#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৪৭
#আরশিয়া_জান্নাত
৪৭
“আস্সালামু আলাইকুম আন্টি।”
“ওয়ালাইকুমুস্সালাম। কেমন আছ?”
“আলহামদুলিল্লাহ ভালো। আপনি ভালো তো?”
“আলহামদুলিল্লাহ!”
“আপনারা এসেছেন আমি অনেক খুশি হয়েছি। আঙ্কেল আসেননি?”
“হ্যাঁ এসেছে।”
“আচ্ছা আপনারা বসুন আমি আম্মুকে ডেকে আনছি।”
পাপিয়া রিজভীর মা-বোনকে বসিয়ে নিজের মাকে খুঁজতে গেল। যাওয়ার পূর্বে ওয়েটারকে বলে গেল উনাদের খেয়াল রাখতে।
বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা প্রায় শেষের পথে, একটু পরেই কনে বিদায় দেওয়া হবে। এই মুহূর্ত প্রতিটা মেয়ের জীবনে যতটা কষ্টের তার চেয়ে অধিক কষ্টের তার বাবা-মায়ের জন্য। কুহু ভেবেছিল তার বিয়ের দিন তার মায়ের চেয়ে বেশি খুশি আর কেউ হবেনা। তিনি ওর বিয়ে নিয়ে গত কয়েকবছর যে পরিমাণ টেনশন করেছেন, আজ সেটা থেকে মুক্ত হয়ে নিশ্চয়ই খুশিতে গদগদ হয়ে মেয়েকে বিদায় করে বলবেন, “উফ আপদ বিদায় হলো!” কিন্তু না কোহিনূর মেয়েকে জড়িয়ে যে মরা কান্না জুড়েছিলেন তাতে উপস্থীত সবারই চোখে পানি আসতে বাধ্য হয়েছিল। মায়েরা যতই মেয়ের বিয়ে নিয়ে কথা শোনাক না কেন, বিয়ের দিন ঠিক হলে তাদেরই বেশি পুড়ে! বাবা-মায়ের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কুহু চলেছে জীবনের নতুন এক অধ্যায়ে পাশে তার বহুকাঙ্ক্ষিত শখের পুরুষ। ইশরাক নিরবতা ভেঙে বললো,”কুহু মন খারাপ করো না। তোমার যখন ইচ্ছে হবে ওখানে যেতে পারবে। আমি মানা করবোনা। আর কেঁদো না প্লিজ!”
কুহু চোখের কোণে টিস্যু চেপে বসে রইলো। এতো কান্না কোত্থেকে আসছে কে জানে!
আরওয়া ক্লাসে বসে স্যারের লেকচার নোট করছে। রুমাইসা মনোযোগী ছাত্রীর মতো স্যারের দিকে তাকিয়ে থাকলেও ওর মন এখন এখানে নেই।পেটের ভেতর কথাগুলো ঘুটঘুট করছে, আরওয়াকে না বলা অবধি সে শান্তি পাবেনা। আরওয়া আবার ক্লাসে কথা বলে পছন্দ করেনা। সে তো পারলে স্যারের সব কথা এ টু জেড খাতায় তুলে নিবে। রুমাইসা মনে মনে প্রার্থনা করছে ক্লাসটা দ্রুত শেষ হোক।
ক্লাস থেকে বেরিয়ে আরওয়া বলল,”চেহারা এমন বাংলার পাঁচের মতো করে রেখেছিস কেন?কী হয়েছে?”
“বিয়েতে কী পড়বো বুঝতেছিনা। একবার মনে হচ্ছে কাতান পড়ি, আবার মনে হচ্ছে জামদানি পড়ি, আবার লেহেঙ্গা পড়তেও মন চাইতেছে। আমি অনেক কনফিউজড!”
“এটা নিয়ে টেনশনের কী আছে? হলুদে জামদানি পড়িস, বিয়েতে কাতান রিসিপশনে লেহেঙ্গা! হয়ে গেল তো।”
” ধুরর তুই বুঝতেছোস না। বিয়েতে জামদানি পড়া এখন ট্রেন্ড। তাসনিয়া ফারিন কে দেখোস নাই কী সুন্দর লাগছিল! কুহু আপুকে কাতান শাড়িতে জোস লাগছে, দেখে ঐটা পড়তে মন চাইছে। পরে ইনস্টাতে লেহেঙ্গা দেখে….”
আরওয়া বিরক্ত গলায় বললো, “এখন একদিনে সব ট্রেন্ড ফলো করলে কেমনে হবে?”
“সেটাই তো!”
“সাম্য ভাইয়াকে বলেছিস?”
“নাহ।”
” এক কাজ কর এসব ট্রেন্ড বাদ দে, সাম্য ভাইয়ার কোনটা পছন্দ সেটা জিজ্ঞেস কর, সে অনুযায়ী সিলেক্ট কর। যত বেশি ঘাটবি তত কনফিউজড হয়ে যাবি। এর চেয়ে যার জন্য সাজছিস তার পছন্দকে গুরুত্ব দেয়া শ্রেয়!”
“সেটাই করতে হবে মনে হচ্ছে। তুই লাকি রে, তোকে এসব প্যারায় পড়তে হয়নাই।”
“এমনভাবে বলছিস যেন কয়েক যুগ আগে আমার বিয়ে হয়েছে। তখন এসব ছিল না!”
“সেটা বলিনাই। তবে তুই আমার মতো কনফিউজড তো ছিলি না।”
“হুম এটা ঠিক। এখন পরীক্ষায় ফোকাস কর, পরীকৃষার পর না বিয়ের ডেট ফিক্সড হলো?”
