাচ্ছিল, সিমরান বানাচ্ছিল সালাদ৷ মুশফিক ইচ্ছে করেই কফির বয়াম নিতে গিয়ে সিমরানের কাছে গিয়ে তার বাহু ছুঁয়ে দিল। সিমরান এত বিরক্ত হয়ে তাকাল যে মুশফিককে ‘স্যরি’ বলে চলে আসতে হলো। ব্যাপারটা বড্ড ভাবাতে লাগল তাকে। সে কাছে যেতে চাইছে দেখে কি সিমরানের ভাব বেড়ে গেল? সে কি ইচ্ছে করে এমন করছে যাতে সে আরো ছটফট করে? সুন্দরী মেয়েগুলো নিজেকে কী ভাবে?
**********
সুইজারল্যান্ডের উদ্দেশ্যে রওনা দেবার আগেরদিন সকালে সিমরান ইশতিয়াককে হঠাৎ বলল, “আমি একবার বাড়ি যাব।”
ইশতিয়াক অবাক হয়ে বলল, “কোন বাড়ি?”
“আমার বাবার বাড়ি।”
“কেন?”
“মা বাবার কথা মনে পড়ছে।”
“হঠাৎ?”
“হঠাৎ না, সবসময়ই মনে পড়ে।”
“ওরা তোমাকে রেখে দেবে। আর আসতে দেবে না৷ এমনিতেও মামলা করে বিচ্ছিরি অবস্থা করে রেখেছে। অফিসেও তোমার বাবা আমার রেপুটেশন খারাপ করে ফেলেছে। তুমি তবুও তাদের কাছে যেতে চাও?”
সিমরান কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “তোমার মেয়ের একটু জ্বর হলেও তুমি অস্থির হয়ে যাও ইশতিয়াক। রোজ ভিডিও কলে কথা না বললে তোমার ঘুম হয় না৷ আমি তোমাকে কখনো এজন্য কিছু বলিনি। সামান্য অভিযোগও করিনি। কারন আমি জানি বাবারা মেয়েদের জন্য কেমন অনুভব করে। আমার বাবাও আমাকে অতটাই ভালোবাসে। বরং আরো বেশি ভালোবাসে। এতদিন আমাকে ছাড়া থাকতে তাদের কত কষ্ট হয়েছে আমি জানি না। তখন আবেগের বশে ডেস্পারেট হয়ে আমি চলে এসেছিলাম৷ কিন্তু এখানে আসার পর থেকে আমি ওদের ভয়ানক মিস করছি। কখনো ওদের ছাড়া এক রাতও বাইরে থাকিনি। আর দেখো, কয়েক মাস পেরিয়ে গেছে ওদের দেখি না৷ আমি নিজের জেদ ধরে রাখতে ওদের সাথে যোগাযোগ করিনি, কথা বলিনি, দেখাও করতে যাইনি৷ কিন্তু আজ যাব। এতদূর ঘুরতে যাব, ওদের না দেখে গেলে আমি শান্তি পাব না।”
ইশতিয়াক অগত্যা রাজি হলো। “ঠিক আছে, যাও। কিন্তু বেশিক্ষণ থাকবে না। গোছগাছও করা লাগবে। কালই তো ফ্লাইট।”
“আমি একবার দেখা করেই চলে আসব।”
“এখন যাবে?”
“না, রাতে। বাবা অফিস থেকে ফেরার পর।”
“আচ্ছা।”
রাতে সিমরান গাড়ি করে ওর বাবার বাড়িতে গেল। কতদিন পর চেনা গলি, চেনা বাড়িটার সামনে এলো সে! সবকিছু আগের মতোই আছে। শুধু বদলে গেছে সে নিজে। দুরুদুরু বুকে সে সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল। শেষদিন পাগলের মতো এই সিঁড়ি বেয়েই নেমে পালিয়েছিল সে।
নিজেদের ফ্ল্যাটের সামনে এসে বেশ কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। সাহস হচ্ছে না কলিংবেল চাপার। ওদের কেমন রিয়েকশন হবে ওকে দেখে?
