#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৬
#আরশিয়া_জান্নাত
জহির সাহেব আপনমনে কথা বলতে বলতে বাগানে পানি দিচ্ছেন। উনার কথা শুনলে মনেই হবেনা তিনি সেখানে একা। আরওয়া সকালে হাঁটার উদ্দেশ্যে বের হয়ে শ্বশুরকে বকবক করতে দেখে এগিয়ে গেল।
গুড মর্নিং বাবা।
গুড মর্নিং, বাহ আমার বৌমা দেখি আর্লি রাইজার। ভেরি গুড হ্যাবিট!
আপনি কার সঙ্গে কথা বলছিলেন? কানে তো ফোন নেই,,
কানে ফোন লাগবে কেন? আমার সামনে শতশত প্রাণ বসে আছে, ওদের সাথে আলাপ করেই তো কূল পাচ্ছি না।
ওয়াও! আমি অবশ্য একটা আর্টিকেল পড়েছিলাম। গাছের সঙ্গে কথা বললে ওদের গ্রোথ ভালো হয়। আর মনও ভালো থাকে। আপনি সেটাই করছেন তাই না?
হ্যাঁ ঠিক ধরেছ। আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে হোক সেটা উদ্ভিদ কিংবা প্রাণী। সবকিছুই কোনো না কোনোভাবে আমাদের উপকারী বন্ধু। বন্ধুর প্রতি যত্নশীল তো হতেই হবে তাই না? আর কিছু না পারি হাসিমুখে দুটো কথা হলেও বলা উচিত!
বেশ সুন্দর চিন্তা।
এই গাছটা দেখো, দেখে কি মনে হচ্ছে?
আরওয়া ক্যাকটাসের দিকে তাকিয়ে বললো, কাঁটাযুক্ত গাছ?
অপ্রয়োজনীয়?
নাহ।
কেন না?
ক্যাকটাস খুব উপকারী গাছ। এটি বাতাসের কার্বন ডাইঅক্সাইড নিয়ে অক্সিজেন ত্যাগ করে।
ওটা তো সব গাছ ই করে, এর বিশেষত্ব কি?
আরওয়া উত্তর টা জেনেও বললো না। কৌতুহলী গলায় জিজ্ঞাসা করলো, আসলেই তো বিশেষত্ব কি?
জহির সাহেব বললেন, এটি স্ট্রেস কমায়, বাতাসকে পরিশোধন করে, সবচেয়ে মজার বিষয় এটি বিরূপ পরিবেশেও খুব দ্রুত অভিযোজিত হয়ে টিকে থাকতে পারে। এখান থেকে আমরা শিক্ষা পাই যেকোনো পরিস্থিতিতে শক্ত ভাবে টিকে থাকতে হবে। এই পৃথিবী সবসময় আমাদের অনুকূলে থাকবেনা।
আরওয়া মনোযোগী শ্রোতার মতো সবটা শুনে মাথা নাড়লো। জহির সাহেব তার মনোযোগ দেখে বেশ আনন্দিত হলেন। মেয়েটার গাছ নিয়ে আগ্রহ আছে বোঝাই যাচ্ছে!
।
মা তোমার সাথে আমার অনেক জরুরী কথা আছে।
রোকেয়া কাপড় ভাঁজ করতে করতে বললেন, হুম বল কি বলবি?
জাওয়াদ একবার বাবার দিকে তাকালো। একটু দূরেই জহির সাহেব চেয়ারে বসে পেপার পড়ছেন। সে মনের জোর এনে বললো, এই বিয়ে আমি মানতে পারছি না মা। আরওয়ার সাথে আমার এডজাস্ট হচ্ছে না। আমি তাকে ডিভোর্স দিতে চাই…
বিস্ময়ে রোকেয়ার হাত থেকে শাড়ি পড়ে গেল। সে দুইহাত কানে চেপে চিৎকার করে বললো, নেহিইইইইইইই ইয়ে নেহি হো সাকতা….
তার চিৎকারে জাওয়াদের কানের পর্দা ফেটে গেল যেন। পরক্ষণেই সে একদম স্বাভাবিক গলায় বললো, তুই কি ভেবেছিলি আমি এরকম রিয়েকশন দিবো? তোদের বিয়ে হলো সপ্তাহও পেরোলো না, এখনি হাল ছেড়ে এই কথা বলছিস? তোর বাবার সাথে আমি ২৮ বছর ধরে সংসার করে এডজাস্ট করতে পারলাম না, আর তুই দুইদিনে করে ফেলবি ভাবলি কিভাবে?