“এটাই বিরক্তিকর। পরীক্ষাটা মাঝখানে না টপকালে হতো না! বিয়ের পর পরীক্ষা হলে কী হতো!”
“আমারে বলোস আমি জামাই পাগল, এদিকে তুই তো বিয়ের আগেই সেটা হয়ে গেলি!”
রুমাইসা বাদামের খোসা ছাড়াতে ছাড়াতে বলল, “লোকটাকে দেখলে একটু মায়াই লাগে। কেমন বলদা বলদা লুক নিয়ে তাকাই থাকে। সেজন্য একটু মায়া দেখাই আর কী এমনিতে কিছু না!”
“হইছে আর বুঝ দিতে হবেনা। আমরা খাই সুজি কিছু কিছু বুঝি!”
রোকেয়া বেশ কিছু কাপড় কিনে এনেছেন কাঁথা সেলাইয়ের জন্য। একটু পরেই সাহেরা নামে একজন আসতেই তিনি বললেন, “এখানে আস্তরসহ কাপড় দিচ্ছি, ৫০/৬০টা কাঁথা বানাবে। নকশি করে বানাবে ২০টা বাকিগুলো এমনি সেলাই করলেই হবে।”
“আন্টি আমনেগোর বাড়ির কারো বাচ্চা হইবো নাকি? হঠাৎ এতো খেতা সিলাইতে দিতাছেন?”
“সময় থাকতে থাকতে বানিয়ে নিচ্ছি, কার কখন সুখবর আসে বলা তো যাচ্ছেনা।”
“ওহ আইচ্ছা, বুদ্ধি ভালাই।”
“শোন তোর বোনের হাতের কাজ সুন্দর। ওরে বলিস নকশিগুলো যেন ও করে। যারেই দেই না কেন সবকয়টাই আদরের। তাই কাঁথাগুলো সুন্দর হতেই হবে।”
পাপিয়া মায়ের কান্ড দেখে বললো,”ওরে বাবা এ তো এলাহি কান্ড! তুমি কী সবার বাচ্চার জন্য কাঁথা সেলাই করতে বসছো?”
“এতো চিল্লাইস না। সবাই শুনলে আরেক কাহিনী শুরু হবে।”
পাপিয়া মায়ের কাছে বসে বললো,” সত্যি করে বলো তো আরওয়া ভাবীর সুখবর পাইছো?”
“আরেহ নাহ। এমনিই বানাই রাখতেছি।”
“ওহ। সাহেরা আপা আমার জন্য একটা বড় নকশী কাঁথা বানাবেন।”
“আমনে কাপড় ডা খালি দেন, বাকি সব আমার কাম। এমন সুন্দর ডিজাইন কইরা দিমু সবাই হা কইরা চাইয়া থাকবো।”
।
পাহাড়ের ঢল বেয়ে নেমে আসা বিশাল ঝর্ণার নীচে জাওয়াদ আর আরওয়া দাঁড়িয়ে আছে। পানি আর বাতাসের শব্দ মিলেমিশে অন্যরকম এক পরিবেশ। চারদিকে পাখিদের কিচিরমিচির শব্দ, গাছগাছালির সোঁতা গন্ধ। আরওয়া উল্লাসিত গলায় বললো,”আমার অনেক ইচ্ছে ছিল এমন ঝর্ণা সরাসরি দেখার। কী সুন্দর এটি!!”
জাওয়াদ মুচকি হেসে বললো,”তোমার পছন্দ হলেই স্বার্থক!”
আরওয়া এক কিনারায় বসে পানি নিয়ে খেলতে লাগলো। জাওয়াদ ওর দিকে মুগ্ধদৃষ্টিতে চেয়ে আছে। আরওয়ার উচ্ছাসিত বাচ্চামো দেখতে আজকাল ওল ভালোই লাগে। মেয়েটা কখন যে ওর মনের অনেকটা অংশ দখল করে নিয়েছে কে জানে! জাওয়াদ শুরুতে ভেবেছিল এই বিয়েটা ১মাস ও টিকবে না, ও আরওয়াকে ডিভোর্স দিয়ে দিবে। তখন আরওয়াকে ওর ইমম্যাচিওর,ইরিটেটিং ক্যারেক্টার মনে তো। ওর অগোছালো স্বভাব, জিনিসপত্র এলোমেলো করার প্রবণতা, ঘুমের মধ্যে অস্থির অঙ্গিভঙ্গি সবই বিরক্তিকর লাগতো। অথচ সময়ের সাথে সাথে সব অভ্যেস হয়ে গেছে। আরওয়াও অনেকটা সংসারী হয়েছে, গুছিয়ে চলা শিখছে। গতিটা ধীর হলেও চেষ্টা করে যাচ্ছে এতেই জাওয়াদ খুশি। ঘুমের মাঝে ছটফট ভাবটা সম্পূর্ণ না কমলেও জাওয়াদের বুকে স্থির হয়ে থাকাটা ওকে স্বস্তি দেয়। আজকাল জাওয়াদের বরং কষ্ট হয় ওর সান্নিধ্য না পেলে। ও নাক ফুলিয়ে রেগে ঝগড়া না করলে মনে হয় দিনটা পূর্ণই হলো না।
আরওয়া ওর দিকে পানির ঝাপটা দিতে ধ্যান ভাঙ্গে তার, আরওয়া ভ্রূ উঁচিয়ে বলল,” কোথায় হারালেন?”
জাওয়াদ মুখ মুছে বলে,” এটা কী হলো? এভাবে কেউ পানি মারে!”
