#কাঁটাকম্পাস #পর্ব৮
#আরশিয়া_জান্নাত
আরওয়া তৈরি হয়ে নীচে আসতেই দেখে জাওয়াদ দরজার সামনের পিলারে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সে তো আরো আগেই অফিসে যাওয়ার জন্য বেরিয়েছিল। তবে এখনো যায় নি কেন? তার জন্য অপেক্ষা করছে এই ভাবনা তার মনে ভুলেও উঁকি দেয়নি। আরওয়া বরং ভাবলো কোনো কাজেই হয়তো রয়ে গেছে। তাই সে তাকে অতিক্রম করে আপনমনে ভার্সিটির উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলো। তখনই জাওয়াদ ডাকলো, আরওয়া..
ডাকটা যদিও খুব সাধারণ ছিল। কিন্তু কেন জানি আরওয়ার কাছে এটা ভীষণ আলাদা লেগেছে। সে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে পেছনে ফিরে তাকালো। জাওয়াদ ফোন পকেটে রেখে বললো, আসুন আপনাকে ড্রপ করে দেই।
আমি একা যেতে পারবো, সমস্যা নেই। আপনাকে অযথা উল্টোপথে যেতে হবেনা।
সবসময় এতো কথা বলো কেন? মুখ ব্যথা করে না?
আমি কখন বেশি কথা বললাম? আগের হিসাবে এখন আমি কথা বলি না বললেই চলে। আমার ক্লাসমেটদের জিজ্ঞাসা করে দেখবেন। ওদের কান ঝালাপালা করা আমার মুদ্রাদোষ।
জাওয়াদ গাড়ির দরজা খুলে বললো, বসো।
আরওয়া গাড়িতে বসলো। জাওয়াদ ড্রাইভিং সিটে বসে বলল, এমন হা করে চেয়ে না থেকে সিট বেল্ট পড়ো।
রহস্য কি খন্দকার সাহেব? পথিমধ্যে গায়েব করার ফন্দি আটছেন নাকি? হঠাৎ যেচে নিতে চাইছেন?
মশামাছি মেরে হাত ময়লা করার কারণ দেখছি না।
আমি মশামাছি?
জাওয়াদ ওর দিকে তাকালো, কিয়ৎক্ষণ পরোখ করে বললো, তোমাকে মশামাছি বললে ওদেরো অপমান হবে।
আরওয়া মুখ ফুলিয়ে বলল, আপনার থেকে ভালো কিছু শুনবো এ আশা আরওয়া করে না। রোজ সকলে নিমপাতার রস সেবন করেন বুঝি? অবশ্য যে চিনি ছাড়া কফি পান করে তার অন্য তেতো পানীয়র দরকার কি!
জাওয়াদ ড্রাইভে মন দিলো। এই মেয়ের কথা বলার সঙ্গীও লাগেনা, অটোরেকর্ড চলতেই থাকে প্রতিত্তর বাদেই।
নাহিয়ান নাইট করে এসে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। সাবা যাবতীয় কাজ শেষ করে রুমে এসে বসলো। ঘুমন্ত নাহিয়ানের দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বললো, মাশাআল্লাহ! আল্লাহ আমার বরটাকে কতো কিউট করে সৃষ্টি করেছেন!!
নাহিয়ান হাত বাড়িয়ে বললো, বউ এমন করে চেয়ে থেকো না তো। ঘুমাতে মন চায় না।
সাবা ওর হাতে চুমু খেয়ে বললো, আমার বরের দিকে আমি তাকাবো না তো কে তাকাবে হুম? তুমি নিষেধাজ্ঞা দিলেই মানতে হবে বুঝি?
তোমার জন্য পরোয়ানা জারি করা আছে, আমি দিনে ঘুমানোর সময় আশেপাশে ঘেষবেনা।
বললেই হলো?
অবশ্যই। আজ যখন আইন ভঙ্গ করেছ শাস্তি পেতে তৈরি হও
শাস্তি?
হুম শাস্তি।
কি শাস্তি শুনি?
