#কাঁটামুকুট
পর্ব-৫
সারাদিন বাড়িতে চিৎকার চেঁচামেচি, তারপর বাড়ি থেকে বেরিয়ে সিমরানের গাড়িতে চলে পালিয়ে যাওয়া অনেকেরই চোখে পড়ায় ঘটনা জানাজানি হতে দেরি হলো না। গলির মোড়ের চায়ের দোকানদার আর বাউণ্ডুলে কিছু ছেলেপুলের বদৌলতে সবাই এটাও জেনে গেল যে সিমরান যার সাথে পালিয়েছে সে তার বাবার বয়সী আধবুড়ো লোক। সে নাকি ইদানীং প্রায়ই সিমরানকে বাড়ির সামনে গাড়িতে করে ছেড়ে দিয়ে যেত। অনেকেই এসব শোনার পর ওদের বাড়িতে এলো, কিন্তু সিমরানের মা বাবা কেউই দরজা খুলল না। তালা দিয়ে ভেতরে বসে রইল। দু’জনের মনের অবস্থা অকল্পনীয়। এত আদরে বড় করা একমাত্র মেয়ে তাদের জীবনে এভাবে কালিমা লেপন করে দিয়ে যাবে তা কি তারা কোনোদিন ভেবেছিলেন? সেই রাতে দুজন না বিছানায় পিঠ ঠেকাতে পারলেন, না তাদের দুচোখের পাতা এক মুহূর্তের জন্যও এক হলো।
পরদিন সকালে সারোয়ার সাহেব তৈরি হয়ে অফিসে গেলেন। গিয়েই প্রথমে দুটো লেটার টাইপ করলেন। একটা এইচআর ডিপার্টমেন্টের কাছে ইশতিয়াকের নামে তার ফ্যামিলিতে সমস্যা সৃষ্টি করার জন্য অভিযোগপত্র আর একটা রেজিগনেশন লেটার৷ যদি কোম্পানি ইশতিয়াকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয় তাহলে তিনি চাকরি করবেন আর যদি না নেয় তাহলে রিজাইন করে চলে যাবেন। ওই লোকটার জুনিয়র হয়ে কাজ করার প্রশ্নই আসে না।
*******
রাতেই ইশতিয়াক বলে রেখেছিল আগামীকাল তারা বিয়ে করবে। সিমরান খুশি হয়ে সম্মতি জানিয়েছে। বিয়ের উদ্দেশ্যে শপিং করতে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ল তারা৷ সিমরান জীবনের প্রথমবার যেন মন ভরে শপিং করল। ইশতিয়াক আগেই বলে দিয়েছে যা পছন্দ হবে সব নিয়ে নিতে। যেহেতু সে বাড়ি থেকে কিছু আনেনি, তাই বিয়ের জামাকাপড় ছাড়াও সবসময়ের জন্য প্রয়োজনীয় জামা, জুতো, ব্যাগ ইত্যাদি যেন এখনই কিনে নেয়। সিমরান নিলও। যেসব জামাকাপড় দেখে আগে দাম জিজ্ঞেস করে চলে যেতে হলো সেসব তুলে নিল নির্দ্বিধায়, সেই সব মেকআপের সামগ্রী কিনল যেগুলো এতদিন তার উইলিস্ট ভারী করে বসে থাকত। যেসব জুতোর দোকানে জুতোর ট্রায়াল দিতেও সংকোচ হতো সেখান থেকে কয়েক জোড়া জুতো নিয়ে নিল। আর বিয়ের জন্য পছন্দ করল সোনালী সুতোর কাজ করা চমৎকার একটা গাঢ় বেগুনী ল্যাহেঙ্গা৷ ইশিতয়াকের জন্য বিয়ের পোশাকও সে পছন্দ করে কিনল৷ সব কেনাকাটা শেষে ফেরার সময় সিমরানের এত ভালো লাগতে লাগল যা কোনোদিন লাগেনি। আজ যেন তার সব না পাওয়া, সব অপূর্ণতা পূর্ণ হয়ে গেছে।
যদিও বিয়েটা গ্র্যান্ড স্টাইলে হবে এমন আশাও সিমরানের ছিল, কিন্তু সেসব হলো না৷ কয়েকজন সাক্ষী সমেত সাদামাটা বিয়েই হলো। তবে সিমরান সাজল প্রাণ ভরে। বাড়িতে মেকআপ আর্টিস্ট এসে সাজিয়ে দিয়ে গেল। বাড়িটা সুন্দর করে ডেকোরেটও করা হয়ে গেছে দুপুরের মধ্যে। প্রফেশনাল ফটোগ্রাফার এসেছে। বিয়ের পরপর শুরু হলো ফটোশ্যুট৷ সিমরান মন ভরে ছবি তুলল। একা একা তুলল অজস্র ছবি, কাপল ছবিও তোলা হলো অনেক।
