#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৫১
#আরশিয়া_জান্নাত
“বাচ্চাটা কার? কোত্থেকে এনেছ ওকে?”
“দাদাসাহেব, বাচ্চাটা যার ই হোক এখন থেকে সে আমাদের পরিচয়েই বড় হবে। আমি ওকে এডপ্ট করেছি।”
জোবায়ের সাহেব চেয়ারে বসে বললেন, “তোমার উত্তরাধিকার চাই? তবে ২য় বিয়ে করছো না কেন? আল্লাহর রহমতে তোমার সামর্থ্য আছে ২ স্ত্রীর ভরণপোষণ চালানোর। বাইরের কারো রক্ত না এনে নিজের অংশ পৃথিবীতে আনা অধিক শ্রেয়।”
“আমার পক্ষে সেটা করা সম্ভব না দাদাসাহেব। আমি সাবাকে ছাড়া কাউকে স্ত্রী বানাতে পারবো না।”
“সাবাকে রাখতে চাইছো, রাখো। আমি মানা করবো না। তবে আমার বাড়িতে বাইরের কারো সন্তান থাকবে এটা আমি মেনে নিবো না। এটা কোনো বিড়াল ছানা না যে শখের বশে তুলে এনেছি, লালন পালন করে বড় করবো। এটা মানুষ! মানুষ বড় বেঈমান জাতি। এদের যতোই আদর যত্নে বড় করো না কেন, পর কোনোদিন আপন হয় না।”
“একটা কথা কী জানেন দাদাসাহেব, আমাদের আপনরাও সবসময় আপনের মতো আচারণ করে না। খেয়াল করলে দেখবেন আপনভাইয়ের হাতে ভাই খু*ন হয়, সম্পত্তির জন্য সন্তান পিতাকে হ*ত্যা করে এমন নজিরও তো কম নেই। তাই বলে কী মানুষ সন্তানদের ভালোবাসা কমিয়ে দেয়? নাকি জন্মের পরপরই মে*রে ফেলে?”
“Exeption can’t be example!”
“পর আপন হয় না এটা পুরোপুরি সঠিক না। আসলে আমরা আপনের বেলা চোখে একটা পট্টি বেঁধে রাখি। তাই পিঠে ছোঁড়া ঠুকলেও বলি আপন ই তো! অথচ এই একই কাজ যদি পর কেউ করে তাকে ছেড়ে দেওয়ার কথা কল্পনায় ও আনি না। আমি এই শিশুটিকে এনেছি আমি ওকে আদর যত্ন করে বড় করে তুলবো। অবশ্যই প্রতিদান আশা করা ছাড়া।”
জোবায়ের সাহেবে হেসে বললেন,”আবেগের বশে ভুল ভাবছো। মানুষ যতোই বলুক পার্থক্য করবে না, কিন্তু পার্থক্য চলেই আসে। আজ নাহয় কাল সাবা যদি কখনো মা হয় তখন এই শিশুকে উটকো ঝামেলাই মনে হবে! কিংবা তোমার ভাইবোনের সন্তানদের তুলনায় ওকে কম কাছের মনে হবে। এই বিভেদ কী ও টের পাবে না ভাবছো? আমি এমন অনেক ঘটনার সাক্ষী হয়েছি। বেশি দূর কেন তোমার সাবিনা ফুফুকেই জিজ্ঞেস করো গিয়ে তার ভাসুর যে পালক ছেলে এনেছিল তার কী হাল এখন।”
নাহিয়ানকে নিরব দেখে জোবায়ের সাহেব বললেন, “তোমাদের আশা ভরসা সম্পূর্ণ শেষ হয়ে যায়নি। এসব করে অন্যদের নিশ্চিত হতে দিচ্ছ কেন সাবা কোনোদিন মা হতে পারবেনা?”
“দাদাসাহেব বাচ্চাটার মা ওকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছেন। ওর বাবাকে খবর দেওয়ার পর বলেছে ওকে কোনো এতিমখানায় দিয়ে দিতে। এমন ফুটফুটে নিষ্পাপ শিশুকে আমরা প্রতিপালন করলে কী খুব ক্ষতি হবে? এমনো তো হতে পারে ও আমাদের জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে।”
জোবায়ের সাহেব বুঝলেন নাহিয়ান কে বলে কাজ হবেনা। তাই তিনি হাল ছেড়ে বললেন,”তোমার যা ইচ্ছে তাই করো। আমার আর কিছু বলার নেই। তবে একটা কথা মাথায় রেখো আমি আমার নাতনির বিয়েতে কোনো হাঙ্গামা চাই না।”
নাহিয়ান তার ঘর থেকে বেরিয়ে নিজের ঘরের দিকে এগোলো। সে ভালো করেই জানে দাদাসাহেব মনের দিক থেকে নরম। কিন্তু ভেজাল বাধাবে ওর বাবা!
“নাহিয়ান এই মাথা নিয়ে কেমনে যে এতো বড় ডাক্তার হইছে বুঝি না। বলদ পোলা কোনাই তুই ওগ্গা সুন্দর চাই বয়তালি বিয়া করি পোলামাইয়ার বাপ হবি , হেতে গেছে কোন বেজন্মারে ঘরে তুইলতো। হাগল নি কোনো?”