নাহিয়ান ওকে টেনে বুকের উপর তুলে বললো, তোমার শাস্তি হলো আমাকে ১০০১টা চুমু খাওয়া।
১০০১!!
হুম, কম হয়ে গেল?
পাগল তুমি!
পাগল বলো না প্রিয়, আমি ক্লান্ত বলেই তোমায় দিতে বললাম। নয়তো আমিই দিতাম। নাও শুরু করো। সময় বেশি নেই।
সাবা ওর নাক টেনে বললো, হিসাব নিকাশ করে চুমু খেতে পারবো না। আমার মন চাইলে ১হাজার কেন ১ লক্ষ বার চুমু খাবো।
নাহিয়ান বিরক্ত স্বরে বলল, ও বউ শান্তি দিবে না তুমি। উফ উফ …
আমি আবার কি করলাম?
এমন কথা বলো না মাঝেমধ্যে আমি আর স্থির থাকতে পারি না। এখন ঘুম আর হবে না
বলেই সাবাকে পাশ ফিরিয়ে শুইয়ে দিলো। সাবা দু’হাতে মুখ ঢেকে বললো, এই এখন না প্লিজ।
নাহিয়ান ওর হাতের উপরেই গাঢ় চুমু খেয়ে বললো, এখন মুখ ঢেকে লাভ নেই সোনা। স্বামীর আহ্বানে সাড়া না দিলে পাপ হবে কিন্তু।
নাহিয়ান আর কালক্ষেপণ করলো না, ছোট বড় আদরে সাবাকে বশে এনে ফেলল খুব সহজেই।
।
রোকেয়া বেগম নাক টেনে টেনে কাঁদছেন। আজ তার পছন্দের সিরিয়ালের নায়িকা এক্সিডেন্ট করেছে। নায়িকার জন্য নায়কের কান্না দেখে রোকেয়া বেগমের কলিজা ফেটে যাচ্ছে। আহারে ছেলেটা কি করুণ করেই না অভিনয় করছে! ওকে অভিনয়ের জন্য এওয়ার্ড দেওয়া উচিত। রোকেয়া যদি পারতো তাকে অস্কার দিতো নিশ্চিত। রাহেলা হঠাৎ বিলাপ করে বললো, আফাগো পরিচালকের নাম্বার আফনার কাছে নাই? আমার তো আর সহ্য হইতাছে না আফা। কাউরে কন না পরিচালক রে কল দিতো,,
ওদের আহাজারি দেখে সালমা বেগম ভ্রু কুঁচকে বললো, রাহেলা তুই মরবি না? বেগানা পুরুষের জন্য এমনভাবে চিল্লাইয়া বিলাপ করতেছোস কেমনে? আর এসব তো অভিনয় বাস্তবে কেউই মরেনাই।
ও আম্মাগো অভিনয় বইলা কি দুঃখ এড়ানো যায়? মাইনষের দুঃখে মাইনষে এখন কান্দে? হেয় পাক্কা অভিনেতা বলিই আর চোখে ফানি আইছে। নয়তো রাহেলার কলিজা পাথরের মতো শক্ত। এই শক্ত বেডির মন গলাইয়া যে ফানি আনছে বুইঝতে হইবো সে যেন তেন লোক নো।
সালমা জানেন ওর সাথে তর্ক করে লাভ নেই। তিনি তার মেজোবউ এর দিকে তাকিয়ে হতাশার নিঃশ্বাস ফেললেন। এই দুইজন এই বাড়ির বিখ্যাত কাঁদুনে। এরা বাস্তব ঘটনার জন্য ও এতোবার চোখের পানি ফেলেনাই যতোবার এই টিভি দেখে ফেলছে! কি যে পায় ওরা টিভিতে তার বুঝে আসেনা। তিনি হেঁটে বাগানের দিকে গেলেন সেখানে আরওয়াকে একা বসে থাকতে দেখে কিছুটা অবাকই হলেন বটে। মেয়েটা এখানে একা বসে আছে কেন? ধীর পায়ে আরওয়ার পাশে গিয়ে বসে বললেন, একা একা কি করো?