শেষ পর্যন্ত কলিংবেল চেপেই ফেলল সিমরান। মিনিটখানেকের অপেক্ষা যেন কয়েক বছর মনে হতে লাগল। ওর মা দরজা খুললেন। ওকে দেখে কয়েক মুহূর্তের জন্য বাক্যহারা হয়ে গেলেন। তারপর সিমরানকে অবাক করে দিয়ে নির্লিপ্ত মুখে দরজা থেকে সরে দাঁড়িয়ে বললেন, “আসুন।”
সিমরান অবাক হলো। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে সে প্রশ্ন করল, “কেমন আছো মা?”
মা উত্তর দিলেন না। সে এগিয়ে গিয়ে জড়িয়ে ধরল মাকে। বুঝল মায়ের শরীর কেঁপে উঠেছে৷ কিন্তু তিনি সিমরানকে জড়িয়ে ধরলেন না। মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন। ঠিক সে সময় বাবাকে দেখা গেল আসতে। অবাক হয়ে কিছুক্ষণ তিনি চেয়ে রইলেন সিমরানের দিকে। যেন বিশ্বাস করতে পারছেন না ও এখানে এসে সশরীর দাঁড়িয়ে আছে৷
সিমরান ছুটে গিয়ে বাবাকেও জড়িয়ে ধরল। তবে এবার সে দেখল বাবাও তাকে ধরল না৷ মায়ের মতো জড়বৎ দাঁড়িয়ে রইল।
সিমরান প্রায় আধঘন্টা সেখানে রইল। এই পুরোটা সময়ে মা, বাবা কেউই তার সাথে তেমন কোনো কথা বললেন না। তাদের ব্যবহার এত শীতল যে সিমরানের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠতে লাগল বারবার। এরা যেন জীবন্ত থেকেও একেকটা লা/শ হয়ে আছে। চোখের দৃষ্টি থেকে চলাফেরা সবই যেন মৃ/ত মানুষের মতো, অনুভূতিশূন্য দুটো শরীর মাত্র।
সিমরানের অনেক কথার কোনোটারই জবাব তারা দিলেন না। ও অনেকবার করে ক্ষমা চাইল, সেটাও যেন মা বাবা শুনতেই পেলেন না। শেষে ভয় পেয়ে সিমরান ফিরে এলো।
সে রাতে সিমরান বারবার ভয়ে কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। কিসের ভয় সে জানে না। তবে বড় ভয় করছে। ভয়ের একটা চাদর ঘিরে আছে তার চারদিকে। ইশতিয়াক পুরো রাত তাকে জড়িয়ে ধরে রইল শক্ত করে। তবুও সিমরানের মনে হলো সে ভীষণ একা৷ এত একা যে শীতল কোনো এক দানব তাকে হা করে গিলতে আসছে।
********
পরদিন সকালে রোদ ওঠার পর সিমরানের ভয় কমে এলো। যোগ হলো সুইজারল্যান্ড যাবার উত্তেজনা। জীবনের প্রথম দেশের বাইরে যাবে সে। মনের ভয়গুলো কেমন করে যেন দিন বাড়ার সাথে সাথে উবে যেতে থাকল। সেখানে জমা হতে লাগল আগমনী ভ্রমণের স্বপ্ন।
এবার আর ইশতিয়াকের শরীর খারাপ হলো না, দু’জনে মধুচন্দ্রিমার উদ্দেশ্যে ভালোভাবেই বেরিয়ে পড়ল।