“ইগ্গো চাচী বেশি মাতিয়েন না, ফরে আর বিয়া খাওন লাইগদো নো, হিচা দি ঠিডি বাইর করি দিবো। হেতে যে বৌ পাগল। বৌয়ের লাই মানুষ খু*ন কইরতেও সময় নিতোনো চাইয়েন”
“মাগ্গো মা ঠিকই কইছোস হুক্কি! আর তুন তো লাগে হেতেরে তাবিজ তুমার করি বচকাই রাইখছে। এন্নে এন্নে বাইজ্জা বেডির জামাই এতো বশে থায়ে?”
সাবা কথাগুলো শুনে স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে গেল। মানুষ কারো পেছনে কীভাবে এতো জঘন্য সমালোচনা করতে পারে! সাবার চোখ ভরে আসে নোনাজলে, এইটুকু শুনেই তার সহ্য হচ্ছেনা, এই ভরা বাড়িতে আরো কতজন আছে যারা ওর পেছনে এমন কত আজেবাজে কথা বলছে। ঐসব শুনলে ও আর বাঁচতে পারবে?
সাবা দ্রুত নিজের ঘরে চলে যায়। বাচ্চাটাকে বুকে চেপে অঝোরে কাঁদতে থাকে। “তবে কী ওকে দত্তক নেওয়া ওদের ভুল সিদ্ধান্ত ছিল?”
নূর মোহাম্মদ রাগান্বিত গলায় বললেন,”তুমি না বলেছিলে তোমার ছেলের উত্তরাধিকার চাই না? ওর বৌ নিয়েই ও খুশি? এই তার নমুনা? কার না কার বাচ্চাকে ঘরে তুলে এনেছে! বাপ হওয়ার এতো শখ যখন ওর আমার কথায় ক্ষেপছিল কেন?”
কোহিনুর ভীত গলায় বললেন, “আমি শুনেছি এমন পালক বাচ্চা আনলে হিংসা হিংসিতে বাচ্চা চলে আসে। আমাদের বাড়ির এক……”
“খবরদার বলতেছি আমাকে উল্টাপাল্টা কাহিনী শোনাতে আসবা না। আমার তো মনে হয় তুমিই এসব আজগুবি কথা শুনিয়ে শুনিয়ে ছেলেটার কান ভরেছ।”
পাপিয়ার হলুদের অনুষ্ঠান বলতে গেলে খুবই অশান্তির মধ্য দিয়েই হলো।
।
জাওয়াদ কফি মগ হাতে লনে আসতে দেখে জোবায়ের সাহেব চুপচাপ বসে আছেন। এই বাগানে তিনি সচরাচর আসেন না। এখানে আসলেই তার মনে পড়ে মেঝ ছেলেটা দারুণ মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও বুয়েটে না পড়ে কৃষিবিজ্ঞানে এডমিশন নিয়েছিল। সেই দিনটার তিক্ততা তিনি এতো বছরেও ভুলতে পারেন নি। তার ৫সন্তানের মধ্যে ২টা তার কলিজায় আঘাত করেছে। এক তার বড় মেয়ে আরেক মেঝ ছেলে। অতীত জীবনের স্মৃতিচারণে কেন জানি এই দুই ঘটনাই শেষ পর্যন্ত চলে আসেই। তিনি চাইলেও এই ব্যতিত সমাপ্তি ঘটাতে পারেন না।
জাওয়াদ নিঃশব্দে দাদার পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। জোবায়ের সাহেব ওর দিকে এক পলক চেয়ে বললো, “তোমরা ফ্যামিলি প্ল্যানিং করছো না কেন? নাকি ঠিক করে রেখেছে সবাই মিলে বাইরে থেকে দত্তক এনে এনে আমার বংশ বিলুপ্ত করবে?”
জাওয়াদ বেঞ্চিতে বসে বললো,”যদি বিলুপ্ত হবার থাকে তবে শত শত উৎপাদন করেও লাভ হবে না। যা হবার তা হবেই…”
জোবায়ের সাহেব বিস্মিত দৃষ্টিতে জাওয়াদের দিকে তাকালেন। জাওয়াদ তাকে এরকম কিছু বলতে পারে এ যেন তার কল্পনাতীত! জাওয়াদ কফিতে চুমুক দিয়ে বলল,”একটা ছোট্ট প্রাণ, যে এখনো পৃথিবীর হিসাব-নিকাশ বোঝেনা, ওর আচার ব্যবহার কেমন হবে, ও কী ভালো হবে নাকি খারাপ হবে সেটা পর্যন্ত আমরা কেউ জানি না। অথচ আমরা কী সুন্দর হিসাব করে ফেলেছি ও পরের সন্তান মানেই ও খারাপ হবে সিওর! ওর জাত রক্ত নষ্ট এটাও নিশ্চিত। আসলেই কী ব্যাপারটা এমন দাদাসাহেব?”