আরওয়া মিষ্টি হেসে বললো, ব্লাড ডোনেশন করছি দাদী।
মশাকে?
হুম।
মন খারাপ?
নাহ। এমনিই বসে আছি, সবসময় ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগেনা।
এখানে মন বসতেছে না তাই না বুবু?
না না তেমন না দাদী।
আমার কাছে লুকিয়ে কি হবে বোইন। আমিও তো একসময় নতুন বউ ছিলাম। আমি জানি নিজের পরিবার ছেড়ে নতুন জায়গায় এসে হঠাৎ করে অন্য পরিবারের সদস্য হওয়াটা এতো সহজ না। সমাজ যদিও ধরে বেঁধে সম্পর্ক চাপাই দেয় কিন্তু মানাই নিতে সময় তো লাগেই।
আচ্ছা দাদী একটা কথা জিজ্ঞাসা করি? কিছু মনে করবে না তো?
কি কথা?
দাদাসাহেব তো অনেক গম্ভীর। উনার সঙ্গে মানিয়ে নিতে তোমার অনেক কষ্ট হয়েছে না?
একটা কথা কি জানো বুবু মাটিতে ফুল ফোটানো অনেক সহজ। যে কেউ চাইলেই একটু যত্ন দিয়ে, একটু পরিচর্যা করে সেখানে ফুল ফুটাতে পারে। বেশি কসরত করা লাগে না বলে ঐ ফুলের অধিকারী অনেক হয়। কিন্তু পাথরে ফুল ফোটানো অনেক কঠিন। সবাই ধৈর্য ধরে সেখানে ফুল ফোটাতে পারে না। তবে যদি ফুল ফোটে ঐ ফুলের অধিকারী বহুজন হয় না নির্দিষ্ট একজনই হয়। গম্ভীর আর অন্তর্মূখী মানুষ গুলোর ভালোবাসা সবাই বুঝতে পারে না। তোমার দাদাসাহেব খুব রাগী মানুষ। প্রথম প্রথম তো তার সামনে কথা বলতেও সাহস পাইতাম না
যদিও তিনি কখনো উচ্চস্বরে কথা বলেনাই। কিন্তু মনের ভয় কি এমনে এমনে দূর হয়? ধীরে ধীরে সময় যত গেছে বুঝলাম ঝিনুকের শক্ত খোলসের ভেতরের অংশ টা খুব নরম। ঐ নরম অংশে জমে থাকা মুক্তার একমাত্র অধিকারী হিসেবে যেদিন নিজেকে আবিষ্কার করছি সব আফসোস মুছে গেছে। সবকিছু সহজ হয়ে গেছে।
আরওয়া হেসে বললো, দাদাসাহেব তোমাকে অনেক ভালোবাসে তাই না?
তা তো বাসেই। তোমার দাদাসাহেব এর জন্য দুইটা দিন বাপের বাড়ি থাকতে পারি নাই। মেহমানের মতো সকালে গেছি বিকালে চলে আসছি।
আরওয়া চেয়ে দেখলো কথাগুলো বলার সময় সালমার চোখেমুখে কেমন দ্যুতি ছড়াচ্ছে। বরের ভালোবাসা যে নারী পায় তার সৌন্দর্য অন্যসবকিছু ছাপিয়ে যায়। আরওয়া দূরের আকাশের দিকে চেয়ে মুচকি হাসলো। এই সৌভাগ্য তার নেই হয়তো। পৃথিবীতে সবাই সুখি হয় না…
।
কাজ শেষ করে বিছানায় শুতে এসে জাওয়াদ দেখে আরওয়া বসে ওর দিকে চেয়ে আছে। যেন ওর বিছানায় আসার অপেক্ষাই করছিল এতোক্ষণ।
জাওয়াদ নিজের বালিশ ঠিক করে শুয়ে পড়তেই আরওয়া বলল, আপনার এই নাটক কতদিন চলবে বলে কনট্র্যাক্ট করেছেন?