“তো কীভাবে মারে?”
“দাঁড়াও দেখাচ্ছি,,”
জাওয়াদকে নিজের দিকে এগিয়ে আসতে দেখে আরওয়া পেছাতে থাকে। হেসে বলে, “আমার ডেমো চাই না। আমি বুঝে গেছি….”
“এখন বললে তো হবে না। আমি ডেমো তো দিবোই। এমন পেছাচ্ছ কেন?”
“আপনি নিশ্চয়ই ডেঞ্জারাস কিছু করবেন, আপনাকে আমি ভালো মতো চিনি।”
“আরওয়া পিছিও না। স্থির হয়ে দাঁড়াও।”
আরওয়া মাথা নেড়ে না বলতে বলতে পেছালো। এলোমেলো পাথরের কিনারায় ব্যালেন্স করতে ওর কষ্ট হলেও স্থির হলোনা। জাওয়াদ ওকে আকড়ে ধরার জন্য এগোতে চাইলেও ও থামলো না। এক পর্যায়ে জাওয়াদ দাঁড়িয়ে বললো,” আরওয়া থামো,আর পিছিও না For God sake!”
আরওয়া খিলখিল করে হেসে বললো,”হুম আমি থেমে যাই আর আপনি ঝট করে ধরে ফেলুন। হবে না সেটা। আমি আর বোকা নেই!”
জাওয়াদ ভয়ার্ত দৃষ্টিতে আরওয়ার দিকে তাকিয়ে রইলো, আরওয়া পেছাতে পেছাতে অনেকটা দূর চলে গেছে। হঠাৎ পা পিছলে আরওয়া ঝিলে পড়ে গেল। পানিতে হাবুডুবু খেয়ে জাওয়াদকে ডাকতে লাগলো। জাওয়াদ ওর কাছে যাওয়ার চেষ্টা করলেও পা কিছুতেই এগোচ্ছে না। বরং মনে হচ্ছে ওর একেকটা পায়ের ওজন কয়েক মণ হয়ে গেছে, সে কিছুতেই পা নাড়িয়ে এগোতে পারছে না। আরওয়া ওকে প্রাণেপনে চিৎকার করে ডেকেই যাচ্ছে আর বলছে, “আমি সাতার পারি না, আমাকে বাঁচান। জাওয়াদ আমাকে বাঁচান প্লিজ…”
হঠাৎ আরওয়া পেছনে তাকিয়ে দেখে বিশাল আকৃতির কুমির তার দিকে এগিয়ে আসছে। ভয়ে ওর আত্মা উড়ে যায় যেন। ও পানিতে ধাপাধাপি করে কিনারায় পৌঁছানোর আপ্রাণ চেষ্টা করতে থাকে। কিন্তু পানির স্রোতের সঙ্গে পেরে উঠে না। জাওয়াদ ওর কাছে এগিয়ে আসতে আসতে পুরো পানি রক্তে লাল হয়ে উঠে…
জাওয়াদ ঘুম থেকে উঠে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলতে থাকে। চোখের কিনারা এখনো অশ্রুসিক্ত, ভয়ে তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। কাঁপা হাতে ল্যাম্প অন করে আরওয়াকে দেখে ওর মন শান্ত হলেও দুঃস্বপ্নের প্রভাব দূর হয় না। ও গ্লাস থেকে পানি পান করে নিজেকে ধাতস্থ করার চেষ্টা করে। মানসপটে বারবার ভেসে উঠে সেই ভয়ানক দৃশ্য। জাওয়াদ আরওয়া কে তুলে বুকের মাঝে নেয়। গালে কপালে চুমু খেয়ে বলে,”আলহামদুলিল্লাহ তুমি ঠিক আছ, তোমার কিচ্ছু হয় নি। ঐটা দুঃস্বপ্ন ছিল।”
আরওয়া মুখে পানির অস্তিত্ব টের পেয়ে জেগে উঠে, ওর চোখ মুছে দিয়ে ঘুমঘুম গলায় বলে, “কী হয়েছে? আপনি কাঁদছেন কেন? খারাপ স্বপ্ন দেখেছেন?”
জাওয়াদ ওর হাতেরমুঠোয় চুমু দিয়ে বলে,”আরওয়া তুমি কখনো আমার কথা অমান্য করবে না। আমি না বললে ঐ পথে আর এগোবে না প্লিজ। তুমি সাবধানে থাকবে বুঝছো।তোমার লাইফে আমার চেয়ে বেস্ট অনেক ছেলে আসলেও আমার লাইফে তোমার মতো কেউ আসবেনা। আমার কাছে তুমি মূল্যবান। এটা মাথায় রেখো।”
আরওয়া ওকে সান্ত্বনা দিয়ে বললো,” খারাপ স্বপ্ন সত্যি হয় না। ঐগুলো আমাদের ভাবনার রিফ্লেক্ট। এতো পাত্তা দেওয়ার কিছু নেই। যা দেখেছেন ভালো দেখেছেন। শান্ত হয়ে ঘুমিয়ে পড়ুন তো। আমি আছি আপনার পাশে।”
জাওয়াদ শান্ত হলো না। বরং সেই রাতে তার গা কাঁপিয়ে জ্বর এলো।
পাপিয়া জাহিদের সঙ্গে গল্প করতে করতে বাসায় ফিরছিল। হঠাৎ তাদের গেইটে তাকিয়ে দেখে বেশ কয়েকটা গাড়ি এসেছে। জাহিদ বললো, “বাসায় কোনো মেহমান এলো নাকি?”
“কুহু আপুদের তো আজ আসার কথা না। তাহলে কে এলো?”