সেখানে গিয়ে ঘোরাফেরা করে সিমরানের মনে হলো সে নিজের জীবনের সবচেয়ে চমৎকার সময়টা কাটিয়ে ফেলছে। সে এত আনন্দ করল, এত জায়গায় ঘুরল, এত ভালো হোটেলে থাকল আর এত চমৎকার সব ছবি তুলল যে জীবনটা সার্থক মনে হতে লাগল। এত সুখ! এত আনন্দ! এত আহ্লাদ! ইশতিয়াক যেন তাকে পুরো পৃথিবীটা কিনে দিয়েছে! তাকে আত্মীয় বন্ধুরা মিলে খুব বলেছিল, তুই ওকে বিয়ে করে জীবনের সবচেয়ে বড় ভুল করছিস৷ তাদেরকে সিমরানের চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে হলো, তোমরা ভুল। আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছি ইশতিয়াককে বিয়ে করে।
অসাধারণ একটা সপ্তাহ কাটিয়ে দেশে ফিরল ইশতিয়াক আর সিমরান। ফিরেই দু’জন প্রচন্ড ব্যস্ত হয়ে পড়ল যার যার কাজে। সিমরানের মিড টার্ম শুরু হয়ে গেল। এতদিন পড়াশুনা হয়নি বলে চাপ পড়ল দ্বিগুণ। আর ইশতিয়াকের অফিসেও ডাবল কাজ করা শুরু করতে হলো।
এসবের মাঝেই একদিন সিমরান একটা ভয়ানক জিনিস আবিষ্কার করল। তার ইমেইল আইডিতে কী একটা ঝামেলা হচ্ছিল৷ কোনোভাবেই মেইল পাঠাতে পারছিল না কাউকে। এদিকে আজই এসাইনমেন্ট সাবমিট করতে হবে। সে আরেকটা মেইল আইডি না খুলে ইশতিয়াকের আইডি দিয়ে পাঠানোর চেষ্টা করল। যে ল্যাপটপে সে কাজ করে সেটা ইশতিয়াকের অনেক আগের ল্যাপটপ। এটাতে তার রেগুলার ব্যবহারের মেইল আইডি ছাড়াও আরেকটা আইডি লগইন করা ছিল। সেটা এখন ইশতিয়াক আর ব্যবহার করে না। সেই আইডি দিয়েই সে পাঠিয়ে দিল মেইল। স্যারকে সমস্যাটা সাথে লিখেও দিল।
এসাইনমেন্ট সাবমিট করে খানিকটা রিলাক্স লাগতে শুরু করল তার। সে ল্যাপটপে আনমনে ঘোরাফেরা করতে করতে হঠাৎ কী মনে করে সেই ইমেইল আইডির গুগল ফটোজে চলে গেল। সেখানে গিয়েই সে বিশাল একটা ধাক্কা খেল।
অজস্র মেয়েদের সাথে ইশতিয়াকের অন্তরঙ্গ ছবি। এখানে আলাদা আলাদাভাবে ক’টা মেয়ে আছে তা যেন সিমরান গুনেও শেষ করতে পারবে না৷ কারো সাথে হোটেলে, কারো সাথে রিসোর্টে, এমনকি ইশতিয়াকের অফিসের একজন বিবাহিত মহিলা কলিগ, যাকে বাবার কলিগ হিসেবে সিমরান চেনেও, তার সাথেও নোংরা অনেক ছবি। সিমরানের দমবন্ধ হয়ে এলো। এখানকার অনেক মেয়ে যে কলগার্ল সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছে।
গা গুলিয়ে উঠল সিমরানের। বাথরুমে ঢুকে বেসিনের সামনে দাঁড়িয়ে মাথায় পানি ঢালতে লাগল সে। তবুও যেন গা গোলানো কমছে না৷ একসময় বমিই করে ফেলল। বেসিন শক্ত করে ধরেও নিজেকে সামলাতে পারল না৷ পড়ে গেল নিচে।
তার জ্ঞান ফিরল কাজের মেয়ের ঝাঁকুনিতে। চোখ মেলেও তার মনে হতে লাগল পুরো পৃথিবী ঘুরছে। ছবিগুলো কিছুতেই চোখের সামনে থেকে সরছে না৷ নিজেকে পর্যন্ত নোংরা লাগছে। সেও তো বিয়ের আগেই লোকটার সাথে বিছানায় গিয়েছিল! ছি!
