কাঁটাকম্পাস পর্ব-৫০

0
369

#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৫০

#আরশিয়া_জান্নাত

পাপিয়া জানালার ধারে বসে আছে। রিজভী সামিয়াকে পাগলের মতো ভালোবাসতো এ তাদের কারোই অজানা নয়। ৪বছরের ভালোবাসা ভুলে যাওয়া এতো সহজ না। এটা সে ভালোভাবেই জানে। তবুও মেয়েদের মন অভিমানী হয়। যার সঙ্গে জীবনের বাকী অংশ একসঙ্গে কাটানোর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে তার চোখে অন্য নারীর জন্য বিষাদ দেখা সহ্য করা কঠিন বৈকি! পাপিয়া যতোই মনকে বুঝ দিক কোথাও না কোথাও ওর ঠিকই মনে হয় ও কেন প্রথম নারী হলো না!

রোকেয়া মেয়েকে আমের আচার দিতে এসে দেখলো পাপিয়া মুখ ভার করে বসে আছে। তার মেয়ে এমন চুপচাপ বসে থাকার মতো না, তবে কি কোনো কারণে মন খারাপ? অবশ্য দু’দিন পর যার বিয়ে তার মনে মেঘ থাকা অস্বাভাবিক না। এতোদিনের চেনা গন্ডি পেরিয়ে নতুন পরিবারে জীবন গুছিয়ে নেওয়া, সবকিছু নতুন করে শুরু করা এতো সহজ না। তাই স্বভাবতই আনন্দের চেয়ে ভয় ভীতি ও দুঃখটাই বেশি অনুভূত হয়। রোকেয়া মেয়ে কাঁধে হাত রেখে বলল, “কিরে এমন মূর্তির মতো বসে আছিস কেন? ধ্যান করছিস নাকি!”

পাপিয়া মায়ের হাত ধরে সামনে বসালো। ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটিয়ে বলল, “তোমাকে অনেক জ্বালাই তাই না আম্মু!”

“হঠাৎ এইকথা কেন বলছিস? বিয়ের আগে সব হিসাব নিকাশ চুকাবি নাকি?”

“নাহ! তোমাদের কাছে আমি আজীবন ঋণী থাকতে চাই।”

“আচ্ছা থাকিস! নে আচার খা, তোর খালা পাঠিয়েছে তোর‌ জন্য।”

পাপিয়া আয়েশ করে আচার খেতে লাগলো, রোকেয়া মেয়ের দিকে স্নেহার্দ্র দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন, “আল্লাহ ওকে সুখী করো!”

নাহিয়ান রাউন্ড শেষ করে কেবিনে এসে দেখে সাবা ওর চেয়ারে বসে আছে। নাহিয়ান হেসে বলে, “কী সৌভাগ্য আমার মিসেস খন্দকার আমার কেবিনে এলেন যে!”

সাবা চেয়ারে দোল খেতে খেতে বললো, “দেখতে এলাম আসলেই ঠিকঠাক চিকিৎসা করছো, নাকি হসপিটালে ফাঁকিবাজি করে দিন কাটাও!”

নাহিয়ান হ্যান্ড সেনিটাইজার দিয়ে হাত ক্লিন করে বললো,” হতে পারি একটু আড্ডাবাজ তাই বলে ফাঁকিবাজ নই ম্যাডাম! চাইলে ডিটেক্টিভ দিয়ে খোঁজ নিতে পারেন।”

“তাই না!”

“জ্বি ঠিক তাই।”

ডক্টর তারিন দরজায় নক করে বললো,”আসতে পারি?”

সাবা হেসে বললো,”আসো আপু। কেমন আছ?”

“ভালো আছি, তুমি ভালো তো? ”

“আলহামদুলিল্লাহ।”

নাহিয়ান চায়ের অর্ডার দিয়ে চেয়ারে বসলো।তারিন অপর চেয়ারে বসে বললো, “জীবন খুব অদ্ভুত গল্পের নাম।”

“তা তো বটেই!”

নাহিয়ান বলল,” হঠাৎ দর্শন নিয়ে বসলি কেন? কিছু হয়েছে আবার?”