“চলো ভেতরে গিয়ে দেখি।”
পাপিয়া বাড়ির ভেতরে ঢুকে ভুত দেখার মতো চমকে যায়। তাদের ড্রইং রুমে রিজভী ও তার পরিবারের সবাই বসে আছে। রিজভী দেশে ফিরলো কবে! কই ওকে তো কিছু বলেনাই।
চলবে…
#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৪৮
#আরশিয়া_জান্নাত
“কুহু উঠো। আরেকটু দেরি হলে পরে নিজেই আফসোস করবে।”
কুহু ইশরাকের কথা শুনেছে বলে মনে হলো না। বরং আরো গুটিয়ে আয়েশ করে ঘুমাচ্ছে। ইশরাক ঘড়ির দিকে চেয়ে বললো,” আজকেও উঠতে লেট করবে, তারপর দাদীর কাছে বকা শুনবে।”
ইশরাক আরেকদফা ডেকে ওয়াশরুমে গেল। কুহু ফোনের এলার্ম অফ করে উঠে বসে। ওর দাদী শাশুড়ি ঢাকায় এসেছেন ৩দিন হলো। এই ৩দিন ওকে ফজরের ওয়াক্তে উঠে নামাজ পড়ে নাস্তার আয়োজন করতে হয়। ঘড়ির কাটা ৬টায় পড়লেই তাকে থোকমা ভেজানো ১গ্লাস পানি দিতে হয়। নাস্তায় পাতলা করে ৩টা রুটি আর তরকারি, শেষে মধু দেওয়া রং চা। রুটি পাতলা আর গোল না হলে তিনি ছুঁয়েও দেখেন না।
এসব কাজ এতোদিন ছেলের বৌ করলেও এবার এসেই বলেছেন নাতবৌ যেন সব করে। তাই কুহুকেই সবটা দেখতে হচ্ছে। এই ৩দিনে সে রোজ বকা শুনেছে, কখনো দেরি করে উঠার জন্য তো কখনো রুটির জন্য। বেচারি যতোই চেষ্টা করুক পারফেক্ট দিন শুরুই হচ্ছেনা। ইশরাক উযু করে এসে জায়নামাজ বিছিয়ে বললো, “তাড়াতাড়ি করো সময় চলে যাচ্ছে।”
কুহু দ্রুত ফ্রেশ হয়ে ইশরাকের পাশে নামাজে দাঁড়ালো। নামাজ শেষে ইশরাক বরাবরের মতো কুহুর হাতের কড়ায় তসবীহ পাঠ করে, তারপর দোয়া পড়ে তার মাথায় ফুঁ দিয়ে বলে, “আল্লাহ তোমার মুশকিল আসান করে দিক!”
কুহু আধখোলা চোখে হেসে ওর দিকে তাকায়। ইশরাক ওর গালে হাত রেখে বলে,”কষ্ট হচ্ছে অনেক তাই না?”
“দাদী চলে যাওয়ার পর আমি কয়দিন টানা ঘুমাবো। এখানে পসিবল না হলে আমাদের বাসায় গিয়ে হলেও ঘুমাবো। আগে থেকে বলে দিচ্ছি!”
“আচ্ছা!”
সাবা আর নাহিয়ান শ্রীমঙ্গল বেড়াতে এসেছে। শহুরে ব্যস্ততা ভুলে ক’টা দিন প্রকৃতির মাঝে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতেই এই কারসাজি। পাখির কিচিরমিচির শব্দ, স্নিগ্ধ শীতল বাতাস, মাটির ভেজা গন্ধ। সব মিলিয়ে প্রকৃতির নৈকট্যে এক দারুণ সময় পার করছে এই দম্পতি।
পাপিয়া ঘুম থেকে জেগে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। গতকাল বিকেলের ঘটনা তার কাছে স্বপ্নের মতোই মনে হচ্ছে। কিন্তু অনামিকায় জ্বজ্বল করতে থাকা হীরের আংটিটা জানান দিলো এ স্বপ্ন নয় বরং উজ্জ্বল দিনের মতো সত্যি! রিজভী পারিবারিকভাবে ওকে বিয়ের প্রপোজাল দিয়েছে। গতকাল সবার কথায় বোঝা গেল এই বিয়েটা নিয়ে ইতোমধ্যে দুই পরিবারে কথাবার্তা হয়েছে। কেবল রিজভী ফেরার অপেক্ষা ছিল। পাপিয়া চোখ বন্ধ করে ভাবতে লাগলো তার আর রিজভীর কথোপকথন,
“কেমন সারপ্রাইজ দিলাম? চমকে গেছিস অনেক তাই না?”
“এটা সারপ্রাইজ ছিল না শক ছিল। তোর সাথে সেদিনও তো কথা হলো, দেশে আসবি বললি না তো!”
“তোকে বলেছিলাম না ওখানে একা থাকা কঠিন হয়ে যাচ্ছে? একজন সঙ্গী থাকলে ভালো হতো। তাই ভাবলাম দেশে যাই কাউকে ধরে আনি।”
“বিয়ে করার জন্য দেশে ফিরলি তাই বল! আমিও তো অবাক বলা নেই কওয়া নেই ভুত হাজির!”
“ভুতেরা বুঝি তোকে বলে কয়ে আসে? তা আসবার আগে কী বলে? পাপিয়া ম্যাম মে আই কাম ইন?”