কিন্তু মা ও আমার চেয়ে আলাদা। ওর কার্যকলাপ আমার ভালো লাগেনা। আমার সাথে সারাক্ষণ ঝগড়া করে।
একই মেন্টালিটির হলে তো তোদের সংসার জমবেনা। পজিটিভ নেগেটিভ কে আকর্ষণ করবে এটাই তো নিয়ম। আর ঝগড়া এ বাড়িতে করেনা কে? তোর দাদী কে দেখ, সাবা নাহিয়ান কে দেখ। এখন এসব অহেতুক কথা বাদ দিয়ে যা তো। আমার অনেক কাজ পড়ে আছে।
জহির সাহেব বিরবির করে বললেন, ১নম্বর ঝগড়ুটের নামটাই যে বাদ দিলে!
জাওয়াদ কান ঝাড়তে ঝাড়তে বাবার সামনে গিয়ে বসলো। উহু কানটা গেল, এতো জোরে চিৎকার করে কেউ? জহির সাহেব পেপারের উপর উঁকি দিয়ে বললেন, কিরে এবারও পাত্তা পাস নাই?
জাওয়াদ ঘাড় নাড়িয়ে না বললো। জহির সাহেব হেসে বললেন, ওটা আমিও এই ২৮ বছরে পাই নাই। ব্যাপার না!
বলেই আবার পেপারের পিছে মুখ ঢাকলেন। জাওয়াদ কাটকাট গলায় বলল, বাবা তুমি উল্টা পেপার পড়ছো কেন?
জহির সাহেব মাথা বের করে ফের বললেন, সোজাভাবে পড়া শেষ, তোর মায়ের উটকো কথা শোনার চেয়ে উল্টো পেপার পড়ার অনুশীলন করা বেশ ভালো। আমার মাঝেমধ্যে কী মনে হয় জানিস? নারীদের ব্রেইনে মিরর এফেক্ট আছে। যা বলবি বা বুঝাবি তার উল্টোটা তাদের মস্তিষ্কে যায়। যদি বলিস ভালো বুঝবে মন্দ।
মন্দ বললে ভালো বুঝবে?
নাহ। মন্দ বললে আরো ডাবল মন্দ বুঝবে।
তাহলে তো মিরর এফেক্ট ও যুক্তিযুক্ত না। বলা উচিত ছিল ওদের মস্তিষ্কে পজিটিভ সেন্সরটাই নাই। সব নেগেটিভ…
পয়েন্ট টু বি নোটেড এটা শুধুমাত্র স্বামীর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য! তাও তোর ভাগ্য ভালো তোর বউ হিন্দি সিরিয়াল দেখে না। নয়তো আমার মতো কনফিউজড হয়ে যেতি এ নায়িকা নাকি খলনায়িকা!
বাবা, তুমি অন্তত বোঝার চেষ্টা করো। আমার পক্ষে এই বিয়ে মানা কঠিন হয়ে যাচ্ছে!
বাবারে, বিয়ে জিনিস টাই এমন। মেনে নেওয়া কঠিন বৈ কিছু না।
জাওয়াদ নিরাশ হয়ে বাবা-মায়ের রুম থেকে বেরিয়ে গেল। রোকেয়া সাথে সাথে জহির সাহেবের কাছে এসে বললেন, বাপ বেটা কি ফিসফিস করছিলে?
সব তো কানখাড়া করে শুনেছই, নতুন করে কি বলবো?
ছেলেটা সেই শুরু থেকেই বিয়েটা করতে চায়নি। যখন না করার ছিল তখন না বলার সাহস পায়নি, এখন আর কপাল চাপড়ে কি হবে?
এটাই তো আমাদের বংশের ছেলেদের দূর্বলতা, কর্তার সামনে কেউই না করতে পারিনি। নয়তো এতো বদনসীব হয়?
এই কি বললে তুমি?
আমি আবার কি বললাম?
এই তুমি পেপার উল্টে রেখেছ কেন? এতোক্ষণ পেপার পড়ার ভান ধরেছিলে?