মানে?
মানে যার জন্য এই কাঁটাতার সেটে রেখেছেন সে কতদিনের সময় দিলো?
কার কথা বলছো? রাতবিরেতে মাথা গেছে নাকি?
আরওয়া সিরিয়াস গলায় বললো, আপনার প্রেয়সীর জন্য ই তো এই বিয়ে মানতে অসুবিধা তাই না? তো সে আপনাকে এই বিয়ে ভাঙতে কতদিন সময় দিলো?
ওহ এই ব্যাপার।
খবরদার কোল্ড ওয়্যার খেলতে আসবেন না। আমি টায়ার্ড এই সবে। আমার মনে হচ্ছে এখন একটা বিহিত করা উচিত। বিয়ের প্রায় ২০দিন হয়ে গেছে। এবার অন্তত খোলাসা করুন। আমি জানতে চাই আমাকে কেন আপনি মানতে নারাজ। পরিবারের চাপে বাধ্য হয়ে বিয়ে করেছেন বুঝেছি, কিন্তু এখন বিয়ের পর ডিভোর্স দিলে কি পরিবার মানবে? যদি এখন মানে তবে না বলার সময় মানলো না কেন? আমার জীবনটা অযথা প্রশ্নবিদ্ধ করার দরকার কি ছিল? আমার নামের আগে ডিভোর্সী খেতাব লাগানোর চেয়ে বিয়েটা না করা কি ভালো ছিল না? আপনি যখন এটা মানবেন ই না বলে মনস্থির করেছিলেন তবে আমাকে এই সম্পর্কে জড়ালেন কেন?
জাওয়াদ আরওয়ার দিকে শান্তদৃষ্টিতে তাকালো। দু’হাতে নিজের মুখ মুছে চুলগুলো ঠেলে পেছনে নিলো। মাথা নীচু করে নিরব রইলো বেশ অনেকটা সময়। আরওয়া ভাবলো এখন বুঝি জাওয়াদ সবটা ক্লিয়ার করবে। কিন্তু না তাকে নিরাশ করে দিয়ে জাওয়াদ বলল, অনেক রাত হয়েছে। ঘুমিয়ে পড়ো। সকালে ক্লাস আছে না?
আরওয়ার ভীষণ মেজাজ খারাপ হয়ে গেল। সে হাতের কাছে থাকা কাঁচের গ্লাসটা ফ্লোরে ছুড়ে মারলো। সেই ভাঙা কাঁচের দিকে এগিয়ে গিয়ে হেসে বললো, আমি আমার লাইফে এডভেঞ্চার চেয়েছিলাম। তাই বলে আল্লাহ সেটা এভাবে পূরণ করবে ভাবি নি। আসলে কোনোকিছু ভাবা ঠিক না। কখন কোন মনোঃকামনা পূরণ হয়ে যায় বলা যায় না। লাইফ শুড বি গো এহেড উইদাউট থিংকিং এনিথিং! আর এটা হবে আমার ভাবনার বাইরের একটা কাজ…
বলেই আরওয়া কাচের একটা বড় টুকরো হাতে নিয়ে এলোপাথাড়ি আঁচড় আঁকতে লাগলো নিজের হাতে। যন্ত্রণায় তার চোখ থেকে পানি পড়ছে, তবুও রাগ পড়ছে না। জাওয়াদ দ্রুত ওর কাছে গিয়ে আটকানোর চেষ্টা করলো। কিন্তু আরওয়া ওর কাছে ঘেঁষতে দিলো না। ওর হাত থেকে টপটপ করে রক্ত ঝরছে দেখে জাওয়াদ আর দেরি করলো না, দু’হাতে ওকে আগলে নিয়ে কাঁচের টুকরোটা ফেলে দিলো। আরওয়া ওর বুকের মাঝেই অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল।
আরওয়ার যখন জ্ঞান ফেরে রাত প্রায় সাড়ে তিনটা। হাতে ব্যান্ডেজ করা হলেও ভীষণ জ্বালাপোড়া করছে। কাঁচের আঁচড় কি ভীষণ জ্বালাময়ী ভুক্তভোগী ছাড়া কেউ বুঝবেনা। আরওয়া চারদিকে চেয়ে বোঝার চেষ্টা করলো জাওয়াদ কোথায়। বেলকনীতে জাওয়াদের ছায়া দেখে বালিশে মাথা রেখে সিদ্ধান্ত নিলো কাল সকালেই সে চলে যাবে। যা টেকার নয় তার পেছনে সময় নষ্ট করে আর লাভ নেই। যার বাড়ি, যার বিছানা সে আরাম করেই তা ভোগ করুক। সে কেন এসবের মাঝে অন্তরক হবে?
চলবে…
#কাঁটাকম্পাস #পর্ব৯
#আরশিয়া_জান্নাত
একটা মেয়ে অনেক আশা ভরসা নিয়ে বিয়ের পর স্বামীর বাড়িতে আসে। অচেনা অজানা পরিবেশে এসে নিজেকে মানিয়ে নিতে মেয়েদের অনেক কষ্ট হয়। তবে যদি জীবনসঙ্গী সাপোর্টিভ হয় অন্য সব প্রতিকূলতা কাটিয়ে মেয়েটা খুব সহজেই টিকে যায় এবং নতুন পরিবারের বিশেষ সদস্য হয়ে উঠে।
এই বিয়েতে জাওয়াদের মত না থাকলেও আরওয়ার পূর্ণ মত ছিল। চঞ্চল প্রকৃতির মানুষরা চুপচাপ মানুষের প্রতি বরাবরই আকর্ষণ বোধ করে। বিয়ের আগে যে দুইবার তাদের দেখা হয়েছিল জাওয়াদ তার সাথে সৌজন্যমূলক আচরণ করেছে। তখন তাকে দেখে আর যাইহোক এটা মনে হয়নি বিয়েটা তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে হচ্ছে।
যদি একটাবার সে আরওয়াকে বলতো তবে আরওয়া কখনোই এই বিয়ে হতে দিতো না। ওর পরিবারে ওর মতের বিরুদ্ধে যাবে এমন কেউ নেই। এখনো যদি সে গিয়ে বলে এই বিয়ে সে রাখবেনা উনারা তাকে সাপোর্ট করবেন এইটুকু ভরসা তার আছে। কিন্তু ব্যথাটা যে ভিন্ন জায়গায়। আরওয়ার দু’চোখ বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়লো। ও মুখে যতোই ঝগড়া করুক বা জাওয়াদকে বিরক্ত করুক, জাওয়াদের প্রতি ওর দূর্বলতা অনেক। শান্তশিষ্ট সুদর্শন পুরুষ জাওয়াদ। সে যখন ল্যাপটপে কাজে মগ্ন থাকে, বা নিরবে এককোণে বসে বই পড়ে। আরওয়ার শান্তি লাগেনা। এই দুটো বস্তুকে আরওয়া খুব হিংসা করে। জাওয়াদ যে গভীর মনোযোগে ওদের নিয়ে মত্ত থাকে, আরওয়াতে তেমন মত্ত থাকে না কেন? মানুষ আবেগের তাড়নায় কত কি করে। নারী-পুরুষের মাঝে যে চৌম্বক আকর্ষণ আছে তার প্রভাবও কি নেই ওর মাঝে? কোনো পুরুষের পক্ষে কি সম্ভব এমন তরুণী স্ত্রীকে উপেক্ষা করে দিনের পর দিন কাটানো? এতো নির্লিপ্ততা কখন আসে মানুষের? হয় তার জীবনে অন্য নারী আছে হোক সে পাস্ট কিংবা প্রেজেন্ট অথবা সে অক্ষম।