পাপিয়া কোলের কাছে কুশন নিয়ে বলল,” এরকম বলে না তবে হিন্ট দেয়। মুভিতে দেখিস না কীভাবে লাইট অনঅফ হয়, দরজায় নক করে, কিংবা উপস্থিতি টের দেয়। তারপরই তো প্রকট হয়। হুট করে তোর সময় সরাসরি উদয় হয় না।”
“তাই না! কেমন তুই? আমি এতোদিন পর এলাম কোথায় ভাবলাম জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি করবি। বলবি, ও দোস্ত তোরে কত মিস করছি, এতো শুকাই গেলি কেমনে? ঐখানে কী খাওয়া দাওয়া করিস না! তা না করে এমন ভাব নিচ্ছিস যেন আমি আসায় তুই মহাবিরক্ত।”
“তেমন হতে যাবে কেন আজীব!”
“তেমন হলেও আমার লস কী? তোকে বিরক্ত করাই আমার আনন্দের কাজ। যাই হোক আজ এমনি এমনি আড্ডা দিতে আসি নি। একটা সিরিয়াস টপিকে কথা বলতেই এসেছি।”
“হুম বল কী সিরিয়াস কথা?”
“আমার হাতে সময় বেশি নাই। ১০দিনের মধ্যে বিয়ে করে বৌকে সঙ্গে নিয়ে যাবো, সেই উদ্দেশ্যেই এসেছি।”
“১০দিনে মেয়ে খুঁজে বিয়ে করবি? সিরিয়াসলি? এত কম সময়ে মেয়ে পাবি কই?”
“আরে আম্মু সব ঠিক করে রেখেছে। আমি এসেছি জাস্ট কবুল বলে সাইন করতে”
কথাটা শুনে পাপিয়ার চেহারার রং বদলে গেল। তবে বিয়ের দাওয়াত দিতেই উনারা সবাই এলেন? পাপিয়া নিজের অভিব্যক্তি লুকিয়ে হাসিমুখে বললো,”ওয়াও কংগ্রেটস। আমি সত্যিই তোর জন্য অনেক খুশি। তুই মুভ অন করতে পেরেছিস এটা আসলেই আমাদের জন্য অনেক ভালো খবর।”
রিজভী পাপিয়ার দিকে চেয়ে বাঁকা হাসলো। ফুরফুরে গলায় বললো,” হুম তুই আমার প্রথম সারির শুভাকাঙ্ক্ষি বলে কথা! তোর তো ভালো লাগবেই। শোন তুই ও বিয়ে করে ফেল। কুহু তো গেল, এবার তুই ও যা, তোর ভাইয়ের বৌদের একটু শান্তি দে।”
“এখন বুঝি অশান্তি দিচ্ছি!”
“অফকোর্স দিচ্ছিস। আবিয়াইত্তা ননদ থাকার প্যারা বুঝিস? বাংলা সিনেমা দেখিস নি? কাল ননদীর অত্যাচারে কত নায়িকা কষ্টের অভিনয় করতো!”
“বলছে তোরে!”
“এটাই চিরন্তন সত্যি, বলে দিতে হয় না। যাই হোক আমার হাতে অনেক ছেলে আছে, দেখবো নাকি তোর জন্য?”
“আমারে নিয়ে তোরে ভাবতে হবেনা। নিজের চরকায় তেল দে।”
“নিজের চরকায় তেল দিতেই তো তোকে বলছি। তুই না আমার বেস্টফ্রেন্ড? তুই আমি কী আলাদা?”
“আমি তোর কোনোকালের বেস্টফ্রেন্ড না। এসব স্বপ্নবিলাস বন্ধ কর।”
রিজভী কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,” নাআআ এ হতে পারে না। বলে দে তুই মিথ্যে বলছিস, বলে দে এই সবই মনগড়া কথা!”
“বাপ্পারাজ সাজিস না তো। অসহ্যকর!”
রিজভী হেহে করে হাসতে লাগলো। বহুক্ষণ পর হাসি থামিয়ে বললো,”পাপিতা আমি একা এই জেলখানার কয়েদি হবোনা রে। তোরে সাথে নিয়েই বিয়ে নামক জেলখানায় ঢুকবো। বাংলাদেশে এখন সীজনটা বিয়ের জন্য পারফেক্ট না হলেও সমস্যা নেই। ইউকে তে পারফেক্ট ই আছে।”
পাপিয়া ভ্রু কুঁচকে বললো,”তোর কথার আগামাথা আমি কিছুই বুঝতেছি না।”
“মাথামোটা মেয়ে, তোর বুঝতেও হবেনা।চুপচাপ শুধু দেখে যা, না বলার স্পর্ধা দেখাবি না বলে দিচ্ছি।”
আরওয়া এসে বললো, “আপু তোমাদের ডাকছে, নীচে চলো।”
পাপিয়া আরওয়ার সাথে যেতে যেতে বলল,”ভাবি ঘটনা কী হচ্ছে জানো কিছু?”
আরওয়া ওর কাধে হাত রেখে বলল, “এটা বোধহয় বিয়ের বছর গো ননদী, সবার বিয়ে এ বছর ই হবে…”
।
জাওয়াদের আজকাল অফিস থেকে ফিরতে বেশ রাত হয়। সাইটের বিভিন্ন কাজ সরেজমিন দেখে এসে অফিশিয়াল কাজ চেক করতে করতে দিন পেরিয়ে কখন যে অনেক রাত হয়ে যায় হুশ থাকে না। আরওয়া ১১টা পর্যন্ত বহুকষ্টে জেগে থাকলেও এরপর আর পারেনা। জাওয়াদ পা টিপে টিপে শব্দ না করে রুমে ঢুকে, চেইঞ্জ করে ফ্রেশ হয়ে আসে এমনভাবে যেন আরওয়ার ঘুম না ভাঙ্গে। কিন্তু ঘুমের কুমির আরওয়া তার অস্তিত্ব টের পেতেই উঠে যায়। চোখ কচলে ওর দিকে তাকিয়ে বলে, “রোজ এতো লেট হয় আপনার? এভাবে আর কতদিন চলবে হু?”
জাওয়াদ বিছানার একপাশে বসে বলে,” আর কয়টা দিন, তারপর রিল্যাক্স হয়ে যাবো।”
“আপনি বসুন আমি খাবার গরম করছি।”
“তুমি ঘুমাও, রাহেলা আন্টি আছে তো, উনি দিবেন।”
আরওয়া চুল ঝেড়ে খোপা করে বলে, “আমি থাকতে আমার বরকে অন্য কেউ বেড়ে দিতে হবে না। যখন থাকবো না তখন অন্য হিসাব।”
জাওয়াদের বুকটা ধ্বক করে উঠে ওর কথা শুনে। ও তাকে হেচকা টানে বুকে এনে বলে, ‘যখন থাকবে না মানে? কোথায় যাবে তুমি?”
আরওয়া ওর দিকে তাকিয়ে বলল,”কোথাও যাচ্ছি না, কথার কথা বললাম আর কী। ”
“কথার কথা এতো নেতিবাচক হয় কেন আরওয়া? তুমি যেখানেই যাও না কেন, সাথে আমিও যাবো।”
আরওয়া ওর গলা জড়িয়ে বলল,”কোথাও বুঝি একা ছাড়বেন না?”
“নাহ একদমই না।”
“এ কেমন অধ্যাদেশ জারি করলেন হুম? ব্যক্তিস্বাধীনতা ক্ষুন্ন করা কি উচিত?”
জাওয়াদ ওর কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলল,”আমাকে তুমি নিষ্ঠুর, বর্বর অত্যাচারী যাই বলোনা কেন, আমার বৌকে ছাড়া আমি এক দন্ডও একা থাকবোনা।”
আরওয়া ওকে জড়িয়ে ধরে বলল,”ওয়েএএ সো সুইট অফ ইউ!”
জাওয়াদ ওকে বুকের মাঝে নিয়ে চাপা নিঃশ্বাস ফেলল, ওর বুকের ভেতর যে ভয় ঢুকেছে তার পরিত্রাণ করা কি সম্ভব? আরওয়াকে ছাড়া জীবন সে কল্পনাও করতে চায় না। জাওয়াদ এই অস্থিরতা দূর করতে কয়েকদিন ধরে গরীব দুঃখীদের দান সদকা বাড়িয়ে দিয়েছে। দানসদকা অযাচিত বিপদ এড়ানোর উত্তম পন্থা। আল্লাহ ওর আরওয়াকে সহীহ সালামত রাখুক, বিপদ আপদ থেকে হেফাজত করুক এটাই তো তার এখন চাওয়া! একজন ঠিকই বলেছে, “ভালোবাসা মানুষের সবচেয়ে বড় দূর্বলতা!!”
চলবে…
#কাঁটাকম্পাস_পর্ব৪৯
#আরশিয়া_জান্নাত
আরওয়া খুব মন দিয়ে হাতে মেহেদী আঁকছে। করিমুন্নেসা নাতনীর দিকে স্নেহার্দ্র দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন। আরওয়া বলল, “দাদীজান আমার আজকাল নিজেকে ভীষণ সুখী মনে হয়। তুমি ঠিকই বলেছিলে যে মেয়ের স্বামী তাকে ভালোবাসে সে এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মেয়ে।”
“নিজের সুখ লই বেশি মাতামাতি করিচ্চা। সাপের মুখ লাল মাইনষের মুখ কাল। আল্লাহর কাছে সবসময় দোয়া কইরবি যেন হিংসুক আর শয়তানের বদনজর থেকে তোগোরে হেফাজত করে।”
“আচ্ছা।”
আরওয়ার মা শিরিন এসে বললেন, “দুপুরে কী খাবি? মাছ তরকারী আছে, আর কিছু করবো?”
“নাহ আর কিছু করা লাগবেনা।”
“আম্মা দেখেছেন আয়েশা কত বদলে গেছে!”
করিমুন্নেসা বললেন,” তা তো দেখতেছি। আগে মাছের কথা শুনলে নাক ছিটকাইতো। এখন দেখি চুপচাপ আছে।”
আরওয়া বললো,”উনার মাছের আইটেম অনেক পছন্দ। তাই এখন আমারও মাছ ভালো লাগে। এতো চমকানোর কী আছে?”
শিরিন বললেন,”আচ্ছা জামাই পাগল তো তুই!”
আরওয়া মুখ চওড়া করে হেসে বললো,”দাদীর উপর গেছি তো তাই!”
করিমুন্নেসা নিজের লাঠি দিয়ে ওকে খোঁচা দিয়ে বলল,”এরে তুই বুঝি আর উফর গেছত?”
“অবশ্যই। তুমি যে দাদাজানের জন্য কত পাগল ছিলা জানিনা ভাবছো? আমাকে ছোট দাদী সব বলেছে।”
“হেতির আর কাম কী, আজাইরা কিচ্ছাকাহিনী বানাই কয়।”
“হইছে থাক আর লজ্জা পাইতে হবেনা। জামাইরে ভালোবাসা খারাপ না। এটাই তো স্বাভাবিক। প্রাউড ফিল করবা বুঝছো। আম্মু তুমিও আব্বুকে অনেক ভালোবাসবা, বেশি বেশি প্রকাশ করবা।”
শিরিন মেয়ের কান মলে বললেন, “তোর যত হাবিজাবি কথা। পরীক্ষার চিন্তা নাই? কয়দিন বাদে না ইয়ার ফাইনাল?”