ভাবতে ভাবতে আবারও বমি করল সিমরান। কাজের মেয়েটা তাকে পরিষ্কার করে দিয়ে ধরে এনে শুইয়ে দিল ওর ঘরে। ইশতিয়াক নেই বলে মুশফিকের ডাক পড়ল।
সিমরান মুশফিককে কিছুই বলল না। বলল, উল্টোপাল্টা খেয়ে বোধহয় এমন হয়েছে। মুশফিক ডাক্তার ডাকতে চাইলে সিমরান নিষেধ করে দিল।
বিকেলের দিকে একটু ভালো লাগতে লাগল তার। উঠে জানালার পাশে বসে রইল। সেটা দেখে মুশফিক দু’জনের জন্য কফি বানিয়ে নিয়ে আড্ডা দিতে এলো।
সিমরান আজ যেন কথাই বলতে পারছে না। মুশফিক অনেক কথা বলছে। কথায় কথায় মুশফিকের মায়ের কথা উঠলে সিমরান আচমকা জিজ্ঞেস করল, “তোমার মায়ের সাথে ইশতিয়াকের ডিভোর্স হয়েছিল কেন?”
মুশফিক প্রশ্নটা শুনে যেন অস্বস্তিতে পড়ে গেল। সে বলতে চাইল না৷ এদিকে সিমরান নাছোড়বান্দা। সে মুশফিকের হাত ধরে অনুরোধ করল, “প্লিজ বলো! আমি তোমার বাবাকে বলব না যে তুমি কিছু বলেছ। এমন কী ঘটনা যে বলতে চাইছো না?”
এতদিন ধরে মুশফিক সিমরানের সান্নিধ্য চাইছিল। আজ সিমরান নিজেই তার হাত ধরে কিছু অনুরোধ করছে। সে ফেলতে পারল না৷ যত লজ্জারই হোক, ব্যাপারটা বলে ফেলল। অবশ্য বলে তার পৈশাচিক আনন্দও হলো। “বাবা মাকে চিট করেছিল, তাও একটা কাজের মেয়ের সাথে… বুঝতেই পারছো কী মিন করছি।”
সিমরান শক্ত হয়ে গেল। সব বুঝতে পারছে সে। পরকীয়ার জন্য লোকটার প্রথম বউ চলে গেছে৷ এরপর অবাধে নিজের লাগামছাড়া জীবন সে চালিয়েছে। এরপর হঠাৎ সিমরানের দেখা পেয়েছে। সিমরান অল্পবয়সী, সুন্দরী, ঝামেলা বিহীন বলে পারমানেন্টলি কাছে রেখে দিতে বিয়েও করে নিয়েছে৷ আর সিমরান ভাবত লোকটা তাকে ভালোবাসে!
সিমরান হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল। মুশফিক যেন সুযোগ পেয়েই জড়িয়ে ধরে সান্ত্বনা দিতে থাকল তাকে৷ তবে সিমরানের সহ্য হলো না ওকে৷ চিৎকার করে বের করে দিল ঘর থেকে।
সেদিন ইশতিয়াকের সাথে প্রচন্ড ঝগড়া হলো সিমরানের। ওর ব্যক্তিগত জিনিসে হাত দিয়েছে বলে ইশতিয়াক ভয়ানক রেগে গেল। আর সিমরান আগে থেকেই ছবিগুলো দেখে ভেতরে ভেতরে আগ্নেয়গিরির মতো ফুসছিল। প্রবল ঝগড়া আর জিনিসপত্র ভাঙচুর হলো। সিমরান সে রাতে ওদের বেডরুম থেকে বের হয়ে গিয়ে গেস্টরুমে শুয়ে পড়ল।
সিমরানের ইচ্ছে ছিল বাপের বাড়িতে চলে যাবার। কিন্তু বাবা মায়ের সেদিনকার ব্যবহারের কথা মনে পড়লে তার যেন আরো বেশি সংকোচ হতে থাকে। ভেতরে ভেতরে ক্রমশ সে নিজের কাছে ছোটো হতে থাকে।