তুমি আশেপাশে থাকলে কোনোকিছুই মনোযোগ দিয়ে করতে পারি বলো? মনতো ঘুরেফিরে তোমার দিকেই সরে যায়…
রোকেয়া লাজুকতা লুকিয়ে বললেন, সব ঢং তোমার। বুঝি না ভাবো?
হাহ সত্যি কথার ভাত নাই! তাই তো আমি দুইবেলা রুটি খাই..
।
আরওয়া গালে হাত দিয়ে ভাবতে লাগলো, জাওয়াদের সমস্যা টা কি। সে কেন আমাকে মেনে নিতে নারাজ। তার কি গফ আছে? এমন খরুচ লোকের গফ থাকবে? অবশ্য বলা যায় না, হয়তো আমার সামনেই এমন ভাবে আছে অন্যদের সামনে ভিন্ন। দেখা গেল তার গফের কাছে সে পৃথিবীর সবচেয়ে রোমান্টিক এবং কেয়ারিং প্রেমিক। নাহ এই লোকের মিস্ট্রি এমনি এমনি সলভ হবেনা। কোনো একটা উপায় বের করতেই হবে। কিন্তু কি করা যায়?
জাওয়াদের এই কয়দিনের রুটিন পর্যবেক্ষণ করে যা বুঝলো সে খুবই বোরিং। সকালে ঘুম থেকে উঠে কিছুক্ষণ এক্সারসাইজ করে। তারপর নাস্তা খেয়ে অফিসে যায়, অফিস থেকে ফিরে এক মগ কফি খাবে, সাথে কিছু স্ন্যাক্স। তারপর ল্যাপটপ নিয়ে বসবে, একদম ডিনারের আগ পর্যন্ত ল্যাপটপেই ডুবে থাকবে। এমন রোবোটিক লাইফ দেখতেও আরওয়ার অসহনীয় লাগে। বাসায় এতো মানুষ, সবাই কত খোশগল্প করে। নাহিয়ান ভাইয়ার মতো নিউরো স্পাইন সার্জন পর্যন্ত কত প্রাণোচ্ছল থাকে। যখনই সময় পায় পরিবারের সবার সাথে আড্ডা দেয়। তাকে দেখলে বোঝাই যায়না দীর্ঘসময় ওটি করে ক্লান্ত হয়ে ফিরে এসেছেন। এতোটাই প্রাণবন্ত মানুষ তিনি। এই ১৫দিনে জাওয়াদকে একদিনো সবার সঙ্গে বসে কথা বলতে দেখেনি। খাওয়ার টেবিলে সে উপস্থিত আছে কি নেই এটাও বোঝা যায় না। এতোটাই নির্লিপ্ত সে। আরওয়ার মেজাজ খারাপ লাগে। তার জীবনে এমন রোবটই আসার ছিল? এই বিয়েটার কি আদৌ ভবিষ্যত আছে? এভাবে আর কতদিন চলবে?
হ্যালো ফারাজ?
হ্যাঁ তানভির বল।
কি খবর তোর?
এই তো চলে। তোর?
ভালোই। তুই আজ সন্ধ্যায় ফ্রি আছিস? থাকলে ধানমন্ডি আয় আড্ডা দেই?
জাওয়াদ ঘড়ির দিকে চেয়ে বললো, আচ্ছা।
ক্যাফেতে বসে তানভির বললো, ভাবি কেমন আছে?
আছে ভালোই। তোর কি অবস্থা হঠাৎ আসতে বললি?
এমনি বহুদিন কথা হয়না ভাবলাম বসি কোথাও।
নিপা ভাবি বাপের বাড়ি গেছে নাকি?
কিভাবে বুঝলি?
না বোঝার কি আছে, বিয়ের পর তুই আর আড্ডায় আসিস না এ তো সবার জানা।
তানভির ম্লান হেসে বললো, আমার সঙ্গে এখন কেউই কনট্যাক্ট রাখেনা। অবশ্য এর জন্য আমিই দায়ী। বন্ধুত্ব টিকিয়ে রাখতে হলে টাচে থাকতে হয়। দূরত্ব বাড়লে গুরুত্ব কমে যায়।
দূরত্ব ম্যাটার না। তুই তো বলতে গেলে একদম বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছিস।
কি করবো বল? নিপা পছন্দ করেনা এসব। ওর জন্য সেপারেট বাসা নিলাম, যা যা চেয়েছে তাই তাই করেছি। তবুও ওর মন পাই না। বিয়ের ২ বছর পর ছেলে হলো, ছেলেটা এখন হাঁটতে শিখেছে, একটু চোখের আড়াল হলেই দূর্ঘটনা ঘটে যায়। কতবার যে পড়ে ব্যথা পাইছে। একাহাতে বাচ্চা সামলানো যায়? আমি যতক্ষণ থাকি ওকে সঙ্গ দেই। অথচ আমার বাবা-মা একা পড়ে আছেন, উনারা থাকলে এতো পেরেশান হতে হতো না।
তো আন্টিকে বল তোদের ওখানে চলে আসতে?