“পড়াশোনা আরওয়ার বা’হাতের খেল। ঐটা কোনো ব্যাপারই না। আচ্ছা আম্মু শুনো বাসায় চ্যাপা শুটকি আছে? ভর্তা খেতে ইচ্ছে করতেছে।”
“নাই, আচ্ছা আমি ব্যবস্থা করতেছি।”
রোকেয়া পাকোড়া আর চা নিয়ে লনে বসলেন। জহির সাহেব গাছে পানি দিতে দিতে বললো,”কী ব্যাপার মহারাণীর মনে হচ্ছে আজ মন খুব ভালো?”
রোকেয়া চায়ে চুমুক দিয়ে বললো, “মেয়ে দুটোর নাল করতে পেরে শান্তি অনুভব হচ্ছে। আপাতত কয়েক বছর আর কারো বিয়ের চিন্তা নেই।”
“হাহাহা তাই বলো!”
“রিজভীকে তো বলতে গেলে ছোট থেকেই চিনি, ওর পরিবারের সবার সাথে আমাদের সখ্যতা দুইদিনের না। এমন পরিচিত ঘরে মেয়ে দিয়েও শান্তি। কিন্তু…”
“কিন্তু কী?”
“আমার একটা মাত্র মেয়ে। একা বিদেশে পড়ে থাকবে? এখানে থাকলে তো চিন্তা ছিল না। কিন্তু ওখানে….”
“সবাই চায় ওসব উন্নত দেশে সেটেল হতে। এতে খুশি না হয়ে বেজার হচ্ছ কেন?”
“সবাই যদি দেশটাকে ফেলে চলে যায় এ দেশটার কী হবে? মানছি এখানে দূর্নীতির অভাব নেই, তবুও জন্মভূমি তো। মায়া ছাড়া কী সহজ?”
জহির সাহেব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন,” তিক্ত হলেও সত্যি এদেশে পড়ে থেকে লাভ নাই। যাই হোক দেশের কথা তুলে মুড নষ্ট করতে চাইছি না। দেখি কেমন হলো…”
রোকেয়া তার জন্য কাপে চা ঢেলে বলল,”এই শুনছো ভাবছিলাম কী পাপিয়ার বিয়ের অনুষ্ঠান ঢাকায় না করে মুন্সীগঞ্জ করলে কেমন হয়? ওর জন্ম যেখানে সেখানেই বিয়ের অনুষ্ঠান হলো!”
“আইডিয়া খারাপ না, আব্বাকে বলে দেখতে হবে।”
।
পাপিয়া আর রিজভী বিয়ের শপিং শেষে রেস্টুরেন্টে বসে আছে। রিজভী খাবার অর্ডার করে বললো,”তুই এতো কিউট ক্যান বল তো? আমি ভেবেছিলাম বিয়ের শপিং করতে আসলে সারাদিন চলে যাবে প্লাস পকেট পুরা ফাঁকা হবে। কিন্তু তুই আমারে ভুল প্রমাণ করলি। এতো শর্টকাটে কোনো মেয়ে শপিং করতে পারে!”
“পছন্দ হয়ে গেছে কিনে ফেলছি, এতো ঘোরাঘুরি করে সময় নষ্ট করার দরকার কী?”
রিজভী হেসে বললো, “তুই একা আসলি কেন, ভাবী বা আপুদের আনলি না?”
“এমনিই আনিনি। কেন আমি একা আসায় তোর ভালো লাগছে না?”
“সেটা বলিনাই, বিয়ের শপিং তো সবাই দলবেধে করে, তাই বললাম আর কি!”
“হিয়া বিয়েতে আসতে পারবেনা বললো, দেখেছিস কেমন হারামি? সেই যে বিয়েতে দেখেছি ওটাই লাস্ট। আর দেখা নেই। বিয়ের পর মানুষ এতো পর হয়ে যায়…”
“জানি তো, তাই তোকেই বৌ করে নিচ্ছি। যাতে তুই পর না হস!”
পাপিয়া ভেংচি কেটে বলল,”বড় উপকার করেছেন!”
হঠাৎ চেনা গলা শুনে রিজভী পেছনে ফিরে তাকায়। সামিয়াকে দেখে রিজভী অবাক না হয়ে পারে না। সামিয়া ঢাকায় ব্যাক করেছিল!
রিজভীর চেহারা মুহূর্তেই বদলে যায়। সামিয়ার সাথে অনাকাঙ্খিত সাক্ষাৎ সে চায় না। সে চুপচাপ পাপিয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে। পাপিয়া ব্যাপারটা বুঝতে পেরে ওর হাতের উপর হাত রাখে। নরম গলায় বলে,”তুই চাইলে ওর সঙ্গে কথা বলতে পারিস। আমি কিছু মনে করবোনা।”
রিজভী চোখ বন্ধ করে শ্বাস নিয়ে বলে “আমি ঠিক আছি, ডোন্ট ওয়ারি!”
সামিয়া হাসতে হাসতে তার বরের হাত ধরে বেরিয়ে যায়, রিজভীর ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসি ফুটে উঠে। হয়তো পুরনো কোনো সুন্দর স্মৃতিচারণ করে অথবা নিজের বোকমীতে, পাপিয়া তাকে প্রশ্ন করে বিব্রত করেনা। ভাঙা মনের পুরুষকে যে ভালোবেসেছে, তার এসব তোয়াক্কা করলে খাটে?