ইশতিয়াকের সাথে ঝগড়া এদিকে চলমান রইল। সিমরান ভেবেছিল ইশতিয়াক আসবে তার রাগ ভাঙাতে, কোনো ব্যাখ্যা দিতে। কিন্তু অবাক হয়ে দেখল তেমন কিছু হলো না। বরং ইশতিয়াক যেন তার ওপর উল্টো রাগ দেখাচ্ছে। এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন তার কোনো দোষ নেই, সব দোষ সিমরানের।
এমনই এক রাতে ইশতিয়াক বাড়ি ফিরল না। কেন ফিরল না সেটাও জানতে পারল না সিমরান। জানার চেষ্টাও করল না। সে যথারীতি গেস্টরুমে শুয়ে পড়ল।
মাঝরাতে দরজায় টোকা পড়ল। সিমরান দরজা খুলে দেখল মুশফিক দাঁড়িয়ে আছে।
“কী হয়েছে?” জিজ্ঞেস করল সিমরান।
“ঘুম আসছে না।” বলল মুশফিক।
“তো? সেজন্য আমার ঘুম ভাঙাবে?”
“তোমারই বা কোথায় ঘুম হচ্ছে? জানি তো বড্ড বিরহে আছো। কতদিন স্বামীর সাথে থাকো না। এসো আজ আমি তোমার স্বামীর জায়গাটা পূরণ করে দেই…”
মুশফিককে বিপজ্জনকভাবে কাছে আসতে দেখে চিৎকার করতে গেল সিমরান। কিন্তু মুশফিক আগেই ওর মুখ চেপে ধরল। একটা কাপড় বেঁধে দিল মুখে। অনায়েসেই সিমরানের হালকা পাতলা শরীরটা তুলে ফেলল সে৷ বিছানায় নিয়ে গিয়ে চেপে ধরে ওর দুটো হাত খাটের স্ট্যান্ডের সাথে আটকে ফেলল হ্যান্ডকাফ দিয়ে। তারপর ওর শরীর থেকে সব জামাকাপড় খুলে ফেলল।
সিমরানের ইচ্ছে হলো মরে যেতে। সে যত ছটফট করতে লাগল মুশফিক যেন ততই মজা পেতে থাকল৷ সে বহুক্ষণ কিছু না করে স্রেফ বসে বসে সিমরানের নগ্ন শরীরের দিকে চেয়ে রইল। তারপর একসময় ঝাঁপিয়ে পড়ল।
ভোরবেলা ওকে মুক্ত করে দিয়ে চলে গেল মুশফিক। বলে গেল, “যদি বাবা জানতে পারে, তাহলে আমার কিছু হবে না। উল্টো তোমাকে আস্তাকুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলা হবে৷ এই বাড়ির এত আরাম আয়েশ আর লাক্সারি চাইলে মুখ বন্ধ করে যা হচ্ছে সেসব মেনে নিয়ে থাকতে হবে। কথাটা মনে রেখো। আর যদি এসব এনজয় করো, তাহলে দেখবে জীবনটা কত আনন্দের। ভেবে দেখো সুইটহার্ট।”
মুশফিক চলে যাবার পর জামাকাপড় পরে নিয়ে সিমরান হতবুদ্ধির মতো বসে ঠকঠক করে কাঁপতে লাগল। ওর সবকিছু এলোমেলো হয়ে গেছে। কী করবে কিছুই যেন বুঝতে পারছে না। সে ফোনটা নিয়ে কাঁপা হাতে বাবার নাম্বারটা ডায়াল করল। বাবা ফোন ধরলেন। তিনি ‘হ্যালো’ বলতেই সিমরান চিৎকার করে কেঁদে উঠল, “বাবা, আমাকে বাঁচাও, আমাকে নিয়ে যাও এখান থেকে। আমাকে বাঁচাও বাবা। প্লিজ! প্লিজ আমাকে বাঁচাও।”
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু