#কাঁটামুকুট
পর্ব-১
সুমাইয়া আমান নিতু
গিফট বক্সটা খুলে সিমরান এত অবাক হলো যে অনেকক্ষণ সে নড়তে চড়তে পারল না৷ এটা তাকে কে পাঠালো? যে জিনিটা সে উপহার হিসেবে পেয়েছে তার জন্য বাড়িতে বায়না করে সে তিনদিন ঠিকমতো না খেয়ে না ঘুমিয়ে একপ্রকার অনশনে আছে। বাবার সামর্থ্য নেই, নইলে হয়তো কিনেই দিত। তবুও সে জেদ ধরেছিল, যদি কোনোভাবে পেয়ে যায়। কিন্তু শখের হিসেবে জিনিসটার দাম তাদের অর্থনৈতিক অবস্থার তুলনায় একটু বেয়াড়া রকমেরই বেশি। তাই সে ভেবেছিল এবারের মতো জেদটা ছেড়েই দেবে। যদিও তার বড্ড বেশিই পছন্দ হয়ে গিয়েছিল জিনিসটা।
আর এখন তার চোখের সামনে চমৎকার বক্সের ভেতর থেকে বেরিয়ে এসেছে একসেট ব্র্যান্ড নিউ লিপস্টিক সেট। মোট দশটা লিপস্টিক আছে এতে, গুনে দেখল সিমরান। দামী ব্র্যান্ড। স্পেশাল এডিশনে এসেছিল সেটটা, মাত্র কিছুদিনের জন্য। এর একেকটার দাম পাঁচ হাজারেরও বেশি। পুরো সেটটা কিনতে লেগেছে পঞ্চাশ হাজার টাকারও বেশি। তার এক বান্ধবী কিছুদিন আগেই কিনেছিল বক্সটা। তখন থেকে চোখে লেগে আছে ওর। কী সুন্দর একেকটা রঙ! কী সুন্দর টেক্সচার! সিমরানের পুরো মুখ উজ্জ্বল হয়ে যায় এক লিপস্টিকের বদৌলতে।
কিন্তু….
প্রশ্নটা আবার মাথায় ধাক্কা দেয়। পাঠালো কে এটা? পার্সেলে এসেছে এটা। তার মা বাবা অনলাইনে অর্ডার দিতে অত পারদর্শী নন। তারা জানেনই না কোন পেজ থেকে কিনতে হবে। এটা অন্য কেউ পাঠিয়েছে। বক্সটা উল্টেপাল্টে দেখল সে। ভেতর থেকে একটা ছোট্ট কার্ড বেরিয়ে এলো,
“Dear Simran,
A small present for the most beautiful lady of the town. Happy birthday to you.
~ Ishtiaq Ahmed”
ইশতিয়াক! এই নামের একজনকেই তো চেনে সে। কিন্তু তার সাথে তো এরকম গিফট দেয়ার সম্পর্ক তার নয়। নাহ, অতিরিক্ত ভাবছে সে৷ এ কি তাহলে তার পিছনে ঘুরতে থাকা বড়লোকের কোনো ছেলে? কিন্তু এমন কাউকেই তো সে চেনে না। যারা পেছনে ঘোরে প্রত্যেককেই ভালোমতো চেনে সিমরান। ভাবতে ভাবতেই কল চলে আসে তার মোবাইলে।
ট্রু কলারে ভেসে ওঠে নামটা, ইশতিয়াক আহমেদ! ফোনটা তুলে কাঁপা গলায় বলে সে, “হ..হ্যালো..”
“কেমন আছো সিমরান?”
গলাটা চেনা সিমরানের। চেনা কথার ধরনটাও। যার কথা প্রথমে মনে হয়েছে এই লোক সে-ই! ইশতিয়াক আহমেদ, অফিসে তার বাবার অনেকটাই সিনিয়র। লোকটার সাথে একবারই দেখা হয়েছে সিমরানের। গত মাসে তিনি এসেছিলেন পাশেই একটা পার্টি সেন্টারে কোনো এক বিয়ের দাওয়াতে। সেখানে সিমরানরাও ইনভাইটেড ছিল। অফিসের বসের সাথে আচমকা দেখা হয়ে যাওয়ায় বাবা আর ছাড়েননি। দাওয়াত শেষে নিয়ে এসেছিলেন ওদের ফ্ল্যাটে। সেদিন বাবা আর মায়ের আপ্যায়নের ব্যস্ততার সুযোগে সিমরানের সাথে বেশ কিছুক্ষণ গল্প হয়েছিল তার৷ তিনি এমনিতে বেশ মিশুক প্রকৃতির। সিমরানকে বলেছিলেন তাকে আঙ্কেল না ডাকতে। ওটা ডাকলে নাকি তার নিজেকে বুড়ো বুড়ো মনে হয়। অথচ তিনি মনে মনে এখনো তরুণ। তবে সিমরান চাইলে তাকে নাম ধরে ডাকতে পারে। অত বড় লোকটাকে নাম ধরে ডাকার সাহস সিমরানের হয়নি। সে কিছুই ডাকেনি। সেদিনের পর থেকে লোকটার সাথে তার কোনো যোগাযোগও হয়নি। আজ হঠাৎ এসব…
“শুনছো সিমরান?”
“জি শুনছি।” সম্বিত ফিরল সিমরানের।
“গিফট পছন্দ হয়েছে?”
“হুম। অনেক পছন্দ হয়েছে। কিন্তু আপনি জানলেন কী করে এটা আমার উইশলিস্টে ছিল? আর আজ আমার জন্মদিন তাই বা জানলেন কেমন করে?”
“কোথা থেকে আর জানব! তোমার ইন্সটাগ্রামেই তো সব আছে। সেদিন এই লিপস্টিক সেটটার ছবি শেয়ার করে লিখেছিলে কেউ ভালোবাসলে এটা গিফট পেতে। আর আজকে জেনেছি সবার উইশ করা দেখে।”
সিমরান অবাক হয়ে বলল, “আপনি আমাকে ইন্সটাগ্রামে ফলো করেন?”
“ইয়েস মিস। তবে ফলো করি না, শুধু স্টক করি৷ সুন্দরীদের দেখা ছাড়া ইন্সটাগ্রামের আর কাজটা কী বলো?”
“থ্যাংক ইউ সো মাচ স্যার!”
“স্যার? আমি তোমার বাবার স্যার। তোমার নই। আমি তোমার ফ্রেন্ড, ঠিক আছে?”
“ঠিক আছে।”
“এখন এইযে গিফট দিলাম, এর রিটার্ন গিফট কি আমার পাওনা হয়নি?”
“অফকোর্স। কিন্তু আমি আপনাকে এমন কী বা দিতে পারি?”
“এমন কিছুই চাইব যা তুমি দিতে পারবে।”
“কী চান বলুন? সাধ্যের মধ্যে থাকলে আমি অবশ্যই দেব।”
ইশতিয়াক হেসে বললেন, “ওকে! আগামী শনিবার বিকেল পাঁচটায় আমার সাথে এক কাপ কফি খাবে। কফিটা তুমি খাওয়াবে।”
“এটাই?” খুশি হয়ে বলল সিমরান।
“হ্যাঁ এটাই। ও হ্যাঁ, সাথে আজকের লিপস্টিক সেট থেকে সবচেয়ে সুন্দর লিপস্টিকটা লাগিয়ে আসবে।”
“অবশ্যই।” হেসে বলল সিমরান৷
“আর একটা কথা, আমি যে উপহার দিয়েছি এটা প্লিজ তোমার বাবাকে বলো না৷ তাহলে সে বলবে তার মেয়েকে গিফট দিয়ে আমি স্পয়েল করে দিচ্ছি। হাজার হোক তোমার বাবা পুরানো চিন্তাধারার মানুষ। দেখো না বুড়ো হয়ে গেছে। কত বলি একটু আধুনিক হন, তিনি কি আর শোনেন? আমাকেই দেখো, যুগের সাথে তাল মিলিয়ে চলছি৷ তোমাদের জেনারেশনের মতোই ফ্রেশ আমার চিন্তাভাবনা।”
“হ্যাঁ, বাবাটা একদম ওল্ড ফ্যাশন।” ঠোঁট উল্টে বলল সিমরান।
“আচ্ছা রাখছি তাহলে। দেখা হবে শনিবার।”
“ওকে বাই।”
এমন সময় মা দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন। লিপস্টিক সেটটা দেখে চোখ বড় বড় করে জিজ্ঞেস করলেন, “পেলি কোথায় এটা?”
যেন কিছুই হয়নি এমন ভঙ্গিতে সিমরান জানাল, “ফ্রেন্ড গিফট করেছে।”
মা এগিয়ে এসে লিপস্টিকগুলো হাত দিয়ে ছুঁয়ে বললেন, “এগুলো কি সেগুলো যার জন্য..”
“হ্যাঁ।”
“তোর এত দরদী ফ্রেন্ড কবে হলো? এত দামী গিফট দিয়েছে?”
সিমরান বাঁকা হেসে বলল, “সবসময়ই ছিল। শুধু তোমরাই আমার শখের কোনো পাত্তা দাও না৷ তার মানে এটা নয় যে আর কেউ দেবে না।”
মা আর কথা বাড়ালেন না। মেয়েটার সাথে কথা বলা বিপদ। অপমান করে কথা বলা শিখেছে। ছোটোবেলায় শাসন করা হয়নি, এখন এমন সব কথা বলে যে গা পিত্তি জ্বলে যায়, অথচ এখন শাসনের বয়স নেই। ইউনিভার্সিটিতে উঠে গেছে, এই বয়সী মেয়েদের কি কিছু বলা যায়? বলতে গেলে উল্টো তেড়ে আসে। সাথে আছে বায়না আর জেদ। তার ইদানীং নিজেকে ভীষণ অসহায় লাগে।
*******
শনিবার বিকেলে সেজেগুজে বেশ পরিপাটি হয়ে বের হলো সিমরান৷ লাল রঙের টপস আর গাঢ় নীল জিন্স পরেছে। কানে ছোট্ট মুক্তার দুল, ঠোঁটে লাল লিপস্টিক, হাতে ব্রেসলেট। আর্টিফিশিয়াল আইল্যাশ ছাড়া চোখের আর কোনো সাজসজ্জা করেনি। মুখে সামান্য বেইজ মেকআপ করে ব্লাশন লাগিয়ে নিয়েছে। দেখে মনে হয় মেকআপ করেনি। সে অবশ্য এমনিতেই সুন্দর দেখতে। গায়ের রঙ মাখনের মতো। হাসলে গালের একপাশে টোল পড়ে। ওর বান্ধবীরা প্রায় সবাই ওকে হিংসে করে। সেজন্যই বোধহয় নিজেদের টাকাপয়সার গরম ওর সামনে একটু বেশিই দেখায়। ওর বান্ধবীদের মধ্যে একমাত্র সিমরানদের ফিনানশিয়াল অবস্থাই একটু নিচে। বাকিরা দেদারসে টাকা ওড়ায়। তাকে খানিক কটাক্ষও করে। ব্যাপারটা সহ্য হয় না ওর। মনে হয় কোনো জাদুর কাঠি দিয়ে বড়লোক হয়ে যেতে পারত যদি! বড়লোক অনেকে অবশ্য ওকে প্রপোজ করে। তবে সিমরান এখনো মনের মতো কাউকে পায়নি।
এসব ভাবতে ভাবতেই সে পৌঁছে গেল কফিশপে। গিয়ে দেখল ইশতিয়াক আগেই এসে বসে আছেন। ওকে দেখে উঠে দাঁড়ালেন তিনি৷ চেয়ার টেনে দিলেন ওর জন্য। মুগ্ধ হয়ে গেল সিমরান। এতটা সে আশা করেনি। বসার পর ইশতিয়াক বললেন, “তুমি পনেরো মিনিট লেট।”
সিমরান খানিক বিব্রত হয়ে বলল, “স্যরি, আসলে জ্যাম…”
“জ্যাম ঠেলে তো আমিও এসেছি।” বলেই হেসে ফেলল ইশতিয়াক। “তবে সুন্দরীদের এক্সকিউজ মেনে নেয়াই যায়, কী বলো? কোন কফি খাবে বলো?” মেন্যু কার্ডটা এগিয়ে দিলেন তিনি।
সিমরান মেন্যুটা উল্টো ঠেলে দিল৷ “আপনি সিলেক্ট করুন। আপনার জন্যও, আর আমার জন্যও। আজকের পছন্দটা আপনার ওপর ছেড়ে দিলাম।”
ইশতিয়াক হেসে মেন্যুটা মনোযোগ দিয়ে দেখতে লাগলেন। এই ফাঁকে ভালো করে তাকে দেখল সিমরান৷ অসম্ভব হ্যান্ডসাম লাগছে তাকে। চকচকে কালো স্যুটটা চমৎকারভাবে মানিয়ে গিয়েছে তার গায়ের ফর্সা রঙের সাথে। চুলগুলো পুরোপুরি কালো নয়, সাদা আর কালোর মিশেলে। তবে মাথাভর্তি চুল, দেখলেই ছুঁয়ে দিতে ইচ্ছে হয়। দাড়িগোঁফ কামানো চেহারায় সামান্যই ভাজ পড়েছে। তবে সেজন্যই বুঝি লোকটাকে আরো বেশি ম্যানলি লাগছে। হাতে রোলেক্স ঘড়ি আর একটা দামী আংটি। পেশিবহুল হাতটা দেখে শরীর নিজের অজান্তেই শিরশির করে উঠল সিমরানের। ইশতিয়াকের শরীর থেকে মোহনীয় ঘ্রাণ আছে। খুব দামী পারফিউম বুঝি!
ততক্ষণে কফি অর্ডার দিয়ে অবসর পেয়েছেন ইশতিয়াক। তিনি নানা বিষয়ে কথা বলতে লাগলেন। ফ্যাশন, ট্রেন্ড, সিনেমা, ট্রাভেলিং… সব সিমরানের পছন্দের টপিক। এত ভালো লাগল ওর গল্প করে! ওর আশেপাশের ছেলেগুলো যেন কিছুই জানে না। এরা শুধু পড়ে আছে ফেসবুক, রিলস, মিমস নিয়ে। এদের সাথে গল্প করতেও ভালো লাগে না।
কফির সাথে ইশতিয়াক পেস্ট্রি আর চকোলেট চিপস কুকি অর্ডার করেছিল। সেগুলো চলে আসায় সিমরান নিজের মানিব্যাগের কথাটা একটু ভাবল। জমানো সব টাকাই সে নিয়ে এসেছে। তবুও কম পড়লে? এত পশ কফিশপে আগে আসেনি সে। মেন্যুকার্ডটাও দেখেনি। তবে সে নিজের নার্ভাসনেসটা বুঝতে দিল না ইশতিয়াককে। হাসিমুখে খেতে শুরু করল।
খাওয়া শেষে বিলটা ইশতিয়াকই পে করলেন। সিমরান জোর করেছিল, কিন্তু তিনি ওর হাত থেকে ব্যাগটাই টেনে নিয়ে গেছেন। সেখান থেকে বের হয়ে ইশতিয়াক তাকে গাড়িতে করে বাড়ি পৌঁছে দিলেন৷ ড্রাইভ করলেন নিজেই। সিমরানের মনে হলো চমৎকার একটা ডেট ছিল এটা! যদি আদৌ ডেট হয়ে থাকে তাহলে। লোকটা তাকে এত স্পেশাল ফিল করাচ্ছে কেন? মুখে তো কিছু বলছে না।
বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে ব্যাগটা খুলেই চমকে গেল সে। তার অগোচরে কখন যেন ইশতিয়াক একটা ছোট্ট গিফট বক্স ঢুকিয়ে দিয়েছে ব্যাগের ভেতর। সেটা খুলতেই বেরিয়ে এলো ছোট্ট একটা হীরের আংটি। অসম্ভব সুন্দর কাটিং। সাথে একটা চিরকুট। “রিংটা একসেপ্ট করলে ফোন করবে। নয়তো এটাই আমাদের শেষ দেখা ছিল।”
সিমরানের চোখে পানি চলে এলো। তার পক্ষে কি এটা রিজেক্ট করা সম্ভব? ইশতিয়াক এটা কেমন করে লিখতে পারল? অভিমান হলো তার।
সাথে সাথেই ফোন করল সিমরান। ইশতিয়াক কল ধরতেই সে বলল, “আপনার কেন মনে হলো আমি রিংটা একসেপ্ট করব না?”
ইশতিয়াক বেশ ধীর গলায় বললেন, “তুমি হয়তো বুঝতে পারছো না সিমরান, শুধুই বন্ধু হিসেবে একসেপ্ট করার কথা বলিনি আমি।”
“আমি অত বোকা নই ইশতিয়াক। আপনি যেভাবে চাইছেন আমি সেভাবেই আপনাকে একসেপ্ট করলাম।”
ইশতিয়াক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে হেসে বললেন, “ধন্যবাদ।”
“আপনাকে ধন্যবাদ এত সুন্দর একটা আংটির জন্য। এর রিটার্ন গিফট কিন্তু দিতে পারব না।”
“কেন পারবে না? আমার সাথে আংটির দোকানে গিয়ে একটা চুজ করে দেবে। সেটাই হবে আমায় দেয়া তোমার উপহার।”
“আচ্ছা।”
“কবে যাবে?”
“যেদিন বলবেন।”
“কালই এসো।”
“ওকে।”
“উফ… ভাবতেই কষ্ট হচ্ছে। কতটা সময় তোমাকে না দেখে কাটাতে হবে!”
সিমরান খিলখিল করে হেসে বলল, “আপনি তো টিনএজারদের মতো কথা বলছেন।”
ইশতিয়াক বলল, “প্রেমে পড়লে সবাই টিনএজার হয়ে যায় সুইটি।”
(চলবে)