নিপা আসতে দিবে ভাবছিস? কখনোই না।
জাওয়াদ হেসে বললো, তুই চাইলে সব হতো। প্রশ্রয় দিয়েছিস বলেই এই অবস্থা।
তানভির পেছনে হেলান দিয়ে উপরে তাকিয়ে ঠোঁট গোল করে নিঃশ্বাস ফেলল। কিছুক্ষণ নিরব থেকে বলল, আমার মাঝেমধ্যে মনে হয় বিয়ে করাই উচিত হয়নি। আগেই বিন্দাস ছিলাম। কেন যে এই সংসার নামক জেলখানায় ঢুকতে গেলাম! এখনের যুগের মেয়েরা খুব সাংঘাতিক বুঝলি। এমনিতে ফরজ কিছু ই মানবেনা, কিন্তু হাতিয়ার হিসেবে কিছু হাদিস মুখস্থ করে রাখবে। বলবে শ্বশুড়-শাশুড়ির খিদমত করতে ওরা বাধ্য না। এমন সব হাদিস শুনায় কিছুই আর বলতে পারি না। যদি বলি পর্দা করাও তো ফরজ, স্বামীর সব কথা শোনা ও তো আবশ্যক তখন আবার তেতে বলবে, My life my choice এখন কি আগের যামানা আছে নাকি?
তুই ডিপ্রেসড হয়ে গেছিস। এতো মন খারাপ করিস না চিল কর।
আর চিল! সব সুখশান্তি চিলেই ছোঁ মেরে নিয়ে গেছে।
জাওয়াদ আর কিছু বললোনা। চুপচাপ কফিতে চুমুক দিলো আর ভাবতে লাগলো এখনের মেয়েরা আসলেই অনেক খারাপ। ছেলেদের জীবন তেজপাতা করতে ওদের ২মিনিটও লাগেনা।
চলবে…
#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৭
#আরশিয়া_জান্নাত
নির্জন জায়গায় গাড়ি থামিয়ে জাওয়াদ গাড়ির উপর উঠে শুয়ে পড়লো। আকাশ ভরা তারা ঝলমল করছে, চাঁদ নেই বলে তারাদের আধিপত্য দৃশ্যমান। জাওয়াদ এক ধ্যানে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। আকাশ ওর খুব পছন্দ। কি সুন্দর লক্ষকোটি নক্ষত্ররাজি বুকে রেখে উদারতার উপমা হয়ে আছে! অথচ এই আকাশের নীচে বাস করা মানুষের মন কত নীচ কত ছোট! হিংসা বিদ্বেষ, স্বার্থপরতা রন্ধ্রে রন্ধ্রে মিশে আছে। ধনসম্পদের পাহাড় গড়েও কেউ কেউ তুষ্ট হতে পারেনা। গুড তো বেটার চাই, বেটার তো বেস্ট চাই বেস্ট তো এক্সিলেন্ট চাই। তবুও শান্তি হয়না তুষ্টি মিলেনা।
বাসায় ফিরতেই জাওয়াদ দেখে আরওয়া সামনের দিকে ঝুঁকে কান্না করছে, ওর কান্নার তোপে শরীর টা কেঁপে কেঁপে উঠছে। পেছন থেকে এমন দৃশ্য দেখে জাওয়াদের মন কিছুটা খারাপ হলো। মেয়েটা হয়তো এই অদ্ভুত সম্পর্কে জড়িয়ে খুব কষ্ট পাচ্ছে। সবার সামনে স্বাভাবিক দেখালেও একা থাকলেই কেঁদে ভাসায়। আজ অসময়ে ফেরায় সে ব্যাপারটা জানতে পেরেছে। কিছু টা আত্মগ্লানিতেই ভুগলো জাওয়াদ।
জাওয়াদ ধীর পায়ে আরওয়ার পেছনে খানিকটা দূরত্ব রেখে বসলো। সান্ত্বনার স্বরে বলল, আমি আসলে কি বলবো বুঝতে পারছি না। আমি লইয়ারের সাথে কথা বলেছি, বিয়ের বয়সটা খুব কম তো। তাই আইনি কাজে একটু অপেক্ষা করতে হবে। আপনি চিন্তা করবেন না, আমি নিজ দায়িত্বে আপনার বিয়ের ব্যবস্থা করবো। আপনার কোনো সমস্যা হবেনা।
আরওয়ার কান্না আরো বাড়লো। জাওয়াদ মাথা নীচু করে বসে রইলো। তখন হঠাৎ আরওয়া পিছনে শুয়ে পড়লো। জাওয়াদ ভয়ে দ্রুত উঠে সরতেই দেখে আরওয়া বিছানায় গড়াগড়ি খেয়ে হাসছে, তার কানে ইয়ারফোন আর হাতে ফোন। জাওয়াদ বিস্মিত চোখে তাকিয়ে রইলো। তার মানে এতোক্ষণ ও কাঁদছিল না হাসছিল? হাসবার সময় কেউ এমন কাঁপে আর গুনগুন শব্দ করে? নাকি একা একা হাসছিল বলে শব্দ টা কান্নার মতো শোনাচ্ছিল? অথচ সে কি না কি ভেবে এতোক্ষণ আপসেট ফীল করছিল! সে আসলেই বলদ।
পাশ ফিরে জাওয়াদকে দেখে আরওয়া
কান থেকে ইয়ারফোন সরিয়ে কোনোমতে হাসি থামিয়ে বললো, আপনি আজকে এই সময়ে হঠাৎ? কখন এলেন?
জাওয়াদ টাইয়ের নট খুলতে লাগলো মনে মনে বলল, ভাগ্য ভালো আরওয়া কিছু টের পায়নি। নয়তো আরেক দফা হেহে করতো।
আরওয়া ফোন রেখে টেবিলে থেকে পানি এগিয়ে দিলো। জাওয়াদ পানি পান করে বেডের একপাশে পেছনে বালিশ রেখে হেলান দিয়ে বসলো। আরওয়া কাভার্ড থেকে টিশার্ট বের করে বেডের উপর রেখে বললো, আজ কি বেশি চাপ ছিল অফিসে? আপনাকে খুব টায়ার্ড দেখাচ্ছে।
নাহ আমি ঠিক আছি।
আরওয়া কফি মেকার অন করে চেয়ারে বসলো। জাওয়াদ চোখ বন্ধ করে বললো, আরওয়া আপনি এখানে হ্যাপি আছেন? আই মিন এমন এবনরমাল রিলেশনশিপ কন্টিনিউ করতে ভালো তো লাগার কথা না।
ভালো লাগার কথা না এটা ঠিক। তবে এন্টারটেইনমেন্ট হচ্ছে।
কিভাবে?
আপনার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্য খুব মজার মানুষ। এদের একেকজনের কীর্তিকলাপ একেক রকম। এই বৈচিত্র্যতা দেখতে ভালো লাগছে।
ওহ।
দাদাসাহেব লোক পাঠিয়ে আমার বই খাতা আনালেন। উনি বললেন পড়াশোনা কন্টিনিউ করতে। আপনি কি বলেন?
অবশ্যই করবেন, করবেন না কেন? একটা সাময়িক সম্পর্কের জন্য নিজের পড়াশোনার বা ক্যারিয়ার ক্ষতিগ্রস্ত করা ঠিক হবেনা।
আরওয়া হাসলো। ওর হাসি দেখে জাওয়াদ বললো, কি ব্যাপার হাসছেন কেন? আমি কি হাসির কথা বলেছি?
হাসির মতোই ঘটনা কিন্তু। দেখুন আপনাকে আমি কি দারুন অফার দিয়েছিলাম। আমাকে সলিড রিজন দেখালেই কিন্তু আমি চলে যেতাম। এই বিয়েটা রাখতাম না। কিন্তু আপনি আমায় ঠিকঠাক উত্তর না দিয়ে একপ্রকার রেখেই দিয়েছেন। যে পরোক্ষভাবে আটকে রেখে মুখে বলছে এটা সাময়িক সম্পর্ক তখন হাসি আসবে না?