ছাদে কাপড় মেলে দেওয়ার সময় ইশরাক এসে কুহুকে পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে। কুহু হাত সরিয়ে বলে, “ইশ ছাড়ো তো, কখন কে চলে আসে। তুমিও না!”
ইশরাক ওর কাধে চিবুক রেখে বলে, “ধরলে নিজের বৌ কে ধরেছি, কার কী?”
“তাই না?”
“কোনো সন্দেহ আছে?”
“কুহু বাকি কাপড় মেলে বললো, “সন্দেহ থাকবে কেন? ছুটির দিনে তোমার ভালোবাসা বাড়ে এ তো আজ নতুন না! আমি আগেই বলে দিচ্ছি আজ আমি আর রান্নাঘরে যাচ্ছি না। তোমার কিছু খেতে ইচ্ছে হলে ফুড পান্ডায় অর্ডার করবে।”
“ছি কুহু আমায় তুমি এমন ভাবতে পারলে? আমি বুঝি শুধু তোমাকে রান্না করানোর জন্য আদর করি? এমনি করিনা?”
“এমনি করো না কখন বলেছি?”
“বললেই তো! আচ্ছা যাও এখন থেকে আর কোনো কিছু রেঁধে দিতে বলবোনা। যা খেতে মন চাইবে বাইরে থেকে আনিয়ে খাবো।”
কুহু হাই তুলে বললো,”হ্যাঁ বাইরে থেকে আনবে আর পরে মা বলবে ছেলেটা ছুটির দিনে একটু বাসায় থাকে তাও ঘরের বৌ কিছু বানিয়ে দিতে পারেনা।”
“তোমাদের বৌ শাশুড়ির রেষারেষিতে আমি পিষে মরি। যাও আগামী সপ্তাহ থেকে আর বাসাতেই থাকবো না।”
“বাবারে ভল্লা দেখি রাগ ও করতে পারে!”
“ভল্লা ডাকবে না। আমি ভল্লা নই!”
“তুমিই তো নিজের নাম ভল্লা দিয়েছিলে। এখন পছন্দ হচ্ছে না কেন?”
“কোন দুঃখে যে সেটা বলতে গেছিলাম! তুমি আমাকে সবার সামনে এই নামে ডেকে এমন হাল করেছ। অফিসে কয়েকদিন সবাই আমাকে ভল্লা ভাই ডাকছে!”
“হাহাহাহাহা,, বেশ করেছে। ডাকটা তো দারুণ ভল্লাভাই! পাপিয়া আর জাহিদকেও বলবো তোমাকে দুলাভাই না ডেকে যেন ভল্লাভাই ডাকে।”
“ঐ না প্লিজ!”
কুহু চারদিক ঝংকরিত করে হাসতে লাগলো। ইশরাক মাথা চুলকে বললো, “হাসলে তোমায় লাগে আরো ভালো!”
।
আরওয়া গোসল সেরে এসে দেখে জাওয়াদ বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। গতকাল সাম্য আর রুমাইসার হলুদ ফাংশন থেকে ফিরতে প্রায় ভোর হয়ে যায়। সারারাত নির্ঘুম পার করায় জনাব এখন নিচিন্তে ঘুমাচ্ছেন। আরওয়ার মাথায় দুষ্ট বুদ্ধি এলো, সে নিজের ভেজা চুল দিয়ে জাওয়াদের নাকে মুখে সুরসুরি দিতে লাগলো। জাওয়াদ মুখ থেকে চুল সরিয়ে বললো, “আহ আরওয়া লেট মি স্লিপ।”
“অনেক বেলা হয়েছে, উঠুন তো। সারাদিন ঘুমিয়ে পার করবেন নাকি?”
“আজ কোনো কাজ নেই তো। ঘুমালেও সমস্যা কী?”
“অবশ্যই সমস্যা আছে, উঠে দুপুরের খাবার খেয়ে নিন। তারপর আবার ঘুমান, কিছু বলবোনা।”
জাওয়াদ ওকে টেনে পাশে শুইয়ে দিলো। ওর গলায় মুখ গুজে বলল,” ঐসব বাদ দিয়ে তুমিও ঘুমাও।”
আরওয়া ওর চুলে হাত বুলিয়ে বললো, “আচ্ছা বেশ আপনি ঘুমান। আমি বরং যাই।”
জাওয়াদ ওকে শক্ত করে ধরে রাখলো। আরওয়া নড়তে না পেরে বললো,”কী ব্যাপার ছাড়ছেন না কেন?”
জাওয়াদ মাথা উঁচু করে আরওয়ার দিকে তাকালো, গাঢ় গলায় বললো,”এখন তো ছাড়া যাবে না। ঘুম সরে গেছে তোমার সোপের ঘ্রাণে!”
“তাহলে তো ভালোই, উঠে ফ্রেশ হয়ে নিন। একসঙ্গে লাঞ্চ করবো।”
“হাহ! বোকা মেয়ে। এখনো বরের মন বুঝলে না। ”
আরওয়া অবস্থা বেগতিক বুঝে মানে মানে সরে যেতে চাইলো, কিন্তু জাওয়াদ তার চেয়ে বরাবরই দুই কদম এগিয়ে। সে ঠিকই আদরের চাদরে মুড়িয়ে খুব সহজেই আরওয়াকে বশে করে নিলো। আরওয়াও তার প্রিয় পুরুষের গভীর স্পর্শে দ্রুত সায় দেয়। এই মানুষটার সংস্পর্শে থাকার চেয়ে সুখের আর কিছুই যে তার নেই!
চলবে..