আরওয়ার ভেতরটা ভারী হয়ে আসে, বারবার জিজ্ঞেস করতে মন চায়, আমায় কেন ভালোবাসতে পারছেন না? এই বিয়েটাকে একটা সুযোগ দেওয়া কি খুব কঠিন হতো আপনার জন্য? আপনি একবার সুযোগ দিয়ে দেখুন আমি আপনাকে অভিযোগ করার স্কোপ দিবো না। আমি তো বিয়ে করে এসেছি বিয়ে নামক পরীক্ষা টায় ফুল মার্কসে পাশ করতে। আমি তো সাপ নেউলের খেলা খেলতে আসি নি…
কিন্তু এসব আবেগ দেখিয়ে নিজের দূর্বলতা প্রকাশ করতে ইচ্ছে করেনা তার।
জাওয়াদ রুমে ফিরে আরওয়ার দিকে তাকালো। আরওয়া তাকে ঢুকতে দেখেই চোখ বন্ধ করে ঘুমের ভান ধরেছে। জাওয়াদ আলতোভাবে ওর ব্যান্ডেজ করা হাতটা ধরলো। আরওয়া বালিশ চেপে কাঁদছিলো বলে হাতটা বালিশের নীচে ছিল। জাওয়াদ বালিশ সরিয়ে তাই হাতটা মেলে দিলো। ওর স্পর্শে আরওয়ার কষ্ট যেন আরো বাড়লো। কান্না সব দলা পাকিয়ে সজোরে বেরিয়ে আসতে চাইছে। আরওয়া নিজেকে সামলানোর কঠিন চেষ্টা করছে। নাহ কান্না করা যাবে না। কান্নাকাটি করে দয়া ভিক্ষা চায় না সে।
জাওয়াদ ওর চোখের পানি মুছে দিয়ে বললো, এ কয়দিনে অনেক পাপ জমা করছি। আমার আরো শক্ত হওয়া উচিত ছিল। নিজের মতামত রাখার মতো স্ট্রং হওয়া উচিত ছিল। আমার দূর্বলতার দায়ভার তোমার উপর বর্তায় না। তুমি চিন্তা করো না, আমি তোমার জন্য বেস্ট কাউকে আনবো। যে সবটা জেনে তোমাকে অনায়াসে মেনে নিবে। এই বিয়ের কোনো খারাপ প্রভাব তোমার জীবনে পড়বে না।
আরওয়া চোখ মেলে চাইলো জাওয়াদের দিকে। জাওয়াদ অপ্রস্তুত ভঙ্গিতে ওর হাত ছেড়ে বললো, পেইনকিলার খেয়ে নিবে একটা? অনেক ব্যথা করছে না?
আরওয়া হেসে বললো, নাহ একটুও ব্যথা করছেনা। আরাম লাগছে।
জাওয়াদ ড্রয়ার থেকে পেইনকিলার বের করে বললো, এটা খেয়ে ঘুমাও ভালো লাগবে।
আরওয়া শান্তস্বরে বলল, আমি কাল সকালে চলে যাবো। আপনি কষ্ট করে রফিক চাচাকে বলবেন আমাকে যেন দিয়ে আসেন।
জাওয়াদ প্রত্যুত্তর না করে হলুদ মেশানো দুধের গ্লাসটা এগিয়ে দিলো।
আপনাকে কষ্ট করে কেয়ার দেখাতে হবে না। আমি ঠিক আছি।
জাওয়াদ গম্ভীর স্বরে বললো, জেদ ধরো না। যা বলছি চুপচাপ করো।
আরওয়া এবার কেঁদেই ফেললো। কাঁদতে কাঁদতে বললো, পেয়েছেন কি আপনি? আপনি যা বলবেন তাই হবে? আমার ইচ্ছা অনিচ্ছার কোনো দাম নেই?