তারিন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,”আমার ওয়ার্ডে একটা ডেলিভারি পেশেন্ট এসেছে গতকাল। বেচারি একা একাই ভর্তি হয়েছে। ওর সাথে কেউ আসে নি। ফ্যামিলি সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করতেই বললো, ওর বাবা-মা কেউ নেই। মামার বাসায় বড় হয়েছে। পারিবারিকভাবে বিয়ে হয়েছে। কিন্তু হাজবেন্ড সুবিধার না।”

“আহারে বেচারি! এমন কঠিন সময় একা সব হ্যান্ডেল করছে।”

“হুম আসলেই। আচ্ছা সাবা শোনো, আমি এখন রাউন্ডে যাবো। এসেই তোমাকে চেকাপ করবো কেমন? অপেক্ষা করতে অসুবিধা হবেনা তো?”

নাহিয়ান বললো,”অসুবিধা অবশ্যই আছে, আগে থেকে এপয়েন্টমেন্ট দিয়েও যদি অপেক্ষা করতে হয় তাহলে লাভ কী হলো? ”

“তুই মাঝখানে ঢুকিস না, এটা আমাদের ভাবি ননদের ব্যাপার”

“আপু তুমি যাও, সমস্যা নেই আমি আছি।”

জাওয়াদ ঘড়ির দিকে তাকিয়ে ফের দরজার দিকে তাকালো। না এখনো তানভির আসছেনা।ও কি আদৌ আসবে নাকি অযথাই বসিয়ে রাখছে কে জানে। জাওয়াদ ৩য় বার কফি অর্ডার করে সিদ্ধান্ত নিলো এই কফি শেষ হলেই ও চলে যাবে। আর অপেক্ষা করবেনা।

“সরি দোস্ত অনেকক্ষণ অপেক্ষা করালাম। প্লিজ রাগ করিস না।”

জাওয়াদ কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, “ইমার্জেন্সি খবর দিয়ে নিজেই লেট করে আসা কেউ তোর থেকে শিখুক! এনিওয়ে কেন ডেকেছিস তাই বল?”

“আমি একটা কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছি, তোকে সেটা শেয়ার করতেই মূলত ডাকা।”

“কী সিদ্ধান্ত?”

তানভির কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো,”আমি নিপাকে ডিভোর্স দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি!”

জাওয়াদ ভাবলেশহীনভাবে জবাব দিলো,”আচ্ছা!”

তানভির ওর দিকে তাকিয়ে বললো,”তোর থেকে রিয়েক্ট আশা করা ঠিক না!”

“তুই নিশ্চয়ই শুধুমাত্র আমার রিয়েকশন দেখতে এমন সিদ্ধান্ত নিস নি! সলিড রিজন আছে বলেই নিয়েছিস।”

“হুম রিজন তো আছেই!”

“তা ফিন্যান্সিয়ালী রেডি তো? আই মিন এন্টিমনি…”

“২০লক্ষ টাকা কাবিন ছিল…”

“মাথা গরম করে ডিসিশন নিস না। সমস্যা আইডেন্টিফাই কর, সল্যুশন আছে কী না দেখ। দুজনে কথা বল সর্ট আউট করার ট্রায় কর। তারপরো যদি মনে হয় হচ্ছে না, দ্যান ডিভোর্স ফাইল করিস। তন্ময় এর কথা মাথায় রাখ, তোরা দুজনে মুভ অন করে যার যার লাইফে সেটেল হলেও বাচ্চাটা একা পড়ে যাবে।”

“ওর জন্যই তো শত সমস্যা এড়িয়েও সংসার করে যাচ্ছি! আমার লাইফ যদি ১টা দিন লিড করতি বুঝতি কী অবস্থায় বেঁচে আছি। ভালো মেয়ে স্ত্রী হিসেবে পাওয়া অনেক বড় গিফট। আমি আসলেই হতভাগা!”