সন্ধ্যার পরপর ক্লান্ত হয়ে সোফায় গা এলিয়ে বসল সিমরান। তাকে আজ অসম্ভব সুন্দর লাগছে। বেগুনী রঙটা তার ফর্সা শরীরে ফুটে আছে একেবারে। সোফায় আধশোয়া হয়ে সে মোবাইল স্ক্রল করতে লাগল। আগের সিম সে ফেলে দিয়েছে। গতরাতে এত পরিমানে কল আসছিল যে অসহ্য হয়ে পড়েছিল সে। নতুন সিম কিনে দিয়েছে ইশতিয়াক। আর ফেসবুক থেকে ফ্যামিলির সবাইকে ধরে ধরে ব্লক করে দিয়েছে গতরাতেই। তাই এখন আর ঝামেলা নেই, রিলাক্সে ফেসবুকের পাতায় ঘোরাফেরা করা যাচ্ছে। কিছু ছবি তার মোবাইলেও তোলা হয়েছে। সে ঠিক করতে পারছে না কোন ছবি প্রোফাইল ফটোতে দেবে, মোবাইলের ছবিই আগে আপলোড করবে নাকি ফটোগ্রাফারের তোলা ছবি হাতে পেলে তারপর দেবে? তার যে তর সইছে না৷
হঠাৎ পাশ থেকে একটা পুরুষ কণ্ঠ কানে আসতেই চমকে তাকাল সিমরান। মুশফিক এসে বসেছে পাশে। তার হাতে দুটো কফির কাপ। একটা সিমরানের দিকে বাড়িয়ে দিয়ে সে জিজ্ঞেস করলল, “কফি খাবে?”
সিমরান কাপটা তুলে নিল। মুশফিক বলল, “তুমি অফিশিয়ালি আমার বাবার বউ হয়ে গেলেও বয়সে কিন্তু আমার থেকে ছোটো। তোমাকে আমি তুমি করেই বলব। আশা করি মা-মামনী বলে ডাকার এক্সপেক্ট করবে না।”
সিমরান হেসে বলল, “পাগল নাকি? তুমি আমার নাম ধরেই ডেকো।”
“ঠিক আছে। খুব সুন্দর লাগছে তোমাকে।”
“ধন্যবাদ। কফিটা ভালো হয়েছে। তুমি বানিয়েছ?”
“হ্যাঁ। আমি নিজের হাতের কফি ছাড়া খেতে পারি না।”
“এরপর থেকে আমাকেও দিও।”
“অবশ্যই।”
ইশতিয়াক জরুরি কাজ আছে বলে বেরিয়ে গেছে অনেকক্ষণ হলো। এই ফাঁকে মুশফিকের সাথে ভালোই গল্প হলো সিমরানের। ওরা একই সাবজেক্টে পড়ে বলে কথাবার্তার টপিকেরও অভাব হলো না।
********
সারোয়ার সাহেব সারাদিন এলোমেলো চক্কর কাটলেন। অফিস থেকে থানা, থানা থেকে অফিস। একবার ভাবলেন ইশতিয়াকের বাড়ি যাবেন কি না, কিন্তু সেই রুচি তার হলো না। মনে হলো গিয়েও লাভ নেই, মেয়েকে তিনি কুমিরের পেট থেকে বের করে আনতে পারবেন না।
সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে তিনি দেখলেন বাড়ি লোকে লোকারন্য। আত্মীয়স্বজন কেমন করে যেন খবর পেয়ে গেছে। সব ভিড় করে এসেছে যেন সার্কাস দেখতে। তার স্ত্রী কী করবেন কিছুই বুঝতে না পেরে হতবুদ্ধি হয়ে বসে রয়েছেন সবার মাঝে। কোনো কথাবার্তা বলছেন না।
সারোয়ার সাহেবও মুখে তালা লাগিয়েই ভেতরে ঢুকলেন। বলার তো কিছু নেই।
***********
বাসর রাত নিয়ে সিমরানের জল্পনা কল্পনার অন্ত ছিল না। যদিও তাদের হানিমুন সেই রিসোর্টেই হয়ে গেছে, তবুও তার শখ ছিল বহু কিছু৷ বরং রিসোর্টে কাটানো সময়টুকুই যেন তার আকাঙ্খা আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। সে বিয়ের সাজ একটুও নষ্ট হতে দেয়নি। সারাদিন ব্যস্ততায় চলে গেছে, ইশতিয়াক তাকে ভালো করে দেখেওনি৷ একমাত্র স্বামী, একমাত্র প্রেমিকের কাছে কমপ্লিমেন্ট না পেয়ে সাজ নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না।
ইশতিয়াকের ফিরতে বেশ দেরি হয়ে গেল। সে ঘরে ঢুকল বিরক্ত মুখে। ঢুকতেই সিমরান অভিযোগ করে বসল, “আজকের দিনেও এত্ত কাজ!”
ইশতিয়াক যেন আরো একটু বিরক্ত হলো। বলল, “তোমার বাবা যে পুলিশে কেস করে বসবে তাই তো ভাবতে পারিনি। এত বিরক্তিকর একটা লোক! এতক্ষণ সেই ঝামেলা সামলে এলাম৷ পুলিশও আছে, সেই টাকাই খাবে, তবুও ঘোরাবে, নখরা করবে। ভাব এমন যেন নিজেরা একেকটা সাধু পুরুষ!”
সিমরান ভয়ার্ত মুখে বলল, “তোমাকে ধরে নিয়ে যাবে না তো?”
“আরে নাহ৷ ম্যানেজ করে এসেছি৷ তবে তোমার বাবা বেশি বাড়াবাড়ি করলে আদালত পর্যন্ত যেতে হতে পারে। তাও ঝামেলা হবে না। তুমি সাক্ষ্য দেবে যে ইচ্ছে করেই আমার সাথে এসেছ। আর তাছাড়া তুমি প্রাপ্তবয়স্কা। সার্টিফিকেট দেখিয়ে বয়স প্রমাণ করতে পারলে এমনিতেই ঝামেলা মিটে যাবে।”
“কিন্তু সার্টিফিকেট তো আনিনি।”
ইশতিয়াক একটু ভেবে বললেন, “ওটা ম্যানেজ হয়ে যাবে। ভেবো না৷ এখন মাথাটা ধরে আছে একেবারে। আমি গোসলটা সেরে আসি।”
ইশতিয়াক গোসল করল, খাওয়াদাওয়া করল, তারপর মাথাব্যথা আর ব্লাড প্রেশারের ঔষধ খেয়ে শুতে এলো। সিমরান তখনো বিয়ের পোশাকে বসে আছে। তাকে প্রথমবার খেয়াল করে ইশতিয়াক অবাক হয়ে বলল, “তুমি এখনো এই পোশাকে কেন?”
সিমরানের কান্না পেয়ে গেল। এতদিন এত রোমান্টিকতা দেখিয়ে সব এখন হাওয়া? ওর চেহারা দেখে ইশতিয়াক কিছুটা আঁচ করতে পারল। সে ওর মুখটা নিজের দু’হাতে তুলে বলল, “তোমাকে চাঁদের মতো লাগছে সিমরান। এত সুন্দর বউ আমার হবে আমি কোনোদিন কল্পনাই করিনি।”
সিমরান ভালোলাগায় কেঁদে ফেলল। ইশতিয়াক যত্ন করে তার চোখের পানি মুছিয়ে দিয়ে বলল, “আরে কাঁদে কেন পাগল মেয়ে! যাও এই ভারী শাড়ি খুলে একটু আরামদায়ক জামাকাপড় পরে এসো। আজকের রাতটা অনেক স্পেশাল হতে যাচ্ছে! এসব শাড়ি গয়নার ঝামেলায় সেটা নষ্ট করতে চাই না।”
সিমরান খুশি মনে উঠে পড়ল। যত দ্রুত পারে মেকআপ তুলে জামা বদলে আরামদায়ক অথচ সুন্দর একটা নাইট ড্রেস পরে নিল৷ এটা ইশতিয়াক নিজে পছন্দ করে কিনেছে। এত সুন্দর লাগছে তাকে জামাটা পরে! ভেতরে চেরি পিংক অন্তর্বাসের ওপর ফিনফিনে একটা গাউন। গাউনটা খোলার জন্য আবার ফিতে খুলতে হবে ছয়টা! ভাবতেই দুষ্টুমি খেলা করে গেল মাথায়।
সিমরান যখন ড্রেসিং রুম থেকে বেরিয়ে এলো তখন সে অবাক হয়ে দেখল ইশতিয়াক ঘুমিয়ে পড়েছে। নাক ডাকার শব্দ এতদূর পর্যন্ত আসছে!
(চলবে)
সুমাইয়া আমান নিতু