জোবায়ের সাহেব অপ্রস্তুত গলায় বললেন,”আমি কখন বলেছি ওর জাত রক্ত নষ্ট! ”
“আমি তো বলিনি আপনি বলেছেন, আপনি বলেছেন নাকি?”
“নাহ! আমি কেন এসব অহেতুক কথা বলতে যাবো। আমি বলেছি ওর যা ইচ্ছে হয় করুক। আমার কী?”
“এটা আপনার ৩য় আফসোস হবেনা তো?”
জোবায়ের সাহেব গলা ঠিক করে বললেন, “এ জীবনে আমার কোনো আফসোস নেই। আল্লাহ আমাকে অনেক দিয়েছেন আলহামদুলিল্লাহ।সেসবের শোকর আদায় করেই তো কূল পাই না আফসোস করবো কখন!
“আপনার উপর আমার অনেক রাগ ছিল সেটা আপনার অজানা না। তবে এখন আমি আপনার নিকট কৃতজ্ঞ। থ্যাংক ইউ সো মাচ দাদাসাহেব! হয়তো আপনি সেদিন জোর না করলে আমি কখনোই আরওয়ার মতো মেয়েকে জীবনসঙ্গী হিসেবে পেতাম না!”
জোবায়ের সাহেব তার কাঁধে হাত রেখে বললেন,”বলেছিলাম না সুযোগ দিয়ে দেখো, নিরাশ হবে না!”
“সুযোগ পাওয়ার অধিকার সবাই রাখে তাই না?।ওরা যখন চাইছে ওদেরকে সুযোগ দিন না? ঢাল হয়ে দাঁড়ান না ওদের সামনে? আপনি দাঁড়ালে এখানে কেউ আর কথা বলার সাহস পাবে না!”
জোবায়ের সাহেব নিরবে প্রস্থান করলেন।
“আমার একদম ভালো লাগছে না ভাবি! দেখো একটা ছবিও কারো ভালো আসেনি। সবার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে যেন মরা বাড়িতে এসেছে! দিস ইজ নট ফেয়ার!!”
আরওয়া লাগেজে চেইন আটকাতে আটকাতে বললো, “আসলেই ছবিগুলো ভয়ঙ্কর লাগছে! তবে পজিটিভলিও বলতে পারো, আদরের মেয়েকে বিদায় করার ভাবনায় সবাই গ্লুমি হয়ে আছে।”
“আমার ভাগ্যটাই আসলে খারাপ। কুহু আপুর বিয়ের সময় কত মজা হয়েছে। আমরা কত আনন্দ করেছি, হৈ চৈ করেছি। আর আমার বেলা…..ওরা এখনই কেন এসব করতে গেল বলো তো? ক’টা দিন অপেক্ষা করা গেল না?”
কুহু ওর মাথায় গাট্টি মেরে বলল,”নাকি কান্না থামা তো। আমার বিয়ে আমার বিয়ে বলে বলে কেমন ফ্যাঁচ ফ্যাঁচ করে কাঁদছিস ছি!”
“তুই তো বলবিই! নিজের বিয়ে তো এমন হয় নি। পছন্দের ছেলের সাথে নাচতে নাচতে চলে গেছ, হলুদেও কত রং ঢং করে নাচলা। আর আমার বেলা কী করছো?”
“এমন ভাবে বলছিস যেন তোরটা অপছন্দের কারো সাথে হচ্ছে? তুই ও নাচতে নাচতে যা না ধরে রাখছে কে?”
“তুই আমার দুঃখ বুঝবি না, বোনেরা বিয়ের পর এমনিতেই পর হয়ে যায়। আর তুই তো বিয়ের আগে আমার সৎবোন ছিলি!”
কুহু হাই তুলে বললো,”এসব ঝগড়াঝাটি বাদ দে, আমার অনেক ঘুম পাচ্ছে, দেখি সর ঘুমাই।”
“তুই আমার রুমে কেন ঘুমাবি? তোর রুমে যা।”
“আমার রুমে জায়গা নেই। কাদের আন্ডাবাচ্চা সব আমার বিছানায় ঘুমাচ্ছে কে জানে। এখন ওদের মা খুঁজে খুঁজে এনে ওদের তুলবো এতো সময় আমার নাই।”
“দুলাভাই কোথায়?”
“বাসায় চলে গেছে। আমাকেও বলছিল যেতে, পরে ভাবলাম এ বাড়িতে তোর আজ শেষ দিন। দয়া দেখিয়ে থেকেই যাই। আবার কবে না কবে একসাথে ঘুমানোর সুযোগ হয়!”
“আপু দেখো আর কিছু নেওয়া বাকী আছে কি না। তারপর লক করে দিও। তোমাদের আর কিছু লাগবে?”
কুহু বললো,”অনেক খেটেছ গো মনু, যাও এখন গিয়ে ঘুমাও।”
“গুড নাইট!”
“গুড নাইট”
আরওয়া দরজা আটকে নিজের রুমের দিকে অগ্রসর হলো। আজকের দিনটা অনেক লম্বা কেটেছে যেন। কত কী ঘটলো সেই সকাল থেকে। এখন বিছানায় গা এলিয়ে ঘুম দিতে পারলেই শান্তি…
চলবে,,,,