“তোর যদি বেশি কষ্ট হয় তবে বলবো ছেড়ে দে। আমরা সবাই ভালো জীবন ডিজার্ভ করি।”

তানভির চোখের কোণ চেপে বলল,”আম্মা খুব অসুস্থ ছিলেন। অপারেশনের সব টাকা রাহার হাজবেন্ড দিছে। আমাকে বলে নাই কারণ জানে নিপা অশান্তি করবে। আব্বার মতো রাগী লোক ও নিপাকে এড়িয়ে চলে। আমার এই টাকাপয়সার কী ভ্যলু বল তো? যদি নিজের মা-বাপের জন্য ইচ্ছেমতো খরচ করতে পারি না। ছেলে বেঁচে থাকতে মেয়ের জামাই থেকে অপারেশনের টাকা নিতে হয়……”

জাওয়াদ বাইরের দিকে তাকালো। শত শত গাড়ির হেডলাইটের আলোয় রাত টা রাত মনে হয় না। এই শহরে সবাই কত লড়ছে একটা সুখী জীবন পেতে। কিন্তু সবাই কী সুখ পায়? বাড়ি ফিরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারে?

জাওয়াদ বাসায় ফিরে মাত্রই আরওয়াকে জড়িয়ে ধরলো। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিয়ে মনে মনে বলল, “রোজ শোকরানার নামাজ আদায় করলেও বোধহয় শোকর আদায় শেষ হবে না আমার!”

“ব্যাপার কী বলুন তো? আজ এসে মাত্রই জড়িয়ে ধররেন! সচরাচর তো এমন করেন না..”

“একটা হেডলাইন দেখলাম স্ত্রীকে জড়িয়ে ধরে থাকলে নাকি হার্ট এট্যাকের ঝুঁকি অনেকটা কমে যায়। এমনিতেই ছেলেদের এই ঝুঁকি অনেক বেশি, তাই সেটা কমানোর ট্রায় করছি!”

“তাহলে বেশি সময় নিয়ে জড়িয়ে রাখুন।”

জাওয়াদ মুচকি হেসে বললো,”পরীক্ষা কেমন হলো আজ?”

“আলহামদুলিল্লাহ ভালোই। আপনার অফিসে সব ঠিকঠাক তো?”

“হুম।”

“আপনি ফ্রেশ হয়ে নিন আমি নাস্তা পানির ব্যবস্থা করছি।”

“আরওয়া”

“হুম?”

“ব্যাগে কিছু আছে কি না দেখে যেও তো…”

আরওয়া ফিরে ব্যাগের চেইন খুলে দেখে হলুদ গোলাপফুল রাখা। আরওয়া ফুলগুলো ঠিক করে বলল, “কাঁচা ফুল কেউ এভাবে ব্যাগে রাখে? হাতে করে বৌয়ের জন্য কিছু আনতে জনাবের যতো লজ্জা! হুহ!”

“হ্যালো পাপিতা, কোথায় আছিস?”

“বাসায় আর কোথায় থাকবো?”

“নিচে আয় চটজলদি”

“তুই কী আমাদের এখানে? হঠাৎ এই অসময়ে?

“এতো কথা না বলে দ্রুত আয়।”

পাপিয়া ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বিরক্ত হলো। যদিও রাত ১০টা তেমন রাত না। তবুও এরকম আসলে কেমন দেখায়! পাপিয়া মনে মনে রিজভীক কিছু গালি দিয়ে নিচে নামলো। ভাগ্যিস ড্রইং এ কেউ নেই এখন। পাপিয়া দরজা খুলে বের হতেই ভুত দেখার মতো চমকে গেল।

হিয়া চিরচেনা ভঙ্গিতে হেসে বললো, “কিরে এমন মূর্তির মতো দাড়িয়ে থাকবি জড়াই ধরবি না?”

পাপিয়া ওকে জড়িয়ে ধরে বললো, “আল্লাহ! হিয়া সত্যিই তুই আসছোস? কিভাবে সম্ভব!!”

রিজভী পাশ থেকে উঁকি দিয়ে বলল,”অসম্ভবকে সম্ভব করা রিজভীর কাজ!”