জেদের বশে হাত কেটে কোনো মহৎ কাজ করো নি। তোমার ইচ্ছার ডেমো দেখা হয়ে গেছে আমার। এটার উপর আপাতত ভরসা করতে পারছি না।
আপনি মানুষ না আপনি পাথর। আপনার মন বলতে কিছু নেই।
আরওয়া তোমার মন এখন বিক্ষিপ্ত হয়ে আছে। শান্ত হও তারপর এই বিষয়ে কথা বলবো।
আর কোনো কথাবার্তার প্রয়োজন তো দেখছি না। আমি সকালে চলে যাবো এটাই ফাইনাল।
বেশ চলে যেতে চাইছো যখন যাবে। এখন যা বলছি করো।
আরওয়া উঠে দেখলো জাওয়াদ ইতোমধ্যেই রুমটা ক্লিন করে ফেলেছে। সে নিজের বালিশ সরিয়ে বললো, আপনাকে অনেক জ্বালিয়েছি। আমাকে ক্ষমা করবেন। আপনার বিছানায় আপনি শান্তিতে ঘুমান। আর শুনুন আপনার প্রেমিকা যদি এই বিয়ের কারণে কোনো সন্দেহ বা অশান্তি করে আমাকে বলবেন। আমি তার সন্দেহ দূর করে দিবো।
জাওয়াদ ওর বোকা বোকা কথা শুনে মনে মনে হাসলো। কি বলে ও এসব!
আরওয়া ফ্লোরে শুয়ে পড়লো। আর তো কয়েকটা ঘন্টা, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে। এই ঘরটাতে জাওয়াদের কাঙ্ক্ষিত নারী আসবে। ওরা সুখেশান্তিতে বাস করবে। আরওয়ার কথা কারোই মনে থাকবেনা। এসব ভাবতে গিয়ে ও আরওয়ার কান্না বাড়ছে। উফ আজকে সব আবেগ উৎলে উঠছে কেন! অসহ্যকর।
জাওয়াদ খুব মনোযোগ দিয়ে আরওয়ার কান্না দেখছে। মেয়েরা কত অদ্ভুত হতে পারে! নিজের মনগড়া গল্পে নিজেই কেঁদেকেটে বুক ভাসায়। স্ট্রেইঞ্জ!
।
পরদিন সকালে আরওয়া চলে যাবে কি বিছানা ছেড়ে উঠার শক্তি ও পেলো না। তীব্র জ্বরে কুপোকাত হয়ে বিছানায় পড়ে রইলো। নাহিয়ান ওকে দেখে বললো, হাত কাটার ইচ্ছে হয়েছে যখন ভালো কিছু নিতে। কাঁচ নিতে গেলে কেন? ইনফেকশন হলে খবর আছে! রাগ দেখানোর ফর্মুলা পাপিয়া থেকে শিখবে, ও তোমাকে ভালোমতো শিখিয়ে দিবে কিভাবে নিজের ক্ষতি না করেও সবাইকে নাকানিচুবানি খাইয়ে রাগ মেটানো যায়।
রোকেয়া বেগম ওর কান মলে বললো, তোর সবসময় বাজে কথা। কি দেখলি অবস্থা কি বেশি খারাপ?
মেঝ আম্মু আমার কান না মলে তোমার ছেলের কান মলা দাও। সাথে দুটো চড়ও দিও। এই হাবলা রুমে থাকতেও এমন দূর্ঘটনা কিভাবে ঘটলো?
আরওয়া ধীর গলায় বলল, উনার দোষ নেই ভাইয়া। আমার ই মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছিলো। তাই এমন করেছি।
নাহিয়ান মুচকি হাসলো। বের হবার সময় জাওয়াদের ঘাড় ধরে টেনে ছাদে নিয়ে বলল,
তোর সমস্যা কি খুলে বল তো?
আমার কি সমস্যা?
তোর কি ধারণা আমরা সবাই ফিডার খাই? নাকি আন্ধা?
আমি সেসব ভাবতে যাবো কেন?
তাই তো ভাবছিস বোধহয়! তোদের কার্যকলাপ কারো চোখে পড়ছেনা ভাবছিস? দেখ জাওয়াদ বিয়েটা ছেলেখেলা নয়। আরওয়া এখন তোর দায়িত্ব। তুই এটা অস্বীকার করতে পারিস না। ওর ড্রেসিং তো তুই করেছিলি দেখেছিস কতোটা জখম হয়েছে? একটা মানুষ সজ্ঞানে নিজেকে এতো কষ্ট দিতে পারে?