জাওয়াদ কপালের মাঝে দু’আঙুল চেপে ঘষলো। প্রচুর মাথা ব্যথা করছে তার। এই মুহূর্তে অযথা তর্ক করার ইচ্ছা নেই তার।
আরওয়া মগে কফি ঢেলে ওকে দিয়ে বললো, মাথা ধরেছে? আমি ম্যাসাজ করে দেই?
নো থ্যাঙ্কস।
নিষেধাজ্ঞা তোয়াক্কা না করে ড্রয়ার থেকে ভিক্স নিয়ে আরওয়া জাওয়াদের কপালে লাগিয়ে ম্যাসাজ করে দিলো। জাওয়াদ চোখ বুজে রইলো। আরওয়া মন দিয়ে চেয়ে দেখলো তার বরের মুখখানি। প্রশস্ত কপালে মাঝারি গড়নের ভ্রু জোড়া, চোখগুলো বেশি বড় না আবার ছোটও না চেহারার সঙ্গে মানানসই। খাড়া নাক আর ছেঁটে রাখা চাপ দাঁড়িতে দেখতে তাকে ভীষণ ম্যানলি লাগে। তার উপর গাঁয়ের রং তামাটে হওয়ায় তাকে নায়কের চেয়ে কোনো অংশে কম মনে হয় না।
আরওয়া তার চুলে হাত গলিয়ে হালকা টেনে দিলো। জাওয়াদের নিরবতা দেখে বোঝা যাচ্ছে তার আরামই লাগছে। আরওয়া মনে মনে বলল, কেন যে আপনি এই বিয়েটাকে কঠিন বানাচ্ছেন বুঝি না। নয়তো আরওয়া দেখিয়ে দিতো বরকে যত্ন করা কাকে বলে কত প্রকার ও কি কি! নিজের কত বড় লস করেছেন এখনো টের পাচ্ছেন না, আহারে!
।
ঘুম থেকে উঠে জাওয়াদ কিছু টা অবাক হলো। কখন যে দু’চোখের পাতা এক হয়ে গেছে বলতেই পারে না। ঝগড়ুটে মেয়েটার হাতে জাদু আছে বলতেই হয়। শোয়া থেকে উঠে ওয়াশরুমে গিয়ে ফ্রেশ হলো। মাঝেমধ্যে অসময়ে ঘুমালে শরীর ও মন দুটাই ফুরফুরে লাগে। জাওয়াদ রুম থেকে বেরিয়ে চারদিকে তাকিলো। না আশেপাশে আরওয়াকে দেখা যাচ্ছে না। বসার ঘর থেকে হাসাহাসির শব্দ আসছে, হয়তো আরওয়া ওখানেই আছে। তাকে দেখে রোকেয়া বললেন,কিরে তোর ঘুম ভাঙলো? রাহেলা ওর জন্য নুডলসটা গরম করে আন তো।
রাহেলা ওভেনে নুডলস গরম করে জাওয়াদকে দিলো। জাওয়াদ বাটিটা হাতে নিতেই সবাই কথা বন্ধ করে ওর দিকে তাকালো। কাঁটা চামচে নুডলস পেঁচিয়ে মুখে তুলতেই কুহু বললো, মজা?
জাওয়াদ ভ্রু কুঁচকে বললো, মজা হবেনা কেন?
এভাবে না, ভালো মতো বল।
তুই করেছিস নাকি?
বল না..
হ্যাঁ মজাই।
সব ঠিকঠাক?
হুম।
নতুন ভাবি এবার বিশ্বাস হলো তো?
পাপিয়া বললো, এতোক্ষণ আমরা সবাই বললাম অনেক মজা হয়েছে, কিন্তু সে মানতেই চায় না।
সাবা বললো, তোরা এখন বুঝবি না। বিয়ের পর হাজবেন্ড ছাড়া দুনিয়ার সবাই বললেও কাজ দেয় না।
রোকেয়া বললো, তোরা থাম তো, আমার বৌমাকে লজ্জায় ফেলে দিচ্ছিস। দেখ ওর মুখ কেমন লাল হয়ে গেছে।
জাওয়াদ আড়চোখে আরওয়ার দিকে তাকালো। আরওয়া প্রসঙ্গ পাল্টাতে বললো, মা তুমি না বলছিলে তোমাদের বিয়ের ছবি দেখাবে। চলো না দেখি।
বলেই জোর করে রোকায়াকে নিয়ে আরওয়া চলে গেল। কুহু, সাবা, পাপিয়া হিহি করে হাসতে লাগলো।
জাওয়াদ থমথমে গলায় বললো, এতো হাসার কি আছে বুঝি না। সব কথায় হি হি করা লাগে?
কুহু বলল, আমরা ক্লোজাপ দিয়ে দাঁত মাজি তো, তাই হেহে করে টুথপেস্টের বিজ্ঞাপন প্রচার করছি।
পাপিয়া বলল, একদম ঠিক। ভাইয়া তোমার হিংসে হয় আমাদের মতো হাসতে পারো না বলে?
এটা নিয়ে আবার হিংসা? তোদের থট দেখলে হাসি পায়।
বলেই জাওয়াদ নুডলসের বাটি নিয়ে রুমে চলে গেল।
কুহু বললো, এই জায়গায় নাহিয়ান ভাইয়া হলে কতবার যে ভাবির হাতে চুমু খেয়ে বলতো ও বউ তুমি সেরা রাঁধুনি! আর জাওয়াদ ভাইকে দেখ কিছু ই বললো না। ভেজিটেবল একটা!
সাবা বললো, সবাই এক হয় না কুহু, তুলনা করো না। একেকজন একেকরকম হয়। ভাইয়া আমাদের সামনে প্রকাশ করতে পছন্দ করছে না হয়তো।
পাপিয়া বললো, আমি নিশ্চিত ও নতুন ভাবির সামনেও কিছু বলবে না। আমার তো মনে হয় ও কথা বলার সময় মেপে মেপে বলে। বেশি বললে শেষ হয়ে যায় যদি! হেহেহে
হেহেহে একদম ঠিক।
।
জোবায়ের সাহেব রকিং চেয়ারে চোখ বন্ধ করে বসে কি যেন ভাবছেন। সালমা বেগম পান সাজিয়ে তার দিকে এগিয়ে বললেন, কি হইছে কি ভাবতেছেন এতো?
জোবায়ের সাহেব পান গালে তুলে বললেন, নওয়াবিকে কেমন দেখছো?
ভালোই তো। হাসিখুশি মেয়ে সবার সাথে তাড়াতাড়ি মিশে গেছে।
তোমার কি মনে হচ্ছে আমি ভুল চয়েজ করছি?
সালমা হেসে বললো, আপনার চয়েজ ভুল এই কথা আমরা কেউ ভাবি না। অবশ্যই আপনি ভালো টা আনেন, তবে আপনার পদ্ধতি টা ভুল।
কিছু মনে করবেন না আপনার উচিত ছিল ওর মতামত নেওয়া। ও কি বলতে চায় তা অন্তত শোনা। ওর পছন্দের কেউ আছে কি না যাচাই করা।
তুমি বলতে চাইছো ও এই বিয়েতে সুখি না?
সুখি কি সুখি না ঐটা সময়ই বলে দিবে। ও তো চুপচাপ স্বভাবের মনের খবর বোঝা যায় না। তবে..
তবে?
আমি হয়তো বেশি ভাবতেসি, বাদ দেন।
না তুমি কি ভাবতেছ বলো আমাকে?
নয়া মিয়া-বিবির লক্ষণ তো দেখতে পাই না। কেমন জানি খাপছাড়া খাপছাড়া লাগে।
জোবায়ের সাহেব ফের মৌনতা অবলম্বন করলেন।
সকালে অফিস যাওয়ার আগে জোবায়ের সাহেব বললেন, কি ব্যাপার তুমি একা যাচ্ছ যে?
জাওয়াদ বললো, আমার সঙ্গে আর কে যাবে?
কেন আজ না আয়েশার ক্লাসে যাওয়ার কথা?
জাওয়াদ চুপ করে রইলো।
এখন থেকে রোজ তুমি আয়েশাকে ভার্সিটিতে নামিয়ে অফিস যাবে। সবকিছু মুখে বলে দিতে হয় কেন? স্ত্রীর প্রতি দায়িত্ব কর্তব্য কি লাইন বাই লাইন বলে দিতে হবে?
স্যরি দাদাসাহেব। আমার আরো কেয়ারফুল হওয়া উচিত ছিল।
আজকে গুগলে সার্চ দিয়ে দেখবে How to be a good husband.
বলেই জোবায়ের সাহেব মুখ ভার করে চলে গেলেন।
চলবে,,,