“এই বাদরটা আজ দুপুরে চাঁদপুর গিয়ে হাজির। কত কী করে তোর ভাইয়াকে রাজী করালো যদি দেখতি! আমার বাসায় একটু পানিও খায় নাই, সাথে করে নিয়ে আসছে সোজা এখানে।”

“তোহ কী করবো বল? তোর জন্য সেতি যেই মরা কান্না জুটাইছে। পরে বিয়ের আগেই না বিধবা হয়ে যাই আমি!”

“ছেলেরা বিধবা হয় না বিপত্নিক হয়!”

“দেখেছিস হিয়া কেমন ও! এই সময়েও ব্যাকরণের ভূল ধরে? কোথায় খুশিতে আমাকে একটু জড়িয়ে ধরে চুমু খাবে তা না…”

পাপিয়া ভ্রু কুঁচকে বলল,”দিন দিন তুই ঠোঁটকাটা হয়ে যাচ্ছিস! যাই হোক হিয়া তোর সাথে আমার অনেক বড় ঝগড়া আছে। আগে ফ্রেশ হয়ে নে তারপর ঝগড়ার ঝুলি খুলে বসবো।”

“এ কি রে, বান্ধবীকে নিয়ে চলে যাচ্ছিস আমাকে আসতে বলবি না?”

“তুই লাগেজগুলো নিয়ে আয়। হ্যাঁ রে দুলাভাই আসেনাই?”

“আসছে, রিজভী তো পথে থামতেও দিলো না। খালি হাতে কীভাবে আসবে। তাই কিছু কিনতে গেছে।”

পাপিয়া হিয়ার ছেলেকে কোলে নিয়ে দুনিয়ার কথা বলতে বলতে সোফায় গিয়ে বসলো। ওর চোখেমুখে আনন্দের ফোয়ারা বয়ে যাচ্ছে।রিজভী ওর দিকে চেয়ে আড়মোড়া ভেঙে বিড়বিড় করে বলল, “যাক কষ্ট সার্থক হলো!”

পাপিয়ার হলুদের দিন সকালে খন্দকার বাড়িতে একটা বড়সড় ঘটনা ঘটে গেল। নাহিয়ান আর সাবা সদ্য জন্ম নেওয়া একটি নবজাতক শিশুকে কোলে নিয়ে যখন দরজায় দাড়ালো বাড়ির সকলে ভীষণ অবাক বৈ কী
বলা নেই কওয়া নেই হুট করে একজনকে এভাবে নিয়ে আসবে এ সবার কল্পনার অতীত। অতিথিরা সবাই কানাঘুষা শুরু করলেও জোবায়ের সাহেবের ভয়ে আওয়াজ করতে পারলো না। নূর মোহাম্মদ ছেলের এহেন কান্ডে রেগে আগুন। তার সব রাগ গিয়ে সাবার উপরেই কেন্দ্রীভূত হয়। এই মেয়েটাই তার ছেলের মাথা খেয়ে রেখেছে।‌ নয়তো আজ তাকে এই দিন দেখা লাগতো? শক্ত সামর্থ্য ছেলে হয়েও বাবা হবার সুখ থেকে বঞ্চিত সে। শুধুমাত্র ভালোবাসায় অন্ধ হয়েই আরেকটা বিয়ে করছে না। বাবা হয়ে এটা মেনে নেওয়া যায়?
জোবায়ের সাহেব নিরবতা ভেঙে বললেন, “সালমা সাবাকে নিয়ে ভেতরে যাও। আর নাহিয়ান আমার ঘরে আসো।”

কুহু বাচ্চাটাকে কোলে তুলে বলল,”মাশাআল্লাহ কত সুন্দর বাচ্চাটা! ভাবি এতো সুন্দর পরী কোত্থেকে আনলে গো?”

সাবা নিষ্পাপ শিশুটির কপালে চুমু খেয়ে বললো, “আল্লাহ বোধহয় ওকে আমার কোল আলো করতেই পাঠিয়েছেন….”

চলবে…..

একটি উত্তর ত্যাগ

আপনার মন্তব্য লিখুন দয়া করে!
এখানে আপনার নাম লিখুন দয়া করে