হুট করে ও এমন করবে আমি কল্পনাই করিনি। ও অনেক অন্যরকম। আমার সাথে যায় না আসলে। কখন কিভাবে রিয়েক্ট করে বসে আমি বুঝতে পারি না।
তুই ওকে বোঝার চেষ্টা করেছিস? ও কি চায় কেন এমন করে অনুসন্ধান করেছিস? আমার তো মনে হয় তুই ই ওকে বাধ্য করছিস এমন সব স্টেপ নিতে।
আমি?
হ্যাঁ তুই। তোদের বিয়ে হয়ে মাস পেরুলো না।অথচ তোর হাবভাব সেই আগের মতোই। নির্লিপ্ত, নিরস! সদ্য বিবাহিত দম্পতি এমন হয়? একটা দিন তোদের একসাথে হাসতে দেখলাম না, কোথাও বেড়াতে যেতেও দেখলাম না। আমি তোদের চিটাগং যাওয়া কনফার্ম করলাম আর তুই সেটা ক্যানসেল করে দিলি। এসব লক্ষণ দেখলে আমি কেন যে কেউ বলে দিতে পারবে আরওয়া কেন এতো ডিসপেরেট হয়ে আছে।
জাওয়াদের নিরবতা দেখে নাহিয়ান বললো, তুই কি এখনো মেয়েদের ঘৃণা করিস? বিয়ের প্রতি বিদ্বেষ তোর এখনো আছে?
জাওয়াদ আকশের দিকে চেয়ে বলল, জোর করে বিয়ে করালেই মনোভাব পাল্টে যায় না। বরং ঘৃণার মাত্রা বাড়তে থাকে। এটা জোবায়ের সাহেবকে কে বোঝাবেন?
তুই ভুল ভাবনায় পড়ে আছিস ভাই। Exception can’t be example.কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে নিজের চিন্তাচেতনাকে প্রভাবিত করা মোটেও উচিত নয়।সবাই এক নয় এটা তোকে মানতেই হবে।
ভিন্ন কোথায়? বিয়ে মানেই একটা জাহান্নাম। সেই জাহান্নামে পুরুষ রা কেবল পুড়ে দগ্ধ হয়, ছাই হয়। এখনের মেয়েরা খুব ডেঞ্জারাস হয়। ওদের কার্যকলাপে জীবন দূর্বিষহ হয়ে উঠে। আমি এজন্য ই বিয়ে করতে চাই নি। বেশ তো ছিলাম একা। কেন অযথা আমার বিয়ে শাদী নিয়ে মাতলো সবাই?
আসল সুখের খোঁজ পাসনি বলে তোর মাথা থেকে এসব সরছেনা। তুই যাদের দেখে এই নেতিবাচক মনোভাব পোষা শুরু করেছিস তারা কিন্তু দিনশেষে একে অপরের সান্নিধ্যে সুখেই আছে। দূর থেকে সুখী মনে হলেই মানুষটা যেমন সুখী নাও হতে পারে। তেমনি দূর থেকে দেখতে দুঃখী হলেও অতো দুঃখ ও তাদের নাও থাকতে পারে। মোদ্দা কথা হলো কোনোকিছু ই বাহ্যিকভাবে বিচার করা ঠিক না। সংসার করতে গেলে অনেক কিছু ই ঘটে,কেউ ঘটা করে সুখের গল্প করে তো কেউ দুঃখের। অন্যের বলা গল্প শুনে মনে বিদ্বেষ পোষণ করা তো সমাধান নয়।সবার গল্পও এক নয়। আমি বলবো তুই এসব বাদ দিয়ে মন দিয়ে সংসার কর। সব ঠিক হয়ে যাবে। তারপরও মনস্থির না হলে ফ্যামিলি কাউন্সেলিং কর। সাইক্রিয়ার্স্টিস্ট দেখা।
জাওয়াদ দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘাড় নাড়লো।
চলবে,,,